নবকুমার বসুর ‘দুই বেয়ান’ গল্প অবলম্বনে শ্রুতিনাটক

নন্দন সেনগুপ্ত
নাটক
Bengali
নবকুমার বসুর ‘দুই বেয়ান’ গল্প অবলম্বনে শ্রুতিনাটক

ভূমিকা:

নবকুমার বসুর এই গল্পটি অবলম্বনে শ্রুতিনাটক করার দায়িত্ব পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতিম সাহিত্যিক নবকুমার বসুর সঙ্গে আলাপও এই কাজের সূত্রে, যদিও তাঁর লেখার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত আমি অনেকদিন থেকেই। গল্পটিকে নাট্যরূপান্তর করতে গিয়ে প্রধান সমস্যাটা ছিল সময়ের এগোনো-পিছোনোর যে পরিস্থিতিগুলো গল্পে আছে, তাকে সঠিক ভাবে উপস্থাপিত করা। যেহেতু শ্রুতিনাটক, সেহেতু শুধু আবহ দিয়েই সেটা করার চেষ্টা করেছি। লেখকও সস্নেহে অনুমতি দিয়েছেন এবং সর্বোপরি নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন বরাবর। ফলত আবহ সম্পর্কিত বিষয়গুলি নাটকের অঙ্গ হিসেবেই পাণ্ডুলিপিতে রইল। যেখানে একাধিক আবহ একের পর এক লেখা আছে, সেখানে নম্বর দিয়ে পরপর সেগুলো লেখা হয়েছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, যদিও পরপর লেখা হয়েছে, কিন্তু একটার সঙ্গে পরেরটা মিশে যাওয়াই কাম্য, ফেড ইন-ফেড আঊট ব্যবহার করে। তাতে নাটকের গতি বজায় রাখতে সুবিধে হবে। এ বিষয়ে কোন পরামর্শ করতে চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ করুন, আমি সানন্দে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।

২০১৮ সালের মে মাসে, কেম্ব্রিজে, – ‘কল্পনা‘ সংস্থার একটি সাহিত্য – অনুষ্ঠানে নবকুমার বসুর সঙ্গে একটি চমৎকার সন্ধ্যে কাটিয়েছিলেন স্থানীয় সাহিত্যরসিকরা। সেখানেই নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়। অভিনয় করেছিলেন অমৃতা রায় ( ঋতু), অনসূয়া চট্টোপাধ্যায় ( রিয়া), সীমা চক্রবর্তী (অদিতি)। আবহ এবং যৎসামান্য পরিচালনায় আমি নন্দন সেনগুপ্ত।

 

চরিত্র – ঋতু ( মেয়ে),  রিয়া ( মা ),  অদিতি (শাশুড়ী )

 

১. Sound

২. Sound

১. Scene Signature Tune

২. ফোন বেজে ওঠে ( Signature ringtone for Ritu)

