নখদর্পণ

রঞ্জন রায়
গল্প
Bengali
নখদর্পণ

ফার্স্ট বেঞ্চ লাস্ট বেঞ্চ

মানসকে জব্দ করার এমন সু্যোগ পাওয়া যাবে কে ভেবেছিল? সাতটা দিনও যায় নি আমরা ঝগড়া করে কথা বলা বন্ধ করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি খালি ঝগড়া নয়, একটু হাতাহাতিও  হয়েছিল।  আসলে মানস হচ্ছে অতিচালাক।  কথায় বলে না – অতি চালাকের গলায় দড়ি!

আরে এটা কী বললাম! গলায় দড়ি! না, না।  মানস আমাদের মিশনের বাগানের আমগাছের ডাল থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে এ আমি কল্পনাই করতে পারি নে, সে যতই ঝগড়া হোক।  আর সত্যি কথাটা হচ্ছে একসময় আমরা খুব বন্ধু ছিলাম।

একসময় মানে? মানে এই গতবছর পর্য্যন্ত।  কবে থেকে? সেই ক্লাস সিক্স থেকে।  এখন আমরা টেনে পড়ি।  ও হল আমাদের ফার্স্ট বয়। আরে সব ক্লাসেই তো একজন করে ফার্স্ট বয় থাকে। তাতে কী! আমি খুব খারাপ ছাত্র নই, তবে ক্লাসে এগারো নম্বর।  কিন্তু ক্রিকেটের মাঠে আমি একনম্বর। শুধু ওপেনিং ব্যাটই নই, ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ ফসকায় না।

আর মানস হল আমাদের আম্পায়ার। রুল বুক গুলে খেয়েছে। এল বি ডব্লিউ এর সমস্ত নিয়ম, বলের মাপ ও ওজন, পিচের কন্ডিশন, কখন খেলা বন্ধ হওয়া উচিত এসব ও স্যারদের থেকেও ভাল জানে।

এসব নিয়ে কোন ঝামেলা ছিল না।  প্রব্লেম হল মানস এ বছর থেকে হোস্টেল ছেড়ে ডে স্কলার হয়ে যাওয়ায়। একটু খুলে বলি।

ক্লাস সিক্সে, এক রোববারে আমি মিশনের হোস্টেলে ভর্তি হলাম।  ছোট ছেলেদের জন্যেএকটা বড় হলে বারো জন করে থাকার ব্যবস্থা।  আমাদের ক্যাপ্টেন শিবুদা। ক্লাস এইটে পড়ে, তিন বছরের পুরনো বলে খুব ঘ্যাম নেয়।  পরের দিন সকালে একটা বালতি আর ন্যাতা দেখিয়ে বলল—এই যে নতুন ছেলে! আজ তোমার ঘর মোছার ডিউটি।  ঘর বলতে গোটা হলটা।  ভাল করে ন্যাতা নিংড়ে  কষে মুছবে। জলে ভেজা চুবচুবে ন্যাতা আলতো করে বোলালে আবার মুছতে হবে। ফাঁকিবাজি চলবে না।

আমি কখনো ঘর মুছিনি।  আমাদের কোলকাতার ভাড়াবাড়িতে ঘরগুলো অনেক ছোট।  এত বড় হলঘর! আমাকে একলা মুছতে হবে? কান্না পেয়ে গেল।

এমন সময় মানস এগিয়ে এল।

–শিবুদা, এই হল তো রোজ দু’জনে মিলে মুছি। আজ নতুন ছেলেকে হটাৎ করে গোটা হলটা একা করতে বলছ কেন?

শিবুদা থতমত খেয়ে সামনে নিল। বাঃ, নতুন এসেই উকিল ধরেছে দেখছি।  দেয়ালে লাগানো চার্ট দেখ । আজ নীলু আর নতুন ছেলে সুমানস এর পালা।  নীলু শনিবার বাড়ি গেছে, কাল রাত্তিরেও আসেনি। তাই সুমানস একা মুছবে।

আমি কিন্তু কিন্তু করে বললাম—শিবুদা, আমার নাম কিন্তু সুমনস, সুমানস নয়।

–ওটা আবার কোন নাম হল নাকি? নামটা সুমানসই হবে, খামকা তক্কো করিস না।

— না শিবুদা, নতুন ছেলে ঠিক বলেছে। সুমনস মানে ফুল। ওটা তৎসম শব্দ।

শিবুদা বিষম খেল।

–আচ্ছা আচ্ছা, তোর যখন নতুন ছেলেটার জন্যে এতই দরদ, তুই নিজে ওর সঙ্গে হাত লাগা না! আর তুই—সুমানুস না বনমানুষ- ভাল করে শোন; আমাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকবি, কোন দাদা-টাদা নয়।

