তোমারই তো নামে

মীনাক্ষী লায়েক
মুক্তগদ্য
Bengali
তোমারই তো নামে

দেখতে দেখতে অনেকগুলি বছর গড়িয়ে গেলো সময়ের বেগবান আবর্তে। মনে হয়, এই তো সেদিন। এমনই এক কালবোশেখীর দিন, ভয়াল ঝঞ্ঝায় শান্তিনিকেতনের সযত্নে লালিত বৃক্ষগুলি যেন সমূলে উড়ে যেতে চায়। চারিদিকে ধুলোর প্রলয় নাচন, আশ্রমের গুরু-শিষ্যেরা সবাই নিজের আস্তানায়, শুধু দূর থেকে এক হাতে সাদা জোব্বা খামচে আরেক হাতে চশমা, তাঁর সাদা লম্বিত দাড়ি সহস্র ফণায় দোদুল্যমান, ততোধিক ঝড়ের বেগে তিনি ধেয়ে আসছেন, তত স্পষ্টতর হচ্ছে তাঁর দেহাবয়ব, সবেগে ঘরে ঢুকে ‘দীনু দে’ … তারপর উদাত্ত কণ্ঠে কবি ও দীনেন্দ্রনাথের একটির পর একটি বর্ষার গান, সেই গানের সাথে সাথে বাইরের ঝড়-বৃষ্টির অপূর্ব ঐক্যতান। হ্যাঁ, মনে হয় এই তো সেদিন। শুধু এই প্রজন্ম নয়, এরপরের প্রজন্ম, তারপরের প্রজন্ম….  নিরবচ্ছিন্ন বাঙালীদের মনে হবে এই তো সেদিন। সময়ের হিসেব-নিকেশ শুধুমাত্র সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের হিসেবমাত্র।

১২৬৮-র ২৫ শে বৈশাখ,  ১৪২৭ এর ২৫ শে বৈশাখ, মাঝখানের বৈশাখগুলি শুধুমাত্র যোগবিয়োগের খেলা, শুধুই উপলক্ষের অজুহাত।  তিনি রয়েছেন তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের দিবালোকে, রাত্রিতে এবং প্রতিটি মুহূর্তে, নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে, প্রেমে, পূজায়, বিশ্বাসে। তিনি রয়েছেন নীরবে, হৃদয়ে। তাই তো মনে হয় এই তো সেদিন। মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে তিনি রয়েছেন আমাদের দিকে চেয়ে, আমরা চেয়ে রয়েছি তাঁর দিকে। যাকে নিবিড় করে গভীরে পাওয়া যায় তাঁর বাহ্যিক জন্মদিনের আয়োজনের উপলক্ষ্যে ঢাক-ঢোল-দামামা অথবা মাইক্রোফোনের তুমুল চিতকারে তাঁর বাহ্যিক না থাকাটা বড় বেশী বাজে অন্তরে।

বীরভূমের কাঠ-ফাটা রোদ, আগুনের হলকা, দুঃসহ তাপ, প্রখর তপন তাপে আশ্রমবাসীরা আশ্রয় নেয় ঘরে, তখন তিনি উদয়নের সমস্ত দরজা জানালা খুলে প্রসন্ন চিত্তে চেয়ার টেবিলে একমনে রচনা করে চলেছেন কালজয়ী আখরগুলি, মনে হয় এই তো সেদিন।

গরমে তাঁর ক্লেশ ছিলো না। তিনি সকৌতুকে বীরবিক্রমে ঘোষণা করতেন তাঁর নামের সাথেই রবি আছে যে, সেই দীর্ঘ দ্বিপ্রহর প্রিয় ছিলো তাঁর। কিন্তু আশ্রমবাসীরা? ছোট ছোট পড়ুয়া, আশ্রমের কর্মচারীরা, এমন কি অধ্যাপকেরাও অস্থির হয়ে উঠতেন অসহ্য গরমে। তার সাথে জলের ভাঁড়ারে পড়তো টান। একটি কি দুটি কুয়োর তলানি ছাড়া সব কুয়ো শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণার জলেরও হাহাকার। অথচ তাদের বড় প্রিয়, বড় গর্বের, বড় আদরের, বড় কাছের গুরুদেবের জন্মদিন আসছে যে! সে উৎসবে মন না ভেজালে হয়! তিনি আশ্রমিকদের উপদেশ দিলেন ১লা বৈশাখ নববর্ষের দিন তাঁর জন্মদিন পালিত হোক। তাহলে সেদিনই গরমের ছুটি ঘোষণা করা যায়। শিশুরা তাহলে গরমের হাত থেকে রেহাই পাবে। সেই মতোই কাজ হলো। আশ্রমবালা ও বালকগণের বৈতালিক গান গেয়ে আশ্রম পরিক্রমা, গুরুদেব বসে রয়েছেন আম্রচ্ছায়ে, আসনের চারিদিকে সুন্দর আলপনা, আশ্রমিকদের গুরুদেবের আশীর্বাদ – সবে মিলে মহাযজ্ঞ। মনে হয় এই তো সেদিন।

