ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
শিরোনাম: ধানুয়াপুরের নায়েবে আমির
উৎসর্গ: সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতামুক্ত, উদার মানবিক চেতনাঋদ্ধ যাঁদের হৃদয়
লেখকের কথা: ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মের নির্দয় অপব্যবহারের করুণ কাহিনী এটি। ধর্মীয় রাজনীতির কলা-কুশিলবদের এক নিদারুণ নৈতিক অধঃপতনের প্রতিপাদ্যও বটে। এর পাত্র-পাত্রী কাল্পনিক। তবে ঘটনা বাস্তব জগতের। এ জন্য কোনো চরিত্রের সাথে কোনো ঘটনা মিলে গেলে লেখক বা প্রকাশককে দায়ী করা যাবে না।
পর্ব- ১
সেই সক্কাল বেলা ফজরের নামাজের পর মোবাইল বেজে উঠতেই চঁড়–ইপাড়ার কাজী সাহেবের মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ফোন করেছেন তারই পুরনো বন্ধু ধনবাড়িয়া দারুল এহসান মাদ্রাসায় তাঁর সহপাঠী এখন ধানুয়াপুরের নায়েবে আমির আলহাজ মাওলানা বিলায়েত আলি। সাতবনিয়া কিবলা হুজুরের মাদ্রাসা, কচুড়িপাড়া বড় হুজুরের মাদ্রাসা শেষ করে মদিনা শরিফেও লেখাপড়া করেছেন এই বিলায়েত আলি। এখন তিনি মস্ত বড় এলেমদার। তার উপর আছে সৌদি কানেকশন। ইসলামি রাজনীতি তথা দুনিয়া-ভি-আখিরাতের কল্যাণে একমাত্র মহান গণতান্ত্রিক দল পাক ইসলামি দলের সংগেও নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়েছেন। এখন পদমর্যাদায় তিনি ধানুয়াপুরে নায়েবের আমির। ভ্রমরকৃষ্ণ রেশমি দাড়ি এবং মনোযোগের সাথে ছাটা ছোট ছোট গোঁফের মধ্যে নায়েবে আমিরের গোলাপি পুরু ঠোঁট দু’টি সবার দৃষ্টি কাড়ে। আর তিনি যখন এই ঘনকৃষ্ণ শ্মশ্রু স্তূপের ভিতর থেকে অসম্ভব সুন্দর ঠোঁট দু’টি নাড়িয়ে প্রাঞ্জল সুরে কোরান-হাদিস আবৃত্তি করে বক্তৃতা করেন, তখন তা দর্শক শ্রোতাদের মন জুড়িয়ে দেয়। এলেম, ওয়াজ আর আভিজাত্যের গুণে এলাকাবাসী এ নায়েবে আমিরকে নায়েবে নবী জ্ঞানে সম্মান করেন। নায়েবে আমির অপেক্ষা ‘নায়েবে’ নবী হিসেবে সম্বোধিত হলে তিনি বরং বেশি আত্ম-তৃপ্তি লাভ করেন। কিন্তু এ নায়েবে নবীর ভিতরের চেহারা যে কী তা বাল্যবন্ধু চঁড়–ইপাড়ার কাজীর আলবত জানা আছে। সে যা হোক নায়েবে আমিরের দীর্ঘ শরীর, তুখোড় স্বাস্থ্য, দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রং, পুরু গোলাপি ঠোঁট, দীর্ঘ নূরানী দাড়ি, মদিনা শরিফের পড়ালেখা এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য কানেকশন পাক ইসলামি দলের আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
চঁড়–ইপাড়ার কাজী সেই ছোটবেলার মাদ্রাসা জীবন থেকে সহপাঠি বিলায়েতের ভক্ত ও অনুরক্ত। কিন্তু তার আফসোসও আছে বরাবর। বিলায়েতের মতো তাঁর ভাগ্য কখনো সুপ্রসন্ন ছিল না। দ্বীনি লাইনে পশার জমাতে গেলে রহস্যময়তা তৈরিতে জেল্লাদার দীর্ঘ ঘন চাপদাড়ির একটি বাড়তি সুবিধা থাকে। কিন্তু থুতনিতে দুগাছি ছাগুলে দাড়ি নিয়ে চঁড়–ইপাড়ার কাজীর মনে আফসোসের শেষ নেই। বিলায়েতের উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়ই বলেন, আল্লায় যারে দেয় তারে ছাপ্পড় ভইরা দেয়।
টেলিফোনে বিলায়েত আলির কথা শুনেই চঁড়–ইপাড়ার কাজী খিকখিক করে হেসে ওঠেন। বলেন, তুই বেটা মস্ত বড় এলেমদার। রাজনীতিতে নেমে বিরাট ধনী আর নামজাদা হয়েছিস। কিন্তু ছোটবেলার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারস নাই। তা এ মাল বাগালি কেমনে? এমন এলেমদার আর ইংরেজি মাল? কী বললি, কোন ইউনির্ভাসিটি? ও বরেন্দ্র? কিসে পাশ দিছে?
