দ্বিতীয় জন্ম

রুদ্র অয়ন
ছোটগল্প
Bengali
দ্বিতীয় জন্ম

 

পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে বন্ধ ফোনটা অন করে সময়টা একবার দেখে নিলো তারপর পুনরায় ফোন অফ করে দিলো রোদ্দুর। রাত এগারোটা বাজতে এখনো ১০ মিনিট বাকি । এগারোটার দিকে আন্তঃনগর ট্রেন যাবে । আজ রোদ্দুরের জীবনের শেষ দিন । আবার রাত বারোটার পর তার জন্ম দিন । রোদ্দুর ভাবছে, কেউ মুল্য দিলো না। বাবা বুঝে না। মা সারাদিন ভুল ধরতে থাকে।
কোন কাজ বা চাকুরির জন্যে কেউ সাহায্য করে না । সবাই শুধু উপদেশ দেয় ।
জীবনের চেয়েও যাকে বেশি ভালোবাসে সেও কিনা বলে, কোন বেকার ছেলে কে বিয়ে করবে না! কেন করবে না? প্রেম করার সময় তো রোদ্দুর বেকারই ছিলো । মানুষ তো একটা কিছু নিয়ে বাঁচে। ভালোবাসার মানুষটাও যদি একটু ভালো আচরণ, ভালো ব্যবহার করতো তবু মনটাকে বোঝানো যেতো । রোদ্দুর রেল লাইনের ওপর শুয়ে আছে। মানিব্যাগটা বের করে শেষ পর্যন্ত আর একবার ভালোবাসার মানুষটার ছবি দেখে নিলো । মনে হচ্ছিলো ছবির মানুষটা তার দিকে চেয়ে ছলনার হাঁসি হাঁসছে । খুব ইচ্ছা ছিলো যদি কিছু টাকা থাকতো তাহালে জন্ম দিনের সন্ধ্যাটা তার সাথে কাটানো যেতো। কেন এতো কিছু ভাবছে রোদ্দুর! রোদ্দুরের তো কারো কথা ভাববার না। নিজের প্রতি খুব রাগ হচ্ছে রোদ্দুরের! নিজেকে প্রশ্ন করছে, আমি কি কোন মানুষ! আমার কি মূল্য আছে?

রেল গাড়ির অপেক্ষা করছে রোদ্দুর। এটাই তার জীবনের শেষ রাত । এই মায়ার পৃথিবীতে কোন মূল্য নেই তার।
আকাশ পানে চেয়ে মেঘমুক্ত জোছনাস্নাত আকাশ দেখছে সে! আর কয়েক মিনিট পর হয়তো আর কেউ কোন দিন তাকে ভুল বুঝবে না । একমাত্র মৃত্যু মানুষকে পৃথিবীর সব দুঃখ থেকে মুক্তি দেয় ।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ট্রেন আসছে । রোদ্দুর রেল লাইনের মাঝ দিয়ে হাটে । মনে হলো একজন রমণী এগিয়ে আসছে। রোদ্দুর ওঠে দাঁড়ালো । আবার ফোনটা অন করে সময় দেখে নেয় সে। তারপর আবার অফ করে দেয়।
রাত এগারোটা বেজে ৫ মিনিট । এ কি মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে! রোদ্দুর এবার শুয়ে পরলো রেল লাইনের ওপরে । ট্রেন কাছাকাছি আসতেই মেয়েটা দৌড়ে রোদ্দুরের কাছে এসে রোদ্দুরকে জোর করে হাত ধরে টান দিয়ে রেল লাইনের পাশে সরিয়ে নিয়ে যায় ।
উদ্বিগ্ন স্বরে বলে : কি ব্যাপার মিস্টার, মরবেন নাকি ?
– হ্যা মরতে চাই । কেন আমার হাত ধরে টান দিলেন? আমি তো আপনাকে বাঁচাতে বলি নাই ?
: কেউ কাউকে বাঁচায় না ! হয়তো আপনার আরও কিছু কাজ বাকি আছে দুনিয়ায় তাই বেঁচে গেলেন ।
– এটা আবার কি ধরণের কথা? আমার আবার কোন মুল্য আছে নাকি ? আর এই দুনিয়ায় আমি একটা অপদার্থ । যার কোন মুল্য নাই ।
: বাহ দারুন তো । তা কে বলেছে আপনার মুল্য নাই?
