তেরো‘শ ছিয়াশি

সৈয়দ মনির হেলাল
গল্প
Bengali
তেরো‘শ ছিয়াশি

মধ্যদুপুরের মাঠ-ঘাট ঢেকে দিয়ে প্রকান্ড এক ধুলিঝড় ওলটপালট ধোঁয়া উড়িয়ে যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ততই বিস্ময় ছড়িয়ে পড়তে থাকে বনগাঁওয়ের চারদিকে। এ দৃশ্যের জন্য যদিও বা বনগাঁও কিংবা মোহনডাঙ্গা পরগনার কেউই প্রস্তুত ছিল না, তথাপি দেখা গেলো ধুলিঝড়ের পেট চিরে বের হয়ে আসছে দুরন্ত এক বালকের দল। সাদা-মেটো রঙে এমনভাবে তারা মাখামাখি যে পুরনো চেহারায় কাউকে আর চেনার উপায়ই নেই । সারিবাঁধা ট্রাক-ট্রাক্টরগুলোর নাক-মুখ থেকে তখনো উত্তপ্ত ধোঁয়া বেরোচ্ছে সমানে, তারই খোলস ভেদ করে বেরিয়ে আসছে সাদা সাদা নতুন এক একজন মানুষ। নাক-মুখ ঝাড়তে ঝাড়তে কেউ ইতিউতি তাকাচ্ছে অথবা পায়চারি করছে, কেউ খোলা মাঠের চারদিকে খুঁজছে একলা কোন গাছ-বিরিক্ষির ছায়াতল; আর ছোকরা মতন যেজন- অমনি ধুলিমাখা হয়েই সে বালতি হাতে দৌড়াচ্ছে খালপারের দিকে, ঝাড়াঝাড়ির সময় নেই হয়তো তার। এইসমস্ত আনকোরা যা কিছু তার সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে দেখতে দেখতে ছেলে-ছোকরা আর জোয়ান মানুষের সমাগম ঘটতে থাকে, এবং যথাশীঘ্র তাদের উদ্যোগ আয়োজনের পর দেখা গেল সদ্যকাটা ধানের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাড়াগুলো পাইট করে তাদের বুকের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সারি সারি চা-বিস্কুটের দোকান।

দুই

দলবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলো যেন এক কঠিন বিশ্বাসের প্রতিমূর্তি, দূর থেকে মনে হবে যেন হাত ধরাধরি করে সারা বনগাঁওটি বেঁধে রেখেছে আলগোছে। উঁচু পাড়ের স্থানে স্থানে সুন্দিবেত আর মুর্তার বন ঘণিভূত হয়ে আছে উদবিড়াল, বেজি, তক্ককসমুহের সামাজিকতায়। একটা প্রকান্ড শিমুলবৃক্ষ ততোধিক দীর্ঘ বাহুমন্ডলী ছড়িয়ে দিয়ে বেশ জাত্যাভিমান সহকারে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। এমন কিছু বৈপরীত্যকে সামলে নিয়ে রাতের প্রথম প্রহর থেকেই শিয়ালগুলো দলবেঁধে হেঁটে বেড়ায় জাবর কাটতে কাটতে। আর সেই উঁচু পাড়ের ঢালু বরাবর চোখ ফেললে দেখা যায় শালুক আচ্ছাদিত টলটলে নরোম জলময় বিশাল পুকুরটি। পশ্চিম দিকে বনগাঁওর এবড়ো-থেবড়ো ঘরবাড়ি আর পূর্বদিকে বিস্তৃত মাঠ, ধানখেত, অথবা নানান শষ্যদানার এক সুখ সুখ চিত্রপট। কিন্তু এই তালগাছ, মস্ত পুকুর, নাকি বনগাঁও গ্রামটি এই মোহনডাঙ্গা পরগনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে, কিংবা কীভাবে হলো এই গ্রামটির পত্তন, সে কতদিন আগে- সেসব জানবার কোন কায়দা পাওয়া গেল না সহসাই। তবে ভীষণ দুঃখের কথা এই যে, তালগাছগুলোর শীর্ষদেশে বাবুই পাখির অসংখ্য বাসা বাতাসে দুলতে থাকলেও আশেপাশে বাবুই পাখি দেখা গেল না একটাও। বরং সদ্যকাটা, কস চুইয়ে পড়া শেওড়া গাছের গুড়ির পাশে বাবুই পাখির একটা বিধ্বস্ত বাসা পড়ে আছে এবং যার ভিতর-বাহির ঠেসে আছে লাল লাল পিঁপড়ের দল, প্লাটুন প্লাটুন সেনাদলের মতো টহল দিতে দেখা গেল বাইরের দিকেও। তারই অনতিদূরে শীর্ন হতে যাওয়া  একটা সুনন্দা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে হেলে-দুলে বয়ে যাচ্ছে, যার হাড়জিরজিরে বুকজুড়ে শর্ষের হলুদ আভা ঝিকমিক করছে আনকোরা রোদ-হাওয়ায়।

