স্বরচিত দহন (পর্ব – ১)

সোহরাব হোসেন
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
স্বরচিত দহন (পর্ব – ১)

সকাল হতে টানা বৃষ্টি ঝরছে। চঞ্চল মেয়ের হাতভর্তি চুড়ি যেমন নিরন্তর রিনিঝিনি বাজতে থাকে— ক্ষণেক্ষণে জানালার আরশিতে বৃষ্টিপতনের পর্যায়বৃত্তিক শব্দ তেমনি সুর তুলে যায়। আওয়াজ শুনেই অনায়াসে বলে দেওয়া যায়— এই বৃষ্টি থামবার নয়। শরতের মেঘলা আকাশ আঁধার-মলিন রূপালি আভা ছড়াচ্ছে। মেঘমেদুর দিন না হলে এই বেলায় জানালা দিয়ে সোনালি রোদ্দুর এসে উঁকি মারতো।

হিম হিম বাতাসে বৃষ্টির এমন সুরেলা আওয়াজ কানের কাছে যতই বাজতে থাকে—সমস্ত দিনের কর্মোদ্যমতা ততই বিলীন হতে থাকে। ছকেবাঁধা একগুঁয়ে জীবন হতে ছুটি নেবার যুতসই উছিলা পাওয়া গেছে। বাবার শিক্ষা আর স্কাউটিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যদিও রুটিন মানা পছন্দ করি, বাদলার বদৌলতে প্রাপ্ত সুযোগটা কাঙ্ক্ষিত  রুটিনমাফিক জীবন হতে মনকে পুরাই বিচ্যুত করে দিয়েছে! এই আবহে বিছানা ছাড়তে একদমই ইচ্ছে করছে না। কলেজেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই। কয়েকটা ক্লাস মিস যাবে—এই যা।

টাপুর-টুপুর শব্দে আমার মতো ঘুমকাতুরে মানুষের ঘুমের নেশা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তবুও কলেজে যাবার সময়টা পার হবার আগ পর্যন্ত বিছানা ছাড়ার তাগিদ অনুভব করছিলাম। এখন আর করছি না। পাতলা কাঁথায় নিজেকে আপাদমস্তক মুড়িয়ে নিয়ে ঘুমের অপেক্ষা করে করে আরেকদফা ঘুম দিলাম।

একসময় বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দকে ছাপিয়ে কানের কাছে মুঠোফোনের যান্ত্রিক শব্দ বাজতে থাকে। চোখ বন্ধ রেখেই বালিশের পাশ থেকে হাতড়িয়ে ফোনটা ধরলাম, হ্যালো।

দোস্ত, কী করছিস?

অপরিচিত নম্বর হতে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে একেবারে গভীর থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে হাই উঠে। কয়েক সেকেন্ড প্রাণপণ চেষ্টায় ঈষৎ ঊর্ধ্বমুখী হা-করা মুখটাকে আয়ত্তে আনা গেল। অবশ্য তন্ময় পাশে থাকলে আরো কম সময় লাগত। দুষ্টুটা যখনই কাউকে হাই তুলতে দেখে তখনই মুখে তর্জনী ঢুকাতে তেড়ে যায়। অগত্যা অনতিবিলম্বে হাই তোলাতে ইতি টানতে হয়।

ওপাশ থেকে বলে, কীরে—একেবারে চুপচাপ যে?

কে—নিলয়? এটা কার নাম্বার?

হ্যাঁ। দুলাভাইয়ের নাম্বার। কীরে—কী হলো? অসুস্থ? নাকি এখনো ঘুমাচ্ছিলে?

ছোট করে আরেকবার হাই তুললাম। কী প্রশ্নের জবাবে ঠিক কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। মস্তিষ্কের তথ্যভাণ্ডারটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। হয়তো সেজন্যই ঘন ঘন হাই আসছে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠটায় লাগাম ধরে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, কী আর করা? এমন দিনে আপাদমস্তক কাঁথামোড়া ঘুমের চেয়ে মজা আর কীসে! তবে রোম্যান্টিক কবিতা লিখতে বসলেও মন্দ হতো না—রবীন্দ্রনাথও ফেল মারতো!

রাখ তোর রোম্যান্টিসিজম। কার্ড খেলবি? খেললে এক্ষুণি চলে আয়।

এমন বৃষ্টির দিনে বিছানার উপর গায়ে কাঁথা-কম্বল প্যাঁচিয়ে তাস খেলার আড্ডা ভালোই জমবে। এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার মানে হয় না। ঘড়ির কাঁটায় দশটা বিশ। চট করে উঠে বসলাম।

কীরে—আসবি নাকি?

হুম, আসব।

তাহলে তাড়াতাড়ি চলে আয়।

একটু সময় লাগবে।

ক’টা নাগাদ আসতে পারবি?

উমমম… বারটার মধ্যে।

এতক্ষণ! খেলার ইচ্ছে আছে তোর?

সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি, বিছানাও ছাড়িনি। ফ্রেশ হবো না! নাস্তা করবো না! বারটা তো কমই বলেছি।

ওকে মামা, বারটার মধ্যে চলে আয়। দেরি করিস না।

টানা বৃষ্টিতে ঘরময় স্যাঁতস্যাঁতে আবহ আর থেকে থেকে বর্ষণের আওয়াজে গতরাতে পড়ার টেবিলে বসে থাকার উদ্যমটা পুরোপুরি পরাস্ত হয়ে গিয়েছিল। এমন বর্ষণে মনে কেমন শূন্যতার ঘোর জেগে উঠে। তার উপর শূন্য বিছানার দুর্ভেদ্য আকর্ষণ—আমাকে মরিয়া হয়ে টানছিলো। কাঁথার ভেতর যাবার আগপর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাইনি। ছোটবেলা থেকেই শীত নেই বর্ষা নেই— সবসময় এই নকশী কাঁথাটাকে গায়ে জড়িয়ে ঘুমাই। এর নকশা, রঙের সন্নিবেশ, করুকাজ—সব মিলিয়ে দারুণ লাগে! এটা নিউমার্কেট থেকে কেনা। আমার তেরতম জন্মদিনে মা দিয়েছিল। মায়ের স্নেহ আর ছেলেবেলার সান্নিধ্য যেন আষ্টেপৃষ্টে বিজড়িত হয়ে থাকে এই কাঁথার ওমে।

