দিপুর ডায়েরি (পর্ব ১)

বিপ্লব ব্যানার্জি
ধারাবাহিক, নন ফিকশন
Bengali
দিপুর ডায়েরি (পর্ব ১)

একটি করোটির উপাখ্যান

“তোমাদের সিলেবাসে মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স এর করোটির শনাক্ত করণ অন্তর্ভুক্ত”,

বলে জুলজির ডি.বি স্যার অর্থাৎ অধ্যাপক দীপঙ্কর ব্যানার্জি টেবিলের উপর বসলেন।

এটাই ওনার পছন্দের সিট। রোল কল করা ওনার ধাতে নেই, প্রয়োজন ও নেই। ডি.বি’র ক্লাস মিস বা ব্যাঙ্ক করার কথা ছাত্রছাত্রীদের কল্পনাতেও আসে না। ক্লাস শেষে হাজিরা খাতায় টিক দিয়ে সবাইকে প্রেজেন্ট করে দেন।

“তো যা বলছিলাম”

বলে এক মিনিট থামলেন ডি.বি স্যার।

এটা ওনার অভ্যাস ও বলা চলে, অথবা ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের একটা ট্রিক্স ও হবে হয়তো।

“তোমরা নিশ্চয়ই জানো, দাঁত হলো স্তন্যপায়ীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদের কেউ তৃণভোজী, কেউ মাংসাশী, আবার কেউ উভয় ভোজী। সুতরাং..”

বলে কয়েক সেকেন্ড থামলেন। সেকেন্ড বেঞ্চে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা রঞ্জনার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে, “এই যে মেয়ে, কি যেন নাম তোমার। মাংসাশী প্রাণীর দাঁতের প্রধান বৈশিষ্ট্য কি বলতে পারো?”

“কে স্যার, আমি? আমার নাম সুরঞ্জনা স্যার। কেনিয়ান স্যার, মানে কৃন্তক স্যার”।

“ও তুমি সুরঞ্জনা। ঠিক বলেছ, বসো। তবে কেনিয়ান বা কৃন্তক স্যার নয়, দাঁত”।বলে টেবিলের উপর রাখা কাঁচের জার থেকে একটা করোটি বের করে তুলে ধরলেন।

“এটা হলো মানুষের করোটি বা মাথার খুলি। তোমরা নিশ্চয়ই চেনো! এই, কি যেন নাম! ব্রতীন! বলো তো কোন দুটো কেনিয়ান টিথ? নাও, ধরো”।

“না, মানে স্যার। ওটা ধরবো স্যার! মানে পিসিমা যদি শোনে স্যার, স্নান না করিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেবে না স্যার”।

“ওফঃ! বিজ্ঞান পড়তে আসা তোমাদের উচিত হয় নি। যাক, যা বলছিলাম। এই যে, এই দুটোই হল কেনিয়ান বা কৃন্তক দাঁত। আর এই গুলো প্রি-মোলার আর মোলার”।

থার্ড বেঞ্চের জয়িতা বলে বসে, “স্যার, মারা যাওয়ার আগে মানুষটা ভাবতেও পারে নি যে একদিন কলেজের ক্লাসে তার দাঁত নিয়ে আলোচনা হবে!”

“বাঃ! বেশ বললে তো। ঠিক ঠিক! এই করোটির মালিক একদিন হেসেছে কেঁদেছে স্বপ্ন দেখছে, আর আজ কাঁচের জারে ল্যাবরেটরিতে বিরাজ করছে!” বলে কোন সুদুরের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে যান ডি.বি স্যার।

পুরো ক্লাস স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে।

“চলো আজ পড়ানো বন্ধ রেখে একটা গল্প বলি “।

“বলুন, বলুন স্যার। আমরা শুনবো। ক্লাসটা স্যার পরের দিন হবে”। পুরো ক্লাস সমস্বরে বলে ওঠে।

কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবেন। মনটা বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যায়। কয়েকটা ছবি পর পর মনসচক্ষে ভেসে ওঠে। কত হবে মানুষটার বয়স, পঁচিশ বা আঠাশ। খুব বেশি হলে তিরিশ। মংলা হাঁসদা, মংলা খেপা। বিধবা ফুলমনির একমাত্র ছেলে। স্বাস্থ্য বান, কিন্তু মৃগী রোগী সে। কখন কোথায় তার খিঁচুনি শুরু হবে, কেউ বলতে পারে না। ফুলমনি অর্থাৎ ফুলমনি হাঁসদার বিধবা ভাতা আর মাঝে সাঝে দিন মজুরি, এভাবেই দিন চলে। মংলা ভোর থেকে বের হয়ে যায়। সকালে সাধু মোড়লের চা মিষ্টির দোকানে উনুন টা ধরিয়ে দিলে এক কাপ চা মিলে যায়। ব্যস, আর কোনো কাজে লাগে না। বাজারের যত কুকুর ছিলো মংলার সঙ্গী।

