দহনকাল

শেলী জামান খান
মুক্তগদ্য
Bengali
দহনকাল

শেলী জামান খান

আজকাল একটু সময় পেলেই আমার শোবার ঘর সংলগ্ন ঝুলবারান্দাটিতে এসে বসি। এই উত্তরের বারান্দাটিই এখনও আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যেই খুব দমবন্ধ লাগে।তখন বারান্দার চেয়ারটিতে এসে বসলেই যেন প্রাণ ফিরে পাই।সকালের নরম রোদে শরীর মেলে দেই।ঢাকার আকাশে এখন অবাক করা ঝকঝকে রোদ।এমন পরিস্কার আকাশ বহুদিন দেখেনি ঢাকাবাসী। ক্রমে আকাশের রং বদলে যায়। বিকেলে নীলাভ আকাশে মেঘ উড়ে বেড়ায়। কোন কোন দিন একপশলা বৃষ্টি নামে। কিন্তু সেই বৃষ্টিতে তপ্ত বাতাস শীতল হয় না। শুধু ভিজে মাটি থেকে খানিকটা শোদাগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। মায়াময় সেই মাটির গন্ধ মাথার ভেতরে নেশা ধরায়।সন্ধ্যায় আকাশের পশ্চিমকোনে অস্তগামী সূর্যের সোনাগলা রোদ ঝিকমিক করে।গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে, সবুজাভ কাঁচা আমের উপর সেই আলো লুকোচুরি খেলে।

সতেরো বছর পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যখন প্রথম ফিরে এসেছিলাম, তখন ঢাকার ধুয়াশাভরা আকাশ, ধূলিময় ধূসর গাছপালা আমাকে ব্যাথিত, বিষন্ন করেছিল।কিন্তু লকডাউন যেন আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রকৃতির জন্য। কিছুদিন আগে আমার জানালার পাশের আমগাছটিতে বসে একটি বিরহী কোকিল বসন্তদিনে তার সঙ্গীকে খুঁজে ফিরতো কুহু কুহু ডাকে।তখন বাতাসে ছিল ভালোবাসা, শরীরে যৌবনের আবেগ। কিন্তু ক’দিন ধরে শুনছি, জৈষ্ঠের গরমেও সে অবিরাম গাইছে তার কুহু কুহু গান।প্রকৃতি নিজেকে শুদ্ধ করে নিচ্ছে, এ যেন তারই বার্তা!

জৈষ্ঠ্যের গরমে তপ্ত ঢাকা। গুমোট গরমে বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের তারাভরা আকাশ দেখি।চাতকের মত মেঘ দেখি, বৃষ্টির আশায়। রোজাও এখন শেষের পথে। বাসায় রোজদার, ভোজদার দু’দলই আছে। খুব পরিমিত হলেও ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ইফতার, ডিনার ও সেহরীর আয়োজন করতে হয় সবার জন্য। বাঁচার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য; পরিমিত, স্বাস্থ্যসন্মত খাবার। ভূরিভোজ বা বিলাসি কোন খাবার নয়। মিতব্যয়ীভাবেই প্রতিদিন রান্না করছি ফ্রেস খাবার।

যদিও ফেসবুক ওপেন করলেই মন চনমন করে ওঠে। রসনা অসংযত হয়ে পড়ে। মনের কী দোষ? মানুষের মন, বড় লাগামছাড়া। সাধআল্হাদে লাগাম টানা খুব কঠিন।লকডাউনে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী মানুষ। তাই ফেসবুকের আঙিনা জুড়ে চলছে রান্নাবান্না, সাজপোশাক, ঘরসাজানো, গান, কবিতা, আলোচনা আর আড্ডার ধুম। চলছে কর্তাগিন্নী দু’জনে মিলে গৃহকাজ। সমানে সমান। নানারকম লেহ্যপেয় খেতে ইচ্ছে করতেই পারে। তাই সুদৃশ্য খাবারের সুঘ্রাণে ফেসবুকের টাইমলাইন মৌ মৌ করছে। এদিকে ঘরে ঘরে কেক, দই, মিষ্টি, জিলাপীর নব্য কারিগরদের উত্থানে সনাতন কারিগরদের মাথায় হাত পড়েছে।