টেপের পানি বেশ ঠাণ্ডা! একদমই ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাজ সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে বেসিনের সামনে দাঁড়ালাম— এমন সময় তন্ময় এসে পিছন থেকে ডাকে। ধরন শুনেই বুঝতে পারলাম সে কোন না কোন মতলব নিয়ে এসেছে। প্রশ্রয় না দিয়ে কাটকাট গলায় জানতে চাইলাম, বল—কী বলবি।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

বৃষ্টি তো বাইরেই হবে— নাকি? তো হয়েছে কী?

কথা না বাড়িয়ে সে সুবোধ বালকের মতো আবদার করে, ভিজতে যাবা? ছাদে? চোখে-মুখে প্রলোভনে ভরা হাসি।

একটা ধমক লাগিয়ে বললাম, সেদিন না বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগিয়ে মায়ের বকা খাওয়ালি! শখ মেটেনি—না?

কিছুতেই সে সেদিনের দোষ মেনে নিতে নারাজ। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, তাহলে গেইমস খেলবা? একা একা খেলতে খেলতে বোর হয়ে গেছি।

না।

কী করবা এখন?

তোকে বলতে হবে!

তন্ময় গলা টেনে বলল, আহা—বলই না।

খাব।

তারপর?

কাজ আছে। বাইরে যাব।

উদ্দেশ্য সফল হবে না বুঝতে পেরে সে আর বিরক্ত না করে চলে গেল।

এমন দিনে মায়ের খিচুরি রান্নার খুব ঝোঁক। প্রায়ই বৃষ্টিস্নাত সকালে পরিবারের সাবাই এক বৈঠকে বসে খিচুরি খাই। আজকের নাস্তাও খিচুরি। সবার সঙ্গে বসে নাস্তা করার জন্য আমাকে জাগানোর চেষ্টায় মা কয়েক দফা ডেকে হয়রান হয়ে গেছে। অগত্যা তন্ময়ের সাথে নাস্তা করে আবার ঘুমিয়েছে। বাবা ঢাকার বাইরে। বাসায় থাকলে ঠিকই সবার সঙ্গে বসে খেতাম, কারণ বাবার সামনে অনিয়ম করতে পারি না। টেবিলে আমার খাবার রাখা ছিল। তাই মা’কে ডাকা লাগল না।

মা ভীষণ ঘুমকাতুরে। আমার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি উপরে। সকালে নাস্তার পর একটা ঘুম তার চাই-ই চাই। বৃষ্টির দিন হলে তো আর কথাই নেই!

মা’কে জাগিয়ে একশটা টাকা চাইতেই ঘুম জড়ানো বিস্ময় ভরা চোখে জানতে চাইলো, কেন? বৃষ্টির মধ্যে আবার কোথায় যাবি?

ঘরবন্দী হয়ে থাকতে আর কতক্ষণ ভালো লাগেÑবল! তার উপর তোমরাও শুধু ঘুমাবে। দাও তো—বেশি দেরি করবো না।

ঘরে যে বাজার নেই!

একশটা টাকা চাইলাম— তাতেই ঘরে বাজার নেই শুনিয়ে দিলে!

আহাÑআমি কি তাই বলেছি নাকি? তোর বাবা বাসায় নেই। তুইও চলে গেলে বাজার করবে কে? আগে বাজার করে দিয়ে যা।

এই বৃষ্টির মধ্যে বাজারে যেতে পারব না। ড্রাইভারকে পাঠাও।

বাসার বাজারের দায়িত্বটা বরাবরই বাবা নিজের হাতে সারে। ড্রাইভারকে নিয়ে সপ্তাহে একদিন বাজারে যায়। মাঝে মধ্যে আমাকে নিয়ে যায় শেখানোর জন্য। মা বলে, এ আর এমন কী কঠিন জিনিস যে শেখাতে হবে! মানুষতো আপনিতেই বাজার শিখে ফেলে। হাতে টাকা থাকলে সবাই বাজার করতে পারে। বাবা বলে, করলেই হয়ে গেলো! কতটা দক্ষতার সাথে করা হলো সেটা দেখতে হবে না!

সংসারের জটিল সব কর্মকাণ্ড বাবা আমাকে নিজহাতে শেখাতে চায়।

বাবার সাথে বাজার করতে দারুণ লাগে। শুরুতেই ঘুরে ঘুরে টাটকা তরিতরকারি কেনে। তারপর মাছ। এতে মাছ নিয়ে যেমন বাড়তি ঘুরাঘুরি করতে হয় না, আবার চাপ পড়ে মাছ নরম হবার সম্ভাবনা কম থাকে। সবশেষে ফেরার সময় করে শুকনো বাজার। কারণ শুকনো বাজার এক দোকানে বসেও করা যায়। ওটার জন্য সময় লাগে কম এবং কেনার পর একগাদা জিনিশ হাতে নিয়ে বাড়তি কোন ঘুরাঘুরিও করতে হয় না। দোকানদারদের সাথে হাসি-ঠাট্টা ইয়ার্কি রসিকতার মধ্যদিয়ে বাজার করা শেষ হয়ে যায়। বাবার সহজাত হাসি-ঠাট্টা মেশানো আলাপচারিতার মাধ্যমে খুব সহজেই বিক্রেতাদের সাথে আমাদের অন্যরকম একটা সদ্ভাব গড়ে উঠে। এমনকি কখনো কখনো সেটা প্রথম পরিচয়েই। একা একা চলতে-ফিরতে বাবাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করি বেশ কাজে দেয়।

