প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
উঠোনে প্রত্যুষের আলোয় গাছের ছায়া আঁকিবুঁকি খেলছে। শামিয়ানা টানানো হয়েছে। ফজলে চাচা রান্নাবান্নার তদারকিতে ব্যস্ত। গ্রামশুদ্ধ ছোট বড় সকলের কাছে তিনি হজইল্যার বাপ। আমরা বলি ফজলে চাচা। পাশের গ্রামের। আব্বা গ্রামে এলে আঠার মতো লেগে থাকতেন। যে কোনো প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আব্বার অবর্তমানে ঘরের পিছনের জায়গাটুকুতে গাছ লাগানো, নিয়মিত পানি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার সহ বাগান পরিচর্যার কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করতেন ফজলে চাচা। আম, নারকেল, কলা, তাল, সুপারি নিয়ে মাঝে মাঝেই হাজির হতেন আমাদের শহরের বাড়িতে। শক্ত সামর্থ্য মানুষটি বয়সের চেয়েও বুড়িয়ে গেছেন যেন! অবশ্য এবার দীর্ঘদিন পর ফজলে চাচাকে দেখি।
কাচারি ঘরের একপাশে প্রকাণ্ড আমগাছের ছায়ায় ইট বসিয়ে চুলা বানানো হয়েছে। বড় বড় ডেকচি আনা হয়েছে গাঁয়ের বাজারের ডেকোরেশনের দোকান থেকে। গরু জবাই হয়েছে ফজরের ঈষৎ পরেই। শামিয়ানার নিচে চেয়ার টেবিল সাজানো হচ্ছে।
টেবিলের উপর প্লাস্টিকের জগ, গ্লাস রাখছে মুবিন। মুবিন আমার চাচাতো ভাই। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এই বয়েসি ছেলেপেলেরা একটু উড়াধুরা হয়। সংসারের কোনো কাজে সহযোগিতা করার কথা বললে ‘পারুম না’ বলে বন্ধুদের আড্ডায় ‘দে ছুট’ দেয়। কিন্তু মুবিন তেমনটি নয়। বড় নম্র, ভদ্র গোছের ছেলে। তাকে শেষ দেখেছি পনর বছর আগে। তখন সে ভাসা ভাসা চোখের ৪/৫ বছরের ছোট্ট শিশু।
ঈদ উপলক্ষে আমরা দাদার বাড়ি গেলে আব্বার নির্মিত ঘরে ঘুমাতাম না। মানুষজন না থাকায় ঘরের জানালা, দরজার কাঠে ঘুনেপোকা বাসা বাঁধত। মাকড়সাও কম যায় না। আর তাই ছোট কাকার ঘরে ঘুমাতে হোত। স্থান সংকুলানের অভাবে মুবিন আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাত। ঘুমের আগে গল্প শুনতে চাইত। রাজ্যের কথা বলত। আমি জানতে চাইতাম, ‘মুবিন, আমি তোর কে রে?’ সে দ্রুততার সাথে উত্তর দিত, ‘বুইন’। তারপর বড় বড় চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলত, ‘তুমি আমার বুইন’। ঘরের জানালার শিক ভেদ করে বাইরের আবছা আলো সমান্তরাল ছায়া ফেলে মুবিনের মায়াবি মুখে এসে পড়ত। ঘুমে ঢুলু ঢুলু সেই মুখ আমার আজও কেমন ঘোরের মতো চোখের সামনে ভাসে।
পনর বছর কত দ্রুত কেটে গেল!