সেই দিন থেকে ও আর আমি ভীষণ বন্ধু হয়ে গেলাম। মানস আর সুমনস, হোস্টেলের মানিকজোড়।  ছূটিতে বাড়ি গিয়েও আমরা একজন আরেকজনকে চিঠি লিখতাম। ছুটি থেকে ফিরে একই রুমে সিট না পেলে ওয়ার্ডেন স্যারকে রিকোয়েস্ট করতাম।  ক্লাসে দুজনেই পেছনের বেঞ্চে বসতাম।  ফার্স্ট বয়কে লাস্ট বেঞ্চে বসতে দেখে স্যারেরা অবাক হতেন।

আসলে হোস্টেল থেকে ভাত খেয়ে এসে প্রথম পিরিয়ড একটু এগোতেই আমার বড্ড ঘুম পেত। ঠান্ডা কাঠের বেঞ্চে আলতো করে গাল রাখলে একটু পরে বাংলা স্যারের কথাগুলো আমার কানে অস্পষ্ট হতে হতে ভ্রমরগুঞ্জন হয়ে শেষে কোথায় হারিয়ে যেত।

বাংলা স্যার  বেশ বেঁটে, একটা লম্বা ছেলের পেছনে বসা আমাকে সহজে দেখতে পেতেন না। যদি বা দেখে ফেলতেন তখন মানস পাঁজরায় আঙুলের খোঁচা দিয়ে আমাকে জাগিয়ে দিত, স্যার পড়া ধরলে পাশ থেকে ঠোঁট না নাড়িয়ে চমৎকার প্রম্পট করত।

আবার টিফিনের পর হিন্দি ক্লাস; রবিনবাবু অদ্ভূত উচ্চারণে পড়াতেন—অগর ন নভ মেঁ বাদল হোতে!

আর মানস সেই সময় লাইব্রেরি থেকে আনা ‘পথের পাঁচালি’ বা ‘চরিত্রহীন’ মাথা গুঁজে পড়তে থাকত।  অবশ্যি বইটার গায়ে ভাল করে খবরের কাগজের মলাট চড়ানো আর তাতে কালি দিয়ে  মোটা  মোটা অক্ষরে লেখা ‘ আদর্শ হিন্দি ব্যাকরণ অউর নিবন্ধ’।

রবিনবাবু পড়াতে পড়াতে চক ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করে টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন। ওঁর পড়ানো বন্ধ হত না, কিন্তু কাউকে অন্যমনস্ক হতে বা ঝিমুতে দেখলে নিখুঁত টিপে চকের টুকরো ওদের মাথা তাক করে ছূঁড়তেন, কদাচিৎ ফস্কাতেন।

আমার কাজ ছিল স্যারের দিকে চোখ রাখা আর বিপদ বুঝলেই মানসকে সতর্ক করা। একবার রবিনবাবু ইশারায় আমাকে না নড়তে বলে মানসের দিকে চক ছুঁড়লেন। আমি অসহায়। কিন্তু আমার অজান্তেই আমার হাতের লাল খাতাটা টেবিল টেনিসের মত ব্যাকহ্যান্ড ড্রাইভ করে চকের টুকরোটাকে সোজা স্যারের টেবিলে ফিরিয়ে দিল। গোটা ক্লাস হেসে উঠল।

জীবনে প্রথম নিল ডাউন হলাম।

গতবছরের শেষের দিকে মানস ছুটি থেকে ফিরল ন্যাড়া মাথা হয়ে।  ওর বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। আসানসোল রেল  হাসপাতাল থেকে আর ফিরে আসেন নি।

নভেম্বর মাসে জানলাম যে ওর জেঠু হস্টেলের খরচ দিতে পারবেন না।  উনি বরানগরেই থাকেন। নৈনানপাড়ায়  ওঁর মনিহারি দোকান। মানস ওর মার সঙ্গে এখন থেকে জেঠুর সংসারেই থাকবে।  বার্ষিক পরীক্ষার আগেই ও হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে ডে স্কলার হয়ে গেল।  কিন্তু শেষ ক’টা দিন আমার পাশে লাস্ট বেঞ্চেই বসত।

গজব রে গজব!