বেরুবার সময় ছাদে চেঁচানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। নিশ্চয় সুযোগ পেয়ে বুয়ার ছেলেটার সাথে তন্ময় বৃষ্টিতে ভিজছে। গিয়ে দেখি ঠিক তাই। আমাকে দেখতে পেয়ে সে তড়িঘড়ি এসে নালিশ করে, ভাইয়া—হানিফ বৃষ্টিতে ভিজতেছিল, আর আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। হানিফ না—আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।

ততক্ষণে হানিফও দৌড়ে আসে। নালিশ শেষে তন্ময় ওকে ধাক্কা মারলে সে দূরে ছিটকে পড়ে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সে তৎক্ষণাৎ তন্ময়ের কথার প্রতিবাদ জানায়, না—না রাইম ভাইয়া। তন্ময় ভাইয়াই আমারে ধাক্কা মাইরা বৃষ্টির মাইজে ভিজায়া দিছে।

কে দোষী তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আসলে ওদের বয়সে এরকম বৃষ্টিতে ভেজার লোভ কে সামলাতে পারে! এই বয়সে এসে আমি পারি। কারণ বৃষ্টি ছাড়াও এতোদিনে অনেক উৎস হতেই আনন্দ কুড়াতে শিখেছি। অথচ ওদের কাছে বৃষ্টির মতো এমন আনন্দের উৎস আর আছে কোথায়!

কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় ছাদে তন্ময়, প্রিন্স আর তমাসহ আমরা বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। তমা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। ভিকারুন্নেছা স্কুলের এসএসসির ছাত্রী। প্রিন্স ওর ছোটভাই। তন্ময়ের চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে। আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক বেশ জোরালো। তমা প্রিন্সকে পাঠিয়েছিল তন্ময়কে ছাদে নিয়ে আসার জন্য। বৃষ্টিতে ভেজার প্রস্তাব পেয়ে বাবা-মায়ের বকুনি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তন্ময় আমাকেও সাথে নিতে চাইলো। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজার কথা শুনে তার দিকে একরকম দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকালাম। অতটুকুন তন্ময় দুষ্টু হাসি হেসে বলে, তমা আপু পাঠিয়েছে।

যদিও তমার মতো এক ষোড়শীর সাথে বৃষ্টিতে ভেজার আগ্রহ আর দশটা ছেলের চেয়ে আমার মাঝেও কিছু কম ছিল না, তারপরও নির্লিপ্ততার ভান করে বলেছিলাম, তোর তমা আপু তো প্রিন্সকে পাঠালো তোকে নিতে!

তাতে কী হয়েছে? আমি তো তোমাকে ছাড়া যাব না।

কেন যাবি না? বকা খাওয়ার ভয়ে?

কথা না বাড়িয়ে তন্ময় হাত টেনে ধরে বলেছিল, আহা—চলই না ভাইয়া!

সেদিন ছাদের দরজায় পা রাখতেই বুঝেছিলাম, আমার জন্য কী এক নৈসর্গিক সন্ধ্যা অপেক্ষা করছিল! বিশাল এই ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদটা এমনিতেই খুব সুন্দর। তার উপর আধো আলো আধো ছায়ার খেলায় বৃষ্টিস্নাত তমাকে দেখে নিজের ভেতর কেমন যেন একটা অদ্ভুত-অচেনা অনুভূতি বিরাজ করছিল। কেমন একটা আড়ষ্টতা গ্রাস করে রেখেছিল আমাকে। যেন সমস্ত পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে আমরা এক মোহজালে মেতেছিলাম। প্রথমবারের মতো নিজেকে মনে হয়েছিল শাসনের বেড়াজাল থেকে সদ্যমুক্ত এক পুরুষ।

হৈ-হুল্লোর আর ছুটাছুটির এক পর্যায়ে তমা ভারসাম্য হারিয়ে আমার উপর আছড়ে পড়ে। পতনরক্ষার্থে ওকে আঁকড়ে ধরি। মুহূর্তেই যেন লক্ষ-কোটি তথ্য এসে মাথায় ভিড় জমায়। দেহের প্রতিটা নিউরন উন্মাদনায় মত্ত হয়ে তাদের খেই হারিয়ে ফেলে। সমস্ত চিন্তা-চেতনা দিয়ে কিছুতেই আমার তিন বছরে চেনা তমা, আঠার বছরের চেনা পৃথিবী আর নিজেকে মিলাতে পারছিলাম না। অদ্ভুতসব আনকোরা অনুভূতিরা আমায় জড়িয়ে রেখেছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় তন্ময় আর প্রিন্সের মুখ হা-হয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে তমা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। মাথায় তখন আর কিছু খেলছিল না। লোক জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে—শুধুমাত্র এই চিন্তাটুকু সমগ্র চেতনাকে গ্রাস করেছিল।

প্রিন্স বললো, ইশ—তুমি যদি এভাবে সিনেমার হিরোর মতো আপুকে না ধরতে, তাহলে নিশ্চিত আপুর মাথা ফাটত! বাসায় গেলে মা আচ্ছামতো বকা লাগাত। আর জন্মের মতো বৃষ্টিতে ভিজবার সাধ মিটিয়ে দিতো না!

আমি তখন ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে বললাম, সসস….। তমা এভাবে পড়ে যাচ্ছিল একথা কাউকে বলতে হবে না।

তন্ময় আপত্তি তুলে বলেছিল, কেন?

গাধা কোথাকার! তাহলে দুর্ঘটনার ভয়ে আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে দেবে?

সুযোগমতো আড়চোখে কয়েকবার তমার দিকে তাকালাম। লাজশোণিমায় সে আমার চোখে চোখ রেখে তাকানোর শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছিল। ওর সঙ্গে কত খেলেছি, দুষ্টুমি করেছি, ঝগড়া করেছি! অথচ সেদিন অনুভব করেছিলাম—সেই তমা আর এই তমার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক।

সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে সে বলল, প্রিন্স—বাসায় চল।

প্রিন্স ওকে অনুসরণ করতে করতে বলে, সে কী আপু! এখনই যাবি? আরেকটু থাকি!

