পাগল
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
তখন বারীনদা (কবি বারীন ঘোষাল) আর জামশেদপুর (টাটানগর) সমার্থক। তবে এই শহরের সঙ্গে আমার নাড়ির টান। আমি জন্মেছিলাম এখানে, এখানেই আমার মায়ের বাড়ি। সোনারি, ওয়েস্ট লে আউটে বারীনদার বাড়িতে যাওয়ার সময় অবধারিত পেরিয়ে যেতে হত আমার প্রথম কৈশোরের অনিবার্য ‘স্টপ’ গুলো। বিশেষত বিষ্টুপুর মার্কেট, মামাবাড়ির ব্যবসার সৌজন্যে সেই হাফপ্যান্ট বয়স থেকেই এখানে আসা যাওয়া আমার। ১৯৬৯। আমি তেরো। ১৯৭০, চোদ্দ। সাইকেলে চক্কর কাটছি। হৃদয় বামাচারী বলেই হয়ত তখনকার বাঙালি কিশোর, তরুনরা বামীয় হয়ে উঠছিল। এর সঙ্গে ছিল এক রহস্যময় নান্দনিক জগতের অমোঘ টান। কী সব দহনাবৃত দিন। রাত। ‘গণশক্তি’, ‘দেশব্রতী’, ‘কালান্তর’ এই দলীয় পত্রিকাগুলোর বাইরে ছিল ‘দর্পণ’ নামের এক পত্রিকা। সেখানে রাজনীতি কট কট করতো।
ওই সময়টা এরকমই ছিল। খবরের কাগজ, সাহিত্য পত্রিকা, গল্প, উপন্যাস আর কবিতায় সংপৃক্ত। আর এই বিষ্টুপুর মার্কেটেই ছিল দুটো বইয়ের দোকান। ‘সান্যাল ব্রস’ আর ‘সেন অ্যান্ড কো’।বিপ্লব, কবিতা আর উপদ্রপী শরীরের ইন্টুবিন্টু সামাল দিতে দিতে আমি ‘রানীকুদার’ থেকে বিষ্টুপুর মার্কেটে যেতাম। সাইকেলে। মামার দোকানে মুখ দেখিয়ে বিপ্লবের গন্ধ শুঁকতাম খবরের কাগজে। মাও, তখনো মাও-সে-তুং আর বেজিং ছিল পিকিং। তারপরে এসে দাঁড়াতাম ‘সান্যাল ব্রস’-এর সামনে। বই দেখতাম, বই! তখন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের হাতে এখনকার মত রেস্ত থাকতো না। আমি দূর থেকেই দেখতাম আর মনে মনে স্পর্শ করতাম ‘বনলতা সেন’কে। সে এক আশ্চর্য শারীরিকতা। দারুচিনি ঘোলা, দ্বীপাবৃত, অল্পায়ু ঘামে ভেজা আমি তীব্র শূন্যতার আক্ষেপে শিউরে উঠতাম সেই মার্কেট প্লেসে, শ্রীলংকার সামুদ্রিকতা থেকে যোজন যোজন দূরত্বে একটি কেঁপে ওঠা বনলতাময় হয়ে যেত, আমি তার শিখর-শীৎকার শুনতে শুনতে নাবিকারোপণে নিয়ে যেতাম নিজেকে। হাল ভাঙা নাবিক।
‘সান্যাল ব্রস’ থেকে একটু এগোলেই ‘সোডা ফাউন্টেন’, আইসক্রিম বার। বনলতার অভাব ছিলনা জামশেদপুর বা টাটায়, আর আমি এক অতৃপ্ত কিশোর দেখতাম ‘রোদজ্বলা দুপুরে সুর তুলে নূপুরে’ ‘রুবি রায়’রা আমায় পাত্তা না দিয়ে হৈ হৈ করে ‘সোডা ফাউন্টেন’-এ ঢুকে যাচ্ছে। বনলতা সেন, রুবি রায়, ১৯৬৯, সিপিএম, নকশালবাড়ি আর মেয়েলিনজরে পাত্তা না পাওয়া অপরিপক্ক এক উপেক্ষিত কিশোর এসবই মিশ্রিত হত বাজারে, বিষ্টুপুরে। তবে আরেকটু পেকে উঠতেই আমি শিখে নিলাম কিভাবে নানাখাতে পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতে হয়। আর একদিন, এক শিশিরের পুর দেওয়া টাটার শীতকালীন ছুটির সন্ধ্যায় আমি পা রাখলাম ‘সান্যাল ব্রস’-এর ভেতরে। হাত দিয়ে ছুঁলাম বনলতা সেনকে। প্রচ্ছদ, সত্যজিৎ রায়, প্রকাশক-সিগনেট প্রেস। মূল্য ধরে দিলাম কাউন্টারে। সেই দোকানের যিনি অধিপতি (কোনও সান্যালই হবেন) তিনি আমার হাতে বইটি দিতে দিতে জিগগেস করলেন,
তুমি কবিতা পড়ো?
মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ বাচক।
সান্যাল বললেন, বাঃ!
১৯৭১, আমার হাতের তালুতে বনলতা। মহীনের ঘোড়া। আমি সদ্য পনেরো। একটু কি জল এল চোখে, কেমন যেন আবছা দেখছি সব!
