ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
অতঃপর আমার জায়গা হল এই লাশকাটা ঘরের এক ফালি এক স্ট্রেচারে। হঠাৎ ডাক্তারের বিকট চিৎকার। ছুটে আসে আরও আরও কেউ—! সেই চিৎকারে ছুটে আসে রুপান্তরিত জনমের আবেশ।
রৌদ্রজ্জ্বল উৎড়ানো সকাল ছিল। ব্যস্ত এক শহরের চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম যার জন্য সে তখন কেবলই আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। সময় গড়িয়ে অস্থিরতা বেড়ে যখন ঘেমে উঠছিলাম রোদের তাপে, ঠিক তখনই সে এল। আমি যতটা না তাকে দেখে স্তম্ভিত তত বেশি অবাক সে বস্তুটি দেখে। যেন, চোখa কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে দরজার চৌকাঠে পা পড়তেই দৃষ্টি আটকে গেল কালো কুচকুচে বস্তুটির উপর। কি অদ্ভুত সুন্দর! প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম বাতাসের শিরশির অনুভূতিতে। প্রেম বুঝি এমনই হয়। কি নাম দেব তার? ভাবতেই ঝলকে দুলে উঠল হৃদয়ের রক্ত, এ তো আমার স্বপ্নে দেখা নয় বরং বাস্তবে পেয়েও হারানো “ব্ল্যাকপ্রিন্স”! একটি প্রাপ্তি প্রত্যাশার চেয়েও বড় কিছু। সবসময়ই যে স্বপ্নের মধ্যে ঘোরে ব্ল্যাকপ্রিন্সটি। ফ্ল্যাশব্যাকে মগজ ঘুরে এল কি বিষম দ্রুত গতিতে।
আব্বা খুব রাগী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, তবে আদরে ভরা রাগের ওই বাক্সটি আমাকে জীবনে দিয়েছিল গভীর অনুভূতিময় ভালোবাসা। আমি তখন খুব ছোট। আব্বার একটা লাল রঙের হোন্ডা ছিল। আমি খুব পছন্দ করতাম। আব্বার সেই লাল রঙের হোন্ডায় আব্বার কোমর জড়িয়ে বসতাম রোজ সন্ধ্যায়। বহুদূর বহুদূর ঘুরে আব্বা আর আমি রাত গিলতাম নির্মল আনন্দে। ওদিকে আব্বার ব্যবসার প্রসার বাড়তেই থাকলো। চারিদিকে কেবলই টাকা দেখি আর টাকা দেখি। এক সকালে আবিষ্কার করি, লাল রঙের হোন্ডাটা আর নেই বাড়ির সামনে। দিনভর কেঁদে কেঁদে আমি হয়রান যখন কেবলই সন্ধ্যার আকাশ দেখি ঠিক তখনই চিৎকার আব্বার।
“অ্যাই মা, বাইরে আয়।”
গেলাম বাইরে।
আব্বার মুখ ভরা হাসি, চোখ ভরা উচ্ছ্বাস। আমার দৃষ্টি চলে গেল সেসব ছাপিয়ে আরেকটু দূরে কালো কুচকুচে বস্তুটির উপর। কি অদ্ভুত সুন্দর! সেই বস্তুটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি চক্কর দিই আনন্দে। বস্তুটির আবার চারটি দরজাও আছে। সেই বস্তুটির পেছনের একটি দরজা খুলতেই দেখি ভেতরে বসার জায়গা। না না ঐটুকু যেন আমার শোয়ার জায়গা। আমার সমস্ত দিনের কান্না’রা যেন ফেরত এসেছে রাশি রাশি আনন্দ আর আনন্দ নিয়ে। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খুশি তো?”
কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় কই আমার? আমি তখন নাম খুঁজছি মগজ খাটিয়ে খাটিয়ে। ব্ল্যাকপ্রিন্স! পেয়েছি। এই নামেই ডাকবো তাকে। কিন্তু খুশি যে চিরস্থায়ী নয় সে যে ঐটুকু শরীরের মগজ বোঝেনি। দিন গিয়ে মাস গড়িয়ে বছর যায় চলে। পরিস্থিতি বদলায়। ব্যবসার হাল খুউব খারাপ। চারিদিকে ঋণ আর ঋণ। ব্যাংক থেকে চিঠি আসে আর আসে। খেই হারায় আব্বা। বিক্রি হল বাড়ি। বিক্রি হল ব্ল্যাকপ্রিন্স। ক্রেতা এলেন ব্ল্যাকপ্রিন্সকে নিতে। কিন্তু আমি তো ব্ল্যাকপ্রিন্সকে কোথাও নিতে দেব না, তাই চাবিটি লুকিয়ে রাখি আলমারির নীচে। আব্বা বুঝে কি মারটাই মারলেন আমাকে উঠোনে রাখা বরই গাছের ডাল দিয়ে। আমার চিৎকারে বোধ করি ব্ল্যাকপ্রিন্সও অভিশাপ গুনেছিল।
সেই চাবি পাওয়াও গেল সেই আলমারির নীচেই। ব্ল্যাকপ্রিন্স চলে গেল অচেনা কারো হাত-পায়ের চাপে। আমিও বেরোলাম বাড়ি থেকে। সারাদিন বাড়ি ফিরিনি। কোথায় ছিলাম জানি না। রাতে নাকি আমাকে আমার দাদার বাড়ির খাটের নীচ থেকে পাওয়া যায় বেঘোরের ঘুমে ফুটন্ত জলের মতো গরম শরীরে। চারদিন আমি বেঘোরে ছিলাম। এরপর কেবল ধ্বংস আর ধ্বংসাবশেষ। সেই ধ্বংসাবশেষ আঁকড়ে আর কুড়িয়ে আমি তৈরি করেছিলাম এক স্মরণীয় বলয়, যা আমাকে স্মৃতিতে আবেশী করে রাখতো। জীবনের সমস্ত চড়াই-উৎরাই এবং লুকিয়ে চুরিয়ে ব্ল্যাকপ্রিন্সের উপর আমার ভালোবাসা কেউ কখনো বুঝতে পারেনি। ব্ল্যাকপ্রিন্সটি নেই ভাবিনি কখনও, বরং ছিল মনে। ভেবেছি, আজ নেই তবে ওটি আবার ফিরে আসবে পুরনো জায়গায়, এই আমাতে। আমি এবং আমার চিন্তায় ভালোবাসার ব্ল্যাকপ্রিন্স রয়ে গেল আজন্ম এক ব্যথা হয়ে।
“কি, উঠে আসুন।”
সম্বিত ফিরল কারো কথায়। আমি দাঁড়িয়ে আছি ব্যস্ততম শহরের কোন এক চৌরাস্তার মোড়ে। আমার সামনে আমার শৈশব দাঁড়ানো, দাঁড়ানো সেই ব্ল্যাকপ্রিন্স। অচেনা কেউ নিয়ে গিয়েছিল অথচ ফেরত পাঠালো চেনা এই দেবদূতের হাত-পায়ের চাপে।
“কই আসুন”
আমার খেই ফেরে বাস্তবে। ব্ল্যাকপ্রিন্সের বাম পাশের দরজাটা খোলা। আমাকে বেশ কসরত করেই ঢুকতে হল। বললাম,
“এত ছোট। খেলনা যে!”
