প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
‘হট…হট…হট… খানকির বাইচ্চা! এক্কেবারে বাইর কইরা দিমু বাড়িরতন…।’ এক মালসা আগুন নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ তছিরণ জবুথবু হয়ে বসেছিল গোয়ালে। ফিকে হতে হতে ঘুম এখন আসতেই চায় না। বিছানায় শুয়েও ঘোলা চোখে অন্ধকারে চেয়ে থাকতে হয় অনেক বছর ধরে। বয়সের ভারের চেয়ে স্মৃতিরা ভিমরুল হয়ে হুল ফোটাতে থাকে তার বিধ্বস্ত শরীর-মনে। তবু গেড়েবসা অভ্যাস তাকে আজানের আগেই টেনে তোলে। প্রয়োজন তাকে ওভাবেই তৈরী করেছে। জীবনের একবিন্দু সময়ও যেন আলস্যে না কাটে, নিজের হাতে কাজ যেন তছিরণ খুঁজে বের করে। বড়ির কুকুরের খাবারটিও ঠিক জায়গায়, ঠিক পাত্রে রাখতে এখনো ভুল করে না। পোষা কুকুরের প্রতি তার এই যত্নপূর্ণ আচরণ কুকুরটিকে মানুষের ঢিল, গুঁতো খাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। তছিরণের জন্য সবার চোখে তাদের কুকুরটিও ওই সংসারের একজন গণ্য সদস্য। অতএব ভাড়াটিয়া পরশীদের সমীহ কুকুরও পায়।
শরীর নিঃসাড় হয়ে আসার আগ পর্যন্ত লালি নামের গাভীর এক বছরের সারা শরীর হাতড়ে পোকা বাছে তছিরণ। তারপর তাকে হাতের আন্দাজে উকুনের মতো দু’নখে টিপে মারে। নিজের নাতিপুতি হয় না। বারো বছর হতে চলল একমাত্র সন্তান জামশেদের বিয়ে হয়েছে। তবু এ নিয়ে তাকে কখনো আক্ষেপ করতে শোনা যায় নি। কেউ উস্কানিমূলক কিছু বললে, তছিরণ খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দেয় ‘খোদার ওপর কারু আত আছে?’
এই গোয়ালে জন্ম নেওয়া লালি চতুর্থবারের মতো আবার পোয়াতি হয়েছে। এতেই তছিরণ আহ্লাদিত। কিন্তু ছেলের কুঁদানি শুনে গায়ের জড়ানো আধ ময়লা কাঁথাটা ঝেড়ে ফেলে, প্রায় উবু হয়ে চার হাত-পা একত্র করে উটের মতো হেঁটে গেল গেটের কাছে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বউকে মারমুখী ছেলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে, একহাতে নিজের বুকের কাপড় আগলে, অন্য হাতে এলোপাতাড়ি দুর্বল ক’ঘা জামশেদের বুকেপিঠে মেরে ঘুম ভেঙে উঠে আসা ক’জনকে হতবাক করে দিল তছিরণ। তারপর ভাঙা ভাঙা গর্জনে বর্ষে যেতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে-গোলামের পুত, বউয়ের যে খানকির বাইচ্চা কইলি? তর মায় খানকি না অইয়া তরে প্যাডে নিছিল কেমনে লো গোলামের পুত! গাইল দিতি আর কোনো বাষা পাইলি না লো গোলামের পুত! শাশুড়িরে জামাই ক্যামনে খানকি কয়? মায়ের ধমকধামকে চুপসে খালি ঠোঙা হয়ে গেল পঁয়তাত্রিশের জামশেদ আলী। আশপাশে মানুষের চোখে তার কত সম্মান! এই বয়সে পাঁচ, পাঁচখানা ট্রাকের মালিক সে। জামশেদ আলীর অতীত তার বর্তমান পরিচিত সমাজে