আমরা মানুষরা বড়ই বিচিত্র জাতি। মহামারি, দূর্যোগ, মৃত্যুও আমাদের টলাতে পারে না।ক’দিন পরই ঈদ। ঈদের উৎসবও তাই থেমে থাকবে না। যতক্ষণ শ্বাস; ততক্ষণ আশ। নতুন কাপড় ছাড়া ঈদ? নৈব নৈবচ। ইতোমধ্যেই ফেসবুক সরব হয়ে উঠেছে। খুলেছে অনেকগুলো ভার্চুয়াল দোকান। চলছে অনলাইনে পোশাক প্রদর্শন, বেঁচাকেনা।মানুষকে দাবায়ে রাখা বড়ই কঠিন। জানি, ঈদের দিন জামাতে নামাজও হবে।অনেকেই নতুন পোশাক পরবে।অনেক ঘরেই পোলাও, কোর্মা, সেমাই রান্না হবে। ফেসবুকও সয়লাব হবে সুদৃশ্য খাবারের ছবিতে।পাশাপাশি, কোন কোন পোস্টে থাকবে সদ্য চলে যাওয়া প্রিয়জনের ছবি। এভাবেই আমরা উদযাপন করব ঈদ। দাহকালের ঈদ উৎসব।

এবার ঈদ করব ঢাকায়।প্রায় আঠারো বছর পর নিজেদের বাড়িতে ঈদ। শৈশবে বড় হয়ে ওঠার, কৈশর থেকে যৌবনে পা দেয়ার, কন্যা থেকে মা হয়ে ওঠার এই বাড়ি। কে জানত, এবারের ঈদ হবে করোনাক্রান্ত দিনের লকডাউনে। হোম কোয়ারেন্টিনের আইসোলেশনে।

আমাদের বাড়িটির নাম ‘অন্তরা’। প্রতিটি বাড়ির একটি গল্প থাকে। একটি চরিত্র থাকে। আমাদের যখন শৈশব; অন্তরা’রও শৈশব চলছে। নতুন সদ্য নির্মিত বাড়ি। সদ্য নির্মিত কয়েকটা টিনের ঘর। সামনে মস্ত উঠোন। এক কোনে একটি চাপকল।চারিদিকে প্রচুর গাছপালা।বাড়ির কিছু কিছু গাছপালা এবং আমরা ভাইবোনেরা একসাথেই বড় হয়ে উঠেছি।তপোবনের মত ছায়াময়, নিরিবিলি বাড়িটি দেখে তখন সবাই খুব মুগ্ধ হত।বাড়ির পাশেই অনেক স্মৃতিবিজরিত একটি দোতলা সাদা মসজিদ।মসজিদটির জন্মলগ্ন থেকে আব্বা এর সাথে জড়িত ছিলেন।মসজিদ নির্মানে আব্বার সামান্য হলেও অবদান আছে।যদিও কিছুই আর আগের মত নেই।আব্বা চলে গেছেন বহুদিন আগে। চলে গেছেন আব্বার সঙ্গীসাথী পাড়ার খালু চাচারাও। তাদের পরিবারের কে কোথায় আছে এখন, তাও জানা নেই। কিন্তু একসময় তাঁরাই ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। ধীরে ধীরে আব্বার অভাববোধের তীব্রতাও কমে এসেছে। তারপরও বহুবার ঈদ উদাযাপন করেছি এই সাবেকি বাড়িতে। ‘অন্তরা’র রূপও একসময় বদলে গেছে। টিনেরঘর ভেঙ্গে পাঁচতলা বাড়ি হয়েছে। গাছপালাগুলো আর নেই। তপোবন হটিয়ে জায়গা করেছে ইটপাথরের দেয়াল। গাছেগাছে গান গাওয়া পাখিগুলোও কোথায় উড়ে চলে গেছে।একটা সময় আমিও নিজের সংসার, স্বামী, বাচ্চাদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি।

