প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ফাগুনের এক মন কেমন করা দিনে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি তে বসে ছিলাম।সর্বনাশ, আমি যে বুড়ো বললাম শুনে ফেললেই আর রক্ষা নেই। অমনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রমাণ করে ছাড়বেন যে “আমার বুড়ো” টা মোটেই বুড়ো হন নি। একথা অবশ্য সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে যে, কর্তাটি আমার চির তরুণ। তারুণ্য যে মনের, শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তার প্রমাণ আপাদমস্তক তরুণ এই ” আমার বুড়ো”টা।আমাদের মোটামুটিভাবে নিস্তরঙ্গ জীবনে হল্লা গাড়ির মত আক্রমণ করতে মাঝে মাঝেই হাজির হয় দুই তূর্কী।সবুজ আর তোড়া,আমাদের নাতনি আর আমাদের হবু নাতজামাই। ওরা কদিন আছে এখানে।
বাইরে মনে হলো গাড়ি এসে থামল। এলেন বোধহয় । সেই কোন সকালে বেরিয়ে এই ফিরছে। এই ছোট্ট মফস্বল শহর আপাদমস্তক চষে বেরায় কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ।
—ঠাম্!!! জাস্ট লুক এট ইউ!!!!সো প্রিটি!!! তোড়া র সঙ্গে বিয়ে ক্যানসেল্ড।তোমাকে আগে দেখলে ওই পেত্নিটা কে কি প্রপোজ করতাম?” এই বলে সবুজ জড়িয়ে ধরল আমাকে ।
তোড়া কপট রাগ দেখিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল রিক্লাইনারে বসে থাকা দাদানের, বললো — ইসসসস, অ্যজ ইফ তুমি প্রপোজ করলেই ঠাম্ তোমাকে এক্সেপ্ট করত !!! দাদান কে দেখেছ কি হ্যনডু!! ইউ জাস্ট ডোন্ট স্ট্যান্ড এ চান্স”
এই বলেই দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ল। হাসি বড়ই ছোয়াঁচে। অমন প্রাণ খোলা হাসির ঢেউ এই বৃদ্ধার মন ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁটে,চোখে। আড় চোখে দেখি কর্তা বাবুও মিটি মিটি হাসছেন। দুধ সাদা, সদ্য পাট ভাঙা পাজামা পাঞ্জাবি আর হাতে বই। এটাই কর্তা মশাই এর চেনা ছবি। হাতের বই টা পাশের টেবিলে নাবিয়ে, চোখের চশমা ঠিক করে, গলায় ছদ্ম গাম্ভীর্য এনে বললেন
— গিন্নি, তোকে ছেড়ে ওই ঝগরুটে বুড়ি কে যার মনে ধরে তার চয়েসের ওপর নির্ভর করা কিন্তু তোর ঠিক হবে না । কোথায় আমার সুইট হার্ট আর কোথায় উনি । ও নিয়ে যাক নতুন বৌকে । তুই আমার সঙ্গে লং ড্রাইভে চল।
আবার হাসির ফোয়ারা উঠল।এত দিনে বাড়িটা যেন প্রাণ পেল। দুজনে যেন আমাদের বাঁচার রসদ যুগিয়ে দিল। এদের কথায় কথায় খুনসুটি , মান অভিমান, প্রেম ভালবাসা দেখে আমাদের ফেলে আসা স্মৃতিগুলি ধুলো ঝেড়ে আবার মনে ফিরে আসছে । স্মৃতির ঝর্ণা ধারায় ধুয়ে থেমে থাকা জীবন যেন আবার ডাক দেয় ভেসে যাবার।
সবুজ–“লং ড্রাইভ !!! ও এম জি!!! সো রোম্যানটিক্!!”
