নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে

উইলি মুক্তি
গল্প
Bengali
নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে

হঠাৎ করে দেখলে সাধারণ বাঙালি ছেলের মতো দেখায় না। খুব নিখুঁত ভাবে দেখলে বোঝা যায় বুদ্ধিদৃপ্ত চেহারায় সৌখিনতার ছাপ স্পষ্ট। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। দেখতে চোখে পড়ার মত সুদর্শন। লম্বা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। বয়স ত্রিশ। মাথা ভর্তি ঘন কালো লম্বা সিল্কি চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। দেখলেই বোঝা যায় বেশভূষায় বেশ পরিপাটি। স্বভাব উড়ন্ত। মানে ভ্রমণ প্রিয়। কথা বলার ধরণ চমৎকার। বাংলায় কথা বলার চাইতে ইংরেজী বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ঘন্টার পর ঘন্টা যে কাউকেই কথার ছন্দে বেঁধে রাখার অসাধারণ দক্ষতা রাখে। বহতা নদীর মতো নির্দ্বিধায়, সাবলীল ভঙ্গিতে একটার পর একটা প্রসঙ্গ পাল্টে কথা বলে যায়। যাকে বলে তুখোড় বক্তা। বিষয়বস্তু এতটাই চমকপ্রদ থাকে যে যার সঙ্গে কথা বলে, মানে যে শ্রোতা তার বলতেও ইচ্ছে হয় না। এবার থামো তো !!

আর এই সুদর্শন মহাশয় এর নাম হচ্ছে ধ্রুব।

কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে 9B প্লাটফর্মে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে ধ্রুব। বিকেল ৪:৫০ নাগাদ রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়বে। নিউ দিল্লী পৌঁছাতে পরদিন সকাল ১০:৩৫।

হঠাৎ ধ্রুবর চায়ের ভীষণ তেষ্টা পেলো। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। দূরপাল্লার জার্নি বলে স্টেশনের আনাচে কাঁনাচে যত দোকান ছিল পঁচিশ মিনিট ধরে ঘুরে ঘুরে কিছু ম্যাগাজিন আর পানি কিনে নিল। সেই সাথে খোঁজ করতে লাগল চা কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু চায়ের কোনো হদিসই পেল না। মনের মধ্যে এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে কীসের যেন একটা অপূর্ণতা রয়ে গেল। এদিকে ট্রেনও ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম। এনাউন্স করছে দিল্লিগামী রাজধানী ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। কোনো রকম দৌড়ে ট্রেনে উঠে পড়ল ধ্রুব। কনট্রাক্টরের নির্দেশ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর কেবিনে ঢুকে চোখ ঘোরাতেই এক নিমেষে নজর আটকে গেল বাতায়ন পাশে বসে থাকা সুশ্রী এক তরুণীর দিকে। আর তখনই আচানক জানালার ওপাশ থেকে শুনতে পেল

এই চায়েএএ– গারাম ! চায়েএএ।

শুনে মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল ধ্রুবর। সময় মত পেল না বলে চা আর খাওয়া হলো না। কেবিনের ডান পাশের সিটে আরো দুজন যাত্রী বেশ আয়েশ করে বসে আছেন। তারা আগেই তাদের সিট রিজার্ভ করে নিয়েছেন বুঝা যাচ্ছে। অগত্যা ব্যাগটি বাম পাশের বাঙ্কের উপর, মানে দ্বিতল বিছানার উপর রেখে তরুণীটির সাথেই বসে পড়ল ধ্রুব। জানালা দিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মের জনস্রোতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ভাবতে লাগল, জীবনে যা চাই কেন যে সময় মত তা পাই না! ততক্ষণে গা ঝাড়া দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।

এর মধ্যে দু তিনবার মেয়েটির সাথে ধ্রুবর দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। একবার নিজ থেকেই ধ্রুব কৌতূহলী চেহারা নিয়ে হ্যালো বলল। ভদ্রতার খাতিরেই হয়ত তরুণী ধ্রুবকে মিষ্টি ছোট্ট একটি হাসি ফেরত দিয়ে আবারও জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ধ্রুব ভাবতে লাগল, এত মিষ্টি করেও কেউ হাসতে পারে? জানা ছিল না তো!

অলস বিকেলের ঝিমিয়ে পড়া সূর্যের আলো চেহারায় পড়ে মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছে। ওর হাসিটা আরেকবার দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে নিজ থেকেই পরিচিত হতে চাইল।

আমি ধ্রুব

আপনি ?

জবাবে সেতারের তরঙ্গের মতো মধুর সুললিত কন্ঠে ভেসে এলো

আমি অনন্যা।

অনন্যা অসম্ভব সুন্দরী এক তরুণী। টানা টানা চোখের মাঝে কী যেন এক অদ্ভুত মায়ার কথা জড়ানো। স্নিগ্ধ আবরণে ঢেকে থাকা চেহারার আদলটি একদম পুতুলের মতো। যেখানে সরলতা মিশে একাকার। বয়স ২৫ ছুঁই ছুঁই করছে। লম্বা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। ছিপছিপে গড়নে গায়ের রংটি হলদে রকমের ফর্সা। ভ্রূ দুটি যেন তুলি দিয়ে আঁকা। ঘন সুকৃষ্ণ লম্বা চুল অবিন্যস্ত হয়ে মুখখানিকে আরো কমনীয় করে রেখেছে। কেবিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়া স্বত্বেও মাথার উপর একটা ফ্যান গটগট আওয়াজ করে চলছে। যে কারণে সামনের কিছুটা চুল অনন্যার মুখের উপর বাতাসে উড়ছে। আর কিছুটা এলোমেলো ভাবে লেপ্টে আছে। এই কারণে মেয়েটিকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে চুলগুলো কে  সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ফ্যানের বৈরী বাতাস চুলগুলোকে কিছুতেই এক জায়গায় থাকতে দিচ্ছে না। বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসছে কপালে। পরনে সাধারণ একটি কালো তাতের শাড়ি। কপালে ছোট একটি কালো টিপ। মনে হচ্ছে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা ব্লাক কফির উপর অতি যত্নে মনের মাধুরী মিশিয়ে কেউ উইপ ক্রিম দিয়ে ড্রইং করেছে। শাড়ির কালো রঙটি যেন সৌন্দর্যকে নিরীক্ষণ করার জন্য বিরহের কাজল এঁকে দেওয়ার মত। ব্যক্তিত্বে অসাধারণ এক মাধুর্য ফুটে উঠেছে। শান্ত স্বভাবের। কথা তেমন বলে না।

ধ্রুব নীরবে বসে থাকা লোকদের মধ্যে নয়। তাই কথা বলার জন্য নিজ থেকেই জানতে চাইল,

বেড়াতে বেড়িয়েছেন বুঝি ?

আবারও অনন্যা ছোট এক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

নিউ দিল্লিতে যাব।

ওহ্ আচ্ছা,

আমিও সেখানেই যাচ্ছি। তবে উদ্দেশ্যবিহীন। দেশ বিদেশে ভ্রমণ করা আমার অনেক পছন্দ। একটা শখ বলতে পারেন।

ঐ যে ব্যাগটি দেখছেন এটি হচ্ছে আমার একমাত্র সঙ্গী। সবসময় আমার সাথেই থাকে।

অনন্যা মনে মনে বিরক্ত হলো। লোকটি কেনো এত যেচে পড়ে কথা বলতে চাইছে ? ওর এখন কথা বলতে ও শুনতে দুটোর কোনোটাই ভালো লাগছে না। অনন্যা ধ্রুবর কথা না শোনার ভান করে সাথে করে নিয়ে আসা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল।

ট্রেন হাওয়ার বেগে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। কেবিনের ভেতর মুখোমুখি বসা আরো দুজন যে যাত্রী আছেন তারা প্রবীণ এক দম্পতি। মহিলার বয়স ষাট বছরের মতো হবে। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। চেহারার আদলটি ডেংগা ধরনের। মাথায় কালোর চেয়ে সাদা চুলই বেশি। যেখানে মোটা করে সিঁদুর লাগানো রয়েছে। কপালে আঁধুলির মত একটি সিঁদুরের ফোটা। ভারি শরীরে এক প্যাঁচ দিয়ে লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরেছেন বলে দেখতে দেবী দেবী লাগছে। অতি দ্রুত দক্ষতার সাথে উল দিয়ে সোয়েটার বুনে চলেছেন। পাশে পৌঢ় ভদ্রলোকটি তার স্বামী। গম্ভীর মুখে বসে আছেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন যাবৎ কোনো একটা কঠিন রোগে ভুগছেন। দেহে মাংস বলতে কিছুই নেই। মুখের গঠন আর চোখের দৃষ্টি ভীষণ তীক্ষ্ণ এবং ধাঁরালো। চশমার ভিতর থেকে তার চাহনি দেখলেই বোঝা যায় বিচক্ষণ দৃষ্টি। নাকটা টিকালো। টিঙ টিংঙে লম্বা। মাথার চুল নেই বললেই চলে। সামনের দিকে পুরোটাই টাক মাথা। পেছনের দিকে হালকা কিছু সাদা চুল আছে। ক্লিন সেভ করা। পোশাক আশাকে বেশ পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। চেহারাটা ভীষণ রুক্ষ। যেন রাজ্যের বিরক্তি উনার উপর বালতি ভরে কেউ ঢেলে দিয়েছে। কেবিনে ব্যাঙ্ক সহ চারটি বিছানা। নীচের বিছানা দুটো তে চারজন বসে আছে।

