দ্য লাঞ্চন- বাংলাদেশ ভার্সন

তৌহিদ জামান
গল্প
Bengali
দ্য লাঞ্চন- বাংলাদেশ ভার্সন

আজ বাইরের কাজ। একজন অতিথি আসছেন, মাঠ পরিদর্শনে। খুব টেনশনে রয়েছি।

গেস্টকে নিয়ে আমাদের পরিদর্শন এলাকায় পৌঁছে গেছি।

গাড়ি থেকে নামতেই সুবর্ণা চেঁচিয়ে উঠলো, ভাইয়া… মিষ্টি খাবো!

মিষ্টির দোকানটা দেখে প্রথমে যে বিষয়টি মাথায় খেলে, তা হচ্ছে- এতো নোংরা কোনও খাবারের স্টল হতে পারে? চারিদিকে মাছি ভনভন করছে; একটা গা শিরশিরে বা ঘিনঘিনে ভাব আসে। কোনোরকমে সেখান থেকে চোখটা সরিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ!

: শোনো, এই মিষ্টির পরে ভনভন করে মাছি উড়ছে! এতে পেট খারাপ হবে…

ভাইয়া, এই মিষ্টিটাই আমি পছন্দ করি, প্লিজ! না বলো না

কী আর করা; গেস্টের সামনে বেশি কিছু বলতেও পারছি না। অগত্যা ড্রাইভারকে বলি- যান ওকে মিষ্টি খাওয়ান।

ড্রাইভার একটি প্লেটে তিনটে মিষ্টি নিয়ে এসে সামনে ধরে।

বলি, নাহ! চলবে না! অতিথিও তাই।

কিন্তু সুবর্ণা কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই গপ গপ করে সাবাড় করে ফেললো, তিনটেই!

বেলা উঠতেই তেষ্টা পেয়েছে সবার। সামনে সাইকেলে এক লোক ডাব নিয়ে যাচ্ছেন।

গেস্টকে বলি, আপনি কি ডাব খাবেন একটা?

তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানোর আগেই সুবর্ণা চিৎকার করে বলে উঠলো, ডাব খাবো, ডাব খাবো। অ্যাই- আমাকে সরওয়ালা একটা বড় দেখে ডাব দাও। ভাইয়া, ডাব না আমার খুব প্রিয়!

আমি ভাবতে থাকি, সকাল থেকে শুরু করে দিয়েছো; কোন খাবারটা তোমার রোচে না- সেটাই এখন বড় গবেষণার বিষয়!

মুখে বলি, সরওয়ালা ডাবের চেয়ে কচি ডাবই ভাল স্বাস্থ্যের জন্যে।

: ভাইয়া, আমার না সর খেতে খুব ভাল লাগে…

কাজ সারতে সারতে দুপুর হয়ে যায়। আমাদের দুপুরের খাবার আজ বিখ্যাত একটা হোটেলে সারবো ভেবেছি। গেস্টকে বলি, আপনার জন্যে সারপ্রাইজ!

উনি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলি, এই হোটেলটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এখানকার রান্নায় তেল-মসলার বাহুল্য নেই। একেবারে বাড়ির রান্না!

উনি খুশি হন।

গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত হোটেলের দিকে রওনা হই। সুবর্ণার এখন অন্যরকম উচ্ছ্বাস চোখেমুখে। সে হোটেলটা চেনে; সেখানকার খাবার এরআগেও কয়েকদফা ভক্ষণ করেছে। বেশ গদগদ কণ্ঠে কিন্তু ফিসফিসিয়ে বলে, ভাইয়া- আজ কিন্তু আমি ইচ্ছেমত খাবো। তুমি কিন্তু বারণ করো না, প্লিজ!

আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিছুই বলতে পারি না। ভাবি, কী আর খাবে!

