নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের অন্দরমহলে

মলয় সরকার
ভ্রমণ
Bengali
নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের অন্দরমহলে

হঠাৎ করে ঠিক হওয়া প্ল্যানে এয়ার ইণ্ডিয়ার যান্ত্রিক পাখীর পেটে ডিমের মত চুপচাপ থেকে, যখন  বাইরে বেরোলাম তখন সত্যিই আমার নতুন শাবকের পৃথিবীর আলো দেখার মত অবস্থা। মন তখন ছটফট করছে নতুনের জন্য।সেই তাসের দেশের ‘এলেম নতুন দেশে—’র মত অবস্থা।

নাগাল্যণ্ড আর মণিপুরের নাম শুনে এসেছি। সেই শিশুকাল থেকে শুনে এসেছি, মহাভারতের গল্পে, যেখানে অর্জুন বিয়ে করে এসেছিলেন কিন্তু সংগে আনেন নি দুই রাজকন্যা কে, একজন নাগ রাজকন্যা উলুপী আর অন্য জন মণিপুর রাজনন্দিনী চিত্রাংগদা।দ্বিতীয় জন পরবর্তী কালে আমার অনেক নিকট পরিচিত জন কবিগুরুর হাত ধরে। তাই এনাদের জন্মভূমি সম্বন্ধে আমার জানার আকুতি অনেক দিনের।

সেই উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ডিমাপুরের মাটি ছুঁলাম উড়ন্ত পাখীর পেট থেকে।তখন বেলা প্রায় একটা। আকাশে চকচকে রোদ। ছোট্ট এয়ার পোর্টে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতেই  গাছে ছাওয়া অটো স্ট্যাণ্ডের চালকের দল ঘিরে ধরল, কেউ বলে ডিমাপুর শহরে যাবে? কেউ বলে কোহিমা যাবে? দাম হাঁকে অস্বাভাবিক। আগেই শুনে এসেছিলাম, অটো তে ডিমাপুর রেল স্টেশন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ওখান থেকে প্রিপেড ট্যাক্সি বুথ অর্থাৎ ইউনিয়নের পরিচালিত বুথে টিকিট কেটে গাড়িতে ওঠাই ভাল, ঠকার ভয় থাকে না। আর এয়ার পোর্ট থেকে স্টেশন যেতে জনপ্রতি অটোতে লাগে ২৫-৩০ টাকা। যদিও সে দামে অটো পাচ্ছিলাম না, শেষে অবশ্য ২০০ টাকায় আমাদের চার জনের জন্য একটি অটোয় রফা হল। পরে বুঝলাম এই টাকাও কম হয়েছে। এয়ার পোর্ট থেকে শহরে ঢোকার ভি আই পি রোড (?) যে এমন তা জানা ছিল না। একেবারে ভাঙ্গাচোরা গর্ত ভরা ধূলি ধূসরিত অন্নপ্রাশনের ভাত ওঠানো রাস্তা। ভাবলাম এই রাস্তায় গাড়ী চলে কি করে বা শহরে ভি আই পি রা আসেন কি করে? তখনো জানিনা যে, টুরের ভাগ্য- দেবতা  আড়ালে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে নয়, হো হো করে হাসছেন আগামী সময়ের কথা ভেবে।

স্ট্যান্ডে দেখি প্রচুর বিভিন্ন ধরণের গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, অনেকেই কোহিমা যাবার জন্য বলছে।আমরা ব্যক্তিগত ভাবে প্রাইভেট গাড়ী নেওয়ার ঝামেলা এড়িয়ে নির্দিষ্ট বুথে গিয়ে জনপ্রতি ৩০০ টাকা দিয়ে কোহিমা যাওয়ার শেয়ারে গাড়ি নিলাম। গাড়ি আরও তিনজন যাত্রী নিয়ে ছাড়ল একটু পরেই।শহরের ভাঙ্গাচোরা রাস্তা অতিক্রম করছি আর মনে ভাবছি এর পরেই তো ন্যাশনাল হাইওয়ে আসবে, তখন নিশ্চয় ভাল রাস্তা আসবে।একটু পরেই  এলও তা, তবে ভাগ্যদেবতার হাসি আমার কাছে আরও প্রকট ভাবে মূর্তি ধরে দেখা দিল।আমাদের গাড়ী একেবারে চওড়া এক বিশাল চষা মাটির মাঠে পড়ল।বাস্তবে একেবারে ইংরাজীর Out of fry pan into the fire অবস্থা।   আমি ভাবছি এরকম তো হওয়ার কথা নয়। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম।সে বলল, এখানে এশিয়ান হাইওয়ে তৈরী হচ্ছে তো তাই সব রাস্তা খোঁড়া হয়েছে।পরে জানলাম, সারা এশিয়া জুড়ে যে বিশাল গ্রেট এশিয়ান হাইওয়ের কর্মযজ্ঞ চলছে, যার মধ্যে ৬টি হচ্ছে আমাদের ভারতবর্ষে তার মধ্যে এই হাইওয়ে টি এশিয়ান হাইওয়ে নং ১, যা মায়ানামারের সীমানা মোরে থেকে মনিপুর কোহিমা ডিমাপুর আসাম ছুঁয়ে মেঘালয়ের ডাউকি পর্যন্ত যাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতি আমাদের এই দুর্ভোগ।এই রাস্তার সুফল কখনো পাব কিনা জানি না, আমাদের ওপর তার কুফলটা তো এখন ভোগ করি।বাকী ভবিষ্যত বলবে। রাস্তার কিছুক্ষণ অন্তরই বিশাল বিশাল পাহাড় কাটা যন্ত্র অতিকায় ডাইনোসরের মত লম্বা লম্বা গলা বাড়িয়ে রয়েছে। কেউ মাটিতে ঘাস খাওয়ার ভঙ্গীতে, আবার কেউ যেন উদাস হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও দাঁড়িয়ে আছে আবার কোথাও বা কাজ করে চলেছে। বিশাল চার বা ছয় লেনের জায়গা করা হচ্ছে। সেই কাটা রাস্তার ওপর কোথাও কাদা, কোথাও গর্ত, কোথাও নিছক ধূলো।এবরো- খেবরো রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ী ধূলো ধূসরিত হয়ে আমাদেরও একই রংগে রাঙ্গিয়ে নাচাতে নাচাতে চলল  হেলে দুলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। মনে পড়ল কবিগুরুকে, “রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো আমায় রাঙিয়ে দিয়ে —” “ আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে–”।যাকে দেখছি চারপাশে, সবাই ধূলা ধূসরিত হয়ে একই অবস্থা। কাউকে যেন আর স্বমূর্তিতে চেনা যাচ্ছে না।আমাদের তখন কোমর খুলে যাবার অবস্থা। ড্রাইভারকে বললাম, আর কতদূর এরকম যেতে হবে ? ও নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল, শেষ পর্যন্ত।শুনে আঁতকে উঠলাম আমরা।সে কি! ড্রাইভার আবার নির্বিকারভাবে নিঃশব্দে  হাঁ- বাচক ঘাড় নাড়ল শুধু।আমরা হতাশ হয়ে ভাগ্যের হাতে এবং গাড়ির সীটের উপর নিজেদের ছেড়ে দিলাম।

আমি বুঝতে পারলাম না, এত বুদ্ধিমান মানুষের কর্মযজ্ঞ, ভাগে ভাগে, বা রাস্তাটা অর্ধেক করে না করে, গাড়ী যাতায়াতের ব্যবস্থা না রেখে একেবারে পুরো রাস্তাটা একসঙ্গে, ডিমাপুর থেকে কোহিমা পর্যন্ত খোঁড়ার কি প্রয়োজন ছিল।জানি না, আমি মূর্খ মানুষ, দুর্ভোগ ছাড়া আর আমাদের মত সাধারণ মানুষের কপালে কি ই বা থাকতে পারে !মনে পড়ল পাটনায় থাকা কালীন একটি ঘটনা।

তখন থাকি পাটনা শহরের বোরিং ক্যানাল রোড এলাকায়, বেশ সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষের বাস এখানে। একটি চওড়া রাস্তা কাঁচা ছিল। লোকে লেখালিখি করে তার পাকা করার বন্দোবস্ত করল। নির্দিষ্ট সময়ে রাস্তা সুন্দর পাকা হয়ে গেল। লোকে খুব খুশী। হঠাৎ কয়েকদিন পর লোকে দেখল,সকালবেলা একদল লোক গাঁইতি কোদাল নিয়ে তৈরী রাস্তা খুঁড়ে ফেলেছে। কি ব্যাপার! না, তলা দিয়ে জল নিকাশের ড্রেন যাবে। ড্রেন তৈরী হল। রাস্তা খোঁড়াই পড়ে রইল। লোকে খোঁজ নিয়ে জানতে গিয়ে দেখল, সবার চাহিদামত মিউনিসিপ্যালিটি রাস্তা ও ড্রেনের টেণ্ডার ডেকে দুটোই করে দিয়েছে। সরকারী খাতায় দুটোই আছে ,নতুন তৈরী। তাহলে কি হল ব্যাপারটা! না, দুটো কাজের টেণ্ডার দুজনকে দেওয়া হয়েছিল। যার কাজের টাকা আগে পাশ হয়েছে সে আগে শেষ করেছে। তার পর কি হবে সে দেখা তার কর্তব্য নয়। কাজেই রাস্তাওলা আগে রাস্তা করেছে। ড্রেন ওলা পরে ড্রেন করেছে। খাতা কলমে দুটোই কমপ্লিট। কিন্তু লোকের দুর্ভোগ যেমন ছিল তেমনই রইল। এ অভিজ্ঞতা শুধু পাটনা নয় কলকাতাতেও আমরা নিত্য দেখি। এখানেও কে জানে সেরকমই কাজ হচ্ছে কি না।

দূরে দেখছি রাস্তা থেকে দেখে উপভোগ করার জিনিষপত্র দৃশ্যাবলী ধীরে ধীরে পিছনে চলে যাচ্ছে, যদিও নির্ধারিত ৪০ কিমি গতিবেগের তুলনায় মাত্র ১৫ কিমি বেগে; কিন্তু সূর্যদেবের গতিবেগ তো আর কমছে না, তিনি তো নিজের বেগেই অস্তাচলের দিকে দৌড়োচ্ছেন। অবশ্য রাস্তার যা সুখকর যাত্রা(?) তাতে দৃশ্যাবলী উপভোগ করার মত অবস্থা কতটা ছিল, তাই চিন্তার কথা। কাজেই শীঘ্রই অন্ধকারের আগমনধ্বনি পেলাম। মাঝে দয়া করে বা নিজের প্রয়োজনে ড্রাইভার একবার থামাল রথ। বলল, চা খেয়ে নিন। একটা ছোট ঝোপড়ির সামনে- দেখে আর চা খেতে ইচ্ছা হল না। তবে গাড়ী থেকে নেমে হাত পা টা একটু ছাড়িয়ে নেবার সুযোগ পাওয়া গেল। সবাই নিজেদের দিকে তাকিয়ে হাসতে আরম্ভ করলাম, কারণ সবার চুল, খোলা জানালার ধূলো তে সাদা হয়ে গেছে। নাকে না হয় রুমাল দিলাম, কিন্তু বাকী – চুল,মুখ কি করব ! জানালা বন্ধ করেও থাকতে পারি না,  দম  বন্ধ হয়ে যাবে।

