দুধে ধোয়া তুলসি পাতার আগমন

মাসকাওয়াথ আহসান
রম্য রচনা
দুধে ধোয়া তুলসি পাতার আগমন

সাধুগ্রামের এক সবুজে ঢাকা পাখি ডাকা স্নিগ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। ঘটা করে গাছ কেটে পাখি তাড়িয়ে কংক্রিটের দালান তোলার প্রকল্পের প্রস্তুতি চলছে। প্রকল্প মানেই কোটি কোটি টাকার খবর চাউর হওয়া।

উন্নয়নের ছাত্রসৈনিকরা পড়ুয়া ছাত্রদের কাছ থেকে ক্যালকুলেটর কেড়ে নিয়ে আসন্ন প্রকল্প বরাদ্দ থেকে ঠিক কত শতাংশ তাদের ন্যায্য পাওনা; সে হিসাব করছে। এই যে তারা সারাবছর পড়াশোনা বাদ দিয়ে কেবল দেশকে ভালোবেসে মিছিল-মিটিং-শো-ডাউন করছে; হেলমেট পরে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন দমনে সম্মুখ সমরে অংশ নিচ্ছে; এতে তাদের যথেষ্ট শ্রম দিতে হচ্ছে আর ঘাম ঝরাতে হচ্ছে।
যেহেতু দেশপ্রেম- শ্রমিকের শ্রমের ঘাম শুকিয়ে যাবার আগেই তার শ্রমের মূল্য পরিশোধ করা দেশের কর্তব্য; সুতরাং দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৪-৬ শতাংশ প্রেম-শ্রমবাবদ দেশপ্রেমশ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা।

সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এই দেশপ্রেমশ্রমিকদের দাবী করা জিজিয়া করের বিরোধিতা করে। তারা প্রতিবাদ জারী রাখে। শিক্ষাঙ্গনকে টাকা ভাগাভাগির জুয়াখানায় পরিণত না করতে বার বার অনুরোধ জানায় তারা।

সবুজে ঢাকা-পাখি ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকার গন্ধ হাওয়ায় উড়ে উড়ে চলে আসে ছা-ছপ-ছমুছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের ছাত্র সৈনিকদের কাছে। তারা তো ক্ষেপে টং। কারণ দেশপ্রেমের জন্য অনেক শ্রম আর ঘাম দিতে হয় তাদের। বারো মাসে তেরো আন্দোলন দমাতে এতো স্নায়ুচাপ হয় যে; উন্নয়নের ছাত্রসৈনিক কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিয়েও চিকন ঘাম শুকানো যায় না। এই প্রেমের শ্রমের ঘর্মাক্ত শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা চুকিয়ে দেয়া দেশের কর্তব্য।

সুতরাং দেশপ্রেমিক ছাত্রসৈনিকেরা হাজির হয়ে যায় নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কয়েক ক্রোশ দূরে সবুজে ঢাকা-পাখি ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অমায়িক উপাচার্যের আদরে নিয়মিত ছা-ছপ-ছমুছা খেয়ে অভ্যস্ত তারা। তাদের নিয়ে যাওয়া সমস্ত মামু বাড়ির আবদারের দরখাস্তে উপাচার্য মহোদয় মিষ্টি হেসে স্বাক্ষর করে দেন। সেই মিষ্টতা নেই সবুজে ঢাকা পাখি ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মাঝে। দেশপ্রেম শ্রমিকেরা খালা বাড়ির আবদার জুড়ে দেয়, শুনলাম এখানকার ছাত্রসৈনিকেরা প্রকল্পের ১-২ শতাংশ জিজিয়া কর পাচ্ছে; আমরা আরো বড় মাপের ছাত্র সৈনিক; সুতরাং আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য ৪-৬ শতাংশ জিজিয়া কর দিয়ে দিন।

উপাচার্য কোন কর দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। ছাত্রসৈনিকেরা মাছের বাজারের দর-কষাকষির হৈ চৈ জুড়ে দেয়। উপাচার্য শীর্ষ দুই ছাত্র সৈনিকের জিজিয়া কর দাবি করার ঘটনা মাকামে মাহমুদে জানিয়ে দেন।

সেখান থেকে ওহি ভেসে আসে, শীর্ষ দুই ছাত্র সৈনিককে স্বর্গ হতে বিদায় করা হলো।

ওহি শুনেই স্বর্গচ্যুত দুই ছাত্র সৈনিকের পেছনের ইঞ্চিমত ভাই ও বোনেরা দ্রুত কেটে পড়ে। তারা ফেসবুকে নতুন গদিনশীন হওয়া দুই শীর্ষ সৈনিকের ইঞ্চিমত ভাই ও বোন হয়ে পড়ে। তারা মাতম তোলে, দুধে ধোয়া তুলসি পাতার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।

সাধুগ্রামে ছ্যা ছ্যা রব পড়ে যায় সদ্য সাবেক হওয়া দুই শীর্ষ ছাত্রসৈনিকের দুর্নীতি প্রকাশিত হওয়ায়। সাধুগ্রামে যেহেতু দুর্নীতি ধরা না পড়া পর্যন্ত সবাই তুলসি পাতা; সেহেতু যে জাঢ্য জরদগবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রী মাছের মতো শিকার করে তাদের ছাত্র-সৈনিক বানায়; তারা বেশ আয়েস করে, ছাত্র সৈনিক নামের বিষফলদের দুর্নীতির সমালোচনা করে। বাণী চিরন্তনী খুলে
কতিপয় ছাত্রসৈনিকের সততার ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ঘটনায় ডুকরে ডুকরে কাঁদে। কিন্তু নিজেদের বিষবৃক্ষটির কথা বলে না; যার শাখা প্রশাখায় শোভা পাচ্ছে থোকায় থোকায় বিষফল।

নবাগত গদিনশীন উন্নয়নের ছাত্রসৈনিকদ্বয় ভাবমূর্তি মেরামতের জন্য মাঠে নেমে পড়ে। তাদের নিয়ে ইঞ্চিমতভাই ও বোনেরা মাতম তোলে, দুধে ধোয়া তুলসি পাতার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