– আপনাকে বলে কি হবে? আপনি কি করে বুঝবেন মনের কষ্ট!
: মনের কষ্ট বুঝে লাভ নাই । মন দিয়ে কি এক বেলার খাবার আসে ? মনকে কাজের মধ্যে রাখুন । মনকে যদি অপাত্রে দান করেন তাহালে তো মরতে হবে ।
– আপনি কে যে আমাকে এতো উপদেশ দিচ্ছেন?
: আমি যেই হই, আপনি কিন্তু সকাল আটটা পর্যন্ত আর মরতে পারছেন না। কারন আটটার আগে কোন ট্রেন নেই । এখন বরং আমার সাথে চলুন । ঐ একটু সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। দারুন চা বানায় । রাহুল কাকুর চা । ভীষণ মজা।
রোদ্দুর মেয়েটার দিকে তাকায় । মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী। কিন্তু এতো রাতে বাইরে থাকা, রেল লাইনের কাছে হাটাচলা করা এই মেয়েটা আসলে কে ?
রোদ্দুর ভাবতে থাকে, মেয়েটা কেন বাঁচালো আমাকে!
রোদ্দুর আবার মেয়েটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে এক নজর দেখলো । চাঁদের আলোতে ওকে ভালোই দেখাচ্ছে । আর কথাও বলে খুব সুন্দর করে ।
রোদ্দুর বললো : কেন মরতে চাইলাম জানতে চাইলেন না? মেয়েটা একটু চোখ বাকা করে বললো : দেখুন মানুষ কেন মরতে চায় এটা আমি ভালো করে জানি ।
রোদ্দুর আবার প্রশ্ন করলো : কীভাবে জানেন ?
মেয়েটা বললো : এই যে আমাকে দেখছেন আর ভাবছেন এতো রাতে একটা মেয়ে রেল লাইন দিয়ে হেটে আসছে নিশ্চয় মেয়েটা কোন খারাপ মেয়ে ।
আপনি ভাবতে পারেন এটা স্বাভাবিক । কিন্তু দেখুন সমাজে আমরা না জেনে অনেকের ব্যাপারে অনেক মন্তব্য করে বসি, অনেক কিছু ভেবে বসি! একটা পুরুষ মানুষ রাতবিরেতে একা যেতে আসতে পারে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু একজন মেয়ে রাতে একা বের হলে তার বেলায় যতো সমস্যা, যতো বাজে মন্তব্য! এই দৃষ্টি ভঙ্গীর পরিবর্তন দরকার।
রোদ্দুর আর একবার আকাশ টা দেখলো আর মেয়েটার দিকেও তাকালো।
মেয়েটি মৃদু হেঁসে বললো : মেয়েদের দিকে আঁড়চোখে দেখতে নেই।
রোদ্দুর এবার একটু হাসলো। হাটতে হাটতে রাহুল কাকু’র চায়ের দোকানে সামনে চলে এলো ওরা।
দোকানে প্রবেশ করে মেয়েটি বললো : আদাব কাকু ।
দোকানদার রাহুল কাকু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো : আদাব। আরে আম্মাজান!
ষাটোর্ধ বছরের বুড়ো মানুষ কি সুন্দর করে ‘আম্মাজান’ বলে ডাকলো ।
রাহুল কাকু বলে : কারে নিয়া আইছেন আম্মাজান?

আর বলবেন না কাকু, ওর নাম জানা হয় নাই!

রোদ্দুর নিজে থেকে বললো : আমার নাম শেখ রোদ্দুর ।
রাহুল কাকু চা হাতে বললো : নেন চা খান । আজ তেমন কোন কাস্টমার নাই । আপনি প্রথম আসলেন । তাও দেবী মায়ের সাথে ।
দেবী মা মানে ? প্রশ্ন করলো রোদ্দুর।
মেয়েটা বললো : রাহুল কাকু আমাকে শখ করে দেবী মা ডাকে ।
‘তা আপনার কোন নাম নাই দেবী।’ প্রশ্ন করলো রোদ্দুর।
মেয়েটি বললো : ইচ্ছে হলে পছন্দ মতো নাম দিয়ে ডাকতে পারেন । আপনি একটা নাম দিতে পারেন ।
রোদ্দুর একটু অবাক হয়ে বললো : এই পথের জীবনের মানুষদের মতো কথা বলছেন কেন?