আমরা পৌঁছে যাই হোটেলে… হোটেল মালিক আমাদের সাদরে নিয়ে বসান সুন্দর একটি টেবিলে।

হাত মুখ ধুয়ে আসন নিয়ে বসি।

ওয়েটার খাবার দিয়ে যান। সাদাভাত, লালশাক, ডালভর্তা, চিংড়িভর্তা, শিংমাছ ভুনা, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, দেশি মুরগি ভুনা, খাসির মাংস…

আমাদের অতিথি একটা শিংমাছ আর কিছুটা সবজি নেন পাতে। আমিও একটা ভর্তা, শিংমাছ আর পাতলা ডাল দিয়ে খেতে শুরু করি।

সুবর্ণা চিংড়ি ভর্তা দিয়ে শুরু করেছে। একটু পর ডালভর্তা নিয়েছে পাতে- আমি বেশ খুশি হই। যাক, ইচ্ছেমত খাচ্ছে! কিন্তু খাবারের বিল বাড়বে না… একরকম আনন্দ পাচ্ছি মনে মনে।

ভর্তা চ্যাপটার ক্লোজ করে সে এবার পাতে তোলে বিশাল সাইজের একটা গলদা চিংড়ির মালাইকারী! নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না… বেশ সুঘ্রাণ আসছে। আহ!

সুবর্ণা খাচ্ছে- আর আমি হিসেব কষছি!

: ভাইয়া, তুমি একটা নাও না- বেশ আহ্লাদি কণ্ঠে বলে।

আমি বলি, নাহ! অতোবড় চিংড়ির ভেতরে তেল-মসলা ঢোকে না। আমার ওসব পছন্দ না

: তুমি ঠিকই বলেছো! কেমন যেন… মুখে এই কথা বললেও চপ চপ করে সে খেতে থাকে। আর আমি ভাবি, এখানেই শেষ হবে নিশ্চয়!

পরম আয়েশে চিংড়ির ঝোল ভাতে মেখে মুখে পুরে দিচ্ছে সে, তার চোখে দারুণ তৃপ্তির ঝলক!

আমাদের গেস্ট হঠাৎ করেই ফিক করে হেসে ওঠেন। আমি তার মুখপানে চেয়ে দেখি। তার চোখ সুবর্ণার পাতে।

চোখ ঘুরিয়ে আমিও নিবব্ধ করি সেখানে। প্লেটের এপাশ-ওপাশ জুড়ে মুরগির ঠ্যাং একটা। প্লেটের একটা বড় অংশ জুড়ে সেটি রয়েছে।

গেস্ট যেমন হাসছেন নির্ভেজাল, আর শঙ্কায় চোখ কপালে উঠছে আমার। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন, ২৮ ইঞ্চি কোমরের মালিক এই মেয়েটি এতো খাবার কোথায় রাখছে।

আমি ভাবছি, কত টাকা বিল আসবে! প্রথমদিকে তার ভর্তা ভাজি মাছ নেওয়ার সময় বেশ হাসিখুশি ছিলাম। যাই হোক, বিল খুব বেশি হবে না। কিন্তু সেই ভুল ভাঙলো অচিরেই। প্রমাণ সাইজের একটা মুরগির ঠ্যাং যে স্টাইলে চিবুচ্ছে সুবর্ণা, তাতে আমার ভিমরি খাওয়ার জো! ভাবলাম, এখানেই শেষ করবে, এইটুকু পেট, আর কত সইবে?

আমার সব জল্পনা কল্পনাকে পরাভূত করে বিপুল বিক্রমে এগিয়ে চলেছে সে। আমার হার্টবিট দুপ দুপ থেকে দ্রিম দ্রিম তালে বাজতে শুরু করেছে! হে আল্লাহ! বিপদে মোরে রক্ষা করো…

আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ; সুবর্ণার শেষ না হলে উঠতে পারছি না। বেচারি এত বড় টেবিলে একা একা খাবে- দৃষ্টিকটু!

মুরগির ঠ্যাং শেষ!

আলহামদুলিল্লাহ! ভাবলাম, এবার সে উঠবে… আমিও উঠতে যাচ্ছি। কিন্তু আমার চোখ বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়! খাসির মাংসের গামলাটা সে এবার নিজের কাছে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। একটা টুকরো তুলে নিলো পাতে। আমি অবাক তাকিয়ে রই। তার কোনোদিকে নজর নেই। ওই দুটো চক চক করছে মাংসের উপরে। আমি অপলক চেয়ে থাকি; সে এবার ভাতে মাংসের ঝোলটা মেখে নেয়। এরপর চার আঙুলের অপূর্ব ভঙ্গিতে মাংসটি মুখের কাছে আনে। অর্ধেক মাংস দাঁতে আর বাকি অংশ হাতে। বেশ কসরৎ করে টেনে ছিঁড়ছে; আমার বুকের শিরা মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাচ্ছে। এবার সামান্য বেদনাহত দৃষ্টিতে আমার পানে চায়, বলে- ভাইয়া মাংসটা বেশ শক্ত!

