ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
আগেরপর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন: ১ম পর্ব
বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটিতে পার্টির কাজ করতে এসে এক শুভক্ষণে ফেরদৌসির সাথে নায়েবে আমিরের দেখা হয়েছিল। পাক ইসলামি দলের ছাত্র সংগঠন ‘শিবিরে রসুল’ এর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এই ফেরদৌসি। সবুজ স্কার্ফের মধ্যে অনিন্দ্য রক্তিম মুখ, লাজুক অথচ দৃঢ়, প্রথম দর্শনেই নায়েবে নবীর কলিজা হরণ করে। এক আশ্চর্য তন্বী ফেরদৌসি। কনকচাঁপার মতো সোনার আভা তার সর্বাঙ্গে। সবুজ স্কার্ফের মধ্যে সোনালি দ্যুতিময় মুখ সবুজ পাতার মধ্যে ফুটে থাকা যেন এক মোহন গোলাপ, যদিও সে গোলাপ মাংসের। টানা নাকের দুপাশে ভাসা ভাসা দুটি চোখ যেন একজোড়া উৎসুক পাখি- এখনই তা সুদূরে পাখা মেলবে উড়াল দিতে।
বিলায়েত আলির মনে হয় এই উৎসুক চোখ কী যেন খুঁজে ফিরছে। সেই ‘কী যেন’ বস্তুটি আঙুর, জইতুন, তরমুজ সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্গীয় ফলের উদ্যান হবে নায়েবে আমিরের তা মনে হয়নি। কেননা যদিও ইসলামে স্বর্গের বর্ণনায় বরেন্দ্রভূমির মধু-মেওয়া আমের উল্লেখ নেই, যারা বরেন্দ্রভূমির গাছপাকা আম হামেশা খাওয়ার সুযোগ পান মধ্যপ্রাচ্যের ওই সব ফলমূল তাঁদের আর প্রলুব্ধ করে না। তবে মনে হয় ফেরদৌসির চোখ স্বর্গের লাবণ্যময় বালক সাকি-গেলমানের জন্য উঁকিঝুকি মারে। কেননা সে বেহেশতমুখি আদর্শের কর্মী। শিবিরে রসুলের নেত্রী এবং পাক ইসলামি দলের রুকন। শুধু দুনিয়াবি সুখ নয়, মানুষকে বেহেশতের ঠিকানা দেয় যে দল, সে তো পাক ইসলামি দল- এমনই বিশ্বাস ফেরদৌসির। ইতোমধ্যে এই দলে রুকনের মর্যাদায় আসীন হয়েছে সে। তাই স্বর্গের শরাব হুর গেলমানের সুধাময় জগৎ তার নজরে থাকবেই। কিন্তু নায়েবে আমির দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন আপাতত কোনো স্বর্গের গেলমান নয়, ফেরদৌসির চোখ কোনো মাটির মানুষ চায়। সে মানুষ হবে এক শক্তিমান ইসলামি মানুষ। মর্দে মোমেন।
সেদিন বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে এক দীনি ভাইয়ের বাড়িতে এলাকার সদস্যদের নিয়ে নায়েবে নবীর নেতৃত্বে এক সভা হচ্ছিল। সভায় অধিকাংশ সভ্যই ছিল বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। এরকম সভা আগেও হয়েছে। নায়েবে নবী সে সব সভায় আগেও নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু আজকের সভায় ফেরদৌসির উপস্থিতি নায়েবে আমিরের হৃদয়ে ভিন্ন এক আমেজ এনে দেয়, যা তাঁর বক্তৃতাকে আরো বেশি আবেগময় এবং সুললিত করে। তাঁর সে ভাষণ ভীষণ জঙ্গি রূপ নিয়ে উপস্থিত রুকনদের করতালিতে ধন্য হয়।
