দস্তয়ভস্কির ‘জুয়াড়ি’, একটি উপন্যাস এবং প্রেমের জন্ম

জাকির তালুকদার
গল্প
Bengali
দস্তয়ভস্কির ‘জুয়াড়ি’, একটি উপন্যাস এবং প্রেমের জন্ম

দস্তয়ভস্কি জুয়ায় প্রচ- আসক্ত ছিলেন ১৮৬৩ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত। রুলেত নামের জুয়া খেলতেন তিনি। নেশার সূত্রপাত ফ্রান্সের উনসবাদেন নামের শহরে। ভাগ্য বিপর্যয়ের চূড়ান্ত দশায় পৌঁছে যান তিনি এই নেশার কারণে। এই সময় ভাই মিখাইলকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘আমি আমার পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। এক ঘণ্টার এক চতুর্থাংশ সময়ে আমি জিতেছি ৬০০ ফ্রাঁ। এটা আমার জেতার ক্ষুধাকে উসকে দেয়। তারপরেই আমি হারতে শুরু করি; নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না, সর্বস্ব হারি। এরপর আমি আমার শেষ অর্থ নিয়ে খেলতে যাই…। আমি সেই সাময়িক সৌভাগ্যের ছলনাতে ৩৫টি সোনার মোহর বাজি ধরি এবং সব হেরে ফতুর হই।’

সত্যিকারের লেখকের জীবনে কোনো অভিজ্ঞতাই অকাজের নয়। এই জুয়ার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে দস্তয়ভস্কিকে ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসটি লিখতে সাহায্য করেছিল। এবং এই উপন্যাসটি রচনার মাধ্যমে দস্তয়ভস্কি রক্ষা পেয়েছিলেন হাজতবাস থেকে, রক্ষা পেয়েছিল তাঁর রচনাবলীর স্বত্ত্ব অর্থগৃধœ প্রকাশকের কুক্ষিগত হওয়ার হাত থেকে।

‘জুয়াড়ি’ উপন্যাস হিসাবেও যেমন অসাধারণ, তার রচনার পেছনের কারণ এবং রচনার পদ্ধতিও নাটকের মতোই টানটান উত্তেজনার। এই উপন্যাস রচনার সাথে সর্বতোভাবে সংশ্লিষ্ট আনা গ্রিগোরিয়েভ্নার জবানীতে উঠে আসে সেই নাটকীয় বিবরণ, আসে দস্তয়ভস্কির জীবনের কিছুটা অজানা অংশও।

দুই)

দস্তয়ভস্কি এক সত্যিকারের মর্মভেদী চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন ১৮৬৬ সালে। তার ভাই মিখাইল মারা গেছেন। ভাইয়ের সম্পাদিত ‘ভ্রেমিয়া’ পত্রিকাটির যত ঋণ ছিল দস্তয়ভস্কি সেগুলি নিজের কাঁধে তুলে নেন। সবগুলো ঋণই ছিল সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারপত্রের আকারে। কাজেই পাওনাদাররা দস্তয়ভস্কিকে এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিলেন না। তারা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন যে দস্তয়ভস্কির স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হবে, তাকে হাজতে ঢোকানো হবে। সেই সময়কার আইন অনুসারে সত্যিসত্যিই দস্তয়ভস্কিকে হাজতবাস করানো সম্ভব ছিল। জরুরি ভিত্তিতে শোধ দিতে হবে, এমন ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল তিন হাজার রুবলে। দস্তয়ভস্কি কোনোভাবেই অর্থ সংগ্রহ করতে পারলেন না। ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছে তিন হাজার রুবল নিয়ে এলেন প্রকাশক স্তেলোভস্কি। তবে তার শর্তগুলো ছিল যথেষ্ট অবমাননাকর। দস্তয়ভস্কির প্রকাশিত রচনার তিন খ-ের সংকলনের স্বত্ত্ব তিন হাজার রুবলের বিনিময়ে কিনে নিলেন স্তেলোভস্কি। তবে শর্ত ছিল এর সঙ্গে নতুন লেখা একটি  উপন্যাসও দিতে হবে, যা হবে কমপক্ষে সাত ফর্মার। সময়সীমা ১৮৬৬ সালের ১ নভেম্বর। দস্তয়ভস্কি যদি ১ নভেম্বরের মধ্যে উপন্যাসটি জমা দিতে না পারেন, তাহলে বিপুল অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে তাঁকে। আরও একমাস পরেও, অর্থাৎ ১ ডিসেম্বরের মধ্যেও উপন্যাস জমা দিতে না পারলে, দস্তয়ভস্কির সকল রচনার স্বত্ত্বাধিকার চিরতরে চলে যাবে স্তেলোভস্কির অধিকারে।