বৃক্ষ লতারা স্তব্ধ। সূর্য এখনো পড়েনি। দূরে ঐ গাছের পাতায় পাতায় নিবন্ধন সূর্যের সোনালি আলো ঝিলমিল করছে। প্রশস্ত দীঘির টলটলে জলে পদ্য ফুলেরা হাসছে। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত দৃশ্য। গ্রামের পর গ্রাম শেষ বিকেলের সোনা রঙের আভা অঙ্গে মেখে যেন দৌড়ে পালাচ্ছে। অনন্যার চেহারায় এক প্রশান্তি। মোহাবিষ্টের মতো বাইরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছে। হঠাৎ অনন্যা ধ্রুবর কথায় ফিরে তাকাল। বয়স্ক মহিলার উলের বলটি নিচে পড়ে গিয়েছিল। উনি খেয়াল করেননি। ধ্রুব উলের বলটি মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই যে শুনছেন, আপনার উল। নিচে পড়ে গিয়েছিল। মহিলা উলের বলটি হাতে নিয়ে হাসিমুখে ধ্রুব কে বলল, এই দেখো, কখন যে উলটি পড়ে গ্যাছে দেখতেই পাইনি। ধন্যবাদ বাছা। আমার নাম সুধা। সুধা ব্যানার্জি। আমাকে আন্টি বলে ডাকতে পারো। তারপর অনন্যাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, চা খাবে? অনন্যা প্রশ্নজনিত দৃষ্টি নিয়ে সুধার দিকে তাকাল। সুধা ব্যানার্জি ওড়ফে আন্টি কলকাতার খাঁটি শুদ্ধ ভাষায় বললেন, আমি যখনই জার্নি করি ফ্লাস্কে চা করে নিয়ে আসি। আমার বাপু ওদের চা খেয়ে পোষায় না। অনন্যা মাথা নেড়ে সুধা দেবী কে সম্মতি প্রকাশ করল। সুধা দেবী কাঁটা সহ উলের বোনা অর্ধেক সোয়েটার পাশে রাখলেন। সিটের নিচ থেকে মাঝারি সাইজের একটি সবুজ ঝুড়ি বের করে আনলেন। একটি ফ্লাস্ক থেকে ছোট্ট একটি কাপে চা ঢেলে অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে হাসিমুখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেবো না তোমাকেও দিব। ধ্রুব যেন একটু লজ্জাই পেল। মাথাটা নিচু করে হেসে দিল। সুধা দেবী আরেকটি কাপে ধ্রুবকে চা এগিয়ে দিয়ে আবারও বললেন জার্নিতে চা না হলে আমার বাপু একদমই চলে না। বৃদ্ধ লোকটির দিকে ইশারা করে বললেন, আমি আবার যখন তখন উনার মত জার্নিতে ঘুমাতে পারি না। বৃদ্ধ লোকটির দিকে দুজনেই একসাথে তাকাল। সত্যিই তো, উনি পেছনে হেলান দিয়ে বসে বসেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। ওরা দুজনেই সুধা দেবীর কথায় স্মিথ হেসে গরম গরম চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিল। ধ্রুব বলল, বাহ্ বেশ তো চায়ের স্বাধ।

তাই, ভালো হয়েছে?

দুজনেই একসাথে বলে উঠল, জ্বী আন্টি।

দেখো দেখি এখনও তোমাদের নামই জানা হলো না! সুধা দেবী বললেন।

আমি ধ্রুব, চায়ের কাপ থেকে মুখ সরিয়ে ঝট করে উত্তর দিয়ে দিল। যেন প্রতিযোগিতা। কে কার আগে নাম বলতে পারে। অনন্যাও হেসে দিয়ে বলল, আমি অনন্যা। সুধা দেবী অনন্যার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন। বাহ্ বেশ তো সুন্দর নামটি তোমার। তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছ বুঝি ? আবারও দুজনে একসাথে উত্তর দিল, জ্বী।

ধ্রুব সুধার সাথে কথা আগে বাড়ানোর জন্য জিজ্ঞেস করল আপনারা কি কলকাতায় থাকেন ?

হ্যাঁ, আমরা পার্ক স্ট্রিট থাকি।

দিল্লি বুঝি বেড়াতে যাচ্ছেন ?

না না, চিকিৎসার জন্য যাচ্ছি। সুধা দেবী বললেন, ওনার হার্টের অপারেশন হবে। দিল্লির NCR হসপিটালে।

ধ্রুব চোখ কিঞ্চিত খাটো করে একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে জানতে চাইল।

আপনি একা যাচ্ছেন!

আমার ছেলে থাকে দিল্লিতে। হরবর করে বলে উঠলেন সুধা দেবী। সবকিছু আমার ছেলেই ঠিক করে রেখেছে।

ওহ, আচ্ছা বুঝতে পেরেছি,  ধ্রুব বলল।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সুধা দেবী নির্লিপ্ত চোখে বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নৈরাশ্যের বিবর্ণ হাসি মুখে টেনে এনে বলতে লাগলেন, উনি আর্মি অফিসার ছিলেন। সার্জেন্ট মেজর জেনারেল। সারাজীবন দেশের জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। শেষ বয়সে এসে এখন এত বড় অসুখ বাঁধিয়েছেন। কথাটা শেষ করেই উনি আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন।

কথা শুনতে শুনতে নিঃশব্দে দুজনেই চা খাওয়া শেষ করে কাপটি সুধা দেবীকে ফেরৎ দিয়ে বলল,

ধন্যবাদ আন্টি।

ধ্রুব ব্যাগ থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।

সূর্যাস্তের সোনালী রঙ মিলিয়ে যেতে আর বেশি সময় দেরি নেই। দ্রুত পিছনে ফেলে আসা মাইলের পর মাইল সবুজ গ্রাম নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে কমলা রঙের আভা উছলে পড়ছে জানালার কাঁচের উপর। সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্যের কিরণ যেন কোনো এক অপরূপ সুন্দরী মহিয়সী প্রতিমার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সমস্ত আকাশে সিঁদুর ছড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল। এমন মনোরম দৃশ্য দেখে অনন্যা মোহগ্রস্তের মতো অভিভূত হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল।

কেবিনের ল্যাম্পের আধো আলো-আঁধারিতে মেয়েটিকে অন্যরকম রহস্যময় মায়াবি লাগছে।

ধ্রুব এক মূহুর্তের জন্য মুগ্ধ হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইল। সূর্য পড়ে যেয়ে রাত উঠে এসেছে। অনন্যা এখনও জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। সমস্ত কেবিন জুড়ে যেন একটা আলো আঁধারির খেলা চলছে। লম্বা হওয়ার কারণে খানিকটা কুঁজো হয়ে নিজের সিটে বসতে বসতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব বলল,

গরম লাগছে না ?

অনন্যা মাথা নেড়ে বলল, না।

ফ্যানটা অনেক আওয়াজ করছিল। আন্টি তাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

ধ্রুব বাঙ্কের উপরে নিচে তাকিয়ে দেখল দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন এবং প্রচন্ড জোরে নাক ডাকছেন। অনন্যার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে এনে ধ্রুব বলল, আয়েশের পরাকাষ্ঠা।

অনন্যা বলল, আপনার গরম লাগলে ফ্যান ছেড়ে দিতে পারেন।

না ঠিক আছে। তার দরকার হবে না।

একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে ধ্রুব বলতে শুরু করল, এশিয়ার দেশগুলোতে তাও গরম অনেক কম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আরো চৌদ্দ গুণ গরম বেশি। গতবছর এই সময়ে দুবাই বেড়াতে গিয়েছিলাম।

অসম্ভব গরম সেখানে।

আগুন !

জানেন আগুন !

সিরিঞ্জ দিয়ে যেমন রক্ত চুষে নেয় তেমনি গরম শরীরের সমস্ত পানিকে চুষে নেয়।

আপনি কখনো গিয়েছেন দুবাই?

অনন্যার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব জিজ্ঞেস করল।

অনন্যা বলল, না।

অনেক সুন্দর একটি শহর। দেখার মতো অনেক জায়গা আছে সেখানে। কিন্তু প্রচন্ড গরম।

বিশ্বজুড়ে দর্শনার্থীদের কাছে আশ্চর্যজনক শপিংমলের স্থান হচ্ছে দুবাই শহর। কেনাকাটার জন্য জায়গাটি সুবিখ্যাত। জুন জুলাই মাসে দুবাই এর তাপমাত্রা ৩৮’থেকে ৪০’ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। আপনি দুই মিনিটের জন্য এ সি থেকে বাহিরে থাকলে প্রচন্ড গরমে একদম ভিজে যাবেন।

সেখানকার এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর টেক্সি নিতে হলে বিশ থেকে পঁচিশ ফুট লম্বা একটা রাস্তা পাড় হতে হয়। এপাড় থেকে ওপাড়। ট্যাক্সি ভাড়া করার আগে ঐখানকার টোকেন বুথ থেকে টোকেন নিয়ে ট্যাক্সির জন্য মাত্র দু মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। আমি মাত্র সেই দুই মিনিট অপেক্ষা করে গরমে পুরো ভিজে সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

অনন্যা মনোযোগ সহকারে ধ্রুবর কথা শুনছিল। হঠাৎ করেই ধ্রুবর খেয়াল হলো, সে বেশি কথা বলছে। অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইল, আমি বকবক করে আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?