রিয়া হ্যালো হ্যালো ,  কে হ্যালোওও?
ঋতু মা আমি ! আমি ! ঋতু বলছি। হ্যালো … শুনতে পাচ্ছো ?
রিয়া হ্যালো …। হ্যাঁ হ্যাঁ এইবার শুনতে পাচ্ছি। কিরে ? এখন ফোন করেছিস যে ? কটা বাজে তোদের কেম্ব্রিজে এখন ?  অফিস নেই তোর আজ ? সব ভালো তো ?
ঋতু হ্যাঁ হ্যাঁ , সব ভালো … এইতো আটটা বাজে । সানিকে স্কুলে নামিয়ে অফিস যাচ্ছি ..। আসলে একটা কথা তোমাকে বলার ছিল… ভাবলাম এখনই করে নি ফোনটা  … লাঞ্চ করতে বসেছ নাকি?
রিয়া হ্যাঁ এই বসব। বল … কি কথা
ঋতু মা… মনে হচ্ছিল আবার …
রিয়া আবার মানে ? … কি আবার ? থেমে যাস কেন কথার মাঝখানে…
ঋতু আঃ বলতে দেবে তো। আবার মানে সেকেন্ড টাইম … মনে হচ্ছিল কদিন ধরেই …টেস্ট করেছি …। পজিটিভ …
রিয়া ও … তাই ই ই ! বাঃ সে তো ভালো খবর রে। খুশীর খবর । তা কদিন হল মনে হচ্ছে ?
ঋতু ডাক্তার দেখিয়েছি …। চার সপ্তাহে পড়েছে বলছে
রিয়া স্ক্যান ট্যান কিছু করিয়েছিস ?
ঋতু না। ছ সপ্তাহের আগে স্ক্যান তো করবে না।
রিয়া ও বাবা , তাহলে জানবো কি করে ছেলে না মেয়ে ?
ঋতু ওঃ , তাই নিয়ে এতো তাড়াহুড়োর কি আছে ? যখন জানবার তখন জানবে। শোনো , আসল কথাটা হল , আসার প্ল্যান করো কিন্তু। পূজোর বেশ আগেই চলে এসো। বাবাকে আগে থেকে বলে রেখো। না হলে তো আবার অন্য কিছু প্ল্যান করে বসে থাকবে
রিয়া দাঁড়া … ওরকম তাড়াহুড়ো করে কি হয় !। এইতো সবে বললি। একটু ভেবে নি।
ঋতু রিটায়ার্ড লাইফে অত ভাবাভাবির কি আছে মা ? তোমাদের তো দশ বছর মাল্টি এন্ট্রি করানোই আছে । দমদম থেকে প্লেনে উঠবে আর এখানে নামবে… এই তো
রিয়া আরে সে বললে হয় ? পাট গুটিয়ে কয়েক মাসের জন্য যাওয়া … ভেবে দেখতে হবে না ? তোর শাশুড়িকে বলেছিস ?
ঋতু তোমার কাছ থেকে আগে গ্রীন সিগনাল পাই যে আসছ… তারপরে ওনাদের বলবো।
রিয়া গ্রীন সিগনাল পাওয়ার আর কি আছে। খবর যা… তাতে না গিয়ে পারবো কি করে? শুধু একটু প্ল্যান ট্যান করে আর কি…। তা ওঁদের যাওয়া কবে কিরকম হবে কিছু ভেবেছিস ?
ঋতু ( একটু চুপ করে থেকে) আমি জানি তুমি কেন জিজ্ঞেস করছ মা… চিন্তা নেই…
রিয়া এতে আবার জানবার কি আছে  ?  আমি এমনি জিজ্ঞেস করছি…।
ঋতু এমনি জিজ্ঞেস করছ ? ( একটু হাসে ) … হাসিও না আর… এনিওয়ে… তোমরা ফিরে যাবার পরেই ওনাদের আসতে বলবো। ওভারল্যাপিং হবে না। ঠিক আছে?
রিয়া তোর যেমন কথা । ওভারল্যাপিং হলেই বা কি । আমার কিছু অসুবিধে নেই।
ঋতু আমার অসুবিধে আছে । সানি হবার পরে যখন ছিলে তখন তো পদে পদে… (হঠাৎ থেমে) ওসব কথা থাক। তোমাদের আসার তোড়জোড় কর। এখন রাখছি ।
রিয়া (স্বগতোক্তি) হ্যাঁ … আগের বার একটু ধকল হয়েছিল বটে। একদিকে বেয়ান আর অন্যদিকে বাচ্চা …
১.  Sound

২. Sound

 

১. Melody – Flashback

২. আবহ –  বাচ্চার কান্না – দুই মহিলার কণ্ঠস্বর – বাচ্চাকে ভোলানোর নানারকম অর্থহীন অথচ আকর্ষণীয় আওয়াজ ।

 

