দৌড়

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
দৌড়

এণাক্ষী ক্লিপ দিয়ে চুলটা টেনে উঁচু করে বাঁধলো। কোনোভাবেই যাতে চুল খুলে চোখে মুখে এসে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো কয়েকবার। ভিতরে টাইট গেঞ্জি আর স্ল্যাকস্ পরাই ছিলো। ওপরের সালোয়ার কামিজটা খুলে লাইনের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসলো। স্টার্টিং পয়েন্টে দশজন প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে আছে। ফিনিশিং পয়েন্টে তিনজন বিচারক চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। তাদের সামনের টেবিলে দরকারী কাগজপত্র। সময় দেখার জন্য টাইমার হাতে দুজন। বাঁশি বাজতেই দশজন দৌড় শুরু করলো। এণাক্ষীর চোখ মেয়েগুলোর বুকের দিকে আটকে গেলো। কাঁটা বেঁধার মতো গতকাল সন্ধ্যার ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। টাইট গেঞ্জি আর ছোট স্ল্যাকস্ এর জন্য পিসির বাড়ী গিয়েছিলো এণা। পিসির মেয়ে ডলি ওসবই পরে ঘরে। এণারও ছিলো দুটো কিন্তু সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। গেঞ্জি আর স্ল্যাকস্ তো পাওয়া গেলো কিন্তু পিসির মস্করাটা তখন থেকে বিঁধে রইলো।যদিও পিসির বকবকানি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে এণার। দীপাঞ্জনকে নিয়ে পিসি যে প্রায়ই একথা সেকথা বলে এণা তা জানে। এই তো সেদিন। মাকে পিসি বলছিলো,

” রেজিস্ট্রি যখন হয়ে গেছে সিঁদুরটা দিয়ে দিচ্ছোনা কেনো গো বৌদি, দুজনে ঘুরছে ফিরছে, পাঁচজনে দেখবে পাঁচকথা বলবে, লোকের নজর বলে কথা, সিঁদুরটা দিয়ে দিলেই তো পারো। নাহয় মন্দিরে গিয়েই দিয়ে দাও, অনুষ্ঠান করতে হবেনা। “

“হ্যাঁ গো দেখছি “।

এণার মা পাশ কাটিয়ে যায়।কিন্তু পিসির ঘ্যানঘ্যানানি থামেনা।

” আসলে লোকে তো বুঝবে না রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, কি থেকে কি রটে, আজকালকার ছেলেমেয়ে সব, পরে যদি আবার বিয়ে করবেনা বলে, কি যাতা ব্যাপার হবে বলতো।”

“আসলে আমাদের সামর্থ্য মতো ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করেই দেওয়ার ইচ্ছে আছে গো। একমাত্র মেয়ে আমাদের।”

ডলি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলো। এবার এণার দিকে তাকিয়ে বললো,

“জানিস সেদিন ঝুম্পা তোদের দেখেছিলো, আর আমাকে কোচিনে সবার সামনে বলেছে, তোর দিদিকে দেখলাম পার্ক থেকে একটা ছেলের সাথে বেরোচ্ছে, কালো করে লম্বা মতন একটা ছেলে, হ্যাঁ রে ওই ছেলেটার সাথেই আছে বুঝি? “

এণা হেসে বলে,

“বললেই পারতিস ওই ছেলেটার সাথেই আছে, আর ওটার সাথেই বিয়ে হবে, তাহলেই তো ঝামেলা খতম হতো।”

“ঝামেলা খতম হবে কেনো “

ডলি বলতে শুরু করে,

“ওই কথা বলেই তো ফেঁসে গেলাম, বাব্বা কত কথা, ছেলেটা কি করে, তোর দিদির পড়া শেষ তাহলে বিয়ে করছেনা কেন, আরও কতো কি। “

“আমি চাকরী না করে বিয়ে করছিনা।”

মুখ খোলে এণা,

” দীপও তাই চায়।”

এবার পিসি সুর টানে,

“চাকরী কি অতো সহজ রে যে চাইলেই পাবি, অবশ্য তোর আবার রেজাল্ট ভালো, দ্যাখ কবে হয়। “

