নতুন কবিতার পথে (পর্ব- ২)

স্বপন রায়
মুক্তগদ্য
Bengali
নতুন কবিতার পথে (পর্ব- ২)

১.

(বর্ণিত যা কিছু হয়ত কাল্পনিক নয় আবার অতটা সত্যিও। চরিত্র সৃষ্টির জন্য একটা শব্দও লিখিনি। কবিতার জন্য কিন্তু নতুনকে অভ্যস্থ, ব্যবহৃত ঘরের ছায়ায় পাওয়া যাবেনা। রবীন্দ্রনাথের যেমন মনে হয়েছিল মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার মুসাফিরি, বিকল্প জীবন তেমনি এক মুসাফিরি। পাঠক, ‘ইজি’। ‘নতুন কবিতা’য় কোনও ‘রেজিমেন্টেশন’ নেই, ‘অর্ডার’ নেই। হাল্কা পল্কা হাঁটতে থাকুন, পায়ে নতুন বাজবেই, বেই..)

শিলিগুড়ি। জোড়থাং। ইয়ুকসাম।

হোটেলের বাইরে রোদ পোহাচ্ছিলাম। ইয়ুকসাম একসময় সিকিমের রাজধানী ছিল। এখন পাহাড়ের গায়ে আটকানো একটা গঞ্জ। এখান থেকেই গোয়েচালা ট্রেকিং শুরু হয়। আমার গন্তব্য যদিও কাংলা পাস। এটা নেপাল আর সিকিমের সংযোগকারী গিরিখাত। এইসব সাতপাঁচ ভাবছি যখন লম্বা, একহারা একটি ছেলে এসে হঠাতই বলল, দাদা, আর ইউ ফ্রম কোলকাতা?

মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ বাচক।

-আয়াম শশী। শশী নায়ার ফ্রম মুম্বই।

-হেলো

ছেলেটি এবার ভাঙা বাংলায় বলল, আমি জানতাম আপনি এখানে আসছেন তাই অপেক্ষা করছি।

একটু অবাক হলাম। শশী নায়ার বলে কাউকে চিনিনা। মুখ দেখেও তেমন কিছু মনে পড়ছে না। কে হতে পারে? এই ট্রেক ‘স্পনসর’ করছে ‘ইয়ুথ হস্টেলে’র কলকাতা শাখা। তাদের কেউ? কিন্তু আসছে তো মুম্বই থেকে, তাহলে?

শশী বলল, আপনার নামটাও আমি জানি, শৌভিক, ইজন্ট ইট? (বলল, শাউভিক)।

আমি হাসলাম। শশীর মাথার পিছনে একটুকরো ‘কাব্রু’ শৃঙ্গ উঁকি মারছে। দীর্ঘদেহী শশীর ছায়া আমার পায়ের কাছে। বললাম, ট্রেকিং গ্রুপের আর সবাই কোথায়?

-রিপোর্ট করেনি

আমি একটু অসহায় বোধ করলাম। এতদূর থেকে আসা, কতদিনের প্ল্যান, বললাম, কেন আসেনি, এনি ইনফো?

-শুনেছি একটা ট্রেন ‘ডিরেলড’ হওয়ায় ওরা ভাইজাগেই আটকে গেছে। আমি, আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। তবে, ইফ ইউ ওয়ান্ট, আমরা দুজনে কিন্তু ট্রেক করতে পারি। একজন ‘গাইড’

আর একজন লাগেজ ক্যারিয়ার’ লাগবে, দ্যাট ক্যান বি ম্যানেজড।

আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। অগত্যা। বললাম, চলো আগে কফি খাওয়া যাক।

শশীর সঙ্গে একটা হাল্কা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এক দিনেই। হয়ত পাহাড়ের গুণ। বা মানসিকতার। শশীও ঘুরিয়ে ছেলে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটিও হল। এই ইয়ুকসামেই অভিনেতা ড্যানির বাড়ি। গেলাম দুজনে। কাঠোক মনাস্ট্রি আর ডুবডি মনাস্ট্রিও ঘোরা হল। ওঠানামা করে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। জাওয়া ছেংরি আর কর্মা ভুটিয় আমাদের সঙ্গী হবে।জাওয়া গাইড আর কর্মা মালবাহক। কাল দুজনে বেরোবো। যাবো কাংলা পাস। ফিরে যেতে হচ্ছেনা এতেই খুশি আমি। জীবন পুরনোই হতে থাকে। আর ট্রেকিং হল রিনিউয়াল, জীবনের।

২.

জোংরি। উচ্চতা তেরো হাজার ফুট। আজকের লক্ষ্য। বেশ ঠান্ডা। গাইড জাওয়া একটা স্টোভ এনেছে। চা, কফি আর ম্যাগি, চাল, ডাল, নুন, চিনি, আলু, পেঁয়াজের স্টকও ঠিকঠাক। কফির কাপ হাতে নিয়ে শশী আমার পাশেই বসে পড়ল। একটা পাথরের চাতাল। নিচে প্রায় হাজার ফুটের খাদ। পাইন, আর বার্চের জঙ্গল উঠে আসতে আসতে ক্রমশ ফাঁকা হওয়ার মুখে।
শশী বলল, দাদা ইউ রাইট পোয়েমস, নো? অবাক হলাম। আমার কবিতা লেখার কথা মুম্বইয়ের শশী নায়ার জানল কিভাবে? বললাম, তুমিও লেখো? শশী মাথা নাড়ে, বলে, ইটস নট মাই কাপ অফ টি, তবে ভাল লাগে। কিন্তু শশী, আমি যা লিখি – ওই যাকে তুমি কবিতা বলছ – এতো আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ জানেনা, আই অ্যাম নট আ সেলেব্রিটি, তো মুম্বইতে বসে তুমি আমার এসব গোপন কাজ কারবারের খবর পেলে কিভাবে? আবার সিকিমের ট্রেকিং-এ এসে তুমি আমার বায়োডাটা বলে দিচ্ছ, কী বলবো, ইজ নট দ্যাট সারপ্রাইজিং? শশীর একটু হাসি রোগ আছে। হাসতে হাসতে বলল, ‘ইয়ুথ হস্টেল’ সবার পরিচিতি পাঠিয়ে দিয়েছিল, আপনি বোধহয় পাননি। এছাড়াও আরেকটা সোর্স রয়েছে, আই উইল টেল ইউ এভরিথিং, বাট বিফোর দ্যাট এই হিমালয়ান নেসেন্সির জন্য কয়েকটা লাইন, প্লিজ… আমি চুপ করে থাকলাম। শশী নাছোড়। এভাবে ‘ইন্সট্যান্ট’ কবিতা আমি বলতে পারিনা। তবুও ওর জোরাজুরিতে বলতে হলঃ

‘ রাস্তা দিয়ে পথ তৈরি করতে করতে সরু কথাবার্তা
ব্রীজের বায়না নিতে চাইছে
ভেজা, চারদিশারী গাছ
টুপটাপ লিখিত বাটোয়ারা, ভাসা ভাসা
আঁচলের ছায়ায় বৃষ্টির হাজার ইনিশিয়াল…’

স্বপন রায়। কবি। জন্ম ১৯৫৬। ভারতের দুটো ইস্পাতনগরী জামশেদপুর এবং রাউরকেলা স্বপন রায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রথমটি জন্মসূত্রে। দ্বিতীয়টি বড় হয়ে ওঠার সূত্রে। নব্বই দশকের শুরুতে 'নতুন কবিতা'র ভাবনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরনো, প্রতিষ্ঠিত ধারাকবিতা ত্যাগ করে কবিতাকে নানাভাবে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