বারীনদার বাড়ি যাওয়ার সময় বিষ্টুপুর বাজার পেরোতে হয়। ‘সান্যাল ব্রস’ উঠে গেছে। তবু চোখ চলে যায় প্রতিবারই। আবছা মনে পড়ে। আমার চোখে জল, ১৯৭১, কী লজ্জা! আমি না বিপ্লবী? মনে পড়ে। আমি ‘কমরেড লেনিনের আহ্বান’ শুনতে শুনতেই পড়েছিলাম, বনলতা সেন। মনে পড়ে। ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলা নাদেখা ‘চিল’ আমার বৈপ্লবীক চেতনায় দু’ দণ্ড অবসর মিশিয়ে দিয়েছিল বলেই না কবিতা আমার সঙ্গে রয়ে গেল। আজ বারীনদা নেই। জামশেদপুরও ধীরে ধীরে দারুচিনি দ্বীপ হয়ে যাচ্ছে। আমি আজও এক তরুন নাবিকের ভাঙা হাল আর সিংহলের দাহ্য সমুদ্র এক হারিয়ে যাওয়া কিশোরের কাছে খুঁজে চলেছি…
দুই.
হাত নাড়ছে। হাত নাড়ার ভেতরে নেশাবিলীন কিছু থাকে, যা নিরপেক্ষ নয়। অন্তত ধন্যবাদ-নিরপেক্ষ তো নয়ই। ট্রেন ছেড়ে দিল, হাতনাড়া তরঙ্গ হয়ে গেল। ভালবাসলে সেই তরঙ্গে কাল, আজ হতে থাকে। আজ, কাল… হতে হতে, সময় পেরিয়ে যায় বুধবার অব্দি। সীমানা শুরু, এবার আদিগন্ত শান্তিনিকেতন!
আমরা কালোর দোকান হয়ে ফিরছিলাম। দেখি ও ঈশারা করছে, লেডিজ সাইকেলে সূর্যাস্ত রাখা। কেরিয়ারে আর কি, অস্তারুণের স্তিমিত সেই কেরিয়ারে আমি যেতেই ও উঠে বসল। আমি উড়লাম। অশোককে এতটা ব’লে, পরের দৃশ্যে যাওয়ার আগে দেখালাম, টুরিস্টরা দাঁড়িয়ে আছে।
-কিরে, দেবেনদার সমাধি দেখাবি না?
অশোক হাসল। ও আর প্রণয় উঠে দাঁড়ালো। প্রণয় বলল, চল্ অশোক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধি ব’লে কথা, আমরা ছাড়া কে দেখাবে?
সেই বিকেলপার সময়ে অশোক আর প্রণয় টুরিস্টদের সঙ্গে কথা বলছে। আমরা যারা যাইনি তারা কিন্তু জানি কি ব’লছে ওরা। এরপর টুরিস্টদের হাতে মোমবাতি উঠবে। আর সেই মোম জ্বালিয়ে তারা ‘ অসতো মা সদ্গময়/তমসো মা জ্যোতির্গময়’ উচ্চারণ ক’রতে ক’রতে ‘তিন পাথরি’ বটগাছের নিচে জমাট ঢিবিটাকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সমাধি ভেবে প্রদক্ষিণ ক’রবে। করার সময় কেউ ব’লবে, অসৎ-মা সদাগম, কেউ আবার জ্যোতিগুময়, আবার কেউ কেউ ব’লে উঠবে, ভাই মোম নিভে যাচ্ছে যে…আর অশোক অথবা প্রণয় ব’লে উঠবে উনি আপনাদের প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন, খুব ভাল লক্ষণ এটা… এরপর ওরা ফিরে আসবে…আজো এল, কুড়ি জনের গ্রুপ। পাঁচ টাকা পার হেড। একশো টাকা। ১৯৮৫’তে অনেক। বোটু অর্থাৎ বোকা টুরিস্টদের কাছ থেকে নেয়া দক্ষিণায় আজ মোচ্ছব হবে। ঠাকুর, ক্ষমো হে ক্ষমো…
সাইকেল কুড়িয়ে নেয় কখনো পূরবী, তো কখনো পটদীপ। রাগের এই অকারণের বিলোনো সারিয়ে তোলে ক্লান্ত ডানাগুলো, আমি আর ও শ্যামবাটির কাছে আকাশে চোখ তুলে দেখি, পাখিরা খেল দেখাচ্ছে! আকাশে আঁকছে। ঘরে ফেরার ক্লান্তি আর নেই। আমি প্যাডেলে চাপ দিয়ে কিছু একটা গেয়ে ওঠার আগেই ও গেয়ে ওঠে, আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দরবিকাশে আহা…. আমি দ্বিজব্রত, আমার সঙ্গে ও, আমরা ‘কোপাই’ যাচ্ছি। একটু পরে সন্ধ্যা নামবে। কোপাই-এর যে জায়গাটা আমাদের তার একটু দূরেই হাওয়ায় সাদা দাগ এঁকে দেবে পৌষের আব্রুপসন্দ্ হিমেরা।
জলের এক বিন্দু আরেক বিন্দুর টলে রাখবে হৃৎকোরানো শম্পাতিক্ষুদ্র সব্জে কাচ, আর বেলোয়ারি হতে না হতেই আমি দেখবো ‘হেসটিয়া’য় চলে যাচ্ছে ও। হেসটিয়া, আগুনের দেবী। কুমারী। গ্রীক। কি গরম ওর শরীর। পৌষ ওকে আগ্নেয় ক’রে তুলছে। ও কুমারী, ওর আগুনে জ্যোৎস্না ঢালার সময় চাঁদের যা হয় আমারো তাই হল। অকাতর যৌনতা, সকাতর দূরত্বে। আমি পটের গড়ে ওঠা দেখি। না, পট নয়। ছেনির ঠুক্ ঠুক্। আমায় দেখে হাসে। ব’লে, ভাই আমি রামকিঙ্কর, আমি ছাড়া ওকে কেউ রাখতে পারবেনা, রাখি ওকে?
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..