: না পাস দেয়নি এখনো। অনার্স পড়ছে। থার্ড ইয়ারে। পলিটিক্যাল সায়েন্স।
: কী সায়েন্স-ফষ্টিনষ্টি সায়েন্স? –কাজী সাহেব খিকখিক করে হাসেন।
হাসিটা মর্দা পাতিহাঁসের ডাকের মতো ফ্যাসফেসে হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
কাজী সাহেবের বিবি রোকেয়া অবশ্য ভোরে একটু বেশি ঘুমান। ফোনে হাসাহাসি আর কথার আওয়াজে ভোরের নিদ্রার ব্যঘাত হলে রোকেয়া আবার খিক্কিরি মেরে উঠবে, ঘাপান লাগাবে নির্ঘাত। তাই ফোনে নায়েবে নবীর কথায় অফুরন্ত আমোদের ব্যাপার থাকলেও কাজী ভয়ে ভয়ে নিম্নকণ্ঠে খিকখিক করেন। বেতমিজ মহিলা সুবেহ সাদেকের সময় হলে তার নাক ডাকে বেশি। মনে মনে কথাগুলো ভেবে কাজী সাহেব ঘুমন্ত রোকেয়ার দিকে বার বার তাকান।
বন্ধু নায়েবে আমিরের ফোন, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটির তরুণীর সেপাত-সুরতের বর্ণনা, আর পাশাপাশি স্ত্রী ধুমশো বেঢক মাংশপি-, দস্তার গোলার মতো বেড়াল-মুখ কাজী সাহেবকে বড় ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু কী করা যাবে, জাঁদরেল মহিলা রোকেয়া, শরিয়ত মানে না। কাহালুর মওলানা ফয়েজুল্লাকে ধরে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কাজীর লাইসেন্স পাওয়ার পর এই এগারো বছরে চঁড়ইপাড়ার কাজী কয়েক হাজার বিয়ে পড়ালেন। আহা কত থরথর তরুণীর মুখ থেকে কবুল ধ্বনি তিনি শুনলেন এই কাজী জীবনে! তার কী ইচ্ছা হয় না নিজের জন্য আরেকটা বিবি জোগাড় করতে! কিন্তু কী করার আছে? চার নিকাহ শরিয়তে হালাল-এ কথা রোকেয়াকে বোঝায় কে? একবার কাজি সাহেব মামাতো শালি তরুণী বিধবা তহুরাকে বিয়ের জন্য রোকেয়ার অনুমতি চান। কত করে বুঝান বিয়ে তো আর সুখের জন্য নয়, একটা পুলার জন্যে। আর তহুরা নরম-দরম, শান্ত-শিষ্ট মেয়ে, তারই বোন। তার অনুগত হয়েই থাকবে। কিন্তু কোনো কথাই রোকেয়ার কাছে হালে পানি পায় না। বদমেজাজি রোকেয়ার চিৎকারে কাজীর স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়। এর পরও কাজি বড় রিস্ক নিয়েছিলেন বিয়ে করবেন বলে। গেল বার গাবতলীর ইদ্রিস মাতুব্বরের মেয়ে ফাতিমাকে বিয়ে করার জন্য কাজী সাহেব রোকেয়ার কাছে প্রস্তাব পেড়েছিলেন। আগের মতোই অনড় অবস্থা রোকেয়ার। তিনি এত বোঝালেন যে ফাতিমা মেয়েটা ভালো। এ সংসারে এলে সে তাঁর ছোটবোনের মতো থাকবে। কিন্তু তাতে ফল হয় নি। তাই গোপনেই কাজী ফাতিমাকে বিয়ের ফিকির চালিয়ে যান। কিন্তু বদ কপাল যে কাজীর। নারীভাগ্য নিয়ে তিনি আসেন নি। তাই এবার বাদ সাধল ফাতিমার বাবা ইদ্রিস মাতব্বর।