কৌতুহলের উদ্রেক করলেও তাকে নিয়ে তামাশা করার স্পর্ধা কারও হয় না; বরং ছোট থেকে বড় হওয়ার মূলমন্ত্র তার নিষ্ঠাকে সবাই সমীহ করে চলে। তা ছাড়া জামশেদ আলী স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী। তাঁর গলা কখনো কেউ উঁচুতে চড়তে শোনে নি। মেজাজ বিগড়াতে দেখে নি; বরং মা তছিরণ তার ঠিক উল্টো। কলতলায় একটু পানি গড়ালেও বাড়ি মাথায় তোলে। বাড়ির ভেতর কারও সামান্য ঝগড়ার গন্ধ পেলে, ন্যায়-অন্যায়ের বিহিত করতে তছিরণ বোঁচা নাকটি তখনই আগ বাড়িয়ে গলায়। তার নাকের ঝাঁঝে বিশ ঘর ভাড়াটিয়ার পুরো বাড়ি স্তব্ধ। কিন্তু গায়ের ঝালে কেউ কেউ বলে ওঠে-বুড়ির স্বাভাব গেল না। আসলে বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে যার দিন গেছে। তা ছাড়া জোয়ানকালে জামাই মরছে। আরেকটা হাঙ্গা বইয়াও ছাড়তে অইলো। তাই শইল্যের ত্যাজ সবটুক জমা রইয়া গ্যাছে। অহনো সাঙাত দরকার…।
ছেলেকে ঠেলে গেটের বাইরে বের করে নড়বড়ে খিলটা বুড়ি জোরসে লাগিয়ে দিল। অনেকগুলো চোখের পর্দার সামনে নাটকের অবতারণা শেষ হওয়ার পর যেন মঞ্চটি অন্ধকারে তলিয়ে গেল। অথচ ভেতর বাড়িতে ষাট পাওয়ারের বাল্বটি জ¦লছে। ঘরের আলোও দ্বিগুণ করা হলো আরেকটি বাল্ব জ্বালিয়ে। তছিরণ আলগোছে, মৃদু পায়ে প্রায় লম্বা বউটির কোমর হাতে পেঁচিয়ে টিমটিম করে হাঁটতে লাগল। নিজের মুখখানা বউয়ের মুখের অনেক নিচে পড়ে থাকলেও যেন সেই ভারবাহী হয়ে হিঁচড়ে ঘরে টেনে এনেছে, এমনভাবে বিছানায় তুলল হাসনাকে। হাসনা গুছিয়ে বসলে সম্ভাব্য আশঙ্কায় চোখ কুঁচকে তছিরণ তার কপালে আভাসটা লক্ষ করল। বিষয়টি ছেলেমেয়ে না হওয়ার দোষের কিছু কি না। কারণ কান কথায় ভার করার মানুষের তো অভাব নেই। তছিরণ আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল,রাইত য্যান কয়ড়া বাজে…।
কিছুক্ষণ ক্ষ্যান্ত থেকে আবার শুরু করলো, গোলামের পুত কাজডা করল কী? কাইল সকালে এত্তোগুলান বাড়াইট্টার সামনে আমার এই বউডা ক্যামনে মুখ দ্যাহাইবো? মাইনষে কইব, সাতটা না পাঁচটা না, একটামাত্র পুত, হেইডারেই বেডি মানুষ বানাইতে পারল না! আরে বউয়েরে কিছু কওনের থাকলে তারে গরে রাইখ্যা ক…। থাউক বউ তুমি মন খারাপ কইরো না। এ্যার শাস্তি না অওন পর্যন্ত অরে আমি বাড়ি ডুকবার দিমু বাবছো? অইতে পারে অর পাঁচখান ট্রাক আছে। কিন্তু এই বাড়ির জমিনটুক আমার, বুজলা? মাইনষের গরের মাডির দেয়াল গাঁইথা তয় টেকা জমাইছি। এইডা অহন না মফস্বল শহর অইছে। বাড়ি বাড়ি বিল্ডিং উঠছে। আগে তো আন্দার গ্রাম আছিলো। সব মাটির গর আছিলো। তুমি আইয়াই তো আমাগো মাটির গর পাইছো। …তোমার ঝি-পুত না অইলে এটুক আমি তোমার নামে লেইখ্যা দিমু। আর অইলে তো সবই পাইলা!