আমার ডান পাশে বসা দেবদূত যেন লজ্জা পেলেন খুউব। আর আমি পেলাম দিগন্ত ছোঁয়া উচ্ছ্বাস আর উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাস একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে দিন, মাস, বছর ঘুরে আমাকেও কেবলই টেনে টেনে নিত দেবদূতের গা ঘেঁষে ব্ল্যাকপ্রিন্সের গোপনে প্রেম প্রেম গন্ধে।
সে গন্ধ মদিরতায় কেবলই আমি, দেবদূত আর আমাদের ব্ল্যাকপ্রিন্স। ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত দিনের ভাঁজে আমাদের টুকরো টুকরো সময়ের খাঁজে চলে কেবলই উদযাপন। আমাদের চোখের সুখি সুখি কোনে উপচে উপচে পড়ে অত্যুজ্বল আলোকছ্বটা। আমাদের কপাল বেয়ে গড়ায় শ্রান্তির ঘাম। অথচ ক্ষণস্থায়ী তাও সে সুখের কোনে এল আবারও কোন এক সকাল। দেবদূত নিখোঁজ হলেন সাথে নিয়ে ব্ল্যাকপ্রিন্স। আমার নিঃশ্বাসে শুরু হল হাঁপড়ের মতো ওঠানামা। সেই ওঠানামায় একটু একটু করে নিঃশেষ হতে থাকি গভীর কোন ক্ষরণে। দেবদূত তবু ফিরলেন। ব্ল্যাকপ্রিন্স ছাড়া। ব্ল্যাকপ্রিন্স নাকি আর নেই। রঙ বদলের উৎসবে ব্ল্যাকপ্রিন্স হাত বদল হয়ে হারিয়ে গেছে চির নবান্নের দেশে। কি হল তাতে! হল তো। আমি যে আর দেবদূতের চোখে আমাকে রাখতে পারি না। আমার সমস্তটুকুতে ধরল পচন। এর নাম নাকি অসুস্থতা! কোন ঔষধই কাজ করে না আমার শরীরে, আমার মননে। তবে আমার অসুস্থতাও কেউই ধরতে পারে না। অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই ভালোবাসা ডুবে গেছে বৃষ্টির শেষ ফোঁটায়, সেটিও কেউ বোঝে না। ভালোবাসাও সারে না। মৃত্যুর শিরশির অনুভূতি ছুঁয়ে দিয়ে গেল প্রেমবিহীন হৃদয়ে। অতঃপর আমার জায়গা হল এই লাশকাটা ঘরের এক ফালি এক স্ট্রেচারে। হঠাৎ ডাক্তারের বিকট চিৎকার। ছুটে আসে আরও আরও কেউ। ডাক্তার চিৎকার করে বলেন,
“লাশ কাটা ঘরে একান্ন বছর কেটে গেছে। অনেকের লাশ কাটাছেঁড়া করেছি, কিন্তু এমন ঘটনা আজ অব্দি ঘটেনি। মর্গের টেবিলের উপর যে তরুনীর লাশটি এখন রাখা আছে তার হৃদযন্ত্রটিকে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাতে হবে। ল অ্যান্ড ফোর্স ডিপার্টমেন্ট থেকে হুকুম জারি হয়েছে, “ওটা ফরেন্সিক বিভাগে পাঠিয়ে দাও কেটে।” কিন্তু ভারী আশ্চর্যের বিষয়, লাশটির হৃদযন্ত্রটিই নেই। আচ্ছা কেন নেই হৃদযন্ত্রটি?”
প্রশ্নের উত্তর যেন খুব কঠিন। লাশকাটা ঘরে যেন নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবাইকে ভাবাচ্ছে কেবল একটিই প্রশ্ন,
“আচ্ছা তাহলে কি পৃথিবীতে এই তরুণীটি হৃদযন্ত্র ছাড়াই এসেছিল?”
কিংকর্তব্যবিমুঢ় ডাক্তার এবার মৃদুস্বরে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে, “কেন ছিঁড়েখুঁড়ে ছারখার হৃদপিণ্ডবিহীন তরুণী?”
ভাবনার হ্যালুসিনেশনে ফরেন্সিক ল্যাব আর হৃদযন্ত্রবিহীন তরুণী, আদপে যে আমিই। আমাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ে ভীতি। অথচ তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডাক্তার আর অমীমাংসিত প্রশ্ন মুখোমুখি, কেন ছিঁড়েখুঁড়ে ছারখার হৃদপিণ্ডবিহীন তরুণী?
উহ্, অসহনীয় অসহ্য যন্ত্রনার প্রশ্নবাণে কাতরাচ্ছে ডাক্তার, নেই কেন ওটি?
ওদিকে হৃদপিণ্ডবিহীন তরুণীর চারপাশে ভনভন করতে শুরু করেছে মাছি। যেন বলছে,
“স্পর্শিত বেহায়া ব্যাকুল অক্ষীর দুকূল, এজন্মে পরজন্মে হাহাকার, কার সঙ্গে বাঁধে কার ঘর! কার তরেই মরেছিস, পুড়েছিস, ডুবেছিস, তবুও যে সে তোর নয়। এমনকি তুইও নস তার। জলে জল ছুঁয়ে অনঙ্গে কেমন যেন বাহারি সে আর তুই। গেঁথেছিস মালা, দিয়ে একটি সুঁই।”
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..