১৮৬৬ সালের বেশিরভাগ সময়ই দস্তয়ভস্কি ব্যস্ত ছিলেন ‘অপরাধ ও শাস্তি’ উপন্যাসটির কাজে। স্তেলোভস্কির শর্তের সমন যখন এল, তখন তাঁর হাতে সময় রয়েছে ছয় থেকে আট সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে কি সাত ফর্মার একটি উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব?

দস্তয়ভস্কির তিন ঘনিষ্ট লেখকবন্ধু মাইকভ, মিলিউকভ এবং দোলগোমোস্তিয়েভ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁরা প্রত্যেকেই উপন্যাসের একটা করে অংশ লিখে দিতে চাইলেন। তারা লেখা শেষ করে সেগুলি দস্তয়ভস্কির কাছে জমা দেবেন। তিনি সম্পাদনা করে নেবেন। কিন্তু দস্তয়ভস্কি বন্ধুদের ধন্যবাদ জানালেও প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলেন। অন্যের লেখায় নিজের নাম স্বাক্ষরের বদলে তিনি বরং সমস্ত রচনার স্বত্ত্ব হারাতেও প্রস্তুত আছেন।

তখন মিলিউকভ প্রস্তাব করলেন যে একজন স্টেনোগ্রাফারের সাহায্য নিলে হয়তো দস্তয়ভস্কি  উপন্যাসটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিখে শেষ করতে পারবেন।

এই প্রস্তাব গৃহীত হলো।

আর স্টেনোগ্রাফার হিসাবে দস্তয়ভস্কির জীবনে প্রবেশ করলেন আনা গ্রিগোরিয়েভনা। তারিখটা ছিল ৪ অক্টোবর ১৮৬৬।

আনা ছিলেন পি.এম. ওলখিনের স্টেনোগ্রাফি ক্লাসের ছাত্রী। তখন তার বয়স কুড়ি বৎসর। নিম্নবিত্ত অথচ ভদ্র পরিবারের মেয়ে। ওলখিন আগের দিন আনাকে বলেন যে শর্টহ্যান্ডে আনার দক্ষতার কারণে তিনি তাকে দস্তয়ভস্কির উপন্যাস রচনার সহযোগী হিসাবে নির্বাচন করেছেন। আনা এই কাজের জন্য ৫০ রুবল মজুরি পাবেন। ওলখিন আনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ঠিকানা এবং সময় লেখা চিরকুট- ‘স্তোলিয়ারনি লেন এবং মালাইয়া মেশ্চানস্কায়া স্ট্রিটের কোণে আলোনকিন হাউস, ১৩ নং ফ্ল্যাট (দস্তয়ভস্কিকে চাইবেন)। দয়া করে, আগামীকাল ঠিক সাড়ে এগারোটায়- আগেও না, পরেও না।’

পরের দিন, ঠিক এগারোটা পঁচিশ মিনিটে আনা আলোনকিন হাউসে পৌঁছে গেটের মুখে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন ১৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি কোথায়।

দস্তয়ভস্কির বাসার কাজের মহিলা দরজা খুললেন। তার কাঁধের ওপর একটা চেককাটা সবুজ শাল। কিছুদিন আগেই আনা পড়েছেন ‘অপরাধ ও শাস্তি’। এই শালটা দেখতে পাবেন বলে তিনি আগে থেকেই আশা করছিলেন। বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিং রুমে পৌঁছে আনা সন্তুষ্টির সঙ্গে খেয়াল করলেন যে, দেয়াল ঘড়িতে ঠিক ঠিক সময় এগারোটা তিরিশ মিনিট।