তাঁর উপস্থিতিতে শেষ জন্মদিন পালিত হয়েছিলো আশ্রমে, সেটি ছিলো ১৯৪১ সাল, ১৯৪৮ বঙ্গাব্দ। উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে সুসজ্জিত মন্ডপের মাঝে তাঁর আশি বত্সরের জন্মদিন পালিত হচ্ছে। মনে হয় এই তো সেদিন। তখন কে জানতো জীবতকালে এটিই তাঁর শেষ জন্মোৎসব। সেদিনই গান্ধীজী তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তা দেন এবং তাঁর শতায়ু হবার অভীপ্সা প্রকাশ করেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর আয়ুষ্মান চেতনায় নিজের কবিধর্মকেই একমাত্র পরিচয় বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর যৌবনকাল হতে শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজের কবিজীবনকেই নিরাপত্তা দিতে চেয়েছেন। অথচ তাঁর সৃজনশীলতা সাহিত্য সংস্কৃতির জগতের পাশাপাশি তাঁর কর্মের জগতকে বহুমাত্রিক করে তুলেছিলো। তাঁর কর্মময় জীবনের সন্ধানে পথ হাঁটতে হাঁটতে আজও রবীন্দ্রচর্চার নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কবি বলেছেন “কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে” – তবু তাঁর কবিজীবনী প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ” কোন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি কাব্যে এবং জীবনের কর্মে উভয়তই নিজের প্রতিভা বিকাশ করিতে পারেন, কাব্য ও কর্ম উভয়ই তাহার এক প্রতিভার ফল” – উক্তিটি তাঁর  ক্ষেত্রে অধিক সত্য।

তিনি কবিতা লিখেই সন্তুষ্ট থাকেন নি, ভাবকে রূপ দেবার জন্য বারে বারে কর্মক্ষেত্রে নেমেছেন। আর এই কর্মক্ষেত্র জানার উৎসাহে প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে রবীন্দ্র আবিষ্কার। আর শুধুই কর্মক্ষেত্রর নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, হাসি, দুঃখ, বেদনা, বিষাদ, শোক, কষ্ট যা তিনি সকলের কাছে অত্যন্ত সচেতনভাবে গোপন রাখতে চেয়েছেন সেসবও। তাঁর সুদীর্ঘ আশি বছরের জীবনে বার বার নিদারুণ শোকাহত অবস্থাতেও প্রকাশ্যে শোকপ্রকাশ করতে দেখে নি কেউ, মানুষটিকে বাইরে থেকে মনে হতো তাঁর  হৃদয়ে শোক কান্নার কোন স্থান নেই, দুঃখকে তিনি বোধহয় জয় করেছেন। অথচ তাঁর জীবন ইতিহাস, তাঁর ‘গীতবিতান’ কর্মসাধনার আড়ালে থাকা রক্তমাংসের মানুষটিকে চিহ্নিত করে, “দুনয়নে বারি আসে ভরে..”। কবির নিজের কাছেই প্রশ্ন ” কে যে আমায় কাঁদায় আমি কি জানি তার নাম… “। এর উত্তরও হয়তো আগামী কোনো দিন রবি-অনুরাগীগণ ঠিক খুঁজে নেবেন। এ প্রজন্ম, নয়তো পরের প্রজন্ম, নয়তো তার পরের…তার পরের… ততদিন কারণ, যাদের জীবন জুড়ে শুধু রবীন্দ্রনাথ তাদের প্রতিটি দিনই রবীন্দ্র জন্মদিন, শুধু ১লা বা ২৫ শে বৈশাখ নয় —

“দেখেছি তোমার নামে সবার প্রথমে
শ্রাবণে ধানের শিষে দুধটুকু জমে,
তোমারই তো নামে
বৈশাখে আখের ক্ষেতে যত মধু জমে।”…
(দীনেশ দাস) 

মীনাক্ষী লায়েক। লেখক ও সম্পাদক। জন্ম নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের পুরুলিয়ায়। তিনি 'বর্ডার লাইন দি' নামক সংবাদপত্র এবং 'মহুয়া' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা কাজে যুক্ত।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