‘শৈবাল ডেকোরেশন’ দোকানের নামটি ছোট কাকা নিজের প্রথম সন্তান ‘ শৈবাল’ এর নামে রেখেছেন। শৈবাল অবশ্য ছোট কাকার প্রথম সন্তান নয়। পর পর তিন সন্তান জন্মেছিল। ভূমিষ্ঠ হবার কয়দিনের মধ্যেই অজানা কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই চতুর্থ সন্তান শৈবাল তাদের বড় আবেগের, ভালোবাসার সন্তান। বেশ অনেক বছর পর ছোট ছেলের জন্ম হলে নাম রেখেছিলেন ‘প্রবাল’। কিন্তু গাঁয়ের মুরুব্বিস্থানীয় কে যেন বলেছিলেন নাম মিলিয়ে রাখলে সেই সন্তান বাঁচে না। আর তাই ছোট কাকা অজানা আশংকায় অল্পদিনেই নাম পাল্টে রাখেন মুবিন। তাদের দ্বিতীয় সন্তান মুবিন।
কাকা আর আব্বার মধ্যে কখনোই মতের মিল ছিল না। একই মায়ের গর্ভের ভাই হলেও স্বভাবে দুইজন ছিলেন উত্তর-দক্ষিণ। জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায়ই মতবিরোধ হত। বিবাদ লেগে থাকত। বয়সে ছোট হলেও সব বিষয়ে প্রভাব খাটাতে চাইতেন ছোট কাকা। জমি-জমা কাকে বর্গা দিবেন, কাকে দিবেন না, এইসব। কখনো বড় গাছটি বলা-কওয়া ছাড়াই বিক্রি করে দিতেন। কিংবা সব গাছের আম-কাঁঠাল বিক্রির উদ্দেশ্যে গাঁয়ের হাঁটে পাঠাতেন।
আব্বা সহজ সরল মানুষ। সরকারি চাকুরির সুবাদে শহরে থাকলেও নিগূঢ় সত্য হল এই যে, তাঁর হৃদয়,সত্ত্বা প্রবলভাবে গাঁয়ের মাটিতে প্রোথিত ছিল। শহরে তিনি নিজেকে ক্ষণিকের অতিথি ভাবতেন। চাকুরি থেকে অবসরের পর গাঁয়েই স্থায়ী হবেন এমনটি ভাবনা করতেন। মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে সাহায্যের জন্যে কেউ আমাদের শহরের বাসায় এলে তাদের মারফত আব্বা অনেক খবরাখবর পেয়ে যেতেন। মন খারাপ করা খবর। ছোট কাকা অমুক পুকুরের মাছ জেলেদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তমুক জমির ধান কিংবা সেগুন গাছ বিক্রি করেছেন… ইত্যাদি। এ নিয়ে আব্বার দুঃখের অন্ত ছিল না। কিন্তু ভাই বলে কথা। দুই একবার প্রতিবাদ করেছেন যদিও, কিন্তু খুব বেশি জোরালোভাবে নয়।
জীবিতাবস্থায় দুই ভাইয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকলেও আজ আব্বার মৃত্যুর চল্লিশদিন পর দোয়া পড়ানো, কোরআন খতম দেয়া, আত্মীয়-স্বজনসহ, আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষদের খাওয়ানোর যে আয়োজন চলছে, তাতে ছোটকাকার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ মনঃকষ্ট অনেকটাই ভুলিয়ে দেয়।
ঘর ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, গাঁয়ের মানুষজন। আমি বসে আছি আব্বার ঘরে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঘরটিতে ছোটকাকা সপরিবারে বসবাস করে আসছেন। অদূরে পরিত্যক্ত জায়গা ছিল। ভাগ বাটোয়ারায় পরিত্যক্ত জায়গা, পরিত্যক্ত ডোবা পেয়েছিলেন আব্বা। মনঃক্ষুণ্ণ হলেও উচ্চবাচ্চ করেননি। যে ঘরটিতে আত্মীয়পরিজন বেষ্টিত আমি বসে আছি, এটি আব্বার তৈরি। বড় শখ করে বানিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় শহরের কোলাহল ছেড়ে এইখানে এলে শীতল এক শান্তি পেতেন। ছুটির দিনগুলোয় আব্বার একমাত্র বিনোদন ছিল এই স্থান। পরিত্যক্ত ডোবায় মাটি ফেলে ভরাট করে বাগান বানিয়েছেন। নারকেল, সুপারি, আমসহ আরো কত রকম গাছ!
