ধারাবাহিক উপন্যাস : ইমন কল্যান

ওয়াহিদার হোসেন
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
ধারাবাহিক উপন্যাস : ইমন কল্যান

পরিচ্ছেদ ৪

ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম মাঝেমধ্যেই হয়।কেন হয় সে জানেনা।এই অসুখটা আগে ছিলনা।হার্টের ডাক্তার অনেক যুগ আগেই নেশা করতে মানা করে দিয়েছে।কখনো হঠাৎ সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলে সে স্কুলের টয়লেটের পাশে টিচারদের একটা স্মোকিং জোন আছে সেটাতে যেত।ইদানীং স্কুলে স্মোকিং পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।আজ হঠাৎ ঠান্ডা লাগছিল। লুঙ্গি পরে সে শুয়েছিল।যখন সে বিছানা থেকে উঠে পড়লো দেখে সাফিনা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অনেকটা গুটিসুটি হয়ে আছে। তার গায়ে হালকা করে আলনায় রাখা একটা বিছানার চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়।চাদরটাকে ঘুমের ঘোরের জড়িয়ে ধরে সাফিনা।আহা বেচারা।অনেক কষ্ট হয় এই মেয়েটাকে দেখে সঙ্গে নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে নিজের ওপরেই করুণা আসে।কি ছিল সে। কি হল?দুরন্ত ক্রিকেটের সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়।ইউনিভার্সিটি টিমের অপরিহার্য অলরাউন্ডার ছিলো সে।লম্বা দৌড়ে এসে আউটসুইংগুলো মনে পড়ে। আজ যেন আল্লাহর ইনসুইংয়ের কোনো জবাব তার কাছে নেই।সাদিক মিঁয়া নিজের রোমশ বুকের দিকে তাকায় হাত দেয়। এর সম্পুর্ণ অধিকার সে সাফিনাকে দিতে চেয়েছিল।প্রত্যেক পুরুষের স্বপ্ন থাকে তার প্রেয়সীকে বুকে করে আগলে রাখবে।অথচ আজ সে হেরে গেছে।এজন্য কি তার ভাগ্যই দায়ী। যেদিন প্রথমবার বাড়িতে জানাজানি হল বাড়িতে আব্বা তিনদিন কথা বলেনি।মা বলছিল মুসলমান মেয়ে নাই?ভালোবাসা করতে গিয়ে একটা হিন্দু মেয়েকেই ভালোবাসতে হবে?সাদিকের সাহসে কুলোয়নি।সার্ভিস কমিশনে বারবার হেরে যাচ্ছিল সে। এমপ্যানেল্ড হওয়া হচ্ছিলনা।ইংরেজিতে দক্ষ থাকায় বি. এড করে টিউশনি করতে হচ্ছিল।এতটা সাহস,সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তা সে কোথা থেকে দেবে?তারপর সম্পর্কটা কেমন যেন শিথিল হয়ে গেল।অর্গাজমের পরে যেমন হয় আরকি।প্রেমও এমনি।নজর সরে গেলে ভালোবাসা অন্যদিকে তাকায়।সে বিয়ে করে নিল এক প্রফেসরকে মালদায় বাড়ি।বাড়ির লোক ঠিক করেছে।তুমি তো জানো আমার কিছু করার নেই। এতটুকু মেসেজ করেছিল।তখনো হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক আসেনি।মান্ধাতার আমলের ঘটনা সেসব। আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ে যাচ্ছিল।পুকুরের পাশে এসে দাঁড়ায় জাফর সাদিক মানে ধূপগুড়ির এককালের সেরা ক্রিকেটার সাদিক মিঁয়া।ঘরের বাইরে বেরিয়ে টয়লেট করার পরে দরজা খুলে পুকুরের পাশে এসে দাঁড়ায়।সাফিনার নরম শান্ত বন্ধ চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় কি নিষ্পাপ!অথচ,এখন আর সেসব ভাবার সময় কোথায়?
চাচা শ্বশুরের সঙ্গে কথা হয়েছে।এই সন্তানটিকে আর রাখা যাবেনা।এই সন্তান সাদিকের নয়।সাদিকের বিয়ের পরে পরেই সে যখন সাফিনার কাছে গেল কত আগ্রহ কত স্বপ্ন নিয়ে সে কি বুঝলো?সে বুঝলো সাফিনার কাছে অন্য কারো সন্তান।সাফিনার চাচা বড় ব্যাবসায়ী ধূপগুড়ি বাজারে তার প্রচুর ওষুধের দোকান চালু আছে।এগুলোর লাইসেন্স তারই।জলপাইগুড়িতে নিজস্ব বাড়ি আছে।অনেকদিন আগে ফার্মাসির কোর্স করে ধূপগুড়ি চলে আসেন তিনি।তারপর থেকে ধূপগুড়িতেই পার্মানেন্টলি থেকে গেছেন।

