ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
একই বৃন্তের দুই ফুল যেন ওরা। তোফা আর তাকিয়া দুই ভাইবোন। তোফা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, তাকিয়া পড়ে সপ্তম ক্লাসে। এক সাথে একই স্কুলে যায়। ফিরেও এক সাথে।
একজনের প্রতি আরেকজনের মায়া,দরদ অপরিসীম। খাবার কিম্বা খেলনা নিয়ে কখনও দু’জনের ঝগড়া হয়নি। মা অবাক হন ওদের পারস্পরিক ভালোবাসা দেখে। মনে মনে স্রষ্টার দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানান।
তোফা ও তাকিয়ার বাবা দুবাইয়ে থাকেন। ফলে দু’ভাইবোনের যত আবদান মায়ের কাছেই। সারাদিনের ঘটে যাওয়া বিচিত্র ঘটনাগুলো দু’জনে মায়ের সাথে শেয়ার করে। বাবার সাথে সখ্যতা হয় মাঝে মাঝে টেলিফোনে।
তোফা বাইরে কোথাও কিছু খেলে যথাসম্ভব চেষ্টা করে বোনের জন্য নিয়ে আসতে। ভীষণ ভালো বোন তার। ক্লাসে ফাস্ট, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ফাস্ট। পিছিয়ে কেবল নামাজের ব্যাপারে। নামাজ পড়তে সে আগ্রহী নয়। মা অনেকবার চেষ্টা করেছেন তাকে নামাজ পড়াতে। কিন্তু সফল হননি। ধমক দিলে অভিমানী মেয়েটা কান্না করে।
দিনভর কাঁদতে কাঁদতে শেষে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে! তাই তিনি কঠোর হতে পারেন না। দায়িত্বের ঘাটতি তবু তাঁকে নিরাশ করেনা। আল্লাহর কাছে তিনি মনের আকুতি জানান। এই বিষয়টা নিয়ে তাকিয়ার ওপর খুব মন ভার হয় তোফার। নানান গল্পের ছলে নানা ভাবে বুঝিয়েও কাজ হয়নি। তোফার নামাজের প্রথম অনুশীলন হয় তার দাদুর কাছ থেকে।
বয়স যখন তার পাঁচ বছর, তখন থেকেই আযান হওয়া মাত্র তােফাকে নিয়ে মসজিদের পথে ছুটতেন তিনি। বেশির ভাগ সময়ই বাড়ি থেকে ওযু করে যেতেন। তোফা দাদুর দেখাদেখি হাত মুখ ভেজাতো, মাথা মাসেহ করতো। তারপর বাবার দেয়া ছোট জায়নামাজ দাদুর জায়নামাজের পাশে বিছিয়ে নামাজ পড়া শুরু করতো।
দাদু রুকু করলে রুকু করতো, সিজদাহ করলে সিজদাহ করতো। বাড়িতে কোনো কোনো সময় হালকা বিশ্রাম নেওয়ার কালে আযান হলেই তোফা দৌড় দিত দাদুর ঘরে। জায়নামাজ কাঁধে নিয়ে দাদুকে ডাকতো। দাদুভাই! আযান গো। দাদু নাতির ডাকে চোখ খুলে প্রশান্তির হাসি হাসতেন। জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে মসজিদে রওনা হতেন।
নয় বছর বয়সে ভেঙে যায় সেই জুটি। এক কুয়াশাভেজা শীতের রাতে তারা দাদু ইহলোক ত্যাগ করেন। জীবনের প্রথম হোঁচট খায় তোফা। মসজিদে যাবার সময় ভীষণ কাঁদতো দাদুর হাতের ছোঁয়া না পেয়ে। কিন্তু নামাজ ছাড়েনি। বরং নামাযের সময় হলেই মনে পড়তো দাদুর কথাগুলো। দাদু বলতেন- নামাজ হলো বেহেস্তের চাবি। মরার পরে যে নামাজের হিসাব মিলিয়ে দিতে পারবে আল্লাহ তায়ালা তার হাতে বেহেস্তের চাবি দিবেন। আর শুধু নামাজ পড়লেই হবেনা, হতে হবে ভাল মনের ভাল একজন মানুষ। মিথ্যে বলা যাবেনা। যা কিছু মন্দ, অশ্লীল, খারাপ কাজ তা থেকে দূরে থাকতে হবে। যা কিছু ভাল, কল্যাণকর ; তার সাথে থাকতে হবে।