কোন জবাব না দিয়ে তমা হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে যায়।

সেই সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভেজার পর তমা আর মুখোমুখি হয়নি। তন্ময়ের ঠাণ্ডা লাগাতে মা আমাকে বকেছিল—এছাড়া আর তেমন কিছু ঘটেনি।

দুইটাকেই ধমকিয়ে বাসায় পাঠিয়ে ছাদের দরজা আটকিয়ে দিলাম।

বাবা ঢাকার বাইরে। গাড়িটা গ্যারেজেই। ভাবলাম, এই বৃষ্টির দিনে বাড়তি ঝামেলা মাথায় না নিয়ে ওটা নিয়েই বের হওয়া যাক।

ড্রাইভার গাড়ির ভেতর ঘুমাচ্ছে। স্পিকারে সাড়ম্বরে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত গানেরঢালি অনুষ্ঠানে বাংলা ছায়াছবির গান বাজছে। ডেকে বললাম, ইকবাল ভাই—ঘুমাচ্ছেন নাকি? আরামে ঘুমালে তো হবে না, বাজারে যেতে হবে।

ঘুম থেকে জেগে সে আমার ইয়ার্কি মাখানো কথার জবাবে মুচকি হেসে বলে, যাওয়ার দরকার হইলে যামু। কখন যাওন লাগব?

যাবেন—যখন সুবিধা হয়। মা’কে একটু জিজ্ঞেস করে দেখেন।

ড্রাইভিং পারা সত্তে¡ও লাইসেন্স না থাকায় বাবা আমাকে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নিয়ে বেরুতে দেয় না। তবে যতদিন বাবাকে ফাঁকি দিয়ে এভাবে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি— কোনদিনই সমস্যা পোহাতে হয়নি। ট্রাফিকসিগন্যালগুলো ঠিকমতো মেনে চললেই হয়। সম্ভবত প্রাইভেট কার চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঘেঁটে ট্রাফিকপুলিশের ফায়দা কম। ওদের ধান্দা সিএনজি আর ট্যাক্সিক্যাব। জায়গামতো একটাকে ধরতে পারলেই কয়েকশ টাকা পকেটে এসে যায়।

জনসেবায় এদেশে সব ধরনের পুলিশের ভূমিকাই হতাশাজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য ও অজ্ঞ লোকের ছড়াছড়ি। একরাতে এগারটার দিকে বাসায় ফিরছিলাম। সাথে ছিল কিছু সফটওয়্যার সিডি আর কয়েকটা ডিভিডি। সেগুলো দেখে কয়েকজন পুলিশ আমাকে থামিয়ে নানাসব উদ্ভট প্রশ্ন করে। বিভিন্নভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ডিস্ক আর খাপগুলো চেক করে। কভারগুলোতে এমনভাবে খামচাতে লাগলো— যেন এর ভিতর থেকে আমার কোন এক অপরাধী কর্মকাণ্ডকে ওরা জনসমক্ষে বের করে আনবে।

ডিস্ক ও খাপে পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য ইংরেজিতে প্রতিটা ডিভিডির বৃত্তান্ত লেখা ছিল। বুঝতে পারছিলাম না তারপরও ওরা কেন ওভাবে জেরা করছিল, ‘ওটা কী?’, ‘অমুক ডিস্ক দিয়ে কী হয়?’ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ব্যক্তিগত অনেক আপত্তিকর প্রশ্ন। ওরা উইন্ডোজের সিডি পর্যন্ত চেনে না! ছয় বছরের তন্ময়কে যেভাবে তার অবোধ্য বিষয়াদি বুঝিয়ে দিতে হয় তাদেরকেও সেভাবে একে একে সব বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না এটা তাদের অজ্ঞতা—নাকি আমার অসহায়ত্বকে ঘিরে ওদের ইয়ার্কি-ফাজলামো! অনেক চেষ্টায় সেদিন নিজের ক্ষোভ সামলেছিলাম।

এক বন্ধুর কাছে একটা ঘটনা শুনে বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছিল। উঠতি বয়সের তিন ছেলে নাকি একবার কয়েকটা পর্নোসিডিসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল। পুলিশ তাদের বাবা-মা’কে জানিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে পাঁচশ টাকা চায়। দিতে অপারগ হলে তাদের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আড়াইশ টাকা পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। এই ঘটনা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ঘটনাটার জন্য দায়ী ছিল দুইটা জিনিশ—পুলিশের অজ্ঞতা আর ধান্দাবাজি।

বৃষ্টির দিনে রাস্তায় বেশ জ্যাম। এদিকটায় এসে আরো অসহনীয় জ্যামে পড়লাম। মগবাজার মোড় থেকে শান্তিনগর আসতে ঘন্টা খানেক লাগল। ট্রাফিকপুলিশগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে জ্যামের ব্যাপারে তাদের গা-ছাড়া ভাব। কিছুই করার নেই। একটা আদর্শ শহরে যেখানে শতকরা পঁচিশভাগ জায়গা রাস্তার জন্য বরাদ্দ থাকার কথা সেখানে নাকি ঢাকা শহরে আছে মাত্র ছয় ভাগের কাছাকাছি। সে হিসাবে রাস্তায় জ্যাম হলে তাদেরই বা কী দোষ!