হাসনার মুখে কথা নেই। সে স্বামী জামশেদের চেয়েও স্বল্পভাষী। তারপর আবার মেট্রিক পাস। রূপে কিছুটা কটু হলেও গুণে সবাই তার প্রতি মুগ্ধ। আর জামশেদের সঙ্গে হাসনার সম্পর্ক বরাবরই দেখত স্বাভাবিক। তাদের ঝগড়াঝাটি যেমন কারও নজরে পড়ে নি, সারিবদ্ধ ঘরের প্রায় বিশটি ভাড়াটিয়ার প্রতিটি পরিবারের নুন, মরিচ, পেঁয়াজ ঘাটতির মতো ঠুনকো প্রয়োজনেও বাড়ির ভেতর মহল শিশু ও মহিলাদের ধারকর্জের জন্য ঢোকা অবাধ। তবু কেউ তাদের হাসনাবানু ও জামশেদ আলীর কোনো অন্তরঙ্গ দৃশ্য নিঃসন্তান এই একযুগেও দেখার অবকাশ পায় নি। আবার মুখপোড়া বেগুনের মতোও মুখের দশা করে রাখে না তারা, যা নিয়ে অন্যমানুষের আড়ালে আবডালে একটু ঠাট্টা-মশকরা, তিরস্কার চলতে পারে।
তছিরণ আচমকা ঘাবড়েই গেছে। না হলে ও পালঙ্কে উঠে শুতো না। তুলতুলে বিছানায় ঘুম আসে না তছিরণের। পাশে শোয়া হাসনার কণ্ঠ বোজা। সে কোনো কথা বলছে না। জামশেদ গেটের ওপাশে কী করছে। বাইরে ফিনফিনে কুয়াশা। বেশ শীতভাব। জামশেদের গায়ে শুধু একটা স্যা-ো গেঞ্জি। একটা সরু কাঠি দিয়ে গেটের খিলটা বাইরে থেকে তুলে ফেলে যে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু জামশেদ ঢুকবে না এটা হাসনা জানে। মায়ের লাগানো খিল খোলার সাহস জামশেদ আলী আজও অর্জন করে নি।
বাড়িতে কেউ ঢুকতে হলে আগে তছিরণ গিয়ে দাঁড়ায়। দিনভর ড্রাইভার, হেলপার ক’জন যখন-তখন আসা-যাওয়া করে; ট্রাকের যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়া করে। কিন্তু তছিরণ প্রতিবার তাদের মুখে ফেনা বের করে ছাড়ে কৈফিয়ত চেয়ে। তছিরণের তথা তাচ্ছিল্য করে একটা জিনিস বের করে নেয়, এমন সাহস সাত টনি ট্রাকের এক নম্বর ড্রাইভার আনসার আলীরও নেই।
একদিন জামশেদ আলী মা’কে হেসে হেসে বলছিল, তুই তো মা তোর পুতের লাইগা সবতেরেই যম ভাবস। ছানার মতো আঁচলের নিচে অহনো ঢাইক্কা রাখবার চাস আমারে। কিন্তু তুই কী করসছ, তুই নিজেই জানন না।
কী আবার করলাম, বলে সিঁটিয়ে থাকে তছিরণ।
না, যা, কিছু করস নাই, তরে মাফ করন যায়!
না কইলে আবারো যদি সেইডা করি, তাইলে কি বালো অইবো, কয়বার মাফ করবি?
সেইডাও ঠিক। শোন মা, সেদিন যে তুই কটকটিওয়ালাগোর কাছে সেরদরে লোহালক্কড় বেচলি, ওগুলা বাতিল আছিল না। বাতিলগুলো রইয়া গেছে। লাখ টেকার জিনিস দিয়া দিছোস তুই…।
হায়রে পুত এই ডাইনির মতো কাজটা আমি করলাম? চোউকখের মাথা খাইছি পুত। অহন আঁটতে গ্যালেও উস্টা খাই। বয়স জানি কত অইছে আমার, ষাইট অইবো না?
হঅ, তর মায় তরে জন্ম দেওনের সময় আমারে না কছে বওয়াইয়া রাখছিল, তর জন্ম তারিখ মনে রাহনের লাইগা?