মাঝরাস্তায় ঘন কাদার মধ্যে একজায়গায় আবার গাড়ী থেমে গেল। এগিয়ে এল পাশের এক ঝোপড়ি থেকে এক নাগা পুলিশ।সে এসে গাড়ীর ভিতরে মুখ বাড়িয়ে আমাদের বাইরে ডাকল।বাকী যারা সহযাত্রী ছিল তারা স্থানীয়, কাজেই তারা ছাড় পেল। এখানে আই এল পি বা ইনার লাইন পারমিট দেখাতে হবে যা নাগাল্যাণ্ড ঢোকার ছাড়পত্র। এগুলি আমরা কোলকাতার নাগাল্যাণ্ড হাউস থেকেই করে এনে ছিলাম। দেখাতেও, তারা ঝোপড়ির ভেতরে ডাকল।ঝোপড়িতে কয়েকটি পুলিশ বসে আছে। ওটাই অফিস। ওখানে বলে, পাসপোর্ট আছে? আমরা তাও দেখালাম। পুলিশটি একটু হতাশ হল।ঝোপড়ির ভিতরের অফিসার কাগজপত্রে স্ট্যাম্প মেরে ফেরত দিল।তখন বাধ্য হয়ে আগের পুলিশটি পাশ থেকে বলে, পচাশ পচাশ করকে দে কে যাও। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, কোলকাতা অফিসেই তো দিয়ে এসেছি (১ টাকার ফর্ম আর জন প্রতি বিনা রসিদে ৫০ টাকা করে)। শুনে লোকটা আবার থমকে গেল। আর গজগজ করতে করতে শিকার ফসকে যাওয়ার জন্য রাগ প্রকাশ করতে লাগল। আমরা এগোলাম।

যাক সন্ধ্যায় কোহিমা শহর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবার একটু পরে এই রথ আমাদের এক অন্ধকার মোড়ে নামিয়ে দিল। আমাদের গন্তব্যের ঠিকানা শুনে ড্রাইভার বলল, আমরা অন্য দিকে বেঁকে যাব, আপনি সামনে চলে যান, পেয়ে যাবেন।

অন্ধকারের মধ্যে গুগল দাদা আর জিপিএসের হাত ধরে পূর্ব নির্দিষ্ট হোমস্টেতে পৌঁছানো গেল।তখন বেশ অন্ধকার চারিদিকে। রাস্তার আলোও যথেষ্ট নয় মোটেই।

এখানে রাত যেমন তাড়াতাড়ি নামে, ভোরের সূর্যও উঁকি দেয় অনেকের থেকে আগে,  অনেক আগেই।পরদিন সকালে ঝকঝকে আকাশে অর্কিডের ফুলে ভরা ব্যালকনি থেকে  কোহিমা শহর আর দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মন ভরে গেল।নিটোল ছবি একটা।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে একটি ট্যাক্সি ওয়ালার সাথে ঠিক হল আমাদের কিসামা গ্রামে, যেখানে এখানকার বিখ্যাত ‘হর্ণবিল’ উৎসব হয় সেই জায়গা, কিগুয়েমা গ্রাম আর এখানকার বিখ্যাত ক্যাথলিক চার্চ দেখিয়ে আনবে।ড্রাইভার ভদ্রলোকের নাম রমেশ,বাড়ী শিলচর,  ভাষা-করিমগঞ্জের বাংলা। এখানে অনেকে বলে মিশ্র নাগা ভাষা। তবে কথার আদান প্রদান হিন্দি বা অল্প ইংরাজী তে চলছে। এছাড়া যা দেখার অর্থাৎ মিউজিয়াম (সেটা এখন বন্ধ) নাগা বাজার (দেখার কিছু নেই)।কাজেই আমরা নিজেরা সামনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত সৈনিকদের স্মৃতিতে গড়া, শহরের ঠিক মাঝখানে একটু উঁচুতে পার্কের ঢঙ্গে  ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে গেলাম বেলা দশটা নাগাদ প্রাতরাশ সেরেই।সেখানে দেখি,সারি  সারি সব শুয়ে আছে শুধু এক একটি নাম হয়ে, একেবারে কচি কচি ১৪২০ জন, ২২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যেই হবে বেশির ভাগ, তরুণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিদেশী সৈনিক, সাথে ছিল বেশ কিছু হিন্দু ও শিখ সৈনিক। ১৯৪৪ সালে জাপানের সাথে মিত্র শক্তির লড়াইয়ে যে বীর সৈনিকরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতিতে ১৯৪৬ সালে এটি নির্মিত ও উৎসর্গ করা হয়।সবুজ মখমলের মত ঘাসে বাঁধানো পাথরের ফলকগুলি মনটাকে কোন অতীতে নিয়ে গিয়ে বিষন্ন করে তুলল।এই খানেই টেনিস কোর্টের কাছে গ্যারিসন পাহাড়ে ভীষণ যুদ্ধে ব্রিটিশ মিত্র শক্তির হাতে হার হয়েছিল জাপানের, যা মিত্র শক্তির যুদ্ধকে নতুন রূপ দিয়েছিল। ইম্ফল ও কোহিমার এই যুদ্ধ ব্রিটিশদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।আজ সেখানে নবীন শিশু, কিশোর কিশোরী, প্রেমিক প্রেমিকা আর দর্শনার্থীর ভিড় যাদের মনে সেই বীরদের প্রতি কোন অনুভূতিই নেই। এখান থেকে দূর পাহাড়ের চূড়া আর নীচে কোহিমা শহরের ছবি  চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এখান থেকে বেরোবার মুখে,  ডাকতেই এসে  গেল আমাদের আজকের গাড়ীর সারথি বন্ধু রমেশ। সারা রাস্তা তার সংগে গল্প করতে করতে চললাম ডানদিকে পাহাড়কে রেখে। ভাবছিলাম কোহিমা আসার রাস্তাটা খারাপ পেয়েছি, শহরের বাকী রাস্তা নিশ্চয়ই ভাল, যতই হোক রাজধানী বলে কথা- কত মন্ত্রী শান্ত্রী নেতাদের যাতায়াত! ওঃ হরি, কোথায় কি, সব রাস্তাই অগম্য।কিন্তু এখানকার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা নিশ্চয়ই খুব ভাল, তাই যে কোন ধরনের রাস্তাই হোক কাদা, ভাংগা, গর্ত ওরা নির্বিবাদে পার করে দেয়। কোন রাগ বা  অসহিষ্ণুতা ছাড়াই।

যাক যেতে যেতে  হঠাৎ দেখি সামনে একটা বিশাল গেট। বিখ্যাত হর্ণবিল উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। এখন কিছুটা বিবর্ণ, শ্রীহীন। হর্ণবিল বা ধনেশ পাখী নাগাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।এই উৎসব চলে ১লা ডিসেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কিসামার একটি মডেল গ্রামে।এটি কোহিমা থেকে প্রায় ১২ কিমি দূরে।এই পয়লা ডিসেম্বরই নাগাল্যাণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস।তাই এই উৎসব  করা হয় নাগাল্যাণ্ড সরকারের ট্যুরিজম বিভাগের তরফ  থেকে, যাতে বাইরের দেশের মানুষের কাছে নাগাল্যাণ্ড সম্বন্ধে আগ্রহ বাড়ে বা বাইরের মানুষের সাথে তাদের যোগসুত্র উন্নত হয়।এই উৎসবে প্রায় ভারতের প্রতি রাষ্ট্রপতিই এসেছেন।এই সময় নাগাদের আচার অনুষ্ঠান,খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি সম্বন্ধে পরিচিত হওয়া যায়।নানা নাচগান আর  আমোদ চলে ক’দিন ধরে।এখন যা বিবর্ণ হয়ে আছে, আর কয়েকদিন পরেই তা বর্ণোজ্বল হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে লোক সমাগমে মুখর।মনে মনে সেই দৃশ্যটা ভেবে নিয়ে উৎসবগ্রামের ভিতরে ঢুকলাম।পাহাড়ের বুকে একটি নিটোল নাগা গ্রাম তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে নানা উপজাতির নাগাদের মোরাং এর আদলে নকল মোরাং তৈরি করা আছে।মোরাং হল প্রতি নাগা গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামের যে কোন শুভকাজ, আপদ বিপদে আলোচনা, গ্রামের সমস্ত বিষয়ে রক্ষা ইত্যাদিতে অনেকটা পঞ্চায়েতের মত কাজ করে।ছেলে মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেও এর উপযোগিতা যথেষ্ট।এক এক উপজাতির এক এক ধরণের মোরাংএর গঠন। গঠন দেখেই, এরা কোন উপজাতি বোঝা যায়।আবার এদের মধ্যে উপজাতিও অনেক।যদিও সরকার মান্যতা দিয়েছে ১৬টি উপজাতিকে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর সংখ্যা অনেক।আসলে একটা বিশাল, প্রায় কাছাকাছি ধরণের মানুষদেরই নাগা বলা হয়।এরা প্রায় ৯০টার কাছাকাছি ভাষায় কথা বলে যেগুলি তিব্বতী-বর্মা বা সাইনো তিব্বতী ভাষা গোষ্ঠী বলা যায়।অসমীয়ার সংগেও এর অনেক মিল আছে।নাগাল্যাণ্ডে এত ভাষা থাকার জন্য এখানে ইংরাজিকে সরকারি ও শিক্ষার ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

যাক গে, ভিতরে ঢুকে বিভিন্ন উপজাতির মোরাংগুলি দেখলাম। সেগুলি এখন ফাঁকা।হয়ত শীঘ্রই রংচং আরম্ভ হবে।মাঝে একটা চারধারে গ্যালারি করা ফাঁকা জায়গা দেখলাম যেখানে অনুষ্ঠান চলাকালীন নাচ গান ইত্যাদি প্রদর্শন হয়।একটা স্টেজও করা রয়েছে।দূরে উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে দেখলাম হলিউডি কায়দায় লেখা আছে ‘নাগা হেরিটেজ ভিলেজ’’।একটা উঁচু গাছে অনেক ধনেশ পাখীর মডেল করা রয়েছে দেখলাম।তবে সত্যি কথা হল, যতই হর্ণবিল পাখীর নামে উৎসব হোক, আসলে ধনেশ পাখী এতই কমের দিকে যে প্রায় তাকে আজ আর দেখাই যায় না। আমার ছোট বেলায় শিলিগুড়ী বা উত্তরবঙ্গেও ধনেশ পাখী দেখা যেত, আমিও দেখেছি। কিন্তু ধনেশ পাখীর যে আসল জায়গা এই নাগাল্যাণ্ড, এখাণেও আজকাল পড়ায় এই পাখি দেখা  যায় না। মানুষের লোভের বলি হয়ে তারাও বোধ হয় ডোডো বা ফিনিক্স পাখীর পথ ধরেছে।যাই হোক। উঁচুপাহাড়ের গায়ে বেশ অনেক খানি জায়গা নিয়ে এই মডেল গ্রাম।

এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম অল্প একটু দূরেই কিগুয়ামা গ্রামে।অংগামী নাগাদের এই গ্রামটি মোটামুটি উন্নত বলেই মনে হল।অনেক বাড়ির দরজায় গাড়ী দাঁড়িয়ে রয়েছে।প্রত্যেক গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার উপর একটা নাগা ঢংগে গেট থাকবেই, এখানেও তাই দেখলাম।  পরিচ্ছন্ন গ্রামটিতে কাঠের, নাগা ঢংগে তৈরী বাড়ি দিয়ে  সাজানো,  গাছে গাছে অর্কিডের ফুলের ছড়াছড়ি। একটি চার্চও দেখলাম।এখানে ব্যাপটিস্ট চার্চই বেশি।তবে এটি বোধ হয় ক্যাথলিক চার্চ।ইংরেজদের দাক্ষিণ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ নাগাই খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। বেশ খানিকক্ষণ  ঘুরে নাগা গ্রামটিতে অনুভব করতে চেষ্টা করলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই অপরাহ্ণের কথা যখন মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে গোটা গ্রামটিতে জাপানীরা চালিয়েছিল বীভৎস হত্যা ও ধ্বংস লীলা যা আজও প্রবীণদের মনে গেঁথে রয়েছে। আশ্চর্য হলাম  জেনে যে এখানের কাঠের বাড়িগুলো নাকি কয়েক শতাব্দী ধরে রয়েছে। এরা বেশ পরিবেশ সচেতন।আমি পরে আরো কয়েকটি গ্রামে গেছি, সব জায়গাতেই দেখেছি নিজস্ব ঢংগে  এদের ময়লা ফেলার ঝুড়ি আছে রাস্তায় রাস্তায়। এছাড়া পরিবেশ সচেতনতার নতুন নতুন স্লোগানে সমস্ত জায়গা মুখর।গ্রামে মহিলারা খুব সচেতন এবং তার ফলে না কি মদ কে গ্রামছাড়া করেছেন। দেখে নিজেদের অনেক ছোট লাগল এনাদের কাছে। দেখলাম অনেক মহিলা পিঠে বেতের বাস্কেট নিয়ে চলেছেন।এটাই এখানকার রীতি।

দূরে জাফু পাহাড়ের অল্প দর্শন নিয়েও এলাম।কাছে যেতে না পারার দুঃখ দূর থেকেই মেটাতে চেষ্টা করলাম।

এখান থেকে এলাম ক্যথলিক ক্যাথিড্রালএ। ঢোকার মুখেই বিশাল উঁচু জাহাজের ধোঁয়া বেরোবার নলের  মত বা টাওয়ারের মত সাদা এক স্তম্ভ। তবে ক্যাথিড্রালটির গঠন বৈচিত্র যে কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। স্থানীয় নাগাদের মোরাং এর গঠনশৈলীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বানানো জাপানীদের বদান্যতায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চার্চটি  সুন্দর যত্ন করা ফুলের গাছ, অর্কিড দিয়ে সাজানো, সামনে একটি সবুজ ঘাসের মখমল পাতা খেলার মাঠ। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত বলে চারপাশের পাহাড়ের কোলে বাড়ি আর শহরের দৃশ্য মনটাকে  ভরিয়ে তোলে।চার্চটিও বেশ সুন্দর দেখার মত, যদিও চার্চের প্রার্থনা কক্ষে আমরা প্রবেশ করতে পারিনি।চারধারে সুন্দর ফুলগাছ আর বিভিন্ন ধরণের অর্কিড দিয়ে সাজানো। দুই যুযুধান দল ব্রিটিশ ও জাপানীদের যৌথ বোঝাপড়ার ব্যাপারটিও এখানেই হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ বলি, নাগারা ব্রিটিশদের সাথে জাপানীদের যুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষ নিয়েই লড়েছিল। ব্রিটিশরাও এখানে কোন ভারতীয় কর্মী বা শাসকীয় পদের কোন ভারতীয়কে এখানে পাঠায় নি এবং তা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এখানে কেবলমাত্র ব্রিটিশরাই চাকরী বা অন্য কাজে আসতে পারত। তারা এই সুযোগে এখানে খ্রীষ্ট ধর্ম ও ইংরাজীর সম্পূর্ণ প্রসার করতে সমর্থ হয়।

এখানে একটি কথা বলি, নাগাল্যাণ্ডে আমরা সবাইকেই নাগা বলি, সেটা ঠিকই আছে কিন্তু ওদের মধ্যে এত বেশী জাতি উপজাতি বা শাখা প্রশাখা আছে যা আর অন্য কোথাও নেই। ওদের মোটামুটি ভাবে প্রধান কয়েকটি জাতির নাম অঙ্গামী, আও, তাংখুল, তাংশাং, যেমে, পৌমাই, কনিয়াক ইত্যাদি হলেও এ ছাড়া প্রচুর জাতি উপজাতি আছে। এদের ভাষা মূলতঃ সাইনো টিবেটিয়ান হলেও এখানে প্রায় ৮৯ ধরণের ভাষা বলা হয়। এবং এগুলো অনেক গুলোই অন্যদের সাথে মেলে না।সে জন্য এখানে এরা ইংরাজীকেই শিক্ষা, সরকারী বা অন্য কাজে ব্যবহার করার ভাষা হিসাবে দাবী করে ও তাতেই কাজ চালায়। অবশ্য হিন্দী বা অসমীয়াও চলে।

ধর্মের দিক থেকে এরা প্রধানতঃ খ্রীষ্টান, শাসক ব্রিটিশদের দৌলতে।। অবশ্য কিছু বৌদ্ধও আছে।

ফেরার সময় সারথি, নেপালী ছেলে, রমেশ আমাকে জানালো, এখানকার নাগাদের ট্যাক্সি বা গাড়ী না চড়তে। ওদের নাকি কথার ঠিক নেই, এক ভাড়ায় রফা করে পরে বেশি ভাড়া দাবী করে, কিংবা যেখানে যেখানে যাবে বলে সেখানে যায় না, এইসব। এগুলো জাতিবিদ্বেষ   না সত্যি বুঝলাম না। তবে রাস্তায় অঢেল ট্যাক্সি রয়েছে।কোহিমাতে  ফিরে যখন এলাম তখনও বেলা রয়েছে। ভাবলাম, দেখি একবার এদের বাজার। রাস্তায় বাজার বসেছে আমাদের মতই। সেখানে শাক সব্জী ফল সবই  রয়েছে আমাদের এখানকার মতই। দামও প্রায় সমান।  তবে সংগে রয়েছে তাজা মাছ, কুচো চিংড়ি থেকে পোনা পর্যন্ত। তার পাশেই রয়েছে ঝুড়ি ভর্তি গুগলী, পায়ে দড়ি বাঁধা বেশ বড় বড় জ্যান্ত সোনা ব্যাং,  হলুদ বর্ণের এণ্ডির জ্যান্ত পলু পোকা, আর ডেকচি ভর্তি কুকুরের মাংস।দাম করে দেখি পলু পোকা ৫০০ টাকা কিলো, কুকুরের মাংস ২০০ টাকা কিলো, ব্যাঙ ও তাই। ওরা বলল এগুলো নাগাদের প্রিয় খাবার।আমি আর এক জায়গায় দেখেছিলাম বাজারে মুখ বাঁধা অবস্থায় গোটা কুকুরটাকে থলেতে ভরে শুধু মুখটাকে বের করে বিক্রি হচ্ছে। শুনেছি এই কুকুরের মাংসের নাকি থেকে ওরা অদ্ভুত অদ্ভুত খাবার বানায়। ভারতে আর কোথাও কুকুরের মাংস খাওয়া হয় বলে জানি না।তবে ভারতের বাইরে চীন, ভিয়েতনাম, নাইজিরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশেও কুকুরের মাংসের খুব চল আছে।চীনে তো প্রভূত পরিমাণে খাওয়া হয় গরু ও শূয়োরের পাশাপাশি। এই খাবারের স্বাদের সত্যাসত্য যাচাই করি নি বলে লিপিবদ্ধ করলাম না।

২০/১০/১৮

পরদিন ভোরে আবার গাড়ী ঠিক করলাম।

আজ কথা হয়েছে শিলচরের কাছে করিমগঞ্জের একটি ছেলে, আবু হোসেনের সংগে।অল্প বয়স কিন্তু বেশ সপ্রতিভ। ঠিক হল আজ, খোনামা গ্রাম ও সেটিকে ছাড়িয়ে জুলেকে নামের গ্রাম দুটিতে যাব।শহর কিছুক্ষণ ছাড়াতেই একেবারে পাহাড়ী গ্রামীন রাস্তায় এসে গেলাম। রাস্তায় বাঁশগাছ রয়েছে অনেক।বাঁশের কাজে এখানকার মানুষ সিদ্ধহস্ত। থাকা খাওয়া থেকে শোয়া সমস্ত কাজেই  এই বাঁশ ব্যবহার হয়।কখনও কাদামাটি কখনও শুধুই মাটির রাস্তা। পিচ কবে হয়েছিল লোকেরা বোধ হয় ভুলে গেছে। পাহাড়ী হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে কোহিমা থেকে মাত্র ২১ কিমি দূরে ১৪৪৪ মি  উচ্চতায় খোনামা গ্রামে একসময় পৌঁছেও গেলাম।ঢোকার মুখে গ্রামের গেট পেরিয়ে একটি ছোট গুমটি জাতীয় ঘরে নির্দিষ্ট এন্ট্রি ফি দিয়ে খাতায় নাম লিখে গ্রামে ঢুকতে হল। গ্রামের ভিতর গাড়ী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই, তাই একপাশে গাড়ি রাখার জায়গায় রেখে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে ঢুকতে হল। খোনামা গ্রামের একটা বিশেষত্ব হল, এটা হল একটা ইকো ভিলেজ এবং ভারতের প্রথম গ্রীন ভিলেজ।মাত্র ৬০০ পরিবারের এই অংগামী গ্রামটি  পুরোটাই রেলিং ঘেরা বাঁধানো রাস্তা, সবুজে ভরা পরিচ্ছন্নতার চূড়ান্ত ব্যবস্থা। চারিদিকে নীচে ঝুম চাষের, ধাপে ধাপে হলুদ সোনায় ভরা, একেবারে ‘ধরার খুশী ধরে না যে–’ অবস্থা।নীল আকাশ, সাদা মেঘের ভেলা, নীচে সবুজে হলুদে কন্ট্রাস্ট। কি যে রংগের খেলা তা বলে বোঝানো দুস্কর।রাস্তার ধারে ধারে যত্নে -অযত্নে, লাগানো -না লাগানো গাছে রক্ত গাঁদা, অর্কিড, নাম না  জানা ফুলে চারিদিক সেজে বসে আছে। কোনদিকে যে তাকাই বুঝে পাই না। মনে পড়ল কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম চীনে। সেখানে তাজাই বলে একটা গ্রামে আমরা এই ধাপে ধাপে লাগানো ধানের শোভা দেখার জন্যে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, সেই ধান দেখার জন্য নানা দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা এসেছে, দামী দামী হোটেলে থাকছে ( দামী ছাড়া ওখানে কোন হোটেলও নেই)। তাদের দেখানোর জন্য রোপ ওয়ের ব্যবস্থা, ফোটোগ্রাফীর ব্যবস্থা, ওয়েবসাইট সমস্ত করেছে ওরা। অর্থাৎ এই ধানের দৃশ্য দেখিয়ে ওরা কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে। আমি ওখানে গিয়ে ভাবছিলাম, আমাদের দেশেও তো এ দৃশ্য নতুন কিছু নয় আমাদের পাহাড়ে এই ভাবেই তো যুগ যুগ ধরে চাষ হয়ে আসছে, অথচ পৃথিবীর লোককে আমরা তা জানাতেই পারি নি এখনও।  শুনলাম নাকি তাতেও বহু লোক আসে এখানে।অথচ থাকার ব্যবস্থা গ্রামে খুবই কম – একটি হোম স্টে আর একটি হোটেল (ডোবিপাই ইন) ছাড়া  আর কিছু আছে কি না বুঝলাম না। আর সে হোটেলে যেতে গেলেও, জানি না, গ্রামের মুখে গাড়ী রেখে অতদূরে মালপত্র নিয়ে কি করে হোটেলে যাওয়া যাবে। তবু দু একজন অতি উৎসাহী বিদেশী পর্যটক রাস্তাতে  দেখলাম।