বসার ঘর থেকে উঠোনের হাঁক ডাক শোনা যায়। দুপুরের আগেই বাবুর্চি রান্না শেষ করবে। শুক্রবার। জুম্মার নামাজ আদায়ের পরই খাবার পরিবেশন করা হবে। ফুফু, চাচীরা চোখ মুছছেন আঁচলের কোণায়। আব্বার গুণগান করছেন। আব্বা কতটা ভালো মানুষ ছিলেন, সেইসব।
মাথায় ওড়না টেনে উঠোনের একপাশে আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াই। ফজলে চাচা ব্যস্ততায় দ্রুতপায়ে পুব দিক থেকে আসছিলেন। আমায় একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন। গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে কপোল বেঁয়ে নেমে যাওয়া ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,
– তোমার আব্বা যখনই গেরামে আইত, ট্যাহা দিয়া যাইত। আমার পোলা সজলের স্কুলের ভর্তির ট্যাহা, রোগে, ব্যারামে আমাগো ডাক্তর দেহানোর ট্যাহা …। এমুন ফেরেস্তার লাহান মানুষ আশেপাশে দশ গেরামে নাই।
গামছা দিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। নিখাঁদ অশ্রুজল। অতঃপর ব্যস্ততায় হেঁটে গেলেন পশ্চিমের দীঘির পাড়ের দিকে।
চোখের সামনে আব্বার মানবিক গুণাবলিগুলো ভেসে উঠল আলোর ঝলকানির মতো। আলোর মশাল হাতে হেঁটে চলা মানুষ। পৃথিবীর বুকে জীবন চলার পথে আলো ফেলে হাঁটা মানুষ। যে আলোয় পথ দেখে এ গাঁয়ের কিছু মানুষ অন্তত সামনে এগিয়ে যেত।
জুম্মার নামাজ শেষে হাফেজ সাহেব এগিয়ে আসেন। বলেন,
– আপনের আব্বায় আল্লাহর নেক বান্দা আছিলো। রোগে ভুগে নাই। রোগশয্যায় কাউরে কষ্ট দেয় নাই। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা রে উঠায়া লইয়া গ্যাছে। সন্তান হিসাবে আপনাদের দোয়া সবার আগে কবুল হইব। আপনেরা তাঁর জন্য মুনাজাতে দোয়া কইরেন, মা।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঝাপসা হয়ে আসে দুই চোখ। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাই।
আকাশে দুপুরের সূর্য। নিরুত্তাপ ঝকঝকে রোদ। শামিয়ানার নিচে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে আসা চেনা-অচেনা মুখ। খেতে বসেছে সকলে। গরুর মাংস, মোটা চালের ভাত, আর বুটের ডালের ঝোল। খুব সাদামাটা খাবার। মানুষগুলো তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। আব্বা বেঁচে থাকতে এমন করে গাঁয়ের মানুষদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন। প্রতি বছর দুইবার হত এমন আয়োজন। কোরবানি ঈদের সময়ে, আর দাদুর মৃত্যু দিবসে। দাদু মারা যাবার পর প্রতি বছর কাচারি ঘরে কোরআন খতম পড়ানো হত। আর আশেপাশের প্রান্তিক মানুষদের খাওয়ানো হত। আব্বার মৃত্যুর পর তাঁকে অনুসরণ করে আমি আজ একই কাজ করছি। মানুষের জীবনের সাথে জীবনের এইসব মিল বিগত দিনে কত যুগ যুগ ধরে চলছে, কে জানে?
