ধানাকাশে কৃষকের পাশে

মাসকাওয়াথ আহসান
রম্য রচনা
Bengali
ধানাকাশে কৃষকের পাশে

ঈদ আসছে; উন্নয়নের বসন্তে ফুলের রেণু মেখে জাপান, সৌদি-আরব, ফিনল্যান্ডে ঈদের ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মহাজনেরা। অনেকে এই ঈদে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কমপক্ষে দার্জিলিং ভ্রমণের ঘোষণা দিচ্ছে ফেসবুকে। লাখ টাকা দামের ঈদের শাড়ি-সালোয়ার কামিজ-পাঞ্জাবি কিনতে মাতোয়ারা উন্নয়নের নয়নের মনিরা।

শুধু ঈদ নেই কৃষকের ঘরে। ধানের দাম যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে বড় রকমের লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। এই কৃষক অসন্তোষকে মোকাবেলা করতে প্রশমন নাট্যদল তাদের ইন্টিমেট থিয়েটার “ধানাকাশে কৃষকের পাশে” নিয়ে হাজির হতে থাকে ধানক্ষেতে।

ইন্টিমেট থিয়েটারে কস্টিউম প্রপস হিসেবে রয়েছে নাট্যদলের নাম লেখা গেঞ্জি, সিল্কের লুঙ্গি, পুলিশের ইউনিফর্ম। নাটকের চরিত্রেরা নাটকের দর্শকের সঙ্গে সরাসরি মেলামেশার এই ইন্টিমেট থিয়েটারে জমে ওঠে চারপাশ।

রাজ পালংকে নিদ্রারত এক প্রশাসককে এসে কৃষি কর্মকর্তা জানায়, স্যার “ধানাকাশে কৃষকের পাশে” নাটকে আপনার রোল আছে।

–এতো রোদে কাটতে হবে ধান; পারবো কী আমি! নাকি দাবদাহে হারাবো প্রাণ।

–মাননীয় আপনি গেলে কৃষকের পাশে; ধন্য হবে তারা; পাওয়া যাবে মিডিয়ার সাড়া।

প্রশাসক ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখে বিরাট এক গাড়ি।

— এ কার গাড়ি একেবারে ব্র্যান্ড নিউ!

কৃষি কর্মকর্তা আহলাদ করে বলে, উন্নয়নের প্রসাদ পেয়েছি স্যার; যাকে বলে ইন সাইডারস ভিউ। কৃষি উন্নয়নে এতো খেটেছি তাই এটা ছিলো ডিউ।

প্রশাসক বলে, এতো রোদে ধান কাটতে হলে ত্বক পুড়ে যাবে;মুখমণ্ডলে দেখা যাবে ফিফটি শেডস অফ গ্রে।

কৃষি কর্মকর্তা সানস্ক্রিনের টিউব এগিয়ে দিয়ে বলে, মুখে মেখে নিলে মুখমণ্ডল রক্ষা পাবে। ছবিতে গ্ল্যামারটা পাওয়া যাবে।

“ধানাকাশে কৃষকের পাশে” থিয়েটারের প্রথম দৃশ্যে প্রশাসকদের ধানক্ষেতে নামতে দেখে কৃষকেরা অবাক হয়। গরীবের ধানক্ষেতে রীতিমত হাতির পা পড়েছে আজ। প্রশাসকদের সহকারিবৃন্দের স্মার্টফোনগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে; প্রশাসকের ধান কাটার দৃশ্য ছবিতে ধরে নিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিতে।

ধান কাটার এক পর্যায়ে প্রশাসক কৃষককে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললে, কৃষকের বুকের মধ্যে ধক ধক করে। রাজ আলিঙ্গনে হার্ট বিট বেড়ে যায়। ফেসবুকে ধন্যবাদ স্যার অভিনন্দন স্যার ভাইয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ে গান ধরে,

“ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য যে”

ইন্টিমেট থিয়েটারে প্রশাসক অংকের পরেই আসে পুলিশ অংক। পুলিশ কর্তাকে ধানক্ষেতে নামতে দেখে কৃষকেরা ভয় পেয়ে যায়। পুলিশ তাদের অভয় দিয়ে বলে, নাই নাই ভয় হবে হবে জয়, আমি তোমাদেরই লোক। ছবি তোলার সময় বিষণ্ণ কৃষকের মুখখানি মুগ্ধতা প্রকাশে ব্যর্থ হয়।

তবুও ধানক্ষেতে পুলিশের আনন্দাশ্রুর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হলে আবার ধন্যবাদ স্যার অভিনন্দন স্যার ভাইয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ে গান ধরে,

“আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে
সেইখানে তোমাকে আমি রেখেছি কতনা যতনে।”

“ধানাকাশে কৃষকের পাশে” আন্তরিক নাটকে তৃতীয় অংকে এসে পড়ে ‘সহমত ভাই’ দৃশ্যাবলী। উন্নয়নের চিহ্ন সম্বলিত গেঞ্জি আর বাহুবলী মডেলের সিল্কের লুঙ্গি পরে সহমত ভাইদের ধানক্ষেতে নামতে দেখে
ভয়ে কৃষকদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। সহমত ভাইয়েরা অভয় দিয়ে ছুঁড়ে দেয় শতাব্দীর অ ব্যর্থ সংলাপ , আমরা কৃষকেরই সন্তান।

ধানক্ষেতে সহমত ভাইদের ছবি ভাইরাল হলে, নেমে আসে পালে পালে সহমত ভাই। তারা গান ধরে,

আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
শাখে শাখে পাখি ডাকে
কত শোভা চারি পাশে।।

আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