“দু চার বছর চেষ্টা তো করাই যায় পিসি।”

জবাব দেয় এণা,

“এই তো সবে দুমাস হলো গ্র্যাজুয়েট পাশ করলাম, দেখি না ক’বছর, তারপর না হয়… “

সেদিন বাবা চলে আসাতে আলোচনায় ভাঁটা পড়েছিলো। নাহলে আরও কতক্ষণ এণার বিয়ের চুইংগাম চিবোনো হতো কে জানে।

স্পিডে দৌড়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে দেখতে দেখতে গতকাল পিসির বিচ্ছিরি রকম ইঙ্গিতটা বারবার মনে পড়ছিলো। বারবার কথাগুলো তাকে নারীসুলভ লজ্জা জড়তায় বোতলবন্দী করে ফেলছে। এর আগে এণা স্কুল কলেজে কতো দৌড়েছে। পাড়াতেও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এরম কখনো মনে হয়নি। ধুর পিসিটার কথার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কি সব যে বলে। কাল যখন এণা ডলির গেঞ্জি স্ল্যাকস্ নিয়ে ব্যাগে ভরছে পাশ থেকে পিসি বকবক করে যাচ্ছে,

” এসব করে কি করবি, সেই তো খুন্তিই নাড়বি, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ী যা গে, কতদিন আর বাপেরবাড়ী থাকবি। “

“আসলে পিসি বাবা মায়ের জন্যই তো চাকরীটা পেতে চাইছি, ওই তো সামান্য কলের মিস্ত্রীর কাজ, জানোই তো, মাঝে মাঝে যে দুচারটা বড় কন্টাক্ট ধরে তাতেই যা একটু বেশী টাকা পায়, আর কতদিন ভাড়া বাড়ীতে থাকবে বলতো, বয়স হলে বাবা তখন কিকরে রোজগার করবে গো।”

আস্তে আস্তে বলে এণা,

“চাকরী পেলে একটা বাড়ী করবো বাবা মার জন্য, আর বুড়ো বয়সে কিছু টাকাও দিতে পারবো তাই চেষ্টা করছি। “

“তাহলে আর কি, দৌড় গে যা ।”

বলে ওঠে পিসি,

“ওই সব টাইট গেঞ্জি পরে দৌড়বি আর বুকগুলো সব নাচবে আর সামনে বসে থাকা অফিসার গুলো তাই দেখবে বুঝলি। “

এই কথা বলেই পিসি খিকখিক করে হেসে গড়িয়ে পড়লো।মাকে দেখে ডলিরও হাসি উথলে উঠলো। পিসির ভঙ্গী দেখে এণাও হেসে ফেলেছিলো। কিন্তু মনে মনে একটু কষ্টই পেয়েছিলো। পিসিতো একটু উৎসাহ দিতে পারে।তা না করে ভুলভাল বলছে। এণা কিছু না বলে বাইরে এলো। বাইরে আসতেই পাশের বাড়ীর টুসি বৌদির সাথে দেখা।

“কি রে এণা কখন এলি? “

“এই তো বৌদি অনেকক্ষণ, ভালো আছো তো।”

“ও দুপুরে এসেছে গো। “

পাশ থেকে পিসি বলে,

” কাল কি সব চাকরীর পরীক্ষা আছে ইলেকট্রিক অফিসের মাঠে, দৌড়তে হবে, তাই ডলির গেঞ্জি স্ল্যাকস্ নিতে এসেছিলো। “

“ওমা তাই নাকি, খুব ভালো তো, তোর এতো ভালো রেজাল্ট, চেষ্টা কর হয়ে যাবে।”

টুসি বৌদি বলে। এণা কিছু বলার আগেই পিসি বলে ওঠে,

“আমি তো বললাম ওই সব গেঞ্জি পরে দৌড়বি, সামনে সব অফিসাররা থাকবে, বুক গুলো লাফাবে আর ওরা দেখবে। “