নতুন বছর শুরু হল। আর যা ঘটল তা স্বপ্নেও ভাবি নি। আমাদের হোস্টেলে বিহার থেকে পড়তে আসা দীনু বলে উঠল—গজব রে গজব! এবার থেকে ফার্স্ট বয় ফার্স্ট বেঞ্চে!

মানস আমাদের সঙ্গে না বসে বসছে একেবারে ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথম সিটে।  কোন কৈফিয়ৎ না দিয়ে।  অন্য ছেলেদের থেকে কানাঘুষোয় জানা গেল যে ওর জেঠু ওকে লাস্ট বেঞ্চে বসতে বারণ করেছেন।  ওতে নাকি রেজাল্ট খারাপ হয়। আর মানস যদি প্রথম দশজনের মধ্যে না আসে তা হলে উনি আর পড়াবেন না।  মানসকে ওঁর দোকানে বসতে হবে।

যার সঙ্গে গত কয়েকবছর সকাল-সন্ধ্যে একসাথে কাটিয়েছি আজ তার সঙ্গে কথাই হয় না।  ফার্স্ট আর লাস্ট বেঞ্চের দূরত্ব যে অনেক।  পিরিয়ডের ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে কথা শুরু করি, কিন্তু ওর আড়ষ্ট ভাব আর চোখে চোখ না রাখা আমার আগ্রহে জল ঢেলে দেয়।

এ হতে পারে না, এ রকমটা হয় না। ভগবানের দরবারে এত অবিচার! নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে।  একদিন টিফিনের সময় ওকে ধরলাম। কী হয়েছে আমাকে বল, তোকে বলতে হবে।  ও নিস্পৃহ গলায় বলে হাতটা ছাড়। তারপর ক্লাসের সেকন্ড বয়, টবিন রোডের মলয়ের সঙ্গে গল্প করতে থাকে। আমার গালটা জ্বালা করে ওঠে, ফিরে আসি নিজের জায়গায়।

পরের দিন প্রেয়ার শুরু হল –“ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণম্”।

বারান্দায় লাইনের মধ্যে কোথাও মানস চোখে পড়ল না।  ও তো সহজে ক্লাস কামাই করে না!

প্রেয়ার এগিয়ে চলেছেঃ বায়ুর্যমোগ্নির্বরুণঃ শশাঙ্কঃ।

হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় ঢুকছে মানস। তাড়াহুড়ো করে আমাদের ছাড়িয়ে লাইনের পেছনের দিকে যাবার সময় আমি কিছু না ভেবেই পা বাড়িয়ে দিলাম।

আছড়ে পড়ল মানস। মাথাটা বেঁচেছে, কিন্তু হাতে ও হাঁটুতে নুনছাল উঠে গেছে।  সরি বলতে যাব কিন্তু তার আগেই আমার উপর ও ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্ধের মত মেরে চলেছে। আমি আটকাতে পারছি না।

আমাদের দুজনকেই হেডস্যারের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।

আমি কেন ল্যাং মেরেছিলাম তার কোন সদুত্তর দিতে পারলাম না। আমি নিজেই জানি না যে!

দ্বিতীয়বার নিল ডাউন হলাম।

হোস্টেল আর ডে স্কলার। লাস্ট বেঞ্চ বনাম ফার্স্ট বেঞ্চ।

একটা গোপন প্রতিযোগিতা, একটু আকচা আকচি এদের মধ্যে ছিলই। কিন্তু সেদিন আমার নিল ডাউন হওয়া নিয়ে ভাগাভাগি প্রকট হয়ে উঠল।

ডে স্কলারদের মতে আমি বিনা কারণে ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছি।

আবার হোস্টেলের ছেলেদের চোখে মানস হল ‘গদ্দার’। এত বছর হোস্টেলে কাটিয়ে আজ ডে স্কলারদের দলে!