প্রচুর প্রজাপতি ঘুরছে গাছে গাছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী বেশী লোক দেখলাম না রাস্তায়।চারিদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা গ্রামের রাস্তার পাশে পাশে ছোট ছোট ময়লা ফেলার জায়গা করা আছে। সবাই সেখানেই ময়লা ফেলে আর আশ্চর্য যে গ্রামের ছোটরাও সেভাবেই অভ্যস্ত।  আমরা শহুরেরা, বড়রাই পরিচ্ছন্ন রাখতে জানিনা, ছোটদের আর  শেখাব কি! ছোট্ট  গ্রামটিতে একটি আপার সার্কুলার রোড এবং একটি লোয়ার সার্কুলার রোড গোল হয়ে ঘুরে গোটা গ্রামটিকে বেঁধে রেখেছে।। এক ভদ্রলোকের সংগে দেখা হল ওখানে। উনি রিটায়ার্ড সরকারী কর্মী। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রামটা দেখাচ্ছিলেন। দেখালেন গ্রামের প্রাণ কেন্দ্র মোরাং। সর্বসাধারণের জন্য পাহাড়ী ঝরণার জলের যৌথ জলাধার, চার্চ ইত্যাদি। অনেক গল্প করলেন। এখানে সবাই ইংরাজী বলে বা বুঝতে পারে।উনি ওনার ঘরে নিয়ে গিয়ে আতিথ্য করতে চাইছিলেন। কিন্তু আমাদের আর সময় নেই।আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ওনার কাছ থেকে ছাড়া পেলাম। প্রত্যেকের বাড়ীতে, রাস্তায় এত ফুল ফুটে আছে যে গোটা গ্রামটাকেই প্রজাপতি মনে হচ্ছে। ভাবছি, মানুষ এত সুন্দরও হয়! আমরা কেন প্রকৃতি দেখতে সুইজারল্যাণ্ড যাই ভেবে পাই না। এখানে এলে, লাভ ওখানকার থেকে কম হবে না। তাতে আমরাও লাভবান হব,  ওরাও। একজনের ঘরের দরজায় নিবিষ্ট মনে ফুল দেখছি। ভদ্রমহিলা ডেকে যত্ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন ও ওনার ফুল ও অন্যান্য গাছের বাগান দেখালেন। আমি ওনার কাছে কিছু অর্কিডও নিলাম।

এখান থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে সোজা গাড়ী এগোল জুলেকে র( Dzuleke) দিকে।বলা হয় সারা পৃথিবীতে খোনামা এবং জুলেকে হল দুটি গ্রাম যারা সবার আগে প্রকৃতি বৈচিত্র বাঁচাতে, পরিবেশ রক্ষা করতে শিকার একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।তখন মনে হয় ওরা সত্যিই প্রকৃতির সন্তান, যারা প্রকৃতিকে রক্ষা করতে জানে, মায়ের মত তাকে ভাল বাসতে জানে। হাজার দেড়েক লোকের বাস এই জুলেকে তে, প্রায় ৩০-৪০ ঘর মানুষের এই গ্রাম।এখানেও ঝুম চাষ। ছোট্ট তির তির করে বয়ে চলা নদী জুলেকের থেকেই গ্রামের এই নাম। গ্রামটি এতই ছোট যে আমরা যে তাকে পেরিয়ে যাচ্ছি সেটাও ঠিক মত বুঝতে পারছিলাম না। গ্রামে ঢোকার মুখে এখানেও ছোট্ট একটি সাজানো ঘরে নাম লিখিয়ে গ্রামে ঢোকার ব্যবস্থা বাইরের লোকের জন্য।ঢোকার মুখেই চার্চটি প্রথমেই নজর কাড়ে। এখানে এসে ব্রিটিশরা আর কিছু দিয়ে যাক আর না  যাক, ধর্ম টা সবাইকে উজাড় করে দিয়ে গেছে। তাই প্রায় ৯৯% মানুষ নাগাল্যাণ্ডে খৃষ্টধর্মাবলম্বী।এটাই এদিকে শেষ অঙ্গামী গ্রাম। রাস্তা থেকে দেখা গেল দূরে কিছু মানুষ নীচে  রঙিন তাঁবু খাটিয়ে পিকনিক করছে।ওদের লক্ষ্য করে আমরাও এগোলাম বেশ কিছুটা নীচে একটা ছোট্ট তিরতিরে ঝরণার মত জলধারা একটি ছোট লকগেট বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে। লকগেটের মুখ থেকে সজোরে ফেনা তুলে ছুটন্ত ঘোড়ার মত  দৌড়োচ্ছে। আমরা একেবারে হলুদ সয়াবীন ও ঝুম ধানের ক্ষেতের মাঝে গিয়ে পড়লাম।। চারধারে পাহাড়, ঠিক সুইজারল্যাণ্ডের মত সবুজে ঢাকা, একের পর এক পাহাড়ের ঢেউ চলেছে দিগন্ত পর্যন্ত।কিছু স্থানীয় মানুষের সংগে আলাপ হল। সবাই ধান ঝাড়ছে।ধান পেকেছে- মনে পড়ল, ‘রক্তকরবী’র  ‘রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে—’।বারবার মনে হচ্ছে,আমরা কি দেখতে বিদেশ যাই এত খরচা করে !

এই সৌন্দর্য হেলায় পড়ে থাকে, নদীর জলে, নিঃশব্দ পাহাড়ের কোলে নীরবে। এখানে এত সম্পদ অবহেলিত হয় আর আমরা বিদেশ গিয়ে এতটুকু দেখলেই, ‘আহা কি দেখিলাম’, বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করি।এর জন্য ব্যক্তিবিশেষ নয়, সবাই দায়ী। আমাদের দেশের সম্পদকে অবহেলা করতে, নিজের দেশ – নিজের ভাষাকে ঘৃণা করতে আমরা শিশুকাল থেকেই শিখেছি, আমাদের শেখানো হয়েছে। আবার আমরাও আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের শেখাচ্ছি। এর শেষ কোথায় কে বলবে।

যাই হোক, মনে মনে ভেবে নিলাম, সিনেমার কোন নায়িকা এই ধানের বনে নাচছে সবুজের কোলে ঝরণার জলে। মনটা একেবারে ‘তর হইয়া গেল’।

এখান থেকে ফিরলাম যখন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখানে একটা ব্যাপার, রবিবার সমস্ত দোকানপাট, বাস, ট্যাক্সি সব বন্ধ। মরে গেলেও কাউকে পাওয়া যাবে না।এদিকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৫-৬টার মধ্যে সব বন্ধ।যদি কেউ কিছু কেনাকাটি বা কাজ করতে ভুলে যান আগের দিন, তাহলে রবিবার কিছু করার নেই।তাই যাতে দিনটা নষ্ট না হয়, আমরা রবিবার এখান থেকে চলে যাবার ব্যবস্থা করলাম।একটা ট্যাক্সিকে বলে রাজী করালাম নাগাল্যাণ্ড মণিপুরের সীমানা মাও পর্যন্ত যাবে।তারপর, সবাই বলল, ওখান থেকে বাস পেয়ে যাবেন, মণিপুর যাবার অসুবিধা হবে না। কোহিমা থেকে নাগাল্যাণ্ড সরকারের যে বাস মণিপুর যায় তা দিনে একবারই ছাড়ে সকাল ৭ টায়।তা-ও রবিবার বাদ। তার জন্য নাকি ভোর ৫টা থেকে লাইন দিতে হবে।ব্যাপারটা একটু অসুবিধাজনক মনে হল। তাই ভাবছিলাম, একটু পরে মাও পর্যন্ত গিয়ে বাসে যাওয়াই ভাল।সবাই বলল, হ্যাঁ, মাও  তো বর্ডার, ওখানে সব বাস পাবেন।সব, মানে সব দূরপাল্লার বাস গৌহাটি, শিলং, ডিমাপুর এইসব জায়গা থেকে আসে।।এছাড়াও অনেক অন্য বাসও পাবেন।এ সব যে কত ভুল খবর, তা পরে  বুঝলাম।তবে কোহিমা থেকে ইম্ফল যেতে হলে কোন গাড়ীতে না গিয়ে বাসে যাওয়াই ভাল।কারণটা,পরে রাস্তায় গিয়ে হাতে নাতে বুঝেছি।যাই হোক যতই ট্যাক্সি ঠিক করে রাখি, ভয় তো একটু লাগছিলই পরদিন সকালে, কারণ ট্যাক্সি ড্রাইভার নাগা- তার কথার খেলাপ হতেই পারে। (এখানে যা শুনেছি সেই অনুযায়ী)। তবে, সকালে উঠে তার সংগে যোগাযোগ করতে সে বলল, আমি যাব না, তবে আর একজনকে পাঠাচ্ছি, সে যাবে। এবার তার সংগে যোগাযোগ করতে সে জানাল, আমি আসছি। আশ্বস্ত হলাম, তবে ভয় যায় নি।ঠিক সময়ে দেখলাম সে হাজির গাড়ী নিয়ে। ছেলেটি নাগা হলেও বেশ ভদ্র। আমরা কোহিমায় দেখার ব’লে যা বলে, সেগুলোতে আর আকৃষ্ট হলাম না। সবাই বলল, ওসব ফালতু, শুধু নাম, কিছু নেই দেখবার মত। তাই নাগাল্যাণ্ড ছেড়ে রবিবারের সম্পূর্ণ শুনসান রাস্তায় এগোলাম মনিপুরের উদ্দেশ্যে।

বেরোলাম তো আপাত-লোকজন শূন্য রাস্তায় কোহিমা থেকে। তখনও কি জানি, কি বিপদ অপেক্ষা করছে। মাও পৌছালাম যখন, ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে দশটা।মাও চেকপোষ্টে গাড়ী থেকে নামতেই এগিয়ে  এল পুলিশ। বলে,  কোথায় যাবেন?

