দণ্ডিত এক পাকুড়গাছ

সৈয়দ মনির হেলাল
গল্প
Bengali
দণ্ডিত এক পাকুড়গাছ

এখন আমরা ঘুমাব। আমরা বসে থাকব, শুয়ে থাকব, স্মার্ট ফোন বুকের ওপর রেখে চ্যাট করব পরিচিত
অপরিচিতদের সাথে; ফান ভিডিও দেখে হো হো করে হাসব, তিনবেলা খাব- বসে থাকব, শুয়ে থাকব- আবার
ঘুমিয়ে থাকব অসাড় হয়ে। এছাড়া আমরা আর কিছুই করব না; ভাবনা নাই, চিন্তা নাই, দুশ্চিন্তা- কিছুই নাই।
আমরা শব্দ করব না, হাঁটব না, দৌড়াব না- কোথাও যাবার তো প্রশ্নই আসে না।
পাকুড়গাছটির এখন কী অবস্থা, জানবার কোন কায়দা নেই আমাদের হাতে। কোন জনমানব, পশু অথবা পতঙ্গ-
পাকুড়গাছটির শিকড়-বাকড় শুকতে আসে কি না, কিছুই জানবার গরজ নেই আমাদের। বিস্তারিত শাখা-
প্রশাখায় দমমেরে বসে থাকা সাদা বকের দল, পানকৌড়ির লম্পঝম্প, সরালি হাঁসের ঢেকুরতোলা, বাহুমূল
থেকে নেমে আসা ঝুড়ি, কাঠবিড়ালির অনর্থক গোল্লাছুট, হলুদ-কালো, লাল-নীল, সোনালি-সবুজ- পাতারঙ
পতঙ্গের প্রাণময় কোরাসÑ কিছুই ভাবতে চাইব না আমরা। কোনরকমের ভীতি, ভয়, শঙ্কা, বিষাদ- পাকুড়গাছ
কিংবা তার সামগ্রিকতাকে নেতিয়ে ফেলছে কি না- জানবার জন্য এখন আর উদগ্রীব নই আমরা।
এক ভব্য, সভ্য, শিষ্ট এবং সুশীল নিয়মের পরিচর্যায়, কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে শনৈ শনৈ জীবনবর্দ্ধক
জপতপ করতে করতে প্রাণান্ত হচ্ছিলাম যখন, তখন বেশরম টিভির স্ক্রিনে নির্বাক ছবিসমূহ জানান দিচ্ছে
ট্রাকের ওপর সারি সারি কেমিকেলের ড্রামের ভেতর মাথাসমেত ডুবিয়ে রেখে ফেরি পার হচ্ছে কতেক মানব
সন্তান। খেঁক করে ওঠে মিঠুনেরর বাজখাঁই কণ্ঠ- চোঁদনারা মারবে সবাইকে !
পলিথিন মোড়ানো হাতে কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো মাইক্রোফোন, নাকে-মুখে ঠেসে লাগানো রঙচঙা ভারি মাস্ক-
লাইভ রিপোর্টারটিকে কেবল দেখছিলাম আমি। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল পলাশ, তড়াক করে লাফ দিয়ে
ওঠে; আর ভয়-ভয়ার্ত রিপের্টারটিকে শাপ-শাপান্ত করতে লাগল খিটিমিটি মেজাজে- কার কাছে কোথায়
শিখেছে এই কথাবলার ঢং, ছেঃ ছেঃ ছেঃ- চতুর্থ রাষ্ট্র চুইয়ে পড়ছে দুইগাল বেয়ে !
শ্যামা বরাবরই ভীতু আর ভেতরমুখি মানুষ; কিন্তু কেবলই ঘর-বাইর করছেÑ আনঘাটে বাঁধা ছিপ-নাওয়ের
মতোন। আর-সকল নিরুদ্বিগ্নÑ অথচ এলোমেলো, কিছুই করার নেই, শুয়ে বসে দিন গুজরানই যেন একমাত্র
জীবনসাধনা। শ্যামা আবার ঘরের ভেতর ঢুকল, দাঁড়াল, তারপর আচমকাই বললÑ মা ফোন করে বলেছে যে
করেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতে যেন চেষ্টা করি জোরালোভাবে। আমি বেরোচ্ছি !
খাটের পেছনটাতে হাঁটু মুড়ে বসেছিল তমাল; কোলের ওপর মোবাইল ফোন, একেবারে শ্যামার চোখের ওপর
তীব্র চোখ রেখে বললÑ তোর কী মাথা গেছে নাকি ? খালাম্মাকে বল, এখান থেকে বের হওয়া মানেÑ দাঁড়া,
আমিই কল দিচ্ছিÑ
আহা শোন তো আগে, মা একেবারে একাÑ
হঠাৎ থেমে গিয়ে বেশ জোরের সাথে যোগ করলÑ বাবাও আটকা পড়েছে ঢাকার বাইরে !
ঠিক তাই, একলা থাকাটাই এখন সবচেয়ে জরুরী, একলা থাকতে হবে আমাদের সবাইকেইÑ
আমিও তো তাই বলছি। কিন্তু মা কিছুতেই বুঝতে নারাজ। ইস ! কী ফ্যাসাদে যে পড়লাম !
থামলি কেন, দে গালিটা ছেড়ে দে আমার দিকে ! আমিই তো দায়ী, বল- বল নাÑ
কার দায় কার উপর চাপাচ্ছিস তমাল ? ধুর ! আমি বাছা এসবে নাই ! চীন, নাকি আমেরিকা, নাকি কিম, উহান,
মিশিগান, সাপ, বাঁদর, বনরুই, নাকি তমাল- এইসব ঝগড়া-বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, আচার-বিচার বাদ দে তো
বাবারা ! তারচেয়ে চল, একটা গেইম খেলি। ইস ! কত গেইম যে ভেসে বেড়াচ্ছে ভার্চুয়াল তরঙ্গে ! যেন দুনিয়াটা
এক মস্ত খেলার দান আর আমরা ষোলগুটির শুয়োপোকা এক একটা, মানুষ নই- ছিলাম না কখনো ! রিমি এই


