ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
ডিস এলাউড
“তোর খেলা টা পরীক্ষার দিনেই পড়লো!” অন্ধকারে জোনাকির আলো দেখতে দেখতে প্রশান্ত কে বলে দিপু। মশার দল আজ যেন মহাভোজ পেয়েছে। অদূরে ছোট্ট স্টেশনে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। দিনে রাতে তিনখানা ট্রেন থামে, বাকি সময় ঘুমিয়েই থাকে স্টেশনটা।
“আর তোর ওই গাছ থেকে পড়ে যাওয়াটা বুঝি সিলেবাসে ছিল? যত্তসব!” আলোর অভাব কে পুষিয়ে দিতেই যেন প্রশান্তর কথাটা বলা।
সবে রাত সাড়ে’নটা, চক্রধরপুর হাওড়া আপ আসতে এখনো ঘন্টা দুই। সময় যেন কাটতে চায় না। টেস্টে যে ডিস-এলাউড হয়ে যাবে, দু’জনের কেউ তা ভাবতেই পারে নি। স্যারেদের উপর বিশ্বাস ছিল। সকালে সুদেব দা যখন লিস্ট টা টাঙানোর জন্য অফিস থেকে বেরুলো, প্রশান্ত তখনো এসে পৌঁছায় নি। দিপু সাইকেল টা নিয়ে বড় কুসুম গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। সুদেব দা কে দেখে অন্যান্যদের সাথে দিপুও এগিয়ে গেল নোটিশ বোর্ডের দিকে।
তালিকায় উপর থেকে নিজের নাম খুঁজতে খুঁজতে একেবারে শেষে পৌঁছে দিপুর মাথা টা ঘুরে গেল। নাম নেই, মানে ডিস-এলাওড! বিষয়টার পরিণতি উপলব্ধি করতে মিনিট খানেক লাগলো দিপুর। পড়াশোনা করা নিয়ে দিপুর যে বিরাট সুনাম, তা নয়। কিন্তু একেবারে ডিস-এলাওড হয়ে যাবে, ভাবতে পারে নি। অফিসের বারান্দা থেকে নামতে গিয়ে প্রশান্ত কে দেখতে পেল। সে ও কেমন ফ্যাকাসে চোখে দিপুর দিকে তাকালো।
“তুই ও!” শুকনো গলায় দিপু প্রশান্ত কে বলে।
“হ” সাক্ষিপ্ততম উত্তর প্রশান্তর।
দিপু এগিয়ে গিয়ে কুসুম গাছের নিচে বাঁধানো বেদীটার উপর বসে পড়ে। পর পর কতকগুলো দৃশ্য ভেসে ওঠে দিপুর। যতই দুরন্ত হোক, ফুটবল পিটিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে বা মাছ ধরে দিন পার করুক, পড়তেও কিন্তু দিপুর ভালো লাগে। এর পর আবার একটা বছর পর উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া যে কোনোভাবেই হবে না নিশ্চিত। নিজের উপর রাগ হচ্ছে দিপুর।
“চ, হেডুর কাছে যাই” প্রশান্ত কাঁধে হাত রেখে বলে।
এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো দিপু। “তাই চ “।
“কাল বাবা কে নিয়ে স্কুলে আয়, তারপর দেখবো।” বলে হেডমাস্টার সুবিমল মুখুজ্যে নিজের কাজে মন দিলেন।
ওটি যে অসম্ভবতম কাজ, দু’জনেই বোঝে।
অতঃপর, ফটিকের চায়ের দোকান। হাফ প্লেট ঘুগনি আর কোয়ার্টার পাউরুটি দিয়ে পেট না হয় ঠান্ডা করলো দুজন। কিন্তু দিশা কোনো দিকেই নেই। আবার ফিরে স্কুলের কুসুম গাছের নিচের বেদী। দুপর গড়িয়ে বিকেল, হেডমাস্টার সুবিমল বাবু পিয়ন সুধীন দার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন। দু’জন নির্বাক হয়ে সেই যাওয়া দেখলো।
স্যারের পিছনে পিছনে দুজন গুটি গুটি পায়ে চললো। স্কুল থেকে বের হয়ে স্টেশনের দিকে কিছুটা গেলে স্যারের বাড়ি। এক সময় স্যারের বাড়িও এসে গেল, স্যার কোনো দিকে না তাকিয়ে বাড়ি ঢুকে গেলেন। দু’জন কেন যে স্যারের পিছু পিছু এলো, নিজেরাও জানে না। রাস্তা টা সোজা স্টেশনে গিয়েছে। উদ্যেশ্যহীন ভাবে দুজনে স্টেশনের দিকে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে গেল।
সময়টা ১৯৭৮ সাল আর জায়গাটি বাঁকুড়ার রামসাগর গ্রাম। তখনও গ্রামগুলিতে বিদ্যুতের আলো বিলাসিতা আর রেডিও হল বিনোদন।
“কি হবে বলতো? তোর বাবা আসবে?” দিপুর দিকে কথা টা ছুঁড়ে দেয় প্রশান্ত। “আমি তো ভাই বাবা কে বলতেই পারবো না। এমনিতেই কেষ্টপুরের সাথে খেলার দিন মারামারির সময় সাইকেল ফেলে পালিয়ে এসে বাবার হাতে এক প্রস্থ হয়েছে। তারপর এলাও করার জন্য স্কুলে আসার কথা বললে, হয়ে গেল।”
দিপু কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে, “কি রে! ক্যাবলে গেলি যে!”
