দায়

ফারজানা নীলা
গল্প
Bengali
দায়

ছেলেপক্ষ আসবে বিকেল তিনটায়।কথা ছিল আন্টি পরানর পরে আক্তও হয়ে যাতে পারে।

 রাহেলা মেয়েকে সকালে পার্লারে পাঠিয়েছেন। তার এক বান্ধবির সাথে যাওয়ার কথা।

 দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে এখনো মেয়ে ফিরছে না।

 রাহেলা মেয়েকে ফোন দিয়ে বার বার ব্যস্ত পাচ্ছেন। এত ব্যস্ত থাকবে কেন ফোন?

 মেয়ে কি তার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে?

 রাহেলার বুক ধুকধুক করে। তার বড় বোন রান্নার তদারকি করছে আর কিছুক্ষন পর পর এসে জিজ্ঞেস করছে তমা ফিরেছে?

রাহেলা বারান্দাy  চেয়ারে স্থির হয়ে বসে তো আছেন কিন্তু ভেতরে ভিশন অস্থিরতায় হাত পা জমে যাচ্ছে।

তমার বান্ধবিকে ফোন করে জানা গেল তমা তার সাথে পার্লারে যায় নি।

রাহেলার বাম হাত ব্যথা করা শুরু করছে। প্রেশারের লক্ষন দেখা দিচ্ছে।

আশেপাশের আলো কি কম ? তিনি অন্ধকার দেখছেন কেন?

 তমা কি আসবে না? তিনটা বাজতে আর কতক্ষন বাকি?

তমা এমন করল কেন? তাকে তো জিজ্ঞেস করেই সব করা হয়েছিল? তার পছন্দ আছে কিনা সেতাও বারবার জানতে চেয়েছে রাহেলা। কই কিছু তো বলে নি।

শুধু রাতে মেয়ের  রুমের আলো জলতে দেখতেন রাহেলা। চোখের নিচে গাঢ় কালি পরতে দেখেছেন। বিয়ে থিক হয়েছে মাত্র এক মাস। এই এক মাসেই শুকিয়ে অনেক কমে গেছে গা গতরে তমা।

কোথাও কি গোপনিয় কিছু ছিল তমার?

 বললি না,  উল্টো এভাবে অপমানে ফেললি?

তোকে এইভাবে  বড় করি নি যে মাকে বলতে পারবি না?  তোর পছন্দ থাকলে আমি কি জোর করে এখানে বিয়ে দিতাম?

রাহেলা এখন ঘামছেন। তার বোন এসে এখন আর জিজ্ঞেস করছেন না কিছু।  আধাসেদ্ধ হওয়া মুরগির রেজালা পুরো সেদ্ধ না করেই চুলা বন্ধ করে রেখছেন।

কে খাবে এসব?

পিনপতন নিরবরতা বিরাজমান অবস্থায় রাহেলার ফোন আর দরজার কলিংবেল একসাথে বেজে উঠল। রাহেলার যেন আর একটু হলে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ভয়ে।

রাহেলা কাপা হাতে ফোনের দিকে তাকালেন।তমার বাবা দুবাই থেকে ফোন দিচ্ছেন। যে করোনার জন্য মেয়ের একগেজমেন্টেই আসতে পারেন নাই। তাকে কি জবাব দিবেন রাহেলা? ফোন বেজেই চলছে সাথে আবারও কলিংবেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহেলার বড় বোন উঠে দরজা খুলতে গেলেন। রাহেলাও ফোনটা ধরলেন।

খোলা দরজা দিয়ে তমা এসে ঢুকেছে ঘরে। রাহেলা কিছুক্ষন মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে শুয়ে পড়লেন। তার হঠাথ করে খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু জিরিয়ে নিতে হবে, সামনে অনেক কাজ।

ছেলেপক্ষ ঠিক সময়ের একটু পরই এসেছে। তাতে অবশ্য রাহেলার কোনো টেনশন হয় নি। ছেলে পক্ষ একটু লেইট করেই। সেটা ব্যাপার না।

ছেলের বাবা মামা দুই চাচা খালা বড় বোন এসেছে সাথে দুইজন ছোট আত্নীয়। এরা এসেছে আগে কিন্তু ছেলে আসবে পরে  তার দুই বন্ধু নিয়ে পেছনের গাড়ীতে।

বেশ, রাহেলা একবার দেখতে যাচ্ছেন ভেতরের ঘরে তমা রেডি হচ্ছে কিনা ঠিক মত। মেয়ে ঘরেই আছে তবু তার মনে একটা উশখুশ, যেন পালিয়ে যাবে যেকোনো মুহুর্তে। তমা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। সে একবার মাকে ডেকে বলল “মা কিছু বলবে? এভাবে একবার আসছ একবার যাচ্ছ কেন? আমি কি পালিয়ে যাব কোথাও”

রাহেলা শক্ত মুখে বললেন “কয়টায় ফেরার কথা ছিল আর কয়টায় এসেছিস?

এসেছি তো মা। কোথায় যাই নি।

মিথ্যা বলে অন্য কোথাও গিয়েছিলি। পার্লারে যাস নি।

তমা একটা শ্বাস ফেলে নিজের সাজের দিকে নজর দেয়। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি মনে করছ আমি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম?

রাহেলার বুকটা আবার ধ্বক করে উঠে। এ কথা ভাবতেও তার আত্না শুকিয়ে যায় আর মেয়ে এই কথা এমন শান্ত ভাবে বলে দিচ্ছে?

