দেড় দিনের শেষে

অজিতেশ নাগ
ছোটগল্প
Bengali
দেড় দিনের শেষে

বাড়ি ঢোকবার আগে আরেকবার মোবাইল চেক করল বুদ্ধ। নাঃ। বৃথা। কোনও ইনকামিং কলের পাত্তা নেই। তবু নিজের কল লগ আরেকবার চেক করে দেখল। সতেরবার। হোয়াটস অ্যাপ খুলে দেখল। এখন অবধি বারোটা মেসেজ করেছে সে। কিছু ডেলিভার্ড, অথচ পড়েনি জয়ী, বিকেলের দিকের গুলো নন-ডেলিভার্ড । তার মানে কি ফোন সুইচড অফ করে রেখেছে? নাঃ। এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে জয়ীর। এমন কোন ঝগড়াঝাঁটি হয় নি বা কথা কাটাকাটি-হাতাহাতি হয় নি যে বুদ্ধর ফোন সে ধরবে না। কি এমন বলেছিল সে? সেই তো কথার মধ্যে কথা ওঠায় কাল বুদ্ধ চেপে ধরেছিল জয়ীকে।

-তোর মতলবটা কি বলত?

ইকনমিক্সের একটা বই জোগাড় করতে পেরেছিলো এদিন জয়ী। অনেকদিন থেকেই তক্কে তক্কে ছিলো। অ্যাডভান্স ইকনমিক্সের উপরে এম এল ঝিনগানের এই এডিশনটা এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লাইব্রেরীতে আছে এককপি। সুতনু সেই যে নিয়েছিলো, তো নিয়েছিলো। সে জমা দিয়েছে খবর পেয়েই দৌড়েছিলো লাইব্রেরীতে। কপাল মন্দ। ঠিক সেইসময়ে বইটা কালেক্ট করছিলো রাজীতা। শেষমেশ রাজীতার সাথে কথা বলে রিকুজিশন জমা দিয়েছিলো। আজ রাজীতার সাথে সাথেই লাইব্রেরীতে এসে বইটা হস্তগত করে তবে শান্তি। মোটা মহাভারতমার্কা বইটা একহাতে সামলাতে সামলাতে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েছিলো বুদ্ধর দিকে,

-কিসের মতলব!

-ন্যাকাচণ্ডী।

-অ্যাই, সাফ সাফ গলা ছাড়। ভ্যান্তারা মারাস না।

-সিধুর সাথে কিসের এত ঢুসঢাস? আমি বুঝিনা।

-সিধু! মানে, সিদ্ধেশ্বরদা। কি যাতা বলছিস?

-যাতা! কালকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আরো অনেকেই দেখেছে। আমায় বলেছিল, আমি বিলিভ করিনি।

-কি দেখলি নিজের চোখে?

ভারি হাসি পেয়ে গিয়েছিলো জয়ীর। সিদ্ধেশ্বরদা তাদের ব্যাচের নয়। মাস্টার ডিগ্রি করছে ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক্সে। এই বুদ্ধটা সত্যিই একটা বুদ্ধু। বুদ্ধদেবকে সে নিজে মাঝে মধ্যে মজা করে বুদ্ধু ডাকে। আর লোক পেলো না! শেষে সিদ্ধেশ্বরদা!

-কাটাস না। আমি নিজে দেখেছি। ফার্স্টে ক্যান্টিনে গায়ে গা ঠেকিয়ে, তারপর তোর স্কুটির পেছনে চড়ে চলে যেতে। তোর না ফিফথ পিরিয়ডে কমনরুমে আসার কথা? আমি ওয়েট করছিলাম। কোথায় গিয়েছিলি? নন্দনের ঝোপে, নাকি, ময়দানের গাছের নিচে?

বেশ মজা পেল জয়ী। এখন একটা জুৎসই জবাব দেওয়া চাই। যাকে বলে জ্বলে পে নমক ছিড়কনা!