সদরপুরের ফেলু মেম্বারের ছেলে আবুল কালামের সাথে বিয়ে হয়েছিল ফাতিমার। কিন্তু আবুল কালাম একটা অমানুষ। ইদ্রিস মাতুব্বর নিজের টাকায় কাহালু বাজারে জামাইয়ের জন্য মুদি দোকান সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে কী হবে। আবুল কালামের ঘর ফাতেমা করতে পারে নি। পারতো তাস খেলার সাথে যদি ওর অন্য বদ অভ্যাস না থাকত। শুধু মদ তাড়ি নয়, আমড়াতলার জুলাপল্লীর করিমনের সাথে রাত কাটিয়ে ভোরে বাড়ি ফেরে প্রায়ই। কিছু বলতে গেলেই ফাতিমার কপালে জোটে বেদম মার। মা-মাতারি তুলে গালাগালতো আছেই। ভাদাইমা মাতালের মুখে কিছুই বাঁধে না। তাই পরির মতো মেয়ে ফাতিমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন ইদ্রিস মাতুব্বর।
কাজী গাবতলী এলাকায় বিয়ে পড়াতে গেলে ইদ্রিস মাতুব্বরের বাড়িতে একটু না বেড়িয়ে পারেন না। মেয়ে নিয়েই আলাপ মাতুব্বরের। কাজী সাহেবের এ আলোচনা ভালো লাগে। দু-এক পোলা এর মধ্যে ফাতিমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু মাতুব্বরের মন সায় দেয় না। ইংরেজি পড়া পোলাপান আর নয়। এবার মাতুব্বর দীনদার আলেম খুঁজছেন মেয়ের জন্য। এরূপ পোলা পেলে দক্ষিণ ডাঙার তিন কানি দো-ফসলা ধানি জমি তিনি লিখে দেবেন জামাইয়ের নামে।
অনেকবারই তো চঁড়–ইপাড়ার কাজী ইদ্রিস মাতুব্বরের বারান্দায় বসে গল্পগুজব করলেন, খাওয়া-দাওয়াও সারলেন, কিন্তু ফাতিমাকে তো তিনি দেখতে পেলেন না। ফাতিমা ঘরের ভিতর থেকে বের হয় না নাকি? তিন কানি ধানি জমির কথা শুনে কাজী সাহেবের মনটা ফাতিমার জন্য আরো বেশি চনমন করে। কী ভাবে ফাতিমাকে দেখা যায়? কাজীর মন আজ বড় বেপরোয়া। তিনি ফাতিমাকে একনজর দেখবেনই।
কাজী মাতুব্বরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাতবর সাহেব, বিয়ে নিকেহ্ তো কম পড়ালাম না প্রায় এক যুগের কাজী জীবনে। তালাকের এত্তেলাও কম দেখি নাই। বিয়ের পর ফদ্দ-ফ্যাসাদেরও কমতি নেই। এ সবই হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষার কুফল। আসলে ইংরেজি শিক্ষা সমাজে ক্যানসারের মতো ছড়ানোর কারণে মেয়েদের সুখ-শান্তি বরবাদ হয়ে গেছে। তালাক হচ্ছে হরহামেশা। আমার অফিসেও তালাকপ্রাপ্তদের কাবিননামার নকলের ফরমায়েশ হরদম লেগে আছে। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে। করবেন কী? আখেরি জামানা। ইংরেজি পোলা মেয়ের জন্য পেয়ে গেলে মেয়ের বাবাদের আর ডান-বাম জ্ঞান থাকে না। মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর পস্তায়। তো আপনার দীনি এলেমদার ছেলের নিয়ডটি ভালা। দেখমু নি। কাজীর পেশা ঘটকালির পেশা নয়। তবে এ পেশায় যখন আছি পোলা পানের সাক্ষাৎও মেলে। যদিও সত্যিকার দীনি আলেম পাওয়া ভার। এরপর দাড়িতে একটু হাত বুলিয়ে কণ্ঠস্বরে এক ধরনের ব্যাকুলতা এনে কাজী বলেন, কিন্তু আপনার মাইয়াডা তো এক নজর দেখলাম না। ঘটকালি করবার লাগলেও মেয়ের চেহারা-সুরতের একটা বর্ণনা দিতে হয়। এ জন্য একটু দেখনের দরকার হয় – বুঝলেন তো মাতবর সাব? মেয়েডাবে এক নজর না দেখলে কি চলে!