সূর্য একটু একটু করে পশ্চিমাকাশের দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। মানুষগুলোর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বাড়ির পিছনে বাগানের দিকে যাই। ছায়াঘেরা স্থান। জমিনে গাছেদের অগণন দীর্ঘ ছায়া বুক পেতে শুয়ে আছে যেন। গভীর আদিম কোনো অরণ্যের মত নির্জন স্থান। ডানে দীঘির পাড়ে বাঁশের মাচায় বসি। গ্রামে এলে এইখানে ঘন সবুজে নির্মল বাতাসে আব্বা বসে থাকতেন বিকেলের দিকে। সন্ধ্যা নামার আগ অব্দি। বাগান, গাছ, দীঘি, এইসব নিয়ে আব্বার অনেক পরিকল্পনা ছিল। ভাবনা ছিল। মানুষ হারিয়ে যায়, কিন্তু তাঁর ভাবনাগুলো পৃথিবীতে থেকে যায়। মৃদু শীতল বাতাসের পরশ গা ছুঁয়ে গেল। তুমুল বৃষ্টি শেষে এক পশলা রোদের মতন আরামবোধ হোল। এমন নৈসর্গিক অনুভূতিতে পৃথিবীর প্রতি মায়া বাড়ে। আরো বহু বছর বেঁচে থাকার অভিলাস তীব্রতর হয়।
সীমাহীন আকাশের গা ঘেঁষে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। গোধূলিবেলার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে দীঘির স্বচ্ছ জলে। তরঙ্গহীন নিথর জলরাশি। আমি পায়ের আঙুল ভিজিয়ে জলের স্পর্শ নেই। শান্ত, শীতল জলের স্পর্শ আব্বার মুখখানি মনে করিয়ে দেয়। মাথা নুইয়ে জলের দিকে তাকাই। ঘনায়মান সন্ধ্যার আকাশ দেখি জলের গভীরে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসে নীলাকাশে। একঝাঁক বলাকা উড়ে যায় জলের বুক চিরে। জলের নিচে একই সঙ্গে আকাশ, মেঘ, আর উড়ে যাওয়া বলাকা, পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য!
– রাশু …
কারো কাঁপা কণ্ঠের ডাকে সম্বিত ফিরে। এ বড় চেনা স্বর। বড় আপন স্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরি। চাচাতো ভাই শৈবাল দাঁড়িয়ে। আমার চেয়ে বছর তিনেক বড়। লেখাপড়ায় দারুণ মেধাবি ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার সময়কার কয়টি মাস আমাদের বাসায় ছিল। ভর্তির কোচিং করেছিল তখন। ভর্তির পর হোস্টেলে সিট পেতে দেরি হচ্ছিল। চিলেকোঠার রুমে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল আব্বা। আমায় পড়া দেখিয়ে দেবার সুবাদে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। ভাব থেকে ভালোবাসা। বইয়ের পাতার ভেতরে লুকিয়ে চিঠি আদান-প্রদান চলত। বাসার সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, কোচিং ফাঁকি দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা টিএসসির আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম। এক একটি বিকেল একসাথে গল্প করে, স্বপ্নের ডাল-পালা ছড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমি ফিরতাম কিছু আগে। শৈবাল ফিরত সন্ধ্যা ঘনাবার কালে। একই সঙ্গে ভয় এবং ভালোলাগার আনন্দ ওতোপ্রোতভাবে মিশে থাকার অনুভূতিতে ডুবে ছিলাম বেশ অনেকগুলো দিন। সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। নিবিড় হয়। জীবনটা প্রজাপতির মতো রঙিন মনে হত। তুমুল উথাল-পাতাল ভালোবাসার দিনগুলোতে আমরা কেউ কাউকে কোনোদিন ছেড়ে না যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম হাতে হাত রেখে। শৈবাল খুব আবেগি হয়ে সেদিন বলেছিল,