মাঝে মাঝে মনে হয় এই ট্রাফিকপুলিশগুলো না থাকলেই বুঝি রাস্তাঘাটে যানবাহন আরেকটু ভালো চলতো। লোকজন ঠিকমতো মেনে চলাচল করলে ট্রাফিকসিগন্যালগুলোই যথেষ্ট।

কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির সামনে এসে একেবারে বোবা জ্যামে আটকে আছি। গাড়ি নড়েই না। সচল উইপারগুলো বৃষ্টির পানিকে বনেটের দিকে সরিয়ে দিচ্ছে। উইন্ডস্ক্রিনের ভেতরের দিকে অনেক ময়েশ্চার জমে প্রায় ঘোলা হয়ে গেছে। মুছার পর বেশ স্বচ্ছ হয়ে গেলো বাহিরটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আকাশ দেখে বৃষ্টি থামবার কোন পূর্বাভাস আঁচ করা যাচ্ছে না। গা-ছাড়াভাবে ঝরছে তো ঝরছেই।

শান্তিনগরের কাছাকাছি আসতেই দুর্ভোগের আরেক নতুন মাত্রা যোগ হলো। ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে, যেকোন সময় টানা কয়েক ঘন্টা বৃষ্টি হলে আটাশির বন্যায় শহরের কী হাল হয়েছিল তা অনায়াসে কল্পনা করা যায়। মনে হচ্ছে গাড়ি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাঁটুজলওয়ালা ছোটনদী পার হচ্ছি। সিটিকর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এই জলাবদ্ধতাকে আসলে কোন চোখে দেখে? তারা কি টাইম ট্রাভেল করে বারবার আটাশিতে চলে যেতে পছন্দ করে— নাকি কল্পনাবিলাসী হয়ে নগরবাসীকে অন্যরকম এক ঢাকা উপহার দিতে পছন্দ করে!

 

দুই

নিলয় আর শুভ্র একই মেসে থাকে। দুজনেরই বাড়ি গাজীপুর। আমরা তিনজন সহপাঠী।

শুভ্র আমার স্কুলের বন্ধু। স্কুল পেরিয়ে এসে ওর সুবাদে নিলয়ের সাথে বন্ধুত্ব। স্কুলের মাঠে প্রায়ই শুভ্রর সাথে ক্রিকেট খেলা হতো। স্কুলজীবন শেষে একটা ভালো কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে পড়াশোনায় সবাইকে আরো মনোযোগী হতে হলো। স্কুলের মাঠটা একটু দূরে হওয়ায় সেখানে আর খেলতে যাওয়া হতো না। বাসার কাছেই একটা পতিত জমিতে নিয়মিত খেলতাম।

একদিন নিলয়কে নিয়ে শুভ্র আমাদের পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে আসে। সেখান থেকেই ওর সাথে পরিচয়। শান্তশিষ্ট ছেলে। গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসেছে ভর্তিপরীক্ষার কোচিং করতে। শুরুতে মনে হয়েছিল মফস্বলের ছেলেদের আত্মবিশ্বাসের কমতি থাকে। তা না হলে কলেজের ভর্তিপরীক্ষার জন্য এত ঝামেলা করে কোচিং করার কোন মানে হয়? এটা তো আর ইউনিভার্সিটি ভর্তিপরীক্ষা নয়। তবে নিলয়ের দুর্দান্ত ব্যাটিং দেখে আর মনেই হয়নি  যে এই ছেলের মধ্যে কোথাও আত্মবিশ্বাসের কমতি আছে।

শুভ্রদের এলাকাটা খুব ঘিঞ্জি ও জনবসতিপূর্ণ। লম্বা— সরু গলি দিয়ে ঢুকতে হয়। বিপরীত দিক হতে আরেকটা গাড়ি এসে পড়লেই দফা-রফা। আজ অবশ্য সেরকম কিছু ঘটেনি।

ওদের বিল্ডিংয়ের সামনের দোকানের নাম ফরিদপুর জেনারেল স্টোর। বলাই বাহুল্য দোকানি কাসেম ভাইয়ের বাড়ি ফরিদপুর। নিজের এলাকার নামানুসারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ আজকালকার প্রচলিত রীতিগুলোর একটি। দোকানি ক্রেতাদের সাথে জম্পেশ রসিকতা করে। মিষ্টি ব্যবহারকে পুঁজি করে বেশ ভালোই ব্যবসা করছে। এই দোকানে আসলেই কেউ বুঝে যাবে, ব্যবহারে শুধু বংশপরিচয় নয়— ব্যবসায়ে পুঁজি হিসেবেও এর জুড়ি নেই!

রোজকার মতো কাসেম ভাই আজ ব্যস্ত না। বৃষ্টির মধ্যে কেনাবেচা নেই। হাতের উপর থুতনি রেখে ঘুমঘুম চোখে বৃষ্টি দেখছে। গাড়ি পার্কিং করে দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট চাইলাম।

দোকান কেমন চলছে ভাই?

কাসেম ভাই গলা টেনে বলে, আর ব্যবসা! জিনিসপত্রের দাম যেইহারে বাড়তাছে! কোনদিন জানি দোকানদারি ছাইড়া দিয়া বাড়িত যাওনগা লাগে—কে জানে!

হ ভাই! তিন টাকার বাংলাফাইভ এখন চার টাকা। আরো নাকি বাড়বে!

দ্যাশটা চোর-চাট্টায় ভইরা গেছে গা।

কাসেম জেনারেল স্টোরের সামনের ফ্যাকাসে হলুদ রঙের পুরোনো বিল্ডিংটার নীচতলায় শুভ্ররা থাকে। বাড়ির জীর্ণ রং অনায়াসে বলে দিচ্ছে বাড়িওয়ালা অতটা সচ্ছল নয়। সাথে রুচিহীন কিংবা কিপ্টা কিসিমেরও। বাসার প্রবেশপথের দুইপাশে খানিকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। ওখানটায় বেষ্টনী দিয়ে নীলা আপু কিছু ফুল আর শখের কিছু ফলগাছ লাগিয়েছে। আপু বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে। ঢাকা ভার্সিটিতে ইংরেজিতে অনার্স করছে। খুব মিশুক। আমাদের সাথেও বেশ মিশে।

বাসায় ঢুকার পথে মাঝারি আকারের একটি পেঁপেগাছ গলায় অসংখ্য ঝুলন্ত পেঁপেসহ দাঁড়িয়ে আছে। এর পাতাগুলো একেবারে ছাতার মতন বড় বড়। গাছটায় দুইটা অর্ধেক-ভেজা কাক বসেছিল। কাছাকাছি আসতেই ভয়ে উড়ে যায়। ওদের ভরবেগ সামলাতে গিয়ে গাছটা নাড়া খেল, আর পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি দিয়ে আমাকে প্রায় ভিজিয়ে দিলো—একেই বলে কাকভেজা!