রাহেলা কিছু না বলে মেহমানদের কাছে যায়। তাদের চা নাস্তা দেওয়া হয়েছে। ছোট মেয়ে তিন্নিকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন যেন এক মুহুর্ত্ত তমাকে চোখের আড়াল না করে। তিন্নির বয়স ১৩। সে কঠিন মুখ করে বোনের সামনে বসে আছে।

আপু,  তুমি  সত্যি সত্যি কই গেছিলা?

কাজে। তমা লিপ্সটিক লাগাতে লাগাতে বলে।

কি কাজ?

বললে তুই বুঝবি না। তমা চুরি পরে।

তুমি পার্লারে যাও নি কেন?

পার্লারে সাজতে ইচ্ছে করে না তাই।

তাহলে মিথ্যা বললে কেন?

মিথ্যা না বললে আজকে আমাকে বের হতে দিত না।

মানে কি?

মানে আজ আমার বের  হওয়া খুব জরুরি ছিল। তাই মিথ্যা বলে বের হয়েছি।

তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপা?

এত বক বক করছিস কেন? কুচি ধর ঠিক করে। তমাকে দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই সে তার একগেজমেন্টের দিন কাউকে কিছু না বলে কোনো এক অজানা জায়গায় চলে গিয়েছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল তমা আর ফিরবে না। অথচ এখন কি সুন্দর করে সাজছে। কপালে লাল টিপও দিয়েছে। চোখে কাজল। হাল্কা কম্পেক পাউডার। এতেই  দেখতে অপুর্ব লাগছে।

তিন্নি কুচি ঠিক করতে করতে  বিজ্ঞের মত বলল “আপা তোমার কি কাউকে পছন্দ?”

তমা এবার একটু বিরক্ত হল। “তোদের সবার কি এই ধারনা?”

তিন্নি চুপ করে গেলো।

তমা একটু পারফিউম মাখাল গায়ে। এরপর খাটে গিয়ে বসে রইল। তিন্নিকে বলল “ওরা ডাকলে জানাস”

রাহেলার বড় আপা খেয়াল করল বরপক্ষ এসেছে অনেক্ষন কিন্তু বরই আসে নি এখনো।

রাহেলার সেদিকে যে খেয়ালই নেই সেটা তার কথা বলার ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে।

তিনি একবার রাহেলাকে ডাকলেন রান্না ঘরে।

“ছেলে কই? কয়টা বাজে”

রাহেলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “ছেলে কই মানে , ছেলে পথে বলল না?”

“এরা এসেছে এক ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে? পেছনের গাড়ীতে থাকলে এতক্ষন লাগে?”

রাহেলার আবার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। আবার হাত পা ঘামচ্ছে।

ছেলেকে খালাকে আড়ালে ডাকা হলো। তিনিও কিছু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ছেলের এত দেরি হচ্ছে দেখে।

সবার হাতেই ফোন। সবাই ছেলেকে কল দিচ্ছে। রাহেলা এটা দেখে আরো বিরক্ত হলেন। সবাই একসাথে এক নাম্বারে ট্রাই করলে কি পাওয়া যাবে?

রাহেলার মাথা ঝিম ঝিম করছে, বাম হাত ব্যথা শুরু হচ্ছে। তিনি চোখে আবার অন্ধকার দেখছেন।

রাত প্রায় ১২টা। ছেলে পক্ষ চলে গেছে এক ঘন্টা হবে। ছেলেকে ফোনে পাওয়া যায় নি। তার নাম্বার বন্ধ। তারা সবাই মুখ কালো করে এবং নিচু করে না খেয়ে বিদায় নিলেন।

বিদায় নেওয়ার আগে রাহেলার বড় বোনের কাছে বার বার মাপ চেয়ে গেলেন। রাহেলার শুয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তার প্রেশার বেড়ে যা তা অবস্থা। তাকে প্রেশারের ওসুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি রুম অন্ধকার করে জোরে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তমার বাবার ফোন তিনি ধরতে পারছেন না। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছেন।

এবারো পিন পতন নিরবতায় রাহেলার রুমে ঢুকল তমা। মাকে দেখেই বুঝল চোখ দিয়ে পানি পড়েছে অনেক্ষন ধরে। চোখের দুই কোণে দাগ হয়ে গেছে।

মার কপালে হাত রেখে খুব নরম সুরে ডাকল “মা”

হুম। রাহেলা ক্ষীন স্বরে জবাব দিলেন।

আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে উঠেপড়ে লেগেছো কেন মা?

রাহেলা নিরব।

তোমার একার চাকরিতে সংসার চালাতে যে খুব কষ্ট হয় সে আমার চেয়ে ভাল কে জানে? আমি এখন বড় হয়েছি আমাকে বিয়ে না দিয়ে দায়িত্ব নিতে দাও না মা।

রাহেলার চোখ দিয়ে আবারও পানি গড়াচ্ছে।

আমি আজ সকালে তোমাকে মিথ্যা বলে একটা চাকরির রেজাল্ট দেখতে গিয়েছিলাম। চাকরিটা হয়েছে । আমি ঠিক করে রেখেছিলাম আজ আন্টি পরার আগে ওদের বলব যে আমার চাকরি হয়েছে এবং আমাকে আমার মার পাশে থাকতে হবে।

রাহেলা চোখে মেলে চাইলেন মেয়ের দিকে।

একটা শ্বাস ফেলে তমা আরো বলল “ভালই হলো এলো না। এখন আমাকে একটূ কাজ করতে দাও মা। বিয়ে পরেও করা যাবে। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার সময় চলে গেলে আর পাবো না। তিন্নির দায়িত্ব এবার আমাকে নিতে দাও মা”

রাহেলা নিরবে চোখ মুছেন। মেয়ের হাত শক্ত করে মুঠো করে ধরে রাখেন। যেন কোথাও পালিয়ে যাবে মেয়ে। ছুটে দৌড় দিবে।

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..