নদীঘ্রাণ

অয়ন্ত ইমরুল
গল্প
Bengali
নদীঘ্রাণ

সেই সময়টাতে নদীর ছলাৎ টানতো খুব। নদীকে রাইয়ের মতো মনে হতো, কখনো বা রাঙাদি- রসুইঘরের মা। অনেক পূর্ণিমা সাক্ষী,সাক্ষী বেলাবেলির বালিহাঁস- কত রাত ভোর করেছি এই নদীর ভাটায় ভেসে। তারপর আবার উজানের স্রোত ডিঙিয়ে ঘরে ফেরা। এখন ডর করে, ভ্রমে ধরে, ধরে আলেয়ায়। সামান্য বাতাস হলেই,একটু ঢেউ হলেই আৎকে উঠি। তাই সন্ধ্যা লাগার পরপরই এই নদীর সাথে আমি আমার সম্পৃক্ততা ভুলে যাই। কিন্তু মাঝেমাঝে যে তেষ্টা পায় না- তা নয়, চাঁদ তার চিকন দশা কাটিয়ে উঠলেই জোছনার তৃষ্ণায় আমি উতলা হয়ে যাই। যখন চুইয়ে নামে আমি চুমুকের ভঙ্গিমায় নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি।কখনো পাড় ভাঙার শব্দে পরানডায় চিলিক দিয়া ওঠে,এই বুঝি পড়ে গেলাম। আজকাল পড়ে যাওয়ার ভয়টা খুব ফুরফুরে মেজাজে রাজত্ব করে আমার ভেতর। আমার এ ভীত স্বভাবের সুযোগ নেয় অনেকেই।

কখনো বিঁছে, কেউটে, কখনো বা তেলাপোকা। এইযে কানের পাশ দিয়ে একটা চামচিকে উড়ে গেল- আমি ভীষণভাবে চমকে গেলাম। এইযে এখনো হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক টের পাচ্ছি।

কিন্তু একটাসময় আমার সাহসের তারিফ করতো লোকজন। কুস্তিসম্রাট বলে দশগাঁয় আমার খুব নাম-ডাক ছিল। আমি বিশ্বাস করতেই পারি না এই সেই দবিরখাঁ- এই তো সেদিনও নদী সাঁতরে ওপারে যেতাম। কোথাও অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতাম। এখন এড়িয়ে যাই। এড়িয়ে যেতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমার সামনে ঘটনা-দূর্ঘটনা, যাই ঘটুক না কেন- আমি এড়িয়ে যাই; একটা ভয়ে। কিন্তু কী সে ভয়, তা অনাবিষ্কৃত। নদীতে নামলেই শুশুক আমায় ভয় দেখায়। তবে স্বস্তির বিষয়টা হল, এই নদীতে কুমির নেই। থাকলে সেও প্রভাব খাটাতো আমার ওপর। আমার সেই আমিকে কোথাও খুঁজে পাই না। কিংবা পেয়েও হারিয়ে ফেলি। আমি কি অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে চলেছি!