দুহাত দিয়ে বুক লাফানোর ভঙ্গি করে পিসি হাসতে থাকে। টুসি বৌদি বলে,

“কেনো দিদি ওসব বলছো, ও একটা মনস্থির করে দৌড়বে, এসব মাথায় এলে স্পিড ব্রেক করবে, না রে এণা, তুই তো দৌড়ে প্রাইজ পেয়েছিস, মন দিয়ে দৌড়, ঠিক পারবি। “

এণা চুপ করে বেরিয়ে এলেও মনটা খারাপ হয়ে যায়। অদ্ভুতভাবে তখন থেকেই নিজের বুকের দিকে মন চলে যাচ্ছে। কতবার কত জায়গায় কত লোকের সামনে দৌড়েছে। কখনো এরম উৎটক ভাবনা মাথায় আসেনি তার। বাড়ী ফেরার পথে দীপাঞ্জন দাঁড়িয়ে ছিলো। বিস্কুট চকলেট আর বাদামভাজার প্যাকেটটা দিয়ে বললো,

” এগুলো কাল নিয়ে যাস, খিদে পেলে খাস, এই চকলেটটা খেতে খেতে আমার চকলেটি কিসুগুলোর কথা ভাবিস, আলাদা এনার্জী পাবি বুঝলি। “

এণা হাসলো। মনটা এতক্ষণে ভালো হলো। কথা বলতে বলতে পিসির ভুলভাল তামশার কথাও বললো। দীপাঞ্জন ধমক দিয়ে বললো,

এ্যাই তোর ওই আঁতেলমার্কা পিসিটার কথা একদম আমার কানে দিবিনাতো, আর ডলিটাও তেমনি,কোন একস্ট্রা নলেজ নেই, পাশ করে বিয়ের পাত্রী তৈরি হচ্ছে, শোন এণা তোর বুক আছে তাই লাফাবে আর অফিসারের চোখ আছে তাই দেখবে, তাতে তোর কি রে ? তোর একটাই কাজ, কাকু কাকীমাকে সেফটি দেওয়া ব্যাস, শোন আমি কথা বলে রেখেছি, তোর কত ভালো রেজাল্ট, দৌড়টা টাইমে কমপ্লিট করলেই তোকে কেউ আটকাতে পারবেনা বুঝলি, যা তো বাড়ি গিয়ে খেয়ে টানা ঘুম দে, ঘুমের ঘোরে আবার স্বপ্ন দেখিসনা তোর বুক লাফাচ্ছে, গাঁট্টা খাবি বুঝলি। “

দীপাঞ্জনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এণা স্টার্টিং পয়েন্টে এসে দাঁড়ালো। বাবা মায়ের মাথার ওপর ছাদ চাই একটা। এণা চোয়াল শক্ত করে দৌড় শুরু করার প্রস্তুতি নিলো। বাঁশি বাজতেই ছিটকে বেরোলো এণা। ফিনিশিং পয়েন্টে এসে বুঝলো সে পেরেছে। যখন তার নাম লেখা হচ্ছে তখন চোখের জল কোনরকমে সামলাচ্ছে এণা। দীপ বলেছে কথা বলে রেখেছে। এণা কি তাহলে সত্যিই পারলো বাবা মায়ের পাশে দাঁড়াতে।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একদিন সন্ধ্যায় এণাদের বাড়ীতে পিসি এসে হাজির।কদিন থেকেই কথাটা শুনছে এণা। বাবাকে একদিন পিসি ডেকেও পাঠিয়েছিলো। আজ একেবারে ডলির বিয়ের নেমতন্নের কার্ড নিয়ে হাজির।

“বুঝলে বৌদি এতভালো সম্বন্ধ পেয়ে আর হাতছাড়া করলামনা, তিনতলা বাড়ী, একমাত্র ছেলে, কোন ঝামেলা নেই রোজগারও ভালো, গ্র্যাজুয়েশনটা আর এক বছর বাকি ছিলো, কিন্তু কি হবে বলো আর, ভালো জায়গায় একটা বিয়ে হয়ে গেলেই শান্তি বুঝলে।”

পিসি তখন থেকে বকেই চলেছে,

” তোরা যে কবে বিয়ে করবি, চাকরী তো পেলি এবার আর কি চাই রে, দুজনেই সরকারী চাকরী, এবার বিয়েটা কর। “