অনন্যা বলল, না না তা কেনো হবে। আপনি বলুন, শুনতে মন্দ লাগছে না।

ধ্রুব অনন্যার কথায় আশ্বস্ত হলো। যেন কথা বলার সুযোগ পেয়ে মনে মনে খুশিই হলো। এক গাল হেসে দু দুবার ধন্যবাদ জানাল।  ভাবছিলাম কী করে সারারাত পাড় করবো!

অনন্যা বলল কেন ? ঘুমাবেন না?

ঘুমাবো। তবে মনে হয় না তেমন ঘুম হবে।

আবারও দুজনে একসাথে ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।

এরপর ধ্রুব আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করল, দুবাই যেয়ে একবার সেখানকার সমুদ্রে গিয়েছিলাম। সমুদ্র আমার চিরকালের অনেক প্রিয় একটি জায়গা। সমুদ্রের কাছাকাছি গেলে আমার মাথা পরিস্কার হয়ে যায়। বড় বড় ঢেউ ক্ষরশান্ত ফোয়ারার মতো লক্ষ লক্ষ ফনায় ছোঁবল মারে অবিরাম। সমুদ্র যখন ফুঁসে উঠে প্রবল তাড়নায়, আছড়ে পড়া পানি তীক্ষ্ণ ধারায় লক্ষ বিন্দু হয়ে ছুটে আসে বালুর উপরে। তখন আমার মনকে আরো চনমনে করে তোলে। আমি আনন্দ নিয়ে উপভোগ করি সেইসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

আহা, আমার সমুদ্র বিলাস।

কথাটি বলেই এক মূহুর্তের জন্য ধ্রুব চোখ দুটি বন্ধ করে দিল। যেন সেই দৃশ্যপট উপলব্ধি করল।

সমুদ্র থেকে উঠে আসার পর আমার পায়ে প্রচুর বালি লেগেছিল। পা পরিষ্কার করার জন্য সমুদ্র থেকে বেশ দূরে কিছু জায়গায় আলাদা আলাদা ক্লিনিং বুথ থাকে। একদিকে মেয়েদের, অন্য দিকে ছেলেদের। আমি পা ধোয়ার জন্য একটা বুথের মধ্যে ঢুকে পড়ি। বুথ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই এক মধ্যবয়সী বাঙালি মহিলা দৌড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, এটা আপনি কী করেছেন ? আমি হতভম্ব হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, কেনো? কী করেছি? মহিলা আঙুল তুলে ইশারায় আমাকে বুথ এর দরজা দেখালেন। যেখানে লেখা ছিল ফিমেইল বুথ। আমার অজ্ঞতায় আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ মহিলাকে বিনয়ের সাথে দুঃখিত বললাম। আমি বললাম, আসলে লেখাটি নিচে ছিল বলে আমার চোখে পড়েনি। আমার লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গি দেখে মহিলা বিশ্বাস করলেন। আমি সত্যি কথা বলেছি ভেবে মহিলা বললেন, আপনি বাঙালি বলে ছেড়ে দিলাম নয়ত এই ভুলের কারণে এক হাজার দিরহাম জরিমানা করা হয়। আমি আবারও উনাকে হাত জোর করে দুঃখিত বললাম। তারপর উনার কাছে জানতে চাইলাম খাওয়ার পানি কোথায় পাওয়া যাবে? উনি আমাকে কিছুটা দূরে ফিল্টারের কল দেখিয়ে দিলেন। আমি পানি নিয়ে ভদ্র মহিলার কাছে ফিরে এলাম কথা বলার জন্য।

কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ভদ্র মহিলার নাম শিউলি। বারো বছর ধরে দুবাই থাকেন। আমি জানতে চেয়ছিলাম, এই গরমের মধ্যে আপনি বারো বছর ধরে এখানেই কাজ করেন ?

শিউলি বলেছিলেন, না।

দশ বছর যাবৎ এখানে কাজ করি।

আমি অবাক হয়ে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ণএই গরমের মধ্যে কী করে কাজ করেন?

শিউলি জানালেন, অনেক কষ্ট হয়। অতিরিক্ত গরমে কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তবে শীঘ্রই আরো কিছু টাকা জমা করে কাজ ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে যাব। এখানে যারাই কাজ করেন সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড গরমের কারণে খাওয়ার রুচিও নষ্ট হয়ে যায়। ঠিকমতো খেতে পারি না। শুনে আমার প্রচন্ড মন খারাপ হল শিউলির জন্য। আমি উনাকে খাবারের প্রস্তাব করলাম। বললাম, চলুন আমরা কোথাও বসে লাঞ্চ করি। উনি রাজি হলেন না। বললেন, আমি এখন ডিউটিতে আছি আর তাছাড়া আমার কাছে খাবার আছে। চাইলে আপনি আমার কাছ থেকে খাবার ভাগ নিতে পারেন। আমি যদি খাই আপনার খাবার কম পড়ে যাবে না?

সমস্যা নেই একদিন না হয় একটু কমই খেলাম। আমি উনাকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ধন্যবাদ জানালাম। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঐ জায়গা থেকে চলে এলাম।

তারপর ধ্রুব মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। অনন্যা অপেক্ষা করছে শোনার জন্য। এরপর কী হলো? বিষন্ন দৃষ্টি নিয়ে বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল ধ্রুব। কিছুক্ষণ পর বলল, ভাবতে পারেন, আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো বিদেশে যেয়ে কত পরিশ্রম করে রক্ত পানি করে টাকা উপার্জন করছে। শুধু মাত্র দেশে নিজের পরিবারের লোকজনগুলো যেন সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে বিদেশীরা প্রবাসীদের কী যে প্রচুর পরিমাণে পরিশ্রম করায় সেটা আপনি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।

সময়ের কাছে সুখ বড়ই অসহায়। আমরা ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে অনেক সময় নষ্ট করি। কিন্তু আমরা যে বর্তমানে বাস করছি সেটা নিয়ে কখনো ভাবিনা। পৃথিবীর যে কোনো দেশেই যাই না কেনো তার একটা ভিসার মেয়াদ আছে। কিন্তু দেখুন আমরা যে পৃথিবীতে এসেছি আমাদের কোনো ভিসা নেই। কোনো মেয়াদ নেই। কে কতদিন এই পৃথিবীতে থাকতে পারব কেউ তা বলতে পারি না। অথচ ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবে বর্তমান কে অবহেলা করছি। কিছুক্ষন দুজনেই নীরব। থমথমে একটা ভাব কেবিনের মধ্যে বিরাজ করছে। প্রবীণ দম্পতির দুজনের নাক ডাকার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে অনন্যা ভাবতে লাগল, লোকটির যেচে কথা বলার ধরণ দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল প্রথমে। অথচ ভাবতেই পারেনি, সেই বকবক করা প্রচুর কথা বলা মানুষটির ভেতরেও অন্য রকম একজন দরদী, নরম মনের মানুষ বাস করে। কী ভেবে যেন অনন্যা ধ্রুবর ব্যবহারের প্রতি একটু আস্বত্বই হলো।

বেয়ারা এসে রাতের খাবার দিয়ে গেল। আগেই খাবারের কথা বলে দেওয়া হয়েছিল।

দাদখানি চালের ভাত, মুরগির মাংস, সবজি তরকারি আর পাতলা ডাল। প্রবীণ দম্পতির খাবার ঢেকে রেখে আমাদের খাবার দিয়ে বেয়াড়া চলে গেলো। খেতে খেতে ধ্রুব আবার কথা বলা শুরু করল। আপনি ব্যাংকক গিয়েছেন কখনো ? অনন্যা মাথা নেড়ে বলল আমি বাংলাদেশের বাইরে কখনো কোথাও যাইনি। এই প্রথম দিল্লি একা যাচ্ছি। ধ্রুব অবাক দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথাও না ?

অনন্যা একটু হাসল। তারপর মাথা নেড়ে আবারও বলল, না।

আমি অনেকবার ব্যাংকক গিয়েছি।

প্রথমবার আমরা তিন বন্ধু মিলে একসাথে ব্যাংককে গিয়েছিলাম। ওখানে পৌঁছে হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই শহরটি ঘুরে দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তায় চলতে চলতে চারপাশ দেখার পর আবিষ্কার করলাম, একচেটিয়া কমনীয়তায় সমৃদ্ধ ব্যাংককের গ্রেস হোটেল। বিভিন্ন ধরনের রাস্তার অলি গলি ঘুরতে ঘুরতে দেখি নিকটবর্তী এক আরবি অঞ্চলে অবস্থিত এই এরাবিয়ান হোটেল। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল কেন্দ্রস্থল। সুইমিং পুলের পাশে বিশাল ওপেন ইয়ার্ড। বিশ্বের সব ধরনের সম্পদশালীদের আড্ডা আর প্রচুর নারীদের ভিড় থাকে সেখানে। তুলনামূলক ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের সংখ্যাই বেশি। যেখানে দেহপসারিণীদেরও উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। এদের লক্ষ্য কেন্দ্র বিশাল গ্রেস হোটেলের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার দেহপসারিণীরা কৌশলে ধনবান পর্যটকদের টার্গেট করে।

সম্মতি থাকলে যোজকের মাধ্যমে দেহপসারিনীরা তাদেরকে হোটেল রুমে নিয়ে যায়।

হঠাৎ ধ্রুব বলে উঠল,

আপনি আমার কথায় বিব্রত বোধ করছেন না তো? অনন্যা মনোযোগ দিয়ে ধ্রুবর কথা শুনছিল। হঠাৎ এ কথা শুনে অনন্যাই লজ্জা পেয়ে গেল। মাথা নিচু করে বললো, না, শুনছি বলুন।

একটু ইতস্তত করে ধ্রুব অনন্যাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আমি কি আপনাকে তুমি সম্মধন করতে পারি ?

