প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
কাগজ, পেন্সিল, কালি-কলম, ইজেল, তুলি, বোর্ড, ক্লিপ, ক্যানভাস এবং রংয়ের টিউবগুলো এক এক করে গুছিয়ে নেয় সবাই। আর্টক্যাম্প গুটিয়ে ফেলা হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
পঞ্চরত্ন মন্দিরের পাশে ক্যাম্প করার ধারণাটা ছিল তাপসের। মন্দিরের গায়ের টেরাকোটাগুলো ক্যানভাসে অনুকরণ অনুশীলন করাটাই ছিল উদ্দেশ।
-আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?
-সোজা উত্তরে কোথাও।
কোথাও মানে কি?
-মানে আবার কি , শহরেই ফিরবো।আমাদের বাড়িতে সবাই মিলে দুদিন থাকবি। তারপর ঢাকায় ফিরে যাবো।
-ঠিক আছে, কিন্তু উত্তরে যাবি উত্তরে তো কোন পথই নেই।
-এখান থেকে সোজা পূবের রাস্তা ধরলে হাইওয়ে পাওয়া যাবে। ওখান থেকে কিছু একটা ধরে শহরে যাওয়া যায়।
-শোন তাপস,সব কিছুতেই এমন হেয়ালি ঠিক না। সাতদিন ধরে মন্দিরের পাশে খোলামাঠে শুয়ে বসে ছবি আকঁলাম। এখন ভাই একটু রেস্ট দরকার।
-হ্যাঁ সেজন্যই তো আমার বাড়িতে তোদের নিয়ে যাচ্ছি।
-আরে ভাই তোদের বাড়িতে যেতে হলে তো একটা রাস্তা দরকার না-কি?
-হ্যাঁ, এখান থেকে সোজা উত্তরেই আমাদের বাড়িটা। আমি যতদূর জানি এখানে কোন নদীও নেই। কাজেই হাঁটা ধরলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যেতে পারবো।
তাপস আর রবির কথাগুলো এতক্ষণ সবাই শুনছিল। এসব ব্যাপারে কারো কোন মাথা ব্যাথা আছে বলে মনে হচ্ছেনা। সাইট সিলেকশন করেছে তাপস,টিম লিডারও তাপস সুতরাং তার সিদ্ধান্তই পুরো টিমের সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করা হবে। এটাই হয়ত সবাই ভাবছে।
সীমান্ত ব্যাকব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে দিয়ে তাপসের দিকে তাকিয়ে বলে“রবি খারাপ বলেনি, মন্দিরে আসা যাওয়ার জন্য চমৎকার একটা রাস্তা রয়েছে।
মরা তো এটাতেই এসেছি এখন সেটা দিয়েই ফিরে যেতে কি অসুবিধা ”?
-না কোন অসুবিধা নেই,আমরা একটা নতুন পথ বানালেই বা কী অসুবিধা ?
-আমি তাপসের সাথে যাচ্ছি, বলেই সোহানা তাপসের পাশে এসে দাঁড়ায়। একে একে রনি,শেলি,জিসান,মৌরি আরো সবাই এসে দাঁড়ায়।তাপস নিজের ব্যাগটা কাধে তুলে নিতে নিতে বলে
-শুধু এটুকু পথ যেতে যেতেই হেমন্তের রুপটা দেখতে পাবি। তুলিতে যতই রঙ লাগাস পাকা ধানের রঙ কখনও আনতে পারবি ? মাটির রঙ,কৃষকের শরীরের রঙ,ঘাসফুলের রঙ আরো আরো বিচিত্র সব রঙ।একসঙ্গে এত রঙ একটা ক্যানভাসে আমি কোন এক্সিবিশনে দেখতে পাবোনা। সুতরাং…..
