নতুন বউ

কুম্ভকর্ণ
ছোটগল্প
Bengali
নতুন বউ

 

ঘটনাটি আমার কর্মজীবনের, নব্বই দশকের প্রথম দিককার।আমি সাইট সুপারভাইসারের পদে বোকারোর এক কারখানায় চাকুরিরত।আমার এই কোম্পানীটা খুবই সাম্প্রতিক।যাই হোক এবার মুল ঘটনায় আসা যাক-এটি একটি প্রেমের গল্প,নতুন বউ এর গল্প।

(১)

আমাদের কালো রঙের গাড়িটা একটানা ছুটে চলেছে।বোকারো থেকে বেরিয়েছি,গন্তব্য মজিলপুর।
গাড়িতে আমার সঙ্গে আছে কোম্পানির অ্যডমিন মন্ডলদা আর ড্রাইভার রামরতন আর পিছনে ঘুমিয়ে আছে শিমুল,আমার বয়সই।রগচটা শিমুলের ঘুম আর ভাঙবে না,প্ল্যান্টের ভিতর এক অক্সিডেন্টে সে মারা গেছে। যেহেতু কর্মসুত্রে আমি তার সুপারভাইসার, তাই কোম্পানির নিয়ম মোতাবেক আমাকেই নিয়ে যেতে হবে মৃত শিমুল কে তার গ্রামে।সেখানে দশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণের চেকটা পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে।তারপর তাদের কাছ থেকে “সব কিছু বুঝিয়া পাইলাম ইস্তেহারে” সই নিয়ে জমা করতে কোলকাতার অফিসে।মন্ডলদা এ সব কেসে অনেক অভিজ্ঞতা আছে,তাই কোম্পানীর তরফ থেকে আমার মতন শিক্ষানবিশের সাথে তাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

গাড়ি থামলো রাস্তার ধারে এক চায়ের দোকানে।গ্রামের নান ফুলতলার।দোকানি বললো,এখান থেকে মজিলপুর দেড় ঘন্টার রাস্তা।গাড়ি ছাড়লো,ফাগুন মাসের বিকেল ছোট গল্পের মতন,শেষ হয়েও শেষ হয় না।কালো পিচের রাস্তা,দুধারের বড় বড় গাছগুলো যেন নতজানু হয়ে দাড়িয়ে অভিবাদনের জন্য।দুরের গ্রামগুলো তুলি দিয়ে আঁকা কোনো শিল্পীর কল্পনা।পড়ন্ত বিকেলে পুকুরে চলছে সাদা হাঁস গুলো দিনের লাস্ট ল্যাপ-বাড়ি ফিরতে হবে তাদেরও।শিমূলও ফিরছে,সবাই কে ফিরতে হয়।
বুঝেছেল বডিটা হ্যান্ড ওভার করেই বেরিয়ে পড়বো,শুনুন আপনি বেশী বোঝাতে যাবেন না,গাঁয়ের মেয়েছেলেরা মরা কান্না ধরলে থামতে চায় না।চটকাটা ভাঙলো আমার।
একটু থামলেন মন্ডলদা,তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন ,ভাবছি শ্রীরামপুরের ছোট পিসির বাড়ি দোল অবধি কাটিয়ে যাবো বুঝলেন মিত্তির।
একটু শুকনো হেসে বললাম,দোলের তো এখনো দু-তিন দিন বাকি..আপনার ছোট পিসির সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা এখনো ঠিক হয়নি?
-না হে মিত্তির,আশি বছরের বুড়ি এখনো ঘাটে ওঠার কোনো সিগনাল নেই।তাই মাঝে মাঝে না গেলে উইল থেকে নাম কাটা যেতে পারে।আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড-আপনি আর কি বুঝবেন ভাই।

(২)