রিয়া না না… কাঁদে না কাঁদে না …। এই যে বাবু… এই যে সোনা …। ওলে বাবা লে …… কি কান্না কি কান্না… ( কান্না আস্তে আস্তে থামে) … এই তো এই তো , হাসো দেখি এবার। দেখো ঠামুও এসে গেছে। অদিতি দি  – দেখো তোমার নাতির গলার জোর …
অদিতি ওরে দুষ্টু ছেলে … দিদার কাছে হাসি আর ঠামুর কাছে এলেই কান্না  … দাঁড়াও তো … দেখাচ্ছি মজা
রিয়া আর কটা দিন সময় দাও … দেখবে তখন ছাড়তেই চাইবে না।
অদিতি হ্যাঁ, সবে তো এলাম। এই কদিনে আর কতটুকুই বা চিনবে ! তবে তুমি যে আগে আগে এসে পড়েছিলে , তাতে বড় ভালো হয়েছে রিয়া
রিয়া (হেসে) এ আর এমন কি। আমাদের মা দিদিমারাও করেছেন, আমরাও করছি।
অদিতি কি যে বলো। এ যে কত বড় উপকার, সারা জীবন মনে রাখার মত।
রিয়া ( একটু তীক্ষ্ণ ভাবে)  উপকার আবার কি? মেয়ের বাচ্চা হবে, তাও প্রথম বার, আমি ছাড়া কে সামলাবে ?
অদিতি সে তুমি যাই বলো , কজন মা এমন করে ভাবে গো ? তোমার মতন ধকল নিতেই বা পারে কজন?
রিয়া না না , কি বলছ – মেয়ের মা কি এই অবস্থায় বসে থাকতে পারে? করতে প্রাণ চায়ই –  তবে সবাই হয়তো সময় সুযোগের জন্য ঠিক পেরে ওঠেনা।
অদিতি হ্যাঁ , তাই তো। আবার মেয়েগুলোও তো তদ্দিনে অন্য ফ্যামিলির হয়ে যায়, . নিজের মা-ই যেন পর তখন , দেখছি তো
রিয়া আমার ঋতুর তেমন হয়নি। কন্সিভ করে অবধি মা মা করছে। আর পার্থ যেমন উদার ভালো ছেলে ……
অদিতি হ্যাঁ সে তো বটেই। নিজের ছেলে বলে বলছি না , তবে তোমার মেয়েরও কপাল ভালো ! অমন স্বামী পেয়েছে
রিয়া ( একটু শুকনো ভাবে) ওদের যোগাযোগটা ভালোই হয়েছিল ।
অদিতি সে আর বলতে ! যাই হোক –  আমাদের ফ্যামিলি এখন থেকে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইল রিয়া ।
রিয়া যাঃ ওভাবে বোলোনা। মেয়ের প্রথম বাচ্চা হচ্ছে শুনে কি আমি বসে থাকতে পারি ?
অদিতি ওমা , সেকি গো !। বলবো না ? নিজের ঘর সংসার সব ফেলে কষ্ট করে এলে, এতদিন থেকে গেলে – তবেই না আমার এমন কোলজোড়া নাতি।
রিয়া কষ্ট নয় গো। মেয়ে মা হল, নাতিও এই প্রথম। একি কম স্যাটিসফ্যাকশন?
অদিতি আসলে জানো তো ফলের চেয়ে বীজের কদর বেশী। ছেলের কাছ থেকে আবার ছেলে পাওয়া, বংশের সন্তান । আনন্দটা একেবারে বুকের ভেতর গো। কিন্তু চিন্তা তো হয়, বলো ? একটা কাজের লোকও তো এখানে পাওয়া যায়না। কি টেনশনে যে ছিলাম। তুমি দেখাশোনা করতে আসছ শুনে পাষাণভার নেমে গেল বুক থেকে।
রিয়া ( শুকনো হেসে) কাজের লোক আর এখানে কোথায় পাবে। আর পেলেও …… মেয়ে-জামাইয়ের  নতুন সংসার, দুজনেই কাজ করে। বিদেশ – বিভুঁইয়ে আমরা এসে না দাঁড়ালে কি চলে ?
অদিতি আমি তো পার্থর বাবাকে সেই কথাই বলি। মা ছাড়া মেয়ের কষ্ট বোঝে কে ! ঐ সময়টা তোমাকেই বউমনির দরকার ছিল।
রিয়া হ্যাঁ , সে তো বটেই।
অদিতি যাক … ঠাকুরের কৃপায় আমার ছেলে বউমণির সে ক্ষমতাও আছে, নইলে অত দূর থেকে যাতায়াতের খরচটাই কি কম ?
রিয়া ( শুকনো গলা) খরচ কিন্তু ওদের কিছু করতে হয়নি। প্রয়োজনে আমেরিকা আসার মত ক্ষমতা ভগবান আমাদের দিয়েছেন।
অদিতি সেকি আর আমি জানিনা ভেবেছ ? পার্থকে তো বললাম – তুই আবার ওঁদের একটা খরচের ধাক্কায় কেন ফেললি বাবা। বংশের ছেলে, দায়িত্ব তো আমাদের।
রিয়া আর ছেলের মা যে আমারই পেটের  মেয়ে, সে কথা ভুলে যেওনা।
অদিতি ওমা ছি… তাই কখনো পারি ! তোমরা যে আনন্দ করে এসেছ, ধকল নিয়েছ, ভালোবাসো বলেই তো। খরচটা সেখানে কোনও ব্যাপার ?
রিয়া মেয়ে , নাতি আমার সুস্থ আছে… আর কিছু চাইনা। এবার নিজেদেরটা বুঝে চলতে পারলেই…
অদিতি পারবে বই কি। আর আমিও তো এবার এসে পড়েছি… ছেলের নিজের ঠাকুমা বলে কথা…
রিয়া হ্যাঁ … ঠিকই তো। আমাদেরও ফেরার সময় তো হয়ে এলো
 অদিতি নিশ্চিন্তে যাও , একবার যখন এসে পড়েছি… ছেলের ঘর সংসার সব গুছিয়ে দিয়েই যাবো।
১. Sound