তিন

পরস্পর বিচ্ছিন্ন, প্রবল অসামঞ্জস্যতায় পূর্ণ নানান কায়দা-কানুনের ভেতর থেকে সে একদিন আমার সামনে হাজির হলো তার আটপৌরে চেহারা নিয়ে। অদ্ভুত তার কাজ আর কথা। সাদা কালো  কিংবা বাদামি বড় বড় পাথরে  বোঝাই করা ট্রাকগুলো ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর ধুলির ঘূর্ণি তুলে যখন গড়িয়ে যেত একটার পর একটা, তখন দেখা যেত তাদের পেছন পেছন, মেঠো জমিনের পিঠে ছিলে-যাওয়া ক্ষতসমূহকে পাশে রেখে দৌড়াচ্ছে সে। তারপর সারা শরীরে ধুলির আবরণ নিয়ে খুসমনে লেগে যেত পাথর গুনার কাজে। আর-সকল থেকে আলাদা করে রাখা বেঢপ বড় বড় দুটি চোখ তখন লেপ্টে থাকত প্রতিটি পাথরের গায়ে। এক- দুই -দশ-বারো- তেত্রিশ- চৌত্রিশ- বিরামহীন সে গুণে যেত লেবারদের সারিসারি করে বিছানো পাথরগুলো। এ এক আজব খেলা তার। ট্রাক-ট্রাক্টরগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, তার নাট-বল্টু নিয়ে নানান জিজ্ঞাসার পর প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হতো অবধারিত একটা প্রশ্নেরÑ আর কতদূর যাবে এই পাথরের সারি ? তার থেকে কিঞ্চিৎ বয়োজ্যেষ্ঠ হেলপার ছেলেটি ছিল আরেক বিস্ময় তার কাছে। প্রথম দিনই তার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল হেলপার ছেলেটি। ট্রাকের ঝুলে পড়া নাকের ভেতর বাঁকানো এক লৌহশলা ঢুকিয়ে দিয়ে, বাহুর ভেতর সমস্ত শক্তি জমাট করে কী মুন্সিয়ানার সাথে ঘুরাচ্ছে আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে  কালো ধোঁয়া ছাড়ছে ট্রাকটি, সেদিন থেকেই সে  ওস্তাদ ডাকতে শুরু করে আমার হেলপার ছেলেটিকে। অবশ্য প্রকাশ্য সম্বোধনের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পাক্কা তিন দিন; পেছন পেছন ঘুরঘুর করা, শুনিয়ে শুনিয়ে শিষ বাজানো, তারপর আরো সাহসী হয়ে ট্রাকের চাক্কাটি ওপরে ঠেলে তুলে দিল যেদিন, সেদিনই- ওস্তাদ, নেও মুড়ি খাও বলে শীষ্যত্বের বায়েত গ্রহণ করেছিল বালকটি।  বলাই বাহুল্য যে, এই বনগাঁও মাঠে কয়টা ট্রাক কিংবা কয়টা ট্রাক্টর পাথর নিয়ে আসা-যাওয়া করে, সব ছিল তার নখদর্পনে। কেবল তা-ই নয়, কোনটির কী রং, কার কয়টা চাকা, সামনে পেছনে কি লেখা আছে- সবই ছিল বালকটির মুখস্থ। গাড়িগুলো যখন আসতে থাকত জমিনের ওপর দিয়ে তখন অনেক দূর থেকেই সে বলে দিতে পারত তাদের নম্বর প্ল্যাটের সংখ্যাগুলো। আর একটা প্রশ্ন সে থেকে থেকেই নানাজনকে করতে শোনা যেত- এই পাথরের সড়কটিতে কি আবার ধান-দূর্বা গজাবে সবুজ পাতাসহ ?

