দুঃস্বপ্ন

সামিয়া ইতি
গল্প, ছোটগল্প
Bengali
দুঃস্বপ্ন

আমি কুঁজো হয়ে বসে আছি, কানে ধরে আছি, দুই হাঁটুর নীচের ভাঁজ দিয়ে হাত বের করে, কিছুতেই ধরতে পারছিনা, বার বার সরে যাচ্ছে হাত, সেই জন্য জঘন্য সব কথা শুনতে হচ্ছে।

ওহ না! না! আমি পারছিনা, আমি পারছিনা, আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ, আমার এখন এসব করবার বয়স না, ঊনআশি বছর বয়সের বৃদ্ধ আমি। আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না?

-চুপ করুন, একদম কথা বলবেন না, কথা বলে বলে আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি।

-তাই বলে আমার সাথে এভাবে অন্যায় করবেন?

-কোন অন্যায় করা হচ্ছেনা আপনার সাথে,

-অন্যায় করা হচ্ছেনা? ঊনআশি বছর বয়সের এক বৃদ্ধকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন আপনাদের আর্মি ট্রেনিংয়ে, তবু অন্যায় হচ্ছে না?

-কিশের অন্যায়? আপনি নিজে থেকেই এখানে এসেছেন, আবার জয়েন করেছেন, এখন এই সকল রুলস আপনাকে ফলো করতেই হবে।

-আপনারা কি বলছেন আবোল তাবোল? আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না একবার চাকরীতে রিজাইন দিয়ে চলে গেলে আবার জয়েন করা যায় না।

-যায়

-কে বলেছে

-আমি বলেছি আমাদের সরকারের করে দেয়া আইন এটা,

-না

-আপনি ভুল বলছেন,

-ঠিকাছে হয়তো আমি ভুল বলছি, কিন্তু আমি বিশ বছর আগে রিজাইন দিয়েছি, তারপর আর এই চাকরীতে জয়েন করিনি,

-করেছেন

-কেন আপনারা এমন করছেন আমি বৃদ্ধ মানুষ, প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন।

-উঠে দাঁড়ান, আপনি এখুনি উঠে দাঁড়ান, বাঁশিতে ফু দেয়ার সাথে সাথে আপনি দুই কিলোমিটার দৌড়াবেন। আমাদের পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, তাড়াতাড়ি, উঠুন; উঠুন; দৌড়ান; ওয়ান টু থ্রি………….

-বাবা, আপনাদের অবশ্যই ভুল হয়েছে আমি একটানা দশ মিনিট হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাই, আর আপনি কিনা বলছেন দুই কিলোমিটার দৌড়াতে? বোঝার চেষ্টা করুন বাবা; আমি ঊনআশি বছর বয়সের এক বৃদ্ধ।

-চুপ, চুপ,একদম চুপ।

বুঝেছি, বুঝেছি, আপনাকে শাস্তি না দিলে ঠিক হবেন না, এই কে আছিস? এইদিকে আয়, তাড়াতাড়ি।

এর গায়ে এক বালতি বরফ ঢেলে দিয়ে যা, সে আমাদের সৈন্য বাহিনীর মর্যাদা এবং শৃঙ্খলা নষ্ট করেছে।

-শৃঙ্খলা নষ্ট করেছি?

আমি? দেখুন,দেখুন স্যার, আপনাদের কোথাও ভুল হয়েছে।

এমন সময় কে যেনো হিমশীতল বরফ ঢেলে দিলো বৃদ্ধের সারা শরীরে, কাঁপতে কাঁপতে ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেলো বৃদ্ধ। ঘুম ভাঙল প্রবল ঝাঁকুনিতে, পাশেই তার স্ত্রী জুলেখা, সে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিলো, কি হয়েছে? হয়েছে কি আপনার? এত কাঁপছেন কেন??