২.  Sound

৩. Sound

১. Melody – scene signature tune

২. Melody – flash forward

৩. ফোন বেজে ওঠে আবার – ( Signature ringtone for Ritu)

রিয়া হ্যাঁ ঋতু , বল। টিকেটের ডিটেল পেয়েছিস তো ? তোর বাবা মেল করে দিয়েছে
ঋতু হ্যাঁ , পেয়েছি সব। আজকাল কিন্তু অনলাইন চেক ইন হয় আগে থেকে। আমি বা পার্থ সব করে তোমাদের মেল করে দেব। সেগুলো প্রিন্ট করে নিও মনে করে।
রিয়া ( হেসে ) তোর বাবা করে নেবে । অত ভাবিস না।
ঋতু আর শোনো … আমার শাশুড়িকেও এবার জানিয়ে দিচ্ছি ।
রিয়া হ্যাঁ হ্যাঁ , আমিও ফোন করবো ওনাকে।
ঋতু দেখো তার আগেই উনিই তোমাকে রিং করবেন হয়তো। ভুলভাল বকলে পাত্তা দিও না।
রিয়া ( ধমকে ) ও কি , ছিঃ , ওরকম বলে নাকি।
ঋতু যেমন বলাবে, তেমনই বলতে হবে। ওনার তো একটু আছেই এটা ওটা বলে ফেলার স্বভাব, তুমি তো ভালো করেই জানো।
রিয়া সে ওনার যা আছে তা আছে… কথা কানে না করলেই হল। আর তেমন বেশী কিছু বললে আমিও একটু কুট করে শুনিয়ে দি। ( হাসি)
ঋতু ( হাসে ) তোমরা যে সব কি ধাতু দিয়ে তৈরি।
রিয়া তোকে আর আমার ধাতু নিয়ে ভাবতে হবে না। আর সপ্তাখানেক পরেই দেখা হবে। নিজের দিকে খেয়াল রেখো। দাদুসোনা কেমন আছে?
ঋতু সানি একদম ফিট। স্কুলে যেতে খুব পছন্দ করছে। তোমাকে আর বাবাকে নাকি ওর ক্লাসে ভর্তি করে দেবে বলছে ( হাসে )
রিয়া ( হেসে ) বেশ তো, আবার সব শিখবো না হয়।
ঋতু ঠিক আছে মা। রাখছি এখন। শাশুড়ি ফোন করলে কথা বলে নিও।
রিয়া হ্যাঁ হ্যাঁ , ঠিক আছে ।
Sound ফোন বেজে ওঠে আবার – ( normal ringtone )
রিয়া হ্যালো .. ওমা বেয়ান যে .. আমি আজকেই ফোন করতাম তোমাকে। কেমন আছো অদিতি দি ?
অদিতি ভালো আছি গো, খুব ভালো  আছি। তা তোমাদের সব রেডি ? কোন এয়ারলাইন্সে যাচ্ছ যেন ?
রিয়া কে এল এম টাই ভালো পেলাম। কেন গো ? পার্থ-ঋতু রা বলেনি ?