ইসলামি দীন কায়েমের জন্য প্রতিপক্ষের রগ কাটা তো কোনো বিষয়ই না, বরং প্রতিপক্ষকে হত্যা করা যে জায়েজ এবং ইসলামের নবী স্বয়ং এজন্য সাহাবিদের উৎসাহ-মোবারক দান করেছেন- এ ধরনের বক্তব্য তিনি আগেও ফরমিয়েছেন এবং প্রত্যেক নায়েবে নবীই অনুরূপ বক্তৃতা করে থাকেন। ইসলামি রাজনীতির নিবেদিত ছাত্র ক্যাডাররা এ কাজ অকম্পিত হাতে বিশেষ দক্ষতার সাথেই করে থাকে এবং এ বিদ্যায় খুবই কামিয়াব হওয়ায় ধর্মহীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে তারা লবেজান করে ফেলেছে। পুরা ক্যাম্পাস তাদের দখলে। উপাচার্য তাদের পুতুল, দখলে অধিকাংশ শিক্ষকও। কিন্তু কিছু নাছোড় শিক্ষক আছে যাদেরকে ধর্মনিরপেক্ষতার নাসারা নীতি থেকে টলানো যাচ্ছে না। এদের নিয়ে কী করা যায় এটাই ছিল আজকের সভায় বিশেষ নীতিনির্ধারণী বিষয়।
নায়েবে আমির এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা দেন তাঁর ভাষণপর্বে। যোগ্য তীরন্দাজ যেমন যুদ্ধকালে শত্রুর অবস্থান বুঝে তার তুনে রাখা বিচিত্র তীরভাণ্ডার থেকে উপযুক্ত শরগুলো বের করে এনে নিক্ষেপ করে তেমনি তিনি তাঁর কুরান-ছুন্নার অগাধ এলেমভাণ্ডার থেকে উপযুক্ত আয়াত ও হাদিস তুলে এনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার হৃদয় আদর্শবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন। তরুণ রুকনদের মধ্যে শুধু ‘মারহাবা মারহাবা’ রব। কখনো কখনো ‘আল্লাহ আকবর’ তকবির ধ্বনিতে কম্পিত হয় সভাকক্ষ। নায়েবে নবী লক্ষ করেন সভার প্রথম সারিতে বসা এক স্বর্গহুরতুল্য রমণীর গোলাপী শরীর যেন ভক্তিভরে কম্পিত হচ্ছে। তার দৃষ্টি বক্তার চোখে নিবন্ধ হয়ে আছে আর মুখ থেকে শুধু মারহাবা-মারহাবা ধ্বনি উঠছে। সে ধ্বনি বড় মিষ্টি। যেন ভুবন ভরে উঠছে সে ধ্বনিতে ।
ওস্তাদ-শিক্ষকের কদর ইসলামে বিশেষভাবে স্বীকৃত। এতদিন ছাত্র-ছাত্রীদের রগ কেটে তাদের নুলো-ন্যাংড়া করে দিলেও বা কাউকে হত্যা করে গুম করে ফেললেও তাতে ক্যাডারদের কোনো পিছু টান ছিল না। এখন নায়েবে নবী বিলায়েত আলির সহি ভাষণের পর কারও আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলো না যে দীন প্রতিষ্ঠার রাজনীতির স্বার্থে ধর্মহীন ওস্তাদগুলোর রগ কাটাই শুধু নয় তাদের খুন করে ম্যানহোলে ফেলে গুম করলেও কোনো সমস্যা নেই। বরং বিনা হিসাবে বেহেশতে যাওয়া যায়। হুর গেলমানের বরাদ্দও বেশি হয়। নায়েবে আমির তাঁর ভাষণে আরও বলেন, পাক ইসলামি দলের ঐতিহ্যের দিকে আপনারা লক্ষ রাখবেন। তাহলে কোনো দুর্বলতাই আপনাদের মনে দ্বিধা তৈরি করতে পারবে না। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর স্মরণে রাখলেই কোনো ভীরুতা, কোনো দোদুল্যমানতা আপনাদের স্পর্শ করবে না। পাক বদর বাহিনীর ধর্মযোদ্ধারা সেদিন পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ঢাকা ইউনিভার্সিটির একদল মুরতাদ শিক্ষক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি তাই আমাদের অহংকার। বদর প্রান্তরের মতো আমাদের অনুপ্রেরণা, সাহস ও শৌর্যবীর্যের চিরন্তর উৎস। সে সময়ের বদর বাহিনী আমাদের পাক ইসলামি দলের মতোই ছিল একটি সহি ইসলামি দল।