তোড়া — দেখ দেখ!! কিছু শেখ আমার দাদানের কাছ থেকে।
সবুজ —আরে আমার যদি ঠামের মত সুন্দরী বৌ থাকত তাহলে আমি ও লং ড্রাইভে যেতাম ।
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে ইশারায় আমার সম্মতি চাইল।
তোড়া– থাক । আগে প্রজেক্ট ছেড়ে টাইম বের কর তারপর আমিও সুন্দরী হব। ততক্ষণ জাস্ট চেপে যা।
তার পরেই আদুরে গলায় বলল–দাদান তুমি বরং তোমার একটা লাভ স্টোরি শোনাও। সবুজ শিখুক কি করে প্রেম করতে হয় ।
অমনি কর্তা ও যেন ওদের সঙ্গে ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন।চোখে কৌতুক এনে উৎসাহে নড়ে চড়ে বসলেন।
— ও নতুন বৌ। বলব নাকি আমাদের পালিয়ে প্রেমের গল্পটা।
আমি—আহ্ কি যে করোনা তুমি । বাচ্চাদের সামনে, লজ্জা শরম আর কিছু রাখবেনা নাকি?
কর্তা — তাতে কি হয়েছে? ওরাও জানুক। “
গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন-
আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।
আমি সকল দাগে হব দাগি॥
তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন,
যেথা তোমার ধুলার শয়ন
সেথা আঁচল পাতব আমার–
তোমার রাগে অনুরাগী॥
লজ্জায় এই বয়সেও আমার কান লাল হবার উপক্রম ।তাকিয়ে দেখি কর্তার চোখে প্রশ্রয়ের হাসি।
কর্তা — লজ্জা কিসের নতুন বৌ। বললে দেখবে কিছুক্ষণের জন্য আবার সেই মুহূর্তগুলো তে ফিরে গেছ।তুমি বলো। আমি বরং আর একবার সেই মুহূর্তগুলো অনুভব করি।
আমি –সত্যি!! তুমি কি যে করো না। কত দিনের কথা, সব কি মনে আছে?
তোড়া — প্লিজ ঠাম ।প্লিঈঈঈঈজ্। এম শিওর তোমার সব মনে আছে । ইভেন টু দা মাইনুট ডিটেলস্।
আমি –আচ্ছা , আচ্ছা বলি শোন।
তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন । সারাদিন দেখা হওয়ারই সুযোগ নেই, কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠেনা। এখনকার মত হাতে হাতে মোবাইল নেই যে হোয়াট্সাপে কথা বলব। বাড়িতে একটাই ফোন তাও সদরঘরে। তবে উনি বাইরে গেলে ফোন করতেন যদিও বেশির ভাগ সময় অন্য কেউ ফোন ধরত।
একবার বর্ধমানে নেমন্তন্ন খেতে যাব বলে সকাল থেকে তোড়জোড় । যেহেতু অনেকটা পথ তাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়তে হবে ।তখন তো হাইওয়ে এমন চকচকে ঝকঝকে ছিলনা ।অবশ্য এত গাড়িও চলত না।অ্যম্বাসাডার চালিয়ে যাওয়াতে কারুর তেমন মত ছিল না। কিন্তু ট্রেনে গেলে রাতে আর ফেরা যাবেনা তাই গাড়ি করে যাবার অনুমতি মিলল। গাড়ি চালাবেন কর্তা মশাই। এই প্রথম ওনার সঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে যাওয়া।অবশ্য সঙ্গে যাবেন পিসিমা আর পিসতুতো ননদ যাকে তোরা ফুল পিপি বলিস। কিন্তু ঠিক বেরোনোর মুখেই সিঁড়ি তে পা মচকে তোদের ফুল পিপি গোল বাঁধাল। মেয়ে কে ওই ভাবে রেখে কি মা বেরুতে পারে?সুতরাং পিসিমা সটান জানিয়ে দিলেন তিনিও যাবেন না। ফলে যাওয়া বন্ধ হতে বসল। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিন্তু নেমন্তন্ন রক্ষা না করলেও নয়। তাই আমরা কর্তা গিন্নিতেই রওনা হলাম। আমার তো আনন্দের সীমা নেই। নতুন বিয়ের পর একসঙ্গে বেড়ানোর কথা ভাবতেই উত্তেজনায় চোখ মুখ রাঙা হয়ে উঠল। সবাই কে প্রণাম করে, ডুস্ আর ডোন্টস্ এর সব মাথা নেড়ে নেড়ে শুনে রওনা হলাম। ড্রাইভিং সিটে আমার বিলেত ফেরত বর। মন যেন ময়ুরীর মত পেখম মেলল। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভাসলাম।
নতুন বরের পাশে বসে হু হু করে গাড়ি ছুটিয়ে চললাম। শুধু দুজনে।
“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলতো” গুণগুণ করছি । এমন সময় উনি বললেন
— সত্যি যদি শেষ না হয়!!