একটা ব্যাপারে অন্যদের থেকে অন্যরকম, ভণিতা কিংবা ভন্ডামি নেই একেবারেই, যা ঠিক মনে হয় তা
ঠাসঠাস বলে ফেলে দ্বিধাহীনভাবে। শোনো দোস্ত-বন্ধুগণ, অতো আহ্লাদ ফলাতে হবে না, বিপদ যখন মাথার
ওপর আছড়ে পড়বে তখন কে কোথায় উড়ে যাবে সে আমার ভালোই জানা আছে ! তমালের কাছে বড় তেতো লাগল
কথাটা- তুই কী বলতে চাস তাহলে শুনি ? কিছুই বলতে চাই না আমি, শ্যামা যদি যেতেই চায় আমাদের উচিৎ
হবে তাকে সাহায্য করা। শ্যামার মুখের দিকে তাকায় সবাই, কিন্তু সে চুপ করে যায় আরো, যেন মস্ত এক
আপদ সে এখন !
কিন্তু লাফ দিয়ে ওঠে মিঠুন, সে অমন ভারিক্কি কথাবার্তায় নেই। খবর শুনেছিস ? এই দেখ, আরে রাখ তো
তোর ল্যাপটপ; জিপি হ্েচ্ছ সেরা- অনলি ওয়ান পিস ! এই দেখ, যত ডাটা কিনবে পাবে তার দ্বিগুন, মুফতে-
একেবারো ডাবলে ডাবল, ভাবতে পারিস ? তমালও তার সাথে কথা মেলায়- হ্যাঁ দেখেছি তো, তারা নাকি দশ লাখ
জিবি ডাটা ফ্রি দিচ্ছে ! উরে ব্বাস ! তাহলে তো লাইন পড়ে গেছে সবখানে, সামাজিক দুরত্বের বারোটা এবার
বেজেই গেল বুঝি ! বেটা, তুই আছিস সেই এক ধান্দায়, কোথায় কী মাগনা পাওয়া যায়, আরে বেটা রুখÑ ধমক
দেয় পলাশ !
তমাল মিঠুন আর রিমি একসাথে হৈ হৈ করে ওঠে, কিন্তু কথা শোনা গেল না একফোটাও। শেষপর্যন্ত জিৎ হল
রিমির, মিঠুনের কথাটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে ফোঁস করে ওঠেÑ তা আর দেখতে হবে না, রবি অভিযোগ
দিয়েছে, জিপি একচেটিয়া কারবার করার মওকা খুজছে ! এও বলে দিয়েছে, এমন যদি হয় তাহলে জিপিই ব্যবসা
করুক একা, আমরা চলি !
কি রে মিঠুন, দেখ সব ডাটা-ফাটা নিয়ে জিপি এবার পটল তুলল না কি- পলাশ ফোড়ন কাটে।
তিন পক্ষ মিলে এখন কী না কী কামড়াকামড়ি শুরু হয়, আল্লা রে আল্লা রক্ষা করো- শ্যামা যেন সত্যি অথৈ
সাগর দেখছে সামনে।
মন্দ কী ? কামড়াকামড়ি চলুক না, আমরা দেখে যাই ! দেখছিস নাÑ মেগা মল আর ব্র্যান্ড শপগুলো কেমন
টানাটানি শুরু করেছে, আর পাড়া-মহল্লার ছোটখাট দোকানদারগুলো খাবি খাচ্ছে অতল জলে। কিন্তু আমার
কথাটাকে একফুঁ-য়ে বাতিল করে দিল মিঠুন। নাহ, এমন কথা তুই বলতে পারিস না। তোকে মানতেই হবে- এই
ইন্টারনেটই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। ভেবে দেখ- এই নেটের সুবিধা আজ না থাকলে কী হতো আমাদের- মিঠুন
বেশ রেগেই গেল বোধ হয়।
এইসব খুনসুটি, তর্ক, রাগ গোস্বা শ্যামার খুব ভালো লাগছিল না বোধহয়। শ্যামা বেরিয়ে যায় নিঃশব্দে।
পায়চারি করতে থাকে টানা বারান্দায়, অনেক্ষণ। খোলা বারান্দা, বারান্দা থেকে প্রশস্ত উঠোন- মিঠে
আলোর ভেতর হাঁটতে হাঁটতে, পায়চারি করতে করতে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে তখন সে। তারপর সকল
বিস্বাদ, চিনচিন ব্যথা সামলে নিয়ে, আলুথালু বুকটাকে বাতাসের অনিরুদ্ধতার মাঝখানে সঁপে দিয়ে ততক্ষণে
উঠোনের নরোম ঘাসে বসে পড়েছে পা ছড়িয়ে দিয়ে। তারপর শ্যামা, এক বুনো লতার মতো তিরতির করে দুলতে
থাকা শ্যামা তার অনামিকা থেকে পিঙ্ক আর মধ্যমা থেকে সাদা অঙ্গুরীয় দুটি খুলে নেয়, দুই হাতের তালুতে
রেখে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ, যেন পৃথিবীর পথ আর প্রণালী তার দুই হাতের মুঠোয় ভিজে সপসপ করছে। পিঙ্ক
রিংটা তার মায়ের এনগেজমেন্টের স্মৃতি, মায়ের কাছ থেকে প্রায় জোর করে পরে নিয়েছিল নিজের আঙুলে।
আর সাদা রিংটা বাবার গিফট, আঠারো বছর পূর্তিতে- যখন ভার্সিটির বৃহৎ আঙিনায় পা রাখতে যাবে, নিজেই
পরিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। বড় অবাক লাগে তার, মা চিরদিন একটা ঘর চেয়েছিল, আর এখন সে ছটফট করে
ঘরের ভেতর, একলা থাকা এখন ভয় বড় তার ! কী অদ্ভুত !
রিমি উঁকি দেয় বারান্দা থেকে। তার সামনে চিত্রল পটভূমি হয়ে বসে আছে শ্যামা, জলছাপ এক ক্যানভাসের
মতো। হাঁক ছাড়ে রিমিÑ ওহে কুঁড়ের বাদশাগণ, দেখ দেখ- কী সুন্দর সবুজ রোদ হেসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে সারা
উঠোনময়।
তমালও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। হাঁক ছাড়ে গলা ফুলিয়ে, অপার আনন্দ চাও তো বেরিয়ে আসো এই বদ্ধ
ঘরের ভেতর থেকে ! কী সুন্দর পড়ন্ত রোদ, যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। শরমে লাল হতে থাকা
সূর্যটা ডুবিডুবি করছে তখন, যখন মিঠুন, রিমি, পলাশও বারান্দা থেকে পা রাখে সবুজ মাঠে। আয় না ভাই,


একবার রোদটা মেখে নিই সকলে মিলে। বলা তো যায় না কাল কী হয় না হয়। আমরা গিয়ে গোল হয়ে বসলাম
উঠোনের ঘাসের ওপর।
সবার মাথা ছুঁয়ে সূর্যের লাল আভা পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে ততক্ষণে। সকলেই নিশ্চুপ। কোন কথা নেই। যেন
সূর্যের নিরুদ্দেশ হওয়া, কিংবা ঐ-দূর বনবিথির নিথর দাঁড়িয়ে থাকার দিকে চেয়ে আছে সবাই। কয়েকটা
নীড়হারা পাখির ত্রস্ততা, তাদের শোঁ শোঁ ডানা ঝাপটানো- আরো কাব্যময় করে তোলে চারপাশ।
পলাশ সতর্কতা জারি করল খুব জোরের সাথেই।
আর যা-ই বল, সকলের স্বার্থেই সকলকে সচেতন হতে হবে এখন, না হলে আমাদের জন্য কী আছে ভবিষ্যতে
তা আমরা কেউই বলতে পারব না। পলাশকে থামিয়ে দেয় তমাল, ভবিষ্যৎ তো ভবিষ্যৎ, বর্তমানটারই বা কী
দশা তা নিয়ে ভাব একবার ! এই যে ঘরদোর বন্ধ করে বসে আছি, কদ্দিন আর ? এভাবে তো নির্ঘাত মারা যাব-
একটা কাক-পক্ষিও টের পাবে না। কাঁদবার জন্য, শোক করবার জন্য, একফোটা জল ফেলবারও লোক পাওয়া
যাবে নাÑ রিমিও সায় দেয় তাদের সাথে। কে কোথায় মরে- পচে-গলে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকবে, কে কার খোঁজ
রাখবে ! কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ আমাদের মানবজনম, তা আজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মাত্র কদিনের
বিপরীত এক সময়- তমাল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বড় বড় নিঃশ্বাস নেয়। পলাশও তার সাথে যোগ দেয়-
যে মানবসমাজ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত আত্মশ্লাঘায় ভোগি, বড়াই করি- সেই মানবসমাজের নীতিনির্ধারণী
ব্যবস্থা, আমাদের জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, অর্থনীতি, শিল্পনীতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা- কত ঠুনকো তা
একেবারে উদোম হয়ে গেছে এই কয়দিনে। রিমির এতো কঠিন কঠিন কথা ভাললাগে না, সে মুখটাকে মেঘের মতো
কালো করে বলে- নদীর পাড়ে হাাঁটি না কতদিন; একটা জারুল ফুল, একটা বউ কথা কও সুর, একটা প্রজাপতির
ডানা- কতদিন খোলা হাওয়ায় দোল খাওয়া হয় না আমাদের ! মেজাজটাকে তিরিক্ষি করে মিঠুন ধমক দেয়
রিমিকেÑ আরে তুই আছিস তোর কাব্যকলা নিয়ে ! মানুষ না খেয়ে মরতে বসেছে- কাজ নেই; মিলের চাকা ঘুরছে
না, ব্যবসাপাতি বন্ধ; শ্রমিক, মিস্ত্রি, সুতার, কারিগর- সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে, অর্থনৈতিক
কর্মকান্ড স্থবির, মানুষ বাঁচবে কী করে, সেটা ভেবে দেখ একবার।
কাজের কথা যখন উঠলই, সাহস করে তখন ছেড়ে দিলাম কথাটা।
হ্যাঁ, কাজ তো করতেই হবে। মানুষ হারতে পারে না। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে শীঘ্রই। আর হ্যাঁ, আমাদের
কাজটাকেও বোধহয় এভাবে ফেলে রাখা ভালো হচ্ছে না। যা-ই বলো, যতটুকু সম্ভব কাজটা আগানো দরকার।
কথাগুলো শেষ করবার আগেই শ্যামা কেড়ে নেয় ত্বরিতে, কী করব তাহলে ? দোষ কী আমাদের ? মিঠুনও সায়
দেয় তাতে- ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনা ২০ তারিখ, তার পরদিন খালিয়াজুরি; এসেই কী কাজে নেমে
যাই নি আমরা ? পলাশ আবারো যোগ দেয়- তিনদিন তো গেল প্রজেক্টের ম্যাপ করতেই, এরপর যে-ই সার্ভে
করতে শুরু করেছি, মানুষের সাথে কথা বলা শুরু করেছি, ওমনি শুরু হল এই লকডাউন, আমাদের কী করবার ছিল
তখন ?
না না, এটা তো কেউ অস্বীকার করছে না ! কিন্তু অফিসেরও তো একটা নিয়ম আছে, নীতি আছে ! শোনো,
অফিস থেকে মেইল এসেছে, কী কাজ হয়েছে, কতটুকু এগোনো গেছে, মানুষের ভাবনা কী, বিস্তারিত রিপোর্ট
যেন দুই দিনের মধ্যেই মেইল করি।
সে আর অমন কী ! দাও, রিপোর্টটা আমিই তৈরী করে দিচ্ছি, মেইল করে দিস তুইÑ রিমি যেন অপেক্ষায় ছিল
একটা কিছু কাজের জন্য।
বাহ! ঝামেলা তাহলে মিটেই গেল। ঠিক আছে, সবগুলো ডাটা রিমিকে দিয়ে দাও সবাই। একটা খসড়া দাঁড় করুক
সে, তারপর না হয় সবাই মিলে বসব আমরা।
না না, ডাটা ফাটা লাগবে না, সব আমার মগজের মধ্যেই আছে।
উরে ব্বাস ! দেখেছো কান্ড ! রিমি আজ বিগড়ে গেল মনে হচ্ছে !
এহঃ ! ঢং হচ্ছে ! বলি, এই রিপোর্ট আর আহামরি কী এমন ?