মিটিং শেষ হয়ে যায়। হাজেরানে রুকনগণ একে একে নায়েবে নবীর কাছে এসে শুকরিয়া জানিয়ে যায়। নায়েবে নবী তাদের কারো কারো নাম জিজ্ঞাসা করেন। ছেলেদের সাথে হ্যান্ডশেকও করেন। এবার লাইনে আসে ফেরদৌসি। নায়েবের নবী তার নাম জানতে চান। জবাব পেয়ে হাসিমুখে নায়েবে নবী বলেন, মারহাবা। ভারি সুন্দর নাম তোমার ফেরদৌসি! সভায় যে ভক্তি আর আন্তরিকতা তোমার মধ্যে লক্ষ করেছি তাতে তুমি যে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিবাসী হবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই মা। তোমাকে অন্তর থেকে ‘মা’ ডেকে ফেললাম। তুমি যে দেখতে আমার মেয়ের মতো। এই নাও আমার ভিজিটিং কার্ড। ফোন দিয়ো।
ফেরদৌসি অভিভূত হয়ে যায়। নায়েবে নবীর খেজাব দেওয়া কালো কুচকুচে দাড়ি, খাটো করে ছাঁটা গোঁফ, লম্বা গোল টুপি, ফর্সা শরীরকে ঘিরে জরির কাজ করা দামি শেরওয়ানি, বাহারি নাগরা জুতা, চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা আর সর্বোপরি তাঁর তেজোদীপ্ত, সুললিত ভাষণ ফেরদৌসিকে মুগ্ধ করেছিল। সে তখন শুধু জিহাদি জোশের স্রোতেই নয়, রসের প্লাবনেও ভাসছিল। তার যৌবন-নিকুঞ্জে হঠাৎ যেন কোকিল এসে তুলেছিল কুহুতান । কিন্তু নায়েবে আমিরের ‘মা’ ডাক যেন সবকিছু উলোট-পালট করে দেয়। নায়েবে নবী না হলে যে নায়েবে আমির হওয়া যায় না ফেরদৌসি মনে মনে এরকম একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে প্রবোধ খোঁজে। তবু কোত্থেকে যেন অকাল দখিন হাওয়া এসে থেকে থেকে ফেরদৌসিকে অধীর করে যায়। এ অধীরতার কারণ সে বোঝে না। দেহজ কামনা আর সে কামনাতাড়িত প্রেমাবেগ কখন যে কি ভাবে জাগ্রত হয় তা কেউ বলতে পারে না। এ এক গভীর রহস্য। এ গভীর রহস্যজালে যুবতী কেন কিশোরী কন্যাও বৃদ্ধের প্রেমে পড়ে। আবার কোনো কিশোরও বিগত যৌবনা নারীর মায়ায় পড়ে যায়। ফেরদৌসি হোস্টেলে ফিরে যায়। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নায়েবে আমিরের ভিজিটিং কার্ডখানি বের করে। দামি কাগজে সোনালি হরফে লেখা ভিজিটিং কার্ড। নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর লেখা ইংরেজি আর আরবিতে। আরবি হরফগুলো ইংরেজি হরফ থেকে উত্তম। আল্লাহর মনোনীত ভাষা আরবির প্রতি ফেরদৌসির ভক্তি আরও বেড়ে যায়। আর যে মহামানব, ইনসানে কামেল, ইংরেজির পাশাপাশি আরবিতেও নেমকার্ড ছেপেছেন, তাঁর প্রতি ফেরদৌসির আস্থা-ভক্তি দশগুণ বেড়ে যায়।
পরদিন ফেরদৌসি ভিজিটিং কার্ডটি নেড়ে চেড়ে দেখে শ্রদ্ধায় চুমু খেয়ে নিজ বুকের মাঝখানে ভক্তিভরে কিছুক্ষণ চেপে রেখে আবার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতরের পকেটে খুব যত্ন করে রেখে দেয়। ইংরেজি-আরবিতে লেখা এ ভিজিটিং কার্ডটিতে সে বেহেশতের সুসংবাদ খোঁজে আর ভাবে, আর বিলম্ব নয়, কালই নায়েবে আমিরকে রিং করতে হবে।
নায়েবে আমিরের মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। রিংটোনে সুরা আররহমানের সুললিত তেলাওয়াত ধ্বনি। সে ধ্বনি বেশি দূর না এগুতেই রিসিভারে ভরাট কণ্ঠের ‘হ্যালো’ ভেসে আসে। শিহরিত ফেরদৌসি পরম-ভক্তি ও আবেগের সাথে কাঁপা কণ্ঠে দ্রুত আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে।
ওপাশ থেকে অত্যন্ত আন্তরিক কণ্ঠে “ওয়ালাইকুমআসসালাম ওয়া রহমাতুল্লিলা জবাব আসে, আর সাথে সাথে প্রশ্ন : তুমি ভালো আছ ফেরদৌসি?