এই জীবনের লাইগা তওবা করলাম, আর আমি কিছু বেচতাম না। আমি তো বাবছি ওগুলা পইড়া আর্বজনা অইয়া আছে। এহনতন বাতিল জিনিসগুলা বউরে বুজাইয়া দিস।
বউয়েরে বুঝাইয়া দিলে তর তো আবার বুহে ঠাডা পড়বো। তুই তো সবঐ চাস নিজে আগলাইয়া রাখতে।
ক্যান যে চাই, সেইডা আমি বইচ্চা থাকতে তুই বুজতি না। এর লাইগা ইচ্ছা করে, কইদিন পলাইয়া থাইক্কা দেহি, তুই কেমনে চলোস। এমনে পলাইলে তো খুঁজতি না। বুইড়া অইয়া গেছি। বুইড়া মাইনষেরে কে খোঁজে? তয় একবার আমার ইচ্ছা আছে, যেইদিকে দুই চোউখ যায়, যামুগিয়া।
যা গিয়া। আমার ওপর তুই এহনো পাত্থরের মতো শাসন চাপাস। মাজে মাজে অসহ্য করোস তুই মা…।
যামু মানে? তুই কি ভাবছোস আমি একলা যামু? আরে আমি জানি, আমি একলা গেলে কেউ আমারে খুঁজব না। তাই তো অপেক্ষা করতাছি, তর একটা পোলাপাইন অউক আগে। অইলে তারে কোলে লইয়া যামু…।
মা আর ছেলের এতটা সহজ সম্পর্কে বউ হাসনাবানু যেন ওদের দুজনের কাছেই বেশ ভার। মা-ছেলের এই সমান সমান তুই-তোকারি, শাসনের ধরন, প্রশ্রয়, সবকিছুতে হাসনার প্রথমুদিকে বেশ অস্বস্তি হতো। এখনো তাদের মাঝখানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না সে। এখনো তাকে নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়ার ভূমিকাটিই বরং তখন তৎপর হয়ে খুঁজে বের করতে হয়। বউকে রান্নাবান্নার আয়োজন করতে না দেখলে, শাশুড়ি নিজেই সময় আন্দাজ করে আনাজপাতি গোছাতে শুরু করে দেয়। বউ ছুটে আসে কেড়ে নিলে তছিরণ বলে, ‘আমি বাবলাম, তোমার বুজি শইলডা বালা না।’
তছিরণ বিধবা হওয়ার ক’দিন পর থেকেই আর ঘরে বসে পেট চলছিল না। তখন বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ নিতে হলো তাকে। পাঁচ টাকা পুজি জমিয়ে একদিন জামশেদের গলায় গামছা দিয়ে বেঁধে দিতে হয়েছিল একঝুড়ি বাদাম। আজতক কাহিনির শুরুটা ঠিক এমন ছিল। তছিরণ এই কথা নিজেই চাউর করে। যে দুঃসহ দিন সে পার করে এসেছে। তাকে আর কে কী বিপদের ভয় দেখাতে পারে! একটা সূক্ষ্ম মারমুখী ভাব নিয়ে তাই নিজের জীবনবৃত্তান্ত সবার মগজে আরোপ করে রাখা।
জামশেদের বাবা মারা যাওয়ার পর তছিরণের আবার বিয়ে হয়েছিল। সে বিয়েতে স্বামীর ভাত-কাপড়ের দায় গ্রহণের ভার ছিল না। ছিল শুধু কলঙ্ক এড়াবার প্রয়োজন। যৌবনের একজন অভিভাবক। ব্যাস। নিজের খুব একটা মত ছিল না তছিরণের। কিন্তু কখন কে অপবাদ দিয়ে বংশের মুখে কালি লেপে। দু’মুঠো ভাত যারা মা-বেটার পাতে পাতে দিতে পারে নি, বাইশ বছরের যুবতী তছিরণ তার পাঁচ বছরের শিশু জামশেদকে নিয়ে আগল টপকে কাজে নেমে গেলে, তখন তারাই বিধবা ভাবি- বোনের ইজ্জতের দাবিদার হয়ে একজনকে জোগাড় করে এনেছিল চেষ্টা-তদ্বিরে। দুজনের পেট পালতে নাভিশ^াস ওঠে তছিরণের। আর সেই ধকল, যেন বেলা শেষে দিনের গল্পের মতো তছিরণ আজও জুড়ে বসে পরম্পরা ছাড়া। ‘… তারপরও ব্যাটায় আইলে আর যাইতে চাইত না। খালি বালো-মন্দ খাওনের বায়না। যাওনের সময় নতুন তবন দেও। পাঞ্জাবি দেও। গ্রামের মানুষ কইবো কী? কিছু যদি না-ই পাইলা, তয় বিধবা বিয়া কইরা কী লাভ?’ এই কথা শোনারতন মরণ বালা আছিল আমার। তাই সাহস কইরা কইয়া ফেললাম-তয় বিয়া না কইরা কারও ঢেমনা সাইজ্জা থাকতেন।
ব্যাডাই আশ্চর্য অইয়া জানতে চাইল, ঢেমনা আবার কী?