দুই মিনিট পরে দস্তয়ভস্কি ঘরে ঢুকলেন। আনাকে নিয়ে গেলেন নিজের লেখার ঘরে। আনা খেয়াল করলেন, দস্তয়ভস্কির লেখার ঘরটি বেশ বড়। দুটো জানালা। ঘরের একেবারে একপ্রান্তে একটা বাদামি রঙের ডিভান, তার সামনে গোলাকার টেবিল লাল কাপড়ের আসবাবে সাজানো। টেবিলের উপরে একটি ল্যাম্প, দুটি কি তিনটি অ্যালবাম। হাতলওয়ালা চেয়ার এবং গদিমোড়া সোজা চেয়ারে চারপাশ ঘেরা। ডিভানের উপরে ঝুলছে আখরোট কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ভীষণ রুগ্ন এক মহিলার ছবি। দুই জানালার মাঝের দেয়ালে একটা কালো ফ্রেমে ঝোলানো বিশাল আয়না। আয়নার তুলনায় জায়গাটা বেশ চওড়া এবং ডানদিকের জানালার গায়ে লাগানো, কাজেই দেখতে ভালো লাগছে না। প্রতিটি জানালার ধাড়িতে একটা করে সুদৃশ্য চীনা জলপাত্র। দেয়ালের গায়ে সবুজ চামড়ায় ঢাকা একটি শয্যা এবং তার গায়েই ছোট টেবিলের উপর পানির পাত্র। ঘরের উল্টোদিকেই দেয়ালের আড়াআড়ি একটা ডেস্ক। পরবর্তীতে এই ডেস্কে বসেই আনা ডিকটেশন নিতেন দস্তয়ভস্কির কাছ থেকে।

এর আগে আনা কখনো লেখক দস্তয়ভস্কিকে দেখেননি। তিনি পরিচিতি পর্বের মধ্যেই নারীসুলভ দক্ষতায় খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছিলেন দস্তয়ভস্কিকে। প্রথমে আনা লেখককে ভাবছিলেন মাঝবয়সী। কিন্তু লেখক কথা বলতে শুরু করতেই মনে হলো তাঁর বয়স বেশ কম। আনার তখন মনে হলো দস্তয়ভস্কির বয়স ৩৫ বা ৩৭ বছরের বেশি হবে না। আনার বর্ণনায়, তিনি ছিলেন মাঝারি উচ্চতার এবং নিজেকে টান টান ঋজু রাখতেন, তার হালকা বাদামি চুলে লালের আভা। বেশ তেল চকচকে এবং সুন্দর করে আঁচড়ানো। তার মধ্যে সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় লেখকের চোখজোড়া। একটার মণি বাদামি, অন্যটির মণি বেশ বড়। চোখের পুরো গোলকটা যেন ঢেকে দিয়েছিল। তার মুখের ভাবে বিবর্ণতা এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের লক্ষণ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। পরনে সেদিন ছিল ঘন নীল কাপড়ের জ্যাকেট।

প্রথম দিন উপন্যাসের কোনো কাজ করা হয়নি। আসলে দস্তয়ভস্কি নিজেই সন্দিহান ছিলেন যে এইভাবে কোনো উপন্যাস লেখা যায় কি না। তিনি আনাকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন। আনা নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন,  প্রথমে তাকে খুব কড়া এককাপ চা খেতে দেওয়া হলো। সেদিন ছিল খুব গরম। চা খাওয়ার কোনো ইচ্ছা আনার ছিল না। কিন্তু তবু ভদ্রতার খাতিরে তিনি কাপ তুলে ঠোঁটে ঠেকালেন। দস্তয়ভস্কি তাদের কথোকথনের শুরুতেই জানিয়েছিলেন যে তিনি মৃগিরোগী। তিনি ঘরের এ দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত অনবরত পায়চারি করছিলেন আর সিগারেট টেনে চলেছিলেন। কোনো কোনোটা আধ-খাওয়া অবস্থায় ছাইদানিতে চেপে দিয়ে আবার নতুন আরেকটা ধরাচ্ছিলেন। একবার তিনি আনাকে সিগারেট অফার করলেন। আনা উত্তর দিলেন যে তিনি নিজে ধূমপান তো করেনই না, উপরন্তু কোনো মেয়ে ধূমপান করছে, এমন দৃশ্য দেখতেও পছন্দ করেন না।