অনন্যা একটু ক্ষণ চুপ করে রইল। ধ্রুব তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, আপনি না চাইলে থাক।

অনন্যা বলল, বয়সে আমি আপনার ছোটই হবো। তুমি করে বললে সমস্যা হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।

অনন্যা সম্মতি দেওয়ার সাথে সাথেই ধ্রুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুখ ভর্তি একগাল হাসিতে গদগদ করে আবার কথা বলতে শুরু করল।

জানো, সেই আরবি পাড়ায় খাবারের অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। যেখানে মুখোরচক হালাল খাবারও পাওয়া যায়।

একদিন আমরা তিন বন্ধু মিলে মনস্থির করলাম, এরাবিয়ান খাবার খাবো। যথারীতি আরবি পাড়ায় রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি যেয়ে হাজির হলাম। বাহির থেকেই গ্লাস ভেদ করে দেখা যায় রেস্টুরেন্টের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় খাবার সাজানো। খাবারের দোকানে ঢুকতে যাব ওমনি দেখি তিনজনের মধ্যে আমাদের এক বন্ধু শাকিল সাথে নেই। উধাও। কোথায় গেল বুঝে উঠতে পারলাম না। আমরা দুজনে মিলে প্রতিটি দোকানে দোকানে খোঁজ করতে লাগলাম। পুরো এরাবিয়ান পাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালাম। কিন্তু কোনো জায়গাতেই ওকে খুঁজে পেলাম না। তার আর কোনো হদিসই পেলাম না। চোখের পলকে যেন বন্ধুটি ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমরা দুজনেই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। সাথে অজানা এক ভয়।

ভয় কেন ?

অনন্যা সাথে সাথে জানতে চাইল ধ্রুবর কাছে।

ধ্রুব বলল,

কারণ আছে বলছি। অনেক ধরণের খারাপ কথা শুনেছি ব্যাংকক সম্পর্কে। সে ব্যাপারে তোমাকে পরে বলছি।

তারপর কী হলো ?

অনন্যা ধ্রুবর কাছে জানতে চাইল।

তারপর আর কী হবে। অবশেষে শাকিল কে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুধা নিয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। ঘন্টা দুই পর শাকিল হোটেলে ফিরে এল। হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। আমরা দুজনেই পাগলের মতো ওর উপর প্রায় হুমরি খেয়ে পড়লাম। কোথায় গিয়েছিলে ? এতক্ষণ কোথায় ছিলে ? কিছু হয়েছিল ? কোনো অঘটন ঘটেনি তো ? আমাদের বিরামহীন কৌতূহলভরা প্রশ্নের সম্মুখীন শাকিল,  হাসিমুখে বিছানার উপর আয়েশ করে বসতে বসতে হাত উঠিয়ে বলল,

আরে থামো, থামো, বলছি।

আমার কিছুই হয়নি।

এরপর ঘটনার বিবরণ দিতে যেয়ে সে যা বলল তা হলো, ঘুরতে ঘুরতে শাকিল একটা ঘড়ির দোকানে ঢুকেছিল। সেই দোকানে ওর একটি দামী ঘড়ি অনেক পছন্দ হয়। ঘড়িটা কেনার উদ্দেশ্যে শাকিল দোকানের ভেতরেই ছিল। কিন্তু দামটা অনেক বেশি বলে শাকিলের ঘড়িটি আর কেনা হয়নি। আমাদের না পেয়ে সে এতক্ষণ শপিং করে হোটেলে ফিরে এসেছে।

এই কথা শুনে আমি রাগে বজ্রের মতো জ্বলে উঠলাম। চিৎকার করে বললাম, তুমি একবারও ভেবে দেখেছো এখানে আমাদের অবস্থা কতটা সোচনীয় হয়ে পড়েছিল। তুমি আমাদের একটা ফোন তো করতে পারতে। আমরা ফোন করেছি সেটা ও তুমি ধরোনি। অন্য বন্ধুটি বলল, আমরা ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে, তোমাকে না আবার কোনো দেহপসারিণী অথবা সিমেইল ধরে নিয়ে গেল। আমি রাগ সামলাতে না পেরে উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেললাম। ওকে আর কে ধরে নিয়ে যাবে। ও নিজেই তো একটা সিমেইল। এই কথায় শাকিল আমার উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। অনেক রাত অবধি এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলল। রাতের খাবার আর খাওয়া হলো না। এক পর্যায়ে আমরা না খেয়েই সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।

অনেক সময় হলো ধ্রুব অনন্যার সাথে কথা বলেই চলেছে। এরমধ্যে কথার প্রতিটি পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে বেশ কয়েকবার আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে অনন্যাকে বলেছে, তোমার সাথে আমার আরো আগে কেনো দেখা হলো না অনন্যা ?

অনন্যা নিঃশব্দে হাসল।

ধ্রুব বলল, কেনো ভয় পেয়েছিলাম জিজ্ঞেস করেছিলে না তখন?

অনন্যা কৌতূহলী চোখ নিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল।

ব্যাংককে কিছু খারাপ জায়গা আছে। যেখানে প্রচুর দেহপসারিণী এবং সিমেইলদের আনাগোনা। যারা রাতের আঁধারে চোখে মাস্কারা, গালে ব্লাশন, আর ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। নতুন পর্যটকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য তাদেরকে জোরপূর্বক হাত করার চেষ্টা করে।

থাইল্যান্ডেও এমন কিছু জায়গা আছে যে জায়গাগুলো পাপের জায়গা নামে পরিচিত। তেমনি একটি জায়গার নাম পাতায়া। এই শহরটিকে বিশ্বের “যৌনতার রাজধানী” পাপের শহর বলা হয়ে থাকে। সেখানকার রাতের দৃশ্যপট দিনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। পাতায়ার রাত রঙিন বাতির আলকসজ্জিত ঝলমলে একদম উদ্দাম, সুদর্শন একটি শহর। পর্যটকদের বেড়ানোর জন্য অনেক সুন্দর জায়গা আছে সেখানে। একোরিয়াম, ফ্লোটিং মার্কেট, আরো এমন অনেক কিছু আছে যেখানে দিনের আলোতে দর্শনার্থীদের প্রচুর ভিড় জমে থাকে। ভোর পাঁচটা ‍পর্যন্ত ফুটপাতের দুই ধারে বার, ডিস্কো, রেস্টুরেন্ট প্রায় সবকিছুই খোলা থাকে। আর থাকে ওদের নির্লজ্জতার উল্লাস। মজার ব্যাপার কী জানো, পাতায়ায় ঢোকার আগে দেখা যায় সাইন বোর্ডে লেখা আছে – Good Men Go To Heaven And Bad Men Go To Pataya.

পাতায়ায় জুয়ার আড্ডা অনেক বেশি। সেখানে ইউরোপীয়ানরা বেশি যায়। ঐখানকার যে সব যোজক আছে তারা পর্যটকদেরকে যে কোনো উপায়ে জুয়া খেলতে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। তুমি চাও অথবা না চাও তোমাকে তারা বিভিন্ন ভাবে ট্রিট দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

টাকা না থাকলে প্রয়োজনে তারা টাকা ধার দিবে তারপরও তোমাকে খেলতে বাধ্য করবে। তাছাড়া চিকিৎসা বলো অথবা ব্যবসার খাতিরেই হোক যেখানেই তুমি যেতে চাও না কেনো হোটেলের নিচে তোমার জন্য ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে। এতটাই মাই ডিয়ার টাইপ যে, তারা ব্যবসার খাতিরে নিজের টাকা খরচ করে হলেও তোমাকে চা, কফি অথবা ড্রিঙ্কস খাওয়াবে।

কথা বলতে বলতে দুজনেরই খাওয়া শেষ হয়ে গেল।

ধ্রুব বলল, একটা ব্যাপার আমাকে অনেক অবাক করে দিয়েছে জানো।

কৌতূহলী চোখ নিয়ে অনন্যা জানতে চাইল।

কী ?

জীবনে তোমার মতো এমন মনোযোগী শ্রোতা আমি আর কখনোই পাইনি। তোমার সাথে আমার আরো আগে কেন দেখা হলো না, অনন্যা ?

কথাটি আবারও বলতে বলতে ধ্রুব হাত উল্টে ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বেজে গেছে।

অনন্যাও উঠে দাঁড়াল।

ধ্রুব জানতে চাইল, বাহিরে যাবে?

জ্বী, একটু ফ্রেস হয়ে আসি। চলো তবে। আমিও তোমার সাথে যাই। একটা সিগারেট ধরাতে হবে।

ট্রেনের করিডোরে অকম্পিত টিমটিমে কিছু আলো জ্বলছে। করিডোরের পথ অনেকটা সরু। আলো-আঁধারিতে পথ একটু সাবধানে চলতে হয়। পাশাপাশি হাটা যায় না। অনন্যা অতি সাবধানে আগে আগে যাচ্ছে আর ধ্রুব তার পেছনে। বগির শেষ প্রান্তে পৌঁছে দরজার পাশে অনন্যাকে হাতের ইশারায় বাম পাশটা দেখিয়ে দিয়ে ধ্রুব বলল, ঐ দিকে।

ট্রেনটি এখন গয়া জংশন স্টেশনে থেমেছে। ধ্রুব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা টান দিয়ে সিগারেট টানছে। স্টেশনের আলোটা দেখতে কেমন ভূতুরে। আকাশবাড়ির তারারা ভূখণ্ডের অন্ধকার দেখে মিটমিট করে হাসছে। হঠাৎ দুজন যাত্রী তড়িঘড়ি করে ওদের কম্পাটমেন্টে উঠল। ওদের সাজ পোশাক দেখে ভুত দেখার মতোই যেন একটু চমকে গেল ধ্রুব। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে

দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। যাত্রী দুজন রীতিমতো ধাক্কা দিয়েই ধ্রুবর গা ঘেঁসে ব্যাগ উঠাচ্ছিল।

ফিরে এসে অনন্যা দেখল, দরজার পাশে ধ্রুব এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দুজন যাত্রী পেছন ফিরে ওদের জিনিস পত্র উপরে উঠাচ্ছে। ধ্রুবর হাতে সিগারেটের প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট টুকরো। অনন্যা জিজ্ঞেস করল এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে? কেবিনে যাননি? ধ্রুব বলল, তোমাকে ফেলে কী করে যাই ম্যাডাম? লজ্জিত দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে অনন্যা বলল, আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন?