“বাবা তো আসবেই না, এমনকি বাবা কে আসার কথাটা আমি বলতেই পারবো না!”শুকনো গলায় দিপু। “অনেক কষ্টে মা এবারের ফরম পূরণের টাকা টা জোগাড় করেছে। আরও একটা বছর….”চুপ করে যায় দিপু। বোধহয় গলা টা ভিজে যাওয়ায়। “বাবা কে আসতে বলার চেয়ে মরে যাওয়া সহজ, বুঝলি।” ‘মরে যাওয়া সহজ’…মাত্র তিনটে শব্দ, কিন্তু কিন্তু তার অভিঘাত তীব্র। শব্দ তিনটে দুজনের মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকে। প্রশান্তের সাইকেলের চাকা টা অন্ধকারে একটা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে লাফিয়ে ওঠে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে। দিপু ঘুরে তাকায়। অন্ধকারে কেউ কাউকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না, আবছা অবয়ব মাত্র। ” তাই চ, মরে যাই।” প্রশান্তর কথাটার জন্যই দিপু যেন অপেক্ষা করছিল।
“সেই ভালো। চ!” দিপুর স্বগতোক্তি। “আপ চক্রধরপুর যেন ক’টায়?”
ছিটকে পড়া সাইকেল টা কুড়োতে কুড়োতে প্রশান্ত বলে, “সাড়ে এগারোটায়।” স্টেশনের বাঁ দিকে একটা মোরামের রাস্তা চলে গেছে রেল লাইন পেরিয়ে মণ্ডলহাটি, দেরেপুর, পলাশনের দিকে। একটা ফটক ও আছে। ফটকের আগে রেল লাইন টা বেশ বড় একটা বাঁক নিয়েছে।
“ওই বাঁকের মুখ টা বেশ সুবিধার হবে। পুরো লাইনের উপর একেবারে শেষ মুহূর্তে ড্রাইভারের নজর পড়ে।”বেশ বিজ্ঞের মত বলে দিপু।
মোরাম রাস্তা টা উঁচু হয়ে লাইন পার হয়েছে। ফটকের একদিকে একটা কালভার্ট, তার উপর বসে দু’জনে। সেই দুপুরের ঘুগনি পাউরুটি বহু আগেই হজম হয়ে গেছে দু জনেরই। কয়েকবার টিউবওয়েল থেকে জল খেয়েছে তারা, ব্যস। এবারে কিন্তু খালি পেট মোচড় দিয়ে খিদেটা জানান দিল। কিন্তু এসেছে আত্মহত্যা করতে, খিদের প্রসঙ্গ টা এখানে মোটেই কাজের নয়। দিপুর মনে বোনের মুখ টা ভেসে উঠলো। ফাইভ চলছে এখন। ঝাঁকড়া চুলের পুতুল পুতুল বোনটা বড্ড বেশি নেওঠা। খুব কাঁদবে।
“কে রে তুরা? এত রাতে ইখেনে কি কচ্চু?”আচমকা দুটো প্রশ্ন আর টর্চের আলো সব ভাবনা কে জল ছবির মত মুছে দিল। “তুদের ঘর কুথায়?”
খাঁকি হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরা গেটম্যান টর্চ হাতে এগিয়ে আসে। দিপু ওনাকে চিনলেও দিপুকে উনি চেনেন না।
“তুদের মতলব টা কি, বলবি?”