— তাহলে কিন্তু বেশ হত।
–‘যাবে?
—কোথায়?
— যে দিকে দু চোখ যায় ।শুধু আমার হাত ধরে । এই গোধূলির মিষ্টি আলো মেখে চলো সূর্য স্নান করে আসি। যাবে? শুনে গায়ে কাঁটা দিল।
প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
পথে যেতে যেতে দেখি ভরা সর্ষের ক্ষেত । হলুদ সবুজে মাখামাখি । ঠিক যেন কোন চিত্র শিল্পীর ক্যানভাস। হয়তো মনের কথা বুঝতে পেরে অথবা নিজের মনের টানেই গাড়ি থামালো। বেশ কিছুক্ষণ সেই হলুদ সবুজ মাঠে লাল শাড়ি পরা আমি দৌড়াচ্ছি, গান গাইছি । অনেক দিন পরে আমার ভিতরের কিশোরী বেড়িয়ে এল। হঠাৎ কেমন যেন কান্না পেল। বুকের মধ্যে একটা শীত শীত ভাব। মনে হল মুক্ত হয়ে বাঁচতে যেমন ঝিনুক লাগে,নদী হয়ে বইতে ঢেউ লাগে এই খোলা মাঠ টা তেমন আমার প্রয়োজন ছিল আর একবার আমি হয়ে উঠতে । হঠাৎ খেয়াল পড়ল– ও কোথায়? আশেপাশে চোখ ফেরাতেই দেখি তিনি আমাকে ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত।
তোড়া— আরি বাআআস্ ঠাম, এ তো পুরো ডি ডি ল জে র সিচুয়েশন!!! পুরো জমে গেছে!!
এই বলে দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। বেশ বুঝতে পারলাম যে আমার ভালো লাগার মুহূর্তগুলো ওদের ভালোবাসার ওমে সিক্ত হচ্ছে ।
সবুজ—তার পর ?? কি গো?।প্লিজ বলো!
আমি— তারপর দুজনে কিছুটা আল ধরে হেঁটে গ্রামের কাছে গিয়ে একটা ছোট্ট দোকান দেখে চা নিয়ে বসলাম । দোকানের কাঁচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কান্না পেয়ে গেল । এই ভাবে কি করে বিয়ে বাড়িতে যাব? ধোপ দুরুস্ত শাড়ি তে যেন ঘূর্ণিঝড় খেলে গেছে , চুল সব উস্কোখুস্ক ,কপালের টিপ ধেবড়ে গেছে। সারা মুখে ঘাম, কিন্তু চোখের কাজল ধেবড়ে গেলেও সেখানে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য।
যতটা সম্ভব নিজেকে একটু ফিটফাট করলাম । তারপর জিজ্ঞাসা করলাম — দাদা এখান থেকে বর্ধমান কতদূর?