ফিরে আসি গানের ধ্রুবপদে, সাতদিন আগের ঘটনায়।

ম্যাথসের ক্লাস।  অ্যসিস্টান্ট হেডমাস্টার রাজেন্দ্রস্যার কোয়াড্রাটিক ইকোয়েশন বা দ্বিঘাত সমীকরণ বোঝাচ্ছেন।  সেদিনের ক্লাসে উনি দেখাচ্ছিলেন যে কোন সমীকরণের যত ঘাত বা পাওয়ার, তার তত রুটস বা মূল হবে।  তাই দ্বিঘাত সমীকরণের দুটোই রুটস হবে। তিনটে হতে পারে না।

এবার উনি এই উপপাদ্যের অলটারনেটিভ প্রুফ নিয়ে পড়লেন।

-মনে কর, এই সমীকরণে দুটোর জায়াগায় তিনটি রুটস আছে- আলফা, বেটা, গামা।  এবার এইভাবে এগোতে গিয়ে দেখব যে এমন জায়গায় পৌঁছেচি যা আপাতবিরোধী বা সেলফ-কন্ট্রাডিক্টরি।  তার মানে? তার মানে হল প্রথম প্রেমিস বা আ্যসাম্পশানটাই ভুল বা গোড়ায় গলদ। ঠিক আছে? আচ্ছা, এই  ‘অলটারনেটিভ প্রুফ’ কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ কী হতে পারে? কে বলবে?

আমি হাত তুললাম। তার আগেই প্রথম বেঞ্চ থেকে হাত তুলেছে মানস।

স্যার একটু ভ্রূ কুঁচকে লাস্ট বেঞ্চকে দেখলেন। আমি বললাম—বিকল্প প্রমাণ।

–না স্যার! ওটা হবে বৈকল্পিক প্রমাণ। মানসের গলা।

স্যার বললেন-বাঃ।

–কেন স্যার? বিকল্প প্রমাণ কথাটা কি ভুল?

–না, না। ভুল কেন হবে? তবে ‘বৈকল্পিক প্রমাণ’ আরও নান্দনিক।

ওরা মুচকে হাসল।

আমরা দাঁতে দাঁত পিষলাম।

এবার আজকের দিনটা।

হোস্টেলের রাঁধুনি পঞ্চা ভাত পুড়িয়ে ফেলায় আমাদের ক্লাসে আসতে দেরি হল। ঢুকে দেখি তুলকালাম।

ব্যাপারটা একেবারে পাঞ্জুরিতে তিড়িতংক!

সেকশন বি’র ডে স্কলার অনিল আমাদের ক্লাস টিচার বাংলার স্যার সন্তোষবাবুর কাছে নালিশ করেছে যে এ’ সেকশনের মানস ওর রিস্টওয়াচ চুরি করেছে।

কী যা তা! মানস তো ক্লাস টেন এর ফার্স্ট বয়।

তাতে কী! পড়াশুনোয় ফার্স্ট বয় কি চুরিবিদ্যায় ফার্স্ট হতে পারে না?

মানস কেন চুরি করবে?

চোর কেন চুরি করে? টাকার জন্যে। ওর এখন টাকার দরকার।

আজ ওর বাবা নেই বলে এমন নোংরা কথা বলতে পারলি?

ধেত্তেরি! যা সত্যি তাই তো বললাম।

সন্তোষস্যার সবাইকে চুপ করতে বললেন।

হ্যাঁরে অনিল, ঠিক করে বলতো –কী হয়েছিল?

-কালকে ছুটির পরে আমি স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। বইয়ের ব্যাগ, ফুলপ্যান্ট আর ঘড়ি একসাথে করে গোলপোস্টের পাশে রেখেছিলাম। খেলার শেষে প্যান্ট পরে ব্যাগ তুলতে গিয়ে দেখি প্যান্টের পকেটে রাখা রিস্টওয়াচটা নেই।  ওটা আমার জন্মদিনে মাসিমণির গিফট—ফেবার লুইবা।

— গোলপোস্টের কাছে মানস ছিল?

–হ্যাঁ স্যার।

সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের সেকেন্ডবয় থার্ডবয় চেঁচিয়ে উঠল।

–স্যার, আরও অনেক ছেলে ছিল। আমরাও ওর সঙ্গে ছিলাম।

সন্তোষবাবুস্যার সাদামাটা ভাল মানুষ।  মানসকে ডেকে বললেন—যদি নিয়ে থাক তো দিয়ে দাও।

মানসের চোখমুখ বসে গেছে। কোনরকমে বলল—স্যার! আমি নিইনি। বিশ্বাস করুন, মা সরস্বতীর  দিব্যি!

এবার গোটা দলটা সন্তোষস্যারকে নিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার রাজেন্দ্রস্যারের চেম্বারে গেল। পেছন পেছন আমরা , হোস্টেলের ছেলেরা।

রাজেন্দ্রস্যার জানতে চাইলেন যে অনিল মানসকেই চোর ঠাঊরেছে কেন?