মেয়েটা বললো : দেখুন রোদ্দুর সাহেব, এই পথের মাঝে জীবনের সব অভিজ্ঞতা রয়েছে । কতো মানুষের সুখ দুঃখ এই পথ । রাস্তা আর নদী মানুষের জীবনে মিশে আছে । তবে নদীর পার ভাঙ্গে আর রাস্তা গুলো মানুষ তার সুবিধার জন্য ভাঙ্গে ।
রোদ্দুর মেয়েটার যুক্তির কাছে পেরে ওঠছেনা ।
মেয়েটা এবার বললো : এই যে আপনি মরতে যাচ্ছিলেন কারন আপনার কোন পিছু টান নাই মনে হয় । যে মা আপনাকে কষ্ট করে জন্ম দিলো এতো বড় করলো তার একটু মান অভিমান আপনার ভালো লাগে না! যে বাবা আপনাকে লালন পালন করে বড় করলো তাঁর শাসন আপনার ভালো লাগে না! আর আপনি যাকে ভালোবাসেন সে আপনাকে মূল্য দেয় না। এটা কি আপনার ব্যর্থতা না ? তাহলে আপনি তাদের মূল আশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন । কোন নিয়মের মধ্য আসতে পারছেন না!
রোদ্দুর অবাক হয়ে বললো : আমার মনের কথা আপনি কি করে জানলেন?
মেয়েটি বললো : বললাম না এই যে পথ। পথ আমাকে জীবনের সব কিছু দিয়েছে । দেখুন আমি একসময় একটা ছেলে কে ভালোবাসতাম । আমার বড় বোন একটা ছেলে কে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত আমার বাবা পেনসনের টাকা দিয়েও সেই ছেলেকে বোনের জন্য রাখতে পারে নাই । একদিন আমার বোন মারা যায় সেই নেশাগ্রস্থ ছেলের হাত থেকে বাঁচতে । আপনি হয়তো বেকার, মনে অনেক দুঃখ!দেখুন, রাস্তায় বের হলে দেখবেন মানুষ কতো রকমের কাজ করছে । আসলে কাজ করার মতো মনে সাহস থাকতে হবে।
একটুক্ষণ থেমে মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো : আর এই আমি, বাবা মারা যাওয়ার পর । আমার ভালোবাসার মানুষটি আমাকে দেখালো এক নতুন স্বপ্ন । আমি হয়ে গেলাম ওর ওপরে ওঠার শিড়ি । আমাকে দিয়ে হাতিয়ে নিলো একের পর এক টেন্ডার । আমি হয়ে গেলাম ওর কাজ পাওয়ার একমাত্র স্বর্ণকমল । ওর জন্যে এই সমাজের নামি দামি মানুষের কাছে আমাকে বিছানায় যেতে হয়েছে । যার জন্য এতো কিছু করলাম শেষটাই সে বলে, বেশ্যা শুধু আনন্দের জিনিস! এটা কেউ সংসারে রাখে না।
একটুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটি আবার বলতে লাগলো : আসলে মেয়েরা বেশ্যা হয়না, কিছু অসভ্য জানোয়ার পুরুষই মেয়েদের বেশ্যা বানায়। মা খুব অসুস্থ । ছোট বোন ক্লাস টেন এ পরে । মাত্র অনার্স পাশ করেছিলাম। চাকুরির আশায় অনেক ছুটাছুটি করে যে কয়টা চাকুরিতেই জয়েন করেছি সেখানেও হেনস্থা হয়রানির স্বীকার শুধুমাত্র মেয়ে মানুষ বলে! তখন টাকার খুব দরকার! মা, বোনকে নিয়ে আমি এই শহরে চলে আসি। প্রথমে কয়েকটা ষ্টুডেন্ট যোগার করে টিউশনি শুরু করি। এখন ১০০’র ওপরে ষ্টুডেন্ট নিয়ে একটা কোচিং সেন্টার চালাই। কম্পিউটারে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংএর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণও নিয়েছি এবং ছোট বোনকেও তা শেখাই, এখন আমরা বাসায় বসে কম্পিউটারে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংএর কাজ করে রোজগারও করি। এখানে কিছু জায়গা জমিও কিনেছি। এইযে আমার জীবনে এতো কিছু, এতো বৈরি সময় চলে গেছে। রোদ্দুর সাহেব কি আমার সেই সব খারাপ সময়ের চেয়েও খারাপ আছে যে মরতে চেয়েছিলো?