ছেলেরা বড় হয়ে যাওয়ায় আজকাল সেইসব ব্যাস্ততাও কমে গেছে। মা এবং আমরা ভাইবোনেরা সপরিবারে প্রবাসি হয়েছি দীর্ঘদিন। ইদানীং প্রতিবছরই শীতকালটায় মাস তিনেকের জন্য আমি দেশে আসি। এসে উঠি মিরপুরে। সমস্ত আয়োজন থাকে একুশে বইমেলাকে ঘিরেই। ঘোরাঘুরি, বন্ধুবান্ধব, স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষ্যাৎ, ভারত ভ্রমণও থাকে এই অনুসঙ্গে।

২০২০ সালটি আমার জন্য শুরু হয়েছিল অন্য বছরগুলোর মতই নানা ব্যাণ্জনা নিয়ে। অক্টোবরে আমিরাতের টিকেট কাটলাম। জানুয়ারিতে দেশে এলাম। ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শুরু হল। তুমুল উত্তজনা নিয়ে বইমেলায় যাই।ঘুরি, বেড়াই। মার্চের শুরুটাও একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছিল। ‘সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার’ প্রাপ্তির খবরে; পুরস্কার গ্রহণের আনন্দে।

হঠাৎ করেই দৃশ্যপট বদলে গেল। বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্ক।যদিও অক্টোবর থেকেই উহানে করোনা ছড়াচ্ছিল। তখন কেউই গা করেনি। সবাই ভাবল, চিনা’রা সাপ-ব্যাঙ-বাদুর খেয়ে মহামারি বাঁধিয়েছে। এটা ওদের দায়।ওরা ঠ্যালা সামলাক। কিন্তু নভেল করোনা দলাদলি, ঠেলাঠেলির ধার ধারলো না। সর্বগ্রাসী মহামারির রূপ নিয়ে উল্কার বেগে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। যখন মহামারি দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে, তখনও আমাদের হুস হয়নি।নেতারা বলল, ‘কুছ নেহি হোগা!’ ততক্ষণে মৃত্যুঘন্টা বাজতে শুরু করেছে। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল।লাশের স্তুপ। নিউইয়র্ক পরিনত হল মৃত্যুপুরীতে। দেশেও হানা দিল করোনা। আমি তড়িঘড়ি টিকেট পাল্টিয়ে মার্চের ২৬ তারিখে নিউইয়র্ক ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ২৩ মার্চ থেকে লকডাউনে আটকা পড়লাম ঢাকায়। পরে আমেরিকান আ্যম্বেসি আয়োজিত পরপর চারটি রেসকিউ চার্টার বিমান রিফিউজ করতে হল দীর্ঘতর জার্নি এবং রেডজোন নিউইয়র্কে ফিরে করনোক্রান্ত হবার ভয়ে। মিরপুরের বাড়িতে শুরু হল আমাদের দীর্ঘ হোম কোয়ারেন্টিন।

প্রতিদিন টেলিভিশন খুললেই আমরা দেখছি, হাজার হাজার মৃত্যুর খবর। পিতাপুত্রের মৃত্যু। দুই ভাইয়ের মৃত্যু। পিতা কন্যার মৃত্যু। সন্তানদের এতিম করে দিয়ে পিতামাতার মৃত্যু। কোন কোন বাড়ি জনশূন্য করে দিয়ে মা,বাবা, সন্তান সবাই চলে গেছে। সারি সারি লাশ। স্তুপিকৃত লাশ। বেওয়ারিশ লাশ, গণকবর। নার্স, ডাক্তারদের জীবন বাঁচানোর ব্যার্থ প্রচেষ্টা। বিষন্ন ডাক্তার, হতাশাগ্রস্থ প্যারামেডিক্সের আত্ম্যহত্যা!