বড় রাস্তাটা ছেড়েছি মিনিট দশেক হবে।এখন গ্রামের মাটির রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি।চারিদিক অন্ধকার,মনে হয় লোডশেডিং ; মন্ডলদা দেখলাম সতর্ক ভাবে গাড়ির জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে চলেছে।গাড়ির আলোতে সামনে একটা একটা বড় বাড়ি দেখে বললো
-গাড়ি থামা,আর এগানো ঠিক হবে না।
গাড়িটা থামতেই সে চট করে নেমে পড়লো।আমিও নামলাম পিছু পিছু।গাড়ির আলোতে দেখলাম,আমরা বড় বাড়ি সামনে-মজিলপুর হাই স্কুল স্থাপিত -১৯৭৫।তার পাশে এক বিশাল মাঠ।
-এখানে দাড়ান,আমি একবার ইস্কুলের ভিতর টা ঘুরে আসি,রামরতন তুই গাড়িটা ঘুরিয়ে দাড় করিয়ে রাখ।
মন্ডলবাবু স্কুলের ভিতরে ঢুকে গেল,চারিদিক জুড়ে যেন এক অপার্থিব নীরবতা।চারিদিকে ঝিঝি পোকা একটানা ডেকে চলেছে।
খানিক ক্ষণ বাদে মন্ডলবাবু বেরিয়ে এলেন,সঙ্গে এক প্রবীণ মানুষ।
-মিত্তির বিশ টাকা দিন তো..
আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে লোকটার ফতুয়ার পকেটে সেটা গুজে দিয়ে বললেন-যান শিমুলের ফ্যামিলিকে খবর দিন,দেখবেন বেশী ভিড় যেন না হয়।মিত্তিরের কাছে আপনার একশ টাকা রাখা রইলো,সব ঠিক ঠাক মিটে গেল আপনাকে আপনার গুরুদক্ষিণা দিয়ে তবেই আমারা এখান থেকে যাবো।
লোকটা হাসতে হাসতে বললো-আমায় এই গাঁয়ে সবাই মানে,চিন্তা নেই আমি ঠিক সই করিয়ে নেবো শিমুলের মায়ের থেকে..শুধু যদি আর একশ টাকা বাড়িয়ে দেন।তাহলে এই গরীবের একটু উপকার হয়।মন্ডলবাবু একটু গম্ভীর ভাবে বললো-সে পরে দেখা যাবে,আগে সব কিছু ভালো ভাবে মিটুক।
লোকটা চলে গেল মাটির রাস্তাটা ধরে।মন্ডলবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললো-আবাক হচ্ছো মিত্তির?পৃথিবীতে সব বিক্রি হয় ভাই-শুধু পকেটে টাকা থাকতে হবে।দাও একখান সিগারেট দাও..!!

(৩)

