দ্য আনডিসপিউটেড মাস্টার সাদাত হুসেন মান্টো

সম্পূর্ণা চ্যাটার্জ্জী
মুক্তগদ্য
Bengali
দ্য আনডিসপিউটেড মাস্টার সাদাত হুসেন মান্টো

‘একদিন হয়ত পাকিস্তান সরকার আমার কবরে পরিয়ে দেবে একটা মেডেল। আর সেটাই হবে আমার কাছে সব থেকে বড় অপমান।’

এটাই চেয়েছিল লোকটা তার কবরের ওপর লেখা হোক। কিন্তু না মৌলবাদীদের চাপে লেখা যায়নি সেটা। প্রায় স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্বংস করে দিতে পেরেছিল, শেষ করে দিতে পেরেছিল জীবনটা মদে চুর হওয়া নেশায় তবুও বদলাতে চায়নি নিজেকে!!প্রত্যেকবার নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যখন মদের বোতল ভেঙে ফেলে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ত পরের দিন আরেকটা মান্টো হয়ে জন্মাত।নেশা কাটাতেও দেখিনি কোনোদিন লেবু জল খেতে! ঘটঘট করে বিষাক্ত জীবনটা রোজ আকন্ঠ গিলে নিত বেহিসাবি লোকটা! অনেকটা সময় কেটে গেছিল মেন্টাল এ্যাসাইলামেও। তবুও একইরকম স্বেচ্ছাচার, একদম আলাদা একটা বাঁচা নিজের জন্য তুলে রাখত আপাদমস্তক অভদ্র লোকটা! নিশ্চই চিনবে! কিন্তু ওর নাম উচ্চারণ করতে যে বুকের পাটা লাগে এ উপমহাদেশে কারুর নেই। সাদাত হুসেন মান্টো!

জন্মের পরেরটুকু বেশিরভাগ হিসেব করা জীবন যেমন হয় তেমন! বাবা ছিলএকজন বিচারক। বিচারকের ন্যায়কক্ষ বাড়িতেও চব্বিশ ঘণ্টার কঠোর শাসনে।স্বাধীনতা বলতে ছিলনা কিস্যু! ছোটবেলা থেকেই তাই বোহেমিয়ান জীবন যাপন। ভারত পাকিস্তান ভাগ না হওয়া দুদেশে অমৃতসরের মুসলিম হাই স্কুলে মন প্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো। পড়ালেখায় ভীষণ অমনোযোগী। দু’বার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতেও ব্যর্থ । কিন্তু স্কুলের পড়ার বই বাদে গল্প-উপন্যাস পড়ার প্রবল আগ্রহ ! এমনকি একবার অমৃতসর রেল স্টেশনের হুইলার বুকস্টল থেকে বই চুরিও করেছিলো।কলেজে পড়াকালীন অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অশান্ত পরিবেশ আর বাবার মৃত্যুর পর চারপাশের চাপে ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছিল কিছুসময়ের জন্য। সে সময় আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে মান্টোর সাক্ষাৎ মান্টোর জীবনে একটা মাইলফলক।

এসবকে বিশেষ পাত্তা দিয়ে চলেনি অবশ্য। যা ছিল নিয়মের বাইরে তাতেই আকর্ষণ বেশি! গল্পের চরিত্ররাও ওর জীবনের মতই বেরঙিন বা ভীষণ রকম স্রোতের বিপরীত। সমাজের অন্ধকার জীবনের জটিলতা, মাতাল, পাগল, ভবঘুরে, পতিতারা ঘুরেফিরে এসেছে। বমি উঠে আসত শিরদাঁড়াহীন দুগ্ধপোষ্য গিরগিটিগুলো দেখলে! ওর বিরুদ্ধে ছ’বার অশ্লীলতার অভিযোগে মামলাও হয়। এমন কি ওর বিটার ফ্রুট গল্পের জন্যে অশ্লীলতার দায়ে লাহোর আদালতে সালটা বোধহয় ১৯৫০ সালের ২৯ আগস্ট ও অভিযুক্ত। পকেটের অবস্থা ভালো নয়।সেই কারণে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেনি। তরুন আইনজীবী শেখ খুরশিদ আহমেদ ও আরো তিনজন তরুন উকিল নিজে থেকেই মান্টোর পক্ষে সওয়াল করেন।পাক টি হাউজে বসে যখন পাকিস্তানের প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স ফোরাম মান্টোকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তখন মান্টো হেসে ফুৎকারে বোধহয় উড়িয়ে দিয়েছিল সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যকে। আসলে কোনোদিনই ভাগ্য টাগ্যকে খুব একটা পাত্তা দিয়ে চলেনি লোকটা! পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে যখন তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, ওর থোরাই কেয়ার স্বভাবটা বলেছিল, ‘ম্যায় তো না লেফট কা হু না রাইট কা হু।’ বাস্তবিকই তখন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিও বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মান্টোকে।