ভেতরে ঢুকে দেখি নিলয় উপুর হয়ে আধশোয়া অবস্থায়, তার সামনে বসা বেঁটে মোটা কালো করে একটা লোককে হাতের কারসাজিতে খেলার তাস দিয়ে বিভিন্নরকম ম্যাজিক দেখাচ্ছে। লোকটা মনোযোগসহ দেখছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে নিলয় ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কীরে—অবশেষে আসলি তাহলে!

কীহ! কথা দিয়ে কখনো বরখেলাফ করেছি?

আমি কি সেকথা বলেছি? বৃষ্টির মধ্যে নানান জট-ঝামেলা পার হয়ে এতদূর আসাটা কি কম কঠিন কাজ? কীরে, তুই দেখি একদম ভিজে গেছিস!

একটা তোয়ালে ছুঁড়ে মেরে বলে, নে—ধর। আগে গা মুছে নে।

শার্টটা প্রায় ভিজে গেছে। তোয়ালেতে গা মুছতে মুছতে বললাম, পুরা রাস্তায় শুকনা ছিলাম। তোদের পেঁপেগাছতলায় আসতে না আসতেই দুই কাক মিলে ভিজিয়ে দিলো!

ভালোই তো, তোকে অভ্যর্থনা জানালো আরকি। হে হে।

আয় দোস্ত পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি শুভ্রর দুলাভাই।

দুলাভাই এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এখন ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, জাহাঙ্গীর আলম।

করমর্দন করতে করতে বললাম, রাইম। আচ্ছা— আপনিই বুঝি শুভ্রর সেই সিঙ্গাপুরী দুলাভাই?

দুলাভাই কথা না বলে একটু হাসে।

কবে এসেছেন?

ঢাকায় কালকে আসলাম।

শা-লা! আগে বলিসনি কেন দুলাভাই এসেছে?

আমাদের তরফ থেকে তোর জন্য সারপ্রাইজ। অবশ্য দুলাভাইয়ের তরফ থেকেও আমাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। কী বলেন দুলা মিয়া?

দুলাভাই বলল, না-না। আপাতত কোন সারপ্রাইজ টারপ্রাইজ না—কার্ড খেলা হবে।

নিলয় বলল, সকাল থেকে জ্বালাচ্ছে। কার্ড খেলার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে মানে! বলো হয়ে আছে। শ্যালকেরা, সাদামাটা খেলা না—ধরা খেলা হবে।

তা তো অবশ্যই। দেখে নেব নাÑশালার দুলাভাই কত বড় জুয়াড়ি!

জানতে চাইলাম, এই দুলাভাই, বিদেশি মাল-টাল কী এনেছেন?

জায়গা থেকে না নড়েচড়ে দুলাভাই চকচকে একটা মার্লবোরোর প্যাকেট ঢিল মেরে বলে, এই নাও—আপাতত এটাই টানো।

আপাতত মানে? আর কী আছে?

দুলাভাই শরীর দুলাতে দুলাতে লাস্যময় ভঙ্গিতে বলে, হেহহে। সেটা এখনই না পরে।

দু’জনে প্রায় একসঙ্গেই বলে উঠি, আবার পরে কেন দুলাভাই, এখন হলে কী?

সময়েরটা সময়ে হবে। বাজিতে কার্ড খেলার উত্তেজনাটা এখন নষ্ট করতে চাই না।

ঠাট্টা করে বললাম, মানে! এতো দেখি বেশ ধূর্ত লোক! চল তিনজনে মিলে ধোলাই লাগাই। শুভ্র কোথায় রে? ওকে দেখছি না যে?

শুভ্রর কথা উঠতেই নিলয় হাসে। ও শালা রোমিও। জুলিয়েটের দেখা না পেলে তার হার্ট আউট অফ কন্ট্রোল। সাত-সকালে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে কলেজে গেছে, আর ফিরে এসেছে একেবারে রোম্যান্টিক চেহারা নিয়ে— বৃষ্টিভেজা রোমিও।

কোনমতে বলা শেষে নিলয় হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি এক সংক্রামক ব্যাধি— মন খোলা থাকলে একে আটকানো যায় না। নিলয়ের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা আর হাসির ঢঙে ওর হাসি আমার মাঝেও সংক্রমিত হয়। হাসতে হাসতে বললাম, গাধাটা এখন কোথায়?

কোথায় আর! বলে সে বাথরুমের দিকে নির্দেশ করে। আধঘন্টা যাবত গায়ে পানি ঢালছে। ঢালতেই আছে… ঢালতেই আছে…

হাসির তোড়ে নিলয়ের কথাগুলো দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। তবুও খুব উপভোগ করছি এবং ধৈর্য ধরে পুরো ঘটনাটা ধরার চেষ্টা করছি। হাসির কাছে ওর ধারা-বিবরণী অসহায়— ঠিকমতো এগুতে পারে না। আনন্দে উচ্ছ্বসিত ওর চোখ দুইটা গোল হয়ে স্থিরচিত্র হয়ে আছে— নড়ে না আর।

বে…চা…রা…! এত কষ্ট করে কলেজ পর্যন্ত গেল। কোন জুলিয়েটের দেখাতো পেলই না—না করতে পারলো কোন ক্লাস। উল্টো আসার সময় খোলা ম্যানহোলের ভিতরে… হা… হা… হা…

নিলয় ঘটনার বিবরণ পুরা করতে পারে না— হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খায়। যন্ত্রের মতো টানা হাসির শব্দ তুলে সে লুটোপুটি খাচ্ছে।

ওর অসম্পূর্ণ বিবরণের বাকি অংশ আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। কার্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে দুলাভাইও এক নিশব্দ হাসির ফোয়ারা যোগ করে। ঘটনা যেমনি হোক, আনন্দের আবহটাই এখানে সার। নিলয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সশব্দ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। এখন এই রুমে হাসি ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।

এমন সময় ঠাশ করে বাথরুমের দরজা খুলে শুভ্র গর্জন করে বলে, তোরা সব খানকি মাগি, মাদারচুদ। অই আমি কি মাগি দেখতে কলেজে গেসিলাম— নাকি ক্লাস করতে?