বললাম, ইম্ফল।

বলে, ওই তো চলে গেল গুয়াহাটি -ইম্ফলের বাস।

সত্যিই তাই,বাসটার পিছনটা দেখলাম দূরে চলে যাচ্ছে বাস, আমাদের অন্ধকারে রেখে।

পুলিশ আবার বলে, যাবেন কিসে? আজ তো আর কোন গাড়ি চলবে না।

-সে কি? সবাই যে বলল, মাও থেকে সব চলে।

-চলে, তবে অন্য দিন। আজ রবিবার,সকাল থেকে বেশ কয়েকটা দূরপাল্লার বাস এসেছিল। সব চলে গেছে।আজ আর কিছু চলবে না। দেখুন,যদি প্রাইভেট গাড়ী কিছু যায়।

সর্বনাশ ! মাথায় বজ্রাঘাত।

এগোলাম এপাশ ওপাশ খুঁজতে যদি কাউকে পাওয়া যায়। কোথায় কে ! যা দু একজন লোককে দেখলাম, সবাই বলল, কেউ যাবে না।  চারিদিক আমাদের এখানের ধর্মঘটের মত বন্ধ। কোন দোকানের ঝাঁপও খোলেনি।

এমন সময় এক বন্ধ দোকানের দোকানদার বলল, না, আর একটা বাস আছে। দেড় ঘন্টা পর, সাড়ে বারোটায়। ডিমাপুর থেকে আসবে। তবে সিট থাকবে কি না  কোন গ্যারান্টি নেই। চিন্তা এবং দোটানায় পড়লাম। আশা একটু পেলাম আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করার পর যদি সিট না থাকে। কি করব, কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। অথচ, ইম্ফলে আজ অনেক দাম দিয়ে হোটেল বুক করা আছে।শেষে ঠিক হল, দেখি অপেক্ষা করে, না  হলে এখানেই কোন হোটেলে থেকে যাব। যা ক্ষতি হয় হবে।এ ছাড়া আর কোন উপায় তো নেই।  দেখা যাক। ইতিমধ্যে, পাশেই পুলিশের কাছে কাগজপত্র চেক করিয়ে আসতে হল।

এই সব ভাবতে ভাবতেই উলটো দিক থেকে একটা ডিমাপুর যাবার বাস এল। সঠিক ব্যাপারটা তাদের কাছেই জানা যাবে ভেবে ওদের ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের সাথে কথা বললাম। তারা বলল, একদম ঠিক, ডিমাপুর থেকে বাস আসছে।কণ্ডাক্টর বলল, ঠিক আছে,আমি ওই ড্রাইভারের সাথে কথা বলছি।বলে তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তাকে আমাদের জন্য চারটে সিট রাখতে বলে দিল। ওকে জানাল যে আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।

আমরা এই ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মনে জোর এল।বুঝি, ভাল মানুষ ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। নিজের গণ্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোলেই আর চেনার চোখ থাকলেই বোঝা যায়, পৃথিবী আজও সত্যিকারের মানুষ শূন্য হয়ে যায় নি। কিন্তু, সেটা আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই।

এখানে সব বাসই থামে একটু বেশী সময়।ড্রাইভাররা খাওয়া দাওয়া করে। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে খেতে গেলাম। দোকানী বলল, একেবারে খাঁটি মনিপুরী মৈতেই ডিস। নিরামিষ ভাত ১৪০ টাকা, মাছ ভাত ১৬০ টাকা।এক কাজ করুন,, আমি সব দিচ্ছি, আপনারা যা পারবেন খাবেন।

দেখি প্রায় ৭-৮ রকমের পদ দিয়ে খেতে দিল। পরে দেখেছি মণিপুরী মৈতেই ডিস এমনই।এক জায়গায় খেয়ে ছিলাম দশ রকমের পদ দিয়ে, সব বাটি করে সাজিয়ে, একেবারে জামাই আদর করে শাশুড়ীর মত খেতে দিয়েছে। বাংলায় কোথাও এমন পাই নি। তবে অনেক পদই খুব ঝাল। খেতে পারিনি।ভেতরে ভেতরে যে এই’ চক্রান্ত’ ছিল বুঝতে পারি নি। আমার সেই বক আর শেয়ালের নিমন্ত্রণ করে উভয়কে খাওয়ানোর কথা মনে হল।

যাক, খেতে খেতেই বাস এল।কণ্ডাকটারও যত্ন করে তুলে নিল। বাস ভালই, তবে রাস্তা যে এমন জানা ছিল না। আমি যাই বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে।প্রায় সারা রাস্তাই, ৬৫ কিমি, বাস এল নাচতে নাচতে। আর সেই সঙ্গে রাস্তার ধূলো।ভাবছিলাম রাস্তার এই অবস্থা কাটবে কখন, এ ভাবে তো ঘোরা টা খুব সুখকর হচ্ছে না। যাই হোক, সেনাপতি (জায়গার নাম) পেরোনোর কিছু পর থেকে খুব মসৃণ না হলেও  বাসের নাচ একটু কমে এল।বোধ হয় বাসও একটানা নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।যতই হোক, বাসের না হয় প্রাণই নেই, শরীর বলে একটা কথা আছে তো ! সেনাপতি এখানকার একটা জেলা এবং জায়গার নাম।

ইম্ফল পৌঁছে দেখি বাসস্ট্যান্ডের  কাছেই হোটেল। হোটেলের নাম ফৌ ওই বী। বেশ ভাল হোটেল। নামতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। তবু মালপত্র রেখে অটো নিয়ে গেলাম এখানকার বিখ্যাত মহিলা পরিচালিত বাজার ইমা কাইথেল দেখতে।এই ইমা কাইথেলের প্রতি আমার একটু আকর্ষণ ছিল এই কারণে যে,এটা নাকি এশিয়ার সব চেয়ে বড় মহিলা পরিচালিত বাজার। ইমা, মানে মা বা মহিলা, কাইথেল মানে বাজার। শহরটা কিন্তু একনজরে হঠাৎ কলকাতার একটা অংশ মনে হচ্ছিল। বেশ চওড়া রাস্তা রিক্সা, বাইক, অটো, গাড়ীতে ব্যস্ত রাস্তা।

ইমা কাইথেল কাছেই। বিরাট দোতলা বাজার। সব বিক্রেতাই মহিলা। ক্রেতা যে কেউ হতে পারে কিন্তু  বিক্রেতা মেয়েরাই হবে। বেশ ভিড় বাজারে। নীচে ফুটপাথেও সব রকম জিনিষই বসেছে, মাছ থেকে সব্জী পর্যন্ত; সব ওই মহিলা।তবে উপরের তলায় শুধু কাপড়, শাল, চাদর, গামছা এইসব।বেশির ভাগই হস্ত শিল্প।সব মেয়েরা বৈষ্ণব মনে হল- সবারই নাকে রসকলি কাটা। তবে এই ব্যাপারটা মেয়েদের মধ্যেই বেশী দেখলাম। প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো এই মহিলা পরিচালিত, এশিয়ার সর্ববৃহৎ বাজারে প্রায় ৫০০০ মহিলা ব্যবসা করছেন।এখানে বিবাহিতা ছাড়া মহিলারা বসতে পারেন না। এই বাজারের আর একটি নাম আছে, খৈরামবন্দ বাজার। তবে আগের নামটিই বেশী প্রচলিত। ২০১৬ সালে এই বাজারটির প্রচণ্ড ভূমিকম্পে খুব ক্ষতি হয়। তবে তা শীঘ্রই সংস্কার করা হয়।বীর টিকেন্দ্রজিত রোডে পাশাপাশি আর একটি দোতলা বাজার আছে। সেটিও মহিলা পরিচালিত।সেটিও ইমা কাইথেলের অংশ।সেখানে সমস্ত সব্জী ফল মাছ ইত্যাদি বিক্রি হয়।তবে আমি পরে দেখলাম, শুধু এখানে নয়,সারা মণিপুরেই মেয়েরাই বাজারে বসেন।

এখান থেকে একটু পরে চলে এলাম। কারণ এখানেও কোহিমার মত অত তাড়াতাড়ি না হলেও ৭টার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যায়।

পরদিন সকালে শহর ঘুরব স্থির করলাম। তাই প্রথমে গেলাম রাধাগোবিন্দ মন্দিরে।মন্দিরটির রঙ সাদা এবং এর নাটমঞ্চটি বেশ বড়। বুঝলাম এই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের জন্যই এখানে সব বৈষ্ণব বা বিপরীতটাও সত্যি। মন্দিরটির কারুকাজ উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তবে এখানে যা কার্যকলাপ চলছে তা আমাদের বাংলাদেশের যে কোন মন্দিরের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ১৮৪৬ সালে রাজা নর সিং এর তৈরী মন্দিরটির দুটি ডোম বা গম্বুজই সোনার পাতে মোড়া।ভিতরে রাধা কৃষ্ণের মূর্তি,যা অত্যন্ত নিয়ম মেনে সঠিক সময় অনুযায়ী পূজা হয়।এখানে জন্মাষ্টমী, রাসলীলা, হোলী প্রভৃতি উৎসব খুব ধুমধাম করেই হয়। এটিই ইম্ফলে সবচেয়ে বড় হিন্দু মন্দির। এর গর্ভগৃহে রাধা কৃষ্ণ ছাড়াও বলভদ্র, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি আছে।

এখানে বেশিরভাগ মানুষই, বিশেষ করে মেয়েদের নাকে বৈষ্ণবদের রসকলি কাটা এবং শাড়ি কিন্তু  অন্যভাবে পরে।এদের সাধারণ পোশাক হল  ইনাফি যা শাল বা দুপাট্টার মত ঊর্ধাঙ্গে পরা হয়,এবং ফানেক, যা নিম্নাঙ্গে জড়ানো হয়। এ ছাড়া মায়েকনাইবি, চিন ফি ইত্যাদিও পরে। ছেলেরা সাদা ধুতি আর সার্ট এবং অনুষ্ঠানে সাদা চাদর পাট করে কাঁধে দেয়। মাথায় সাদা পাগড়িও দেওয়া হয়।

এখান থেকে আমরা গেলাম অটোতে কাংলা ফোর্ট।কাংলা ফোর্ট শহরের মধ্যেই।তার চারদিকে চারটি প্রবেশদ্বার এবং চারিদিকে একটি পরিখা দিয়ে ঘেরা। এটি ইম্ফল নদীর ধারে। এই ফোর্টের বর্তমান প্রবেশ দ্বারের সামনে রাজা নরসিং এর মূর্তি করা আছে।এই খানেই,১৫ই জুলাই ২০০৪ এ, ৩২ বছর বয়সী থাংজাম মনোরমার উপর ১৭ নং আসাম রাইফেলস এর সৈন্যেরা অত্যাচার করায় তার প্রতিবাদে নগ্ন প্রতিবাদে নেমেছিলেন মণিপুরী বয়স্কা মহিলারা।প্রসঙ্গতঃ, এখানে মেয়েরা এই সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ বা বক্তব্যের ব্যাপারে চিরকালই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।

কাংলা ফোর্টের ভিতরে টিকিট করে ঢুকতে হল। এখানে ঢোকার মুখে রাস্তা টা অনেকটা আমাদের রাজভবনের মত,  দুপাশে গাছ দিয়ে সাজানো সোজা চওড়া রাস্তা ভিতরে যাচ্ছে। মাঝে একটি খাল বা পরিখা দিয়ে ঘেরা এই ফোর্ট। এই রাজ্য ১১১০ সালে রাজা লোইউয়াম্বা স্থাপন করেন।রাজা খাগেম্বা ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে এটি তৈরী করেন।তাঁর ছেলে রাজা খুঞ্জাওবার সময় এর যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হয়।প্রথম ব্রিটিশ – মণিপুর যুদ্ধের পর ১৮৯২ সালে ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকার করে মণিপুর।তারপর থেকেই এখানে ব্রিটিশ সৈন্য থাকতে আরম্ভ করে।তা চলে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে দুটি সিংহের মত বিশালাকায় সাদা মূর্তি। এগুলি হল কাংলা শার মূর্তি, যে দেবতা রাজাকে সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহ ও অন্যান্য বিপর্যয়  থেকে রক্ষা করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। আসল মূর্তিগুলি ব্রিটিশরা ধ্বংস করে। পরে নতুন মূর্তিগুলি তৈরী হয়। এটি দাঁড়িয়ে আছে রাজ অভিষেক ভবন উত্রার সামনেই। ভবনটি অনেকটাই বিনষ্ট।