একটা চক্কর খেয়ে বসে পড়ি। রাস্তায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’একটা জোনাক বিশ্রীভাবে জ্বলছে। ওদের ধরে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ঠিক যে কায়দায় আমরা মশা মারি সেভাবে। রাস্তার দুইপাশেই বাঁশঝাড়। এই বাঁশঝাড় এমনভাবে গজিয়ে উঠেছে যে, মনে হচ্ছে সবগুলো বাঁশ কেটে ফেলি। কিন্তু মৃত্যুর সময় বাঁশের অভাব হতে পারে ভেবে ছেড়ে দিই। কিন্তু বাঁশঝাড়ের জন্য এখানেও গা-ছমছমে একটা ভয় কাজ করে। তাছাড়া বাঁশের কঞ্চিগুলো রাস্তার ওপর এমনভাবে ছড়িয়েছে,হাত দিয়ে না সরিয়ে এগুতেই পারছি না। আমাকে তো সামনে যেতে হবে। থেমে থাকলে চলবে না। চারপাশে মানুষ যেভাবে থেমে আছে, ওদের দেখলেই আজকাল নিজেকে উনপাঁজরে মনে হয়। টর্চের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এটা আর আমাকে সাহায্য করতে পারছে না। কিছুটা ওজন থাকায় ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তারপরও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তাকে সঙ্গে রাখার। এই রাতে যদি অন্য কোন কাজে তাকে খাটানো যায়। রাস্তা উঁচুনিচু থাকায় কয়েকবার হোঁচটের স্বাদ পেলাম। পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। নখ ওঠে গেছে কীনা বা রক্ত ঝরছে কীনা- এই অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই। আশেপাশে উন্মুক্ত স্থান পাব বলে মনে হচ্ছে না। আমার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া যেত। চেনা বা অচেনা কোন মুখ মিলছে না এখানে। একটা কুকুর আমার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘেউঘেউ করে সামনে এসেই আবার লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল। লেজ গোটাল কীনা, তা অন্ধকারে যদিও দেখতে পাইনি তবে ধারণা হল আর কী। মনে একটু সাহস পেলাম, এখনো আমাকে দেখে কোন প্রাণী ভয় পায় বলে। ক্লান্ত লাগছে, একটু জিরিয়ে নিলে মন্দ হয় না- এই ভাবনার মধ্য দিয়ে যে কুটিরগুলো বোবা হয়ে আছে, তাতে কোন লুণ্ঠনের জ্বলন নেই। ভেতরের মানুষগুলো জেগে থাকলে অন্তত শব্দ হতো। একবার ঠিক করি, কারো দরজায় গিয়ে করাঘাত করবো আর এমন কেউ দরজা খুলে দিবে, যে আমার অপেক্ষায় আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সে আমার আত্মার আত্মীয়। অথবা আমি তার নাড়ি ছেঁড়া ধন। আমাকে কোথাও যেতে দিবে না। সমস্ত স্নেহ-মমতা দিয়ে আমাকে আটকে রাখতে চাইবে। কিন্তু আমাকে তো আটকানো যাবে না কোন বাঁধনে। আমি অনন্তের যাত্রী।

আমাকে আগাতে হবে। এলোপাতাড়ি। পথের শেষ দেখার জন্য।মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে।

ন্যুব্জ পীঠের মানুষে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। এমন একটা জায়গায় এসে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল যে, আমার ডানে এবং বামে বিস্তৃত চক। মনে হল বিশাল চকের পথ পাড়ি দিয়ে গ্রাম পেতে পারি বা নাও পাড়ি। অনেকটা ভয় নিয়ে চক পেরিয়ে এলাম। আমার চোখ যতদূর গেল, তাতে বাজারের মতো মনে হল। কিন্ত গাঁওগ্রামের বাজারে দোকানপাট এত রাত পর্যন্ত খোলা থাকবে- এটা ভাবতেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। যত আগাচ্ছি বাজার থেকে কোলাহলের শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে’শালারে কষা কইরে বাঁধি ফেল’লাঠি আন, লাঠি আন। সামনে যেতেই খেয়াল করলাম- চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ বছরের একজনকে দড়ি দিয়ে কষা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে যে কাঁচা গাছ ফেঁড়ে রাখা হয়েছে- সম্ভবত আমগাছ হবে। কেননা, বাজারে আমগাছটা দেখে মনে হল, সদ্যই ওর ডাল কাটা হয়েছে। মানুষ আজকাল গাছেদের প্রতি এতটা হিংস্র হচ্ছে যে, ইচ্ছে করে গাছের মতো ওদের ফাঁড়ি, ফেঁড়ে শুঁটকি মাছের মতো করে চুলোয় দিই। তো ওই গাছেরই লাকড়ি হাতে বিশ-বাইশ বছরের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে হুংকার দিচ্ছে ‘তরে আইজ পাইছি, এমন বানান বানাইমু, চোদ্দগুষ্টির নাম ভুলাই দিম’ এই হৈচৈয়ের মধ্যে আমার দিকে কারো তাকানোর সময় হবে না, এ আমি জানি। ক্রমেই জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আশপাশ থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। কিন্তু মানুষ কি না সেটাই ভাবছি।