মহল্লার এক বাড়িতে যখন মৃত্যুর আহাজারি, আরেক বাড়িতে নবজাতকের কান্না। একদিকে শবযাত্রা, অন্যদিকে বেনারশির ঘোমটায় নববধুর আগমন।মৃতদেহ সৎকারের দীর্ঘ প্রতিক্ষার কারনে স্বজনের লাশ ঘরে রেখেই অভুক্ত মানুষ খাবারের থালা হাতে তুলে নিতে বাঁধ্য হচ্ছে। স্বজনের মৃতদেহ বাইরে রেখে দড়জা বন্ধ করতে হচ্ছে ছোঁয়াচে ভাইরাসের ভয়ে। করোনা ভয়ে ভীত পুত্র গভীররাতে মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে আসছে। আমাদের বেঁচে থাকার তাড়না এতই প্রবল। এই করোনাকাল আমাদের মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে। আমরা যেমন দেখছি অজস্র মানবিক মুখ, তেমনি বেরিয়ে এসেছে অনেক পৈচাশিক মুখও। ফ্রন্টলাইন যোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আবার এই বিপন্ন মানুষেরই মুখের গ্রাস কেড়ে মুনাফার স্বপ্ন দেখছে কিছু মানুষ।মানবজাতি আসলেই বহুরূপী। তাই হয়ত নানা বহুরূপী মানুষের শরীরে প্রবেশের পর নভেল করোনাও নিজেকে মিউট্যান্ট করে হয়ে উঠেছে বহুরূপী।করোনার এই রূপ, রং ও চরিত্র বদলে হতভম্ব গবেষকগণ।

ইতোমধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন নক্ষত্রের মত আলো ছড়ান অনেক গুণীজন। এপারে গেলেন আনিসুজ্জামান স্যার, ওপারে ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়!চলে গেলেন নান্দনিক অভিনয় শিল্পী ইরফান খান।যার সাবলীল অভিনয় যাদুর মত মুগ্ধ এবং বিমোহিত করে রাখত দর্শকদের।নায়ক ঋষি কাপুর, নৃত্যশিল্পী হাসান ইমাম। মনের রঙে সবার মন রাঙাতে চেয়েছিলেন যেই মানুষটি তিনিও চলে গেলেন দেউটি নিভিয়ে।সুরকার, সঙ্গীত শিল্পী আজাদ রহমান।করোনা কেড়ে নিল কত কত মেধাবী মানুষ, পরিচিত মুখ।নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটিকে শুন্য করে দিয়ে চলে গেছেন অনেক পরিচিত স্বজন। বড় অসময়ে এসব চলে যাওয়া।

বারান্দায় বসে আছি। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে এশা’র আজান। নস্টালজিক মন। মনে পড়ছে পুরনোদিনের কথা। ছোটবেলার ঈদস্মৃতি। রোজার শেষদিন। রেডিও, টেলিভিশন ছেড়ে উৎগ্রীব বসে থাকা। টানটান উত্তেজনা। উঠোনে ছুটে গিয়ে আকাশ দেখা। পশ্চিমাকাশে সোনালি রেখাটি দেখার কী নিদারুন প্রচেষ্টা, কত কষ্ট কল্পনা; ‘ঐ, ঐ যে দেখা যাচ্ছে’! ঈদের চাঁদ নিজের চোখে দেখার আনন্দই আলাদা। চাঁদরাতের সেকি মহাআনন্দ। কী মহাউল্লাস।

আমরা ছয় বোন, সাথে একটি মাত্র ছোটভাই।সে আমাদের চম্পাভাই। আমরা তার পারুলবোন।আমরা সবাই চাঁদরাতে হাতে নকশাদার মেহেদী পরার জন্য প্রস্তুত হতাম। ছোটদের হাতের তালুতে এঁকে দেয়া হত একটি বড় বৃত্ত কিংবা পুরুষ্ট চাঁদ-তারা। খুব বেশী হলে পাঁচ আঙ্গুলের মাথায় মেহেদির মুকুট। ঈদের জামাত সেরে এসেই যেন সবাই পোলাউ, কোর্মা, জর্দা, সেমাই খেতে পারে, তাই আমাদের মা রাতেই রান্নার আগাম প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত। সব গুছিয়ে মা যখন জিরোতে বসতেন আমরা তার হাতেও একটা বৃত্ত এঁকে দিতাম। মা মুখে না না করলেও, লজ্জিত হাসিতে হাতটি পেতে দিতেন। আব্বার হাতে ছোট্ট একটি বৃত্ত একে দিতে গেলে তিনিও বলতেন, ‘আহা, এসব কি? ছেলেরা মেহেদি পরে নাকি? দিতেই হবে? আচ্ছা দে।’