অনিল বলল যে ও এক তান্ত্রিকের আশ্রমে গেছল। সেখানে তান্ত্রিকবাবা যজ্ঞ করে যজ্ঞবেদীর ছাই দিয়ে নখদর্পণ করেন। তাতে অনিলের নখে ঘড়ি হাতে মানসের ছবি ফুটে উঠেছে।

চারদিকে গুন গুন শুরু হয়ে গেল।

দেখলি তো? নখদর্পণে চোর ধরা পড়েছে।

যত্ত গাঁজাখুরি কথা।  অনিল কী দেখতে কী দেখেছে কে জানে?

ওইটুকু নখের মধ্যে ছবি দেখে কাউকে চেনা যায় নাকি!

একটা কথা ভাব। ও মানসের ছবিই কেন দেখল? সুমনসের কেন দেখল না?

রাজেন্দ্রস্যার গম্ভীর।

—আচ্ছা, তোমার তান্ত্রিক অন্য কারো আঙুলে নখদর্পণ করে চোর দেখাতে পারেন?

–হ্যাঁ স্যার।  তার নাম প, ম, র অথবা স দিয়ে শুরু হতে হবে। আর তার জন্মের রাশি তুলা, মেষ বা কন্যা হতে হবে।

রাজেন্দ্রস্যার সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।

–তোমাদের মধ্যে কেউ আছ? ভলান্টিয়ার হতে রাজি হবে?

আবার আমি পা বাড়িয়ে লেঙ্গি মারলাম।

–আমি স্যার, আমি।

সবার চোখ আমার দিকে।

-আমার নামের প্রথম অক্ষর স।  আর রাশি কন্যা। আমি রাজি।

–বেশ, আমি গেটপাস বানিয়ে দিচ্ছি। বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে ফিরে এসে স্টাফ রুমে রিপোর্ট করবে।

আমি আর অনিল গেটের দিকে এগোই।

মানসের মুখে একটু ভয়ের ছায়া খেলে গেল কি?

উদাসীবাবার আখড়ায়

আশ্বিন মাস। দুপুরের রোদে বেশ ঝাঁঝ ।  আমি ও অনিল হাঁটছি।  গন্তব্য নিউ তরুণ সিনেমার কাছে তান্ত্রিকের ডেরা। এর মধ্যে অনিল একটা গলির ভেতরের দোকান থেকে একটু অগুরু, ধূপকাঠি, দেশলাই আর ছোট্ট ঘিয়ের শিশি কিনেছে।  আর আছে একটা ছোট শিশি তাতে সাদা জলীয় কিছু টলটল করছে। জানলাম ওটা কারণ বারি। কালীমাতার পূজো ও যজ্ঞে লাগে। খরচ হল ছ’টাকা তিন আনা।

–আর জবাফুল নিলি না?

— আশ্রমেই গাছ আছে, পঞ্চমুখী রক্তজবা ও লংকাজবা।

অনেকটা পথ। অনিল বকবক করছে।

— মানস চুরি করবে ভাবতে পারি নি।  ভাগ্যিস তান্ত্রিকবাবা ছিলেন। নইলে চোর ধরা পড়ত না।  ঠিক কী না বল!

আমি মাথা নাড়ি। কিছুই শুনছিলাম না। তান্ত্রিকের আড্ডায় যাচ্ছি। কী জানি কি হয়! পেটের মধ্যে গুরগুর করছে।

নিউ তরুণ সিনেমাহল তো এসে গেল।  এবার?

অনিলের চেহারায় কেমন একটা ভাব। আমার হাত ধরে একটা গলির মধ্যে বন্ধ বাড়ির পেছনে নিয়ে গেল।

এই কি আশ্রম?

ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে মাথা নীচু করে ঢুকে একটা তিনদিক ঘেরা আঙিনামত। একদিকে অন্য একটি বাড়ির বন্ধ দেয়াল। তার গায়ে খাঁজকাটা কুলুঙ্গিতে একটি ছোট্টমত কালীমূর্তি। অন্য দিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটি মাটির বাড়ি,টালির চাল। গা বেয়ে পুঁই আর কুমড়োলতা জড়াজড়ি করে মাথা তুলেছে।  আর একটি বাঁকাচোরা কুঁজো মত টগর ফুলের গাছ। হ্যাঁ, অনিলের কথামত তিনটে জবাফুলের গাছও দেখতে পেলাম। ছ্যাতলা পড়া স্যাঁতসেঁতে দেয়াল।

কিন্তু ওই কুঁজো টগরফুলের গাছ থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না কেন?  কেমন একটা অজানা আতংক আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে। গাছটাকে কেন জীবন্ত মনে হচ্ছে? কেন যে পাকামি করতে গেলাম! মানসকে অনিল চোর ঠাউরেছে তো আমার কী? ওর ডে স্কলার বন্ধুর দল তো রয়েছে।

ঘড়ঘড়ে আওয়াজে কেউ বলল- এইচিস? তা জিনিসপত্র সব ঠিক ঠিক এনিছিস?