-ধুর বোকা। ঐসব ওপেন প্লেসে কেউ যায়? ইউ আর রিয়ালি বুদ্ধু। বুদ্ধুভুতুম।

-ফাক!

হনহন করে বেরিয়ে এসেছিলো বুদ্ধদেব ক্যান্টিন ছেড়ে। জয়ী সামান্য অবাকও হয়েছিলো। সে চেঁচিয়েছিল,

-অ্যাই বুদ্ধু, আই ওয়াজ কিডিং বস। আরে, একটা গুড নিউজ দেওয়ার ছিলো যে।

বুদ্ধর কানে কথাগুলো গিয়েছিলো কিনা মনে হয় নি। অসহ্য রাগে তার মাথা টনটন করছিলো। জয়ী ভেবেছেটা কি? তার সাথে দেড় বছর রিলেশন করে এখন কাটিয়ে দিচ্ছে! তো সেটা স্ট্রেইট বললেই তো পারতো। আর সিদ্ধেশ্বর বোস কি এমন ছেলে। ওটাকে তো ছেলে না বলে লোক বলা উচিৎ। একটা হাভাতে মার্কা চেহারা। কোন ড্রেস-সেন্স নেই। তবে লেখাপড়ায় তুখোড় যেমন, তেমনই পলিটিক্সে তুফান। কলেজ ইলেকশনে সিদ্ধেশ্বর বোসকে হারানো মুশকিল। লোকটার ব্যারিটন ভয়েস। ব্যস। আর কি আছে? আর কি কি দেখে ওর সাথে ঝুলে গেলো জয়ী, ভেবেই কুল করতে পারলো না। একবারও বুদ্ধর দিকটা ভাবল না? শেষে সিদ্ধেশ্বর বোস! যার কাছে লাস্ট ইলেকশনে গো হারা হেরে গেছে বুদ্ধদেব। তখন অবশ্য জয়ী তার পাশেই ছিলো। প্রিন্সেপ ঘাটের আড়াইশো টাকা ঘণ্টার নৌকো-বিহারে জয়ীর আদরে আদরে সেই কষ্ট ভুলে গিয়েছিলো বুদ্ধ। ফের ফিরে এলো হুড়মুড় করে সব। অ্যাদ্দিন অবশ্য সোমঋতা, আবীর, বাসুদেব-রা কানে কানে এসে বলে গিয়েছিলো, ‘বস সামলে’। কান দেয় নি বুদ্ধ। তাই বলে সিদ্ধেশ্বর! মাস সাতেক আগেই কি অ্যাকিউট ইনফ্লুয়েঞ্জার পাল্লায় পরেছিল জয়ী, বুদ্ধ সারাদিন-রাত জেগে তাকে সারিয়ে না তুললে, বেরিয়ে যেত প্রেম করা সিধুর সাথে! যত্তসব!!

প্রায় সারা রাত জেগেই ছিলো সে। একটু বেশী রাতের দিকে বার পাঁচেক জয়ীর ফোন আসে। বুদ্ধ ধরে নি। সকালে অবশ্য মাথাটা ঠান্ডা হয়ে আসে। মাথা গরম করে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় আজ একবার বোঝাতে হবে জয়ীকে। বুঝলে ওরই ভালো, না বুঝলে ফোট!