বলেই হাাঁটা শুরু করলো তাপস। ওকে অনুসরণ করে অন্যরা একটা পথ বানাতে শুরু করলো।
তাপস হেঁটে যায় ,অন্যেরা পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যায়।
বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ফসলের মাঠ। ধানের আটি বাধতে বাধতে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে একবার তাকায় লোকগুলো। একদল শহুরে ছেলে মেয়ে লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে যাক, সেটা নিয়ে তেমন কারো আগ্রহ নেই। পুরুষগলোর সাথে বেশ কজন নারী কাজ করছিল। ওদের মধ্যেই আগ্রহ দেখা গেল । একজন আর একজনকে বলে
-বুজান ,বেটি ছোয়া পেন পিন্দে আইলে আইলে ঘুরে বেড়াছে,বুকতো কাপড় নাই। অপর মহিলা কানে কানে কি যেন বলে অমনি হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। মুরব্বী গোছের একজন ধমকে ওঠে“এই এইঠে এইলা ফাতরামি চলিবেনি,বাড়িত যায়া কত পারেন হাসেন। কাম করিবা আইচ্চেন কাম কর। না পারিলে কাম ছাড়ে বাড়ি চলে যান”
মুখ গোমড়া করে আবার সবাই কাজে মন দেয়।
#
তাপসের দলটি তিনঘন্টা হাঁটার পর উঁচু ঢিবি মত একটা জায়গা দেখতে পায়, ঘন জঙ্গলে ঢাকা। অনেক দূর থেকেই সেটা সবার চোখে পড়ে। চোখে পড়ার অন্য একটা কারণ হচ্ছে এর আশে পাশে কোন বাড়ি ঘর গাছ পালা নেই। মাইলের পর মাইল ধানের জমি।
ঢিবিটার কাছে আসতেই ওরা খেয়াল করে দূর থেকে দেখে যত বড় মনে হয়েছিল আসলে তারচে অনেক বড় এবং উঁচু।
মৌরি বলে এটা কি পাহাড়?
তাপস হেসে বলে এ এলাকা সমতল ভূমী, এখানে পাহাড় থাকার প্রশ্নই ওঠেনা।
-তাহলে?
-এটা একটা মাটির ঢিবি,তবে সচারাচর যা চোখে পড়ে তার চে বড়। অনেকটা টিলার আকার।
আমরা এর ওপরে উঠবো, মৌরি জেদ ধরল।
রবি প্রবল আপত্তি করে বললো , তিন ঘন্টা ধরে হাঁটছি ,এখন কি আর টিলার ওপরে ওঠার শক্তি আছে ? চল চলে যাই।
তাপস দলনেতার মত করেই বলে, আমরা শুধু হেঁটেই ক্লান্ত হইনি। অনেক কিছু দেখেছি এবং শিখেছি। এখন যদি শুধু শক্তি হারিয়েছি এটা বলা হয় তবে পুরো অর্জনটাই আড়ালে চলে যাবে। আমরা হারিয়েছি এবং বিনিমনে অনেক কিছুই পেয়েছি। বলা যায় আমাদের অর্জনটাই অনেক বেশি।
সবাই মাথা নেড়ে তাপসের যুক্তি মেনে নেয়।
আমার প্রস্তাবটার কি হলো মৌরি মনে করিয়ে দেয়।
সবাই তাপসের দিকে তাকায়।
-আমরা ওপরে উঠছি..।
#
ওদের চোখগুলো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল।
ঘন ঝোপ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। ওরা হাত দিয়ে লতাগুল্ম সরিয়ে এগিয়ে যায়। আরো এগুতেই দেখতে পায় সামনেই ছোট্ট একটা মন্দির।
ওদের অবাক হওয়ার কারণ হলো আসে পাশে কোন জন বসতি নেই। এখানে বহুকাল কোন মানুষের পা পড়েনি সেটাও বোঝা যায়। মন্দিরের ভেতরে কোন মূর্তীও নেই।মন্দিরটা কত পুরনো তা অনুমানও করা যাচ্ছেনা। এটাকে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলা যায়।
যার যার মতো করে মন্দিরের ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তাপস সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে
এটা একরত্ন মন্দির।এই দেখ তোরা, চারচালার ঠিক মাঝখানে ছাদে একটি চূড়া দেখা যাচ্ছে। এধরণের চূড়া বা রত্ন থাকলে তাকে একরত্ন মন্দির বলে চেনা যায়।
নমিতা বলে হুগলির বাসুদেব মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম,ঠাকমা বলেছিলন ওটা একরত্ন মন্দির।
যে যার মত করে পর্যবেক্ষন করছে।
তাপস চেচিয়ে ওঠে “ আয় আমরা একটা নাটক করি এখানে”।
-নাটক!
