দীর্ঘশ্বাস
ভালো নেই ভালো নেই ধূসর সন্ধ্যা বিষণ্ন বিকেল, চারিপাশ ভালো নেই কফির কাপ পথের ধুলো…..
যাবতীয় নৈশঃব্দ্য খেয়ে ফেলবো অনিঃসীম এক অজগরের ক্ষিদে আমার জিহ্বায় চাষ করে নিয়ে।
এ নৈশঃব্দ্য পুড়ে পুড়ে চাতকের তৃষ্ণার মতো খাঁটি হলে আরণ্যকের কবির মতো শুয়ে যাবো বনজ্যোৎস্নার ভয়াবহ আগুন সাঁকোয়।
আমার আলখাল্লা পড়িয়েছি ওকে,
ভিতরে ভিতরে এত অন্ধকার আমিই তো ভিড়িয়েছি বনৌষধির কৃপাধন্য পুষ্পবৃষ্টি নৈঋক সমলয়ে।
এখানে আমি যে গড়িয়েছি পাতা ঘেরা ঘর , এখানে যে বৃষ্টিসিক্ত তমসা নির্ঝর –বনোভূমি খুঁড়ে ফেলে প্রতিটি শিকড়ে পচাভাত , উগড়ে দেওয়া বমি, ঋতুস্রাব আরও যত মজুত খামার জমাট করেছি স্বীকৃত ঋণে।
একদিন এইসব উপন্যাসে জমে থাকা কবিতা ভ্রমর হঠাৎই পাখনা মেলে উড়ে যাবে গাছের ওপর , উড়ে যাবে ইতিহাসে । ভ্রমরের প্রত্যাখ্যাত প্রেমের আফসোসে বনদেবী নদীর গভীরে বানভাসি চন্দনের আধোলীন স্নানে ফিরিয়ে
দিতেই পারে নিবিড় গভীর যুবরাণী ব্যাবিলনে , জাম্বিয়া কিংবা আফ্রিকার স্মৃতিভ্রষ্ট বনানীর তুমুল সমীরে।
এতো অবিচ্ছেদ্য খনন কাহিনী এই অন্তর্লীন নৈশঃব্দ্যে নিবন্ধিত হয়ে আছে , তাই তো প্রতিদিন আমি অন্ধকারে মিশে থাকা শব্দহীন নির্জনতা , কামহীন নীরবতা , কায়াহীন নিঃসঙ্গতা আকন্ঠ পান করে যাই।
রেলের পাথরে মাথা ঠুকে অসহায় ভাবে পড়ে আছে সবুজ তেজপাতারা। শুয়ে শুয়ে শুকিয়ে উঠেছে, সুগন্ধী বুকে নিয়ে অনুচ্চারিত বিপন্নতায়। উত্তরের ব্যালকনিতে নতুবা কোনো প্রসিদ্ধ কিচেনে কেউ রসনার অবয়বে প্রতিবিম্ব আঁকে তার।
দারচিনি এলাচের মিশ্ৰণ বিনিময়ে বিলম্বিত দুপুরের নিঃসঙ্গতায়, সবুজ বাদামী যত গাছপাতারা চুপিসারে হাই তুলে নেয়।
আমি যা কখনো দেখিনি, সেই কালো কালো দাগ, সবুজ ও হলুদ সব পাতাদের অনুচ্ছাসি ভীড়ে প্রকট হয়, আরো আরো গাঢ় হয়ে পাতার গভীরে মাথা ঝুঁকিয়েছে সবুজ প্রত্যয়।
নর্তকী হওয়ার সব সম্ভাবনা ছেড়ে পক্ষাঘাত দুষ্ট নদী পাথরের সাথে তার কুশল প্রণয় সেরে ফেলে।
আমি তো মিশর দেখিনি,
কোনদিন, নীলনদের উৎসমুখও নেই কোনো রোমকূপে। পিরামিড আর মমিদের গায়ে লেগে থাকা আঁতরের গন্ধে কি এই সব তেজপাতারা নিজেদের সঁপে দিত শরীরের সবটুকু দিয়ে।
তাই কি শৈশব তার লুপ্তপ্রায় গন্ধ ছেড়ে অলীক প্রত্যয়ে …লোভী চোখে পিপাসা মেটায় আর ঘোলা জল গায়ে মেখে অন্তর্লীণ হয়।
ইচ্ছের এখন আর প্রিয় কোনো মাঠ নেই মুক্ত হওয়ার। পুড়ে ছাই হয়ে যেতে যেতে তবু ডানার রোদের গন্ধে পাখিটি আগুন হয়ে যায়।
ঢাক ঢোল পিটিয়ে চুপ থাকার ঘোষণাপত্রে ঢের ঘৃণা আমার বরাবরের স্বকীয় মেজাজ। যেমন খুব করে কথা বলা, শুনিয়ে নেওয়া বেপরোয়া স্বতস্ফূর্ত নিজের কথা একটানা বিরামহীন …ঠিক তেমনই স্বতঃস্ফূর্ত থেমে যাওয়া আকস্মিক।
এই যে তীব্র চলন যাপনচাকার, এই যে পাশাপাশি মানুষেরা দিনরাত রঙ তুলি কাগজ কলম, এই যে সরল এবং জটিল যন্ত্র মেলে রাখছে চৌরাস্তায় …হঠাৎ করেই সেখানে প্রবল শূন্যতা চেপে বসছে।