২৪ তারিখে স্পটে গেলাম। একটা বৃহৎ পাকুড় গাছ, বয়স আন্দাজ দেড়শ বছর, স্থানীয় বয়সী লোকেদের কথা-
তাদের দাদা পরদাদারা চৈত-বৈশাখের দুপুরে এই পাকুড়গাছের নিচে গড়াগড়ি খেয়েছেন গা উদোম করে।
পাকুড়গাছটির শাখা প্রশাখাগুলো ঈষৎ বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো, একটা ন্যাতানো দড়ির মতন লাগছে তাকে।
এবং পাকুড় গাছটির পাশ দিয়ে একটা মাটির সড়ক গেছে, যেটা এখন বৃহৎ কলেবরে তৈরী করবার যোগাড়যন্ত্র
চলছে বলে মনে হচ্ছে। পাশেই জলাভূমি- প্রাকৃতিক, অদূরে একটি মেগা এগ্রোফার্ম এক বৃহৎ জমি নিয়ে-
হাওর জলাশয়, পাশের বিন্নাবন, সবকিছুর ওপর সদম্ভে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে। এতোগুলো কথা বলে রিমি
একটু দম নিতে গেলে মিঠুন তার সাথে যোগ করে- মেগা প্রকল্পের প্রজেক্ট অফিসার লোকটি অত্যন্ত
অমায়িক। হালকা পাতলা গঠন, একটা সিপাই সিপাই ভাব। তবে চেহারা-সুরত মাশাল্লা বেশ খান্দানি, নূরানী
তেজ টিকরে বেরুচ্ছে সারা শরীর থেকে। আর দিলটা বড় নরম, দরদ আর রহম ভরা ভেতরটাতে। না হলে কী যে
হতো আমাদের। লকাডাউন শুরু হলে আমরা যখন কোথায় থাকব এই চিন্তায় খাবি খাচ্ছিলাম, তখন তিনি তার
প্রজেক্টের বিশাল গেস্ট হাউসটি আমাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। রোজ রোজ মাছ, মাংশ, শাক, সবজি- একেবারে
টাটকা সব- নিজের ইন্ডাস্ট্রির মাল।
তোদের সবকিছুতেই ফাজলামো। পলাশ কপট রাগ প্রকাশ করে প্রফেশন আর দায়িত্বের কথাগুলো স্মরণ
করিয়ে দেয় বেশ ময়মুরুব্বির মতন। শুরুতেই যদি ধান্দাবাজি শুরু করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতের কপালে অনেক
দুঃখ আছে বলে দিচ্ছি সাফসাফ।
বলিহারি কথা তোর ! এখানে ধান্দাবাজির কী আছে শুনি ?
হ্যাঁ, আমাদের কোর্স কো-অর্ডিনেটর, পাবলিক হেল্থ ডিভিশনের প্রধান ব্যক্তি রাশভারি সাইফ স্যার
বারবার আমাদের এই কথাটিই বলেছিলেন- গবেষণা হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা আছে অথচ আমরা সাদা
চোখে দেখতে পাচ্ছি না, সেটিই আমাদেরকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনতে হবে। আর হ্যাঁ, যে অনুসন্ধান কাজে
আমরা নেমেছি, সেই বিষয়ের রূপ, প্রকৃতি, পূর্বাপর সম্মন্ধ, এর গতি, আচরণ, ভাষা- সবকিছুর ভেতরে ঢুকে,
সবকিছুকে ভেঙেচুরে এমন একটা সত্য বের করে আনতে হবে যা হবে একেবারে টাটকা আর জীবন্ত। শেষ
কথা, গবেষণা কাজে থাকতে হবে একশভাগ সৎ আর নিবেদিত।