মাতুব্বর সাহেব বলেন, কাজী ভাই কী আর কইব। ছাড়াছাড়ির দুর্ঘটনার পর মেয়েটা আমার যেন মিইয়ে গেছে। মুখে রা নেই। ঘরের ভিতর থেকে বের হতেই চায় না একেবারে। তো আমি ব্যবস্থা করছি। এই বলে ইদ্রিস মাতুব্বর মেয়ে ফাতিমাকে ডাক দেন: ওমা ফাতিমা! একটা পান বানিয়ে আন তো। তোমার কাজী চাচা খাবে।
একটু পরেই পিতলের পানদানিতে পান আসে। কিন্তু তার সাথে ফাতিমার মুখ আসে না। মুখ দরজার আড়ালে রেখে ফাতিমা হাত দিয়ে বারান্দায় পানদানি বাড়িয়ে দেয়। মাতুব্বর পানদানিটা মেয়ের হাত থেকে ধরে নেন। আর ধরতে ধরতে বলেন : মা এত লজ্জা করচ্চু ক্যা। চঁড়–ইপাড়ার কাজী সাহেব হামার বড় পেয়ারের লোক। খুব মহৎ মানুষ। বুজুর্গ ব্যক্তি। তোমার চাচা হয়। তার সামনে আসতে কিসের শরম?
ফাতিমা তবুও সামনে আসে না। সে যেন দরজা আগলে আরও ভিতরে সেঁধিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মাতুব্বরের কথা শেষ হলে এক অস্বস্তিকর নীরবতা যেন গ্রামীণ কোলাহলময় দুপুরকে ঢেকে দেয়। সে নীরবতা চঁড়–ইপাড়ার কাজীর সপ্রতিভ মুখম-লকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু কাজীর অন্তর্লোক তখন এক মধুর আলোতে উদ্ভাসিত। সে আলো একটি গোলগাল হলুদ রংয়ের হাত থেকে নিঃসরিত হয়েছিল। ফর্সা সে হাতের চাঁপা কলার মতো আঙুলের অগ্রভাগ ছিল মেহেদির লাল রঙে রাঙানো। ফাতিমার সোনার বরণ রাঙা হাতের টানে কাজী এখন ইদ্রিস মাতুব্বরের আরও ঘনিষ্ঠ হন। মেয়ের পাত্রের ব্যাপারে মাতুব্বর কথা তুলতেই কাজী সাহেব বলেন, প্রায় দু-ডজন পাত্র তিনি ইতোমধ্যে দেখেছেন। এর মধ্যে ফাজিল, কামিল, মাওলানা, কোরানে হাফিজ সব পদের পাত্রই আছে। এরপর কণ্ঠে এক তীক্ষè হতাশা এনে কাজী বলেন, কিন্তু মেলে না। আপনার যে সুন্দর মেয়ে আর আপনার যে সুন্দর মন তার সাথে মিল আছে এমন পোলা তো পাওন লাগবো। শেষমেষ গত সপ্তাহে আমি কুলোগাতির ছকু মেম্বারের ভাতিজা মুফতি আহমদউল্লাহর ব্যাপারেও খোঁজখবর নিলাম। জবর আলেম বটে। কিন্তু সমস্যা আছে। রাত-বিরাতে ঘোরাফেরা করে। অপরিচিত লোকজনের সাথেও মেলামেশা আছে। মাঝে-মাঝে দশ-পনেরো দিন কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না। উড়নচণ্ডী স্বভাবের। জিহাদিদের সাথে সর্ম্পক থাকতে পারে বলেও কারো কারো অনুমান। এখন বলেন, ফাতিমাকে কি এ ধরনের পোলার সাথে সাদি দেওন যায়? ইদ্রিস ভাই, একটা কথা কই যদি আপনি অনুমতি দেন। — অনুমতির অপেক্ষা না করেই চঁড়–ইপাড়ার কাজী কৃত্রিম লজ্জার ভাব মুখে এনে মাথা নিচু করে নত কণ্ঠে