অদিতি হ্যাঁ বোধহয় বলেছিল। আমার ছাই মনেও থাকেনা। ( একটু হাসি ) তা মামনিরা কি ওখান থেকেই টিকিট করে পাঠাল ? নাকি এখান থেকেই কেটেছে ? আজকাল তো সব ইন্টারনেটে হয়…
রিয়া ( সামান্য বিরক্ত) না না , ওরা কেন কাটবে ? খুবই জোরজার করছিল কিন্তু ওদের বারন করে দিয়েছি।  ঋভুও এখন আমেরিকায় , ওদের বাবাও পেনশন পাচ্ছেন … সে সব পুষে রেখে কি হবে ?
অদিতি ( একটু অপ্রতিভ অথচ প্রগলভ ) তা বটে … তোমাদের তো এখন সব ডলারে হিসেব। তাও বাপু খরচটা তো কম না। এরোফ্লোতে একটা সস্তার ডিল দিচ্ছিল, ভাবলাম তোমায় জানাই।
রিয়া না গো, আমাদের তো টিকিট হয়ে গেছে। আর সস্তার ফ্লাইটে নাকি নানারকম সর্ত থাকে, সব বুঝিনা তো, ভয় লাগে। তা তোমাদের কত পড়ল?
অদিতি দাঁড়াও , কবে যাবো আগে ঠিক করি। অবশ্য গেলে এবার একটা রাউণ্ড দ্য ওয়ার্ল্ড টিকিট কাটাই ওঁর ইচ্ছে।
রিয়া খুব ভালো। সারাবছর ঐ ঘুপচি ফ্ল্যাটে কেন পড়ে থাকবে ? বেড়িয়ে এলে মনটাও বেশ ——-
অদিতি ওমা জানো না ? ফ্ল্যাট তো বেচে দিচ্ছি। বউমনির এবারেরটা হয়ে গেলে ভাবছি…কতদিন আর দূরে দূরে থাকবো……ওরাও এবার বড্ড চাইছে সবাই একসঙ্গে থাকি……সিটিজেনশিপ পেয়ে গেলো তো !
রিয়া তাই ? বাঃ । এতদিনে তোমাদের একটা হিল্লে হোল তা হলে। সত্যি তো , সারা জীবন কম কষ্ট করেছ !
অদিতি ( সামান্য জ্বালা ধরা হাসি হেসে) এবার তুমি ঘরদোর গুছিয়ে গাছিয়ে ঋতুকেও একটু ট্রেনিং দিয়ে এসো। শ্বশুর – শাশুড়ি নিয়ে ঘর করার অভিজ্ঞতা তো নেই… অবশ্য আমিও শিখিয়ে পড়িয়ে নেবো।
রিয়া ( হেসে ) দ্যাখো শেখানোর দরকার হয় কিনা। ওর আপব্রিঙ্গিং আর কালচারটা অন্যরকম তো … আচ্ছা আজ রাখি গো। একটু বেরোতে হবে, কিছু কেনাকাটা করার আছে , আর তো কদিন পরেই যাওয়া … রাখি কেমন !
অদিতি আচ্ছা…। পরে কথা হবে
Sound 1. Melody – scene signature tune