রোদ্দুর মনে মনে ভাবলো , আসলেই তো সেই রকম খারাপ সময় বা সেই রকম কোন দুঃখ নেই। এখন যে সে বেঁচে আছে সবটাই এই মেয়ের অবদান ।
রোদ্দুর মেয়েটাকে বললো : আমাকে বাঁচিয়ে কি লাভ হলো?
মেয়েটি বললো : আমি তো আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসি নাই যে সব কিছুতেই লাভ খুঁজবো !
রোদ্দুর একটু দ্বিধা করেও শেষ অবধি বললো : তা আমি কি আপনাকে ‘তুমি’ করে বলতে পারি ।
মেয়েটি মৃদু হেসে বললো : তা বলতে পারেন । মাঝে মধ্য মাথাটা ধরলে বের হই রাতে শুধু রাহুল কাকু’র চা খাবার জন্যে । যে রাস্তা দিয়ে হেটে এলাম তার একটু সামনেই আমার বাসা।
রোদ্দুর বলে, ‘জানেন আজ আমার জন্ম দিন ।’
অবাক কণ্ঠে মেয়েটি বলে, ‘কি বলছো তুমি! এই দিনে তুমি মরতে আসছো? জানো তুমি, একটা বেবি জন্ম দিতে একজন মায়ের কতো কষ্ট ।’
রোদ্দুর নরম স্বরে বলে, ‘আসলেই আমি ভুল করেছি । কিন্তু কি করবো? আমার কিছু করার ছিলোনা । না কোন চাকুরি, না কোন ব্যবসা । প্রেমিকা, সেও আমাকে বিয়ে করবে না। কারন তার ফিউচার নষ্ট করতে চায় না ।’
মেয়েটি বলে, ‘দেখো রোদ্দুর, ঐ মেয়ে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে না, সে তার ফিউচার কে ভালোবাসে । কারন ফিউচার মানে হলো অনেক টাকা । কিন্তু জানো, কেউ আমরা ফিউচার দেখি না । শুধু
আগ বাড়িয়ে চিন্তা করি । যায়হোক, তোমাকে যে মূল্যায়ন করে না, তুমি তাকে অবমুল্যায়ন না করে বরং রাস্তা বদল করে নাও । সময় বলে দিবে কোন রাস্তা কোথায় যায় ।’
রোদ্দুর কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো : কিন্তু আমি করবোটা কি? এতো আপমান আমার ভালো লাগে না ।
মেয়েটি বলে : দেখো, যে তোমাকে আপমান করে সে তোমার ভালো চায় । আমার কথা হয়তো তুমি শুনবে না, বুঝবে না! আজকের এই রাত টা তোমার জীবনে অনেক কিছু বদলে দিবে । তোমার জীবনে হয়তো তোমার ভালো কিছু এনে দিবে ।
রোদ্দুর বললো : আমি জানতে পারি কি ভাবে?
মেয়েটি বলে : মনের মধ্যে শক্তি আছে তোমার । কারন তুমি নিজে নিজে মরতে চেয়েছিলে । এটা কম সাহসের কথা না। এই সাহসকে নিজের উন্নতির কাজে লাগাও । আমার দিকে দেখো। আমি দেখতে অনেক সুন্দর । খুব ভালো করে কথা বলতে পারি কিন্তু আমি পুরুষ মানুষ না । আমি যার সাথে গত ৭ বছর ছিলাম তার কাছ থেকে আমি তো অনেক কিছু শিখেছি । আমার মেধা কে তোমার কোনও কাজে লাগাও ।
রোদ্দুর অবাক হলো ওর কথা শুনে । মেয়েটার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি ।
মেয়েটি চায়ের বিল দিয়ে রোদ্দুর কে বললো : রোদ্দুর তুমি অবশ্যই মায়ের কাছে ফিরে যাও । আর কাল আমাকে ফোন দিবে । টাকা আমি দিবো তুমি শুধু শ্রম দিবে । যদি বিশ্বাস করো তাহালেই কিন্তু ফোন দিয়ো।
ওর ফোন নাম্বার দেয় রোদ্দুরকে।
ভোর পাঁচটায় বাসার সামনে আসতেই রোদ্দুরের মা চিৎকার দিয়ে বললো : বাবা রোদ্দুর, কোথায় চলে গিয়েছিলি বাবা?