চাচা সাদিকদের প্রতিবেশি।নিজের ছেলের মতো করে দেখেন।ছোটবেলা থেকে সাদিক চাচাকে দেখে আসছে।চাচার পরামর্শেই সাফিনার সঙ্গে বিয়ে।মেয়ে সুন্দরী। শিক্ষিতা।মিউজিক নিয়ে পড়ছে।আর কিছু ভাবেনি সাদিক। প্রায় বছর তিনেক হল হাইস্কুলে চাকরি পেয়েছে।তারপর বাবা মা দুজনের জেদের কাছে হেরে গিয়ে আত্মসমর্পণ। আসলে সত্যিই কি তার কোনো ইচ্ছে কাজ করেনি?তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে? সে তো ফেসবুকে সাফিনার একাউন্ট দেখেই প্রেমে পড়ে গেছিল।তার পরিণাম এত দু:সহ হবে ভাবেনি।

বিয়ের পরের দিন সে ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর কথা ভেবে ডাক্তার দেখায়।আর সেদিনই স্পষ্ট হয়ে যায় সাফিনা দু’ মাসের গর্ভবতী। ডাক্তার তার ফ্যামিলি মেম্বারের মতো। সাফিনার চাচার ওষুধের দোকানে বসে।কথাটা পার্সোনালি ডেকেও বলতে পারতো।কিন্তু সে ভেবেছে অন্যকিছু। সে ভেবেছিল এটা প্রেমের বিয়ে।বিয়ের আগে কত এমন হয়।তাই যত জটিলতা।যার ফল ভুগতে হচ্ছে সাদিককে।এই নাজায়েজ অওলাদ তার জীবনে বিষ ঢেলে দিয়েছে।অন্য যে কেউ হলে সেদিনই তালাক দিয়ে দিত।কিন্তু বাড়ি ফিরে সে একটাও কথা বলেনি। রাগ দেখায়নি।ধমকায়নি সাফিনাকে।সে এক অদ্ভুত দ্বিধাগ্রস্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।এমনিতে ছোটবেলা থেকে সে খুব ধীর স্থির।হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া তার চরিত্রে নেই। সে অনেক ভেবেও বুঝতে পারেনি তার কি করা উচিত।কথাটা শুনেই চেম্বারে কেঁদে ফেলেছিল সাফিনা।চোখ মুখ ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল।হাত দুটো জড়ো করে বারবার কি যেন বলতে চাইছিল সাদিককে। কিন্তু সাদিক সে সব শুনে কি করবে?তারপর দুজনে রিক্সায় চেপে বাড়ি ফিরে এসেছে।দুদিন ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করেনি সে।চুপচাপ আতঙ্কে সাফিনা ঘুমোতেও পারেনি।তিনদিন কেটে যাওয়ার পরে আজই সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।তার দিকে তাকিয়ে সাদিকের মনে হয় এই বিশ্বাসঘাতক নারীর প্রতি তার এত টান কেন?এই নারী তার প্রেমিক বা যাইহোক, যারই হোক সন্তানকে ধারণ করেছে নিজের গর্ভে। আর সে নিজে কি দুধে ধোওয়া তুলসীপাতা? সে কি সাফিনার দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে তার জায়গায় খোঁজার চেষ্টা করেনি।ইউনিভার্সিটির বান্ধবীর মুখটা মনে করে সে তার রুমে এসে সাফিনার মুখের ঘোমটা তোলেনি?হয়তো মাত্রায় কম বেশি।কিন্তু সেও নিজে নিজে ভেতরে ভেতরে প্রতারক। তার শিক্ষা তার ব্যক্তিত্ব তাকে সৎ হতে বলছে না কি?নিজেকে চেঞ্জ করতে পারছোনা?নিজেকে বদলাতে পারছোনা?পুরোনো অতীত কেন বারবার এসে সাদিককে ধ্বংস করে আক্রমণ করে আক্রান্ত করে?সে আর সাফিনা কি একই মুদ্রার দুটো দিক নয়?