ওদিকে রেডিও এবং টেলিভিশনে বাজত “রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। ঘোষিকারা তাদের দীর্ঘ একমাসের ঘোমটা খুলে তরল কণ্ঠে, হাসি হাসি মুখে বলতেন, “ঈদ মোবারক”।তখন বিটিভিতে খবর পড়তেন, সিরাজুল মজিদ মামুন, সরকার কবির উদ্দিন, রোকেয়া হায়দারের মত তারকা খবর পাঠকরা। বিটিভি প্রচারিত ঈদের অনুষ্ঠান ছিল ঈদের মুল আকর্ষণ।

ঈদের নামাজ শেষ করে বাসার গেটের সামনে দিয়ে যাবার সময় আব্বার সাথে সাথে ঢুকে পরতেন পাড়ার চাচা, খালুরাও। আমরা নতুন কাপড় পরে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। সকালে একদফা খেয়ে রাতে আবার তাঁরাই আসতেন সপরিবারে ঈদের আনুষ্ঠানিক খাবার খেতে। দিনভর এবং মধ্যরাত অব্দি চলত সেই পাল্টাপাল্টি খাওয়া দাওয়া। আমরা তাদের ঘরে, তারা আমাদের ঘরে। এমনকি ঈদের পর পর আরও দু’দিন ধরে চলত দাওয়াত পর্ব। বয়স বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে ঈদের আনন্দও পাল্টে যেতে লাগল। একেক বয়সের আনন্দের ধরনেও এলো ভিন্নতা। ভিন্ন অনুভূতি।

এখন এই মধ্যবয়সে এসে দেখছি মহামারি।এই মূহুর্তে আমরা একটি ভয়াবহ মহামারির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। যদিও মহামারি নতুন নয়। অতীতেও বহু মহামারি হানা দিয়েছে পৃথিবীতে। আজকের মত তখনও বহু দেশ, নগর, জনপদ শুন্য হয়ে গেছে। লকডাউন, হোমকোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন এসব শব্দও নতুন নয়।পৃথিবী অভ্যস্ত মহামারির সাথে। অভ্যস্ত এই লকডাউন এবং আইসোলেশন এর সাথে।’দ্য ব্লাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত প্লেগ মহামারি পৃথিবীতে হানা দিয়েছিল তেরশ সালের মধ্যভাগের দিকে। তারপরও, আঠারোশ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্লেগ তিন দফায় হানা দিয়েছিল মানুষের উপর।তার বিষাক্ত ছোবলে বিরান হয়েছে বহু জনপদ। এখনও যে ক’জন মানুষ একশ বছরের বেশী আয়ু নিয়ে বেঁচে আছেন, তাদের অনেকের স্মৃতিতেই হয়ত বেঁচে আছে ‘স্পেনিশ ‘ফ্লু’ জনিত ভয়াবহ মহামারি। প্রকৃতির হয়ত এটাই নিয়ম। প্রতি একশত বছর পর পর সে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে।মেরামত করে নেয় নিজের ক্ষত। যেসব ক্ষত সৃষ্টি করেছি আমরা উচ্চাভিলাষি মানুষেরা।হয়ত এভাবেই পৃথিবী নিজের হাতে তুলে নেয় নিজেকে রক্ষার কৌশল।

ভয়াবহ কুষ্ঠ, গুটিবসন্ত, কলেরা রোগের গল্পতো শুনেছি দাদা-দাদি, মা-বাবার মুখেই। ঐসময় এই রোগগুলোকে অভিশাপ বলেই মনে করা হত। এইডস আর ইবোলা’তো আমাদের নিজের চোখেই দেখা।