এনভায়র্নমেন্টাল সায়েন্সের মাস্টার্স কোর্সের স্টুন্টেস আমরা এই ক’জন একটা গবেষণা ফার্মে
ইন্টার্নি করছি। ফিল্ডের কাজ প্রায় শেষ করেই ফেলেছি, এমন সময় আমাদের কো-অর্ডিনেটর একটা
এসাইনমেন্ট নিয়ে ডাকলেন আমাদের কয়েকজনকে। শোনো, কাজটাতে একটা জীবন্ত থ্রিল, একটা রহস্যঘেরা
ডাইমেনশন আছে। এতোদিন করেছ একেবারে ট্রাডিশনাল কাজ। এবার করতে হবে অন্যরকম, চ্যালেঞ্জিং
কিছু। ম্যাথডলজি এপ্লাই তো হবেই, কিন্তু গতানুগতিকতার ছক ভেঙে একেবারে নিজস্বতা দিয়ে, নিজেদের
বিবেচনাবোধ, বাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা আর ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে বিষয়টার একটা স্পষ্ট চিত্র তুলে আনতে
হবে তোমাদের।
আমরা শুনছিলাম তার কথাগুলো।
খুবই জায়ান্ট, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর একটা এগ্রোফার্ম হয়েছে, এরা অবশ্য এটাকে শিল্পই বলে- সেটা
তিনবছর। ফার্মটা বেশ দাঁড়িয়ে গেছে এখন। খুব ডাইভারসিফাইড এ প্রজেক্টে আছে নানান বিভাগ, উপবিভাগ;
নানান প্ল্যান্ট, নানান ব্র্যান্ড। দেখবে, সনাতনি এগ্রিকালচারের ছক ভেঙ্গে বহুরকমের কাজ হচ্ছে
সেখানে। এগ্রো-জেনেটিক টেকনলজি ও বায়োটেকনলজির সমন্বয়ে বহুরকমের টুলস ব্যবহৃত হচ্ছে খুব
ধুন্দুমার গতিতে। গবেষণা, পরীক্ষা, নীরিক্ষা, উদ্ভাবন- এক মহাযজ্ঞই বলতে পারো। এদের কথা, প্রচলিত
কৃষিজ ও প্রাণিজ খাদ্য ধারণাকে এরা একেবারেই পাল্টে দিতে চায় ত্বরিৎ গতিতে। তবে কথা সেটা নয়, কথা
হচ্ছে- একটা পাকুড়গাছ নিয়ে। এবং বড় কথা সেটাইÑ প্রজেক্টটি আদৌ থাকবে কি না।
অবশ্য শুরু থেকেই এলাকার কিছু মানুষ বিরোধিতা করেছে এই মেগা প্রজেক্টের। এটা নাকি তাদের প্রাকৃতিক
জীবন জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিল, জলাশয়, হাওর, নদী, কিংবা কাছেই বনের যে অবশিষ্ট আছে


না থাকার মতো করে, তাতে নাকি স্থানীয়দের সর্বজনীন মালিকানা রহিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হবে
ভবিষ্যতে। যা হোক, ওসবকে পাশ কাটিয়ে প্রজেক্টটা দাঁড়িয়ে গেছে বলা যায়। কিন্তু সমস্যার জট পেকে যায়
তখনই, যখন ঐ বয়সী জীর্ণ-শীর্ণ পাকুড়গাছটা বেমক্কা এসে পড়ে প্রস্তাবিত রাস্তাটার ওপর। তোমরা
সাইটে গেলেই দেখতে পাবে, প্রজেক্টে যেতে যে রাস্তাটা আছে, সেটা বড় করা লাগবে- হোক আজ অথবা কাল।
এখানকার প্রাকৃতিক আকারটাই এমন- পাকুড়গাছ না কেটে কিছুতেই রাস্তা প্রশস্ত করা যাবে না। আর
রাস্তাই যদি না থাকে প্রজেক্টের, তাহলে এতো এতো পণ্য, মাল-সামানা পরিবহনের গতি কী ? অথচ
খামোকাই বেঁকে বসল গাঁয়ের কয়েকজন ঘাড়ত্যাড়া মানুষ। তাদের এক কথা, এক যুক্তি : পাকুড়গাছ তাদের
সমাজ-সংসারের অংশ, কাটা যাবে না কিছুতেই।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, পাকুড়গাছ আর তার পরিপার্শ্ব নিয়ে রিয়েল পিকচারটা তুলে আনতে হবে
তোমাদের। এই পাকুড়গাছ কীভাবে সমাজ-সংসারের অংশ হল, কিংবা এটা কেটে ফেললে কীরকম প্রভাব পড়বে
জনজীবন কিংবা জনমতের উপর, কিংবা প্রজেক্টটা বন্ধ করে দিলে মানুষের রুটি-রুজির উপায় কী হবে, তা
গবেষণা করে বের করতে হবে। আর হ্যাঁ, জানই তো- প্রায় সবগুলো ভালো কাজে একটা পক্ষ চিরদিনই দাঁড়িয়ে
যায় বিপরীতে। এস্টাবলিশমেন্টের জোরালো কথা, এক ষন্ডাগোষ্ঠী কোনভাবে স্থানীয় লোকজনকে খেপিয়ে
তুলছে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষকে সামনে রেখে এরা ফায়দা তুলবার কায়দা করছে। কিন্তু, আমারা এসব হুজ্জতে
নাই; আমরা বাস্তবতা দেখব, যা-ই বলো, মানুষের রিযিক-দৌলতের ওপর খোদকারী কিন্তু কেউই বরদাশত
করবে না।
আমরা, বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর মওকা খুঁজতে থাকা এই ছয়জন ইন্টার্ন বোচকাপাতি বেঁধে হৈ হৈ করে
রওয়ানা হয়ে গেলাম তার ঠিক দুইদিন পর। ঢাকা থেকে সোজা ময়মনসিংহ, তারপর নেত্রকোনায় রাতযাপন।
পরদিন লোকাল বাসে চেপে খালিয়াজুরি; মরা গাঙ, বিল, হাওর আর বেওয়ারিশ বনবেষ্ঠিত এবড়ো থেবড়ো এক
পাড়াগাঁ। খালিয়াজুরির এক হোটেলে খুঁটি গাড়লাম আমরা, আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করা ছিল । আমাদের
প্রজেক্ট সাইট এখান থেকে মাইল পাঁচেক। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট করে দিল ছোট্ট এক অনুজীব- এই
কয়মাসে সবথেকে বেশি উচ্চারিত আদুরে এক নাম করোনা ভাইরাস।

কাজের কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ নানান কথাই এসে গেল। যাক, পরসমাচার এই যে, তথ্য উপাত্ত
যে পর্যন্ত সংগ্রহ করা গেছে তা দিয়ে পরশুর মধ্যে একটা রিপোর্ট তৈরী করে ফেলতে হবে বলে আমরা স্থির
সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম।

তমাল, শ্যামা, মিটুন, রিমি, পলাশ, সবাইকেই খুব নির্ভার দেখায় যদিও, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নানান দুর্ভাবনা
যে ঘিরে আছে তাদের, তা বেশ বুঝতে পারি আমি। দুই সপ্তাহের প্রজেক্ট প্রায় দুই মাস, ফাইনাল পরীক্ষাটা
শেষ হতে হতে ঝুলেই আছে ! কী অপেক্ষা করছে সামনেÑ কেউই আন্দাজ করতে পারছি না। মধ্যবিত্ত ঘরের
ছাপোষা মানুষ; নানান আশাÑ নানান স্বপ্ন নিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি সবাই। এখন সবকিছু বাদ, কীভাবে
প্রাণটাকে কোনমতে জিইয়ে রাখা যায়, সেই এক চিন্তা অহর্নিশ ! পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশি, সমাজÑ
বহুদূর আজ ! প্রাণটা আগে ! বড় ভাইয়ের কথা, বাবার কথা, মিঠুনের বোনটা, শ্যামার মা- কেউ, কোনকিছ্ইু
এখন জরুরী নয়, স্বার্থপর হওয়া এখন সময়ের দাবি ! যে যতবেশি স্বার্থপর, ইতর, আত্মকেন্দ্রিক,
অসামাজিক- তাদেরই গুণকীর্তন চলছে চারদিকে।

অনেকদিন হয়, কথা হয় না প্রতিদিনের আড্ডা দেওয়া বন্ধুদের সাথে। যদিও এরই মধ্যে মেসেঞ্জারে একটা
গ্রুপ তৈরী হয়ে গেছে- লকডাউন আড্ডা। দুধের স্বাদ ঘুলে মেটানো আর কি ! নেট অন করতেই অনেকের মুখ
ভেসে এল মোবাইলের স্ক্রিনে, যেন দেহাতীত মুখমন্ডলীর সমাবেশ। তাও ভালো। কিন্তু খানিক বাদেই হতাশ
হতে হল। আড্ডা তো নয়- সেই একই ঘোড়ার আন্ডা ! ঘুরে-ফিরে সেই একই কথা- ভাইরাস আর ভীতি, বিচ্ছেদ


আর মৃত্যু। কোথায় কতজন আক্রান্ত হল, মৃত্যু হল কতজনের- কে কাছে গেল নাকি রাস্তার পাশে ফেলে দিল,
ভাইরাসের স্বভাব-চরিত্র, নিমপাতা-লেবুর রস, ওষুধ-পথ্য, কে কেমন গলাবাজি করছে, দায় এবং দায়হীনতা-
ধুর, ভাল্লাগেনা না এসব আর !
ভালো-মন্দ, তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-অযুক্তি, মিত্রতা-শত্রুতা, মিলন-বিচ্ছেদ, পরার্থপরতা-স্বার্থপরতাÑ
যতই যা থাক না ভরা আমাদের মাঝে; তবুও একটা সাদা-কালো, লাল-নীলÑ ভাজকরা জীবন ছিল চারপাশ নিয়ে !
কিন্তু সবই আজ এক দমহীন নিশ্চল কলের গাড়ি !