পুকুরের টলটলে জলে ঘাই মারছে রুই কাতলা চায়না পুঁটি মৃগেল আমেরিকান রুই গ্রাস কার্প।কিন্তু কথাটা চাচাকে উত্তেজিত হয়ে জানানো কি ঠিক হয়েছে?হয়তো হয়েছে।সাফিনার মেডিকেল গত কোনো ঝামেলা হলে কে দায়িত্ব নেবে।এই বাচ্চাটাকে যদি না রাখা হয়,তাহলে কি হবে?ডাক্তার বাড়ির লোক।বাড়ির লোক অবশ্য কিছুই জানেনা।মনে হয় সাফিনার বাড়ির লোক সব জেনে গেছে।এত জটিল এত মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাওয়াই বোধহয় সাদিকের নিয়তি।সাদিক পুকুর পাড় থেকে উঠে এসে ঘরে ঢোকে।দেখে সাফিনা মাথা নীচু করে বসে আছে।মুখে বিস্ময় লজ্জা অনুশোচনা।হঠাৎই বিছানা থেকে নেমে আসে সাফিনা। এসে জড়িয়ে ধরে সাদিককে।সাদিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।

 

অনুশোচনা মানে কি?শুধু কি অনুশোচনা পাপবোধ থেকে তৈরী হয়?তার নিজের শরীরে যে আরেকটা শরীর বেড়ে উঠছে তাতে খুশি হওয়ার কথা ছিলো। এ অত্যন্ত খুশির খবর। অথচ তার জীবনে এই খবরটাই ভয়াবহ উপদ্রব হিসেবে হাজির হবে সে বুঝতে পারেনি।মইদুলকে মন থেকে ছুড়ে ফেলার পরে তার মনে হয়েছিল সব কিছু নতুন করে শুরু হবে।পরিবার সংসার স্বামী শ্বশুর শাশুড়ী এইসব কিছু নিয়ে যে মেয়েদের ফ্যান্টাসি তার কতটুকু বেঁচেছিল সাফিনার ভেতর?হয়তো অনেক কিছুই সে ভেবেছিল।সব ঠিকঠাক ছিলো। হঠাৎ করে নিকাহ হয়ে যাওয়ার পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর এলো শাশুড়ী অসুস্থ। কনেকে তারা নিয়ে যাবে।যে পরিবারে তার স্থায়ী হওয়া তারা হুট করে সিদ্ধান্ত নিল সাফিনাকে চলে যেতে হবে শ্বশুরবাড়ি।বাবা আপত্তি করলেননা।সাফিনার একটা কথাও গুরুত্ব পেলোনা।তাকে চলে যেতে হবে কামাখ্যাগুড়ি থেকে ধূপগুড়ি। এক রাতেই সব ঠিকঠাক। শ্বশুর বাড়ি ফিরেই পরেরদিন ডাক্তারের কাছে চেক আপ করতে যাওয়া।ঘটনাক্রমে সে ধরা পড়ে গেল সাদিকের কাছে।লোকটা খারাপ নয়।ভীষণ বুঝদার।সে কাছে এসে হাতটা ধরেই অনুযোগের সুরে বললো আয়াম সরি।তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আগামীকাল। আমরা খুব দ্রুত সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করব। মা’র শরীর ভীষণ খারাপ। কখন কি হয় বলা যায়না।তোমাকে সময় দিতে চেয়েও পারলামনা।কিছু মনে কোরোনা।
আচ্ছা ঠিক আছে। বলেছিল সাফিনা।
তারপর আ্যজ ইউজুয়ালি দুজনে নীরবে পরস্পরের হাত ধরেছিল।সারাদিন লোকজনের ভীড় ঝামেলা সামলানো সাদিক নাক ডাকতে শুরু করেছিল।যৌনতার অবকাশ হয়তো সেদিন ছিলো। কিন্তু সুযোগ ছিলনা।