-স্ক্রীপ্ট কই?
-আমার দ্বারা ওসব নাটক ফাটক হবেনা।
-কস্ট্যুম কই?
-আলো কই?
-মঞ্চ কই?
শোন শোন কোন কিছুরই দরকার নেই। সবাই চোখ বন্ধ কর,সবাই ভেবে নে আমরা সতের শতকে অবস্থান করছি।
সতের শতক কেন ? মৌরি জানতে চায়।
সতেরো শতকে মল্ল রাজাদের হাতে এই ধরনের মন্দিরের উৎকর্ষতা লাভ করেছিল।
আমরা সবাই এমন একটা মন্দিরের সামনে উপস্থিত। এটা এমন একটা সময় যখন চূয়ার বিদ্রহ চলছে।
চূয়ার বিদ্রোহ?
তাপস চোখ না খুলেই ১৭৬০ সালের মারাঠা আক্রমণ,বর্ধমানের নীতি,ইংরেজ শাসন,মন্বন্ত¦র এবং এরই মধ্যে চূয়ার বিদ্রোহ সব কিছুই বলে যায়। সবাইকে কাহিনি বলা শেষ করে চরিত্রগুলো বলে দেয়। সবাই যে যার মত করে সংলাপ বলে যায়। নিজের ভেতর থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে যায় মল্লভূমে। কেউ রাজা কেউ প্রজা কেউ বিদ্রোহী । আবছা অন্ধকার যখন আরো গাঢ় হয়ে যখন নিজেদেরই আর দেখা যাচ্ছেনা তখন সম্বিত ফিরে পায় সবাই।
টিলা থেকে নেমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সবাই। সতের শতক থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগে সবারই।
আর কিছুক্ষণ হাাঁটার পর ওরা হাইওয়ে পায়,সামনেই শহর। বাকি সময়টা কেউ কারো সাথে কথা বলেনা।
#
পরিমল রায়,একটা কলেজে ইংরেজি পড়ান।
স্বভাবটা কিছুটা পাগলাটে এটা দু চারজনের জানা। একদিন তাপসের সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচিত অমলকে নিজের বাইকে চড়িয়ে সেই মন্দিরটার সামনে নিয়ে আসে।
অমল তুমি কি এখানে কখনও এসেছো?
-না
-জানো এটা কোথায়?
-জানি
-কীভাবে?