কারেন্ট এলো কিছু ক্ষণ পর তারও কিছু পরে ফিরে এলেন সেই লোকটা,সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা আরও জনা পাঁচ ছয় ছেলে পুলে।পোস্টের চল্লিশ ওয়াটে ঘোলাটে বালবে সবাইকে স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না।
-মন্ডলদা ইনি শিমুলের মা আর উনি আমাদের পঞ্চায়েত সদস্য,আর বাকিরা শিমুলের বন্ধু বান্ধব।লোকটি বললো।
ভদ্রমহিলা করুন ভাবে শিমুলের শান্ত শরীর দিকে তাকিয়ে,তার দু চোখ বেয়ে নেমে আসছে শিমুল নিয়ে দেখা তার স্বপ্ন গুলো।রাস্তার ঘোলাটে আলো মায়ের পুত্র শোক লুকাতে অক্ষম।আমার হৃদয়টা দলা পাকিয়ে উঠছে,মনে হয় অল্পবয়সেই যারা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত তারা সমবয়সী অন্যের মাযের মধ্যে নিজের মা কে হাতড়ে চলে।এসব অপার্থিব ভাবনা গুলিয়ে গেলো মন্ডলদার কথায়
-খুব ভালো,নে নে রামরতন বডিটা নামা।মিত্তির বাবু নিন চেক টা বার করুন।তারপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো-তপনবাবু কাগজটা সই হয়েছে?
রামরতন আর ওই ছেলে পিলে মিলে শিমুল কে মাঠের উপর নামিয়ে রাখলো।আমি চেক টা বার করে মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললাম -আপনার নাম অপরা মন্ডল?
ভদ্রমহিলা ভাঙ্গা গলায় বললেন-সে তো বৌমার নাম।আমি মন্ডলদার দিকে তাকিয়ে বললাম-তাহলে তো শিমুলের বউ এর হাতেই..আমার কথা শেষ করার আগেই মন্ডলবাবু বললেন-যার নামেই মাসীমার হাতে চেকটা তুলে দে।নিন মাসীমা আপনি চেক টা নিন..
কিন্তু যা ভাবা হয় সবসময় সেটা হয় না।ওই ছেলে গুলো মধ্যে একজন হঠাৎ ই বলে উঠলো
-চেকে নতুন বউ এর নাম কেন?কাকীর নামে নেই কেন?
-না মানে শিমুলের নমনি তার স্ত্রী তো তাই আরকি..তা ওতে কোনো অসুবিধা নেই।মন্ডলদা শান্ত ভাবে কথা বললো।
-অসুবিধা নেই মানে? নতুন বউ যদি টাকা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় তখন কাকীর কি হবে?ছেলেটি এক জোর গলায় বললো।
মন্ডলদা তপনবাবু দিকে তাকালেন,তারপরই তপনবাবু শুরু করলেন-আহা অন্তু এখন এসব কতা বলার সময়?নে তারাতারি করে শিমুলকে নিয়ে চ দিকি তার ঘরে..নিন দিদি আপনে এই কাগজটা টিপ ছাপ দিয়ে দিন।
-তুমি চুপ করো তপনকা!চেক আমাদের কাকীর নামেই দিতে হবে না হলে নগদ টাকা!
-অন্তু বেশি ঝামেলা করিস নি..নতুন বউ পড়াশুনা জানা মেয়ে।ও সব মানিয়ে নেবে,তুই তো ওর সাথে পড়াশুনাও করতিস।
-ওটাই তো সমস্যা তপনকা,আমাদের দেশে যে যত বেশী শিক্ষিত সে তত বেশী চোর..আমি যা বলচি তাই হবে,না হলে পঞ্চায়েতের পোধান কে ডাকা হোক।
অন্তুর কথাগুলো মৃদু গুঞ্জনের শুরু হলো কিন্তু শেষ হোলো প্রবল প্রতিবাদে।শিমুলের বউ না তার মা এর দড়ি টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত তাদের কথাই মানতে হোলো।প্রথমে কথা হয়েছিলো আমরা তিনজন ফিরে গিয়ে দু এক দিনের মধ্যে চেক নিয়ে ফিরে আসবো।না যতোটা সরল ভেবেছিলাম,ততটা সরল নন মজিলপুর বাসী,অবশ্য অভিজ্ঞতাই মানুষকে জটিল করে।শহরের মানুষের উপর তাদের ভরসা নেই-সব বচসা শেষে তিনটা সিদ্ধান্ত হোলো
এক,মন্ডলদা গাড়ি নিয়ে কোলকাতা অফিসে ফিরে গিয়ে শিমুলের মায়ের নামে চেক রেডি করবে,সেই হিসাবে দরখাস্ত লেখা হোলো।দুই,অপরা মন্ডলের নামের চেক থাকবে অন্তুর কাছে।নতুন চেক হাতে আসবে এবং পুরানো চেকটা সবার সামনে ছিড়ে ফেলা হবে।তিন,সবচেয়ে ভয়ংকর, আমাকে গ্রামে থাকতে হবে বন্ধক হিসাবে,পনেরো দিন পর্যন্ত থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের..তারপর??

আমার পরিস্থিতি বোঝানোর মতন ভাষার দখল আমার নেই পাঠকগণ,মাফ করবেন।

 

(৪)