2. এয়ারপোর্ট-এর আওয়াজ। ঋতু রিয়া কে বিদায় জানাচ্ছে

 

ঋতু সাবধানে যেও। এই এলে আর এই চলে যাচ্ছ। দেখতে দেখতে দিনগুলো চলে যায়।
রিতু তোরা সব সামলে থাকিস। মুন্নির যেন ঠাণ্ডা ফান্ডা না লাগে  – সবে তিন মাস হয়েছে । সাবধানে রাখিস।
ঋতু ইস , কি তাড়াতাড়ি সময়টা কেটে গেল, ভাবাই যায় না।
রিতু তা গেল বইকি। ( হাসে ) তাই তো হয়। যাকগে তুই এবার যা, তোর শ্বশুর-শ্বাশুড়ী ল্যান্ড করে গেলেন কিনা দেখ।
ঋতু গেলেই বা। পার্থ তো আছে এরাইভাল এ ।
রিয়া না না তুই যা, ওরা এসে বেরিয়ে এসে তোকে দেখতে না পেলে দুঃখ পাবেন। আমরাও আস্তে আস্তে এগোই , সিকিউরিটিতে লাইন হবে।
ঋতু ঠিক আছে, এগোও  তাহলে। কলকাতায় নেমেই একটা মেসেজ করে দেবে কিন্তু।
রিয়া হ্যাঁ রে দেবো। আসি তাহলে । ভালো থাকিস সব । দুগগা দুগগা ।
১. Sound fades out

২. Sound

৩. Sound fades in

৪. Sound

১. এয়ারপোর্ট-এর আওয়াজ কমে যায়। প্লেন ওড়ার আওয়াজ তাকে ছাপিয়ে উঠে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় —–

২. Scene signature tune

৩. কাগজের ওপর পেন বা পেনসিল দিয়ে লেখার আওয়াজ । খুব দ্রুত নয়, ধীরে ধীরে কেউ কিছু লিখছে

৪. চাবি দিয়ে দরজা খোলার আওয়াজ , তারপর দরজা বন্ধ হয়

ঋতু (একটু দূর থেকে) মামনি – আই অ্যাম হোম –  কি ? এখানে বসে কি করছো?
অদিতি এই আর কি, লিস্ট গুলো দেখে রাখছি।
ঋতু কিসের লিস্ট?
অদিতি মুন্নির মুখেভাতের নেমন্তন্ন ! পার্থর করা লিস্ট টা দেখলাম… অনেক নাম নেই ওতে, তাই যোগ করে দিচ্ছি।
ঋতু সেকি ? কার নাম নেই ?
অদিতি এইতো , পার্থর সেজকাকার নাতি পল্টু আর ওর বৌ সুপ্রীতি , তারপর ধর মেজমাসীর ভাসুরপো সমীরদা – তার ছেলে দেবলু  , পলিদির মেয়ে-জামাই মঞ্জুলা আর ম্যাথিউ …
ঋতু এঁদের সবাইকে ডাকার কথা তো কিছু জানিনা। পার্থ তো কিছু বলেনি।
অদিতি আরে সে কি কোনদিন নেমন্তন্ন-বাড়ির কাজকর্ম কিছু করেছে যে জানবে? ভাগ্যিস আমরা এসে পড়েছি। না হলে আদ্ধেক লোকজনই বাদ পড়ে যেতো। সানির বেলা তো এদেশে কিছু করা হয়নি। এবার মুন্নির বেলা যখন হচ্ছে, তখন এদের তো বলতেই হয় বৌমনি।
ঋতু ( কিন্তু কিন্তু অথচ দৃঢ় গলায় ) মামনি , এখানে কিন্তু ওভাবে সবাইকে ঢেলে বলা হয় না। তোমার ঘনিষ্ঠ দুচারজনকে অ্যাড করতে চাও , নিশ্চয়ই করো। কিন্তু এদেশে যে যেখানে আছে সবাইকে ডাকাটা কিন্তু মুশকিল।
অদিতি কিন্তু আত্মীয় স্বজনকে না জানালে তারা কিছু মনে করে যদি  …
ঋতু না , এখানে কেউ কিছু মনে করে না। বরং বললেই প্রবলেম। কাউকে ডাকলে, অ্যাটেণ্ড করতে পারুক না পারুক,  তারও তো একটা ওবলিগেশন চলে আসে, ভবিষ্যতে আমাদের নেমন্তন্ন করার। দূরত্বের একটা ব্যাপার আছে। বাড়িতে না কুলোলে ভেনু হায়ার করতে হবে, তার ঝামেলা আছে। ঐ গণ-নেমন্তন্ন ব্যাপারটা এদেশের লাইফ-স্টাইলে ঠিক ওয়ার্ক-আঊট করে না মামনি।
অদিতি তাই ? আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ইস , পার্থর লিস্টটা কাটাকুটি   করলাম।
ঋতু এটা রাফ লিস্ট। তুমি যা করেছো, রেখে দাও। আমি পরে ল্যাপটপে মাস্টারটা দেখে নিয়ে একটা ফাইনাল করে দেবো।
অদিতি ( একটু অসুখী ভাবে)  আচ্ছা, তাই কোরো
১. Sound