ফেরদৌসী জবাব দেয়, জি।
ভক্তি আর শরমে কেঁপে যায় যেন এ জি-ধ্বনি। ফোনের ওপারে নায়েবে আমিরকে ফেরদৌসি যেন দেখতে পায়। শরমে তার ফর্সা মুখ রক্তিম হয়ে উঠে।
: তুমি ফোন করাতে আমি খুশি হয়েছি। জানো ফেরদৌসি কালকের সভায় তোমরা অনেক ছাত্র-ছাত্রী যোগ দিয়েছিল। তোমাদের মধ্যে যে নিবেদন এবং উৎসাহ দেখেছি তাতে আমি মুগ্ধ। তোমাদের সবাইকে মনে হচ্ছিল এক এক জন সত্যিকার আল্লাহর সেনা। ইসলামের প্রথম যুগে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে দীনের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য যে উৎসাহ দেখা গেছে, তোমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা শুধু তার তুল্য হতে পারে। ইতোমধ্যে নায়েবে নবীর পকেটে অন্য একটা মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ফেরদৌসি সে রিংটোন শুনতে পায়। এই রিং টোনে বাজে অন্য সুরা। ফেরদৌসি শুনতে পায়। রিংটোন বলছে ‘ইয়াসিনাল কুরআনুল হাকিম’। নায়েবে নবী বলেন, একটু হোল্ড কর ফেরদৌসি। তোমাদের ভিসি সাহেব লাইনে আছেন।
ফেরদৌসি অবাক হয়ে যায়। একাধিক মোবাইল ফোন, প্রতিটির রিংটোনে কুরআনের আয়াত-শুধু সে জন্য নয়- এমন অসময়ে স্বয়ং তার ইউনিভার্সিটির ভিসি সাহেব নায়েবে আমিরকে ফোন করেছেন! অথচ তিনি ধানুয়াপুরের নায়েবে আমির, কেন্দ্রের কোনো বড় নেতা নন! ফেরদৌসির বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে নায়েবে আমিরের সাথে ভিসি সাহেবের কথা হতে থাকে। দু’জনের কথোপকথন অন্য ফোনে অপেক্ষায় থাকা ফেরদৌসির কাছে কখনও স্পষ্ট, কখনও হালকা শুনা যায় তবে বক্তব্য ঠিক বুঝে উঠা যায় না। যদিও ফেরদৌসি বুঝতে পারে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কথা হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে। ফেরদৌসি তার ছাত্র সংগঠনের সূত্রে এও জানে যে, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ভিসি সাহেব একটু যেন ঝামেলায় পড়ে গেছেন। তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠনের সিনিয়র ভাই, সিনিয়র রুকন এরাকাত সালেহিনকে নিয়োগ দিতে ভিসি সাহেবের প্রতি চাপ রাখা হয়েছে। ভিসিও তা চান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এরাকাত সালেহিন ভাইয়ের চেয়ে তিনজন যোগ্যতর ক্যানডিডেট রয়ে গেছে। এরাকাত ভাই সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট। কিন্তু বাকি তিন জনের ফাস্ট ক্লাস। এর মধ্যে গৌতম ভৌমিক নামে যে মালাউন আছে সে সমাজ বিজ্ঞানে ফাষ্ট ক্লাস ফাষ্ট হয়েছিল। ইতোমধ্যে এম.