কইলাম-পাড়ার মাগিরা তো রাইত-দিন সমানে পয়সা লইয়া ব্যাডাগো লগে শোয়। তারপরও তাগো ইচ্ছা করে, বিনা পয়সায় তাগোরে কেউ একটু সোহাগ করুক। নিজে আতে তুইল্লা ব্যাডার মুখে পুইরা নলা তুইল্লা খাওয়াইতেও তাগো ইচ্ছা করে। আঁচল দিয়া মুখ মোছাইয়া দিতে ইচ্ছা করে। কিছু বখশিস দিতেও ইচ্ছা করে। আর এই ইচ্ছার বলি যে ব্যাডা অয়, হেই ব্যাডারেই কয় ঢেমনা…। আমার এই কথা কথা শুইন্যা আমার সেই ব্যাডায় চোখ কট্টর কইরা তাকাইলো আমার দিকে। তয় আস্তে আস্তে আবার চাউনি নরম আইলো। বেডায় বালা মাইনষের মতো কাটাইতো কয়দিন। এক একবার মনে অইতো আর যাইবো না। কিন্তু যাওনের লাইগাই তো আইতো!
একবার ফিইরা আইতে অনেক দেরি করলে কইলাম-এতদিন দেরি করছেন ক্যান? তহন কইলো-আমার বড় বউয়ে কয়, আমি যা কামাই করি, বেবাক বলে তোমাকে দিইয়া ফেলি। এইবার পলাইয়া আইছি।
জমশেদ এট্টু বড় অইল, যহন এট্টু রোজগারপাতি করতে লাগল, আমারও একটু বুদ্ধি খুলতে লাগল। মনে অইতে লাগল সাহস বাড়তাছে আমার। ভাইগো লগে, জামশেদের চাচাগো লগে মোকাবেলা অইতে পারুম। তাই ভাবতে লাগলাম, ভাত-কাপড়ের শর্তে মাইয়ামানুষ কোনো ব্যাডার লগে তার শরীর লইয়া বিয়া নামের চুক্তি করলে করুক। ঘুইরা-ফিরা বিয়ার কারণ তো সেইডাই। কিন্তু যেই ব্যাডা আমারে ভাত-কাপড় দিবো না, তার লাইগা আমার নিজেরে সতীলক্ষ্মী সাজাইয়া রাহন লাগবো? বরং তার লগে শোওনডাই আমার দিনে দিনে ঘেন্নার কাম অইয়া উঠলো। হ্যায় থাকন মানেই আমার শরীলডা সারাক্ষণ আমার মনে রাখন। নইলে শইল ক্যান, তহন তো আত্মার কথাও মনে থাহনের কথা আছিলো না আমার।
তছিরণকে ঘিরে থাকা কজনের কারোই এতো সাহস নেই, যে তছিরণ একটু থেমে গেলে কেউ একজন প্রশ্ন করে, তারপর? অথবা জরুরি কাজ থাকলেও কেউ সেখান থেকে উঠে চলে যায়। ঢলঢলে ঝুলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুঁজে কিছু খুচরো পয়সা তুলে আনতে যেটুকু সময় লাগে, তারচেয়ে কম সময়ে তছিরণ আবার শুরু করে ‘…একদিন আমি ব্যাডারে কইলাম, শোনেন, এইবার আপনি আমারে তালাক দেন। নইলে আপনের বউ যেমুন কয়, আপনি আমারে সব দিইয়া ফ্যালেন। তেমনি আমার পোলাও তো বড় অইতাছে। কোনোদিন কইবো, আমার মা তার জামাইয়েরে সব দিইয়া ফ্যালে। কইতে কইতে ব্যাটায় একদিন আমার ওপর ফুঁইসা উঠল। গায়ে আতও তোলা শুরু করলো। শ্যাষে আমি একদিন জামশেদের আতে মু-র তুইল্লা দিলাম। কইলাম, এই সীমানায় পাড়া দিলে ওয়ারে ছাতু বানাইয়া দিবি। দূর থেইক্কা ওই মু-ুর দেইখ্যাই আর আহে নাই। কতদিন পরে অচেনা একজনে একখান কাগজ লইয়া আইয়া কইলো ‘তালাকনামা’। মেলা দেরি কইরা বুঝলাম, কলমার চাইয়া মু-রের জোর বেশি।’
কৌতুহলে জটলা পাকিয়ে, চোখ উদগ্র করে বসে থাকা বিভিন্ন বয়সী মানুষের মধ্যে শাশুড়ির এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে হাসনা বানুর খুব অস্বস্তি হয়। টানটান উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও শ্রোতাদের কেউ ভয়ে প্রশ্নও করতে পারে না। কেমন সিটানোভাব থাকে সবার। কারণ প্রশ্নকারীর ওপরই হয়তো বিস্মৃত হয়ে আসা প্রতিপক্ষের ঝাল দিয়ে পড়বে। এরকম হয়েছেও ক’বার। হাসনাবানুর কান পর্যন্ত যেটুকু এসে পৌঁছে তাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর বারো বছর স্বামী জামশেদের স্ত্রীত্ব বরণ করেও স্বামীকে ভালোবাসতে না পারা। বত্রিশ পার হতে চলল বয়স। এখনো মা হতে পারল না। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে, সে মনোবৃত্তি তার হয় না।