কলেজে গিয়ে দেখলো আজ জয়ী অ্যাবসেন্ট। সেই সাথে সিধুর বাচ্চাও! রাগবে না ভেবেও ফের মটকা গরম হয়ে গেলো। নাঃ! একটা এস্পার ওস্পার দরকার। দুপুরে বি.কে.এমের ক্লাশ শেষ হতেই ফোন লাগালো জয়ীকে। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেলো। এর পরে মোট সতেরবার কল আর বারোটা হোয়াটস অ্যাপ। জয়ী রেসপন্স করে নি। ডিনারের আগে তৃষার মেসেজ পেলো, ‘কেমন আছ? আজ নীল শার্টে তোমাকে একঘর লাগছিলো গো’। তৃষা তারই ব্যাচমেট। বহুবার বুদ্ধর কাছ ঘেঁষতে চেয়েছে, বুদ্ধ পাত্তা দেয় নি। সে জয়ী ছাড়া আর কারো কথা ভাবতেও চায় না। এই প্রথম সে তৃষার মেসেজের জবাব দিলো, ‘ঘুম পাচ্ছে, কাল কলেজ বাঙ্ক করছি। ভালো লাগছে না। বকখালি যাচ্ছি, তুমি যাবে?’ খানিক পরেই একটা স্মাইলি এলো তৃষার মোবাইল থেকে।

গল্পটার আরেকটু বাকি।

আজ জয়ীর ইন্টারভিউ ছিলো পৈলানের কাছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। গত সোমবার ডাকে এসেছে কানাডা-বেসড এই কোম্পানিটা থেকে। সিলেক্ট হলে হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে কাজ করতে তাকে চলে যেতে হবে হায়াদ্রাবাদ। যদিও হাতে সময় আছে এখনো মাস পাঁচেক। হায়াদ্রাবাদে আট মাসের প্রবেশনারি। এই আট মাস মাথা তোলার সময় পাবে না সব সিলেক্টেড ক্যান্ডিডেটরাই। তবে আট মাস পরে যে পরীক্ষাটা হবে, তাতে পাশ করলে প্রথম পোস্টিংই কানাডায়। উফফ! ভাবতেই শিহরণ জাগছিলো। কাল বুদ্ধুভুতুমকে সেই খবরটাই জানাতে চেয়েছিলো জয়ী। মাঝখান থেকে কি সব ফালতু ম্যাটারে মাথা গরম করে ফেললো ছেলেটা। রাতে ফোন করে খবরটা অ্যাটলিস্ট দিতে চেয়েছিলো, ইডিয়টটা ফোন ধরল না। ইন্টারভিউ দিয়ে খুশী খুশী মনে স্কুটিতে বেহালা পাঠকপাড়ায় ফিরে আসছিলো সে। থেকে থেকেই টের পাচ্ছিল পকেটটা ভাইব্রেট হচ্ছে। নিশ্চয় বুদ্ধুটা। নিশ্চয়ই ব্যাটা ভুল বুঝতে পেরে ফোন করছে। বুদ্ধুটা ঐরকমই। এই শান্ত, এই উগ্রমূর্তি। বারংবার পকেট কেঁপে ওঠায় বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে স্কুটি দাঁড় করিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল জয়ী। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সামনের বাম্পারে একটা ট্রাক লাফিয়ে উঠল। বোধহয় বাম্পারটা দেখতে পায় নি। আর লাফিয়ে উঠেই নিয়ন্ত্রণ হারালো।

জয়ীর স্কুটিটা একদলা যন্ত্রাংশে পরিণত হয়ে পরে থাকলো রাস্তার পাশেই। জয়ীর দেহটা ততক্ষণে দলা পাকিয়ে নিচের বাদায়। মিনিট দশেকের মধ্যে নানান লোকের ছায়ায় রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। আর মোবাইলটা লোকচক্ষুর আড়ালে ভাইব্রেট হতে হতে নিভে আসছিলো, ক্রমশঃ।

অজিতেশ নাগ। কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ভারতের উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। সাহিত্যের অন্দরমহলে ঘোরাঘুরি আজ প্রায় তিন দশক। সিগনেট, প্রতিভাসসহ মোট দশটি প্রকাশনী থেকে কবিতার বই আর তিনটি প্রকাশিত উপন্যাস। নিয়মিত লেখা দেশ, কৃত্তিবাস, রেওয়া, কবিতাআশ্রম, ভাষানগর ইত্যাদি বহু পত্রপত্রিকায়। সোপান সাহিত্য সম্মানসহ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