এবার দেখতে পেলাম একজন সাদা দাড়ি সাদা চুল বুড়োকে। ওর পরণে একটা ময়লা লুঙ্গি আর খালি গায়ে পৈতে ও বুকের সাদা চুল মিলে মিশে গেছে। এই তবে বাবাজি?

অনিলকে দেখলাম কোন কথা না বলে ঝোলা থেকে জিনিসপত্তর বের করে বাবাজির পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে উবুড় হয়ে প্রণাম করল।

–বাবা, এই ছেলেটি আমাদের সঙ্গে পড়ে।  স্যার বলেছেন ওর নখেও নখদর্পণ করে চোর দেখাতে।

বাবাজি আমাকে চেরা চোখে জরিপ করে বললেন—নাম?

–সুমনস মুখোপাধ্যায়।

— ব্রাহ্মণ?  তা বেশ। ভাল আধার। কিন্তু রাশি ও গোত্র?

— কন্যা রাশি। ভরদ্বাজ গোত্র।

— বাঃ, নখদর্পণ হবে। আমার ভৈরবী বগলা মা সব ব্যবস্থা করে দেবে। বগলা!ওঠ। ওকে শুদ্ধ কর, আচমন করাও, তারপর যজ্ঞের আয়োজন কর।

টগর গাছকে দেখে কেন জীবন্ত মনে হচ্ছিল এবার বুঝতে পারলাম।

মা বগলা টগর গাছের পাশে এমনভাবে বসেছিলেন যেন উনি গাছেরই আর একটা কান্ড। ওঁর বয়স বাবার থেকে অন্ততঃ কুড়ি বছর কম। কিন্তু মাথার না আঁচড়ানো তেলহীন লম্বা চুল জটপাকিয়ে বিশাল জটার আকার নিয়েছে। ঠিক যেন আর একটা টগর গাছ।

উনি আমার মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর কালীমূর্তির সামনে একটি কুশাসনে বসিয়ে সামনে খানিকটা জায়গা গোবর দিয়ে লেপে তার উপর তামার কোশাকুশি ও একটি চৌকোণা তামার পাত্র বসিয়ে কিছু শুকনো কাঠকুটো সাজিয়ে তাতে অনিলের আনা ঘি খানিকটে ঢেলে দিলেন।  তারপর বললেন—বাবা,এবার আসুন।

আমার থেকে একটু দূরে অনিল বসে উত্তেজনায় কাঁপছে।  বাবাজি একের পর এক মন্ত্র পড়ছেন ও মাঝে মাঝে হুংকার দিয়ে উঠছেন।  বগলা আমার পিঠের কাছে বসে একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন।

যজ্ঞের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। মাঝে মাঝে ধোঁয়ায় চারদিক ভরে যাচ্ছে, আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কিছু বুঝতে পারছি না।  এই যজ্ঞ আর কতক্ষণ চলবে? আমার ঘুম পাচ্ছে।  খালি কানে আসছে ওঁ হ্রীং ক্লীং! বষটকারিণ্যৈ নমঃ।  দক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।

মা বগলার ছোঁয়ায় জেগে উঠেছি। যজ্ঞ মনে হয় শেষ। এবার তার ভস্ম আর ঘি মিশিয়ে খানিকটা কালো থকথকে জিনিস বানিয়ে আমার আর অনিলের কপালে টিপ পরিয়ে মা বগলা আমার ডানদিকে বসলেন। আমার পেছনে ইঁটের দেয়াল।  সামনে বাবাজি।

–ওকে বজ্রাসনে বসাও বগলা!

বাবাজি একের পর এক নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন।

আমি নির্দেশমত হাঁটু মুড়ে গোড়ালির উপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। বগলা আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলের নখে ওই থকথকে কালোমত জিনিসটা লেপে দিয়ে আমার ডান হাত ওঁর দক্ষিণ করে ধারণ করে বাম হাতে পেছন দিক দিয়ে বেষ্টন করে বসেছেন। বাবাজি নখদর্পণের মন্ত্র পড়ছেন। বুঝতে পারছি ভাষাটা ঠিক সংস্কৃত নয়।

হঠাৎ হুংকার দিয়ে বললেন—মুহুর্ত আগত। ওর দক্ষিণ করের বৃদ্ধাংগুষ্ঠ ধারণ করে দর্পণে চোরের মুখ দেখাও।

কানের কাছে মুখ নিয়ে বগলা বললেন—কী দেখছ?