“শোনো। এক পাল কুকুর নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো এক আধ পাগলা লোক, নাম মংলা, মঙ্গল হাঁসদা। হাতে থাকতো একটা এলুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটি। গাঁয়ের বউ ঝিরা ওতে কেউ মাড় ভাত কেউ কয়েক মুঠো মুড়ি দিয়ে দিত। নিজেও খেত আর কুকুরদের খাওয়াতো। গ্রামের আটচালা বা দুর্গা মেলা, রাত্রে কোথাও একটা পড়ে থাকতো। কিংবা, বুড়ি মা মাঝে মাঝে এসে সাঁওতাল পাড়ায় ধরে নিয়ে যেত।”

বলে তিনি এক মুহূর্ত থামলেন, বোধ হয় গল্প টা সাজিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময় নিলেন। আবার শুরু করেন।

“গ্রামের ছেলে বাদল মদন অসীম দিপুদের সাথে মংলার খুব ভাব। কোথায় কদবেল পেকেছে, মংলা সবার আগে খবর পেয়ে যায়। ঘুড়ি বানানোর জন্য বাবলা আঠা, বা তির ধনুকের জন্য বাঁশের কঞ্চি, মংলা ছাড়া আর কেই বা এনে দেবে!”

“এমনি করে দিন কেটে যায়। মংলার যেমন বয়স বাড়ে, গ্রামের সেই সব ছেলেরাও তেমন বড় হয়। তারাও স্কুল ছেড়ে কলেজে পৌঁছে যায়। মংলার মা ফুলমনিও একদিন মারা যায়। ত্রিভুবনে মংলার নিজের বলতে আর কেউ রইলো না। ভিক্ষে করাই তখন তার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল”।

“দিন যথা নিয়মে বয়ে চলে। বাদল মদন অসীম দিপুদের জগৎ এখন অনেক বড়। পড়াশোনা, খেলা, নাটক এই সবের ব্যস্ততায় মংলার সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠে। কখনো কেমনো পঞ্চাশ পয়সা বা এক টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ ই নেই। এমনি এক ভোরে মাঠে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে শোনে সাধু মোড়ল মেরে মংলার পা নাকি ভেঙে দিয়েছে। সবার সাথে দীপুরা ছুটে আসে বাজারে। মংলা নাকি রাতে সাধুর চা মিষ্টির দোকানের অর্গল ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। তারপর যতটা পারা যায় মিষ্টি খেয়ে দোকানের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে দোকান খুলতে এসে সাধুর নজরে সব পড়ে। তখনও মংলা ঘুমিয়ে ছিল। ব্যস, অর্গলের ডান্ডা দিয়ে দিয়েছে পায়ে এক ঘা। ব্যস,

পুর দল তো সাধুর উপর খাপ্পা হয়ে উঠল। একটা রিক্সায় চাপিয়ে মংলা কে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখানো, এক্স রে করানো, সব করল। যাক, পা টা ভাঙে নি, এটাই রক্ষে। এবার সাধুর সাথে বোঝা পড়া বাকি। হাসপাতাল থেকে ফিরে সবাই সাধুর দোকান ঘেরাও করে রাখলো। শেষ মেশ সিদ্ধান্ত হলো যে যত দিন না মংলা স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা চলা না করতে পারবে, তার খাওয়ানোর দায়িত্ব সাধুর।”

“এরপর ক্রমশ সবার ব্যস্ততা বাড়লো, পড়াশোনার চাপে কারোর ই আর মংলার খবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। একটা সময় এমনই হলো যে মংলা নামের মানুষটার কথা তাদের মাথা থেকে হারিয়ে গেল”।

এতক্ষণ বলে ডি.বি স্যার থামলেন।পুরো ক্লাসে রোমাঞ্চকর নিস্তব্ধতা। আবার শুরু করলেন স্যার।

“মাস টা সম্ভবতঃ জুলাইয়ের শেষ বা আগষ্টের প্রথম দিক,  দীপু কলেজের নৈমিত্তিক প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। হঠাৎ বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কয়েকজনের দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজে সচকিত হয়ে ওঠে। বাড়ির বাইরে বের হয়ে শুনলো, মংলা নাকি রানী সায়রের জলে ডুবে গেছে। ছুট ছুট, সোজা রানী সায়রের পাড়, বহু মানুষ আগেই সেখানে হাজির। অন্যদের সঙ্গে দীপুও জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় পনেরো কুড়ি জন উদ্বিগ্ন মানুষ পুকুর টা তোলপাড় করে চলেছে। হঠাৎ করেই একজন, “পেয়েছি পেয়েছি” বলে চিৎকার করে জলে ডুব দিয়ে একটা দেহ তুলে আনে। এরই মধ্যে দেহটা কেমন ফুলে গেছে, মুখ নাক কালো পাঁকে ভর্তি, হাত পা সাদা হয়ে গেছে। সবার সাথে হাত লাগিয়ে দীপুও ডুবে ভারী হয়ে যাওয়া দেহটা কে  ডাঙ্গায় তুলে আনে। ইতিমধ্যে সাঁওতাল বস্তি থেকে মংলার স্বজাতি কয়েকজন খবর পেয়ে হাজির। তাই দীপুদের করার আর কিছু থাকে না। মংলার পাড়ার লোকেরা মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। দীপুরাও যে যার বাড়ি ফিরে এলো”।