কালই পাঠাতে হবে রিপোর্ট। অথচ রিমির মধ্যে কোন ত্রস্ততা নেই। এদিকে সকাল হতে না হতেই হৈচৈ
লাগিয়ে দিল মিঠুন। অবশ্য হৈচৈ-এর মাঝেই মিঠুনের মজা। এক-আধটু বাঁদরামি না করলেই যেন ভাত হজম হয়
না তার, কিন্তু আসলে কাজের বেলা খুব টনটনা। তার এক কথাÑ রিপোর্ট তৈরী করতে হলে বসতে হবে
সবাইকে, রিমিকে তো সহযোগিতা করতে হবে আমাদের । একটু ঝালাই করতে হবে না সবকিছু ? শ্যামার মধ্যে
দীর্ঘ আলসেমি, কী অতো তাড়াহুড়ার দরকার ভাই !
সাইটম্যাপ আর নোটগুলো নিয়ে বিকেলে বসলাম আমরা । আমি, রিমি, পলাশ আর শ্যামা। মিঠুন তো আছেই। এই
পুরোটা হচ্ছে প্রজেক্ট এরিয়া। বিশাল এলাকা; জলাশয়, চারদিকে নদী, প্রবাহকে শাসন করে লেকের গঠন
দেওয়া হয়েছে। পাড়ে লাগানো হয়েছে বনজ আর ঔষধি গাছ, দেশি এবং বিদেশি। মাঝখানের বিশাল এরিয়া জুড়ে
অনেকগুলো পুকুর, তার পাশে একদিকে লাগানো হয়েছে নানান জাতের সবজি বাগান। রিমি বলল, এসব খুব একটা
দরকার নেই আমাদের; মেইন গেট থেকে একটা রাস্তা গেছে সোজা দক্ষিণ দিকে; পশ্চিমপাশে মরা গাঙÑ স্থির
টলটলে জলের বিস্তার আর তীরজুড়ে ঝোপ ঝোপ বিন্নাবন, কেওয়া, ডুমুর, জারুল, আমলকি, লটকন, ছোট ছোট
ভাটবন-লতাপাতাÑ এদিকটাতে মনে হচ্ছে একসময় ঘন বনের অস্তিত্ব ছিল। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে পায়ে
হাঁটা পথ। হ্যাঁ, এই পথ-ই প্রশস্ত সড়ক হবে বলে প্রজেক্ট ম্যাপ বলছে। ঠিক বলেছিস, আমি আঙুল রাখলাম
সেই পাকুড়গাছটার গোড়ায়- এই হচ্ছে আমাদের পাকুড়গাছ। আচ্ছা, একটা বিষয় কী খেয়াল করেছিলে, লোক-
লস্করসহ যে তিনদিন আমরা পাকুড়গাছটির পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম আর দেখেছিলাম প্লাটুন প্লাটুন কালো
পিঁপড়ের সতর্ক টহল জারি থাকতে, তার কোন একটা দিনও কোন জন-মানুষকে কাছেপিঠে দেখলাম না ! অথচ
পাকুড় গাছটির তলা কত স্ন্দুর ঝকঝকে তকতকে, মনে হচ্ছিল যেন মানুষের মেলা বসে সারা দিন- প্রতিদিন।
সাথে শ্যামা যোগ করল, তবে অনেক দূরে দূরেÑ বিক্ষিপ্ত জটলা ছিল নারী পুরুষের; যে শাখা-প্রশাখাগুলো
অবশিষ্ট আছে এখনো তাতে ছটফট করছিল নানান বর্ণের- হলুদ, খয়েরি, বাদামি, ছোট, বড়, মাঝারি অনেক
অনেক পাখপাখালি; নিদারুন এক নীরব হাহাকার ঘিরে রেখেছিল পাকুড়গাছের চারপাশ। মিঠুনের অবশ্য ওসবে
খুব একটা খেয়াল ছিল না; সে মেতেছিল শিকড়ে সাজিয়ে রাখা নানান জাতের ফুল, ফল, খৈ-কলা আর সাজ-
সজ্জার মুন্সিয়ানা নিয়ে।
হ্যাঁ, ফিরে আসবার পথে একজন বয়সি নারীকে আমি প্রথমদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- এমন পাকুড়গাছ এই
এলাকায় আর কটি আছে ? নারীটি বললেন- তিনি নাকি তার দাদার কাছে শুনেছেন, এখানে ঘন বন ছিল একদিন;
কিন্তু এখন নেই কিছুই, উজাড় হতে হতে সব সাফ-সুতরো । আগবাড়িয়ে আরেকজন মাঝবয়স্ক লোক তখন
বললেন, এই পাকুড়গাছই ঠেকিয়ে রেখেছে ঐ বনের যা কিছু অবশেষ এখন অব্দি টিকে আছে ।
পলাশ খাতার নোট দেখিয়ে বলল : ঐ দেখ, তুই একজনকে বলেছিলে, তাদের জীবন এবং জীবিকার নিরিখে এই
পাকুড়গাছটিকে তারা কীভাবে দেখেন। লোকটি এমনভাবে তাচ্ছল্যের সাথে বললেন, আমার এখনো মনে আছে-
আহাম্মকের মতো কথা কইলেন বাবা ! সকাল বিকাল যখন এই পাকুড়গাছটার শিকড়-বাকড় আর ঝাঁকড়া মাথার
দিকে তাকাই, বিশ্বাস যানÑ তখন গাছ নয়, নিজেদের সিনা দেখতে পাই আমরা !
কিন্তু তমাল সব কিছু এলোমেলো করে দিল আচমকাই।
এই যে শুনছেন বাছাধনরা, জানেন না বোধ হয়, ঐ যে দেখেন- ডিজিটিাল সিকিউরিটি এক্ট হয়ে গেছে; কয়েকজন
এখন লাল ঘরে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছেন। অতএব রিপোর্ট-টিপোর্ট লিখবেন লিখেন, কিন্তু যা তা লিখতে