যে মানুষ নিরীহ মানুষ দিয়ে সরকারি জিনিস চুরি করায়। তারপর তাদের বখশিশের নামে নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে। ক’দিন আগে টঙ্গী জংশনের কাছে রেললাইনের নিচে দেয়ার জন্য রাখা বিশাল কাঠ চুরি করতে যাকে পাঠিয়েছে, সে ধরা পড়েও নেপথ্যে থাকা জামশেদের নামটি প্রকাশ করে নি। কিন্তু মনিবের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য লোক মারফত সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। জামশেদ তার দাবি হেসে উড়িয়েছে। বলেছে, কোনো অসৎ মানুষের জন্য তার কোনো দয়া নেই। পরিশ্রমী, ধার্মিকদের জন্য আছে। প্রয়োজনে নুলো, ভিখিরিদের দান খয়রাত করবে। কিন্তু চোরের জেলে পচে মরা উচিত।
হাসনা এই প্রথম ফুঁসে ওঠে ‘বদররে ছাড়াইয়া আনো। ওর বউ ছেলেমেয়ে কান্নাকাটি করতাছে। আর বিষয়ডা আমার মনে চাপ দইরা আছে। আমি পাগল হইয়া যামু…।’ জামশেদ জানে, পোষ্টঅফিসের মাছি মারা প্রাক্তন কেরানি শ^শুরের ঘরে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে আছে আরও দুটি মেয়ে। শ^শুর নিজে বড় বড় কথা বললেও, তার বড় ছেলে দুটির কামাই-রোজগার ভালো না। অতএব হাসনাবানুর যাওয়া অত সোজা না! আর গেলেই কী? যাক না? যা! যা ! যা! শুনতে শুনতে হাসনা বিছানা ছেড়ে নিচে নামে। বলে, এইসব কা- তোমার মায়ের কাছে কইয়া দিমু। হ্যায় তো জানে পোলা তার কত্তো বালা! এই বালোডা হ্যায় জাইন্না মরুক। মায়ের কথা বলায় জামশেদ এই প্রথম হাসনাকে আক্রমণ করে।
তছিরণ সেদিনের পর থেকে বউকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার ধারণা ছেলেমেয়ে হয় না বলেই ঝঞ্ঝাটের শুরু হয়েছে। অতএব সে মরে গেলে ঘরের অশান্তি সামলাবে কে? ছেলেকে ধমকে বলেছে, বউরে লইয়া ডাক্তারের কাছে যা। তুই নিজেও চিকিৎসা ল!ম্যাগে ম্যাগে ব্যালা তো কম অইলো না। অহনো পোলাপান না অইলে, বুইড়া বয়সে অইলে মানুষ করবি কবে?
আমার আবার কী চিকিৎসা? তর বউয়েরে লইয়া যা!
লইয়া যামু মানে? আমি তো চিনি খালি সরকারি হাসপাতাল! এইহানে তো ব্যাডারা শুধু বেতন লওনের লাইগা বহে। চিকিৎসা করনের লইগা তো তাগো ঝকমইক্যা আলাদা জায়গা বানানো আছে। যেহানে মানুষের আত খুইল্লা টেকা রাইহা দেয়।
আইচ্ছা মা, তুই টেকা লইয়াই যা।
দোষডা কার, না জাইন্না আমি পরের মাইয়ারে একলা লইয়া টানাহেঁচড়া করতে পারুম না।
মাইয়া মাইনষেরে ইন্দুর-বিলাইয়েরতন দামডা কেডা বেশি দেয়। সে ডাক্তারই কী, আর গরের ব্যাডাই কী? তুই নিজে খোঁজ খবর লইয়া খরচ কইরা বালা ডাক্তার দেহা।
হ্যায় যাইবোনি, আগে জিগা!
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..