অকপটে আমি আমার অক্ষমতা কবুল করছি, সেই বালকটির নাম এখন আমি আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না। গ্রামের চিরকালীন মেটো রঙের দশ কি বারো বছরের বালকটি গায়ে গতরে ছিল আর দশজনের মতই। শুধু তফাৎ ছিল এই : অন্য ছেলে-ছোকরারা যেখানে ধীরগতিতে চলমান ট্রাক কিংবা ট্রাক্টরগুলোর পেছনে দৌড়ে গিয়ে লটকে থাকত, কিংবা ট্রাকগুলোর ড্রাইভারদের চা-বনরুটির ফরমায়েশ তামিল করে দিনে কয়েকটা বনরুটির মালিক বনে যেত কিংবা বিড়ি-সিগারেটে আগুন ধরানোর উসিলায় দু’একটা টান মেরে ধোঁয়া বের করত দুই নাকের ছিদ্র দিয়ে,  সেখানে বালকটি পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে মাপ-জোক করত আগুয়ান সড়কটি আজ কোনদিকে কতটুকু এগোল, সড়কটি এখন দেখতে কেমন লাগছে- গতকাল এখানে কী ছিল,  সে হিসেব মেলাতে মেলাতে রাত নেমে আসত তার। কয়টা ঢোলকলমি গাছ, কয়টা চিনিবট কিংবা কয়টা ভাটবনকে আজ সড়কের নিচে চলে যেতে হলো, তার কথামত সে হিসাবটি মাঝে মাঝে আমাকেও রাখতে হতো। সেই তার সাথে আস্তে আস্তে একটা ভাব জমে গেল,  এমন হলো যে : আমি যখন কথা বলতাম তখন সেই আমার স্বরটা যেনো বদলে যেতে থাকল আমার অগোচরেই। আমি কিংবা সে’র বদলে অনেককিছুতেই আমরা হয়ে গেলাম। কখনো কখনো আমি যখন কথা বলতাম, তখন ভীষণ ধন্দে পড়ে যেতাম যে, আমি আমার কথা বলছি, নাকি তার কথা বলছি- বুঝে উঠে পারতাম না আদতেই। সে যখন বলত, গত-ভাদ্র-আশ্বিনে যে বীজতলার জমিনে দাড়িয়াবান্দা খেলা নিয়ে তাদের দুইদলে ভীষণ হাতাহাতি-কোস্তাকুস্তি লেগেছিল, সে জমিন খুঁড়ে আজ সারি সারি পাথর বিছানো হলো, তখন আমি এক দীর্ঘ মটরশোভাযাত্রার দর্শকের মতো হা করে দাঁড়িয়ে থেকে বলতাম- চলো তাহলে, চোখে কাপড়ের পট্টি বেঁধে আমরা কানামাছিই খেলি বরং ! এবং বলতে দ্বিধা নেই, এই আমি কিংবা আমরা প্রায়ই এই নির্মীয়মান সড়কটি নিয়ে এতোই আবেগ, উত্তেজনা আর নানারকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তাম যে, আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেখতাম সড়কটি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে  দূর- বহুদূর ।

তবে অচিরেই খবর পাওয়া গেল সড়কটি এক সুনন্দা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছেছে খুব সবলভাবেই।