ফিল করেছে। দেশেবিদেশি জার্নালে তার লেখাও ছাপা হয়েছে। তুখোড় এ ছেলে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে চাকরি প্রার্থী। পরীক্ষায় মেধা তালিকায়ও প্রথম স্থান অধিকার করে বসে আছে। আর পরের দুজন মুতালিব এবং আনোয়ার যথাক্রমে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পজিশনে। চার নম্বরে এসেছে এরাকাত ভাই। তাই এরাকাত ভাই-র চাকরি নিয়ে ভিসি স্যার সমস্যায় আছেন এ কথা ফেরদৌসির জানা। সেই ভিসি সাহেব এখন নায়েবে আমিরকে ফোন করেছেন আর কথা বলছেন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের নিয়োগ নিয়ে। নায়েবে আমিরকে বরেন্দ্র ভার্সিটির জন্য অপরিহার্য লোক মনে হয় ফেরদৌসির।
হোল্ড অন থাকা অবস্থায় এ সকল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফেরদৌসি পুনরায় নায়েবে নবীর হ্যালো কানে আসে। ভিসি সাহেবের অন্য ফোন এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
: দুঃখিত ফেরদৌসি, তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় রেখেছি। তোমাদের ভিসি ফোনে ছিলেন। তবে তুমি শুনে খুশি হবে যে, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে আল্লাহর সৈনিকদের অর্থাৎ তোমাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলাম। এটা ছিল আমাদের ইজ্জতের সোয়াল, অস্তিত্বের প্রশ্ন। বুঝলে ফেরদৌসি, তোমাদের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলছি। আমাদের শক্তিশালী কর্মী এরাকাতকে চাকরি দেয়া হলো। ভিসিকে কেন্দ্রের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে এ কাজ করলাম।
ফেরদৌসি খুশি হয়। ‘আলহামদুলিল্লা’ বলে শোকর গোজার করে। তবে ফেরদৌসি প্রশ্ন করে : কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হলো? এরাকাত ভাই তো চার নম্বরে ছিলেন?
: হাঁ, এরাকাত মেধা তালিকায় চার নম্বর ছিল। কিন্তু আমাদের তালিকায় সে ছিল নম্বর এক-এ, তাই তারই চাকরি হলো।
: কিন্তু কি ভাবে? এ তালিকার বিষয় তো ভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষক সবাই জানে। এরাকাত ভাই তো চার নম্বরে যা সকলের মুখে মুখে আছে।
: হ্যাঁ, এ জন্যই তো সমস্যা হচ্ছিল। তোমাদের ভিসি সাহেব জোট সরকারের খাস লোক এতে সন্দেহ নেই। তোমাদের কল্যাণে তিনি যা করছেন তাও মনে রাখার মতো। কিন্তু লোকটা ট্যাক্টফুল না। এ মেধা তালিকা তার সকলকে জানতে দেয়া ঠিক হয়নি। এ জন্যই বেঁধে গিয়েছিল যত ঝামেলা। কাফের শিক্ষকগুলো গৌতমের নিয়োগের জন্য একাট্টা হয়ে অবস্থান নেয়। সে ফাষ্ট হয়েছে। তাকে চাকরি দেয়া নাকি জাস্টিস। তাকে চাকরি না দিলে নাকি গণতন্ত্র থাকবে না, যত সব! ওরা বুঝতে চায় না যে, আল্লাহর নবী স্বয়ং বলেছেন দানের ক্ষেত্রে তোমরা স্বজনদের প্রাধান্য দিবে। এমন যে খ্রিস্টান, তারাও তো বলেছে চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম। তো কে তোমাদের আপন লোক কও, এরাকাত না ওই মালাউন গৌতম?