ফোর্টে ঢোকার পরে রাস্তার বাঁদিকে রয়েছে মৈতেই সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা বড় দেবতা পাখাংবার মন্দির। সাদা রঙের মন্দিরটি সবুজ ঘাসের লনের মাঝে প্রাচীন স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ভিতরে রয়েছে শ্রী গোবিন্দজীর মন্দির। এটি ১৮৪৬ সালে তৈরী করেছিলেন মহারাজা নর সিং।এটি ১৮৬৮ সালে ভূমিকম্পে নষ্ট হয়ে যাবার পর মহারাজা চন্দ্রকীর্তি এটি পুনর্নির্মাণ করেন।বর্তমানে বেশ কিছু লাল থাম দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন হয়ে অতীতের গৌরব গাথা নিয়ে।

এছাড়া ভিতরে রয়েছে যা, তা বেশিরভাগই সমাধি বা ধ্বংসাবশেষ, কিছু রাজাদের এবং কিছু ব্রিটিশদের।

সুদীর্ঘ দিন এই ফোর্ট আসাম রাইফেলস হাতে থাকার জন্য মানুষের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল।শেষে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৪ সালে এটি মণিপুর রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দেন। তবে বর্তমানে এর ভিতরে বেশিরভাগই কেবল ভগ্নাবশেষ। খুব যে কিছু ইতিহাস বর্ণনা বা পুরানোকেই তুলে ধরে সাজানোর চেষ্টা হয়েছে তেমন নয়। তবে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন জায়গাটা।

মণিপুরে দুটি ভাষার প্রাধান্য, একটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও অপরটি মৈতেই। ধর্মের   মধ্যেও বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য বেশি। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীতে ব্যবহার করা হয় বাংলা হরফ। এটি একটি ইন্দো এরিয়ান ভাষা অপরদিকে মৈতেই হল সাইনো টিবেটান ভাষা। মৈতেই ভাষার সাথে কুকি ও তাংখুল নাগাদের ভাষার মিল আছে।ওদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীর সাথে অসমীয়া, সিলেট, বর্মা বাংলার কিছু মিল আছে।তবে বলা হয় এটি মণিপুরেই বিষ্ণুপুরে উৎপত্তি ও লোকতাক লেকের আশেপাশে বলা হত।যাই হোক বর্তমানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীর প্রচলন একেবারেই কমে গেছে।আমরা দু একটি জায়গায় দোকানে মৈতেইএর পাশে এই ভাষা দেখেছি। এছাড়া সব জায়গাতেই মৈতেইএর ব্যবহার বেশী।আসলে অনেকে এই বিষ্ণুপুরীকে বাংলার অবদান মনে করে ও নিজেদের প্রাচীন ভাষাকে আঁকড়ে থাকতে চায়। তাই এই নিয়ে অতীতে বেশ কিছু প্রতিবাদও হয়েছিল। ধীরে ধীরে তাই বিষ্ণুপুরী একঘরে হয়ে মৈতেইয়েরই প্রাধান্য হয়ে গেছে।

যাক, আমরা   কাংলা ফোর্ট থেকে বেরিয়ে উলটো দিকে বীর টিকেন্দ্রজিত পার্কের মধ্যে ১১ মিটার উঁচু শহীদ মিনার দেখতে গেলাম। পার্কটি পরিচ্ছন্ন, তবে তার বাইরে আমাদের ভারতবর্ষে দিল্লী, কোলকাতায় যেমন হয় তেমনই হকার, ভিখারি সব মিলিয়ে মিশিয়ে রয়েছে।এই জায়গাটিতেই ১৩ই আগষ্ট ১৮৯১ সালে, যেদিন টিকেন্দ্রজিতের বিরূদ্ধে ফাঁসির বিচার শোনানো হয়, সেই দিনই বিকাল পাঁচটায়  প্রকাশ্য জনতার সামনে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।যুবরাজ টিকেন্দ্রজিত সিং ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি ছিলেন রাজার সেনাপতি।মহারাজা চন্দ্রকীর্তি সিংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকারদের মধ্যে বিরোধ বাধলে ব্রিটিশরা টিকেন্দ্রজিতের বিরূদ্ধ পক্ষ, রাজার ছোটভাই যুবরাজ কুলচন্দ্র সিংকে সমর্থন করে।  যেহেতু টিকেন্দ্রজিতও সিংহাসনের দাবীদার ছিলেন এবং মণিপুর বাসীরও অধিকাংশের সমর্থন ছিল এর পক্ষে।ফলে বিশাল বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ দের বারবার লড়তে হয় টিকেন্দ্রজিতের সৈন্যের সাথে।যথেষ্ট বেগ দেওয়ার পর শেষে ব্রিটিশরা কাংলা ফোর্টের দখল নেয় ২৭ শে এপ্রিল ১৮৯১ এবং ২৩ শে মে বন্দী করে টিকেন্দ্রজিত সিংকে। পরবর্তী কালে মণিপুরবাসী এই বীরের প্রতি আনুগত্যে ও শ্রদ্ধায় এই ফাঁসির  জায়গাটিতে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত পার্কের রূপ দেয়। পার্কের পাশের দেওয়ালেই রয়েছে মণিপুরের বিখ্যাত পোলো খেলার মাঠ। এই পোলো খেলার জন্মই মণিপুরে।

এখান থেকে এগিয়ে আমরা বাজারের মধ্যে দিয়ে এগোলাম।পেট তখন জানান দিচ্ছে জ্বালানি ভরতে হবে। নাহলে এবার শরীরকে বহন করতে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। আমরা আগেই জেনে এসেছিলাম

কাংলা ফোর্টের কাছেই Wahengbam Leikai Road এ Luxmi Kitchen এর খুব সুনাম এবং এখানে আসল মৈতেই খাবার পাওয়া যায়। কাজেই আগে মিউজিয়াম ও রাজভবন দেখার আগে মা লক্ষ্মীর রান্নাঘরের খোঁজে যেতেই হল। রাস্তায় অনেক অটো চলে তবে বেশির ভাগই এখনও গ্যাসে চলে না, সবই ওই তেলে চলে এবং পুরানো দিনের বডি নিয়ে পুরানো গাড়ী।

লক্ষ্মী কিচেনে  এসে দেখলাম, প্রচুর কর্মী ভীষণ তাড়াতাড়ি মেসিনের মত কাজ করে যাচ্ছে। বেশ বড় হোটেলের ভিতরটা। সব ধরণের মানুষই খাচ্ছেন। তবে মৈতেই ঢং হচ্ছে প্রায় দশটা পদ দিয়ে খেতে দেওয়া। থালার পাশে প্রায় পুরো গোল করে ছোট ছোট বাটি দিয়ে সাজানো, জামাই ষষ্ঠী্র দিন শাশুড়ির খেতে দেওয়ার মত। মাছেরই প্রায় তিন -চারটে পদ।বেশ সুন্দর পরিবেশন পদ্ধতি। থালি সিস্টেম, চাইলে আবার পাওয়া যায়। দামও বেশ সস্তাই। তবে যদি কেউ ঝাঁ চকচকে বা সাহেবী কায়দার হোটেল চান, এটি তা নয়। এটি সম্পূর্ণ দেশীয় ধরণের। যাই হোক আমাদের ভালই অভিজ্ঞতা হল।

এখান থেকে খেয়ে মনটা ভরতেই আমরা ভাবলাম ঘুরে আসি, এখানকার বিখ্যাত এন্ড্রো গ্রামে। মণিপুরের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করার জন্য এটি একটি আদর্শ গ্রাম। এখানে আছে মিউজিয়াম, এবং এরা আদতে যে ধর্মে বিশ্বাসী ছিল বৈষ্ণব হওয়ার আগে সেই ধর্মের অর্থাৎ সানামাহি ধর্মের (এখনও অনেকেই সেই ধর্মে বিশ্বাসী) মন্দির, আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধরণের ঘর, পোষাক আশাক ইত্যাদি। আমরা ওখান থেকে অটোতে গেলাম আর একটি অটো স্ট্যাণ্ডে যেখান থেকে এণ্ড্রো গ্রামের অটো ছাড়ে। সেগুলি চলে শেয়ারে, যখন লোক ভর্তি হয় গাড়ি ছেড়ে যায়।এন্ড্রো গ্রামে যাওয়ার গাড়ীগুলো একটু বড় ভ্যান ধরণের। আমরা প্রায় আধঘণ্টা  অপেক্ষা করার পর ভ্যান ছাড়ল। বেশ সুন্দর রাস্তা। পাহাড়ের উঁচু নীচু চড়াই উতরাই রাস্তা চলেছে নানা গাছপালায় ছাওয়া রাস্তা দিয়ে। আমরাও চলেছি দেখতে দেখতে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলার পর হঠাৎ মনে হল, একি, কখন পৌঁছাবে ! গাড়ী চলেছে তো চলেইছে। আশপাশে হলুদ ধান ক্ষেত, মেয়েদের সাজানো বাজার সব দেখছি। জিজ্ঞেস করতে বলল, দেরী আছে। শুনেছিলাম, আধ ঘন্টা মত লাগে,সেটা যে ট্যাক্সিতে, সেটা খেয়াল ছিল না।২৫ কি মি রাস্তা।এই গাড়ী তো অনেক আস্তে চলে।আমরা বেলা দু’টো নাগাদ চেপেছি। ভেবেছিলাম আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে, দেখে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসব। সেটা তো হওয়া মুস্কিল মনে হচ্ছে। ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, এটা পৌঁছাবে কখন, আর তার পর ওখান থেকে ফেরার গাড়ী কখন আছে।ওরা তো কথা আদৌ বুঝতে পারছে না।এরা গ্রাম্য মানুষ, ইংরাজীও বোঝে না। আমরা তো ভয় পাচ্ছি, যদি পৌছেও যাই গ্রামে, যেভাবে গাড়ী চলছে, সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তখন তো কিছু দেখাও যাবে না। আবার গ্রামে নিশ্চয়ই কোন হোটেলও নেই, কেউ ভাষাও বোঝে না, থাকব কোথা, ফিরব কি করে। ওরা অনেক কষ্টে যা বুঝতে বা বোঝাতে পারল, তা হচ্ছে,এণ্ড্রো পৌঁছাতে অল্পই দেরী, কিন্তু এখন এখান থেকেও কোন গাড়ী ইম্ফলে যাবে না।সেই কাল সকালের আগে কোন ইম্ফলের গাড়ী পাওয়া যাবে না। ও মা, কি করব তা হলে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠেছে আমাদের সবারই। বাইরের দৃশ্য তখন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মাথায় উঠেছে সৌন্দর্য। কি করব আপাতসমস্যা থেকে বাঁচার সে চিন্তাতেই ডুবে আছি।আমাদের সমস্যা দেখে বা বুঝে একটি কম বয়সী মেয়ে, সে অল্প ইংরাজী জানে বা বোঝে। এগিয়ে এল ত্রাতা হিসাবে। সে বলল, শান্ত হোন, কি করা যায় আমি দেখছি। জানি না ও কি দেখবে, কিন্তু আর তো কোন উপায় নেই, সমুদ্রে কাঠের টুকরো দেখে তাই আঁকড়ে ধরলাম। একটু পরে ও বলল, এখানে নামুন। ও নিজেও নামল সেখানে। নামলাম। একটু দাঁড়াতেই দেখি, একটি উল্টোদিক থেকে আসা ফাঁকা অটোকে দাঁড় করাল। এটি বড় ভ্যান নয়, কাছাকাছি যাওয়ার মত ছোট অটো। তার সঙ্গে ওদের ভাষায় কি বলল। বুঝলাম, এই অটো ড্রাইভার বাড়ী যাচ্ছে। তাকে মেয়েটি আমাদের অবস্থাটা বুঝিয়ে অনুরোধ করল, একটু কষ্ট করে আমাদের কাছাকাছি যে ইম্ফল যাবার অটোস্ট্যাণ্ড আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে ইম্ফল যাবার অটোতে তুলে দিতে।আমরা ব্যাপারটা বুঝে মেয়েটিকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। ভগবান যে মাঝে মাঝে বিপদ থেকে কিভাবে উদ্ধার করেন, ব্যাপারটা ভাবলেই আশ্চর্য লাগে। উনি হয়ত নিজে আসেন না, কিন্তু সাহায্যকারীকে যেন কিভাবে হাজির করেন তা আমরা অনেক সময়ই বুঝতে পারি না।ভাল মানুষ আজও আছে পৃথিবীতে।এরকমই তো আমরা একজনকে পেয়েছিলাম মাওতে, ইম্ফলে আসার সময়।