জ্বী ম্যাডাম। বলে ধ্রুব এক গাল হাসি দিয়ে বাকি সিগারেটের টুকরোটা বাহিরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সামনের দিকে হাত ইশারা করে বলল, চলো ফেরা যাক।

চলুন।

ঘুরে দাঁড়াতেই প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলো অনন্যা। বুকটা ধরফর করে উঠল। অদ্ভুত বিদ্ঘুটে সাজ পোষাকে দুই মহিলা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনন্যাকে দেখেই দুই হাত কানের কাছে নিয়ে বলল “হায় হায় কিতনি ছুন্দর হ্যায়রে তু। কাহাছে আয়াহেরে? দে না কুচ বকশিষ দে না হামকো। দু হাতে তালি বাজাতে লাগল। বুঝতে বাকি রইল না অনন্যার এরা কারা। অনন্যা ভয় পেয়েছে দেখে ধ্রুব পকেট থেকে দ্রুত টাকা বের করে ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল, ওকে আভি আপলোগ যাইয়ে, যাইয়ে।

তারপরও ওরা সামনের থেকে সরলো না। বলতে লাগল, আরে ডারতা কিউরে? ম্যায় হিজড়া হু ইসিলিয়ে ? ম্যায় ভি ইনসান হু তু ভি ইনসান হ্যায়। এই কথা বলেই একজন অনন্যার গায়ে মুখে হাত বোলাতে লাগল।

ঠিক আছে, ঠিক আছে বলেই ধ্রুব দ্রুত অনন্যার সামনে এসে কোনো রকম ওকে আড়াল করলো। সংকোচ ছাড়াই অনন্যার একটা হাত ধরে ঐ জায়গা থেকে ক্যাবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। পেছন থেকে ভেসে আসছিল ওদের অশ্লীল হাসি। কেবিনে এসে হাতটি ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে ধ্রুব বলল,

সরি,

না বলে তোমার হাত ধরে ফেলেছি। অনন্যা স্তম্ভিত। ধ্রুবর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ধ্রুবর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হৃদপিণ্ড যেন খসে পড়বে এক্ষুনি। বুকের ভেতরে রীতিমত তীব্র গতিতে সমুদ্রের গর্জনের তোলপাড় শুনতে পাচ্ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে লাগল। ধ্রুবর সচেতনতার প্রতি হৃদয়ে সূক্ষ্ম এক ইন্দ্রিয় অনুভূতি অনুভব করল অনন্যা।

হঠাৎ পাশের প্রবীণ দম্পতির মেজর সাহেব  দ্বিতল বিছানা উপর অনেক জোরে জোরে কাশতে শুরু করলেন। ওরা দুজনেই তাদের বিছানার দিকে তাকাল। সুধা দেবী কাঁথা মোড়া দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছিলেন। কাশীর আওয়াজ শুনতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে পানি খুঁজতে লাগলেন। মেজরের কাশী কিছুতেই থামছে না। ধ্রুব দ্রুত ওর ব্যাগ থেকে একটি পানির বোতল বের করে মেজরের মুখের সামনে ধরলো।

ভদ্রলোক এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে বোতলের পুরো পানিটা শেষ করল। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে একটি তৃপ্তির হাসি দিলেন। সুধা দেবী মধুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধ্রুবকে বললেন,

বেঁচে থাকো বাবা।

ধ্রুব মেজরের কাছে জানতে চাইল,

এখন ভালো অনুভব করছেন ?

হ্যাঁ, ভালো, ভালো।

অনেক তেষ্টা পেয়েছিল।

ধন্যবাদ তোমাকে বাবা, অশেষ ধন্যবাদ।

ধ্রুব এসে নিজের সিটে বসলো।

অনন্যার চোখে চোখ পড়তেই বলল, অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলে ?

আঁচলটা টেনে নড়েচড়ে বসল অনন্যা। উপরে নিচে মাথা নেড়ে জবাব দিল, হুম।

কিছুক্ষণ নীরবতা। প্রবীণ দম্পতির দুজনেই বিছানা ছেড়ে উঠেছেন। ওনারা নিঃশব্দে খাচ্ছেন। দাদখানি চালের সাদা ভাত আর মাছের ঝোলের তরকারি। খেতে খেতে সুধা দেবী অনন্যার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, তোমরা খেয়েছ তো মা?

জ্বী আন্টি।

খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ পর দুজনেই আবার যার যার মতো বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে।

অনন্যা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছে,

কষ্টি পাথরের মতো কালো অন্ধকার পৃথিবীকে কেমন করে গিলে খাচ্ছে।

ধ্রুব সিটের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

হঠাৎ নড়েচড়ে বলে উঠল, ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা কারো ক্ষতি করে না। একটু লাউড এটিটিউড করে, এই যা।

প্রশ্ন ভরা চোখ নিয়ে অনন্যা বলল,

আপনি ঘুমাননি ?

তেমন করে নাহ্, ঘন্টাখানেক চোখকে একটু বিশ্রাম দিলাম, আরকি।

ঘুম পায়নি ?

না।

ওহ্!

জানো, আমি হিজড়াদেরকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি ধ্রুব বলল,

কোথায় দেখেছেন?

ব্যাংকক শহরে।

অনন্যা অকপটে ধ্রুবর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। একটু মনক্ষুন্ন হয়েই বলল, ওদের কালচার আমাদের দেশের হিজড়াদের কালচার থেকে অনেক ভিন্ন।

হুম তা ঠিক। ধ্রুব বলল।

আমাদের দেশের হিজড়াদের মতো ওরা এতটা এগ্রেসিভ নয়।

তুমি যে এতটা ভয় পাবে আমি বুঝতে পারিনি।

আচ্ছা ভুলে যাও ঐ সময়টির কথা।

ঘুম পেয়েছে ? ধ্রুব এবার অনন্যার কাছে জানতে চাইল।

না।

আচ্ছা, তবে তোমাকে আরেকটি গল্প শোনাই।

শুনবে?

আরো গল্প ?

অবাক হয়ে অনন্যা জানতে চাইল।

পরক্ষণেই বলল, আপনার কাছে গল্পের ভান্ডার আছে দেখছি।

হুম, তা আছে বটে।

বলুন শুনি।

এটাও ব্যাংককে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। আপনি কি প্রায়ই ব্যাংককে যান ?

হুম।

কেন ?

আমার ব্যবসার কাজে।

আচ্ছা!

বলুন, আর কী কী গল্প আছে আপনার কাছে।

গল্প নয় ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা।

ধ্রুব মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল।

তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল।

একবার রাতের ব্যাংককটা একটু ঘুরে দেখার আগ্রহে বের হলাম। সেইবার আমি একাই গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটাচলার পরই দেখতে পেলাম ব্যাংককে প্রচুর সুন্দরী হিজড়াদের বাস।

অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে ধ্রুব বলল, জানো তো হিজড়াদেরকে যে সিমেইল বলে?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই ধ্রুব আবার বলতে শুরু করল, এইসব সিমেইলদের জীবন সমাজের কাছে চরম অবিচার আর লাঞ্ছনার। এদের অসমতা যন্ত্রণার ছবি রাতের আঁধারে সামনে থেকে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

সুখুম্বিট এলাকায় একটি প্রসিদ্ধ আবাসিক হোটেল আছে। “গ্রান্ড সিটি হোটেল”। আমি যখনই ব্যাংকক যাই সেই হোটেলেই উঠি। হোটেলের এক ম্যানেজার দেখতে ছোট খাটো অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে। নাম লিংড়া। অনেক মাই ডিয়ার টাইপ। ওর সাথে অনেক ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। দেখা হলেই অমায়িক ভঙ্গিতে বেশ সুন্দর করে কথা বলত। ব্যাংককে কোন্ জিনিসটা ভালো কোনটা খারাপ সেই ব্যাপারে সবসময় সে আমাকে পরামর্শ দিত। হোটেলের রিসেপশন লবিতে আসার সাথে সাথেই লিংড়া উৎফুল্ল ভঙিতে আমার কাছে এগিয়ে আসত। আমার কী প্রয়োজন, কী লাগবে। আমার কোনো কাজে সে আসতে পারে কিনা? খাওয়া, গাড়ি, ড্রিঙ্কস, এমন কী মেয়েদের সাথে ডেট করার ব্যাপারে অফার করতেও দ্বিধা করতো না।