পুনরায় বলেন, তার আগে একখানা কথা ইদ্রিস ভাই। আপনি তো জানেন আল্লাহর দোয়ায় আমার কিছুর অভাব নেই। জমি-জিরাত টাকা-পয়সা আল্লায় আমারে কম দেয় নাই। আর মান-সম্মান? মাশাআল্লাহ এ মুলুকে কে না চেনে চঁড়–ইপাড়ার এই নাচিজ কাজীরে, কিন্তু দুঃখ ইদ্রিস ভাই আমার স্ত্রী রোকেয়াকে নিয়ে, বিয়ের পর সে পরপর দু-বছরই দুটি সন্তান দিলো। তাও কন্যা। দ্বিতীয় কন্যা তো সিজার- পেট চিরে বাইর করণ লাগছে। এরপর যে কী হলো রোকেয়া দিন দিন মোটা হতে লাগল। এখন বেজায় মোটা। ডাক্তারে কইছে পোলাপান আর দিব না। পীর-ফকির কম দেখাই নাই। ওই গহরডাঙ্গার হুজুরের পানিপড়া এনে খাওয়াইছি। বড়গুনী হুজুরের রেকাবি পড়া। সক্কলে কইল, বড়গুনির হুজুর মাওলানা কুতুকুল্লার কাছে। সাতখানা রেকাবি নিয়া যাবা। হুজুর জাফরান কালি দিয়া রেকাবির গায় আল্লার আয়াত লিখে দিব। সাতদিন ধুইয়া ধুইয়া বিবিরে খাওয়াইবা। পুলাপান অইবই অইব। – কিন্তু লাভ হয় নাই। ওই দাওয়াইতিও যহন কাম অয় নাই, তহন ওর পোলাপান আর অইব না। বলেন মাতুব্বর, একটা বেটা-পোলা না অলে আমার এ সব খাবে কেডা? আমি চঁড়ইপাড়ার কাজী, আমার একটা বেটা- পোলা লাগবো না? আমার এবসেন্সে কে লইবে চঁড়–ইপাড়ার কাজীর ভার? একটা অন্তত বেটা-পোলা আমার দরকার কিনা কন? কন মাতুব্বর কন! – এ সময় কাজীর কণ্ঠ প্রথমে গদগদ পরে ধরা-ধরা হয়ে উঠে।
তা দরকার তো আছেই। কিন্তু আল্লাহ না দিলে কী করার আছে কাজী ভাই।
হঁ মাতব্বর ভাই, আল্লাহ সব করনেওয়ালা। কিন্তু তিনি জিকির-ফিকির উভয়ই করতে কইছেন। তকদির তিনিই ঠিক করেন। তাই বলে বসে থাকা ঠিক না। বান্দাকে তদবির করতে হয়। আমি তাই মনস্থির করেছি আমি একখানা শাদি করুম। মাতব্বর ভাই ভনিতা করে লাভ নেই। নিজে কত মেয়ের বিয়ে পড়াই আমার মেয়ের অভাব নেই। আর আমার বয়সই বা এমন কি। দু-চারখানা দাড়িতে পাক ধরলেও চুল এখনও পাকে নাই আল্লাহর রহমতে।
এই বলে চঁড়–ইপাড়ার কাজী মাথা থেকে গোল টুপি খুলে হাতে ধরেন। তারপর টুপিতে একটি বড় ফুঁ দিয়ে আবার তা নীরবে মাথায় পরে নেন এবং টুপি পরা শেষ করে হঠাৎ ঝাপটা দিয়ে তিনি ইদ্রিস মাতুব্বরের ডানহাতটি ধরে নিজের বুকের কাছে তুলে চেপে ধরে বলেন : কিছু মনে করবেন না মাতব্বর, আপনার ফাতিমাকে আমার মনে লইছে। ঈমানদার মাইয়া। পরদা-পুষিদা মানে। আমি তো তার চাচার লাহান, তবু আমার সম্মুখে আসে না। আমি কাজী, বিয়ে থা পড়াই, হুজুর মানুষ, এ জেনেও লাজে আমার সামনে আসে না। আহা সুন্দর মাইয়া! এর পেটে বুজুর্গ পোলা হইব।