ইস্কুলের টিচার্স রুমে আপাতত আমার ঠিকানা।
মন্ডলদা খানিক আগেই চলে গেছে,চলে গেছে শিমূলও।আমার শিমূলের শেষ যাত্রায় যাবার ইচ্ছে ছিলো,তপন বাবুই বারণ করলেন।বললেন
-উপন্যাসে গ্রামের মানুষ আর জ্যান্ত গ্রামের মানুষের হিসাব কিন্তু এক নয় সার।এই নতুন গামছাটা রেখে গেলাম,চানটা করে নিন,তারপর খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম করুন।আর শিমূলের বাড়ি থেকে জামা কাপড় দিয়ে গেছে,শিমূলেরই হবে,ইচ্ছে হলেই পড়তেও পারেন,অসুবিধা হলে কাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে।নতুন জায়গা একটু সাবধানে থাকবেন,আমি যাই শ্মশান থেকে আসি।
কোনো কোনো দিন অধিক ক্লান্তি মানুষের ঘুমটাও নিয়ে যায়।শিমূল,অচেনা গ্রাম,উদ্ধত মানুষ,পণবন্দী আমি-সব মিলিয়ে মনটা যেন চৈত্রের দুপুর-ক্লান্তি আছে বিরাম নেই।স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম ইস্কুল বাড়িটা থেকে পরনে শিমূলের জামাকাপড়।
বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে দাড়িয়ে পড়লাম একটা পুকুরের সামনে।পুকুর বলা ঠিক হবে না -দীঘি টাইপ,তার সান বাধানো পাড়ে বসে পড়লাম।চাঁদটা দেখে মনে হয় তার পূর্ণতা পেতে আর কিছুদিন লাগবে।অচেনা পরিবেশ,অচেনা অন্ধকার এবং অচেনা আমি।চটকা টা ভাঙলো কার যেন ডাকে,পিছন থেকে
-সার,আপনারে শিমূলদার বাড়িতে ডাকে।
-কে?কে ওখানে ?
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো বছর এগারোর দীপক,ডাক নাম দীপু।পরে জেনেছি ও ছিলো আমার নজরদার।
-আপনারে শিমূলদার বাড়িতে ডাকে,চলুন।
-কেন?
-অতো জানি না সার।নতুন বউ আপনারে খবর দিতে বললো।
একটু দ্বিধা কাটিয়ে চললাম দীপুর পিছু পিছু,মনে মনে ভাবলাম একবার শিমূলের পরিবারের সাথে করা উচিৎ।
কঞ্চির বেড়া দেওয়া মাঝারি মাপের মাটির বাড়ি,সামনে উঠানে পরিপাটি একটা তুলসি মঞ্চ,কিন্তু প্রদীপ দেওয়া নেই।আমাকে একটা মাদুরের উপর বসতে দেওয়া হোলো।শিমূলের বিধবা মা আমার সামনে,একটা হ্যারিকেন জ্বলছে সামনে।আবার লোডশেডিং।
-আপনি কিছু খেয়েছেন সার?
সন্মতির মাথা নাড়লাম আস্তে,তারপর বললাম-আপনি আমায় নাম ধরে ডাকবেন-অনুপম,আর আপনি নয় তুমি বলবেন।
-ওরা আপনাকে খুব বিরক্ত করেছে?ঘরের ভিতর কথাগুলো ভেসে এলো।
-না তেমন কিছু নয়,আপনারা ওসব নিয়ে ভাববেন না,মাসীমা আপনার চেকটা দু’এক দিনে চলে আসবে।
-টাকা তো আমার শিমূলকে ফিরিয়ে দেবে না,তাই না?
-তা তো ঠিক..তা তো ঠিক..
মনে মনে নিজেকে দুষলাম-হায়রে কি কথা বলে ফেললাম।
-নতুন বউ,সারের খেয়াল রাখিস,ও দীপু সারকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।

পরের দিন সকালে অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম,দোলের জন্য তিন দিন অফিস ছুটি।সিদ্ধান্ত যা কিছু হবে অফিস খোলার পর।আস্তে আস্তে গ্রাম্য পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে শিখছি।
দুদিন পর দোলযাত্রার রাতে আমি এসে দাড়ালাম সেই বিশাল দীঘির সামনে।জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক..এ জোৎস্না যেন পানযোগ্য।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না।
-কি দেখছেন অমন ভাবে?
পিছন থেকে প্রশ্নের অজান্তেই উত্তর দিলাম
-জোৎস্না।
পিছনে ফিরে দেখলাম,অপরা মানে নতুন বউ।এই দু দিনে তার সঙ্গে দু-তিন বার দেখা হয়েছে।কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন হয়নি বটে,তবে তার আথিতেয়তা আমায় বেশ মুগ্ধ করেছে।উচ্চতা মাঝারি, মানানসই রঙ যাকে বলে ঊজ্জ্বল শ্যামবর্ণ,নরম কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি,হাসিটা চমৎকার(যদিও একবার দুবার ই দেখেছি),হাসার সময় দুদিকের গজ দাঁত দুটো বেরিয়ে আসে।
একটু হেসে সে বললো
-রবি ঠাকুরের জোৎস্না আর সুকান্ত ভট্টচার্যের জোৎস্নার তফাৎ আছে তাই না?একজনের কাছে তা প্রেমের ডাক অন্যটি ক্ষুদ্ধার্ত মানুষে আর্তি।
চুপ করে গেলাম।সত্যি ভাবতে পারিনি এমন গন্ড গ্রামে জোৎস্নার এমন ব্যাখ্যা পাবো।
-কি ভাবছেন গ্রামের মানুষ এতো সব জানলো কি করে?
-না না ঠিক তেমন কিছু না…!!একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললাম।
নতুন বউ হেসে বললো-আপনি ভাবতেই পারেন,এক শ্রমিকের বিধবা স্ত্রীকে এতো জানার অধিকার তো সমাজ দেয় নি।
-একে বারেই নয়,মানুষের চিন্তন তো নারী পুরুষ পার্থক্য মানে না এমনকি সমাজ তাকে প্রশয় দেয় না।
-সমাজ?আপনাদের সমাজ পুরুষ মানুষের দাস।সে যা বলবে তাই হবে।সে ঠিক করে দেবে নারী কতোটা স্বাধীনতা পেতে পারে।নিজেকে উদার প্রমাণ করার জন্য সে একটু বেশী ছাড় ও দেয় মাঝে মাঝে।কিন্তু সেই নারী যখন সেটার অভ্যাস করে নেয় তখনই পুরুষের নখ দাঁত বেরিয়ে আসে।শুনুন শরতের বাবুর নায়িকারা শুধু উপন্যাসই থাকে,আর সমাজে থাকে রবিঠাকুরের সাধারণ মেয়েরা,যারা সব কিছু মেনে চলে।
কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছিলো। জোৎস্না আলোতে অন্ধকার সমাজের যেন এক নতুন উপলব্ধি। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম।হঠাৎ ই সে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
-এবার যাই বেশীক্ষণ থাকলে আবার রটে যাবে শ্রমিকের বিধবা বউ, ম্যানেজারের সাথে ফস্টি নস্টি করছে।
আমি হেসে বললাম,আমি দারুন কথা বলেন।
নতুন বউ চলে গেলো,কিন্তু তার রেশটা রয়ে গেলো আমার কাছে।তার কথা,তার হাসি,তার উপস্থিতির গ্রাম্য গন্ধটা…সব কিছু।