যাবেন না- সাবধান। হাত-মুখটাকে বাগে রাখতে হবে, না হলে দুঃখ আছে কপালে বললাম। পলাশ বেশ বিরক্ত হল,
আহা রাখ তো তমাল ! শোন রিমি, আমরা কিন্তু দেখতে চাচ্ছি, এই পাকুড়গাছটা মানুষের সংসার-কর্মে,
প্রাকৃতিক জীবনে- আর্থসামাজিক চৌহদ্দায় কীরকম প্রভাব ফেলছে–
তমালের বোধ করি জেদ চেপে গেলÑ মানুষের কথা, ভাষা, কিংবা চিন্তাকে রুদ্ধ করে দেয়া হলে কোন আর্থ-
সামজিক প্রভাব পড়বে না বলছিস তুই ?
কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে। পাকুড়গাছের থাকা না থাকা আর মানুষের চিন্তার জগতকে বন্দি করে রাখা,
কোনটা বেশি জরুরি- বেশ ভাবনায় পড়লাম আমরা ।
কিন্তু মিঠুন ভাবছে অন্য কথা; আরো এক কদম গলা চড়া করে তমালের ওপর চড়াও হল মিঠুন : এই খবর নিয়ে
এসে হাফাচ্ছিস তুই ? শোন তমাল, তুই এতোক্ষণ কোথায় ছিলে, কোথায় যাবে, কী খাবে, কোথায় শোবে- এক ফুঁ
দিয়ে সব বলে দিতে পারি চাইলেই আমি। জ্বিন পরী, নাকি পীর-সাধক হয়ে গেলি তুই- রিমি তাচ্ছল্যের সাথে
বলল। হা রে বাছা হা ! তুই কোথায় যাচ্ছিস, কী করছিস, কার সাথে কথা বলছিস- কী সে কথা- সব, সব এখন
নজরদারি করা হবে চব্বিশ ঘন্টা। সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের গতিবিধি, চালচলন, আচরণ, বিচরণ, অভ্যাস-
এমনকি, কার ভাবনা কী অথবা কেমন, রক্তপ্রবাহের গতি, প্রকৃতি, ইন্দ্রিয় অনুভূতি- সব এখন ট্র্যাকিং-
এর আওতায় আসছে। রিমি একেবারে লাফ দিয়ে ওঠে। আ-রে জানে মন, এখন যাও কোথা দেখব ! আমাকে খাঁ খাঁ
রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে ডেটিং করবা আরেক ছুড়ির লগে ? দাড়াও এইবার খেলা জমবে ভালো ! তমাল
দাঁড়িয়েই ছিল, দাঁত-মুখ খিঁচে জোর তালিয়া বাজাতে লাগলÑ বাহ বেশ বেশ, ফয়েজ স্যারের বকাঝকার মাহাত্ম্য
এবেলা আচ্ছা করে চিচিংফাক করে দিব, বেডরুমের সব ঝারিজুরি ফাঁস করেই ছাড়ব ইনশাল্লাহ ! হুহ ! কী
খাটিয়েই না মারছে শালা !
পলাশ এবার বেশ করে ধমক ঝাড়ল, কী শুরু করলি তোরা বল দেখি ! থাম ভাই থাম, যা হবার হবে, এখন নে ধর,
রিপোর্টটার একটা গতি করি আগে।
আমরা যখন আবারো সাইট ম্যাপের ওপর মনোযোগ দিচ্ছি- তখন, কেউই বোধকরি ভাবিনি প্রজেক্টের তরুণ
সুপারভাইজার মুমিনসাব, যার সাথে এ কয়দিনে আমাদের বেশ একটা ভাবসাব জমে গিয়েছে- আসবে এই
অসময়ে। নেন, বিকেলেই গাছ থেকে পাড়লাম- একেবারে জ্যান্ত, কামড় দিয়ে দেখেন স্যার। এত্তোগুলো ঢাউস
সাইজের পেয়ারা। লাফ দিয়ে উঠে রিমি। গাছ থেকে পেড়ে এনেছেন ? এখনই ? ইস কী সৌভাগ্য ! কিন্তু মিঠুনের
চোখ মুমিনসাবের বাম হাতে ঝুলানো ব্যাগের দিকে। কী এটাতে মুমিন সাহেব ? রক্ত চুইয়ে পড়ছে মনে হচ্ছে ! না
না ডরাইয়েন না স্যার, এ-ই কয়েকটা সরালি হাঁসÑ প্রজেক্ট স্যার পাডাইলেন; নিজেদের ইন্ডাস্ট্রিরÑ
একেবারে নিজস্ব তৈরী-জাত স্যার ! মুমিনসাব ব্যাগটা নাচাতে নাচাতে হনহন করে কিচেন শেডের দিকে পা
চালাল, তার সাথে হেঁটে চলল লাল লাল রক্তের ফোটা।
কী বলব আমরা ! থ মেরে গেলাম । সূর্য তখন বিলের ওপারে নাই হয়ে গেছে।

চারিদিকে সুনসান নীরবতা। কোন চিৎকার নেই, চেচামেচি নেই, যানবাহনের ধোঁয়া নেই, শব্দ নেই, ঘোড়ার
হ্রেসা রব, হৈচৈ, মিছিল, স্লোগান, হুইসেল, বুটের ধপধপ- কিছুই নেই। কী এক দমবদ্ধ অবস্থা; পাজর, কণ্ঠ,
গ্রীবা, মাথা, মগজÑ সব, সবকিছু যেন অপহৃত হয়ে গেছে, এক অদৃশ্য বেপরোয়া গ্রহণছায়া ঘিরে আছে
আমাদেরÑ আমাদের ভূত ভবিষ্যৎ। দোয়েল, ফিঙে, লেজজোলার কিচিরমিচির, ঝিঁঝিঁর একটানা কোরাস,
জলপ্লাবিত ব্যাঙের ঘ্যাঁৎ ঘোঁৎ- সবকিছুর স্বর ও স্বরবর্ণসমূহ আমূল বদলে গিয়ে হিসহিস করছে যেন।
অথবা ভয়, ভীতি, আতঙ্ক, অথবা অস্থিরতা, শঙ্কা- এক অনির্দিষ্ট দোলায় কেবল দুলছেই যেন।
ভাল্লাগছিল না একেবারেই। সন্ধ্যার পর থেকে সবাই যে যার রুমে, একা একা। শ্যামা বসে আছে রিমোর্ট হাতে
নিয়ে লিভিংরুমের সোফায় কাঠ হয়ে । খুব একা হতে মন আনচান করে আমারও, চোখ মুখ মাথা- সারা দেহটার
ভেতর সেধিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচি। চিলেকোঠাটা আমিই পছন্দ করেছিলাম; পাশের খাটে মিঠুনও নাই


দেখছি; সেখানটার সিঙ্গেল খাটে আধশোয়া হয়ে স্মার্টফোন সহায় করে শুয়ে থাকি। নানান নিউজ- কোনটা
সত্য. কোনটা মিথ্যে, কোনটা অর্ধ্ব সত্য, কোনটার ভেতর কী মতলব বুঝবার চেষ্টা করি। ঢু মারি ফেসবুকে।
সারা নিউজফিড ভরে আছে ভয়, ভীতি আর শঙ্কায়। পাশাপাশি আছে নানান ফান ভিডিও, প্রাণশক্তি বটে
মানুষের ! কিন্তু একটা খবর একেবারে ভীত করে তোলে আমাকে। খুব দূরে নয় আমাদের এখান থেকে,
নেত্রকোনারই এক গ্রাম- সেখানকার এক নারী গার্মেন্ট শ্রমিক ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছেন শুনে
কোয়ারেন্টাইনের বাহানায় বাড়ি ঘেরাও করে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে কয়েক যুবক। নারীটির দুটি শিশু, একটি
শিশু কান্না করছে বুকের দুধ খাবে বলে। শিশুটির ছবিও ভাসছে, পা দিয়ে লাথি দিচ্ছে সমানে যে ই কাছে যাচ্ছে।
কী হচ্ছে এসব ?