দাঙ্গার সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে ধর্ষণ করত একটা লোক! শহর জুড়ে লুটপাটের সময়ে লুটের মাল বাড়িতে নিয়ে এসে নিজের স্ত্রী কে দিয়ে কতোবার খুশি করেছে! বনালার পাশে অজ্ঞান হওয়া একটা সতেরো বছরের মেয়েকে তুলে নিয়ে এসে ধর্ষণ।তারপর বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ করছে, অথচ কিছুতেই লোকটার শরীর উত্তেজিত হচ্ছে না।সব কিছু যেন ঠান্ডা! ‘সব কুছ একদম ঠান্ডা গোস্তকা মাফিক।’ স্ত্রী কুলজিৎএর স্তন, নরম মাংসল পাছাও তখন গরম করতে পারছে না।এরপর ক্ষিপ্ত স্ত্রী যখন ভাবছে সে অন্য কারুর প্রেমে পড়েছে এবং সেই রাগেই কৃপান নিয়ে আক্রমণ করল, ঠিক তখনই পুরুষটা বলে উঠল ‘যে মেয়েটাকে আমি তুলে নিয়ে গিয়ে নালার পাশে ধর্ষণ করেছিলাম, উঠে আসার সময়ে লক্ষ্য করলাম ও আগে থেকেই মরে ছিল।ওর শরীর ছিল একদম ঠান্ডা।বিলকুল ঠান্ডা গোস্ত কা মাফিক।’

একটু খানি জেনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! পাশে রাখা জলের গ্লাসটা খুঁজছ সব! কিন্তু ওই লোকটা এসবই লিখত! “ঠান্ডা গোস্ত” এমনই একটা গল্প। খুনি কলমটা দিয়ে ঝরঝর করে এসবই লিখত। স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করত যখন তার গল্প লেখার দরকার পড়ত।কথা বলে যেতে যেতে সে সারারাত তাই নিয়ে ভেবে যেত। প্রথমে কিছুই তার মাথায় খেলত না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে খবর কাগজ, তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে দেখত কোনও গল্পের রসদ পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কোনও ফল হত না। তারপর বাথরুমে যেত। বসে বসে চিন্তা করত, কিন্তু ফল সেই শূন্য। তারপর হতাশার থেকে বউয়ের সঙ্গে বিনা কারণে ঝগড়া বাধাত। তাতও কাজ না হলে রাস্তায় বেরিয়ে একটা পান কিনত। পানটা টেবিলে রেখে দিত যতক্ষণ না গল্পের কোনও প্লট তার মাথায় হঠাৎ খেলে যায়। তারপর হঠাৎ সে পেন বা পেনসিল হাতের কাছে যা পেত তুলে নিয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করে দিত। ‘বাবু গোপীনাথ’ ‘টোবা টেক সিং’ ‘হাটক’ ‘মাম্মি’ ‘মোজেল‘ ‘লাইসেন্স‘। মধ্যবিত্ত সাধারণ চরিত্রগুলোর অপরাধ প্রবণতা, খুব সাধারণ জীবনটা তীরের মতো ছুটত সমাজের যেকোনো অলি গলিতে।

