দাউদ হায়দারের বক্তৃতা

দাউদ হায়দার
সংবাদ, সাক্ষাৎকার
Bengali
দাউদ হায়দারের বক্তৃতা

দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিননি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানির বার্লিনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি দীর্ঘদিন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি একজন আধুনিক কবি। তাঁকে সত্তর দশকের অন্যতম বিপ্লবী কবিও বলা হয়। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্যসভা ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর দেয়া বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা অংশুমালীর পাঠকদের উদ্দেশে এখানে দেয়া হলো।

– জোবায়েন সন্ধি, প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক

(পুনে নিখিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এ বক্তৃতা। ৯ নভেম্বর ২০১৭)

মাননীয় শ্রোতৃকুল,

আন্তরিক বিনতি জানবেন।

বক্তৃতা-শেষে, কী বলবেন আড়ালে, জানা আছে। কবি রায়গুণাকর (ভারতচন্দ্র রায়) যা বলেছেন, “সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।” তো, বাচালতার জন্যে মার্জনাপ্রার্থী।

বছর আটেক আগে পুনে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতাদের আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলুম, প্লেনে যাতায়াতের টিকিট, হোটেলে সুব্যবস্থারও আয়োজন ছিল, কথাও দিয়েছিলুম, শেষ পর্যন্ত বাদ সাধে ‘পারিবারিক ঝামেলা।’ বিয়ে করিনি ঠিকই, কিন্তু অবিবাহিত-সংসারে ফ্যাসাদ বহুবিধ। “বঁধুয়া বন্ধ করিল দুয়ার/আন্ধার হৈল বহির্দ্বার।” বুঝতেই পারছেন বিপদের পরিমাপ।

আপনাদের এই অনুষ্ঠানে প্রেক্ষাগৃহভর্তি জনকুল দেখে ভিমরি খেয়েছিলুম প্রথমে। আয়োজকদেরই একজন, খুবই সত্যবাদী তিনি, সবিনয়ে বললেন, “আপনার বাচালতা শুনতে আগ্রহী নয় কেউ, শ্রোতারা এসেছেন গান শুনতে। অনুষ্ঠানশেষে খাবারের আয়োজন আছে।” জেনে আশ্বস্ত।—বাচলুম।

শুনলুম, পুনে শহরে এখন সাড়ে ৩ লাখের বেশি বাঙালির বাস। কেবল পশ্চিমবঙ্গেরই নয়, পূর্ববঙ্গেরও—যাঁরা, দেশভাগের আগে-পরে উদ্বাস্তু। ঠাঁই নিয়েছেন প্রথমে মুম্বাইয়ে, নাসিকে এবং মহারাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে, পরে, অনেকেই পুনের মাটি বেছে নিয়েছেন।

আজকের পৃথিবীতে ইমিগ্রান্টস শব্দটি চালু হয়েছে খুব। যাকে বলে ‘উদ্বাস্তু।’ পৃথিবীতে কে নয় উদ্বাস্তু? ওল্ড টেস্টামেন্টে কথিত, “বাবেল থেকে মানুষের ধারা প্রবাহিত।” এই প্রবাহে কোনো গোত্র-বর্ণ-জাতিভেদ-ধর্ম ছিল না। এমন কী ‘মানুষ সম্প্রদায়ও’ ছিল না। গোত্র-বর্ণ-জাতি-ধর্ম বেশি দিনের নয়। বৈদিকযুগেও পাওয়া যাবে না। থাক এসব কূটকাচাল। বেশি বললে রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলো জট পাকিয়ে একাকার হবে। আপনারা ঘোঁট পাকাবেন। বরং পুনের স্মৃতি কচলাই।

১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারতে আশ্রিত। শুরুতে কলকাতায়। অতঃপর অ্যাডভেঞ্চার। ভারতের নানা রাজ্যে। খেয়ে-না-খেয়ে। ট্রেনে দু’ধরা পড়ে দিনদশেক জেলে কাটিয়ে, ছাড়া পেয়ে আবার অ্যাডভেঞ্চার। থাক বিস্তারিত। চলে এলুম পুনে। শুনলে অবাক হবেন, ঠাঁই নিই ভগবান রজনীশের আস্তানায়।—সে বহুৎ কেচ্ছা।

ভগবান রজনীশের আশ্রম থেকে পালিয়ে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। ওখানে এক বন্ধু ছিলেন, তিনি বাংলাদেশের, ছাত্র। তাঁর পাল্লায় পড়ে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্রও দুই ছাত্রীর মায়ায় জড়িয়েও এক সন্ধ্যায় লাপাত্তা।