চার

অবশেষে আমরা এক বিকেলে শীর্ণকায়া নদীটির পাড়ে গিয়ে পৌঁছলাম, ধরে নিলাম এখানেই  সড়কটির হয়তো যবনিকাপাত ঘটতে চলেছে। হাতে হাত রেখে আমরা  হাঁটতে লাগলাম নদীর তীর ধরে, যেখানে  মাসকলাই, শর্ষে কিংবা টমেটো-খেত বাতাসে দোল খাচ্ছিল । আমরা হাঁটলাম আর কথা বললাম, একটা প্রায় শীর্ণকায় নদী আটকে দিল এই পাথর-বোঝাই ট্রাকগুলোকে, তার সাথে সড়কটিও আটকে গেল, ব্যাপারটিতে আমরা পুলক অনুভব করব, না কি ব্যথিত হব- বুঝে উঠতে পারছিলাম না সত্যি সত্যি। আমরা অদূরে দাঁড়ানো ট্রাকগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম, মনে হলো যেন নদীর দিকে চেয়ে আছে পিটপিট চোখে। তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ নানান ভাবনা, দুর্ভাবনা অথবা সম্ভাবনার কথা হলো। আমরা দেখলাম, নদীর ঘোলা জলে ঝোপ করে একদল গাই-গরু নেমে গেলে কয়েকটা  ছেলেও একই সাথে ঝাপ দিয়ে গরুগুলোর লেজ ধরে ভেসে থাকল। পরনের লুঙ্গি আর গেঞ্জিটা প্যাঁচ দিয়ে মাথায় বাঁধা তাদের। আর গরুগুলো তাদের নাক জলের উপর ভাসিয়ে রেখে হুঁস হুঁস করে সাঁতরে অপরপারের দিকে ভেসে চলল। আমরা চেয়ে থাকলাম, দেখলাম কী নিশ্চিন্তে গরুর দলটি অপারে গিয়ে আবার লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে- ঘাস-বিচালি খেতে খেতে বাড়িপানে যেতে থাকল। দূর উজান থেকে পর পর কয়েকটা জেলে নৌকা ক্ষীণ ¯্রােতের টানে ভাটির দিকে আসতে দেখলাম, যেগুলোর দুই গলুইয়ে বসে পা দিয়ে বৈঠা ধরে আছে দুজন উদোম গায়ের মানুষ, আর হাত দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে জালের পর জাল। আমরা আরো কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসে থাকলাম, একটা নাইওরি নাও দেখব- এই আশায় বোধকরি।

কিন্তু অচিরেই আমাদেরকে আবার বনগাঁওয়ের দিকে ফিরতে হবে। আমরা পড়ন্ত লাল আভা চোখে-মুখে মেখে রঙিন সূর্যের দিকে হাঁটতে থাকলাম।

অদূরে দেখা গেল সারিসারি ট্রাকগুলো ভারমুক্ত হয়ে পুনর্বার ছুটে চলার অপেক্ষায় ঝিমুচ্ছে।