(৫)

পাঠকরা হয়তো আমাকে ভাবছেন,কয়েকদিনের এক বিধবার এমন বর্ণনা আমি কোন আক্কেলে করে চলেছি।আমি তাদের বলি,জীবনের সম্পর্কগুলো যদুবাবুর পাটীগণিতের অংক নয় যে সবই নিয়ম মেনে হবে।যাই হোক কয়েক দিনের মধ্যে আমি নতুন বউ এর কাছে থেকে তার অতীত জীবনের ঘটনা গুলো সে গুলো সাজিয়ে লিখলাম।
অপরা শিমূলের পাশের গ্রামের মেয়ে।পড়াশুনা করতে ভালেবাসতো এমনি সে কলেজের ভর্তি ও হয়েছিলো।কিন্তু হঠাৎ ই অপরার বাবা সুইসাইড করেন।ব্যাস হয়ে গেল-একে একে কমতে থাকলো -প্রথমে কলেজ যাওয়া,পড়াশুনো তারপর বাইরে বেরানো।কিন্তু সমানুপাতিক ভাবে বাড়তে থাকলো-গ্রামের মানুষদের তার প্রতি উৎসাহ,একটু ছুঁয়ের দেখা ইচ্ছা।এই সামাজিক জীবদের বিরুদ্ধে তার এবং তার বিধবা মায়ের প্রতিরোধ আস্তে আস্তে নড়বড়ে হয়ে আসছিলো।অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে বিয়ে করতে হয় শিমূলকে।এক রগচটা,গোঁয়ার,অর্ধ শিক্ষিত শিমূলকে অপরা তার স্বামী হিসাবে মেনে নিলেও তার জীবন সঙ্গী হিসাবে মানতে পারেনি।

দোলের পর তিনচার দিন কেটে গেলো।আমি অফিসের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছি।অপরা এখন ইস্কুল বাড়িতে আমার কাছে প্রায়ই আসে,এই কদিনে তার উপস্তিতিটা একটা নেশার মতন হয়ে গেছে।অস্বীকার করবো না,ইস্কুলের তপনবাবু আমাকে এই মেলামেশাটাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার সতর্ক করে ছিলেন।কিন্তু অপরার উপস্থিতির নেশার তীব্রতা তপন বাবুর এই সতর্কবাণীর থেকে অনেক জোরালো।
কিছু দিনের মধ্যে খবর পেলাম চেক রেড়ি,তবে অপিসের কিছু সর্ত আছে
(১) চেক শিমূলের পরিবার কে কোলকাতা অফিস নিয়ে আসতে হবে।
(২) অফিস চেকটা শিমূলের মায়ের হাতে তুলে দেবে।