বুড়ো দোকানী পান খাওয়া দাঁত বের করে , এক গাল হেসে বলল– – মা জননী, এজ্ঞে,আমনারা তো সে শহর ছাড়িয়ে এয়ে পড়েচেন গো অনেগখানি। আর একটুসখানিক গেলি তো বোলপুর গো। শুনেই তো বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।
সরব
কর্তা —” পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ ? চিন্তা করো না। আমি জেনেই শুনেই এতটা পথ এগিয়ে এসেছি ,বন্যা । জানো বন্যা অনেক দিনের শখ ছিল, কাউকে নিয়ে পালাব। আজ সুযোগ পেলাম। তাই নিজের বৌ কে নিয়েই পালাচ্ছি। বুঝলে আমার বন্যা রাণী । আজ নো বিয়ে বিয়ে বাড়ি, আজ আমার বন্যার সঙ্গে আমার ডেটে যাচ্ছি । আমাদের রোমান হলিডে !! “
সবুজ –তোমাকে দাদান বন্যা বলে ডাকতো?? হাউ রোমান্টিক!!! উফফফ দাদান ইউ আর জাস্ট টুউউউ গুড।
আমি– হ্যাঁ রে , তখনো বাড়িতে সবাই নতুন বৌ বললেও উনি আড়ালে আমাকে বন্যা বলেই ডাকতেন । আসলে ওই বয়সে সকলেরই বোধহয় শেষের কবিতা নিয়ে একটু মাতামাতি থাকে। তোরা এই প্রজন্মের ছেলে মেয়ে এগুলো বুঝবি না ।
তোড়া —মোটেই না।আমাদেরও ওমন আদরের নাম থাকে।
আমি —সে তো সোনা, বেবি, হানি, মানি গোছের ডাক ।দশ জনের নয় জন একই নামে ডাকে।
সবুজ —-এই জন্য আমি পেত্নি বলে ডাকি । একদম হট্ কে । কি তাই না!!
উত্তরে তোড়া কয়েকটা ফ্লাইং কিস্ ছুঁড়ে দিল। এদের সাবলীল,কুন্ঠা হীন ব্যবহার অনেকের চোখে সামাজিক অবক্ষয় মনে হলেও আমার কিন্তু বেশ লাগে। ভালোবাসা দেখানোর জিনিস নয় ঠিকই, এটা একটা বোধ। কিন্তু প্রকাশ করলে মনের মধ্যে একটা শিহরণ জাগে।সেই অনুরণনের উষ্ণতায় মনে ফাগুনের রঙ লাগে।
তোড়া —‘ঠাম্ তুমি কিন্তু ট্র্যাকে ফিরে এস। তারপর কি হল সেটা শুনি। এই বলে গুছিয়ে বসল যুগলে।
আমি শুরু করলাম –‘ আমরা যতক্ষণে বোলপুর পৌঁছালাম ততক্ষণে সন্ধ্যা নামছে। বোলপুর তখনো ছোট শহর । সন্ধ্যা হলেই চারিদিক নিস্তব্ধ । সে দিন পূর্ণিমা ছিল বোধহয় । ফাঁকা এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে যখন কোপাই এর ধারে পৌঁছালাম ততক্ষণে চারিদিক জোছনার নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে । এই প্রথম বুঝলাম যে জ্যোৎস্না জড়ালে চাঁদের আলোয় রিমঝিম শব্দ হয়। সেই সময় মন দিয়ে মন ছোঁয়া যায় । পাপ তখন স্পর্শ করে না ।
মনতো ভরলো কিন্তু পেটে তখন ছুঁচোয় ডন বৈঠক দিচ্ছে । কিন্তু কোথায় কি??
তোড়া –ওমাআআ সে কি গো অত বড় শান্তিনিকেতন , বোলপুর সেখানে তো কত খাবার দোকান, কিছু নাহোক রোড সাইড ধাবা তো আছেই ।
সবুজ— আরে পাগলী!!!! এটা যে সময়ের কথা সেটা চল্লিশ বছর আগে। তখনকার শান্তিনিকেতন ছিল অন্য রকম। গ্রো আপ রে পেত্নি
তোড়া —- উউউউপস্, সরি সরি ।তুমি ক্যারি অন।
আমি বললাম –আর ক্যারি অন না । এবার খাওয়া দাওয়া সেরে নে। শুধু গল্প শুনলেই পেট ভরবে?