ভিড় ঠেলে একটু সামনে যাই। হ্যাজাকের আলোয় লোকটির মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওর শরীরে আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা যায় যে, এক দফা পেটানো হয়েছে লোকটিকে। লোকটি হাঁপাচ্ছে আর মানুষের মুখের দিকে তাকাচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। সম্ভবত, কারো চোখে-মুখে ওর জন্য সামান্য মায়া বা সহানুভূতি খুঁজে না পেয়ে,একরকম মেনেই নিয়েছে যে আজ আর ওর রক্ষা নেই। তাই ঘাড়টা নামিয়ে নিয়ে স্থির হয়ে আছে মাটির দিকে। ওর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকাটায় বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। একজন জিজ্ঞেস করছে, তোর সাথে আর কেউ আছে কি না বল- লোকটির উত্তর না দেয়াতে বলা হল পা উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেই উঁচিয়ে ধরলো, অমনি একটা বাড়ি পড়লো ঠিক পায়ের তালুতে। লোকটি উহ্য শব্দ পর্যন্ত করলো না। মাটির দিকেই তাকিয়ে থাকলো।

লাকড়ি হাতের ছেলেটে উদ্যত হচ্ছে দ্বিতীয় বাড়ি দেয়ার জন্য, কি মনে করে যেন আমি হাত বাড়িয়ে লাকড়িটা কেড়ে নিই। অবশ্য ব্যথাও পেলাম কিছুটা। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো- আপনি দবির চাচা না?

আমি বিস্মিত হলাম। কেননা,আমাকে তো এখন আর কেউ চেনে না। আমার কাছের মানুষদের সাথে ধাক্কা লাগলেও, কোন কথা না বলেই, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকিয়েই পাশ কেটে যায়। আমি ডাকলেও পিছন ফেরে না। আজকাল আমার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়টা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে আমার পরিবারের লোকজন, গ্রামের লোকজন আমাকে চেনে না। সেখানে এই লোকটি বললো- আপনি দবির চাচা না!

আমি কোন কথা না বলে, একটু কঠোরভাবে উচ্চারণ করলাম যে, ওর গায়ে আর একটাও আঘাত করবা না কেউ। সবাই থমকে গেল। হঠাৎ করে একজন বলে বসলো- এইড্যা ওর সাথের লোক। এইড্যারেও বাঁধি ফালান সবাই। বলতে না বলতে কয়েকজন মিলে আমাকে ঝাপটে ধরে বেঁধে ফেলে এবং লোকটির পাশে বসিয়ে দেয়। আমি বার বার বলে যাচ্ছি যে, আমি সেই দবির খাঁ। উজান তলি আমার বাড়ি। আমি এক সময় বিভিন্ন গ্রামে কুস্তি খেলতাম। লোকে আমাকে কুস্তিসম্রাট বলে ডাকতো। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনে না। তারা বলে যে, আমাদের আশেপাশে দশগ্রামেও এই নামে কেউ নেই। লোকটা বলছে’আপনাদের পায়ে পড়ি, উনাকে ছেড়ে দেন। যা শাস্তি দেয়ার আমারে দেন। আমি মাথা পাইতা নিমু। কিন্তু এই ভাল মানুষডারে অপমান কইরেন না, তারে কোন রকম কষ্ট দিয়েন না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, এই তো মানুষ। তাহলে এই লোকগুলো কি মানুষ না?

তারা কি আধোমানুষ?

তারা কি উনমানুষ?