চূড়ান্ত ক্যামোফ্লেজ একটা। নিজেকে বলত, ধর্ম না মানা নাস্তিক ও। অথচ ওর প্রতিটা শব্দ যেন পবিত্র কোরানের জলছবি! কী বীভৎস ঠকিয়ে গেছে সবাইকে! লোকটা রীতিমতো অশিক্ষিতও ছিল আমি মনে করি। কেননা ও মার্কস পড়েনি, ফ্রয়েডের লেখা চোখেও দেখেনি। হেগেলের নাম শুধু শুনেছে। হ্যাভলক এলিসও শুধু একটা নাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তার সমালোচকরা বলে যে সে নাকি এঁদের দ্বারা প্রভাবিত। যত্তোসব!ওকে যতোদূর জানতাম, মান্টো অন্য কারোর চিন্তা ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে ঘেন্না করত। বারবার বলত,’ যারা আমাকে শিক্ষা দিতে যায় তারা ইডিয়ট ছাড়া কিছু নয়। কেউ অন্য কাউকে পৃথিবী সম্পর্কে শেখাতে যাবে কেন? সে নিজেই আগে ভালো করে দুনিয়াটাকে বুঝুক।’ মান্টো নিজেকে শেখাতে গিয়ে বা কোনও কিছু নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলেছিল যে আমি না হেসে পারি না। মূর্খ একটা।

আমি তোমাদের খুব জোর গলায় বলতে পারি যে মান্টো, যার বিরুদ্ধে এত অশ্লীলতার অভিযোগ রয়েছে, আদতে আপাদমস্তক ভদ্রলোক। কিন্তু একথাও বলে রাখি এর সঙ্গে যে সে আসলে নিরন্তর ঝাড়পোঁছ করে গেছে নিজেকে।ওই লোকটা এমন একটা মিথ্যেবাদী গাম্বাট যে নিজে মুখে বলে গেছে, ‘তাঁকে উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক বলা হলেও ক্লাসের পরীক্ষায় তিনি উর্দুতে কখনো পাশ করতে পারেননি’।

হয়তো তোমরা ভাবছ আমি কে তখন থেকে এমন একটা সস্তা, পাঁড় মাতাল গল্পকারকে নিয়ে বকবক করে চলেছি?বহুদিন ওর সাথে ছিলাম। ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম। খুব ইচ্ছে ছিল ধরে ফেলব একদিন! পারিনি। পারিনি! আশ্চর্য ভাবে শয়তানটা ফাঁকি দিয়ে গেছে। যতটা সহজ ভাবো তোমরা, ও ততটা সহজ ছিলনা। সাদাসিধে চেহারার আস্ত একটা মিচকে! সবাইকে বলত বিদ্রূপ অপমানগুলো গায়ে মাখেনা। আমি দেখেছি ছুঁড়ে দেয়া প্রত্যেকটা উপেক্ষা, চুরমার করে দেয়া তীক্ষ্ণ খোঁচাগুলো লুকিয়ে পকেটে রাখত জমিয়ে! বুকের ভেতর কত সময় ঝরঝর করে রক্ত পড়তে শুনেছি, কিন্তু ও রোজ তাতে ছুরি বার করে খোঁচা দিত। নুন আর মরিচ দিত ছিটিয়ে! উপশম খুঁজতনা! বলত ‘আহ্ কি আরাম! পারব এবার লিখতে।’ তারপর যখন কলম ধরত উলঙ্গ সমাজটা আরও বেশি উলঙ্গ হয়ে নামত। মনে মনে বলত, ধুত্তোর! যেটা ল্যাংটো হয়ে এমনিই আছে সেটা আমি আর কি কাপড় পড়াব। এতোটাই শয়তান ছিল সে! এমন এক কবর যা এতো বছর ধরে সময়ের তলায় শুইয়ে রাখার পরও একটা চর্চা!যে মানুষের দিকে আঙুল তুলেও যেন বলে গেছে, আলবাৎ আমরা সবাই একেকটা অমানুষ! রুশদির চিনিয়ে দিয়ে যাওয়া সেই, ‘Undisputed master of modern Indian short story’।

সম্পূর্ণা চ্যাটার্জ্জী। কবি। জন্ম আসাম তারপর বড় হওয়া হাওড়ায়। বর্তমানে বিবাহসূত্রে উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। লেখাপড়া করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। নিয়মিত কবিতা লেখা তাঁর প্যাশন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