তোড়া –ইম্পসিবল আজ ব্রাঞ্চ করেছি। লাঞ্চ তাই স্কিপ।
আমি– তাহলে বরং একটু বেলের পানা দি খা।গরমে পেট ঠান্ডা হবে।
দুজনের অবাক হওয়া মুখ দেখেই বুঝলাম নাম টা শোনে নি।
জাম বাটি থেকে বেলের পানা গ্লাসে ঢেলে দিতে একটু ইতস্তত করে মুখে দিল। এক মুখ খুশি নিয়ে বলল
তোড়া — উমমম ঠাম্ !! সো ডিলিশিয়াশ!!! সোওওও ইয়াম্!!
আমি হেসে বললাম — মুন্ডু আর মাথা, ওই তো জিনিস তাও আবার ইয়াম!!! পারিসও বটে তোরা।
কর্তা সুর মেলালেন–‘ সত্যি নতুন বৌ পানা খানা তুমি দিব্য বানাও।অবশ্য রান্নার হাত তোমার চিরদিন ভালো ।
সবুজ –ঠাম্ পেত্নিটাকে শিখিয়ে দিও কিন্তু ..
তোড়া –আমার দ্বারা হবে না তুই শিখে নিস।সত্যি লজ্জাও করেনা।শুধু আজে বাজে কথা বলে অফ ট্রাক হয়ে যাচ্ছ ।এবার কিন্তু প্লিজ গল্পটা শেষ কর ঠাম্
আমি গ্লাস গুলো রেখে আবার সেই রঙিন দিনটাকে ফিরে দেখতে বসলাম । ছবির মত ভেসে উঠছে একটা দৃশ্য ।স্মৃতির অঝোর ধারায় ভিজিয়ে নিচ্ছি ক্ষয়ে যাওয়া, মরচধর মনটাকে , আর সেই বর্ষণে ভালবাসায় মজে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের দুটো নবীন মন ।
স্মৃতির তোরঙ্গ হাতড়ে দেখতে পাচ্ছি ..
দুটো তরুণ তরুণী …পায়ে পায়ে পৌঁছাল খোয়াই-এর ধারে। দু’পাশে নিবিড় শালবন , সুনসান নীরবতা মাঝে লালমাটির বিছানো হৃদয়। একটু হিংসাও হয় ….’গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ ‘ কবির মন তাহলে ভুলেছিল এখানেই।
ভুবনডাঙা এখন সোনাঝুরি। আর সোনাঝুরি মানে সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাস আর আকাশমণি গাছের সারি। শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া এই নাম, আর এই প্রজাতির গাছগুলি এসেছিল গুরুদেবেরই বিদেশীবন্ধু পিয়ারসন সাহেবের হাত ধরে।
তোড়া– বলো কি?? যে গাছ ছাড়া আমাদের শান্তি নিকেতন ভাবা যায় না সেটা এ দেশের নয়?