একদিকে চলছে করোনার তান্ডব। করোনা মহামারির মধ্যেই তৈরি হয়েছে আরেকটি দুর্যোগের আশঙ্কা। ক’দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একটি ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে শক্তি সন্চয় করে এখন ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ঝড়ের নামকরন করা হয়েছে ‘আম্পান’।বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে প্রচন্ড গতিতে ধেয়ে আসছে শক্তিশালী ‘আম্পান’। অবস্থান ও গতিপ্রকৃতি বলছে, প্রচন্ড বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়েই আম্পান বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এটি আঘাত হানবে ২০ মে। বুধবার ভোরের দিকে। আবহাওয়া অফিস থেকে পর্যায়ক্রমে বিপদসংকেত বাড়িয়ে সাত থেকে দশ নম্বরে আনা হল।

অবশেষে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে সুন্দরবন অংশ দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টির মূল অংশ দেশের সীমানায় আঘাত করল।ঝড় সুন্দরবনে আঘাত করলেও এর প্রভাব পড়ল চারদিকেই।

সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি নেহাত কম নয়৷ প্রাণহানি ছাড়াও প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়৷ঘূর্ণিঝড় আম্পানও ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছে।অবর্ননীয় কষ্টে, আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে উপকূলবাসীর।ভেঙ্গে গেছে বাঁধ, অনেক কাঁচা ঘড়বাড়ি। ভেসে গেছে চিংড়ি ঘেরের মাছ। সামুদ্রিক জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

তবে এই মহা সাইক্লোন আম্পান আমাদের এপার বাংলার চেয়ে ওপার বাংলাতেই তান্ডব চালিয়েছে বেশী। দুমরেমুচরে দিয়েছে কলকাতার বাড়িঘর, জনপদ।টেলিভিশনের খবরে দেখাগেছে দিশাহারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে যেন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল আমাদের “সুন্দরবন”। প্রতিবারই ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন এলে সুন্দরবন নিজের বুক পেতে দিয়ে দেশকে, জনগণকে বাঁচায়। আমরা কবে সচেতন হব? এখনও কী সময় আসেনি “সুন্দরবন বাঁচাও” আন্দোলন গড়ে তোলার?

এবারও নিশ্চয়ই শেষ রোজার সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে একটি বাঁকা চাঁদ উঠেছিল।চাঁদ কী তার সোনামুখ বের করে দেখতে পেয়েছিল মানব জাতির দূর্দশা? করোনায় থমকে যাওয়া জীবনে নতুন করে আঘাত হেনে লন্ডভন্ড করে দিল মহাসাইক্লোন ‘আম্পান’। ভারত বাংলাদেশের উপকূল জুড়ে অনুষ্ঠিত হল বিবর্ণ এক ঈদ। ছাপা সংবাদপত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি অভিনব সংবাদ ছাপাল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’। ২৪ মে টাইমস এর প্রথম পাতায় অন্য আর কোনও সংবাদ ছিল না। ছিল না কোনও ছবি।পুরো ছয়টি কলাম জুড়েই ছিল করোনার কেড়ে নেয়া মৃত ব্যক্তিদের নামের তালিকা। করোনায় আমেরিকার এক লাখ মানুষের মহামৃত্যুকে এভাবেই স্মরণ করল নিউইয়র্ক টাইমস। আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছে ৩ লাখ ৪৬ হাজারেরও বেশি মানুষ।

তবে জীবন কখনোই থেমে থাকে না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। একদিকে লাশের মিছিল; অন্যদিকে জীবনের জয়গান। সৃষ্টির উল্লাস।আমাদের মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষত সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী, ওজনস্তুরের ছিদ্র বন্ধ হোক, বায়ুদূষন কমে যাক, কমুক পৃথিবীর কম্পন, অটুট থাকুক মেরুবরফ, শান্তহোক সাগর, মহাসাগর।

নতুন করে গড়ে ওঠা করোনাত্তর ভবিষৎ পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে শিখব করোনার সাথে যুদ্ধ করেই।

শেলী জামান খান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম বাংলাদেশের পুরনো ঢাকায়। ছোটবেলা কেটেছে চাকুরিজীবী বাবার সাথে বিভিন্ন মফস্বল শহরে।উচ্চতর শিক্ষাজীবন ঢাকা ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করেন। প্রকাশিত বই:

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