দুলাভাই নিলয়কে আরেকটু ভর দিয়ে বলে, শালাবাবু— আজকে কয়টা ক্লাস করে আসলা?

এই প্রশ্নের পর নিলয় আর্তনাদ করে হাসতে শুরু করে। এতে শুভ্রর রাগের মাত্রা আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়লো। দুলাভাই শুভ্রকে ভয় পাওয়ার কৃত্রিম ভঙ্গি করে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

শুভ্র বলে, দ্যাখ, আমি তোদের সাথে কার্ড খেলব না বলে দিচ্ছি।

নিলয় প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ওর গা-জ্বালানো হাসি বন্ধ করে নিচু স্বরে বলে, বাপ আমার, তোর পায়ে পড়ি। এই কথা বলিস না। দুইটা হাজার টাকা কি হেলায় ছেড়ে দিবি?

মুহূর্তেই শুভ্রর রাগ পানি হয়ে যায়। চেহারায় রাজ্য জয় করার প্রশান্তি নিয়ে বলে, এইতো, এ-খ-ন! এখন লাইনে আসলি কীভাবে?

ওদের দুজনের কথাবার্তায় কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী মামাÑবলতো?

আরে খুবই সিম্পল কেইস, বলে নিলয় আস্ত প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিলো। বাকি প্যাকেটটা আমাকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নেÑধরা।

ধরাতে ধরাতে বললাম, কয় প্যাকেট এনেছে রে?

শা-লা-র এক কার্টন এনেছে। তার মধ্যে তিন নাম্বার প্যাকেট চলছে। কত খাবি খা মামা। বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে খা। বলে শুভ্রও আরেকটা ধরায়।

সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চাইলাম, কত দিনের সফরে এসেছে রে?

মাসখানেকের।

আচ্ছা, ব্যাপারটা তাহলে কী এবার খুলে বল।

নিলয় বলে, কী আর? কার্ড খেলার বাজি নিয়ে।

তার মানে তোরা দুলাভাইয়ের সঙ্গে পাতানো খেলা খেলবি?

তোরা নয়—বল আমরা তিনজন। একজন হবে মিস্টার আলমের পার্টনার।

সেইজন আমি না হলেই বাঁচি।

ওকে, নো প্রবলেম। কাজটা শুভ্রই করবে। এ বেট অফ টু থাউজেন্ড টাকা। ওয়ান থার্ড পার পারসন। দেন হেভ ইউ অ্যানি প্রবলেম?

ভ্রুকুঞ্চিত করে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম, প্রবলেমতো একটা আছেই।

ওরা দুজনেই পাল্টা ভ্রুকুঁচকায়। ঈষৎ হা-করা মুখে নিলয় বলে, কী প্রবলেম!

সামান্য দুষ্টু হাসি হেসে বললাম, ম্যানহোলের ভিতর থেকে উঠে আসা একটা পাবলিকের সাথে বসে খেলব! শালার গা থেকে গন্ধ আসবে না!

অভিমানে ভরা করুণ কণ্ঠে শুভ্র বলে, শা-লা, তুই আমার বন্ধু? কই একটু সিমপ্যাথি দেখাবি তা না, উল্টা কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটা দেস!

সিদ্ধান্ত হলো টুয়েন্টি-নাইন খেলার। কথামতো দুই হাজার টাকার বাজি। নিলয় আমার পার্টনার। আমরা হারলে মাথাপিছু এক হাজার টাকা। যদি ওদের হারাতে পারি তাহলে দুই হাজার দিবে জাহাঙ্গীর আলম একাই। শুরুতেই এই ব্যাপারে কড়া আপত্তি তুলে বলি, আমরা সবাই খেলব রিস্কে আর শুভ্র কোন রিস্ক নেবে না— তা কী করে হয়!

পাকা জুয়াড়িদের ভঙ্গিতে দুলাভাই বলে, মিস্টার রাইম— আমার পার্টনারের ব্যাপারে ডিসিশন নেবো আমিÑওকে?

পাতানো খেলাটা অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ও সন্দেহমুক্ত করে তোলার জন্য শুরুতেই এভাবে আপত্তি করলাম। কতক্ষণ বাগবিতণ্ডার পর মেনে নিলাম, ওকে।

দুলাভাই সিগারেটের প্যাকেটটা সামনে ধরে বলে, তাহলে সিগেরেট টানো আর খেলা শুরু কর।

সিগারেট সাধার ভঙ্গি দেখে মনে হল সে নিজের শ্যালককে পার্টনার বানিয়ে বাজিতে ওর ভাগের টাকার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়েছে, আর সেখানে আপত্তি করায় আমাকে থামানোর জন্য সিগারেট ঘুষ দিচ্ছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানতে লাগলাম।

প্রথম পিটেই হাতে স্পেইড-ডাইসের জ্যাক আর স্পেইডের কিং-কুইন। তাই দুলাভাইয়ের সাথে দর কষাকষি করে কল ষোল থেকে বাইশে তুললাম। ভেবেছে ফেঁসে গেছি। কল ছেড়ে দিয়ে বলে, তাহলে একটা ডাবলের খেলা চলুক।

গলা খাঁকড়িয়ে বললাম, তাই নাকি দুলাভাই! তাহলে একটা রিডাবলের খেলা চলুক।

রিডাবল! পাক্কা?