শিমূলের মা যেহেতু শারীরিক অবস্থা ভালো নয়
তাই দ্বিতীয় সর্তটা একটু শিথিল করা হয়।ঠিক হয় শিমূলের পরিবারের যে কেউ চেকটা সংগ্রহ করতে পারে,তবে তার জন্য আমাকে সাক্ষী হিসাবে থাকতে হবে,মানে আমার পরিচিত কেউ হতে হবে।
আমার সাথে কে কে যাবে সেটা নিয়ে সন্ধ্যাকালীন গ্রামসভা বসলো।
সিদ্ধান্ত হোলো চেক আনতে শহরে আমার সাথে যাবে নতুন বউ যাবে।কিন্তু প্রধান ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না এবং সঙ্গে যোগ্য সংগত দিলো অন্তু।সে বললো
-কাকা,আমরা আগুণ আর ঘী কে একসাথে পাঠাচ্ছি,দেখো আবার সারা গাঁয়ের আবার মুখ না পোড়ে।
আমি একটু রেগে গিয়েই বললাম
-দেখুন আপনাদের এতো সমস্যা থাকলে আপনারা পরে এসেও চেকটা নিতে যেতে পারেন।আমি শহরের অফিসে কয়েকদিন থাকবো।
আমার রাগের অনেক গুলো কারণ ছিলো,
সত্যি আমি চাইনি এতো তাড়াতাড়ি চেকটা তৈরী হোক,তবু যখন শুনলাম আমি আর নতুন বউ একসাথে শহরে যাবো তখন একটু স্বস্থি ফিরলেও অন্তু আর প্রধান সাহেব মিলে সব কিছু আশা অঙ্কুরেই নষ্ট করলো।
যাই হোক ঠিক হোলো শহরে যাবো আমি,অপরা আর অন্তু।আগামী সকালবেলাতেই আমরা রওনা দেবো।

(৬)

আজ মজিলপুরের গাঁয়ে আমার নবমী নিশি।মনটা খারাপ,ভীষণ খারাপ।শেষ বারের মতন এসে দাঁড়ালাম সেই দীঘির পাশে শেষ বারের মতন।না আজ আর জোৎস্না নেই,পৃথিবীর রাত গুলো কুরে কুরে খেয়েছে চাঁদটাকে যেমন আমার সমস্ত ভালোবাসাকে খেয়েছে সমাজ।
এই কদিনেই আমি ভালোবেসে ফেলেছি অপরাকে,জানি এ ভালোবাসা সমাজসিদ্ধ নয় তবু ভালোবাসা তো।আমি জানিনা সে আমাকে ভালোবাসে কিনা কিন্তু আমি তাকে বাসি।

-তাহলে কাল আপনার ডিউটি শেষ?
অপরা আমার পাশে দাড়িয়ে।
-আপনি কখন এলেন? আমি বললাম।
-এসেছি অনেকক্ষণ,আপনি টের পাননি।তাহলে ডিউটি শেষ?
-হুম শেষ,কিন্তু ঘটনাগুলোর রেশটা কতোদিন থাকবে জানা নেই।
-মন খারাপ?
-আমার মন খারাপ হয়না অপরা।খুব ছোটবেলায় বাবা তারপর কিশোর বয়সে মারা যান,অনাথদের মন খারাপের বিলাসিতা সমাজ দেয় না।তবে অনেকদিন পর যেন..থেমে গেলাম আমি।
-অনেকদিন পর কি অনুপম?অপরার গলার আন্তরিকতাটা ছুয়ে গেলো আমার হৃদয়।
-কিচ্ছু না অপরা!শুধু একটা কথা বলতে পারি আমাদের কয়েক বছর আগে দেখা হলে ভালো হোতো।
-আমার বিয়ের আগে তাই না?
চুপ করে রইলাম,অপরা বলতে থাকলো
-একজন মানুষের নিজের মতন বাঁচার অধিকার নেই?তুমি আমাকে মুক্তি দেবে অনুপম?এরা আমায় বাঁচাতে দেবে না…কিছুদিন পর আমায় ছিড়ে খাবে..আমায় বাঁচতে দাও অনুপম।আমি আর এখান থেকে নিয়ে চলো।
আমি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম,আমার অব্যক্ত কথা গুলোই যেনে ফিরে আসছে অপরার কথায়।খুব ইচ্ছ করছিলো অপরাকে জড়িয়ে ধরতে,পারলাম না হয়তো তার অধিকারবোধ এখনো আসে নি আমার মধ্যে।নিজেকে সামলে নিলো অপরা।চলে যাবার আগে একটা কাগজের প্যাকেট আমার হাত দিয়ে বললো
-উপহারটা রাখো।অনুপম জোর করবো না,যদি মন থেকে আসতে পারো তবেই এসো।আসলে নতুন ভাবেই এসো।
-কিন্তু অন্তুকে কিভাবে…
-আমরা শুধু মন চাইতে পারি,বাকি মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সময়ের।
ইস্কুল বাড়িতে ফিরলাম অনেক রাতে।প্যাকেটটার ভিতরে নীল গেঞ্জি তার সঙ্গে একটা চিঠি।
অনুপম,
আমাদের বাপের বাড়ির নিয়ম -নতুন কোনো মানুষ বাড়িতে এলে তাকে কিছু উপহার দেওয়া।আমার তেমন সার্মথ্য নেই,এই সামান্য উপহারটা গ্রহণ করো।কাল সকালের পর হয়তো আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না।তবু মনে রেখো।
অপরা
সারা রাত অনেক ভাবলাম,মনের মধ্য যুদ্ধ চলতে থাকলো।আমার ভালোবাসা বনাম সমাজ,শিমূল,শিমূলের পরিবার।