সবুজ– ইয়েস ম্যাডাম,আলু ,টোম্যাটো, এমনকি কচুরিপানা ও বিদেশী ।
পিঠে এক কিল মেরে সবূজের মুখ চেপে ধরে তোড়া আমাকে ইশারায় গল্প চালিয়ে যেতে বলল ।
আমি–‘ গাড়ি টা রাখা নিয়ে তখন চিন্তা ছিল না। দিন কাল তখন এমন ছিল না তাই গাড়িটাকে জায়গা মত রেখে, রাঙামাটির আবেগটুকু ধরে রাখার জন্যই কাঁচা পথ ধরলাম। লালমাটির বুক চিরে যে জলের ধারা, সে ধারায় তোলপাড় খোয়াই-এর পাড়ে লাল কাঁকড়ের ধারে হাতে হাত জড়িয়ে দুটো সবুজ মন। হয়তো শুধুই ইউক্যালিপটাসের সারি পারে হাওয়ায় উথাল পাথাল সে মনে তাল মেলাতে…। খোয়াই-এর পাড়ে গান ধরেছে বাউল…‘আমি হৃদমাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেব না…’ মন যে সত্যিই ছেড়ে যেতে চায় না।তখন আকাশের চাঁদোয়ায় অজস্র হিরের কুচি। কত দিন যে এমন আকাশ দেখিনি…!বুক চেপে একটা চাপা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এল।হাতের আঙুলের চাপে আবার ফিরে এল স্বস্তি। নিঃশব্দে বলল… চিন্তা কি?? আমি আছিতো।
রাতের অন্ধকারে চোখ গেল পাখির ডাক। মনটা কেমন হুহু করে ওঠে। অন্যদিকে শাল পিয়ালের বন ,সেখানে থোকা থোকা ফুটে রয়েছে সোনা ঝুরি ফুল যেন সবুজ ক্যানভাসে কেউ মুঠোমুঠো রঙ ছুড়ে মেরেছে। সেই দৃশ্য দেখে নিশ্চল হলো চোখ, মন হল ভাষাহীন।
এতদিন শান্তিনিকেতন বলতে বুঝতাম দীর্ঘ ছাতিমের পাশ দিয়ে, মন্দিরের সামনে হাঁটাপথ পেরিয়ে পাঠভবনের ছায়াঘেরা বকুলবীথি আর আম্রকুঞ্জ। গাছের তলায় বাঁধানো চাতাল, যখন ক্লাস বসে ছেলেমেয়েদের। এক একটি গাছের তলায় এক একটি ক্লাস। ঘন সবুজের নরম ছায়ায় গেরুয়ার তন্ময়তা। মাথার ওপর ঝুরু ঝুরু পড়ে ভোরের বকুল—কার আশীর্বাদের মতো! কিন্তু এ যে এক নতুন দিগন্ত, শান্তি নিকেতন কে নব রূপে নতুন করে আবিষ্কার!!!
বৃষ্টির জলে ধুয়ে বেরিয়ে আসা লাল রঙের কাঁকর মাটির আর কোথাও কোথাও অটুট থাকা উপরের হলুদ আস্তরণ। ছোট ছোট মাটির ঢিবির মধ্যে হঠাৎ খাদে জমে আছে বৃষ্টির জল , মনে হয় যেন অভিশপ্ত পাহাড়ী নদী তার অপারগতা নিয়ে এই ক্ষীণধারা রূপে বয়ে গেছে সমতলে। ঠিক জানিনা খোয়াই এর বুকে জলের প্রাবল্য ছিল কি না কোন কালে, তবে রবীন্দ্রনাথের বহুরচনার ও বহুছবির অন্তরে বহতা সে।
কানে ভেসে আসছিল ঢোল আর মাদলের শব্দ। কাছেই তাই স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে সেদিকে হাঁটা লাগালাম।
ছোট্ট একটা সাঁওতালি গ্রাম। একপাশে সাঁওতাল মেয়ে পুরুষের দল মাদলের তালে তালে নাচে মগ্ন। আগুন কে ঘিরে গোল হয়ে নাচ চলছে ।মেয়েদের মাথায় উপর দু’টি করে কাঁসার ঘটি বসানো। উপরের ঘটিতে ফুল ও সতেজ পাতা দেওয়া। দেখে মনে হবে, নাচিয়েদের মাথা ফুঁড়ে ফুল গজিয়েছে।
আমাদের আসতে দেখে এক জন এগিয়ে এল । বলল— হেই বাবু , শহোর থিক্যা আইছিস লাকি তুরা? ইদাগ পানে তুদের দেকছি লাইতো!!
— আমরা কলকাতা থেকে এসেছি ।তোমাদের দেশ দেখতে।
— সিটা তো বড়ই ভাল্লো কুথা বটে।আয় কেনে, মুদের সঙ্গে লাচা গানা কর তুরা।
এমন সময় এক মহিলাও এগিয়ে এল। আমাকে দেখে হাত ধরে টেনে বলল..