দুজনেই চুপ। আত্মহত্যা করবো বলে বসে আছি, এটা তো বলার মত বিষয়ই নয়।
গত দু’তিন বছরে গোটা কয়েক রেলে মাথা দেওয়ার ঘটনার সাক্ষী গেটম্যান দুজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে আরো কাছে এসে, “কি রে, চুপ ক্যেনে?” এরা দুজন যে ইস্কুলের ছাত্র, বুঝতে পারেন। আপ ট্রেন আসতে এখনো ঘন্টা দেড় দেরি। নিজের মনে কর্তব্য ঠিক করে নিয়ে দিপুদের কাছে না দাঁড়িয়ে মোরাম রাস্তা দিয়ে নেমে যান।
আস্তে আস্তে টর্চের আলো দূরে মিলিয়ে যেতে দেয় দিপু। “আর একটু হলেই ব্যাটা সব ভেস্তে দিয়েছিল, বুঝলি।” প্রশান্ত কোনো কথাই বলে না। “কটা বাজল বলতো?” আবারও বলে দিপু। “দশ টা হবে।” সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশান্তর।
অন্ধকারে দূরে দূরে গ্রামের আবছা আলো আর ঝাঁক ঝাঁক জোনাকির আলো, ব্যস। দু’হাত দূরে বসে থাকা বন্ধুর মুখটাও ভালো করে কেউই দেখতে পাচ্ছে না। এই দেখতে না পাওয়ার একটা ভালো দিক হচ্ছে কেউ কারো মুখের ভাব বুঝতে পারছে না। কত স্মৃতি, কত কল্পনা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে দুজনের। মান অভিমান শাসন ভালোবাসা বন্ধুদের সাথে কাটানো সব সময়…। দূরে মাঝে মাঝেই শেয়াল ডেকে উঠছে, গ্রামের কুকুররাও তার জবাব দিয়ে চলেছে। একটা মেঠো ইঁদুর কিচ কিচ করে দৌড়ে গেল বার কয়েক। দু’জনেই স্থির, সময় ও যেন তাদের সাথে তাল মিলিয়ে স্থির হয়ে আছে। কেবল মশার দল যেন দায়িত্ব নিয়ে দিপু প্রশান্ত কে সজাগ রাখার দায়িত্ব নিয়েছে।
হঠাৎ পিছনের মোরাম রাস্তায় দুটো আলোর বিন্দু ফুটে ওঠে। বিন্দু দুটো একটা ছন্দে দুলতে দেখে দুজনেই বোঝে যে আলোর বিন্দুর পিছনে দুটো মানুষও আছে। দুজনেই শঙ্কিত হয়, এরা কারা হতে পারে! এই রাস্তায় এতো রাতে সচরাচর মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। আলোর বিন্দু দুটো ক্রমশ বাড়তে থাকে। বোঝা যায় দুজন মানুষ টর্চ হাতে হনহন করে হেঁটে আসছে। ওইটুকুই, ব্যস। একটা সময় আলো সরাসরি দিপু প্রশান্তের মুখে, চোখ ধাঁধিয়ে যায় দুজনের। কেউ একজন দিপুর হাত টা ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কসে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে বলে, “ছুঁচো, বাঁদর, শুয়োর, আত্মহত্যা করবি!!” পরের থাপ্পড় টা প্রশান্তের গালে, “বাপ এ জন্যই বড় করেছে!”
ঝড়ের বেগে ঘটে যাওয়া কথা আর থাপ্পড় দুটো দুজনকেই হতবাক করে দেয়। চোখের উপর টর্চের আলো, কিন্তু বাঘের গর্জনের মত ধমক শুনে মানুষ টাকে চিনতে এক মুহূর্ত দেরী হয় না কারোর। হেড স্যার সুবিমল বাবু! হতচকিত দিপু বসে পড়েছিল। হাত টা ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে কে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরের থাপ্পড় টা দেওয়ার আগেই সুবিমল বাবুর পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দিপু।
“স্যার, যত খুশি মারুন, কিন্তু এলাউড করিয়ে দেন স্যার।”
প্রশান্তও মুহূর্ত দেরি না করে দু’হাতে সুকুমার বাবুর পা আঁকড়ে ধরে, “হ্যাঁ স্যার, আর কখনো এমন হবে না স্যার। এলাউড করে দেন স্যার,” কোরাস শুরু করে দেয়। ব্যাপার টা দেখে গেটম্যান হতভম্ব হয়ে পড়ে। তার আন্দাজ করতে যে ভুল হয় নি, নিশ্চিত হয় সে।
সুকুমার বাবু দুজনের ঘাড় ধরে দাঁড় করান, “আয় আমার সাথে। বাড়িতে কি আছে জানি না। কিছু না থাকলে মুড়ি জল খেয়ে রাত কাটাবি। কাল যা করার করবো। ওফঃ, কি ভয়ঙ্কর ছেলে তোরা। ওরে শুয়োর, কাল সেকেন্ড লিস্ট বেরোবে তো।একেবারে ফর্ম ফিলাপ করে ঘরে যাবি।”
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..