পাঁচ

কিন্তু কেমন করে যেন আমি তাকে হারিয়ে ফেললাম হঠাৎ। বিরাট বিরাট পাথর আনলোড করা হচ্ছিল যেখানে যেখানে, লটকে থাকা সাদা ফুলের লাউয়ের মাচান, লালশাকের সমতল জমিন, সেখানকার স্তুপাকার পাথরের আগে পিছে- কোথাও দেখতে পেলাম না তাকে। এমনকি ইরি ধানের নাড়া দিয়ে বেড়া দেওয়া লেবারদের টিনের চালাগুলোতে, যেখানে সেই ওস্তাদ ছোকরাটি প্রায়সময়ই ষোলগুটি নিয়ে ধ্যানরত থাকে, সেখানেও কোন খোঁজ না পেয়ে আমি ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত হলাম। কিন্তু আমাকে ট্রাকের পিঠে সওয়ার হতে হবে এখনই। মনের ভেতর একটা খচখচে পেছনটান নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে হলো অবশেষে, এবং  সম্মিলিত ক্যাঁচ ক্যাঁচ ধ্বনি তুলে ট্রাকগুলো আর্মি কনভয়ের মতো এগিয়ে যেতে থাকল। আমি দেখলাম আমার সম্মুখে লাল সূর্যটা তার কমলা-হলুদ আভা ছড়িয়ে দিয়ে খুব দ্রুত গাছ-গাছালির শিকড়ের দিকে নামতে লেগেছে। দ্রুত গতিতে ফুরিয়ে যাওয়া এমনি এক সময়ে হুর-রে ধ্বনিমালার তরঙ্গ সচকিত করে তুলল আমাকে। দেখলাম- মাঠের এবড়ো-থেবড়ো জমিনে সড়কের চিহ্ন আঁকা রেখা বরাবর এগিয়ে যাওয়া ট্রাকগুলোকে পেছন ফেলে আগুয়ান একটি বালকের দল, এক অপরূপ ভঙ্গিতে দুই পায়ের মাঝখানে টেনে ধরেছে একটি নারিকেলের লম্বামান পাতাকে, আর সেগুলোকে ঘোড়ার আদলে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হ্রেষা-রবে। খুব সহজেই ট্রাকবাহী আমাদেরকে পেছনে ফেলে দিল তারা। ছুটেচলা দলের পেছনের ছেলেটিকে দেখে আশ্বস্ত হলাম আমি, সেই বালকটি, যাকে আমি কিছুক্ষণ আগে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, দেখলাম- খুব মুন্সিয়ানার সাথে ঘোড়া দৌড়াচ্ছে সেই বালকটিও। স্টিয়ারিংয়ে হাত ধরা আমার ওপর একবার নজর ফেলে হুর-রে বলে এগিয়ে গেল সে। আমার খুব মজা লাগল এ দৃশ্যটি দেখে। কিন্তু অল্প সময়ের ভেতরেই ট্রাকগুলোর গতি বেড়ে গেল বলে মনে হলো,  ট্রাকের কনভয়টি একটু শক্ত জমিন পেল অথবা ভালো সড়কে পড়ল বলে ট্রাকগুলোর গতি বেড়ে গেল অনেক। ধুলিঝড় উড়ল চারিদিকে। সূর্যটা মনে হলো এক কালো আবরণে ঢেকে যাচ্ছে। ঢেকে গেল সেই বালকটিও, আমি ঠিক ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না- তারা আগে আগে চলে গেল, নাকি পেছনে পড়ে গেল আমাদের।