এরাকাত ভাই এর আগেও যে দুজন প্রার্থী রয়ে গেছেন তারাও তো মুসলিম, ফেরদৌসি প্রশ্ন রাখে।
: দেখ তারা মুসলিম হলেও নামের মুসলিম, কামে না। এদের দুজনের একজন নামাজ পড়ে না। আর দুজনই সমাজ বিজ্ঞানে যা যা পড়েছে তাই বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে আদিম মানব অসভ্য ও বন্য ছিল। তারা উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করত। তখন ধর্ম ছিল না, যাদু বিশ্বাস দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত হতো। প্রকৃতির শক্তির সম্মন্ধে অজ্ঞতা ও ভয় থেকে মানুষ দেব-দেবীর উপর বিশ্বাস তৈরি করেছে, দেবতা মানুষেরই সৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। কও দেখি, এই সব চুদানির পুতদের তুমি মুসলমান বলো? নাউজুবিল্লাহ! মুখ খারাপ করে ফেললাম। কিছু মনে করো না ফেরদৌসি। কাফের-ফাসেকদের ঘৃণা করলেও তাতে সোয়াব। ওদের ঘৃণা জানাতে আমি মুখ খারাপ করি। আসলে আমি ইসলামবিরোধী হারামজাদাদের ঘৃণা জানাতে মুখ খারাপ না করে পারি না। এতে ক্ষতি নেই বরং সোয়াব আছে।
: ওদের বিশ্বাস সম্পর্কে যা বলছেন, অর্থাৎ ওরা সমাজ বিজ্ঞানে যা লেখা আছে তাই সত্য মানে, এ কথা আপনি জানলেন কেমনে?
: আরে তুমি বলছ কি! আমাদের হাতে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে না? তাছাড়া ওদের কিছু লেখালেখি আছে, তুমি পড়ে দেখ। সেখানে আমি যেসব কথা বললাম তাই লেখা আছে। এর থেকেও খারাপ কথা আছে সে লেখায় যা তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু প্রশ্ন যখন করলেই তখন বলি শুন, আদিম যুগে মানুষ নাকি দলবদ্ধ হয়ে সেক্স করত। সমাজে কারও নাকি নির্দিষ্ট নারী ছিল না – নর-নারী সারাক্ষণ উলঙ্গ হয়ে থাকত এবং যে কোনো নারীকে যে কোনো পুরুষ খেলতে পারত। কও দেখি বেলেল্লাদের কথা! তাহলে আমাদের হযরত আদম আর মা হাওয়ার অবস্থান কী দাঁড়ায়? তাঁরা কি অসভ্য ছিলেন? -এরপর তিনি বিরক্তি মিশ্রিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, তওবা-তওবা। অতপর ছোট করে একটু গলা খাকারি দিয়ে পুনরায় শুরু করেন, আর কারও নির্দিষ্ট নারী ছিল না হারামজাদাদের একথা সত্য হলে তো হজরত কাবিল (আঃ) হজরত হাবিল (আঃ) কে খুন করে ফেলতেন না। হাবিল (আঃ) এর স্ত্রীর সাথে তিনি ইচ্ছামত মিলতে পারতেন। ইসলামের ইতিহাস তাহলে আর প্রথম বারের মতো ভ্রাতৃহত্যার অপরাধে কলংকিত হতো না।
: তা সত্য হুজুর, কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান তো অনুরূপ শিক্ষাই দেয়। আমি ইউনিভার্সিটির সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের এক ম্যাগাজিনে মুতালিব সাহেবের একটি লেখা পড়েছি। যিনি বর্তমানে মেধা তালিকায় দ্বিতীয়। এ ধরণের কথা, অর্থাৎ বন্য স্তর থেকে বিবর্তনের ধারায় মানুষের ক্রমান্বয়ে সভ্য হওয়ার কথা সে লেখায় দেখেছি। কিন্তু তাতে তো সমাজ গবেষকদের রেফারেন্স আছে? সমাজ বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা নিয়েই সমাজ বিজ্ঞানের কারবার। এজন্য ওনাদের দোষ কোথায়? ওনাদের বরং বুঝিয়ে বলা যায়, ওই সব লেখা পাশের জন্য পড়, মুখস্ত করো, কিন্তু বিশ্বাস করো না। এ সব বিশ্বাস করা গুনাহ্ কাজ।
