ভুবন ডাঙ্গার হাট

শাহান সাহাবুদ্দিন
কবিতা
ভুবন ডাঙ্গার হাট

ধ্বংস ও রক্তপাতের চেয়ে ভুবন ডাঙ্গার হাট ভালো

হরপ্পার চাঁদকে এক সময় ভালোবাসতাম
এমনকি ভালোবাসতাম মহেঞ্জোদারোর অলি গলি
খানা খন্দ পুকুর নগরীর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া
ব্যস্ত অথচ উদাসীন রাস্তা। তার ও আগে বাগদাদ নগরীর
ব্যস্ত এলাকার এক পাশে পলেস্তার খসে পড়া প্রাসাদপ্রতীম
পুরনো বাড়ির সামনে জটলা, দাসদের হাট, বণিকের ঘোড়া
আশপাশের পাইক পেয়াদা, শক্ত মতো দড়ি, পানের চিপটি,
খান্দানী গোঁফ-এইসব ভালোবেসেছিলাম।

তখন আমার সব কিছুই ভালো লাগতো।

এই আকাশ, নক্ষত্র, অচেনা বাতাস-বাতাসের ঢেউ
সবই ভালো লাগতো।

এখন বুঝি, তখন ভালো লাগার মন ছিলো আমার। হয়তো বয়স ও। বয়সটা যদিও আপেক্ষিক আমার কাছে চিরোকাল। বয়সতো কমানো বাড়ানো আমার হাতে। এই যেমন এখন ইচ্ছে করলেই কাইয়ুম চৌধুরীর অলংকরণে আমার কালের বাংলা সহজ পাঠের বই নিয়ে বসে পড়লেই প্রায় তিন বছর বয়সী আমার পুত্র ‘গল্পের’ সঙ্গে আর তিনটা বছর যোগ করলেই দু চোখে রাজ্যের সব কল্পনার বিস্তার- ভোর হবে, মা দোর খোলে দেবে, জানালার ওপাশে ভোরের কোয়াশা ঝরা শান্ত নদী, নদীতে নৌকা, মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালি- আমি তখন দুরন্ত শিশু।

এই শিশুকে তুমি আর কতোটা পোড়াবে?

আজ রাতে চাঁদ উঠবে। পৃথিবীর বয়সী পুরনো চাঁদ। বৃক্ষের সবুজ পাতা ও ডালে ডালে চাঁদের আলোর প্লাবন। দূরে কোথাও নিবিড় নির্জন জলপাই রঙের অন্ধকার মাঠে নাগ-নাগিনীর উম্মত্ত সঙ্গমে তুমি এবং তোমরা কান পেতে রবে; তোমার এক কালের বাড়ির পাশের যৌবনা নদে বান ডাকবে, আবুল হাশেম মোড়লের বাগানে ফুলের হাটে মৌমাছি ভ্রমর খেলা করবে;
মধুলুটপাটে প্রতিষ্ঠা পাবে পুঁজিবাদ, সর্বহারারা মার খাবে-

এই দৃশ্যপট, তত্ত্ব ও দর্শন যার নখদর্পণে তাকে তুমি কতোটা আর অস্থির করে তুলতে পারো অঙ্গ সৌষ্ঠবের সৌন্দর্যের ও কামকলার বেহাত প্রদর্শনে?

শুনো, হে আমার আরাধ্য রানী, চাঁদ ও পাড়াগাঁর মসজিদের বারান্দা আজকাল আর আমি যত্ন নিয়ে দেখিনা
যেমন টানেনা দুর্বার আকর্ষণ নিয়ে আমার প্রিয় বইয়ের তাক
যেমন টানেনা হুমায়ূন সাধুর আখড়া, রাতের টার্মিনাল ও ট্রেন;
কেনো জানো?
পৃথিবীর কোনো কিছুই স্থির থাকেনা চিরোকাল একজনের জন্য
অবিনশ্বরতা বলে এখানে কিছু নেই
আমার হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু হবে লুপ্ত
কী শিল্প কী মিথ কী সৌন্দর্য কী মানুষ ও ইতিহাসের পাঠ,
এমনকী নৃতাত্ত্বিক বেদনা ও
অধিবিদ্যার আকাশ হবে ধূসর থেকে ধূসরতর-
তুমিতো এসবেরই অবিকল অনুবাদ;

আমাকে আর কি দিয়ে ভয় দেখাবে বলো?

তারচে বরং চলো সব ছলাকলা ভুলে গিয়ে দুচোখে মেখে নেই সাজেকের বিস্ময়কর মেঘমালা
দেখি দূর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সবটুকু আলো;
তোমার চুল ও শরীরের গন্ধ নেয়ার মতো এইটুকুই মৌলিক
মুগ্ধতা-
এইটুকু বাঁচিয়ে রেখে চলো যাই ভুবন ডাঙ্গার হাটে ভরা পূর্ণিমায়
ধ্বংস ও রক্তপাতের চেয়ে এইটুকু ভালো নয় কী, হে প্রিয়তমা?

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