২. Sound

৩. Sound

১. Scene signature tune

২. Sound in the kitchen – utensils being organised

৩. Footsteps down the stair

ঋতু মামনি , আমি বেরোচ্ছি। চাইল্ড-মাইণ্ডার এসে গেছে । মুন্নির কাছে আছে ।
অদিতি ঠিক আছে বৌমনি । সাবধানে যেও
ঋতু তুমি রান্নাঘরে নাকি ? কি করছো ? একি ? ফ্রিজের সব কিছু বাইরে রাখা কেন ?
অদিতি মুন্নির মুখেভাত তো এসে গেল। আর দুদিন মাত্র। তাই একটু দেখে নিচ্ছি কি রান্না হবে না হবে ।
ঋতু তার জন্য তোমাকে রান্না করতে হবে কেন? খাবার এর অর্ডার তো দেওয়া হয়ে গেছে
অদিতি ওমা , বাইরে অর্ডার দেবে কেন? আমি আছি না ! বাড়িতেই করে ফেলবো। লোক তো বেশী না
ঋতু দূর , কি বলছ ? খামোখা এতো খাটবে কেন?
অদিতি খাটনির কি আছে ? এখানে এতো ইজি সব কিছু করা। দেখোনা কি করি। দুপুরে নারকেল কোরা দিয়ে মুগের ডাল, বেগুনভর্তা আর সর্ষে-ইলিশ । আর সন্ধ্যেবেলা পরোটা আর ল্যাম্ব-দোপেঁয়াজি। কেমন ভালো হবে না ?
ঋতু উফ মামনি। তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না । তুমি আমাকে একবার বলবে তো !
অদিতি বলতাম তো। বলবার আগে শুধু দেখে নিচ্ছি কি কি করা যায়।
ঋতু এসব খাবেটা কে ? অর্দ্ধেক লোকের তো অসুখ বিসুখ , নানারকম রেস্ট্রিকশন. তার ওপর কারুর হেলদি ডায়েট, কারুর অ্যালার্জি , কেউ ভেগান। বাইরের খাবার ছাড়া ম্যানেজ করা যায় নাকি ? তুমি ওসব ফ্রিজে তুলে রাখো। আর শোনো মামনি – এখন থেকে – আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনো ব্যবস্থা কোরোনা। প্লীজ।
অদিতি ( একটু অপ্রতিভ , হতাশ ) সেকি বৌমনি । লোকজন আসছে, আমরা রয়েছি, একটু দু-চার পদ না করলে কি চলে ? বাইরের খাবার দেওয়াটা কি ভালো দেখাবে ?
ঋতু ( একটু শক্ত গলায়) মামনি – এটা তো তোমার চেনা বেলেঘাটা নয়। এদেশের হালচাল তুমি জাননা। এখানে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ,  সেটা না হয় আমাকেই বুঝতে দাও। এসব চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও, খাওয়া দাওয়া করে একটু ঘুরে এসো পার্কে। পারলে জিনিষগুলো ফ্রিজে তুলে একটু কিচেনটা ক্লিন করে রেখো বরং , কেমন ? আমি এলাম। দেরি হয়ে যাবে — বাইইই
১. Sound