সেদিন সাদিকের শরীরের পাশে ঘুমোনোর চেষ্টা করেও সাফিনার ঘুম আসেনা।বারবার মইদুলের আশ্লেষে জড়ানোর কথা মনে পড়ছিল।যত মনে পড়ছিল ততটাই খারাপ লাগছিল।অথচ সে ভাবতে পারেনি সেই ঘটনাই তার জীবনে এত বড় বিপদ হয়ে উঠবে।মইদুলের প্রোথিত বীজ তার বেঁচে থাকাকে নরকের থেকেও অসহনীয় করে তুলবে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় ভেতরে একটু ভয় ছিলোই।তবু সে মিথ্যে কথা বলেনি।যার ফল তাকে হয়তো সারাজীবন ভোগ করতে হবে।বাড়ি ফিরেই সাদিক চলে গিয়েছিল চাচারা বাড়ি।মা’র ফোন আসতেই সে বুঝতে পারে তাকে অনেক বড় মাশুল দিতে হবে।মা শুধু একটা কথাই বলেছিল তুই আমাদের ডুবিয়ে দিলি ইমন।
মা।কি বলছ?
ঠিকই বলছি।তুই বাড়ি চলে আয়।জামাইকে বলেছি।তোকে এখানে পাঠিয়ে দেবে।আমার লজ্জা লাগছে যে তোকে আমি পেটে ধরেছি।একবার তোর বাবার কথা ভাবলিনা?
ফোন কেটে যায়।বড় অসহায় লাগে নিজেকে।সে আর কারো ফোন রিসিভ করেনি।ফোনটাকে স্যুইচ অফ করে দেয়।ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হতে থাকে সে।
শ্বশুর শাশুড়ীর মুখ দেখে সে বুঝতে পারে এরা এখনো সত্য থেকে আনজান।এদের আচরণ হিংসাত্মক হতে হয়তো বেশি সময় লাগবেনা।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে সাদিক।ভাত খায়।তারপর কাছে এসে শুয়ে পড়ে।ভোর চারটের দিকে ঘুম ভেঙে যায় সাফিনার সে দেখে সাদিক ঘর থেকে বাথরুমের দিকে গেল।সাফিনা নিজেকে শক্ত করে। সে আজ যেমন করেই হোক এই অবহেলা।এই উপেক্ষার শেষ দেখবে।হয়তো বেঁচে থাকা নয়তো মৃত্যু।সাদিক পুকুর পাড় থেকে উঠে আসে।পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ গুলো বড় আশা জোগায়।জীবনে বেঁচে থাকার আরও ইচ্ছে হয়।
সাদিক ঘরে ঢোকে সে বিছানা থেকে উঠে সাদিকের কাছে যায়।সাদিক তাকে জড়িয়ে ধরে।ওর মাথায় চুমু দেয়।
বলে। ওকে রাখা যাবেনা।
তুমি কি চাওনা আমরা নতুন করে শুরু করি।আগে যা হয়েছে হয়েছে।আমি জানি এটাতে তোমার তেমন দোষ নেই। জবরদস্তি তোমাকে বিয়ে দিয়েছে তোমার বাবা।তবু আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই।
গলা বন্ধ হয়ে যায় সাফিনার।এই লোকটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। সে আবারও সমস্ত অতীত ভুলে যেতে চায়।
শোনো।সাদিক বলে। এই কথা কেউ জানবে না।জানানোর দরকারও নেই। আগামীকালই আমার বন্ধুর ক্লিনিকে যেতে হবে।বুঝতে পারছো?
হ্যাঁ। আমি জানি।যদিও তার শরীরের অপত্য জীবটি তখনো হয়তো জীবনের শেষ শ্বাসটুকু নিচ্ছে।ইমন অনুভব করতে পারে।

ওয়াহিদার হোসেন। কবি। জন্ম ১৯৮৬, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলার দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রাঙ্গালিবাজনায়। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। পেশাগত জীবনে তিনি একজন শিক্ষক। চাকরি করছেন ডুয়ার্সের এক প্রত্যন্ত চা বাগানের প্রাথমিক স্কুলে। প্রকাশিত বই: 'মধ্যরাতের দোজখ যাপন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৩) এবং 'পরিন্দা' (কাব্যগ্রন্থ,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