যাই হোক, আমরা উঠে বসলাম, উল্টোদিকের অটোতে। এছাড়া সাধারণ ভাবে অন্য কোন রুটের অটো আর সেদিনের জন্য পাওয়া যেত না।অটোচালক আবার আমাদের স্থানীয় মন্দির এবং আরও দু একটি জিনিস গাইডের মত দেখাতে দেখাতে চলল। আমরা চিন্তা করছিলাম, ফেরার দেরী হবে কি না, ওখান থেকে ফেরার অটো পাব কি না এই সব। ও বলল, ওসব চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আপনারা সব দেখুন। আমরা আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই ব্যবহারে। গ্রামীন রাস্তা সব, তবে সুন্দর, পাকা বাঁধানো, পরিষ্কার। রাস্তার আশে পাশেও সমস্তই পরিষ্কার, ছাড়া ছাড়া বাড়ী। ও আমাদের নিয়ে এসে ছেড়ে দিল প্রায় সন্ধ্যার মুখে সেই ইম্ফল যাবার অটোস্ট্যাণ্ডে। দেখিয়ে দিল কোনটা ইম্ফল যাবে। আরও আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম, ওকে ভাড়া দিতে চাইলে ও কিছুই না নিয়ে বলল, আপনারা আমাদের মেহমান, বিপদে পড়েছেন, এটুকু আমাদের দায়িত্ব।আমরা বাকরূদ্ধ। আমরা শহরে তো কাউকে এরকম করি কি জানি না। নিজেরা যখন এই ব্যবহার পাই তখন নিজের আমিত্বের কাছে অনেক ছোট হয়ে যাই। এই জন্যই বোধ হয়, মানুষের নিজের গণ্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোনোর দরকার আছে, দেশের চারিদিকে কত মণিমাণিক্য ছড়িয়ে আছে সেগুলোর হদিশ পেতে আর নিজেকে একবার যাচাই করতে। ফিরলাম ইম্ফল।

আজ সকালে আবার আমাদের হোটেল বদল করতে হল। এবার আর হোটেল না নিয়ে স্থানীয় একজনের বাড়িতে হোম স্টে তে গেলাম। অনেক বড় বাড়ি,  গাছ দিয়ে সাজানো।দোতলায় আমাদের দু খানা ঘর, শহর থেকে একটু বাইরে। কিন্তু খুব অসুবিধা নেই। বাড়ীতে কেয়ার টেকার আছে, সে-ই সব রান্না করে দেবে, যদিও রান্নার সব কিছু আছে।আমরা ওর সাথে কথা বললাম, যে আমরা গাড়ী নেব দু দিনের জন্য। ঘুরতে যাব মৈরাং হয়ে লোকতাক লেক, আর ওদিকে উখরুল, শিরুই পিক।

পরদিন আমরা সকালেই বের হলাম। গাড়ী নিয়ে এক ভদ্রলোক একদম ঠিক সময়েই হাজির। আমরাও কোথায় কি খাবার পাব কে জানে, তাই সঙ্গেই কিছু খাবার নিয়ে উঠলাম।

রাস্তা বেশ ভাল যে একথা বলব না। শহর ছাড়িয়ে বেরোতেই ভারতের অন্য সব জায়গার মত অবস্থা। তবে এমনিতে খুব ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার পাশে দোকানপাটও খুব ঘিঞ্জি নয় কোথাও। বরং যথেষ্ট ফাঁকা ফাঁকা। অনেকটা মনে হল, আসামের মধ্যে কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছি।ঢং গুলোও অনেকটা ওদের মতই। সাধারণ বাজার বা হাট যা বসেছে তা বেশির ভাগই বিক্রেতা মেয়েরা, পুরুষেরা হয়ত সাহায্যকারী।

প্রথমেই পৌছালাম ২৭ কিমি দূরে বিষ্ণুপুরে। নামের উৎস একই, আমাদের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর আর মণিপুরের বিষ্ণুপুরের, সেই দেবতা বিষ্ণু। এই মন্দিরটি এখানকার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ইঁটের তৈরী মন্দির।এটি রাজা খ্যাম্বা বা খয়াম্বার সময় তৈরী হয়েছিল। শোনা যায় এর বিষ্ণু মূর্তিটি  বর্তমান মায়ানামারের পং এর রাজা, উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন।এটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে ( ১৪৬৭ সাল) তৈরী।মন্দিরটি খুব বড় নয়। উঁচু লম্বাটে ধরণের কিছুটা চৈনিক স্থাপত্য মিশ্রিত।খুব বেশী কারুকাজ আছে এমন নয়। এই বিষ্ণুপুরই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উৎপত্তিস্থল। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটিও যে বিশাল চওড়া বা বড় এমন কিছু নয়। বরং এটি এখন দেখে মনে হল,  প্রাচীন ঐতিহাসিক স্মারক হিসাবেই রাখা আছে। মূর্তিও এখানে নেই। সেটি বোধ হয় মিউজিয়ামে রাখা আছে।আশপাশটিরও গ্রাম্য পরিবেশ।অথচ এই জায়গাটি এক সময় ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ রাজধানী ছিল।

বিষ্ণুপুর বিখ্যাত আরও কয়েকটি কারণে। এই জেলাতেই আছে বিখ্যাত নাচুনে হরিণ, সাঙ্গাইএর জন্য খ্যাত কেইবুল লামঝাও ন্যাশনাল পার্ক। এছাড়া আছে লোকতাক লেক আর আছে মৈরাং এর নেতাজীর স্মৃতি।

যাই হোক এখান থেকে আমরা এগোলাম আমাদের প্রাণের টান মৈরাং, সেই মৈরাং যার সঙ্গে প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ের এক অচ্ছেদ্য টান রয়েছে তাদের প্রাণের মানুষ নেতাজীর ১৫ই এপ্রিল, ১৯৪৪ সালে প্রথম ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের স্থান হিসাবে ও মৈরাং যেভাবে  তাঁকে সাহায্য করেছিল, পাশে দাঁড়িয়েছিল তা স্মরণ করে।আজও আই এন এ মেমোরিয়াল তাদের প্রাণের জিনিস। মৈরাং বাজারের পাশেই রয়েছে এই মেমোরিয়াল। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে নেতাজী ও আই এন এর ব্যবহৃত জিনিস পত্র, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তাঁর যাত্রাপথের ম্যাপ ইত্যাদি। এটি ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯ এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উদবোধন করেন।ঢোকার মুখেই রয়েছে নেতাজীর দাঁড়ানো মূর্তি। অবশ্য প্রথম মূর্তিটি,(  পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া), অজানা কিছু দুস্কৃতকারী ভেঙ্গে দেয়। পরে আবার একটি মূর্তি,  যেটি মণিপুরী ঢং এ তৈরী, স্থাপিত হয়।সেটিই আজও দাঁড়িয়ে আছে।

এর কাছেই লটপাচিং এ একটি জাপানী সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভ আছে, যে সমস্ত জাপানী সৈনিক বৃটিশদের সাথে যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতিতে।

এখান থেকে গেলাম আমরা লোকতাক লেক এ।

লোকতাক লেক হল উত্তরপূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ পরিষ্কার মিষ্টি জলের হ্রদ।এরই দক্ষিণপূর্ব দিকে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভাসমান ন্যাশনাল পার্ক, কেইবুল ল্যামজাও ন্যাশনাল পার্ক।এই লেকের মধ্যে অনেক দ্বীপ আছে, তাতে অনেক জায়গায় লোক বসতিও আছে। তারা নৌকো করে যাতায়াত ও যোগাযোগ রাখে স্থলভূমির সাথে। এর উপরে অনেক ভাসমান গাছ,পানা ও জলজ উদ্ভিদও আছে।এর জল চাষের কাজ,  বিদ্যুৎ উৎপাদন, মাছ চাষ প্রভৃতি নানা কাজে লাগে। এর মধ্যে জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরী ফুমদি গুলি বেশ সুন্দর। এগুলো প্রাকৃতিকও আছে, কৃত্রিম ও আছে। কৃত্রিমগুলি  বৃত্তাকার, ঘাস বা ঐজাতীয় উদ্ভিদের তৈরী।এগুলির নাম আথাফুম। এগুলি মাছ চাষের কাজে লাগে। সারা লোকতাক লেক জুড়ে ভাসমান ফুমদিগুলি বেশ সুন্দর লাগে দেখতে। ছোট বড় নানা আকৃতির ফুমদি হয়।এ জিনিস আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এরকমই একটি বিশাল ফুমদির উপর কেইবুল লামঝাও পার্কটি রয়েছে।এই লেকের ধারে ধারে যে জেলেরা রয়েছে তাদের বলা হয় ফুমসং।প্রায় এক লক্ষ মানুষ এই লেকের উপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল।এর মাঝে একটি দ্বীপ আছে তার নাম সেন্দ্রা।এখানে একটি টুরিস্ট রিসর্ট ও হোটেলও আছে।