“আসলে পিসি একটা ফ্ল্যাটের খোঁজে আছি, দীপেরও ইচ্ছে আমাদের নিজেদের বাড়ীতে বিয়েটা হোক। “

“কি জানি বাবা, তোমরাও কি নিশ্চিন্তে আছো বৌদি, আমাদের মেয়ে এরম আধা বিয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ালে ঘুমই উড়ে যেতো, আরে ওসব তো বিয়ের পরেও করতে পারবি নাকি। “

ডলির বিয়েতে যথারীতি খুব মজা হলো। এণা অফিস থেকে তিনদিন ছুটি নিয়েছিলো। দীপাঞ্জনদের বাড়ীতেও নেমতন্ন পৌঁছে ছিলো। ভাই বোন বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে খুব হুল্লোড়। এরই মাঝে দীপ আর এণাকে একটু আড়ালে দেখে পিসি বলে,

“আড়ালে খালি গুজগুজ ফুসফুস করলেই হবে? যা না দুজনে বিয়েটা সেরে হানিমুনে যা। “

এণা কিছু বলার আগেই দীপ বলে,

“আসলে পিসি এণার দৌড়টা এখনো শেষ হয়নি গো, দৌড়টা শেষ হলেই বিয়েটা সেরে ফেলবো। “

পিসি কিছু না বুঝে বলে,

“সে বাপু তোমরা দৌড়াদৌড়ি যা খুশি করোগে, আমার ডলিটা পার হলো বাব্বা নিশ্চিন্তি। “

বছর তিনেক পর এক ফাল্গুনী সন্ধ্যায় এণাদের নতুন ফ্ল্যাট সানাইয়ের সুরে ভরে উঠেছে। এণার বাবা নিজের সামর্থ্য মতো জনা কয়েক আত্মীয় ও চেনা পরিচিতকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন।ভাইবোন আর বন্ধুদের মজা খুনসুটির মাঝে এণা লক্ষী কনে বৌ সেজে বসে আছে। সবার মাঝে ডলিও তার বছর দুয়েকের বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। বাচ্চা নিয়ে সে একাই এসেছে বিয়েতে।বর সাথে আসেনি। আসবে কিনা জানার ইচ্ছেটাও তার এখন নেই। শ্বশুরবাড়ী ফেরার ইচ্ছেটাও হারিয়ে গেছে। বিয়ের পর স্বাদ বদল করতে তার বর তার কাছে আসতো এটা ডলি এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারে।কানাঘুসো অনেক কথাই সে শুনতে পায়। বরের চরিত্রটি যে বহু নারী বেষ্টিত তা ভালোই বোঝে ডলি। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীর আর ঘর সংসারের দেখাশোনা করা ছাড়া আর কোন অস্তিত্ব তার আজ নেই। শ্বশুরের টাকাতেই সব চলে। এই তিনবছরে বরের টাকা সে চোখেই দেখেনি। জীবনটা তার পচা ডোবার জলে আটকে গেছে।

যথাসময়ে উলুধ্বনি মালাবদল মন্ত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে বিয়ে হলো। যজ্ঞের আগুনে খই দিতে দিতে দীপাঞ্জন এণার কানে কানে বলে উঠলো,

“তোর একার দৌড়টা শেষ হলো বুঝলি, এবার আমাদের দুজনের দৌড় শুরু। “

“একা কোথায় দৌড়লাম রে, তুই বাবা মা সবাই তো ছিলি সাথে, নইলে কি পারতাম। “

এণার চোখ ভিজে যায়।জীবনের পরম বন্ধুকে পাশে পেয়ে।

এণার মায়ের পাশে বসে বিয়ে দেখছিলো পিসি। মনে মনে ভাবছিলো সেই নাইন থেকে ছেলেটার সাথে চরে বেরিয়ে ভালোই সব গুছিয়ে নিলো। আমার ডলিটাকে এতো তাড়াহুড়ো না করলেই পারতাম।গ্র্যাজুয়েশনটাও শেষ হলোনা। মেয়েটার শুকনো মুখটার দিকে আর তাকানো যায়না।

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