দস্তয়ভস্কি তখন আনার কাজের গতি পরীক্ষা করতে চাইলেন। তিনি রুশ হেরাল্ড পত্রিকা থেকে একটা খবর শর্টহ্যান্ডে ডিকটেশন নিতে বললেন। তিনি খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছিলেন। আনা তাকে বললেন যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে যে গতিতে কথা বলে সেই গতিতেই কথা বলতে হবে লেখককে। তার চাইতে দ্রুত ডিকটেশন দেওয়া যাবে না। শর্টহ্যান্ডে লেখার পরে সেটাকে আবার পূর্ণাঙ্গ গদ্যে রূপান্তর করলেন আনা। দস্তয়ভস্কি পরীক্ষা করে দেখলেন যে আনা একটি দাঁড়ি বাদ দিয়ে গেছেন, আর একটি অক্ষর পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এই ভুলের জন্য দস্তয়ভস্কি বেশ কঠোরভাবেই বকলেন আনাকে। আনা অপমানিতা বোধ করলেও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন দস্তয়ভস্কির সেই সময়কার মানসিক অবস্থা। সেই কারণেই তিনি নিজে কাজটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রইলেন। তিনি জানালেন যে পুনর্লিখনের জন্য যে সময়টা লাগবে, তা নিয়ে লেখককে ভাবতে হবে না। আনা সেগুলি বাড়িতে করবেন রাতে। তিনি শুধু ডিকটেশন নিয়ে চলে যাবেন প্রতিদিন। আনা লিখেছেন- ‘সত্যিই তিনি উত্তেজনার ঘোরে ছিলেন এবং নিজের ভাবনাকে গুছিয়ে নেওয়া কঠিন বলে ভাবছিলেন। কোনো মুহূর্তে আমার নাম জিজ্ঞেস করছেন, কিন্তু যেন তা অবিলম্বেই ভুলে যাবার জন্য। আবার পরের মুহূর্তেই ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করতে থাকলেন, যেন বা আমি সেখানে রয়েছি তা একেবারেই ভুলে বসে আছেন।’

হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে তিনি আনাকে বললেন যে এই মুহূর্তে তিনি ডিকটেশন দেবার মতো অবস্থায় নেই। আনা কি সন্ধ্যা আটটায় আসতে পারবেন? রাতে কাজের জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন না আনা। এটা তার জন্য খুবই অসুবিধাজনক হবে। তবু তিনি কাজটা হারাতে চাইছিলেন না। তাই রাজি হয়ে গেলেন।

দুপুরটা এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাটালেন আনা। কারণ তাদের বাড়িতে গিয়ে আবার ঠিক সময়ে দস্তয়ভস্কির বাড়িতে পৌঁছানো কঠিন হবে। যথাসময়ে ফিরে এলেন লেখকের বাড়িতে। দস্তয়ভস্কি উপন্যাসের ডিকটেশন দিলেন রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত।

পরের দিন আনার পৌঁছুতে দেরি হয়েছিল আধাঘণ্টা। দস্তয়ভস্কি সেই আধাঘণ্টা কাটিয়েছিলেন খুবই টেনশন নিয়ে। তিনি ভাবছিলেন যে কাজটি কঠিন মনে হওয়ায় আনা হয়তো আর আসবেন না। আনা দেরির জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে বললেন যে, তিনি যদি কাজটা না-ও করতে চাইতেন, তাহলেও সেকথা নিজে এসে লেখককে জানিয়ে যেতেন। দস্তয়ভস্কি তখন প্রথম আনাকে জানালেন কীভাবে তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আর সেইসাথে বললেন- ‘যে জন্য আমি বেশি উদ্বিগ্ন তা হলো, পহেলা নভেম্বর আমাকে উপন্যাসটি শেষ করতে হবে। অথচ এখনো আমি তার কোনো নকশা এমনকি তৈরি করতে পারিনি। শুধু এটুকুই জানি যে, স্তেলোভস্কির ছাপায় কমপক্ষে উপন্যাসটির আয়তন হতে হবে সাত ফর্মা।’

সব কথা জানার পরে দস্তয়ভস্কির জন্য আনার হৃদয় দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রিয় লেখককে স্তেলোভস্কির ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য তিনি সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন।