একদিন সকালে বাহিরে বের হওয়ার সময় কথা প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে ফান করে বলেই ফেললাম। আমার তো তোমাকে অনেক পছন্দ। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আমার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইল। ঐ মূহুর্তে আমি ওর চোখের ভাষা পড়তে পারিনি। পরক্ষণেই সে হেসে দিয়ে বলল, তুমি কি আমার সাথে ফান করছো ? বললাম, না। আসলেই তোমাকে আমার অনেক পছন্দ। আমি তোমার সাথে একদিন ডেট এ যেতে চাই। লিংড়া গম্ভীর হয়ে গেল আর কোনো কথা বাড়ালো না। আমি হাসতে হাসতে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম।

সমস্ত কাজ শেষ করে যখন হোটেলে ফিরলাম, দেখি লিংড়া হোটেলের ইউনিফর্ম ছাড়া রিসেপশন লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আমার দিকে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম। সকালের কথা ও আবার সিরিয়াসলি নেয়নি তো! আমাকে দেখে আমার সামনে এসে বললো, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। তোমার কি সময় হবে ? তুমি কি আমার সাথে একটা ড্রিঙ্কস নিবে? আমার অসমাপ্ত কিছু কাজের কথা ভেবে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম। অবশেষে রাজি হয়ে বললাম, ঠিক আছে, আমি রুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসছি।

হোটেলের ব্যাক ইয়ার্ডে সুইমিং পুলের কাছে গোছানো কিছু টেবিল চেয়ার সাজানো থাকে। আমরা দুজন সেখানে মুখোমুখি বসলাম। পুতুলের মতো দেখতে সুন্দর প্রাণবন্ত মেয়েটির চেহারা সেদিন হঠাৎ করেই যেন অনেক মলিন দেখাচ্ছিল। চোখে মুখে এক গভীর বিষন্নতা ছেয়ে আছে। কেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

জানতে চাইলাম, তুমি ঠিক আছো লিংড়া?

গ্লাস রেডি করে সে আমার দিকে ড্রিঙ্কস এগিয়ে দিতে দিতে ছোট্ট এক উত্তরে বলল,

হুম।

তারপর সকালের কথার রেশ টেনে এনে আমার কাছে জানতে চাইল, তুমি আমাকে সকালে ঐ কথাটি কেনো বললে ধ্রুব? প্রশ্নটি শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, আরে ভুলে যাও সেই কথা। আমি তো ফান করেছি তোমার সাথে। লিংড়া মাথা নিচু করে ধীর স্বরে বলল, হুম, আমার সাথে সবাই ফানই করে।

বুঝতে পারলাম অজান্তেই আমি ওকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি বললাম তুমি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছ ? লিংড়া তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, যার জীবনে কখনোই সুখ খুঁজে পায়নি। পুরো জীবনটাই যার বিভীষিকাময় কষ্টের পেয়ালায় পরিপূর্ণ তার আবার কিসের দুঃখ বলো ? বলেই লিংড়া চোখের পানি মুছতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে সাথে সাথে ওকে সরি বললাম। আবারও বললাম আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি সত্যিই ভেরি সরি।

লিংড়া কাঁদতে কাঁদতে বলল ইটস্ ওকে।

আমরা দুজনেই ড্রিঙ্কসে চুমুক দিলাম। লিংড়া আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমার এখানকার কাজ কি শেষ ?

হুম, কাল সকালেই ফ্লাইট।

ওহ্ তবে তো তোমার তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। হুম, ঘুমানো দরকার। ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে নিব। তুমি কী যেন বলবে বলছিলে!

লিংড়া ড্রিঙ্কসে চুমুক দিয়ে বলল,

তোমাকে আমার জীবনের একটা ঘটনা বলতে চাই। যদি তোমার সময় নষ্ট না হয় তবে বলতে পারি।

যদিও আমি প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম।

এই মূহুর্তে আমার ঘুমের অনেক প্রয়োজন তারপরও সকালের কথা ভেবে আমি ওকে সম্মতি জানিয়ে বললাম। অবশ্যই, তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পারো। যা বলতে চাও।

আমি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলার জন্যই হয়ত লিংড়া আমাকে এখানে ডেকে এনেছে। ও ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল। বছর দুই আগে তোমার মতো এক বাঙালি ছেলে প্রায়শই আমাদের হোটেলে এসে উঠত। ওর নাম ছিল শুভ্র। ওর কথা বলার ধরণ ছিল অতি চমৎকার। যে কোনো মেয়েকেই আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট সুদর্শন। লবিতে এলেই বিভিন্ন অজুহাতে শুভ্র আমার সাথে কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করত। কাজে থাকি বলে তেমন করে কখনোই কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ওর সাথে। আমার জন্য প্রায়ই একটি সাদা গোলাপ নিয়ে আসত। প্রতিদিন শুভ্র আমার দিকে আপাদমস্তক যেভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো তাতে করে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে ও আমাকে কতটা পছন্দ করে। আমিও অপেক্ষায় থাকতাম লবিতে কখন শুভ্র নিচে নেমে আসবে। আমি নিজেও ক্রমশ ওর প্রতি দূর্বল হতে লাগলাম।

একদিন শুভ্র আমার হাতে একটি উপহারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, আজ তোমাকে আমি ডিনারে নিয়ে যেতে চাই। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।

আমি যেন এই সময়টির জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। প্রথমে লজ্জা আর সংকোচে চুপ করে রইলাম। বাহিরে অসম্মতি দেখালেও মনে মনে যেন চাইছিলাম শুভ্র আমাকে জোর করুক, অনুরোধ করুক। ও যেন আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল। পরমূহুর্তেই শুভ্রর অনুরোধে আমি রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হলো কাজ শেষে আমরা ডিনারে যাব।

এক অপার্থিব আলোয় ভরে গেল আমার জগৎ। ব্যাগের ভেতরে ছিল একটি লাল রঙের ঝলমলে পোশাক। যথারীতি সময় অনুযায়ী আমি শুভ্রর দেয়া ঝলমলে লাল পোশাক পরে মোহময়ী সাজে তৈরী হয়ে নিলাম। ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রথম ঝলকে নিজেকে আকৃষ্ট করার জন্য যতটুকু সাজের প্রয়োজন তার সবটাই করলাম। মন থেকে সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে পৃথিবীর সবার চাইতে সুখি আর সুন্দর মানুষ বলে নিজেকে ভাবতে শুরু করলাম।

আমার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লিংড়া বলে উঠল, আরে তোমার ড্রিঙ্কস তো শেষ হয়ে গেছে আরেক প্যাগ দেই ? আমি না সূচক মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বললাম, সকালে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠতে পারব না। লিংড়া নিজের গ্লাসে আরেক দফা ঢেলে নিল। আমার অনুভূতির দরজায় কড়া নেড়ে বলে গেল লিংড়া মনে হয় ওর ভেতরের সমস্ত কষ্ট আজ আমার কাছে বলে হালকা হতে চাইছে।

ও আবার বলতে শুরু করল। সেই সন্ধ্যায় আমরা দুজনেই অনেক আনন্দ করলাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম, শপিং করলাম। তারপর একটা ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনার শেষ করে যখন ফিরছি শুভ্র আমাকে অনুরোধ করল, ওর হোটেল রুমে যাওয়ার জন্য। প্রথমে আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না কিন্তু শুভ্র অনেক পিড়াপিড়ি করতে লাগল। শেষ অবদি ওর অনুরোধের কাছে আমি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম। রুমে যেয়ে আমি এককোণে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ভেতরে এক অজানা ভয় তাড়া করছিল। ও আমাকে হাত ধরে বেডের এক পাশে বসিয়ে বলল, রিলাক্স হয়ে বসো। কিছুক্ষণ পর শুভ্র ফ্রেস হয়ে আমার কাছে এসে বসল। আমার হাতে হাত রাখল। আমাকে স্পর্শ করতে লাগল। আমার চুল নিয়ে খেলা করতে লাগল। আমি ভয় পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সরে বসলাম। বললাম আমি ফিরে যেতে চাই। শুভ্র আমার দিকে গভীর ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সত্যি বলছি আমি তোমাকে অনেক অনেক পছন্দ করি লিংড়া। অনেক দিন ধরে চাইছিলাম তোমার সংস্পর্শে আসার। কিন্ত সাহস করতে পাচ্ছিলাম না। আজকে আমার অনেক ভালো লাগছে তোমাকে কাছে পেয়ে। আজ থেকে তোমার সবকিছুর উপর কেবল আমার অধিকার। ওর কথায় আমি যেন অন্ধকার জীবনে কিছুটা আলো খুঁজে পেলাম। ওর এক একটি ভালোবাসার শব্দে আর আদরে আমি আইসক্রিমের মতো গলতে শুরু করলাম। লজ্জার লতা যেন জড়িয়ে ধরেছে অভিসারে গমন উদ্যোগী আমার জিহ্বা। নিজেকে আর বাঁধা দিতে পারলাম না। ওর আদর সোহাগের কাছে ভুলে গেলাম এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার অন্ধকার অস্তিত্বের কথা। আমার অতীতের সবকিছু। তখন আমি উদিত সূর্যের মতো ঐ মূহুর্তটিকে ধরে রাখতে চাইলাম। কিন্তু এত সুন্দর দৃশ্য তো কখনোই ধরে রাখা সম্ভব নয়। আমি যখন শুভ্রর ভালোবাসায় স্বপ্নিল সাগরে ভাসছিলাম, তখনই আকস্মাৎ আমার সমস্ত ভ্রম ভেঙে দিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে শুভ্র বেড থেকে লাফিয়ে নামল। হাত ধরে সে এক ঝাটকায় আমাকে হ্যাঁচকা টানে বিছানা থেকে নামিয়ে মুখের উপর প্রচন্ড জোরে একটি ঘুষি মারল। এক মূহুর্তের জন্য আমার সমস্ত পৃথিবী যেন দুলে উঠল। ছিটকে যেয়ে আমি মেঝেতে হুরমুর করে পড়লাম। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি চিৎকার করে আমার নিজের মুখ চেপে ধরলাম। দুই হাত রক্তে ভেসে গেল। একসময় খেয়াল করলাম আমার হাতের মুঠোয় একটা দাঁত চলে এসেছে। ভয়ে আমি আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় শুভ্র নিজেও অনেক ভয় পেয়ে গেল। ক্ষুব্ধ হয়ে বারবার দুই হাতে আমার গায়ে ঝাকুনি দিয়ে বলতে লাগল, কেনো, কেনো তুমি আমাকে চিট করলে? কেনো তুমি আমাকে গোপন করেছো তোমার মিথ্যে পরিচয় ? কেনো তুমি আমাকে বলনি এই কথা?