ছয়

অনেকদিন থেকেই কথাটা বারবার শুনিয়ে যাচ্ছে সে : শহরে যাবে, এবং সেই শহর ছাড়িয়ে আরো দূরে, যেখান থেকে এই পাথরগুলো ট্রাকে তোলা হয়, সে যাবেই যাবে একদিন সেখানে। কিন্তু আমি ভরসা পাই না কোন। শতশত সড়ক-গলি-পথ- উঁচু নিচু গৃহ কিংবা প্রাসাদোপম বাড়ি, হাজারো রঙের মানুষ- অযুত মুখ ও মুখের বাকধ্বনি, লাখো বিপননসম্ভারের মাঝবরাবর বালকটিকে আমি স্থাপন করবার চেষ্টা করতে থাকি বারবার। কিন্তু তল খুঁজে পাই না এবং ফলতঃ বালকটির সাথে আমি রূঢ় আচরণ করি একদিন। সে কুঞ্চিত হয়, মুখ লুকায়। উড়তে থাকা ধুলোকণার গায়ে জলসিঞ্চিত হলে-  থকথকে কাদায় পিচ্ছিল সড়কপথকে হাডুডু খেলার মাঠ বানিয়ে, পা ডুবিয়ে দ্বিধাহীন সে হেঁটে যায় স্তুপ করে রাখা পাথরের পাদদেশে। আমি তাকে পড়তে চেষ্টা করি এবং আমার স্থির বিশ্বাস জন্মে : দূরে দূরে থাকলেও  তার-আমার মাঝে খুব দুরত্ব তৈরী হয় নি এখনো। কারণ, প্রতিদিনই আমি তার ছায়া দেখতে পাই, তার উদোম শরীরের গন্ধ আমার মগজে গেঁথে থাকে। তেমনি এক সুভাসিত সকালবেলা এক ভীষণ ঘোরপ্যাচে পড়ে আমার বুদ্ধিনাশ হওয়ার দশা, রাতেই সড়ক নির্মাণকারী কন্ট্রাকটর বলে দিয়েছে- দিনের প্রথম ট্রিপ থেকেই যেন সবগুলো গাড়ি আনলোড করি নির্মিয়মান পাকা গেইটওয়ালা বাড়ির উত্তরদিকের তালগাছ বরাবর। কিন্তু আমি পাথরবোঝাই ট্রাক নিয়ে বসে আছি সেই সাতসকাল থেকে; কোথায় পাকা গেইটওয়ালা বাড়ি কিংবা কোনদিকে উত্তর কিছুই আন্দাজ করতে পারছিলাম না। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে আমি যখন নানানজনের শরণ নিয়েও কোন কুল খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন গামছা দিয়ে বাঁধা পুটলি মাথায় জমির আল দিয়ে আগুয়ান বালকটিকে দেখে তার কাঁধে হাত রাখলাম, এবং তৎক্ষণাৎ সে আমাকে নিয়ে চলল সেই পাকা বাড়ির কাছে; তারপর ইটগাঁথুনির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশের মাচানে সে এক লাফে উঠে উত্তর দিকে চেয়ে বলল- ঐ-ই যে তালগাছ দেখা যায়। আমি খুব খুসি হলাম এবং বেশ ক’টা মুড়ির নাড়– তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে কোন উত্তর না দিয়ে নাড়–গুলো তার কোচড়ে তুলে নিল এবং মাচানের ওপর দাঁড়িয়ে এমনভাবে দুলাতে লাগল যেন এখনই উপড়ে ফেলবে সেটা। অতঃপর তরতর করে নেমে ফিরে যাচ্ছিল যখন, তাকে আবারো কাছে ডাকলাম;  সে কোন ভণিতা না করে সোজা বলল : ওস্তাদ বলেছে এ সড়কটি নাকি সোজা শহরে চলে গেছে, এবং সেখানে যাওয়া কোন ব্যাপারই না তার জন্য। আমি আরো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেইসব বাদ রেখে আমি কালই তাকে নিয়ে শহরে যাবো- তিন সত্যি করলাম। সে খুব খুসি হলো এবং যথারীতি সকালেই দেখা গেল সে একটা নীল সার্ট আর ডোরাকাটা হাফপেন্ট পরে বনগাঁওয়ের সারি সারি চা-বিস্কুটের দোকানে দোকানে চক্কর দিচ্ছে আর ফূর্তিতে শিষ বাজাচ্ছে। তারপর মাথার উপরে রোদের তেজ চলে আসার আগেই যখন ট্রাকগুলো একে একে এসে হাজির হতে থাকল, তখন সে খুজতে থাকল হলুদমাথার গাড়িটিকে হয়তো। সে হাঁটে আর দেখে। অবশেষে সে উঠে পড়ল সেই ট্রাকটার খোলা পিঠে। না তাকে নামতে হলো, এবং কাঠের বাঁকানো দরজা খুলে আমার পাশেই বসল সে। ঘোঁৎ করে একটা ঝাকুনি দিয়ে  ট্রাকটি তার স্বভাসিদ্ধ গতিতে ছুটে চলল চেনা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে। অচেনা পথে সে দেখল সকলেই শুধু দৌড়াচ্ছে। গাছ দৌড়াচ্ছে, মানুষ দৌড়াচ্ছে, হাঁসের পাল, গরু, ছাগল এমনকি খড়ের গাদাটিও এক নিমিষে নাই হয়ে গেল তার চোখের নজর থেকে। সে বারবার শিউরে উঠছিল। দুটি চোখ স্থির করে রাখতে না পেরে মাঝেমাঝেই ইতিউতি করছিল সে। তারপর যখন আমরা পাথরের উৎসস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন রোদ মাথার উপর চকচক করছিল। তারচেয়ে বেশি চকচক করছিল সদ্য জল থেকে তোলা পাথরগুলো। সারি সারি, স্তুপ স্থুপ পাথর। সাদা, কালো, মেটো, বাদামি- শুধু পাথর আর পাথর। লাইন ধরে ট্রাক-ট্রাক্টর দাঁড়ানো, আর অসংখ্য লেবার সেই ট্রাকগুলো পাথরে বোঝাই করছে। চারিদিকে হৈহৈ অবস্থা। সে অবাক-বিস্ময়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। আর অনেক অনেক বিস্ময় জিজ্ঞাসা উদয় হতে থাকল তার মনে।