—কী রকম খারাপ, ত্যাঁদড় বুঝতেই পারছেন। ‘দুষ্ট চরিত্র’ও বলতে পারেন।

৪০ বছর পরে পুনে এসে দেখছি, গোটা শহরের আমূল পরিবর্তন। আগের পুনে আর নেই। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে দালানকোঠার চেহারাচরিত্রের হদিশ পাওয়া দুষ্কর। পদে-পদে হোঁচট খাচ্ছি। বাঙালির সুরত সর্বত্র। বাংলা বইয়ের দোকান, বাংলা পত্রপত্রিকা, মায়, বাজারে কাসুন্দী, ইলিশ মাছও পাওয়া যাচ্ছে।

গতকাল এক বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে ইলিশের পাতুরি খেয়ে হাঁই তুলেছি, বাঙালরা যেমন হাঁই তোলেন। দোক্তা-পান না-খেয়েও।

পুনে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের অন্যতম পান্তা সূর্য সেনগুপ্ত, আপনাদের অজানা হয়তো, কিংবা জানেন, ওঁর পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশের পাবনার, এবং পূর্ব পুরুষ কান্তকবি রজনীকান্ত সেন। যাঁর গান ভারত ভাগের আগে, স্বদেশী আন্দোলনে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল।

এই অনুষ্ঠানের শুরুতে সূর্য বললেন, “ওর পরিবারের সবাই কবি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চৌহদ্দির ধ্রুবতারা।” সূর্যর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

—ঠিক যে, আমরা পাঁচভাই গদ্যপদ্য লেখার চেষ্টা করি, কিচ্ছু হয় না। সূর্যর বিশেষ অনুরোধ, —ঘোষণায় যা শুনেছেন—কবে, কখন, কোন সময়সালে প্রথম কবিতা লিখি, এবং ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতার উৎস কী—বলার জন্যে।

—বিশ্রী এই আবদার। কিন্তু ঢেঁকি গিলতেই হবে। পড়েছি বদ্যির পাল্লায়।

কেন ‘বিশ্রী আবদার’ বলেছি, হেতু আছে বৈকী। জনপ্রিয় লেখক নই আদৌ, কী লিখেছি বা লিখি, অনেকেই হয়তো পড়েননি। কিংবা নানা ব্যস্ততায় পড়ার সময়-সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশে বই প্রকাশ হয়, প্রকাশকের অনুরোধে। বাংলাদেশের বই এখানে সুলভ কি-না, বলতে অপারগ। কলকাতা থেকেও প্রকাশিত হয়, তবে বই উঁইপোকায় কাটে। বিক্রি হয় না। চোখেও দ্যাখে না লোকে। ভাগ্যিস দ্যাখে না, দেখলে পেটাতো। পিটিয়ে বলতো, ‘মশাই, টাকা ফেরত দিন। সুদসহ।’

পৃথিবীজুড়ে কবিতা এখন অচল। কবিতা মৃতপ্রায়। কোমায় আছে। আশ্চর্য এই, দুই বাংলায় কবিতার বই নিয়মিত প্রকাশিত, পাঠকও পাওয়া যায়, খুব বেশি নয় তবে।

বলিউডের একদা অভিনেত্রী দীপ্তি নাভাল, মুম্বাইয়ে এক পার্টিতে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জানেন আপনারা, কবিতাও লেখেন দীপ্তি। ওঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে বললেন, ‘দুই প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করেছেন, গাঁটের কড়ি খরচ করে ছেপেছি।’

কবিতার দেশ বলে খ্যাত ফ্রান্স, খ্যাতি আজ মলিন। কবিতার বইয়ের প্রকাশক পাওয়া দুষ্কর।

ইউরোপের যে দেশে বাস করি, শুনলে অবাক হবেন, কবিতার বই বইয়ের দোকানে পাওয়া লটারি পাওয়ার মতোই। কবিতার বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে দোকানি আড়চোখে তাকান। সন্দেহ করেন। ইউরোপে (বর্তমান ইউরোপে) কবির সংখ্যা দ্রুত কমছে। কোনো বিখ্যাত কবির কবিতাপাঠের আসরে ৫০ জন শ্রোতা পাওয়া মানে সাংঘাতিক ব্যাপার।

কবিতা যেহেতু আদি সাহিত্য, ‘এথনিক কালচারের’ অন্তর্গত, অতএব বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সরকারের মাথা ব্যথা। সরকারি উদ্যোগে ‘কবিতা একাডেমি’, কবিতার বই প্রকাশে সরকারের আর্থিক সাহায্য। এমন কী, সরকারই বিক্রিবাট্টার ব্যবস্থা করে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ডে, ডেনমার্কে, আইসল্যান্ডে, সুইডেনে এই ‘যজ্ঞ’ দেখেছি। দুই বঙ্গে কবিতা যে এখনো টিকে আছে, প্রকাশক বই প্রকাশ করেন, নিশ্চয় আশায়। তবে এই আশায় গুঁড়ে-বালি অচিরেই। ব্যবসায়িক কারণেই। টাকা আটকে রেখে, মুনাফা-না হলে, কোন কুবের আছেন?