ঠাণ্ডায় জমে গেছেন বৃদ্ধ, কোন রকম কাঁপতে কাঁপতে বললেন আমার গাঁয়ে কম্বল পেঁচিয়ে দাও, খুব শীত! খুব শীত! বরফ; বরফ; উফ বরফ! এত ঠাণ্ডা!! জুলেখা যত্ন করে কম্বল জড়িয়ে দেয় তার স্বামীকে, ধীরে.. একটু সু-স্থির হয়ে এলে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করেন জুলেখা; সেই দুঃস্বপ্নটা আবার দেখেছেন বুঝি??

-ওরা না! মানতেই চায় না! আমি যে চাকরী থেকে রিটায়ার্ড করেছি, আমাকে বলে কিনা দুই কিলোমিটার দৌড়াতে? আমি ঊনআশি বছরের বৃদ্ধ মানুষ! পারিনা দশ মিনিট হাঁটতে, থাক, থাক, আর বলতে হবেনা, যখন ঘুমাবেন তখন চাকরী নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না ঠিক আছে?

-তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করবো?

-চিন্তা করবেন আমাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে, নাতীনাতনী নিয়ে, আমাকে নিয়ে, আমাদের সংসার নিয়ে।

-আর সংসার, সংসারের আর কিই বা আছে?

– সবই আছে, যতদিন আপনি আমি আছি ততদিন আমাদের সংসার ও আছে।

আচ্ছা বলে বৃদ্ধ ছোট একটা নিঃশ্বাস নেয়।

জানালার গ্রিল বেয়ে কীভাবে যেন একটি ঝিঙার লতা বেয়ে উঠেছে, প্রতিদিন জানালা বন্ধ করা হয়, তখন নিশ্চয়ই চাপ লাগে ওটার গায়ে, তবু কি করে টিকে আছে!

এরকম কি মানুষের জীবন, সয়ে সয়ে ব্যথায় আর আঘাতের পর আঘাত নিয়েই টিকে থাকে।

কিন্তু ঐ দুঃস্বপ্নটা ভীষণ ভোগাচ্ছে, এই নিয়ে ছয় বার দেখা হলো, খুবই বাজে স্বপ্ন।

এরপর পাঁচ দিন কেটে গেলো ভালোই, ঐ খারাপ দুঃস্বপ্নটা এলোনা বৃদ্ধের স্বপ্নে, জুলেখাও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়।

 তারপরই আবার একদিন—-

– এই!এই! আপনি এখানে কি করছেন?? আপনি প্রতি পদে পদে আমাদের আইন, আমাদের নিয়ম, আমাদের শৃঙ্খলা নষ্ট করছেন,

-আবার আমি স্বপ্নে?

-আপনি স্বপ্নে না বাস্তবে? আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন বাতাশে? স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য ধরতে পারেন না বোকার হদ্দ কোথাকার! আরে আপনি নিজের গায়ে চিমটি দিন, হ্যাঁ এইতো, স্বপ্ন মনে হচ্ছে? ব্যথা লাগছে না? এবার বুঝুন স্বপ্নতে কেউ ব্যথা পায়?

-তারমানে এটা বাস্তব?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাস্তব! বাস্তব!! আপনি কি ভেবেছেন আপনার সাথে আমরা তামাশা করতে বসেছি?

উঠুন,দাঁড়ান, যান প্র্যাকটিস করে নিন, আমাদের পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, উঠুন বলছি,বলতে বলতে কি জোরে যে ঝাঁকুনি দিলো লোকটি!