কিন্তু এইসব যা কিছু, টুকরা-টাকরা অনাবশ্যক জঞ্জালের মতো- তার সবকিছুকে খারিজ করে দিয়ে রাতের
খাবার টেবিল গরম হয়ে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিরি আটাশ ভাতের ভাঁপ আর মশলার মগজ-তাতানো সুবাসে
তখন মৌতাত চারপাশ। অন্যবিধ প্রাকৃত অপ্রাকৃত সকল ভাব-অনুভাবকে বাতিল করে দিয়ে বড় হয়ে দেখা
দিল- রোগতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের শাড়ি, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভুলভাল উচ্চারণ এবং এন
নাইনটিফাইভ মাস্কের কান্ডকারখানা ।
রিমি মিঠুনের পিন্ডি চটকাতে লাগল গজগজ করতে করতে : তোরা যে কী, একজন মানুষের শাড়ী পরা নিয়ে
জেলাস ফিল করতে রুচিতে বাধে না তোদের ?
আমাদের রুচি কবে খুব উন্নত আর সভ্য ছিল বল ? আসল কথা হচ্ছে- ঐ যে বললি জেলাস, পুরুষ মানসিকতা,
একজন নারী- সে আবার সবার কর্তা হয়ে ওঠে কেমন করে এ্যাঁ ? পলাশের কথায় মিঠুন হামলে পড়ছে দেখে
রেফারিংয়ের ভূমিকা নিতে হল আমাকেই। তোরা থাম ভাই, নারী আর পুরুষ নিয়ে বিতর্কটার দিকে আগাইস না
তোরা, দোহাই ! নানান তত্ত্ব, ইজম আর বাদ নিয়ে এমনিতেই বড় ফ্যাসাদে আছি। পলাশ অভয় দিল- না,
এখানে মূল বিষয় হচ্ছে শক্তি এবং ক্ষমতা, ক্ষমতাই নির্ধারণ করে দেয় পুরুষ কিংবা পুরুষ মানসিকতা।
নারীও ক্ষমতা পেলে কীভাবে মানসিকতায় পুরুষ হয়ে উঠতে পারে তা কী আমরা দেখছি না প্রতিদিন ?
রিমি এবার কিছুটা ঠান্ডা হল বলে মনে হল। সে কথা হোক একশবার, আর আমার এও মনে হয়Ñ এইসব সস্তা
বাদ কিংবা বিদ্বেষ মানুষ পরিচয়কে দমিয়ে রাখতেই ছেড়ে দেওয়া হয় মাঠে। ঠিক, নানান ব্যর্থতা ঢাকতে
বিভিন্ন ইস্যুগুলো যেভাবে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, যাতে মজা মারতে পারে ইডিওটগুলো !
বাদ দে তো ভাই, খাবারের মজাটাই শেষ করে দিলে তোরা !
সবাই হো হো করে ডাইনিং টেবিল কাঁপিয়ে দিল আর গোগ্রাসে গিলতে লাগল ইন্ডাস্ট্রি রচিত সরালি হাঁসের
পরিযায়ী বুক ।

গুরুপাক কিনা বুঝতে পারছি না- ঘুম আসছে না একেবারেই, খালি ছুকা ঢেকুর উঠছে, মুখ ভরে যাচ্ছে অবাঞ্চিত
লালায়। মিঠুন তখনো বিছানায় আসেনি, এপাশ ওপাশ করলাম অনেক্ষণ। নানান কথা এসে ভীড় করতে লাগল;
বিচ্ছিন্ন, বিস্রস্ত। একবার মনে হল ল্যাপটপ নিয়ে বসি । না, ডাইরি নিয়েই বসলাম।
১৩ মে, ২০২০ :
ঘরবন্দি থাকবার আজ ঊনপঞ্চাশ দিন। চার দেয়ালের মধ্যে এক দন্ডিত জীবন। একমাত্র নিজেকে নিয়ে,
নিজের প্রাণটা নিয়ে আমি, আমরা, সবাই কী এক ভয়াবহ স্বার্থপরতার আগলে আটকে আছি। আমরা কী
কখনো ভেবেছিলাম- এইভাবে পরিবার পরিজন, আত্মীয়, প্রতিবেশি, বন্ধু, বান্ধব- সমাজ সভ্যতা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকব দিনের পর দিন ?


নিজেকে বড় একা লাগে; অসহায়, ক্ষয়িষ্ণু আর নির্জীব বলে মনে হয়। সামনে দেখতে পাই জরা, ভয়, অন্ধত্ব
বিস্তার লাভ করছে ক্রমেই। দলিত,পীড়িত মানুষের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কাফেলা। একা, বড় একা !
হঠাৎ মনে হল- গেল কোথায় মিঠুন আজ। না, সব রুমেরই লাইট অফ, বারান্দায়ও নেই। পা বাড়ালাম মাঠের
দিকে। কালো অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে আছে মিঠুন, একা। তারাদের নিচে মিঠুনের ছায়া ছায়া অবয়ব।
মনটা ভিজে গেল। মনে পড়ল তার বোনটার কথা, দুই পা হারানো বাবার কথা। রেললাইন আর লাল সবুজ নিশানের
সাথে যার জীবন বাঁধা ছিল আষ্টেপিষ্টে; সেই রেল লাইনই কেড়ে নিল ছুটে চলবার দুটি পা একদিন। আর মিঠুনের
বোনটি, তীব্র ঝাকুনি দিয়ে আটকে যাওয়া নিশানাহীন ঘর-সংসারটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চার-
চারটি ছোট ভাই-বোনের হামাগুড়ির কাছে সঙ্গ, সঙ্গম কিংবা সংসার, চাওয়াÑ মরে গেছে সেই কবেই ! থাক,
বসেই থাক মিঠুন, কী দরকার খামোকা ব্যাথা বাড়ানোর !
চোখ এবং বুকটাকে পুটলি বেঁধে অন্ধকারে সেঁধিয়ে যাই, যখন রাত প্রায় তিনটের কাছাকাছি।

আবারো মিঠুনের তাড়া, সকাল হয়েছে সবেমাত্র। রিমির তৈরী করা রিপোর্ট মিঠুনের হাতে, কিন্তু দেখা গেল-
রিমির রিপোর্টজুড়ে বিস্তর হাবিজাবিতে ভরা :
বাহ, কেমন অবস্থা দেখ- যেখানে প্রতিদিন মানুষ মরছে অপঘাতে, লাঠিপেটায়, গুজবে, গণপিটুনিতে, রাস্তায়-
কোন বিকার নেই; আর আজ ভাইরাসে যেন কেউ না মরে তার জন্য কী হৈ চৈ শোরগোল ! সব বন্ধ করে দাও !
এইসব কী মানুষকে বাঁচানোর জন্য নাকি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ? এতোবড় একটা শহর ঢাকা, কত কত ভবন,
অট্টালিকা, কত কত গাড়ি, কত জৌলুস, রঙবেরঙের জীবন; আর অপর পাশে ? লাখো মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই
নেই, কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। এই মানুষেরা কী এই ঢাকা শহরের রং ধুয়ে খাবে ? মানুষ গ্রামের পথে লাইন
ধরেছে, তার জন্যে কত গালাগাল ! এই ইট-সুরকির শহরে, বৃক্ষহীন, আলো-বাতাসহীন নগরেÑ বাস্তুহীন,
কপর্দকহীন হয়ে কী করবে তারা ?
হকার, রিক্সাওয়ালা, নির্মাণ শ্রমিক, রঙমিস্ত্রী, ফেরিওয়ালা, ঘাটশ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী- এদের কী
সমাজ আছে, দল আছে গোষ্ঠী আছে এই নগরে-বন্দরে ? কয়দিন খাবে বসে বসে ? এদেরকে গালি দিচ্ছেন কষে;
দেন, কিন্তু আটকাবেন না, ওরা যাক না ড্রামের ভেতর হয়ে, ট্রাকের ত্রিপলমোড়া হয়ে, পায়ে হেঁটে; অন্তত
নিজের গাঁয়ে গেলে আর কিছু না হোক নিজের আপনজন, নিজের মাটি, গাছ, বৃক্ষ, লতার সংলগ্ন হয়ে খড়-
বিছালির একটা ওম তো পাবে সে ? সিথান দেওয়ার মতো একটা গাছতলা, উদর সামলানোর মতো কচু ঘেটু থেকে
কেন বঞ্চিত করে রাখবেন তাদেরকে ?
ক্ষোভে দুঃখে চোখ-মুখ-মাথা-মগজ জ্বলে-পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে !
তারপর বড় বড় করে লিখে রেখেছে :
বৃহৎ প্রাণিকূলের সমাজ-সংসার আলোচ্য পাকুড়গাছ এক দন্ডিতকালের নিদারুন হাহাকার !