–কিছু না।

–দেখ, ভাল করে দেখ। আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমিও পাবে। এবার দেখ।

— হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।

–কী দেখছ?

— আমাদের মিশন স্কুলের লোহার গেট।

–ঠিক। এবার?

–স্কুলের তিনতলা বিল্ডিং।

— বাঃ, এখন স্কুলের ছাদ, জলের ট্যাংক। আর কিছু না।

— মানসকে দেখ নি?

–নাঃ।

বাবাজি আবার হুংকার দিলেন।

–আয়! মানস আয়! যেখানেই লুকিয়ে আছিস, বেরিয়ে আয়। তোর পালাবার পথ সব বন্ধ করে দিয়েছি।  আয়! আয়! কার আজ্ঞে? হাড়িপ বাবার আজ্ঞে!

বগলার গলায় উত্তেজনার ছোঁয়া।

–এইবার দেখতে পাবে। এইবার!

আমার মনেও ছোঁয়াচ লাগে।

–হ্যাঁ , হ্যাঁ। এই তো দেখতে পারছি। মানস! মানস!

অনিল আমার দিকে হাঁটু গেড়ে এগিয়ে আসে। ঠিক দেখেছিস? মানসই তো?

–হ্যাঁ, ঘড়িতে টাইম দেখে রাখ।

–তিনটে চল্লিশ। সাবাশ! এবার ও ঘড়ি না দিয়ে যাবে কোথায়!

বগলা মা আমাকে ছাড়েন নি।

— কী দেখছ? মানস এখন কী করছে?

— ও ছাদের ট্যাংকের নীচের থেকে কাপড়ে মোড়া একটা ছোট পুঁটুলি বের করে খুলছে।

–এবার?

— ওর হাতে একটা ছোট জিনিস চকচক করছে।  জিনিসটা—জিনিসটা একটা ফেবার লুইবা রিস্টওয়াচ।

–এবার?

–কিছু না; সব ধোঁয়া ধোঁয়া। কিছু না।

আমি ক্লান্ত। আধো অন্ধকার এই আঙিনায় শ্যাওলাধরা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের গন্ধ, অগুরু ধূপের ধোঁয়া, ঘি ও কারণবারির গন্ধ, মা বগলার বিশাল জটার উৎকট গন্ধ সব মিলে আমার গা গোলাচ্ছে। মিনমিন করে বলি—আমায় এবার ছেড়ে দিন, আমাদের যেতে দিন।

ফেরার পথে অনিলের মুখে খই ফুটতে থাকে। আমি নির্বাক। মিশনের কাছে এসে ও বলে—হ্যাঁরে, তুই যা যা দেখেছিস সব ঠিক ঠিক স্যারেদের সামনে বলবি তো?

অলটারনেটিভ প্রুফ

স্টাফরুমে ভীড় ভেঙে পড়েছে।  এমন আজব ঘটনা! আমাদের দুটো সেকশনের ছেলের দল, ল্যাব সহকারীরা মায় স্কুলের চাপরাশি বৈকুন্ঠ ও ঘনশ্যাম।

রাজেন্দ্রস্যার প্রশ্ন করেন—সুমনস, নখদর্পণ হল? কী দেখলে?

–আগে অনিল বলুক।

অনিলের বর্ণনা শেষ হলে সন্নাটা সন্নাটা।

তবে মানস চোর? সবার চোখ এখন ওর দিকে।

–হ্যাঁ স্যার! সুমনস দেখেছে ও ছাতের উপর জলের ট্যাংকের নীচে আমার ফেবার লুইবা রিস্ট ওয়াচ লুকিয়ে রেখেছে।  হ্যাঁ স্যার, আমি তখন ঘড়ি দেখেছিলাম—তিনটে বেজে চল্লিশ!