রোদ্দুর চেয়ে দেখে আপন জনরা সবাই এসে গেছে । রোদ্দুর আগে কোন দিন কাউকে না বলে বাসা থেকে বের হয়নি । বাবা মা যে এতো কান্না করবে এতোটা সে চিন্তাও করে নাই । রোদ্দুর ভাবতে লাগলো যদি ঐ মেয়েটা ঐ সময় ছুটে না এসে তাকে না বাঁচাতো তাহালে আজ কি হতো ! তার বাবা মায়ের কি অবস্থা হতো! আসলেই তো বিরাট ভুল করে বসেছিলো!
ভাগ্য ভালো যে ঐ মেয়েটা সময় মতো এসেছিলো ।
রোদ্দুর বিকেলে ফোনটা অন করতেই মিসড কল এলার্ডের কয়েকটা এস,এম,এস এলো। দেখে তার প্রেমিকা কয়েকবার কল করেছিলো। তা দেখে প্রেমিকা অর্পাকে কে ফোন দিলো রোদ্দুর।
– হ্যাল অর্পা?
: হাঁ অর্পাই বলছি ।
– কাল আমাকে ফোন দিয়েছিলে?
: ইচ্ছে ছিলোনা , আসলে তোমার মা কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো । তোমার খবর নেয়ার জন্য। আমি কোন খবর জানি কি না। তুমি কই মরতে গেছো তাতো জানি না। তাই ফোনে ট্রাই করছিলাম।
– আমি কোথায় ছিলাম তোমার জানার কি কোন দরকার ছিলো না, অর্পা?
: না ছিলো না। যে ছেলে একটা চাকুরি যোগার করতে পারে না, সে আবার বড় বড় কথা বলে । কোন খোঁজ নেয়ার দরকার নেই ।
– চাকুরি না পেলে কি আমাকে বিয়ে করবে না?
: না । করবো না।
রোদ্দুর আর কথা বলে না, ফোনটা কেটে দেয় । মা পাশ থেকে শুনছিলো ছেলের কথা । রোদ্দুর কে বললো : চিন্তা করিস না তো। বাবা বলেছে যে একটা চাকুরি এ মাসেই ঠিক করে দিবে । আর আমাদের কি টাকা পয়সা কম আছে । থাক বাবা যখন চাকুরি হয় হবে । তোমার জন্য আমি যাবো ঐ মেয়েকে বুঝিয়ে আনতে ।
রোদ্দুর বললো : না মা ওর কাছে আর যাওয়ার দরকার নেই ।
সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে ফোনটা বের করে রাতের ঐ দেবীকে ফোন করে রোদ্দুর।
: হ্যালো..
– হ্যালো, কে রোদ্দুর ?
: হুম।
– এখন সময় হলো ফোন দেয়ার? আমি কিন্তু খুব চিন্তা করছিলাম…
: কেন দেবী?
– কেন আবার! বুঝোনা? কি অবস্থায় তোমাকে বাঁচালাম!
: Sorry , দেবী।
– আমি দেবী না । আমার নাম আলো ।
: বাহ । সুন্দর নাম তো । কে রেখেছে?