আমরা একটি নৌকায় বা ক্যানোতে চেপে কাছের একটি দ্বীপে গিয়েছিলাম।নাম কারাং। এই দ্বীপের একটি বড় বিশেষত্ব আছে এই যে, এটি ভারতবর্ষের প্রথম ‘ক্যাশলেশ’ দ্বীপ হিসাবে ভারতসরকার দ্বারা স্বীকৃত দ্বীপ। এখানে কারাং আইল্যাণ্ড বোট এসোসিয়েশন ও পান্থোইবী খোয়োল স্ট্যাণ্ডার্ড এসোসিয়েশন এর যৌথ প্রচেষ্টায় এখানে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়।এখানে বিদ্যুত বিল ও অন্যান্য সমস্ত লেনদেন প্রায় সমস্তটাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়,  যেটা এখনও বহু শিক্ষিত সমাজেও সম্ভব হয় নি।সেই হিসাবে ছোট এই দ্বীপটির গুরুত্ব অসীম। পাহাড়ী  দ্বীপটিতে দারিদ্র‍্য বেশ প্রকট। চাষ বাস অল্প। বেশির ভাগ ঘরই কাঁচা। পাকা রাস্তা দেখি নি। উঁচু নীচু গ্রাম্য মাটির রাস্তা।

লেকটি উপর থেকে বড় সুন্দর দেখায়।

ছেড়ে আসতে বেশ খারাপ লাগছিল।

এখান থেকে ফেরার সময় ঢুকলাম সাঙ্গাই হরিণের জায়গা কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কে।এটি বিষ্ণুপুর জেলাতে, প্রায় ১৫.৫ বর্গ মাইল জুড়ে এর বিস্তৃতি।তবে কিছুদিন আগে এই হরিণ লুপ্ত প্রজাতি বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।তবে বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত নয় বলে স্বীকার করা হয়। আমরা বেশি দূর যাই নি। কাছেই ওয়াচ টাওয়ারের কাছে গিয়েছিলাম। এখান থেকে লোকতাকের আর এক দিকটা দেখা যায়।বড় সুন্দর দৃশ্য।অনেকে বলেন ওই হরিণের দেখা পেয়েছেন, তবে আমরা তো আর অত সৌভাগ্যবান নই, কাজেই হরিণ যে দেখা দেয় নি তা বলাই বাহুল্য। অনেকে বলেন ভোর বেলা গেলে দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

পরদিন সকালে আমরা তৈরী হলাম ফাংরুই যাবার উদ্দেশ্যে। কাল যিনি ড্রাইভার ছিলেন, আজ এসেছে তাঁর ছেলে। বেশ অল্পবয়সী ছেলেটি।

আজ যাব পাহাড়ী দুর্গম জায়গা উখরুল, যা প্রায় ইম্ফল থেকে ৮০ কিমি দূরে।  যেহেতু সমতলের এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে ৮০ কিমি যাওয়া আর এই পাহাড়ী জায়গায় ৮০ কি মি যাওয়ার মধ্যে অনেক তফাত, তাই সকাল সকালই তৈরী হয়ে নিলাম। এতে সময়ও লাগার কথা অনেক বেশী।

এই উখরুল পৃথিবীর মধ্যে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। এখানে পৌঁছে মনে হল, আমি কি ভারতীয়, আমরা কি ভারতেই আছি,  না কি অন্য কোন দেশে এলাম।আবার  মনে হল তখন কবিগুরুর ভাষায়, এলেম নূতন দেশে।

সমতল ছাড়িয়ে অনেক খানি পাহাড়ী রাস্তার আঁকিবুকি, সূর্য আর মেঘের খেলার মাঝে খেলতে খেলতে চলেছি,  এমন জায়গায়, যেখানে সমতল ভারতের অনেক কম লোকই আসে। অন্ততঃ আমি তো একজনকেও দেখিনি।

এই উখরুল জায়গাটা,  নাগা তাংখুল উপজাতিদের দেশ। এরা সংস্কৃতিগত ভাবে বেশ উন্নত। এদের মুখের ভাষা হল সাইনো – টিবেটিয়ান বা টিবেটো- বার্মান। অর্থাৎ এক মিশ্র ভাষা। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক,  কারণ এরা চীন এবং মায়ানমার দুটো থেকেই খুব কাছে। এরা জাতিগত ভাবে অনেকটা মঙ্গোলিয়ান।এরা ক্রমশঃ ভারতের আরও বিভিন্ন জায়গা, যেমন আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যাণ্ড ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম বড় বড় শুয়োর কেটে ঝোলানো রয়েছে অনেক দোকানে।এরা মাংস হিসাবে শুয়োর খুবই খায়।

ঝকঝকে রোদে, পরিষ্কার নীল আকাশের মাঝে সবুজের এই দেশে বাতাস একেবারে স্বচ্ছ। আমরা বলাবলি করছিলাম, যদি এখানে কিছুদিন থাকা যায়, পরিষ্কার অক্সিজেনে শরীর একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

এখানে প্রধানতঃ এদের প্রয়োজনীয় জিনিস বেশির ভাগটাই নিজেরা তৈরী করে। এরা অন্যান্য বাইরের পৃথিবীর থেকে আলাদা স্বয়ং সম্পূর্ণ জাতি  হিসাবে গড়ে উঠেছে। এদের নিজস্ব নিয়ম কানুন,  শাসন ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা আছে। গ্রামের শাসন ব্যবস্থা মোটামুটি ভাবে গ্রামে মাথা বা বয়স্ক প্রধান মাতব্বরই পরিচালনা করেন। এরা ধর্মগত ভাবে আজ প্রায় সবাই খ্রীষ্টান।এরা মূলতঃ চাষ বাসের উপরই নির্ভরশীল, কাজেই কোন সহজে জলের উৎস পাওয়া যাবে এমন ঝরণা বা নদীর কাছেই বসতি স্থাপন করে। কাজেই এদের উৎসব গুলি মূলতঃ কৃষি ভিত্তিক।

এদের তৈরী হাওরা শাল এবং চাংখম শাল খুবই সুন্দর। এদের কাল পাথর এবং কাদা মাটি দিয়ে তৈরী মৃৎশিল্প সত্যিই দেখার মত।একে বলে নুংবি মৃৎশিল্প। কুমোরের চাক ছাড়াই এরা এগুলো বানায়, এবং তা বানায় প্রধানতঃ পুরুষেরাই।যে গ্রামে সেগুলি হয়,  সেই গ্রামটির নাম লংপি। আমাদের আর গ্রামে যাওয়ার সময় হবে না।

উখরুলে যদিও থাকার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল আছে, এবং সেগুলো বুক করাও যায়, আমরা সেগুলোর দিকে আর তাকাই নি কারণ আমাদের হাতে আজকের দিনটিই সময়।এই হোটেলগুলিতে ভিড় হয় প্রধানতঃ শিরুই লিলি উৎসবের ও অন্যান্য উৎসবের সময়।

এই উখরুল হল মণিপুরের সর্বোচ্চ পাহাড়ী শহর।

আমরা পৌছালাম সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮৫০০ ফুট উপরে  সেই পাহাড়ে,যেখানে শিরুই লিলি ফোটে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। আগে এটি স্থানীয় মানুষদের উৎসব ছিল। বর্তমানে ২০১৭ সালে এই ফুলের উৎসবকে মণিপুরের জাতীয় উৎসবের সম্মান  এবং ১৯৬৯ সালে এই ফুলকে মণিপুরের জাতীয় ফুলের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।এই উৎসবের দিনক্ষণ সম্ভবতঃ প্রতিবছর আলাদা করে ঘোষিত হয়।তবে এটি এপ্রিল- মে মাস নাগাদই হয়।এই উৎসবে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসেন।তবে এই ফুল এতই কম দিন থাকে যে অনেক সময়ই নাকি দেখা যায় উৎসবের সময় ফুল তেমন নেই।ফুলটি ভীষণ সুন্দর এবং এটি মাটিতেই আপনা আপনি ফোটে।গাছটি ১-৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।এটি আর কোথাও পাওয়া যায় না।সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এটিকে বহুবার বহু জায়গায় লাগাবার চেষ্টা করা হলেও কোথাও একে বাঁচানো যায় নি। ফলে আর কোথাও এটি নেই।ঘণ্টার মত পিংক রঙের এই ফুলটি বড় সুন্দর।তবে বর্তমানে নাকি ফুলটি প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যে এসে গেছে। আমার মনে পড়ল প্রকৃতির কোলে এরকম আপনি ফুটে থাকা ব্রহ্মকমলের কথা।এই শিরুই পাহাড়টি সত্যিই খুব সুন্দর।এই শিরুই ফুলকে মনে করা হয় দেবী ফিলাভার কন্যা।দেবী থাকেন এই শিরুই পাহাড়ে এবং এই ফুলটিকে সমৃদ্ধি ও আনন্দের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

 আমরা পৌঁছালাম একটি ছোট গেটের মধ্যে দিয়ে ঠিক সেই পাহাড়টির নীচে, যেখান থেকে ট্রেকাররা ভোর বেলা যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যা নাগাদ পাহাড়ের মাথায় পৌঁছান। নীচে থেকে মাথাটি পরিষ্কার দেখা যায়। যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়,  সেখানেই রয়েছে উৎসবের মাঠ।একটি সরকারী বাংলোও রয়েছে। সামনে বিস্তৃত সবুজ ঘাসের লন। ওখানে ওই বাংলোর ছেলেটি ফোন নং দিয়ে বলল, যদি কখনও আসেন, বলবেন আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।  তার নাম সালমা, ফোন নং (961) 420-4133। ইমেল salma@ongshumali.com

বেশ সুন্দর ফাঁকা জায়গা।

কাছেই আর একটি জায়গায় গেলাম একটু দূরে পাহাড়ী পথ ঘুরে, জায়গাটির নাম ফাংরুই। এখানে পাহাড়ের মাথায় বেশ খানিকটা সবুজ ঘাসের লনের মত জায়গা রয়েছে। এখানে অনেকেই পিকনিক করতে আসেন তার প্রমাণ দেখলাম পড়ে থাকা নানা থার্মোকলের থালা গ্লাসের মধ্যে দিয়ে।এখানে সবাই এত পরিচ্ছন্ন, তবে এই নোংরামি, যা আমাদের মত শহুরে মানুষদের একচেটিয়া সম্পত্তি, তাদেরই কাজ হবে হয়ত।খুব বিসদৃশ লাগছিল ব্যাপারটা।

এত উঁচু থেকে নীচে গ্রামগুলো এবং সামনে ফাঁকা আকাশের নীল মন ভরিয়ে দিচ্ছিল।

আমরা যখন শিরুই এসে পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর আর এখন সূর্য রং ছড়াচ্ছে দিনের পরিপক্কতার।

এখানে আর একটি লাইমস্টোনের গুহা আছে কাংখুই তে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার কথা। সে খুব আগ্রহ দেখাল না, বলল, বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য দেখার মত নয়। এই ছেলেগুলি এমনিতে খুবই ভাল, বিশ্বাসী, ভদ্র। কিন্তু এরা কখনও কোন কিছুতে বেঁকে বসলে বা এদের জোর করে কিছু করাতে গেলে মুস্কিল। তাই আমরা আর জোর করলাম না। এমনিতেই পাহাড়ী রাস্তায় ফিরতে রাত হবে। ভাবলাম, যা দেখা হল তাই বা মন্দ কি!

ফিরলাম এক অভূতপূর্ব্ব মন ভাল করা অভিজ্ঞতা নিয়ে।

পরদিন সকালে সোজা ইম্ফল বিমানবন্দরের পথে।

মলয় সরকার। লেখক ও পরিব্রাজক।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..