রাজেন্দ্রস্যারের নির্দেশে ঘনশ্যাম চাপরাশি ছাদে জলের ট্যাংকএর নীচের থেকে ঘড়ি উদ্ধার করতে গেল।

কিন্তু স্টাফরুমে স্যারেদের আর ক্লাস টেনের ছেলেদের মধ্যে ফিসফাস কথা শুরু হয়ে গেছে।  উঠে দাঁড়িয়েছেন কেমিস্ট্রির বাণীব্রত স্যার।

–আমাদের কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

রাজেন্দ্রস্যার অবাক হয়ে কেমিস্ট্রির স্যারের দিকে তাকালেন।

–বলতে চাই যে সুমনস মানস নয়,অন্য কাউকে দেখেছে।

— মানে?

— স্যার, আজ ওদের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস ছিল।  তিনটের থেকে সওয়া চারটে পর্য্যন্ত। মানস আর অরবিন্দ একটা সল্ট টেস্ট করছিল, আমার সামনে। তাই তিনটে চল্লিশে ওর তিনতলার ছাতের ট্যাংকের নীচে কিছু লুকনোর প্রশ্নই ওঠে না।

–হ্যাঁ স্যার, ও আর আমি তখন থেকে একসঙ্গে আছি। অরবিন্দ মুখ খোলে।

অনিল চেঁচিয়ে ওঠে। নিশ্চয় ও বাথরুম যাবার নাম করে ক্লাসের বাইরে গিয়েছিল, স্যারের মনে নেই।

বাণীব্রত স্যার ধমকে ওঠেন—থাম হে ছোকরা!

ইতিমধ্যে চাপরাশি রাধেশ্যাম ফিরে এসেছে। জলের ট্যাংকের নীচে কিছু নেই। মানস সরালো কখন?

রাজেন্দ্রস্যার বলেন—এবার আমরা সুমনসের কথা শুনব।

আমি একবার গোটা ঘরের সবার দিকে চোখ বুলি নিই। সবাই কেমন অপেক্ষায় রয়েছে।

–স্যার, এই তান্ত্রিকের নখদর্পণ ব্যাপারটা পুরো বুজরুকি! আমি কিচ্ছু দেখি নি। দেখা সম্ভব নয়।  এসব ওই বাবাজি ও বগলা মার চালাকি। একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ বানিয়ে জোর করে সাজেস্ট করে কিছু দেখেছি এ’রকম বলতে বাধ্য করা।

ওইটুকু নখের মধ্যে কালি লেপে স্কুলের ছাদ, জলের ট্যাংক, মানসের মুখ আর ঘড়িটা যে ফেবার লুইবা—এসব দেখা ও চিনে ফেলা সম্ভব?

অনিল চেঁচিয়ে ওঠে—কী বলছিস কী তুই!

ওকে রাজেন্দ্রাস্যার এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললেন—আর কিছু বলবে সুমনস?

–রাশি স্যার। আমার রাশি তো কন্যারাশি নয়। তাহলে আমি দেখলাম কী করে?

— তুমি—তুমি আমাকে মানে আমাদের সবাইকে মিথ্যে কথা বলেছিলে?

–না স্যার! অলটারনেটিভ প্রুফ। আপনিই শিখিয়েছিলেন। আমার রাশি তান্ত্রিকের লিস্টির কোন রাশি নয়।  নখদর্পণ সত্যি হলে আমার নখে কিছু দেখতে পাওয়া যাবে না। তাহলে বগলা মা কী করে সব দেখালেন? অর্থাৎ প্রথম প্রেমিসটাই ভুল। ব্যাপারটাই জালি।

রাজেন্দ্রস্যার হো হো করে হেসে উঠলেন।

দু’মাস্ কেটে গেছে। পূজোর পর স্কুল খুলতেই মানস ফিরে এসেছে আমাদের মধ্যে, নিয়মিত বসছে ব্যাকবেঞ্চে।  ঘড়িচোর ধরা পড়েছিল ফেবার লুইবা ঘড়ি বেচতে গিয়ে।

সেদিন মানস জিজ্ঞেস করল—আচ্ছা, কন্যারাশির বিকল্প প্রমাণ তো বুঝলাম, কিন্তু তোর আসল রাশিটা কী?

-আমি জানি না রে! জানতে চাই না।

রঞ্জন রায় কথাসহিত্যিক, মানবাধিকার কর্মী। প্রকাশিত বই : 'বাঙাল জীবনের চালচিত্র', 'রমনীয় দ্রোহকাল', 'দেকার্ত- জীবন ও দর্শন ' প্রকাশিতব‍্য বই: 'ছত্রিশগড় - গ্রামজীবন, সমাজ ও সংস্কৃতির আখ্যান '

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..