: বুঝাতে চাইলেই কি ওরা বুঝবে ফেরদৌসি? আসলে ওরা বুঝতে চাইবে না। কাফেরের বিদ্যা ওদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছে। হাঁ বুঝতে পারছি ফেরদৌসি ওরা কি বলতে চায়। হযরত আদম (আঃ) এবং মা হাওয়াকে দিয়ে শুরু করলে ওদের সমাজ বিজ্ঞান হয় না। বলো ফেরদৌসি পবিত্র কোরন কি সমাজ বিজ্ঞান নয়? মার্কস, এঞ্জেলস, ডারউইন, ম্যাকওয়েভারদের গবেষণা কি কোরানুল করিম অপেক্ষা বড়? বলো, তুমিই বলো ফেরদৌসি! – সমাজবিজ্ঞানে কোরানুল করিমের বিপরীত বক্তব্যে ব্যথিত নায়েবে নবীর কণ্ঠ সে মুহূর্তে বড় করুণ শোনায়। অতঃপর তিনি সুরেলা সহি উচ্চারণে সুরা বাকারার প্রথম কয়েক লাইন পাঠ করেন, যাতে বলা হয়েছে এ কুরানে কোনো সন্দেহ নেই।
পবিত্র কোরানের সত্যতা সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিনের এই অমোঘ ঘোষণা ফেরদৌসির অজানা নয়। নায়েবে নবীর মুখে সে কথা শুনে, ফেরদৌসি যেন ভয়ে কুকড়ে ওঠেন। কী কথা বলে কী পাপ হলো এই ভেবে ভয়ে ফেরদৌসির মুখ শুকিয়ে যায়।
নায়েবে আমির বলেই চলেছেন- আমাদের এরাকাত নেককার বান্দা। পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে যেয়ে খুশু খুশু দিলে জামাতে শরিক হয়। মার্কস, এঞ্জেলস, ডারউইনকে সে ভালোভাবে নিতে পারেনি এজন্য দেশি-বিদেশি পত্র পত্রিকায় তার গবেষণা প্রবন্ধ বের হয়নি বুঝলে? আর এ কারণে মেধা তালিকায় তার জায়গা হয়েছে চার নম্বরে। একজন প্রকৃত মুমেন কাফেরদের আইডিয়া ধার করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কুরানুল করিমকে ছোট করতে পারে না। এই অপরাধে তাকে মেধা তালিকায় নিম্নে যেতে হবে? এটা কি ইনসাফ? তাই আমরা বলে দিয়েছি নম্বর চারই নম্বর এক। অর্থাৎ এরাকাতই ফার্স্ট – তার চাকরি হবে।
: কিন্তু …
: আর কোনো কিন্তুর অবকাশ নেই ফেরদৌসি। তুমি তো বলতে চাচ্ছ, ওই সেক্যুলারের বাচ্ছারা, কিস্তিপন্থি কুত্তাগুলো এতে নাখোশ হবে। ও নিয়ে চিন্তা করো না। কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করে কিন্তু ক্যারাভান এগিয়ে যায়। এরাকাতের চাকরির ফয়সালা আগেই হয়ে গেছে। আমাদের বস ম্যাডামের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। বসের আদেশই আমি শুধু ভিসিকে জানিয়ে দিলাম।
কথার মধ্যেই হঠাৎ ফেরদৌসি অন্য একটি ফোনে রিংটোন শুনতে পেলেন। এটা সুরা আর রহমান বা সুরা ইয়াসিন এর রিংটোন নয়। এটায় শুনা গেল: আলিফ-লাম-মিম যালেকাল কিতাবু…। সুরা বাকারার আয়াত। বড়ই সুরেলা আওয়াজ, কানে যেন সুধা বর্ষণ করে। ফোনটি বেজে উঠেছে নায়েবে আমিরের অন্য এক পকেটে। তাই তিনি অতি বিচলিত হয়ে ফেরদৌসিকে বললেন, লক্ষ্মীটি একটু হোল্ড, একটু হোল্ড করো। গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..