আবার জিগায়!

দুলাভাই থাই চাপড়ে বলে, শুরুতেই খেলা জমিয়ে দিলে। শুভ্রকে সতর্ক করে দিয়ে দুলাভাই নিজেও নড়েচড়ে বসল।

শেষ পর্যন্ত কলটা হারলাম। দুলাভাই খুব ভালো খেলেছে। অবশ্য কারণও আছে। রঙের তাস ছিল দুই হাতে। দুলাভাই তাসগুলো সুযোগমতো কাজে লাগালো, তাই সাহেব-বিবি দিয়েও আর শেষ রক্ষা হয়নি।

শুভ্রও বেশ জমিয়ে খেলছে। শালা একটা পাক্কা কুশীলব! হাবভাব দেখে মনেই হচ্ছে না সে জেতার আগে থামবে। দুলাভাইয়ের সাথে রীতিমতো মাতামাতি উদযাপন শুরু করেছে।

শুরুতেই অপ্রত্যাশিত রিডাবল খাওয়ার পর নিলয় চটে গিয়ে বলল, শালা, মেয়ে পটানো যত সোজা কার্ড খেলা তত সোজা না। বি সিরিয়াস।

মেয়েলি প্রসঙ্গ টেনে আমাকে খোঁচা মেরে নিলয় মস্ত ভুল করেছে।

মাঝে মাঝেই নীলা আপুকে নিয়ে শুভ্র-নিলয় তর্কাতর্কি করে একে অন্যের নামে যেসব দুর্নাম রটায়— ওসবের মধ্যে বেশকিছুই আমার পেটস্থ আছে। নীলা আপুর প্রসঙ্গ টানলে শুভ্রর পক্ষ থেকে জোড়ালো সমর্থন পাওয়া যাবে ঠিকই তবে নিলয়ও আমার এই সমর্থককে পাল্টা জবাব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। তাই এত কাছ থেকে শুরু না করে একটু দূর থেকেই শুরু করলাম, মেয়ে পটানো খুব সোজা— না! কয়টা পটিয়েছিস— হুম? এলাকার একটা মেয়ে— এত কিছু করেও তার মন যোগাতে পারলি না, হাল ছেড়ে দিলি।

ওকে আচ্ছামতন জব্দ করা গেল। মেয়েটার নাম মোনালিসা। নিলয়ের সাথে ওর আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। নিলয় আর যাই হোক অন্তত ওর প্রসঙ্গটা এখানে কামনা করেনি। আমাকে সে শাসিয়ে বলে, দ্যাখ! না জেনে ফাও কথা বলবি না বলে দিলাম।

এবার শুভ্র যোগ দিয়ে বলে, অ্যাঁ! আবার হুমকি দেয়। না জেনে ক্যান? মোনালিসার পেছন পেছন ঘুরঘুর করসনি? বলÑবল!

কে বলেছে তোকে? মোনালিসা?

দ্যাখ নিলয়, মোনালিসা-তুই-আমি তিনজনই গাজীপুরের। সে বা তুই না বললেও কী! আমি সব জানি। পাত্তা না পেয়ে তুই এখন ওর ছায়াও মারাস না।

কার্ড পিটাতে পিটাতে দুলাভাই গান ধরে,

“আমার একটা নদী ছিল— জানলো না তো কেউ

এইখানে এক নদী ছিলÑজানলো না তো কেউ

নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না— ছিল শুধু ঢেউ… হঅঅঅ…”

নিলয় ফুঁসতে থাকে। বলে, মোনালিসা তোদের দুজনেরই বেস্ট ফ্রেন্ড। যেদিন মোনালিসা একথা বলবে, সেদিন এসব বলতে আসবি। কোথাকার কে কী বলল আর ওসব নিয়ে এসে প্যাঁচাল পারিস। ফা-ল-তু!

এতেই আমি দমবার পাত্র নয়। জবাবে বলি, মোনালিসা বলবে তোর কথা! সে তোর নাম পর্যন্ত শোনতে পারে না।

এতক্ষণ ধরে দুলাভাই আমাদের ঝগড়া শুনছিল। এবার শাসিয়ে বলে, আরে ধুর। হুদাই বিষয় নিয়ে তর্ক বাঁধানোর কী মানে হয়! খেলা জমছে না।

আমি বললাম, আচ্ছা দুলাভাই! খেলায় তো হারজিৎ থাকবেই। একটা রিডাবল খেয়েই এমন আপসেট হওয়া কি ঠিক? তার উপর পার্টনারকে আলতু-ফালতু খোঁচা মারা?

নিলয় প্রতিবাদ করে, খুঁচাচ্ছিস তো তুই— হারামি!

আমি বলি, শুরুটা করল কে?

ইতিমধ্যে আরেক কল উঠে গেছে। এবার নিলয় একুশে কল নিয়ে পুরো পঁচিশ ফোঁটা তুলেছে। কথার তালে তালে এমনভাবে খেলছিল যেন প্রতিটা পিটে তাস ছুঁড়ার সময় মোনালিসার প্রতি চরম আক্রোশে তার ক্ষোভ ঝাড়ছে। এক এক করে সে পঁচিশ ফোঁটা গুনে চ্যালেঞ্জের মতো করে তাসগুলো ছুঁড়ে মেরে বলে, দ্যাখ—এভাবে খেলতে হয়।

বৃষ্টিমাতাল ঘোরে মোনালিসা আর সিগারেট মিলিয়ে খেলা বেশ জমেছে। নিলয়কে জবাবদিলাম, কার্ড পেটানো যত সোজা মেয়ে পটানো তত সোজা না।

চলবে…

সোহরাব হোসেন। কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। জন্ম ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায়, বর্তমান নিবাস চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ক্যামিকৌশলে গ্রাজুয়েশন করেছেন। প্রকাশিত বই: 'আটপৌরে গল্প' (২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