তুমি যে একজন সিমেইল।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত লিংড়ার কথা শুনেছিলাম। হঠাৎই যেন প্রচন্ড এক ধাক্কায় বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। বড় বড় চোখ করে লিংড়ার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসলাম। মূহুর্তের জন্য যেন মনে হলো আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লিংড়া বলল, যা শুনেছে তা সবই সত্যি। আমি সাধারণ নারী নই, ধ্রুব। আমি একজন সিমেইল।

কেবিনের ভেতর থমথমে এক নিস্তব্ধতা। অস্তমিত সূর্যের মতো অনন্যার চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছে। কিছু মূহুর্তের জন্য ধ্রুবও নিশ্চুপ হয়ে গেল। এক অচেনা রাত্রিতে অচেনা লোকের কাছে অনন্যা এক অসহায় হিজড়ার জীবন কাহিনী শুনছে। কিছুক্ষণ আগেও যখন দুজন হিজড়া অনন্যার গায়ে হাত দিয়েছিল আতঙ্কে আর ঘৃণায় ওর গা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল। অথচ লিংড়ার কথা ভাবতে ভাবতে অনন্যার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

তারপর ? তারপর কী হল ? দুর্নিবার কৌতূহল নিয়ে অনন্যা ধ্রুবর কাছে জানতে চাইল।

আকস্মিক ভাবে লিংড়ার মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে আমি নিজেই বড়োসড়ো একটি ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমি স্তব্ধ। অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। লিংড়ার দুচোখে জলের ধারা বইছিল। আমার সামনে বসে এত সুন্দর একটি নারী,

নাহ্

নারী নয়।

এক হিজড়া কাঁদছে। আর আমি স্তম্ভিত, হতবিহ্বল। কী বলব? আমার কী বলা উচিৎ?  ঐ মূহুর্তে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলাম লিংড়াকে, এরপর কি হয়েছিল ? শেষ ড্রিংক্সে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল,

আমি দৌড়ে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে আসি। আমার হোটেল স্টাফরা আমাকে এমন অবস্থায় দেখতে পেয়ে পুলিশ কল করে। পুলিশ এসে আমাদের দুজনকেই থানায় নিয়ে যায়।

পরবর্তী ঘটনা ছিল এইরকম।

শুভ্রর কথা শুনে পুলিশ প্রচন্ড রাগ করে লিংড়ার উপর। কারণ সে সিমেইল হয়ে নিজের কথা গোপন করে অন্যায় কাজ করেছে। আর শুভ্র লিংড়াকে আঘাত করার কারণে তার জেল হবে বলে পুলিশ জানায়। এই কথা শুনতেই লিংড়া পুলিশ কে বারণ করল শুভ্রকে যেন জেলে না দেওয়া হয়। লিংড়া পুলিশ অফিসারকে কেইস উঠিয়ে নিতে বলল। পুলিশ রাজি হলো ঠিক, কিন্ত শুভ্রকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়নি। এক হাজার থাই বাত জরিমানা করার পরই কেইস ডিসমিস করেছিল।

শেষ অবদি ওরা দুজনেই দুজনকে সরি বলে যে যার মতো থানা থেকে বিদায় নিয়েছিল।

কথা শেষ করে ধ্রুব শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাহিরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। অনন্যা ধ্রুবর কাছে জানতে চাইল,

এরপরে কি আর কখনো শুভ্রর সাথে লিংড়ার দেখা হয়নি ?

ধ্রুব বলল, না

আপনি কী বললেন? লিংড়ার কথা শুনে।

তেমন কিছুই বলা হয়নি।

লিংড়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, শুভ্র আমার সমস্ত স্বপ্নকে খাঁচায় বন্ধ করে দিয়েছে। শুভ্রকে ভালোবেসে আমি নিজেকেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমাকে এমন করে কখনোই কেউ ভালোবাসেনি। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে চরম ভাবে অবহেলিত। আমার বাবা মা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। এই সমাজের কাছে আমরা যে কতটা নিপীড়িত বাহিরের থেকে কেউ তা বুঝতে পারে না। আমাদের জীবন তোমাদের জীবন থেকে অনেক আলাদা ধ্রুব। আমি সত্যিই শুভ্রকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমাদের যে ভালোবাসতেও নেই। সে কথা কিছু মূহুর্তের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম। গোপন করেছিলাম আমার সত্য পরিচয়। কান্না জড়ানো আড়ষ্ট গলায় লিংড়া বলল, আমি যে এক সিমেইল।

লিংড়া মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল।

জন্ম লগ্ন থেকে শারীরিক ভাবে অপ্রতিভ অপারগ হয়ে বেড়ে ওঠা লিংড়াকে মানুষিকভাবে প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। লিংড়ার অস্তিত্বে শুভ্র সারা জীবনের জন্য এঁকে দিয়ে গেছে অভিমানের চুম্বন। আমি আমার চেয়ার ছেড়ে শ্লথ পায়ে ওর সামনে যেয়ে বসলাম। ওর হাত দুটো ধরে বললাম আমি না জেনে তোমাকে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি লিংড়া। আই এম রিয়েলি ভেরি সরি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। কাঁদতে কাঁদতে লিংড়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও বাঁধা দিলাম না ওকে। জানিনা কতক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম। একসময় লিংড়ার বুক ভাঙ্গা কান্না থামল। তারপর একটা টাইট হাগ দিয়ে আমি আমার হোটেল রুমে ফিরে এলাম। মনটা অনেক অস্থির লাগছিল লিংড়ার জন্য। পরদিন প্রত্যুষে হোটেল ছাড়ার আগে ওকে অনেক খোঁজ করলাম কিন্ত কোথাও পেলাম না। লিংড়াকে দেখতে না পেয়ে আহত পাখির মতো মন খারাপের দল সময়ের হাত ধরে শব্দ সাজিয়ে গেল নিরবে নিভৃতে।

প্রায়শই আমি ভাবি, ক্ষুদ্র এই মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষের সাথে মনুষ্যত্বের সম্পর্ক কি কেবলই স্বার্থের সুতো দিয়ে বাঁধা ?

ধ্রুব ঘড়ি দেখল। চারটা দশ বাজে। ট্রেন কিছুক্ষণ পর কানপুর সেন্ট্রাল স্টেশনে থামবে।

সিগারেটের অনেক তেষ্টা পেয়েছে।

ধ্রুব খেয়ালই করেনি পাশে বসা প্রবীণ দম্পতি আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন।

ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে উঠে দাঁড়াতেই দেখে অনন্যা বিমর্ষ চেহারায় জানালার বাহিরে গভীর রাতের অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো কেটে কেটে পড়ছে কূপকূপে অন্ধকার দেয়ালের ওপর। মাঝে মাঝে সেই আলো এসে অনন্যার চেহারার পড়ছে। আবছায়া আলো-আঁধারির মধ্যে ধ্রুব দেখতে পেলো অনন্যা কাঁদছে। ওর ধবধবে ফর্সা গালে চোখের জল চিকচিক করছে। ধ্রুব কেবিন থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

পাতলা মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢেকে গেছে। সিগারেট টানতে টানতে গভীর রাতের অতলে ডুবন্ত ধ্রুবর অবচেতন মন ভাবতে লাগল অনন্যার কথা। মেয়েটির প্রতি এত আকর্ষণ অনুভব করছে কেন সে?

আমাদের সীমিত জীবনে হঠাৎ করেই কিছু মানুষের আগমন ঘটে। আবার হঠাৎ করেই কাউকে না কাউকে ভালো লেগে যায়। কিন্তু আমরা সময় মত তাদেরকে জীবনে কখনো পাই না। ইচ্ছে করলেও পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। দূর থেকে তখন শুধুই আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

ফিরে এসে ধ্রুব অনন্যাকে আবেগী গলায় ডাকল,

অনন্যা

আড়ষ্ট গলায় অনন্যা জবাব দিল,

হুম

তুমি কাঁদছো?

অনন্যা চুপ।

অনেকটা সময় দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। কারো চোখেই ঘুম নেই। নির্জন মূহুর্তে মানুষের মনের দরজা খুলে যায়।

এতটা সময়, এত কথা, এত গল্পের পর ধ্রুব কোনো রকম ভণিতায় না যেয়ে এক সমুদ্র সাহস সঞ্চয় করে অনন্যাকে বলেই ফেলল। তুমি যদি অনুমতি দাও তবে একটা কথা বলতে চাই !!