-রাশু, যদি কোনোদিন আমায় ছেড়ে যাস, তবে তার আগেই যেন স্রষ্টা আমায় তুলে নেন। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না রে।
আমি মোহাবিষ্টের মতো নির্বাক তাকিয়ে থেকেছি সেদিন।
কিন্তু জগতে প্রতিশ্রুতি দেয়ার চেয়ে তা রক্ষা করা অনেক কঠিন, এ সত্য সেদিন আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিল বোধ হয়। কাকীমার প্রবল আপত্তির মুখে শৈবাল প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেছিল, ‘এক জীবনে মানুষের সব চাওয়াই তো আর পাওয়া হয় না। জীবনকে আবেগে চালিত করা ঠিক নয়।’ অসীম বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেদিনও। তবে কি শৈবাল ঘোরের মাঝে ছিল? আচমকা বাস্তবে ফিরে এসেছে? ভালোবাসলে হাজারটা প্রতিকূলতা থাকবে। তাই বলে …
উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাকীমা ডাক্তার পুত্রের জন্যে বিত্তশালী পরিবারের কন্যা খুঁজছিলেন। শৈবালের প্রয়োজন পাশ করার পর রোগী দেখার জন্যে চেম্বার। নিজস্ব কোনো ক্লিনিক। কিংবা আরেকটু বড় পরিসরে হলে, হাসপাতাল। আমার সরকারি চাকুরীজীবী আব্বার যে সেই সামর্থ্য নেই, তা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তাছাড়া পারিবারিক ছোটখাটো বিরোধ তো ছিলই।
কিন্তু এতদিন পর কী বলতে চায় শৈবাল? বুকের ভেতরে হাতুড়িপেটা শব্দ টের পাই। অবশ হয়ে আসছে শরীর। অভিমানের এক আকাশ মেঘ জমে ছিল ভেতরে। যেন মেঘের কলস ফুটো হয়ে ঝরে পড়বে জমিনে।
অবলীলায় অঝোরে ঝরে পড়া অসংখ্য প্রতিশ্রুতিময় মুহূর্তের কথা মনে পড়ে যায়। আমার কী বলা উচিত? এড়িয়ে যাব ? বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলছে। বাঁশের মাচা থেকে উঠে দিঘীর পাড়ে এসে দাঁড়াই। আমরা দাঁড়িয়ে আছি মুখোমুখি। কিছুটা দূরত্বে অচেনা আগন্তুকের মতো। অথচ একদিন এই মানুষটির উপস্থিতি নিউরনে অনুরণন তুলত।
– এবার দেশে থাকবে কিছুদিন?
আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আগে তো আমায় তুই সম্বোধন করতো শৈবাল। এখন দূরের মানুষ, তাই ‘তুমি’ হয়েছি হয়তো! বললাম,
-চলে গেলে খুশি হও বুঝি?
-ছিঃ ছিঃ এভাবে বলছ কেনো! সেই যে দেশ ছেড়ে গেলে, জেঠিমার অসুস্থতার সময়ও এলে না। ভেবেছিলাম মৃত্যু সংবাদে অন্তত জেঠিমার মুখটা দেখতে আসবে। তা-ও এলে না। তোমায় খুব দেখতে চেয়েছিলেন।
এক পৃথিবীসম অপরাধবোধ তাড়িত করলো মুহূর্তেই। দীর্ঘ পনরটি বছর! একজীবনের হিসেবে দীর্ঘ সময়। বিগত পনরটি বছর দেশে ফিরিনি। সীমানারেখা এঁকে দেয়ার মতো করে বিচ্ছেদের দেয়াল তুলে দিয়েছিলাম দেশের সাথে, বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন সকলের সাথে। শৈবালের প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণার বলি হল আমার মৃত্যুপথযাত্রী আম্মা। প্রাণপ্রিয় আব্বা। তাঁদের জীবদ্দশায় আমার দেশে ফেরা হল না। ক্ষমার্য এক অনুশোচনা তীব্রভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল বুকের বাঁ পাশে। ক্ষোভে, অভিমানে বলি,
– মৃত্যুশয্যায় আম্মা আমায় দেখতে চেয়েছিলেন, জানি। একজীবনে মানুষের সব চাওয়াই কি পূর্ণতা পায়? কিছুই কি থেমে থাকে কারো জন্যে?