তারা ঠিক কোন ধরনের মানুষ এই প্রশ্নটার উত্তরের জন্য আমি নীরব হয়ে গেলাম। কিন্তু এই কোলাহলের মধ্যে ভাববার অবসর পেলাম না। অনেক অনুনয়ের পর লোকটা এটা বোঝাতে পারলো যে, আমি এই লোকটার সহচর নই। কিন্তু একজন আমার পায়ের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো- না, না। এইড্যা ওর সাথের লোক। দেখছেন না, তার আঙুলের নখ উঠে গেছে। মনে অয় পলাইতে গেছিল আর হেই সুময় তাইনের পায়ের নখ উঠে যায়। আমি বলি এটা ঠিক না। আমি বহুদূর থেকে হেঁটে এসেছি, আসার পথে উষ্ঠা খেয়ে নখ উঠে গেছে। তা মিয়া আপনে কই যাইতেছিলেন এত রাইতে? এই পথের অগ্রভাগে আমার বাড়ি। আমি আমার বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। বলতেই একজন এসে আমার বাঁধন ছেড়ে দিল। সবাই মিলে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিল। কিন্তু আমি যেতে চাচ্ছিলাম না। লোকটির শেষ পরিণতি দেখার জন্য বুকটা আনচান আনচান করছিল। কিন্তু তারা আমাকে এখানে থাকতে দিলো না। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে কামনা করছিলাম কোন কুটির পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কার দরজায় যাই, কে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় বলা তো যায় না। আমি হাঁটছি, কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে লোকটির কথা, তার পরিণতির কথা। শেয়ালের ডাকের মতো মনে হল। আমি কান খাড়া করি। চারপাশ স্তব্ধই। কিন্তু শেয়ালের ডাক আসছিলো কোথা থেকে? কোথাও ঝোপ নেই। বন-বনানি নেই। তাহলে? আমি ভুলে গিয়ে আবার পা’কে বলছি, চলো, যেখানে পথের শেষ। একটা সময় মনে হল, আমার পায়ের রগ ছিঁড়ে যাবে অথবা আমার পায়ের তালু দিয়ে রক্ত ঝরবে। এটাকে পিচঢালা পথের মতো মনে হল, মনে হল গ্রাম থেকে শহরের দিকে যাচ্ছি। আমি আমার পায়ের তুলতুলে স্যান্ডেলের কথা মনে করলাম। কিন্তু পায়ে তা দেখতে পেলাম না।

আমি কি স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে এসেছিলাম? কিন্তু কিছুই মনে পড়লো না। ভাবলাম এক জোড়া স্যান্ডেল কেনার কথা। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই আমার নতুন পাঁচ’শ টাকার নোটটা পেলাম না। আমি চমকে উঠলাম। এত দূর্যোগে, এত দূর্ভিক্ষে, অনাহারে থেকেও যা আমি খরচ করিনি, তাকে হারিয়ে ফেলেছি! এটা আমার প্রথম কুস্তি বিজয়ের টাকা। এটা কোনভাবে ভাঙা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মনে পড়ে গেল, ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন আমার পকেটে হাত দিয়েছিল, তখনই সম্ভবত এটা চুরি হয়েছে। নিয়তি বলে মেনে নিলাম। আমি হাঁটছি, ক্রমশ হাঁটছি, সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন। বায়ান্ন থেকে একাত্তর। একাত্তর থেকে নব্বই। নব্বই থেকে এক এগারো। কিন্তু কোথাও আমার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। আমি কি বিরক্ত হচ্ছি? কেউ একজন ডাকছে আমায়। কিন্তু পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। আমার চোখে একাত্তর বয়েসী ঘুম। হাই তুলছি বার বার। কিন্তু নিরাপদ ঘুমের বা নিরাপদ স্বপ্নের সঠিক আশ্রয় এখনো খুজে পাচ্ছি না। একটা কবরস্থান পেরিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি, কবরে যারা আছে তারা হয়তো নিরাপদ ঘুমে, নিরাপদ স্বপ্নে বিভোর। বিভোর উচ্চারণ করতেই ভোরের কথা মনে এল। এত এত হাঁটলাম কিন্তু রাত ফুরোলো না! ভোরের মুখ দেখা হলো না। একটা লাল মোরগের ডাকের অপেক্ষা করছি কতযুগ ধরে। কিন্তু এসব বাড়িতে মনে হয় লাল মোরগ নেই। আমি আবার লোকটির কথা স্মরণ করি- ওর চোখ উপড়ে দেবে না তো? চোখ উপড়ে দিলে গণতন্ত্র দেখবে কী করে, স্বৈরাচার দেখবে কী করে। ফ্যাসিস্ট দেখবে কী করে।