খুব দূরে কোথাও চলে যেতে হবে এক্ষুণি। খুব নিষ্প্রাণ, বরফঢাকা একটা জায়গা খুঁজে নিতে হবে দ্রুত। যেখানে ভালোবাসা, বন্ধুতা, রাষ্ট্রের মায়াবী প্রেম, উচ্ছাস, বিদ্রোহ, বিপ্লব, সন্ত্রাস নেই।
প্রচুর কঙ্কাল, পচাগলা শবদেহ, প্রচুর নিহত পাখি, শিশু বৃদ্ধা নারীদের ধর্ষিত মৃতদেহ পড়ে আছে বরফঢাকা হয়ে ,যন্ত্রণাহীন, রক্ত শুকিয়ে গেছে।প্রসন্ন মুখে হাসি লেগে আছে মৃত মাছে, পবিত্রতা মেখে রাখা লাশে।
ভীষণ স্তব্ধ সকরুণ সেই শান্তি পতাকাহীন গ্রহে এইবার স্থায়ী বাসা করে নেবো।
একটি কথাও কেউ বলবেনা সারাদিনে, সারারাত জ্বলবে না একটিও সবুজ আলো।
অসাড় মগজে নিস্তেজ ঘিলু চুপিসারে ছকে নেবে পালিয়ে যাওয়ার সব নিখুঁত প্লানিং।
টিং টিং করে নক্ষত্রেরা সমস্ত জীবিত গ্রহকে বিদায়ী সঙ্কেত জানিয়ে যাবে।
আমি একা একদমই একা শূন্যতাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকবো অনন্ত মৃত্যুকালে ডুব দিয়ে থেকে।
লণ্ঠনেরা একা রেখে চলে গেছে।
বলে গেছে চন্দনের বনে চাঁদেরা অন্ধ হয়ে বসে যায় রোজই ঘাতক জ্যোৎস্নায়।
সুগন্ধিরা মৃত্যুর চোখে শোকাহত হয়ে ঝুলে যায়।
ধানের খোসা ছাড়ালে যে আলো
ঠিকরোয় সেখানে আঁচল পেতে প্রাচীন নারীর বুকের ওপর গড়িয়েছে নদীটির ঋতুস্রাব।
করোটির ভিতরে পচে যাওয়া আগাছারা শ্মশানের জ্বলন্ত পূণ্যিঘাটে মাথা ঠুকে ঠুকে পিশাচের উন্মুক্ত জিহ্বায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস সাপের লিকলিকে দেহছাল গুছিয়ে রেখেছে।
বটগাছের শিকড়ের সাথে একটি পুরুষকে দেখেছি যুগান্তরের সন্ধিক্ষণে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে যেতে।
ওর চোখা গাল, ভাঙা চোয়াল, রুক্ষ শুষ্ক চোখের নীচে কাটা দাগে আরো একটা গাছের শিকড়।
পাতারাও নতুন এক চুল্লি পেতেছে ওই বুকে শীতলক্ষ্যা স্রোত বুঝে নিতে।
ছেলেটি যুবক হয়ে গেলে বৃষ্টিরা প্রেমপত্রের বদলে চাকরির আবেদন দিয়ে যায়, বৃদ্ধ হলে পেনশনের কাগজ।
বটগাছের মোটা গুঁড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে পুরুষেরা উড়িয়ে দিয়েছে নারীদের সব অভিযোগ।
অভিমান যদিও প্রতিশ্রুতির মিথ্যে বয়ানে …এসব শিকড় পূর্বপুরুষের স্নায়বিক বিকারগ্রস্ততায় বয়ে আসা চিরায়ত ভন্ড জলপান।
মূলাধার এত রস টেনে আনে পুরুষের শরীরের জীর্ণ খোলসে, যদিও সেখানে গঙ্গাফড়িং এক একা নেচে নেচে চুল্লির আঁচে সেঁকে নিচ্ছে প্রায়শ্চিত্তের জরুরি আঘ্রাণ।
ভালো নেই ভালো নেই ধূসর সন্ধ্যা বিষণ্ন বিকেল, চারিপাশ ভালো নেই কফির কাপ পথের ধুলো…..
প্রেমের কবিতা যা কিছু পাষাণ, মনে হয় আঁশ বটিতে কুচি-কুচি করে কাটি পালানো ঘাতক সময়…..
হয়তো একদিন অস্তিত্বে খুঁজে আত্মপরিচয় নিভৃতে অপেক্ষার প্রহরে এ মন ভালোবাসার রূপালী আলোয় রাঙা মুখ…..
তর্জমা স্নানে শুচি হবার পর বেকসুর সন্ধ্যাগুলো শুধুমাত্র নিজস্ব অন্ধকারের নিচে দোলনাচেয়ারে ছড়িয়ে বসা কিছুটা…..