সাত

হ্যাঁ, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এই পাথরগুলো দিয়ে অনায়াসে দশ-বিশটা বনগাঁও মুড়ে দেওয়া যাবে এক লহমায়। আমরা আরো মেনে নিলাম যে, পাহাড় আর পাহাড়ি ঝর্ণার এই পাদদেশে পাথর ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখতে পাই নি। না গাছ, না মানুষ,  জল  কিংবা  হাওয়া- কিছুই না। পাহাড় নয় আমরা পাথর দেখলাম, ঝর্ণা নয় আমরা পাথর দেখলাম- জলের স্বচ্ছ ধারা, নৌকা, মাঝি, লেবার- সবই এক একখন্ড পাথর বৈ কিছুই নয়। এবং সেইমতে আমরা পাথর হয়ে পাথরের সড়ক ধরে চলতে থাকলাম। পাথরের পথ দীর্ঘ হতে থাকলো আমাদের পাথর করে দিয়ে। কথামতো আমরা পড়ন্ত বিকেলে জেলা শহরে যাত্রা বিরতি করলাম। কিন্তু চারিদিকে এতো এতো দীর্ঘ  উঁচু দেওয়াল, প্রকান্ড বাজার আর হাটের ভেতর আমাদের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার, চোখের গতি থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো। থরে থরে সাজানো মোড়কজাত নানা পণ্যসামগ্রী, যার ভিড়ে বারেবারেই আমরা হারিয়ে যেতে থাকলাম পরস্পর থেকে। কেবলই অদেখা আর অচেনা মানুষ এসে গায়ে ধাক্কা দিতে থাকল অনাবশ্যক; এক-এক সময় এমন হলো, কাছে থেকেও আমি তাকে চিনতে না পেরে হাকডাক শুরু করে দিলাম, তেমনি সেও বারে বারে আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে থাকল, মনে হলো তার সাথে জনম জনম শত্রুতা আমার। শেষ পর্যন্ত আমরা বের হয়ে হাঁফছেড়ে বাঁচলাম।

এবং আবারো আমরা পাথরের পথকে টেনে নিয়ে চললাম বনগাঁওয়ের দিকে।

কিন্তু সেই পাকা সড়কটি আমাদেরকে সহসাই বিচ্ছিন্ন করে দিল।

জন, ঘটনা, এবং কাল-ঐক্যের তোয়াক্কা না করে এই বিচ্ছিন্নতা নানান ডালপালা মেলে আরো প্রলম্বিত হতে থাকল।

আট

সারাদিন দেখা গেল লোকটিকে-
যতদূর রাস্তা দেখা যায়-
ততদূর হেঁটে যাচ্ছে একা-
কী খুঁজছে- কাকে খুঁজছে-
কোথা থেকে এসেছে- যাবে কোথায়-
খুব গা করে না কেউ।

একটা বালককেও দেখা গেল তারপর-
একটা সংখ্যা, তেরো শ ছিয়াশি-
বালক আর লোকটির মাঝখানে ঝুলে থাকল।

