দুঃখ এক অভ্যাসের নাম – একটি সহজ স্বীকারোক্তি

আশুতোষ সরকার
রিভিউ
Bengali
দুঃখ এক অভ্যাসের নাম – একটি সহজ স্বীকারোক্তি

কবিতা সব দেশেরই আদি পর্বের সাহিত্যের রূপ। অর্থাৎ যে কোন সাহিত্যেই সর্বপ্রথম যে সাহিত্য প্রকরণ দেখা দিয়েছে তার নাম কবিতা। বাংলা সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন আমরা এখনো পর্যন্ত জানি চর্যাপদ। চর্যাপদের মধ্যে যা রয়েছে তা ধর্ম বিষয়ক এক ধরণের খণ্ড কবিতা বা লুপ্ত সাধনতত্ত্ব। চর্যাপদের পদগুলো মৌলিক কবিতা কিনা তা নিয়ে বিস্তর তর্ক রয়েছে সমালোচকদের মধ্যে। যাইহোক,কবিতা কী? আজ পর্যন্ত কবিতা সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ও সর্বজনগৃহীত সংজ্ঞা সমালোচকগণ দিতে পারেননি। সে অর্থে কবিতা রহস্যময়। আদি গ্রিক মহাকবি হোমার, কবিতা লেখার জন্য ‘মিউজ’ এর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছেন। William Wordsworth (1770-1850)-এর বিখ্যাত বক্তব্য

“Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings”

যা বাংলা করলে বলা যায়,মনের প্রবল আবেগ বা অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে ছাপিয়ে উঠলেই তা হয় কবিতা।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার জন্মকথা ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন —

‘অন্তর হতে আহরি বচন,
আনন্দলোক করি বিরচন
গীতধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে’

আরো অনেক কবি, মনীষী তাঁদের নিজ নিজ মত প্রকাশ করেছেন, তা লেখা অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই একেবারে মূল কথায় আসি। কবিতার উপাদানে কী থাকে? উত্তর হতে পারে জীবনের সুখ-দুঃখ, পাপ-পূণ্য, অর্থ,কাম,মোহ,সুন্দর,প্রেম,বিদ্রোহ ইত্যাদি।

ঠিক তেমনি কবি আবু তাহের —তার জীবনের মুহূর্তে প্রতিনিয়ত সংঘটিত দুঃখ,আনন্দ-বেদনা যাবতীয় কিছুর সুনিবিড় আত্মোপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করেছেন তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ “দুঃখ এক অভ্যাসের নাম” এই বইটির মাধ্যমে। কবি এখানে নিজ উপলব্ধির শব্দযাপনে তুলে এনেছেন ব্যক্তি, সমাজ, দেশ’র নানা প্রসঙ্গ।যেখান—

কবি তার নিজস্বতার দ্বারা সীমাহীন দারিদ্র্য, অনন্ত দুঃখের পসরা সাজিয়ে শিল্পের স্রোত ভাসিয়ে দিয়েছেন অভাব অনটন যন্ত্রনায় ছটফট করা একজন বাবা ও সংসার কর্তার সমকালীন রূপ ফুঁটিয়ে তুলেছেন এভাবে,

“দেখ মেয়ের উদ্ভিন্ন বুকের মলাট ছিঁড়ে গেছে, বউয়ের সোনার আঙুল খসে পড়ছে, কুঁজো হয়ে গেছে বাবা বয়সী শোবার ঘরটা/শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস সাইফুল?”
(দুঃখ এক অভ্যাসের নাম)

গুহাবাসী সন্ন্যাসী জীবন একমাত্র কবিই গ্রহণ করতে পারেন স্বাচ্ছন্দ্যে:

“কানে বাজছে কারাগারের ঘন্টাধ্বনি, গুটিবন্দি হচ্ছে শুঁয়োপোকার জীবন”
(বোবাকান্না)

আমাদের পরিচিত দৃশ্যের বাইরে কত কত প্রেম কুয়াশার মতো টুপ করে ঝরে যায় তার খোঁজ আমরা না রাখলেও কবি রেখেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে:

“তুমি চলে যাচ্ছ; ঘরে, উঠানে বারান্দায় রোদেপোড়া বালির মতো চিকচিক করছে স্মৃতির চুম্বন”
(বিদায়বেলা)

কী অসম্ভবভাবে কবি বোনেন দুঃখের কল্পনাজাল। নির্জনতায় একাকীত্বে কষ্ট বহন করে হেঁটে যাওয়া কবি লিখলেন:

“ছাবেদ আলো-আধাঁরির মধ্যে হাঁটে তার সাথে হাঁটে কয়েকটি রুগ্ন ছায়া/ছায়ার গায়ে ত্যানা জামা, জামার গায়ে জলচিত্র জান্নাত”
(স্বত্বাধিকারী)

কোন প্রকার শাসনকে তোয়াক্কা না করেই একমাত্র কবিই পারেন এমন সাহসী উচ্চারণ করতে । “জীবনানন্দ দাশ একবার বলেছিলেন কবির পক্ষে সময়কে ধারণ করা দরকার”।ঠিক তেমনি কবি আবু তাহের সমকালীন রাষ্ট্র, সমাজ এর নির্মম, ভয়াল অবক্ষয় নিয়ে উচ্চারণ করেছেন:

“যোনির মতো অন্ধকার, তুমুল হাহাকার, রাষ্ট্রের মরণব্যধি ক্যানসার; কোথাও বৃষ্টি নেই, নেই নদীজল,সুবোধ পালিয়ে গেছে –জীবন অরক্ষিত”
(রোগাক্রান্ত)

কবি সবসময় করেন শব্দচাষ, জীবনের বোধকে ঘিরে গড়ে তোলেন স্বপ্নের শব্দের বীজতলা। আর নানা ব্যক্তিগত সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে সাদা কাগজে লাঙল চালান সেইসব বীজ রোপন করার জন্য:

“আমার জমিনটুকু দখল নিয়ে যায় লক্করের আড়ত, শব্দগুলো পাটিগণিত সেজে/বন্দি হয় বার্ষিক টালি খাতায়; স্বপ্নেরা মেঘের সাথে সই পেতে চলে যায় আকাশ পাড়ায়”
(শব্দ ফুলের বীজ)

কবি আবু তাহের অস্বাভাবিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে তুলে এনেছেন স্বার্থক উপমা:

“হৃদয় আকাশে সে ছবি পূর্ণেন্দু চাঁদের মতো বিমূর্ত ফ্রেমে বাঁধাই”
(চিত্তে আঁকা ছবি)

আমরা সত্যিই কবির সাথে একাত্ব হয়েই আশ্চর্য হই:

“আমি খুব আশ্চর্যান্বিত! ধর্ম, অস্ত্র শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি!”
(ধর্ম ও অস্ত্র)

‘জীবনের আরেক নাম রাশি রাশি জল’

এমন আরো অনেক অসাধারণ চরণ/কবিতার নির্মাণ আছে এই বইটিতে।

এখানে একটু বলা দরকার ধর্মের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য ধর্ম এ নিয়ে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে সমাজে। এ প্রসঙ্গ টানছি না । তবে অস্ত্রের বিষয়ে বলা যায় যে, মানুষ অস্ত্র ব্যবহার শিখেছিলো শিকার ও বন্য জন্তুর আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেই অস্ত্র যখন একজন মানুষ অন্য আরেকটি মানুষের দিকে তাক করছে! তখন ভাবতে হয় কতটা নীচুতার দিকে মানবতা চলে গেছে। অস্ত্র হাতে নেওয়া মানুষটি কতটা মানুষ এখানে প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে।

যাইহোক, শেষ করা যাক কবির লিখন শৈলীর কথা বলে- নির্জন দুঃখের ও নিঃসঙ্গতার সংঙ্গে এক আত্মিক যোগসূত্র তৈরি করেছেন কবি, তাই হয়ত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘দুঃখ এক অভ্যাসের নাম‘। তাছাড়া প্রথাবদ্ধ ছন্দের বাইরে এসে নির্মল সজীব বোধের ছন্দ, সহজ ভাষার প্রকাশ প্রতি পঙক্তিতে করেছেন যা পাঠককে নিয়ে যাবে কবির বোধের দোরগোড়ায়।

পরিশেষে বলা থাক, আমি কোন আলোচক, সমালোচক নই এমনকী নিবিড় পাঠকও নই। আমি একজন সাধারণ সাদামাটা পাঠকমাত্র। কবিতা ভালো লাগা, ভালোবাসার স্থান থেকে এ আমার অল্পমানের প্রয়াস। এই বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাক এই প্রত্যাশা করছি।

বইয়ের নাম: দুঃখ এক অভ্যাসের নাম
কবি: আবু তাহের
প্রচ্ছদ: আল নোমান
প্রকাশক: বেহুলাবাংলা
প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯

আশুতোষ সরকার। কবি। জন্ম বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা

  রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..