– টাকা ছাড়া বলা যাবে না । আগে টাকা কামাও । আর শুনো, তুমি আজ পত্রিকা দেখো । একটা ট্রেড লাইসেন্স করো । লাইসেন্স করার টাকা না থাকলে আমাকে ফোন করিও । দেখো কিছু কিছু সাপ্লাইয়ের কাজ আছে । সব চেয়ে ছোট ছোট কাজ গুলো বের করো। যেখানে সমস্যা আমাকে বলবে ।

ছয় মাসে রোদ্দুর ব্যবসার অনেকটা বুঝে গেছে । আস্তে আস্তে রোদ্দুরের হাতে অনেক কাজ চলে আসছে । অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ এখন রোদ্দুরের হাতে । এই সব কিছুর মূলে আলো।
রাত একটায় আলোর ফোন। রোদ্দুর কাল একটা শিডিউল কিনবে । ওপেন টেন্ডার ।
আলো বলে : আমি বলে দিব কত মার্জিনে করবে । এ কাজটা পেলে হয়তো আর পেছন ফিরে দেখতে হবে না।
কয়েক মাস পরে সত্যি সত্যি রোদ্দুর কাজটা পেল । এতো বড় কাজ সে পাবে জীবনে ভাবতে পারে নাই ।
মাঝে মাঝে রোদ্দুর আলোর বাসায় যায় । প্রাণ খুলে গল্প করে ওরা । রোদ্দুরেরর জীবনের রঙ বদলে দিলো সেই রাতের দেবী ।
খুব অল্প সময়ে রোদ্দুর উপরে উঠার শিড়ি পেয়ে গেছে ।
অর্পা আজ কাল খুব বেশি ফোন করে কিন্তু রোদ্দুর খুব ব্যস্ত । অর্পা জানতে চায় রোদ্দুরের কাছে আলো কে ?
রোদ্দুর বলে : আলো হলো আমার দ্বিতীয় জন্ম ।
অর্পা রোদ্দুরের মায়ের কাছে এসে বলে , আমার জীবন নষ্ট করে আপনার ছেলে আলো নামের অন্য একটা মেয়ের সাথে চলে । গত এক বছর আমার কাজিন আমাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে আছে । আর আমি আপনার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছি ।
মা বলে : আজ আসুক রোদ্দুর ।
রাতে রোদ্দুর বাসায় এলে রাতের খাবার শেষে, মা জানতে চায় : আলো কে?
রোদ্দুর মায়ের কাছে সব খুলে বলে । ঐ রাতের ঘটনা এবং তার সফলতার কথা । এবং বলে সে আমার সত্যিকারের ভালোবাসা, মা।
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে : বাবা তুমি ওকে নিয়ে এসো। তোমাদের দু’জনকে এক করে দিতে চাই। আমি তাকে মাথায় করে রাখবো ।
পরের দিন আলোর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয় রোদ্দুর। দূর থেকে ভেসে আসে কোকিলের ডাক। এখন বসন্তকাল।
আলোর বাসায় এসে দরজা নক করতেই আলো এসে দরজা খুলে রোদ্দুরকে ভেতরে নিয়ে যায়। পরিপাটি ঘর। পাশাপাশি বসে দু’জন।
রোদ্দুর আলোকে বলে : জীবনের অর্থ তুমি আমাকে বুঝিয়েছো আলো। নানা প্রতিকুল অবস্থা তুমি পেরিয়ে এসেছো। নানা ঘাত প্রতিঘাতের সাথে যুদ্ধ করে কন্টকপথ পাড়ি দিয়ে দিন শেষে তুমি সফলতার সবুজ প্রান্তরে এসে দাঁড়িয়েছো! তোমাকে স্যালুট দেবী।
আলো বলে : রোদ্দুর, তুমি খুব ভালো একজন মানুষ। আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি ।
রোদ্দুর বুকে টেনে নেয় আলোকে। বলে : তুমি রোদ্দুরের আলো। শোনো, মা আমাদের এক করে দিতে চান। তোমাকে বাসায় নিয়ে ডেকেছেন।
রোদ্দুরের বুকে মাথা রেখে আলো বললো : আমি তোমার সাথে তোমার মায়ের কাছে যাবো রোদ্দুর।

নিজের অজান্তেই কখন যেন ওরা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে গেছে! দু’টি দেহে এক আত্মা, এক প্রাণ। হঠাৎ শোনা যায় কোকিলের সুমধুর কণ্ঠস্বর। বসন্তে সেজেছে প্রকৃতি। বসন্ত ছুঁয়েছে ওদের মন প্রাণ।

রুদ্র অয়ন। কবি।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