নয়

তেরোশ ছিয়ান্নব্বই সংখ্যাগুলো ঝুলে আছে তার সর্বাঙ্গে; হাঁটছে, জনে জনে জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু অচেনা অদেখা লোকটির পাশ থেকে দূরে সরে যেতে চায় সকলেই। কেউ, কোনকিছুই তার চেনা লাগে না। বড় আর মশৃণ সড়ক ধরে লোকটি হাঁটতে থাকে, আরো আরো অনেক ডালপালা গজিয়েছে সড়কটির শরীর থেকে, ধান্দা লাগে বড় ! এখানে, এই আমন ক্ষেতের কোণাটায় একটা ডোবা ছিল ছোট মতন, কত কত দিন এর পাড়ে, বিন্নাঝোপে হেলান দিয়ে দাড়কিনা মাছের খুনসুটি দেখেছি : কেউই তার কোন ঠিকানা দিতে পারে না লোকটিকে। আরো পুর্বদিকে হাঁটতে থাকে লোকটি; ডাইনে বায়ে তাকে ঘিরে ধরে পাতানো হাট বাজার, বিদ্যুতের থাম, মোড়কে ভরা টেলিভিশন, ফ্রিজ, কোল্ডড্রিংস, বোতলজাত পানি। হাটুর ব্যাথাটা বেড়েছে মনে হলো, লোকটি বসে পড়ল উদোম রোদের মধ্যে। ঠিক মনে পড়ে, এই অশ্বত্থতলা পেরিয়ে, ঐ দক্ষিণ দিকে নদী ছিল একটা : কত সকাল বিকেল হেঁটেছি নদীর পাড় দিয়ে। কাশবনের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শর্ষে-খেত, লাউয়ের মাচান, ধনেপাতা, লালশাক, আর ঐ উঁচু পাড়টায় তালগাছ ছিল বেশ কয়েকটা। একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে দেখে লোকটার মন বেশ ভালো হয়ে গেল বোধ হয়। সে ঐ দূর থেকে চেয়ে থাকে তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির পরিত্যক্ত কারুকাজের দিকে। একটা বালক হেঁটে আসতে থাকে তার মুখবরাবর। দু‘জন সামনাসামনি দাঁড়ায়, এবং   হঠাৎ ধুম করে একটা তাল ঝরে পড়লে ভোঁ-দৌড় দেয়, লোকটি অথবা বালকটি। না, একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে কেবল, লোকটি কি বালকে রূপান্তরিত হয়ে গেল, অমীমাংশিতই থেকে গেল।

অতঃপর, ক্ষীণকায় সূর্যটা যখন মিলিয়ে গেল হঠাৎ করে এবং চারপাশের বিজলিবাতিগুলো যখন ধপ করে জ্বলে উঠল, তখন একটা জটলা থেকে এই মর্মে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন নানা কথাবার্তা শোনা গেল :

 -ডানপিটে বালকদের সমান একটা গ্রাম ছিল এখানে

-সলাজ বধুদের সমান একটা নদী ছিল এখানে

-অনেক অনেক চাকা ঝুলিয়ে ট্রাকের এক দীর্ঘ কনভয় এসেছিল একদিন

-ধোঁয়া ওঠা পাথরের ¯্রােতে ভেসে গিয়েছিল সবকিছু।

লোকটি, বালকটি অথবা মানুষটি, গ্রামের একটা গোয়ালঘর, ডাংগুলি-খেলা একটা বালকের দল এবং ঘোমটা টানা এক নববধুর কাজলআঁকা চোখ দেখবে বলে আরো এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

মশৃণ সড়কটিতে তখন ভেঁপু বাজিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে গেল অনেকগুলো ট্রাক। লোকটি, বালকটি অথবা মানুষটি তখন চিৎকার করে বলে ওঠে : তেরো’শ ছিয়াশি নম্বর ট্রাক এখন সমগ্র বাংলাদেশ।

সৈয়দ মনির হেলাল। লেখক ও আইনজীবি। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের সিলেট।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..