বিভিন্ন কথাবার্তার মাধ্যমে দস্তয়ভস্কির মনটা হালকা করলেন আনা। এবার শুরু হলো উপন্যাসের ডিকটেশন। বিকাল চারটায় বিদায় নিলেন আনা। বিদায়ের সময় দস্তয়ভস্কি আনার হাতে তুলে দিলেন হালকা লাইন টানা একতাড়া কাগজ। জানালেন এই কাগজেই তিনি লিখে থাকেন। মার্জিনের কোন পাশটা আনাকে খালি রাখতে হবে, সেটাও জানিয়ে দিলেন।

এভাবেই লেখা এগিয়ে চলল। দস্তয়ভস্কি খুব দ্রুতই শর্টহ্যান্ডের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ। একনাগাড়ে আধাঘণ্টা করে ডিকটেশন দিতেন দস্তয়ভস্কি। আনা লিখে নিতেন শর্টহ্যান্ডে। আধাঘণ্টা কাজের পরে একটুখানি বিশ্রাম, গল্পগুজব, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা। আনার কাছে দস্তয়ভস্কি ছিলেন সত্যিকারের একজন দেবতা-লেখক। তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করার জন্য নিজের সমস্ত শ্রম নিয়োজিত করেছিলেন আনা। সারাদিন দস্তয়ভস্কি যতখানি ডিকটেশন দিতেন, রাতে বাড়িতে ফিরে সেগুলিকে পা-ুলিপিতে পরিণত করতেন আনা পুনর্লিখনের মাধ্যমে। সকালে সেগুলি তিনি তুলে দিতেন লেখকের হাতে। দস্তয়ভস্কি  কোনো পরিমার্জন বা কাটাকুটি করলে সেগুলো পৃষ্ঠা পরের দিনে আবার ফ্রেশ কপি করে এনে দিতেন আনা।

২৯ শে অক্টোবর নেওয়া হলো ‘জুয়াড়ি’র শেষ ডিকটেশন। ছাব্বিশ দিনের মধ্যে আনার সাহায্যে দস্তয়ভস্কি লিখে ফেললেন দুই কলাম পাতার সাত ফর্মার উপন্যাস। সাধারণ ছাপাতে সেটি দশ ফর্মা। আয়তন তো পাওনাদারের হিসাব। পাঠকের হিসাবে উপন্যাসটি এক পরম পাওয়া। আর এই পাওয়ার জন্য আমরা ঋণী দস্তয়ভস্কির মতো আনার কাছেও।

প্রকাশক পা-ুলিপি হাতে পেয়েও যদি বলেন যে তিনি কোনো পা-ুলিপি পাননি, তখন কী অবস্থা হবে? আনা পরামর্শ করলেন তার এক আইনজীবী আত্মীয়র সাথে। তিনি পরামর্শ দিলেন পা-ুলিপি সেই এলাকার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের কাছে জমা দিয়ে স্বাক্ষর ও সিলমোহরসহ রশিদ নিয়ে নেওয়ার। সেই কাজই করা হলো। দীর্ঘ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন দস্তয়ভস্কি।

সংযোজন: ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসের রচনার গল্প অসমাপ্ত থেকে যাবে একটি তথ্য না জানানো হলে। সেই বছরই ৮ই নভেম্বর দস্তয়ভস্কি জানালেন যে তিনি আনাকে ভালোবাসেন এবং তাকে বিয়ে করতে চান। বলাই বাহুল্য আনাও সানন্দ সম্মতি দিয়েছিলেন। খুবই সুখের হয়েছিল তাদের এই মিলন। দস্তয়ভস্কির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন সেই প্রথম পেয়েছিল সত্যিকারের ভালোবাসার পরিচর্যা।

জাকির তালুকদার। বাংলাদেশের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক। জন্ম ২০ জানুয়ারি ১৯৬৫, বাংলাদেশের নাটোরে। পিতা জহিরউদ্দিন তালুকদার ও মাতা রোকেয়া বেগম। এমবিবিএস ছাড়াও স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা, পেশায় চিকিৎসক। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: গল্প: স্বপ্নযাত্রা কিংবা উদ্বাস্তুপুরাণ (১৯৯৭), বিশ্বাসের আগুন (২০০০), কন্যা ও...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..