“দিন দুই পর বিকেলর দিকে গ্রামের লাগোয়া জঙ্গলে দীপুরা বেড়াতে গেছে। নানান ব্যস্ততায় এদিকে আসা প্রায় হয়ই না। বর্ষার জঙ্গল, রাঢ় কে সুন্দরী যৌবনবতী করে তোলে। সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে। এক আলাদা পরা বাস্তব জগৎ যেন। অথবা, আঁকা ছবি। দীপুরা প্রকৃতি প্রেমী, তাই কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কোথাও কুকুরের ঝগড়ার আওয়াজ ওদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়। কুতূহলী হয়ে আওয়াজ লক্ষ্য করে এগুতে থাকে। দশ বারো মিটার গেছে কি যায় নি, একটা বীভৎস দৃশ্য নজরে পড়ল। একটা মৃতদেহ নিয়ে কয়েকটা কুকুরের নখ দাঁতের লড়াই। তীব্র একটা পচা গন্ধে সবার গা গুলিয়ে উঠল। মৃতদেহ টা মাটিতে পোঁতা ছিল, কুকুরে সেটাকে টেনে বের করেছে। ছেঁড়া জামা কাপড়ের টুকরো দেখে বোঝা যায় যে ওটা মংলার দেহ। ওদের দেখে কুকুর গুলো সরে গেছে। প্রায় গলিত ছিন্নভিন্ন দেহটার দিকে এক বুক দুঃখ নিয়ে ওরা তাকিয়ে থাকে। কত দিনের পরিচিত একটা মানুষ!”

“চল, ফিরে যাই।” কেউ একজন বলে ওঠে। দীপু কথাটায় আমল না দিয়ে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল। সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, “কি রে, কি করবি!”

কোনো জবাব না দিয়ে একেবারে দেহটার কাছে গিয়ে হাজির হয়। পাশের শাল ঝোপ থেকে একটা মোটা ডাল ভেঙ্গে নিতেই বাকি সবাই ওর উদ্দেশ্য বুঝে ফেলে, “এই দীপু, না না। ওটা ছুঁবি না বলছি। অপঘাতে মৃত্যু, তোর ভয় ডর নেই!!”

“বন্ধুদের কথায় কর্ণপাত না করে গাছের ডাল টা দিয়ে ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে নেয়। একটা লতান গাছের কিছুটা ছিঁড়ে মুণ্ডু টা বেঁধে নেয়। বন্ধুরা সভয়ে আরো দূরে সরে যায়। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। দীপু সোজা ক্লাব ঘরে গিয়ে হাজির। ক্লাবের সবার তীব্র বাধায় সেটা নিয়ে ঘোষালদের বাড়ির পিছনের গাছে তুলে রেখে দেয়। একটা রাতের ব্যাপার। পর দিন কলেজের ল্যাব থেকে কষ্টিক সোডা নিয়ে আসে। ব্যস, একটা মাটির খোলায় জল দিয়ে তাতে কষ্টিক মিশিয়ে কিছুক্ষণ করে ফোটানো আর মাংস গুলো পরিষ্কার করা। সে সময় প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় স্পেসিমান সংগ্রহ করে জমা দেওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। তো দীপু এই খুলিটাকে স্পেসিমান হিসেবে জমা দিয়ে দেয়।”

বলে বি.ডি. স্যার আটেন্ডেন্স খাতা চক ডাস্টার নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

ক্লাসে তখন পিন পড়ার শব্দ ও শোনা যাবে, সবার নজর তখন করোটির জারে। ভয়ার্ত গলায় কয়েকজন বলে ওঠে,  “মানে স্যার, এ এ এটা মংলার করোটি! আর দিপু এখন কোথায় স্যার “?

ডি.বি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলেন,” সেই দিপু হচ্ছে তোমাদের ডি.বি স্যার, তাকে কিন্তু ভুতে ধরেনি বুঝলে “।

চলবে…

বিপ্লব ব্যানার্জি। গল্পকার ও অধ্যাপক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের বাঁকুড়ায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