-‘ আমার কথা আমায় ফিরিয়ে দিলে?’ বেদনার্ত ফ্যাকাসে মুখে বলল শৈবাল।
অতঃপর সন্ধ্যার ঘোলাটে আলোয় অস্পষ্ট চাহনিতে বলল, ‘প্রতিটি মানুষের দৃশ্যমান জগতের বাইরে আরেকটি জগত থাকে। সেই জগতে আমি ভালো নেই, রাশু। নীরার সাথে আমি ভালো নেই। আমরা দীর্ঘদিন যাবত একই ছাদের নিচে যোজন যোজন দূরত্বে রাত কাটাই। ওর বাবার টাকা এবং অনুকম্পা না পেলে আমি নাকি গলির মোড়ের হাতুড়ে ডাক্তার হতাম। প্রতিনিয়ত এমন অপমান অপদস্থ হতে কার ভালো লাগে বলো? দূরত্বটা এভাবেই বেড়েছে খুব ধিরে।’
শৈবালের বুক চিরে চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ টের পাই। আমি কেনো তার বেদনার, দুঃখের গল্প শুনছি? কেনোইবা অতল হতাশার কথা শুনছি? তবে কী দুর্নিবার এক টান দীর্ঘদিন বোতলবন্দি ছিল? কেউ কী সেই বোতলের ঢাকনা খুলে দিয়েছে আজ ? নাহ্ এ হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। সবকিছু প্রবলভাবে উপেক্ষা করে বাড়ির দিকে ফেরার তাগিদ দেই।
বাবার হাতে গড়া সবুজ বনে সন্ধ্যার আঁধার জেঁকে এসেছে। আমরা পা বাড়াই এক চিলতে আলোর দিকে। যেদিকে সরলরেখার মতো চিকন এক কণা আলো এসে পড়েছে নিকানো উঠোনে। যেদিকে ছোটকাকার ঘর। আমার বাবার পূর্বপুরুষের ঘর। আজ রাতটা এ ঘরেই কাটাতে হবে।
শৈবাল কাচারি ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কী যেন হিসেব নিকেশের কাজ আছে বলল।
ভোরের ট্রেনে ফিরতে হবে আমায় ঢাকায়। রাতের ফ্লাইট ধরতে হবে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে চার্টার বিমানে সিট পেতে। ভাগ্যিস গাঁয়ের দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েনি এখনো। মুঠো ফোনে খবর পেলাম, নিউইয়র্কের মানুষ এখনও মুখর হয়নি। এখনো ছন্দে ফিরেনি জীবন। নিঃশব্দে ঝরে পড়া শিশিরের মতো ঝরে গেছে কতজন। চলে গেছে অনন্ত অসীম এক জগতের দিকে।
ওই তো কিছুটা এগোলেই ছোট কাকার ঘর। ওইটুকু পথ হেঁটে যেতে যেতে শিউলিঝরা পথের কথা মনে পড়ে গেলো। ছোটবেলায় এ পথে কত যে শিউলি কুড়িয়েছি! অনেককিছুই আগের মতো নেই। কিন্তু শিউলি গাছটি আজও আগের মতই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আছে হিজলের গাছও।
– ‘তোমারে’ খুঁজতেছিলাম, কই আছিলা এতক্ষণ?’
কাকিমা এগিয়ে আসেন। গভীর মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে কতকাল এমন করে কেউ মমতার হাত ছোঁওয়ায়নি। মাথার উপরে ছায়া দেয়ার, হাত বুলিয়ে দেয়ার মানুষ দুইজন আজ ধরা-ছোঁওয়ার বাইরের জগতে। অনন্ত পরপারে। বুক ভেঙে কান্না পায়। নিজের কান্না নিজেই গিলে ফেলি। চোখে মেঘের সজলতা। কাকিমা বলেন,
‘ দ্যাশে আইও না ক্যান? আমাগো উপরে রাগ করছো?’ আধো অন্ধকারে কাকিমার চোখে জল চিকচিক করে দেখতে পাই। আমি চোখ নামিয়ে নেই। কী বলব? কী বলা উচিত? আঁচলের কোণে চোখ মুছেন তিনি।
-খাঁটি সোনা চিনলাম না। সবই মন্দ কপালের দোষ। মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, এইসবের উপরে কারো হাত নাই গো মা।
– থাক না কাকিমা, এইসব বলে কি লাভ?