সব কর্পোরেট সংস্থার নিয়ম টাকা ঢালো, টাকা আনো। সবই নগদ।

প্যাঁচাল বেশি হয়ে যাচ্ছে। শ্রোতৃকুল অপেক্ষমান নাচ, গানের জন্যে। এবং খাবারের জন্যে। শ্রোতাদের অনেকেই উশখুশ করছেন, গল্পগুজব করছেন। যতটা সংক্ষেপে সম্ভব, বলছি।

প্রথম কবিতা লিখি পাবনার জিসিআই (গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউট)-এর দেওয়াল পত্রিকায়। ১৯৬২ সালে, ক্লাশ সিক্সে পড়াকালীন। কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিবসে প্রকাশিত দেওয়াল পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণপদ সেনগুপ্ত, ক্লাশ টেনের ছাত্র। কবিতার প্রথম দুই লাইন মনে আছে:

“নজরুল, জীবনে করেছ মস্ত ভুল
দাড়ি না-রেখে রেখেছ চুল।”

—এই কবিতার কারণে বাংলার মাস্টার ডাস্টবিন দিয়ে পিটিয়ে ক্লাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।

প্রায় তিনযুগ পর ‘দাউদ হায়দারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশ হয়, ভূমিকায় উল্লেখ করি ওই দুই লাইন। শুনেছি, বাংলাদেশে ওই দুই লাইন ব্যাপক প্রচারিত।

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ একুশ বছর বয়সে লেখা। সত্যি ঘটনা। তখন, ঢাকা কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ঢুকেছি। থাকতুম ১৪/২ মালিবাগে। পাশের বাড়িতে (ঠিকানা একই, ১৪/২ মালিবাগ) ডাক্তার আজহারুল ইসলামের বাস। তাঁর বাসার একঘরে অপারেশন থিয়েটার। প্রায়ই চিৎকার শুনি রোগীর। যারা অপারেশন করতে আসে, কী অপারেশন করা হয়, অজানা। একদিন এক রোগী, চিৎকার করতে-করতে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসে, তার লুঙ্গি রক্তাক্ত। অসহায় চোখমুখ। এক্ষুনি মরে যাবে যেন। তার এক হাতে কুড়ি টাকা। ওই টাকাও রক্তমাখা। তার মুখ থেকেই শুনি, কাতরস্বরে, ‘আমার দুই বিচি কাইটা দিচ্ছে।’ অর্থাৎ, স্টেরালাইজড্।

—ওই কুড়ি টাকা নিয়ে জীবনধারণ?

একজন সোমত্ত পুরুষের বন্ধ্যাত্বকরণে এতটাই বিমর্ষ হই, ভাবি, তার জীবন বৃথা, তার জন্ম বৃথা, তার জন্মই পাপ। মনে হয়, ‘এই বৃথাজীবন আমারও।’ মনে হয় সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রিক কারণেই।

ভারতে-বাংলাদেশে, পৃথিবীর সব অনুন্নত দেশে, আমাদের জন্ম, জীবনে যা ঘাত-অভিঘাত, জন্মই আমার আজন্ম পাপ। নয় কী? আপনাদের জন্মজীবন পাপ নয়, নিশ্চয় সুখের। ধন্যবাদ।

দাউদ হায়দার। বিপ্লবী কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। ইসলামি মৌলবাদীদের হুমকী ও সরকারের মামলার কারণে তাঁকে ১৯৭৪ সালে দেশত্যাগ করানো হয়। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে নির্বাসিত। প্রকাশিত বই: কাব্যগ্রন্থ: 'জন্মই আমার আজন্ম পাপ', প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর, ১৯৭৩, প্রকাশকঃ প্রগতি প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ শিল্পীঃ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ফ্রিউইন্স-এর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী

ফ্রিউইন্স-এর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী

সম্প্রতি ফ্রিউইন্স আয়োজিত কুড়ি জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর প্রায় অর্ধশত ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল গড়িয়ার মহামায়াতলার…..