আমরা বসলাম, কথা বললাম, তর্ক করলাম, যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে হৈ চৈ করলাম এবং অতঃপর আমরা
একমত হলাম- এই পাকুড়গাছকে বাঁচাতে আমরাও থাকব গ্রামবাসীর সাথে। আরো সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে
চাহিত রিপোর্ট হিসাবে এই কথা-ক’টিই পাঠিয়ে দেব ঢাকা অফিসে।

১০
সারাদিন একটা উত্তেজনার মধ্যে কাটল। বিকেলের দিকে যখন মনটা বেশ হালকা লাগছিল, তখন রিমিকে
বললামÑ চল ঘুরে আসি।
ঘরে থাকুন আর লকডাউনের নিকুচি করে রিমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওদের ইন্ডাস্ট্রি দেখতে। হাঁটতে
হাঁটতে বেশ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি আমরা। দুই পাশে সারি করে লাগোনো গাছ-গাছালিÑ সুন্দর, মনোরম। তারপর
চোখ আটকে গেল পুদিনা পাতার বিশাল এক বাগান দেখে; কী চমৎকারভাবে চকচক করছে পাতাগুলো। তারপর
আছে সারি সারি তুলসি গাছ, নিম গাছ, ওলটকমল, লজ্জাবতী, ভাটগাছ; নানান ধরণের সবজিবাগান- দেখতে খুব
সাধারণ মনে হচ্ছে না; অনেকগুলোরই প্যাটেন্ট করা বলে জানাল সুপারভাইজার। আমরা হাঁটছি আর অবাক
হচ্ছি : বিশাল পুকুরে কাঁকড়ার চাষ করা হয়েছে- বিশাল বড় বড়, পাশেই দাড়কিনা মাছের বেশ বড়সড়ো এক
টানেল- স্রোত সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে, কী অনাবিলভাবে সাঁতার কাটছে । ব্যাঙের একটা পুকুর, নাক
পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছে কিন্তু কোন হাঁক-ডাক নেই তাদের, শুধু চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। দেখলাম একটা
বিরাট পুকুরে কিলবিল করছে হাজার হাজার গুঁইসাপ; কুচিয়া সাপের আরেকটা পুকুর তার কিনার ঘেষেই। তার
কিছুটা দূরে গেলে দেখা মেলে বেজির একটা ঘের, তক্ককের খাঁচা- লেজ নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোটবড় অসংখ্য
তক্কক। আরেকদিকে ছোট নেট দিয়ে ঘেরাও দিয়ে রাখা হয়েছে ঘাসফড়িঙের ছোট ছোট অনেকগুলো কামরা।
কখন যে সন্ধ্যা হয়েছে বুঝতেই পারি নি। ফেরৎপথ ধরতে হল। কোথায় দিয়ে ঢুকেছি আর কোথায় দিয়ে
বেরুচ্ছি, রহস্য রহস্য লাগছে কেবল। কিছুদূর গেলে দেখতে পাইÑ এক আকন্দ গাছের বাগান আর তার ফাঁক
গলে টিকরে বেরুচ্ছে ছেঁড়াছেঁড়া জোনাকির আলো। খুব মন খারাপ হয় আমাদের। খানিক দাঁড়াবার ইচ্ছেটাকে
দমিয়ে রেখে ডানদিকে সোজা হাঁটতে থাকি আমরা বেশ দ্রুত পদক্ষেপে। কিন্তু থামতেই হল, হাফ ধরে গেছে
মনে হচ্ছে, ভীষণ তেষ্টাও লাগছে। পাশেই পড়ল বিশাল বড়ো এক শেড। উঁকি দিল রিমিই প্রথম, ওমনি থতমত
খেয়ে পিছিয়ে এল এক ধাক্কায়। হাঁফাতে লাগল রিমি। উঁকি দিলাম ভেতরে, সারাটা শেডজুড়ে এক এলাহি কারবার
! চকচকে ছুরি আর গ্লাভসপরা আঙুল চলছে ইস্পাতের ফলার মতো; ছালবিহীন অগুনতি তক্কক আর
গুঁইসাপের আস্ত শরীর- মেশিন দিয়ে সাইজ করা হচ্ছে একই মাপে; রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে পাকা ড্রেন দিয়ে
হড়হড় করে। সেখান থেকে পাশের ইউনিট- থরে থরে সাজানো এনামেলের কৌটা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর।
রিমি আর দাঁড়াতে পারছে না, ভেঙেচুরে নুয়ে পড়ছে সে। শুধু বিড়বিড় করে একটা কথাই বলতে পারল : এই
এভাবেই জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড খাদ্যসামগ্রীর কৌটা পৌঁছে যাচ্ছে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক
প্রান্তে !
আমি তখন চোখে অন্ধকার দেখছি, কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না রিমিকে। বমি করে চলেছে অনবরত।
কোনমতে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে এলাম তাকে; অমনি সবকিছু নিয়ে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। শাওয়ারের শব্দ
শোনা যাচ্ছে প্রায় দুইঘন্টা থেকে।
সকালে শ্যামার চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙল। হায় হায়, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে রিমির ! আর বিরামহীনভাবে নাক
দিয়ে ঝরে পড়ছে টপটপ জলের ফোটা, দমকে দমকে বেরিয়ে আসছে কাশির পর কাশি। ঘটনা রাষ্ট্র হয়ে গেল
ঐদিনই; রিমিকে আর রাখা গেল না, সবারই এক কথা- ঠিক হবে না সেটা। রিমিকে আইসোলেশনে যেতে হল
নেত্রকোনার জেলা হাসপাতালে। রাত থেকে মিঠুনও হাঁচি দিতে শুরু করল। এক ভীতি তখন ঘিরে ধরেছে
আমাদের সকলকে। মিঠুনকেও সরিয়ে নেওয়া হল পাশের একলা এক ঘরে।
শ্যামার তখন মরো মরো অবস্থা, ভীষণ ঘাবড়ে গেল সে। অনেক চেষ্টার পর তার এক কাজিন এসে
নেত্রকোনায় নিয়ে গেলেন তাকে। তমাল, পলাশও আলাদা; অনেক দূরে দূরে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা, কেউ কারো
শব্দ পাই না, ঘ্রান পাই না- ছুঁতে পারি না একজন অন্যজনকে !
ভাবতে পারছি না কিছুই। সর্দি, কাশি, জ্বর- কিছুই নেই, তবু এক বিভীষিকা ঘিরে ধরেছে পা থেকে মাথা
পর্যন্ত। দুঃসহ একলা জীবন, কত আর বসে থাকা যায় ! অতি সন্তর্পণে বের হই পা টিপে টিপে। মাটির সড়ক
ধরে হেঁটে যাই সেই পাকুড়গাছের খোঁজে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে- পাকুড়গাছ নয়, দাঁড়িয়ে আছে এক কিম্ভুত
চেহারার বিচ্ছিন্ন কঙ্কাল যেন। আরো সামনে এগোই, বিকট শব্দে কাঁপছে চারদিক, দূর-বিস্তৃত শাখা-
প্রশাখাগুলো ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে নিমিষেই- শালিক, খঞ্জনা, ফিঙেগুলো
অবিরাম চক্কর দিচ্ছে গোল হয়ে। একলা, উবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটির গা বেয়ে বয়ে চলেছে সাদা সাদা রক্ত।
পলাশকেও দেখতে পাই হারিয়ে যাওয়া এক বিন্দুর মতো, নুয়ে আছে ঐ দূর সীমানার কাছাকাছি আর হাতড়ে

১১
চলেছে পাকুড়গাছের ভেজা ভেজা ছায়াসমূহ। কিন্তু অচিরেই সবকিছুকে ধুমড়েমুচড়ে দিয়ে, পাকুড়গাছের ওপর
দিয়ে নির্মিত হতে থাকে ব্যতিব্যস্ত এক বহুজাতিক মহাসড়ক।

সৈয়দ মনির হেলাল। লেখক ও আইনজীবি। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের সিলেট।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..