– দেইখ্যা শুইন্যা বড়লোকের মাইয়া বিয়া করাইসিলাম আমার সোনার টুকরা পোলাডারে। এহন জীবন নিয়া খাবি খাইতাছে। কিছু জিজ্ঞাইলে মাতে না। ক্যামন দম ধইরা থাহে। দম লওয়ারেই কী জীবন কয়, কও?
– কেনো, কী হয়েছে?
– আর বইল্য না, বউমার বাপে শৈবালরে একখান ক্লিনিক দিয়া দিসিল। ভালাই চলতেসিল। কিন্তু বৌমা তো নাকি উঠতে বইতে খোঁটা দেয় এইসব লইয়া। শেষম্যাস আমার পোলাডারে ঘর-জামাই বানাইয়া ফালাইলো। ওরে গেরামে আইতে দিতে চায় না। আমাগো লগে যোগাযোগ রাখতে দেয় না। হের কথায় উঠতে বইতে অইবো। কও, এইভাবে কি জীবন চলে? কত্ত তাবিজ নিসি, পানিপড়া খাইছি, আল্লাহর কাছে কানসি বাজান রে বাচানোর লাইগ্যা। কষ্ট কইরা পড়াইছি লেহাইছি …
কাকিমা আঁচলে অশ্রুজল মুছেন। ক্ষণিক নিস্তব্ধতার অবসান ঘটিয়ে আবার বলতে থাকেন,
– সন্তানাদি হইলেও না হয় সব ঠিক হইয়া যাইত। হেই আশাও তো নাই। আমাগো লগে চাতুরি করসে। আল্লায় বিছার করব। বৌমা যে কোনোদিন সন্তানের মা হইতে পারবো না, এইডা বেয়াই-বেয়াইন আমাগো লগে গোপন করসে। কী এক ব্যারাম নাকি হইসিল ছোডকালে। জরায়ু ফালায়া দিতে হইসিল।
কাকিমা হুহু করে কাঁদছেন।
কী বলবো বুঝে উঠতে পারি না। আমার কী জড়িয়ে ধরা উচিত? কিংবা সান্তনা? বুকের পাঁজর ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বেদনাতাড়িত হই। বিষাদ গ্রাস করে আমায়। কাকীমার দুঃখ-বেদনা সংক্রমিত হয়ে আমার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অভিমান কর্পূরের মতো উবে যায়। ভুলে যাই বিগত পনর বছরের প্রতিটি মুহূর্তের সেই নিদারুণ যন্ত্রণার কথা। ভালোবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার বেদনার কথা। পৃথিবীতে কত কী-ই তো আমরা মনে রাখি না। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে, ফিরে যায়, আবার আসে। আমরা কয়জনে তা মনে রাখি?
আকাশে বিদ্যুতের তরঙ্গ। গাড়ি মেরামতের গ্যারেজে লোহা কাটার সময় আগুনের যে ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, ঠিক তেমন। প্রকৃতিতে ঝড়ো হাওয়া। থেমে থেমে বজ্রপাতের হুঙ্কার। মেঘের ডাক।
রাত পোহালেই যেতে হবে আমায়। উড়াল যানে পাড়ি দিতে হবে সাগর, মহাসাগর। জীবনটাই যে এক অবধারিত ভ্রমণ! শেষ রাতের ঘোর লাগা বিষণ্ণ কোনো সুরের মতো দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে পৌঁছতে হবে আমার ঠিকানায়।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..