সন্দেহ হল ওর বোধ শক্তি আছে কীনা। যদি না থাকে তবে তো অনুভব করতেও পারবে না।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি একটি ডালাপালাসমেত গাছের কথা স্মরণ করি। এমন একটা গাছ বৃষ্টির ভেজানো থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারে। ব্যাপারটা কেমন হল! এর না আছে কোন শেকড়বাকড়, না আছে ডালাপালা- রসবোধবর্জিত একটা ন্যাড়া অশ্বত্থ বিপুল আবেগে আমায় জড়িয়ে নেয়। আমি আশ্চর্য হই। কি বিশ্রী রাত, অন্ধকার তার ওপর আবার বৃষ্টি। বলা নেই কওয়া নেই ঝমঝম করে নেমে পড়লো! রাস্তা কাদায় ভরে গেলে হাঁটতে অসুবিধে হবে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। বৃষ্টি থামেনি। একটা ভ্যানগাড়ি আসছে, ভ্যানগাড়ি থেকে কান্নার শব্দ হচ্ছে। অপরিপক্ক ভ্রুণ জন্ম দিতে গিয়ে ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে মারা গেছে। কাছে যাই।

হারিকেনের আলোয় যতটুকু দেখতে পাই- চমকে উঠি। রুণুর কি পুনরায় জীবন চক্র শুরু হল!

আমি রুনু রুনু বলেই বুকে জড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাকে বাঁধা দেয়া হয়।

একজন আমার মুখের দিকে হ্যারিকেন উঠিয়ে, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে একবার তাকিয়েই নামিয়ে নেয়। ভ্যানগাড়িটি ছুটতে থাকে। আমি পিছন পিছন যেতে থাকি। কিছুদূর গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাই। একটা কণ্ঠস্বরের মতো কানে আসে ‘বাবা ওঠো, বাবা ওঠো’চমকে উঠি। কে? কে? বলে এদিকওদিক তাকাই। না কোথাও কেউ নেই। ভ্যান গাড়িটি অনেকদূর চলে যায়।

রুণু আমার একমাত্র মেয়ে। সেই নিকৃষ্ট ঘটনার পর, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