— ইইই বিটি, তুর মরদ তুকে কি ভাতটো খিতে দেইলাই? ওমুন সোলার মুত বদনটুতে যেন কালি লিপাইঞছে। তুদের ভুখ লাগিঞছে? ইইঈ মদনের বাপ, হোই দাওয়াটুতে বসাইন দে কেনে, ঘুরে পান্তা আইছে । সেটুক খেইয়ে শরিলটা জুড়াক বটে।
ওখানেই ঘটি থেকে জল মুখে হাতে ছিটিয়ে সুন্দর করে নিকানো দাওয়ায় বসলাম।চারদিকে কি মিষ্টি একটা গন্ধ । কেমন মায়াবী পরিবেশ। শুনলাম ওটা মহুয়া ফুলের গন্ধ।
একটা মাটির সরা তে অনেকটা পান্তা ভাত, ক’টা পেঁয়াজ আর লঙ্কা। সঙ্গে একটা তেঁতুলের চাটনি । দেখেই পেটের মধ্যে ছুঁচোরা ডিগবাজি দিতে শুরু করল।আহা সে ভাত যেন অমৃত।
এতক্ষণে কর্তা বললেন” জানো সুইট হার্ট, খাবার সুস্বাদু হতে কি লাগে? তোড়া আকাশ পাতাল ভাবছে দেখে অল্প হেসে বললেন” খিদে, খিদে না থাকলে রাজভোগ ও পানসে লাগে। সে দিনের ভাতের স্বাদ আজও লেগে আছে কারণ সে দিন আমাদের পেটে ছিল ভয়ানক খিদে।”
তোড়া অমনি গলায় আবদারের সুরে বলল” ঠাম কাল কিন্তু মেনু তে পান্তা ভাত রেখো।”
আমি- — বোঝো পাগলীর কান্ড । উনি পান্তা খাবেন।”
সবুজ- -“পরে অফিস থেকে ফিরে কপালে ওই পান্তাই জুটবে।”
আদুরে গলায় তোড়া বলল” তা কেন ? এসে চট পট ভাত রান্না করে নিবি ।তাহলেই গরম ভাত পাবি।” বলেই হো হো করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
আমরা দুই কর্তা গিন্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । একেই বোধহয় বলে জেনারেশন গ্যাপ । তোড়া গলায় অনুযোগের সুর এনে বলল”— শুধু পান্তার গল্প শোনাবে নাকি বাকিটাও বলবে?”
— বলছি,বলছি?? আরে বাবা বুড়ো হয়েছি। স্মৃতির তোরঙ্গের নিচ থেকে ঘটনা গুলো ঝেড়ে মুছে তুলে আনতে সময় লাগে রে মা।
তারপর কি হলো জানিস? দিব্যি তো গানের নাচের তালে তাল দিচ্ছি হঠাৎ দেখি দুটো ছোট্ট মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো — তু আয়না কেনে দিদি, লাচবি ।
পেট ভরা,মেজাজ টাও শরিফ, নেই কোন নিষেধের বেড়ি। মন পাখি তাই মেলল ডানা। আঁচল খানা কোমরে জড়িয়ে নেবে পড়লাম। ধামসা মাদলের তালে তালে পা মিলিয়ে আমিও তখন ওদের আনন্দে সামিল।এতকাল আঞ্চলিক গান বলতে কানে বাজত
লাল পাহাড়ি দেশে যা
রাঙ্গামটির দেশে যা
ইত্থাক তুকে মানাইছে না রে
একবারে মানাইছে না রে …
কিন্তু এই গানগুলো একদম অন্যরকম। মহুয়ার বুনো গন্ধ মেশানো, কেমন যেন নেশা ধরানো। সেই তালে নাচতে নাচতে যখন হাঁফ ধরল, পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম ওনার পাশে।ওখানে আকাশটা যেন কত কাছে। এই অন্ধকারে ও যেন আলোয় ভরা উল্লাসের স্পন্দনকেই অনুভব করছিলাম। সেই অনুরণনে আজও মন বনভাসি…
ভেসে আসছে গানের সুর… ধিধিং ধিতাং…. ধিধিং ধিতাং…..
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..