আমি সবকুল হারানো পথিক! নির্জীব কণ্ঠে বলি, তাহলে ভালো দেখে একটা নাও…

সে আরেক পিস নিতে চাইছিলো মনে হয়। কিন্তু অতিথির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, না থাক!

কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই সে খাওয়া শেষ করে। আর আমিও উঠে যাই। কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। খেয়াল করিনি। আমাকে পিছে ফেলে সে এগিয়ে যায় কাউন্টারে। ম্যানেজারকে উদ্দেশ করে বলে, একটা ঠাণ্ডা দেন! হা স্প্রাইটই দেন…

বিল শোধ করতে গিয়ে গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। আগেই বলেছি, বাড়ির রান্নার মতো বলে এখানকার খাবার সুস্বাদু। তারা চেষ্টা করে বাজারের সেরা খাবারটাই সরবরাহ করতে। সেক্ষেত্রে দামটাও বেশি হয়ে যায়।

গাড়িতে উঠে বসি। আমার ভাবনাজুড়ে সে। কীভাবে এতো খাবার খেয়ে ফেললো। কীভাবে সে এখনও চুপ করে বসে আছে- বমি করছে না কেন- ইত্যকার বিষয় মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে!

গাড়ি চলছে, আমার ভাবনাও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে…

আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি শহরে। অফিসের একটু আগে তাদের বাসা।

ফিসফিস করে সুবর্ণা আমাকে বললো, ভাইয়া, একটু বাসায় নামিয়ে দাও।

জিজ্ঞাসুদৃষ্টি মেলে দিই তার মুখে। সে বলে, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে! গা ঘেমে যাচ্ছে। ­বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করেই ফিরছি… ৫ মিনিট লাগবে।

আমার ধারণা এবার ভুল প্রমাণিত হয়নি। একগাদা খেয়ে তার টয়লেট চেপেছে নিশ্চিত। তবুও নিষেধ করি, যেওনা। গেস্ট চলে যাবে, তার সঙ্গে আমাদের আধঘণ্টার মিটিং আছে। মিটিংশেষে তুমি বাসায় চলে যেও।

: না, ভাইয়া… গা ঘিন ঘিন করছে। প্লিজ!

তাকে নামিয়ে দিই বাসার সামনে। আমরা এগুতে থাকি অফিসের দিকে। পৌঁছে ফ্রেস হই।

এবার গেস্টের সঙ্গে আমাদের লেসন লার্নিং নিয়ে ছোট একটু আলাপ। আমরা বসে আছি, অপেক্ষা করছি সুবর্ণার জন্যে। তার ৫মিনিট পনের মিনিট আগেই শেষ হয়েছে। আমরা গেটের দিকে তাকাই; না কোনও ছায়া-কায়া কিছুই দেখছি না।

এদিকে, গেস্ট চলে যাবেন। তার ফ্লাইটের সময় নিকটবর্তী হচ্ছে। ৫-৭ মিনিট পরেই আমরা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বের হবো। ড্রাইভারকে কল দিয়েছি।

এমন সময় সুবর্ণার আগমন ঘটে। আমাদের প্রতীক্ষার অবসান হয়; তবে, মিটিংটা আর হয় না…

 

কৃতজ্ঞতা:

মনে পড়ে যাচ্ছে উইলিয়াম সমারসেট মম’র গল্প দ্য লাঞ্চন-র  শেষ ক’টা লাইন

….মনে হচ্ছিলো, আমি তার সাথে হাত মিলাচ্ছি, এবং আমি দুপুরে একটার বেশি কিছুই খাই না।

আমি উত্তর দিলাম- আমি আজকে রাতে কিছুই খাবো না!

: হাস্যকর! – সে খুশিতে কেঁদে দিয়ে ক্যাবে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। আপনি সত্যিই মজার মানুষ!

অবশেষে আমার এখন প্রতিশোধ নেবার সময় হয়েছে। আমি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন গড প্রসন্ন বদনে ক্ষমার পক্ষে অবস্থান নেয়।

আজকে তার ওজন ১৩০ কেজি!

 

(এই ঘটনার সঙ্গে কারও মিলে গেলে তা হবে কাকতাল)

তৌহিদ জামান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম, বাংলাদেশের যশোর জেলায় ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল। পড়াশুনো সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত রয়েছেন প্রায় ২০ বছর। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় প্রকল্পভিত্তিক কাজ করেছেন। ছাত্রাবস্থায় প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..