জেগে ওঠার পর ও বৃদ্ধ পুরো এক ঘণ্টা থর থর করে কাঁপলেন, পাশেই টেবিলের উপর জগ গ্লাস রাখা, সেটা থেকে ঢক ঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লেন, তার স্ত্রী জুলেখা গভীর ঘুমে ছিলেন, তাকে আর বিরক্ত করলেন না।

কতক্ষন ঘুমিয়েছিলেন মনে নেই, শেষ রাতের দিকে আবার স্বপ্নটি দেখলেন তবে তেমন কোন আঘাত কিংবা ভয় পেলেন না, এবার দেখলেন সে একটি রাইফেল পরিস্কার করছেন, তার মত অনেকেই তাদের রাইফেল পরিস্কার করছেন, বোঝাই যাচ্ছে কোন  যুদ্ধের প্রস্তুতি, আর কিছু ঘটলো না।

সারাদিন বৃদ্ধের অস্বাভাবিক চিন্তায় কাটলো, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে ভাবতে গেলে এটা কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র।

কিন্তু মনটা কেমন জানি করছে, পাশের বাড়ি থেকে রহিম সাহেব এসে বেশ কিছুক্ষন গল্প করে গেছেন, তার বয়স বৃদ্ধের থেকে অনেক কম, তাই সে তার দুঃস্বপ্নের কথা বলি বলি করেও শেষ পর্যন্ত আর বললেন না

তারপর—-

দিন ফুরিয়ে যখন রাত নেমে এল, কিছুতেই তার বিছানায় ঘুমাতে যেতে ইচ্ছে করছিলো না, জুলেখা এসে কপালে হাত রেখে কয়েকবার পরীক্ষা করে গেছেন জ্বর এসেছে কিনা, নাহ! আসেনি,

যখন রাত বারোটা বাজলো কিছুতেই আর চোখের পাতা মেলে রাখতে পারলেন না, বাধ্য হয়েই নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেলেন।।

কানে নানারকম শব্দ আসতে শুরু করলো, সবাই দৌড়াচ্ছে, ছুটছে, কেউ কেউ রাইফেল দিয়ে অনবরত গুলি ছুড়ছে, বৃদ্ধ ব্যাকুল হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছেন, চিৎকার করে জানতে চাইছেন, আমি কোথায়? কেউ তো বলো, এটা কিশের যুদ্ধ? কেউ তো বলো আমায়? ওরা কারা? কিশের জন্য এই যুদ্ধ? আমাকে বাঁচাও;

সরাও আমাকে এখান থেকে, আমি রাইফেল চালাতে ভুলে গিয়েছি, সেই বিশ বছর আগে আমি রাইফেল চালিয়েছিলাম, এখন আর সে সব কিছু মনে নেই। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো তোমরা, আরে! আরে! আমার গায়ে গুলি লেগে যাবে তো! ওহ না না! না!!

আমার হাত! ওহ আমার পেটটা!! আহ! নাআআআআআ!  মাগো আমার পেটটা একদম ফুটো করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো গুলি, বাঁচাও! বাঁচাও! পানিইইইইইইই! একটু পানি খাবো। আমাকে কেউ একটু পানি দাও, আআআমি! আমিইইইই ঊনআশি বছর বয়সের এক বৃদ্ধ, চাকরী থেকে রিটায়ার্ড করেছিইইইইই বিশ বছর আগেএএএএএএ।

সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছেন জুলেখা, স্বামীকে অনেকদিন পর স্বস্তিতে ঘুমাতে দেখে আর টু শব্দটি ও করেননি, ঝটপট রান্না ঘরে এসে নাস্তা বানিয়ে তবেই ডাকতে গেলেন স্বামীকে।

যখন বৃদ্ধের শরীর স্পর্শ করলেন, ততক্ষনে দেহটি বরফের মতন ঠাণ্ডা আর ভারী হয়ে গেছে।

সামিয়া ইতি। গল্পকার। প্রকাশিত বই: 'অস্তিত্বে অন্তরালে' (গল্পগ্রন্থ), 'অন্বেষা' (উপন্যাস), 'শঙ্কিত শহরে' (গল্পগ্রন্থ), 'হ্যালুসিনেশন' (গল্পগ্রন্থ), এছাড়া সংকলন গ্রন্থ 'উতল হাওয়া', 'মাতাল হাওয়া', 'লেখাজোকা সংকলন'-এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গল্প। ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুই বাঙলার যৌথ কবিতা সংকলন 'কাঁটাতারের এপার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