কাজী আর কথা বলেন না। ‘কী সুন্দর মাইয়া’ বলার সময় কাজীর মনে সে দিনের সেই পানদানি ধরা সোনার বরণ হাতখানা ভেসে উঠে তাঁকে আরও উতলা করে তোলে। তাঁর চোখ যেন মধুর মদিরায় বুঁজে আসে। তখনও মাতুব্বরের হাতখানা নিজ বুকে চেপে ধরে আছেন কাজী। কথা শেষ হয়েও শেষ হয় না। কাজী তাঁর মনের অনেক না বলা কথা ফাতিমার বাবার হাত তখনো নিজের বুকে চেপে রেখে তাঁকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু লাভ হয় নি। কাজীর আক্ষেপে মাতুব্বরের হৃদয় গলে নি। বরং পিতৃবয়স্ক হয়ে কন্যাতুল্য একটি মেয়েকে এভাবে বিয়ের প্রস্তাব করায় মাতুব্বর যুগপৎভাবে বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েছেন। সেদিন নিরাশ হয়ে এবং মাতুব্বরের অবজ্ঞাভরা চাহনি হজম করে চঁড়–ইপাড়ায় ফিরে আসতে হয় ‘হতভাগ্য’ কাজীকে। নারীভাগ্য না থাকায় সব থাকা সত্ত্বেও চঁড়ুইপাড়ার কাজী নিজেকে হতভাগ্য মনে করেন।
এই ‘হতভাগ্য’ অতৃপ্ত আত্মা কাজীর চোখ ও অন্তরে আজ অঢেল শান্তি। খুব ভোরে বরেন্দ্রভূমি হতে বাল্য বন্ধুর টেলিফোন থেকেই সে শান্তির সূচনা। আর সে শান্তি পূর্ণতা পেল যখন শুভ্র ফুলের নরম কোরকে গড়া এক সুন্দরী পাজেরো জীপ থেকে নেমে বন্ধু বিলায়েতের পিছু পিছু নিঃশব্দে চারদিক পুলকে মাতাতে মাতাতে তাঁর অলিন্দে উপনীত হলো। তারপর কাজী তাঁদের বিয়ে পড়ালেন। যদিও কাবিন রেজিষ্ট্রি হলো একটা ফলস্ রেজিষ্টারে। আর সে শান্তি পরিতৃপ্তির প্রান্ত স্পর্শ করলো রাতের বেলা, যখন কাজীর বাড়িতেই বন্ধু ও বন্ধুপতিœর মধুচন্দ্রিমার আয়োজন হলো। মধুচন্দ্রিমার রাতে কক্ষের ছিদ্রপথে কখনো কান পেতে, কখনো প্রকোষ্ঠের ম্লান আলোয় চোখ রেখে কাজী যখন মিথুনবিলাসী হংস-সারসের কুজন-ধ্বনি শুনেছিলেন এবং জীবন্ত বিমূর্ত শিল্পের মতো একটি যুগলের চঞ্চল ছায়া দেখছিলেন তখন সে প্রশান্তি যেন কানায় কানায় ভরে উঠে। যদিও চূড়ান্ত আফসোস থেকেই যায়।
তবে চক্ষু দ্বারা রূপ দর্শন করে কাজীর আজ যে শুভ নিমিত্ত লাভ হয়েছে, তার তো একটা মূল্য আছে। রূপ লাগি কার না আঁখি ঝুরে। সুদর্শন নারীর জন্য কার না চোখ আকুলি-বিকুলি করে। আর মিথুনমত্তা সুন্দরীর শীৎকার ধ্বনির তুল্য শ্রেয়তর শ্রবণযোগ্য কী আছে এ নশ্বর জগতে!-এমনই মনে করেন কাজী। কাজী আজ সেই ধ্বনি শুনছেন। এ যেন ঘ্রাণে অর্ধভোজনের আনন্দ। উদরস্থ না হলেও এরও এক বিরাট তৃপ্তিমূল্য আছে। এই অপূর্ব দিনের মুগ্ধ স্মৃতি কাজী কখনো ভুলবেন না।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..