অস্ফুট স্বরে অনন্যা বলল,

জ্বী বলুন।

তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে অনন্যা। তোমাকে যতই দেখছি ততই অভিভূত হচ্ছি। কথাটা বলে ধ্রুব কিছুক্ষণ অনন্যার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জবাবের অপেক্ষায়।

অনন্যা চকিতে এক অভাবনীয় দৃষ্টি দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইল। ওর তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ধ্রুব আবার বলল, তোমার মনটা অনেক বড়, অনন্যা। পৃথিবীর সমস্ত ধন সম্পদের ভান্ডার তোমার মনের মাঝে। কী অসামান্য সম্পদের মালিক তুমি যা নিজেও জানো না। মন খারাপের মধ্যেও কথাগুলো শুনে অনন্যার মনের কোণে এক অভূতপূর্ব তরঙ্গ খেলে গেল। কেউ যেন একটি টোকা দিয়ে হৃদয়ের ঘুমন্ত নদীতে ছোট ছোট ঢেউ তুলে দিল।

কিছু বলছ না যে, ধ্রুব জিজ্ঞেস করল।

কী বলব ?

আড়ষ্ট গলায় জবাব দিল অনন্যা। তারপরও সাহস করে বলল, এটা কী করে সম্ভব!

আমার জীবনের চলার পথ এতটা সহজ নয় আপনি যেমনটি ভাবছেন। কিছুটা লজ্জা কিছুটা সংকোচ নিয়ে কথাটি বলে কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল অনন্যা। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, অনেক ভীড়ের মাঝেও একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ বোধ করি। মাঝে মাঝে নিজের জগৎটা অনেক শুন্য মনে হয়। মনে হয় কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে অনেক অন্ধকার ছেয়ে আছে আর আমি তার মাঝে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছি।

আমাকে কেউ আবিষ্কার করবে নিজের মতো করে অথবা আমাকে পছন্দ করে এমন প্রিয় কারো দেখা আমি আজও অবদি পাইনি। জীবনে অনেক অনুরাগী পিছু নিয়েছে কিন্ত কখনও আমার মানুষিক উচ্চতার মতো কাউকে বন্ধু হিসেবে পাশে পাইনি। কথা বলার জন্য এমন একজন মানুষ যার কথার জালে আমি আটকে যেতে পারি, বিগলিত হতে পারি, সেই সৌভাগ্য আমার জীবনে কখনোই আসেনি। অনন্যা কিছুক্ষণের জন্য থামল। তারপর বলতে লাগল,

ঘুণে ধরা কাঠের মতো উপর থেকে আমরা নিজেকে দেখাই অনেক ভালো আছি, কিন্তু কাঠের ভেতরটা যে পুরোটাই ক্ষয়ে গেছে একথা কেউ কখনো জানতেও পারে না।

ধ্রুব বলল, তাই বলে নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখবে ?

আমি নিজেকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করি।

ধ্রুব বলল, তোমার ভেতরে একটা আত্মগোপনীয়তা আছে। তারপরও পরতে পরতে শুদ্ধ লোকের আস্তরণ বুঝতে পারি।

জীবনে যদি কখনো ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে, তবে জীবনের সাথে কী করা উচিৎ ? অন্তরের মাঝে লুকানো যে সম্ভাব্য ক্ষমতা আছে  সেই উপলব্ধিকে বিকশিত করা, নাকি পথভ্রষ্ট হয়ে নিজেকে ধংস করে দেয়া। না বালিশে মুখ গুঁজে চোখের পানিতে জীবনকে ভাসিয়ে দেয়া ?

ভেবেছ কখনো একথা ?

এই পৃথিবীতে কেউ পাহাড় সমান দুঃখের ঝুলি নিয়ে বসতে চায় না, অনন্যা। প্রতিটি মানুষই নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। বেঁচে থাকতে চায়। কেউ নিজের জন্য বাঁচে, কেউ অন্যের জন্য। ভয়ঙ্কর দিনগুলোকে জানান দিতে হয় যে তুমিও সেই ভয়াবহ দুর্যোগের থেকে আরো বেশি বিপজ্জনক।

তোমার নীতিবোধ যা মানতে পারছে না। আমার যুক্তিহীন মন সেটাই তীব্র ভাবে চাইছে। জীবনের সমস্ত ছবিকে একসাথে করে আমরা স্বপ্ন দেখি।

সর্বাধিক ভয়াবহ দারিদ্র্য কি জানো অনন্যা ? একাকীত্ব এবং ভালোবাসা না থাকার অনুভূতি। প্রেম আল্লাহর অপূর্ব এক নেয়ামত। আর এর থেকে অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে রাখা বেঁচে থাকার জন্য অনেক কষ্টকর। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ধ্রুব একটু থামল। তারপর অনন্যার দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে আশাহত কণ্ঠে বলল, তোমার অতীত কখনোই আমি জানতে চাইব না। তোমার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে আমার মনের মধ্যে এঁকে নিলাম। তুমি সারাজীবন আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে অঙ্কিত হয়ে থাকবে। আর এই পৃথিবীর যেখানেই থাকো না কেনো আমি ঠিকই তোমার অনুসারী হয়ে থাকব।

ধ্রুব দ্বিতল বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ দুটো ঘোর তন্দ্রাভীভূত। নিদ্রাদেবীর ছায়ামঞ্জির মাথার মধ্যে রুমঝুম করে বাজতে আরম্ভ করেছে। মেজর এবং সুধা দেবী স্বপ্নঘোরে আচ্ছন্ন। ট্রেন ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে। ঘুম ঘুম নিরলস দৃষ্টি দিয়ে বাহিরে কিছু একটা দেখছে অনন্যা। কিন্তু এই অন্ধকার জীবনে গন্তব্যের শেষ কোথায় সে নিজেও জানে না।

ট্রেনের বাতায়ন বলভীতে সুখ সারি তন্দ্রামগ্ন। কাঁচ ভেদ করে ঊষার আলোর ক্ষীণ আভা দেখা যাচ্ছে পূর্ব দিগন্তে। অনন্যা বিষন্ন হয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, ধ্রুব কী কখনও মেনে নিবে তার অতীত ইতিহাস? না এ হতে পারে না।

আমার একাকিত্বের বেদনা প্রচ্ছন্ন। অনন্যা ভাবতে লাগল, জীবনের পাঠাগার অনিশ্চয়তায় আবর্তিত, বেদনার বালুচড়ে ডুবে থাকা দূর্বিসহ অবিচ্ছেদ্য কিছু অংশের কথা।

ভোরের স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়ায় মিষ্টি একটি গন্ধ ভেসে আসছে। বাইরে কুয়াশা বর্জিত শ্ৰাবণের আকাশে সকাল বেলার আলো ঝলমল করছে। ইতিমধ্যেই ঘুম ভাঙা শহরের কর্ম কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। আকাশেও এই চাঞ্চল্যের কিছুটা প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক দূরে একঝাঁক পায়রা সূর্যের উত্তাপের দিকে ছুটে চলেছে। স্টেশনের জনস্রোতের মধ্যে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন এক মায়াজালে আটকা পড়ে গেছে। কোনো রকম কোলাহলই ওদেরকে আর স্পর্শ করতে পারছে না। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। একসময় ধ্রুব বলে উঠল, নারীর হৃদয় পুরুষের কাছে এক দুর্জয় রহস্য। আমি আমার সবটুকু তোমাকে দিতে রাজি আছি অনন্যা। তোমাকে আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা আমার হৃদয়ের স্পর্ধা। আর আমার এই স্বাধীনতাকে তুমি কখনই আহত করতে পারবে না। যদি আবার কোনোদিন দেখা হয়, সেদিন আমাকে আর ফিরিয়ে দিও না অনন্যা। ধ্রুবর চোখে আকুতি।

নিবিড় প্রেম পরিমাপ না করে কেবল বিলিয়ে যায়। তাই কিছু অপূর্ণতায় ভালোবাসার সুখ বিদ্যমান। শুধু মাত্র দায়বদ্ধতার কারণে সম্পর্ক করা বা টিকিয়ে রাখা সবার ভাগ্যে সয় না। একটা অন্বেষণ থেকেই যায়। ধ্রুবর কথায় একটা বড় ধরণের হোঁচট খেলো অনন্যা। মনের মধ্যে আক্ষেপ নিয়ে অনন্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ধ্রুব দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। অনন্যা তাকিয়ে থাকতে চাইছে না। তারপরও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ওর অবাধ্য দুটি চোখ ধ্রুবর চলে যাওয়া দেখছে। অনন্যার নিস্পৃহ দৃষ্টিতে অমোঘ দীঘির জল টলটল করছে। এক সমুদ্র হতাশায় ডুবে গেলো মন। হঠাৎই মনের মধ্যে এক শূন্যতা অনুভব করতে লাগল। বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল। দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা নিজেই নিজের ইচ্ছেডানায় ভর করে মনকে সাজিয়েছে যা একমুহূর্তে ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল। কখন যে চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল টেরই পেল না। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে গন্তব্যহীন উদ্দেশ্যে স্টেশনের বাহিরে সামনের দিকে পা বাড়াল। স্টেশনের দৃশ্যপটে এক তরুণীর না বলা অতলান্ত অনুভূতির কাহিনী চোখের জলে ভূমিতে স্খলিত হয়ে মিশে গেল।

উইলি মুক্তি। কবি ও গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশ ঢাকা, আর কে মিশন রোড। বেড়ে ওঠা, ধানমণ্ডি। বর্তমান নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। পড়াশোনা করেছেন ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ, ইউনিভার্সিটি অফ ডিট্রোয়েট মিশিগান। প্রকাশিত বই: 'জল পাথরের যুগলবন্দি' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০ সাল)

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..