(৭)

সকালে আমরা তিনজন রওনা দিলাম।পরণে আমার উপহারে পাওয়া নতুন নীল জামাটা।আমার মতনই অপরা মুখটাও ঊজ্জ্বল,দুজনে যেন নতুন এক অজানা পথে হাঁটতে চলেছি।ট্রেন স্টেশন মজিলপুর গ্রাম থেকে প্রায় পচিশ মাইল।সেই রাস্তা আমরা পার হলাম খানিকটা ট্রেকার খানিকটা হেঁটে।স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ট্রেন আসতে প্রায় আধা ঘন্টা।
-চা খাবেন?অন্তু জিজ্ঞাস করলো।
সন্মতির মাথা নাড়লাম।তৃপ্তি সহকারে চা খেলাম সঙ্গে বিস্কুট।
সারারাত জাগা দুটো চোখ টেনে আসতে থাকলো।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।ঘুম ভাঙ্গলো প্রবল ঝাকুনিতে।
-ও ভাই,তুমি কোথায় যাবে?
ধড়পড় করে উঠলাম,দেখলাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে।মাথাটা দপ দপ করছে।
-অপরা,অপরা..কোথায় তোমরা?
পাগলো মতন স্টেশনের চারিদিকে ওদের দুজনকে খুঁজতে থাকলাম।কোথাও না পেয়ে একবার ভাবলাম মজিলপুর গাঁয়ে ফিরে যাই।কিন্তু ভাবলাম তাদের কি উত্তর দেবো?
কিছুক্ষণ পরে টের পেলাম আমার ব্যাগটাও নেই।পকেট হাতড়ে পেলাম এক চিঠি,নতুন বউ এর চিঠি।
অনুপম
যখন তুমি এই চিঠিটা পাবে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।কিছু মনে কোরোনা,কোম্পানির দেওয়া আমার নামের চেকটা নিয়ে গেলাম।তুমি ভুল বুঝো না আমায়,আমার টাকার খুব প্রয়োজন।টাকাটা পেলে একজনের একটু উপকার হবে।সে নতুন ভাবে জীবন শুরু করবে।আমার মতন সেও আর ফিরতে চায়না মজিলপুরে।ওখান থেকে আমাদের আর কিছু পাওয়ার নেই।আমি মনে করি সমস্ত মানুষের বাঁচার অধিকার আছে।ভালো থেকো অনুপম,তুমি খুব ভালো মানুষ।তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহারের জন্য অন্তুও তোমার ক্ষমাপ্রার্থী..!
আমরা ভালো থাকবো,তুমিও থেকো।
ইতি
নতুন বউ
পুনশ্চ: অন্তু আমার কলেজ সহপাঠী।ভীষণ মেধাবী,কিন্তু গবীর।আমাদের দেশের গবীরদের কোনো প্রত্যাশা থাকতে নেই।

বসে আছি স্টেশনে..একা।
মাইকে বলে যাচ্ছে শহরে যাওয়া ট্রেন আসছে।

কুম্ভকর্ণ (ছদ্মনাম)। লেখক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় প্রকৌশলী।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