দিকশূন্যপুরের যাত্রী

শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
কবিতা
Bengali
দিকশূন্যপুরের যাত্রী

মৃত্যুহীন বিষ

কে আমার শৈশবে বিছিয়ে রাখে
সেঁকুল কাঁটার নাছোড় জঙ্গল?
চতুর শৃগালের মতো বুকের রক্ত
টেনে নেয় পাঁজর শুকনো করে।

কে অস্বীকার করে আমার
উত্তরাধিকার? জমিতে ফসলের নবান্ন,
লাঙলের অস্থিতে উঠে আসা
সোনালি মাটির নিবিড় আঘ্রাণ।

কে আমার হাতের তালুতে
রেখে যায় সূর্যের আগুন? আর
চাঁদের মোহিনী আলোর মায়া?
মাথায় অবিনশ্বর জটের যন্ত্রণা।

কে আমার ব্রহ্মতালুতে হোমকুণ্ড
জ্বালে? সমিধ আহুতি দেয়,
আর, একাক্ষ রুদ্রাক্ষের অঞ্জলি,
পুড়ে যায় গৈরিক ত্রিপাদ পৃথিবী।

কে আমার চরুতে মেশায় বিষ?
মাতাল নেশার বারান্দায় রাখে
ধুতরো ফলের ভালোবাসা কাঁটা?
অমরতা একমাত্র জানে, বিষই মৃত্যুহীন।

 

সম্পর্ক

অশীতিপর বৃদ্ধা মা পুত্রের মঙ্গল কামনায়
চৈত্র মাসের দুপুর রোদে
মন্দিরে যাচ্ছেন পুজো দিতে
তার নবতিপর বৃদ্ধ স্বামী
মাথায় ছাতা ধরে পিছনে পিছনে

লাসভেগাসে এখন মধ্যরাত
জমজমাট পার্টিতে দুরন্ত স্ট্রিপটিজ
চলকাচ্ছে ফেনিল মদের পেয়ালা
ডান্স -ফ্লোরে নাচছে জ্যাজ
নাচছে ফক্সট্রট।

 

বৃহন্নলা

পাতালঘরে বীজঘুমে শুয়ে তোমার পৌরুষ
নূপুর বেজেছে যমুনার মতো
নক্ষত্রপ্রবণ এই ঋতুকাল
অনূঢ়া চাঁপাও রজস্বলা হয়ে ফুটে আছে
নিঝুম রাত সংবেদী আঙুলে আত্মমৈথুন
লেপ্টে থাকা দেয়ালের ছায়া
নীরব গৃহকোণে কম্পমান জোনাকি আলো
নিষিদ্ধ সেতুর নিরপেক্ষ শর্তের দলগত অন্ধকারে
কুমারী স্তনের মতো জেগে থাকা মধুছন্দা রাত।
কান্না আসে, প্রেম আসে, রোমাঞ্চকর আহ্লাদে
বরফের চাঁই ভেঙে
খুলতে পারছে না কাচের পর্দা
একটা মাংসপিণ্ডের মতো জায়মান ছটফটানি
অন্ধকারে নিজস্ব গন্ডির ভিতর
ক্রমাগত বদলে গেছে কাছের মানুষজন

বিষণ্ণ বাদামের মতো ঠান্ডা পায়ের পাতায়।
পরস্পরকে না ছুঁয়ে ঘুমানোর
মধ্যেকার অন্ধকার তোমায়।
জাগিয়ে রেখেছে অর্ধনারীশ্বর

 

সিঁড়ি

বাঁশি বাজিয়ে বসন্ত এনেছে সেই ছেলেটি
আনন্দউপোসী আমরা অনেকদিন ।
ভিজে যায় আমাদের সব আত্মরতি

বৃষ্টি ধুয়ে গেছে প্রতিমার মুখ।
স্মরণ বিস্মরণের ভাসা ভাসা খেলা
স্বপ্নে কালপুরুষ কথা বলে যায়

মনের গভীরে পরমেশ্বরী আকাঙ্ক্ষার মৌচাক
সারাজীবন যে অঙ্ক কখনো মেলেনি
অন্ধকারে জেগে থাকে শূণ্যে ওঠার সিঁড়ি

 

শুভেচ্ছার ফুলছোঁয়া হাত

কবরের শবধার থেকে
তোমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি
শুভেচ্ছার ফুলছোঁয়া হাত
যারা ঘৃণা আর ক্রোধকে মিলিয়ে দিতে পেরেছিল
সুখাদ্য আর নরম পানীয়ের সাথে
জহ্লাদের মতো সহাস্য
নতমস্তকে নামিয়ে দিতে পেরেছিল নির্মম গিলোটিন
গেরস্থ আকাশে ওঠা এজমালি চাঁদ
ভাগ হয়ে গেছে পূর্ণিমা আর অমায়
তাদেরই সৌজন্যে।

কে যে কার জন্য প্রার্থনা করে?
রমণীয় পতাকা ওড়ে প্রতিটি প্রভাতে
পাঁজরের গুমঘরে হৃদয় স্থবির হয়
হেমন্তের ধানখেত জুড়ে
পড়ে থাকে লাশ আর নবান্ন অক্ষর
শিশির ভেজা হাঁসের পালকে

মার্জনা বা করুণা কিছুই চাওয়ার নেই
বধ্যভূমি পড়ে আছে মৃগয়া- উল্লাসে
শ্বেতপুষ্পে অবিরত যে রক্তদাগ লাগে
জেনে রেখ
সেখানেও তোমার হাতের ছাপ আছে।

দিকশূন্যপুরের যাত্রী

অপসৃয়মাণ কাঁকড়ার পিঠে ছায়ার মতো
দীর্ঘকেশী নবমী মধ্যরাত
সুদীর্ঘ যাত্রাপথে
কেউ কেউ থমকে দাঁড়ায়।
মৃত্যুর পরে কোথাও কি কিছু অপেক্ষা করে?
প্রতীক্ষা নেই, ঘর নেই, উপচে পড়া ভীড় নেই
প্রতিটি সকালে বাউলের একতারা ধরে
কোথাও কি কেউ অনুচ্চারে
বিনিময়ে সংকেত চিহ্ন নিয়ে
কথা, শব্দ, নিজস্ব স্নায়ুতন্ত্রে বর্শাফলকে
স্বপ্নের নিবিড়ে কথা বলে ওঠে
নীরার কণ্ঠস্বর

ধ্বংসাবশেষ থেকে মানুষের প্রেম
দুঃখগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করা
ধূসর পাণ্ডুলিপির পাশে
মাংস ঝলসানো র উষ্ণতায় স্থির হয়ে আছো।
মানচিত্রে সন্ধ্যালিপি লিখে মধুমাসে পাঠাবে না জানি ।
অন্ধকার স্পর্শের ভিতর ঝিনুক ভেঙে ভেঙে
নির্বাক জ্যোৎস্নায় একদিন হেসে দাঁড়াবে গড়িয়াহাটের মোড়ে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..