তবে ওর বাঁচার খুব স্বাদ ছিল। দীর্ঘ তিনমাস নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করে সুস্থও হয়েছিল। গণধর্ষণের শিকার হওয়ার পর এলাকার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ওই লন্ডনপ্রবাসী সাবের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে। আশ্বাস দেয়- ন্যায় বিচার পাইয়ে দিবে। এবং তার বাড়িতেই আমাদের আশ্রয় দেয়। আমরাও নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজ বাড়ি ছেড়ে তার বাড়িতে গিয়ে উঠি। সে একদিকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনি পদক্ষেপ চালানোর পরামর্শ দেয়, অন্যদিকে প্রতিরাতে মেয়েটিকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। তিনি শুধু একাই ধর্ষণ করেননি, কয়েকজন বন্ধুকেও আমন্ত্রণ করে আনেন ধর্ষণ করার জন্য। আর এ ঘটনা সবার কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরই মেয়েটা আমার লজ্জায় ঘৃণায় আত্মহত্যা করে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম, যার সাথে কথা বলছি, সে এক ভিক্ষুক- রাস্তাসংলগ্ন এক দোকানের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মনে হল ওর একটা হাত আমার অশ্রজল মুছে দিচ্ছে। মনে হল পৃথিবীর মধ্যে কেউ অন্তত আমার আছে। ওর পায়ের দিকে তাকাতেই দেখি, একটি পা নেই। আমার কাশির শব্দ পেয়ে ওর ঘুম ভেঙে যায়। এত রাতে! কে আপনি? আর এইখানে কি করেন? ভিক্ষুক চারপাশে তাকিয়ে লুঙ্গিতে মোড়ানো বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে জ্বালিয়ে টানতে থাকে আর একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে আমায়। আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা মোরগ ডেকে ওঠে। লাল মোরগ কীনা জানিনা। ভোরের দিকে যাচ্ছি। ভিক্ষুক আর একটি বিড়ি ধরায়। আমার উদ্দেশ্যে একটা হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু আমি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি জানাই। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই ভিক্ষুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললো- নাই। ছিল একসময়। এখন যেইখানে রাইত, সেইখানেই কাইত। ভিক্ষুক তার পরিচয় দেয়া শুরু করলো। আমি সৈকত, আমার বাড়ি উজানতলী। আমার বাবার নাম দবির খাঁ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ভারতের রায়গঞ্জ মুজিব ক্যাম্প ১২ নং সেক্টরে যোগদান করে সেখানে ট্রেনিং করেন। সেখান থেকে পরে তাকে পাঠানো হয় বুড়িমারি ৬ নং সেক্টরে। এরপর ৬ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে বুড়িমারি থেকে এসে তারা, হাতিবান্ধার বড়খাতা, আদিতমারি ও কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ভারতীয় তালিকা অনুযায়ী সেখানে তার কার্ড নম্বর ছিল। ভারতীয় তালিকায় নাম থাকলেও উজানতলী উপজেলায় অর্থাভাবে তার নাম উঠাতে পারেন নাই। কারন যেসময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও ভাতা প্রদানের জন্য নামের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল, সেসময় এই উপজেলায় দায়িত্বে থাকা লোকদের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে টাকার মূল্য অনেক বেশি ছিল। উনার মাথায় একটি টিউমার হয়। এর চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়। একটাসময় আমাদের ঘরে রান্না করার মতো চাল থাকে না। আমি যেটুকু লেখাপড়া করেছি তা দিয়ে কোন চাকরিও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে কিছুদিন রিক্সা চালাতে হয়। আর তখনই একটা দুর্ঘটনায় আমি পা হারাই। সেই থেকেই হাত পাতি মানুষের দ্বারেদ্বারে। বাবার ঔষধে প্রতিমাসে তিনহাজার টাকা খরচ হয়। আমি ঝিমিয়ে পড়ছি, তন্দ্রায় জড়িয়ে যাচ্ছি।

একটা কাক তীক্ষ্ণ ও কর্কশ গলায় ডাক দিয়ে উড়ে বসে কৃষ্ণচূড়ার ডালে। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিস্কার করি ল্যাম্পপোস্টের নিচে পড়ে থাকা এক টুকরো ছায়াপিণ্ডের মতো ভাসমান মানুষগুলোর শয্যার পাশে ফুটপাতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘোরাচ্ছন্ন অবস্থায় বসে আছি।

যতদূর চোখ যায়, ঘুম ও ঘুমন্ত মানুষের ছবি। কেবল একজন- সম্ভবত বিকৃত মস্তিস্কের, ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে। একটু এগিয়ে গিয়ে মুখের দিকে তাকাতেই পিলে চমকে গেল- লোকটি দেখতে অবিকল আমার মতো!

আমি আবার হাঁটা শুরু করি। আমি হাঁটছি, একজন জেলে মাছের ডালা নিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে টপকে গেল। একটু অনুশোচনা হল না তার। আমি পথকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি নাকী পথ আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ পর সূর্য তার লাল আভায় ভরিয়ে দেবে ভোর। আকাশ এমনটাই ভাবাচ্ছে। তবে কিছু একটা থমকে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

অয়ন্ত ইমরুল। কবি। জন্ম ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সাভার। প্রকাশিত বই: 'ছায়া সমুদ্র' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), 'বুদ্ধের ভায়োলিন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), 'সাদা ধূলির দূরত্বে' (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), 'স্বৈর হাওয়ার হরিণী'  (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০) এবং 'কিসমত আলী অথবা শূন্য' (গল্পগ্রন্থ, ২০২০)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..