২. Sound

৩. Sound

৪. Sound

১. Footsteps going away

২. Scene signature tune

৩. Aircraft landing

৪. Telephone ring (normal)

রিয়া হ্যালো
অদিতি কি রিয়া । কেমন আছো  ?
রিয়া ওমা , ফিরে এসেছ নাকি ? কবে ?
অদিতি এই তো, তিন দিন হল।  ছাড়তে কি চায় ? কিন্তু মন বসে না গো। এখানে ঘর সংসার সব পড়ে রয়েছে ……
রিয়া আমি তো ভাবলাম তোমার এখন বিদেশে সংসার , ছেলে, বৌ, নাতি, নাতনি, আমাদের কি আর মনে থাকবে ?
অদিতি ওমা তাই কখনো হয় ? আমরা হলাম বেয়ান। আমাদের সুখ – দুঃখ আমরা যেমন বুঝবো, আর কেউ কি বুঝবে?
রিয়া তাও – অমন সুখের ডেরা ছেড়ে আবার ঐ ফ্ল্যাটের জীবন , ভালো লাগবে ?
অদিতি ( হেসে ) দেখলাম তো অনেক। আমাদের এই ভালো – এটা সার বুঝে গেছি। এসোনা গো একদিন, কত কথা জমে আছে। তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলবো, কেই বা বুঝবে।
রিয়া ( হেসে ) কথা জমেছে বুঝি ? বেশ , তাহলে তো আসতেই হবে।
অদিতি এসো এসো, চলে এসো। কবে আসবে বলো ।
ঋতু জমিয়ে রাখ সব কথা … কাল এসে শুনব। আর রান্না কোর কিছু ভালো মন্দ। খাওয়া দাওয়া সেরে আসবো একেবারে ।

 

 

অদিতি ( গলায় আনন্দ ) সকাল সকাল চলে এসো , অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু । লাস্ট মোমেন্ট-এ ক্যান্সেল কোরোনা যেন।
ঋতু ( খোলা হাসি) । ক্ষেপেছ ? বেয়ানকে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করব?  আমার ঘাড়ে কটা মাথা ? কাল দেখা হবে। সারাদিন গ্যাঁজাব কেমন ? বেয়ানে বেয়ানে …
Sound Melody – scene signature tune

সমাপ্ত

অংশুমালী প্রকাশকের নোট: 

মূল গল্প নবকুমার বসু, শ্রুতিনাট্যরুপান্তর – নন্দন সেনগুপ্ত। প্রথম অভিনয় আর আবহ সংক্রান্ত ক্রেডিট লাইন ভূমিকাতে রয়েছে। এই নাটক কেউ অভিনয় করলে গল্পকার, নাট্যরূপকার ও অংশুমালীর নাম অনুগ্রহ করে স্বীকার করবেন। 

নন্দন সেনগুপ্ত। লেখক ও নাট্যকার। জন্ম কলকাতায়, কর্মজীবনের অনেকটা কলকাতায় কাটিয়ে তারপর দিল্লি হয়ে বর্তমানে ইংলন্ডের কেমব্রিজের বাসিন্দা। লেখালেখি শুরু কলেজে। অনিয়মিতভাবে লেখার অভ্যেস বজায় আছে এখনও। কিছু লেখা প্রকাশ হয়েছে – মনোরমা পত্রিকায়, পরবাস ইন্টারনেট ম্যাগাজিনে, আনন্দবাজার আন্তর্জাল সংস্করণে।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