তাপস এতবার আমার কাছে এ টিলা ,মন্দির আর নাটকের কথা বলেছে যে না এলেও চোখ বন্ধ করে এর অস্বিত্ব অনুভব করতাম। আপনি আমার চোখ বেধে দিন, আমি বলতে পাবো ওই মন্দিরের কোথায় কোন ইট বের হয়ে আছে। কোথায় মূর্তীটা রাখা ছিল। মন্দিরের উচ্চতা ,চূড়ার উচ্চতা সব সব আমার জানা।
পরিমল স্যার একটা সিগারেট ধরায়।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে আমিও ওর কথা শুনে শুনে অন্তর্চোখে সবটুকু জায়গা দেখতে পাই। তবু নিজ চোখে দেখতে বেশ কবার এখানে এসেছি। অনেকের কাছে এর ইতিহাস জানতে চেয়েছি। তিন চার মাইল দূরে যে বসতিগুলো তারাও কেউ কিছু জানেনা। গ্রামের সবচে বৃদ্ধ মানুষটিও বলে তারা ছোট থাকতেই এটা জঙ্গলে পূর্ণ দেখেছেন।এর বেশি কেউ কিছু জানেন না।
স্যার আমাকে কেন এখানে নিয়ে এলেন ? অমল জিজ্ঞেস করে।
পরিমল স্যার ধোঁয়া ছাড়েন।
-অমল তুমি এবং আমি যা বললাম তার অর্থটা দাঁড়াচ্ছে তাপস আমাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যা কিছু আমাদের বলেছে তা আমরা না দেখেও দেখে ফেলেছি। ওরা যে নাটক করেছিল , ওদের ক্ষেত্রেই তাই হয়েছে। ছেলেটা অসম্ভব প্রতিভাধর ছিল। একটা ক্ষমতা ছিল কাউকে প্রভাবিত করার।
-জি স্যার। অমল সায় দেয়।
অমল , তুমি জানতে তাপস নেশা ধরেছিল?
জানতাম।
আটকালেনা কেন?
আমার কোন কথা শোনেনি।
তারমানে ওকে কথা শোনানোর বা বোঝানোর কোন ক্ষমতাই তোমার ছিলনা?
অমল চুপ করে থাকে।
আমারও ছিলনা। এর মানে দাঁড়ায় তাপস আঁকা,পড়া এবং বন্ধুত্বে কোন ফাঁক রাখেনি। সে ছবি আঁকতে গিয়ে রঙের গভীরে যেতে পারতো তেমনি পড়তে গিয়ে ঘটনার গভীরে যেত। বন্ধুত্ব করতে গিয়ে এতটার গভীরে যেত যখন আমাদের মনের ওপর আমাদের আর নিয়ন্ত্রণ থাকতো।
অমল মাথা নিচু করে বলে “ ঠিক তাই”।
অমল তোমার কি মনে হয়না ,ওর সাথে যারা মিসতাম তারা ওর উপযুক্তই ছিলাম না। অথবা এটাও হতে পারে তাপস ভুল মানুষদের সাথে মিসেছিল , বন্ধুত্ব করেছিল। যারা তার মৃত্যুর দিকে ধাবমান পথটি রুখবার সাহস যোগ্যতা কোনটাই রাখতোনা।
অমল মাথা নিচু করে থাকে।
পরিমল স্যার টিলার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। হাতদুটো আকাশের দিকে ওঠায়,চোখ বন্ধ করে। চিৎকার করে বলে
“ তাপস আমি সতের শতকে নয়,একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আমার ছাত্র, তুমি আমার বন্ধু। তুমি কেবলই সোনালী ধান থেকে রঙ নিয়ে ছবি আঁকবে সে ছবি নাকে ধরলেই সোঁদা মাটির গন্ধে মাতাল হবো। তুমি অন্ধকার থেকে কালো রঙ নেবে,ঘন জঙ্গল থেকে সবুজ নেবে আর মন্দিরের ক্ষয়ে যাওয়া ইট থেকে পোড়া মাটির রঙ নেবে, বুনো গন্ধ নেবে। আমি তোমাকে অনেকগুলো কাগজ,পেন্সিল,কালি-কলম,ইজেল,তুলি,বোর্ড,ক্লিপ,ক্যানভাস এনে দেব।
চোখ ভিজে ওঠে পরিমল স্যারের , অমলেরও।
মোটর সাইকেলটা ধূলো উড়িয়ে চলে যায়।
দিন যায় যায়…
#
তাপস মৌরির অনেকদিন সাথে ছিল,এক কক্ষে রাতও কাটিয়েছে।
তাপস একদিন কোন এক বন্ধুকে বলেছিল ‘আর পারছিনা’।
তাপস একদিন কাউকে ঠিকানা না দিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।
তাপসের কথা একদিন সবাই ভুলে যায়।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..