তোফা তখন এসব কথার মানে না বুঝলেও এখন বোঝে। বোঝে সব সময় নিজেকে ভাল মানুষ হবার চেষ্টা করতে হবে। মন্দ যা কিছু তা থেকে দূরে থাকতে হবে। যা কিছু ভাল তা গ্রহন করতে হবে। বোঝে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চাওয়া পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবার কথা, স্মরণশক্তি বৃদ্ধির কথা, বাবা মায়ের নেক হায়াত দান ও সুস্বাস্থ্যের কথা কিভাবে বাস্তবায়ন করেন। তোফা প্রতি মোনাজাতে দাদুর জন্যে জান্নাতুল ফিরদাউস চাইতে ভুলেনা। তাকিয়া নামাজের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভাবলেই কষ্ট পায় সে।
একদিন সন্ধ্যার কিছু আগে ডাইনিংএ বসে আছে তোফা ও তাকিয়া। ভাইবোনের প্রতিদিনের রুটিনে হাল্কা নাস্তার সময় এখন। টেবিলে রাখা নুডলস খেতে খেতে তাকিয়া বারবার তোফার দিকে তাকাচ্ছে। তোফা আজ খুব নীরব। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে তাকে।
তাকিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে ভাইয়া? কেন এতো চুপচাপ?’
তোফা জবাব দেয়, ‘কিছু হয়নি।’
তাকিয়া আবার বলে, ‘স্কুল থেকে ফেরার সময়ও দেখলাম নীরব ; এখনও দেখছি মনটা ভার! কী হয়েছে বলতো?’
তোফা এবারও বলে, ‘কিছু হয়নি।’
মা আরও কিছু নুডলস প্লেটে দিতে দিতে বললেন, ‘তুমি না মিথ্যে কথা বলো না বাবা? কী হয়েছে বলো?’
তোফা এবার একেবারে নিরব।
মা তোফার মাথায়- কাঁধে হাত বুলিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুলে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
তোফা এবার মনভার রেখেই মৃদু স্বরে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ মা। স্যার বকেছেন।’
একথা শুনে মা ও বোন তাকিয়া দুজনেই অবাক। তাকিয়া ভাবছে ভাইয়া তো বকা খাওয়ার মতো কিছু করেনা। কি এমন করলো যে বকা খেয়ে কান্না করছে!
মা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন বাবা? স্যার বকলেন কেন?’
বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে তোফা বললো, ‘ধর্ম শিক্ষা ক্লাসে আজ স্যার বলছিলেন কে কে আজ ফজরের নামাজ পড়েছো হাত তুলো। আমরা যারা নামায পড়েছি তারা হাত তুললাম। এরপর স্যার একজন একজন করে সবার পরিবারের অন্যান্যদের নামাযের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমার বোনের ব্যাপারটা জানতে চাইলে লজ্জায় আমি মাথা তুলতে পারিনি। বিশ্বাস করো মা, স্যার যখন বলছিলেন তোমার মা তোমার বোনকে নামায পড়তে বলেননা, তুমি বলোনা! তখন লজ্জা আর দুঃখে শরীর কাঁপছিল আমার। সবার সামনে আজ ছোট হয়েছি মা আমি।’
তোফার কথা শুনে তাকিয়া মাথা নিচু করে রইলো। লজ্জায় তারও মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তার জন্যই কিনা আজ তার প্রিয় ভাইটি অপমানিত হয়ে কাঁদছে! লজ্জা পেতে হয়েছে তার সব থেকে প্রিয় স্যারের কাছে!
মা ছেলের চোখ মুছে দিয়ে বললেন, ‘কেঁদো না বাবা। দেখো তোমার বোন নামায পড়বেই ইনশাআল্লাহ। তোমার এ লজ্জা ঘুচবেই।’
কথা শেষ করে টেবিলের উপর রাখা থালা বাটি নিয়ে মা ছুটলেন রান্নাঘরে। ততোক্ষণে তাকিয়াও তার রুমে চলে গেছে।
প্রতিদিনের মতো আজও তোফা ফজরের নামায শেষে ঘরে ফিরছিলো। মায়ের ঘরে পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো দেখে একটু দাঁড়ালো। মা ফজরের নামায শেষে নামাযের ঘরেই নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন। আজও করছেন।
ঘরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ফেরার পথে আলো দেখে আস্তে আস্তে পা ফেললো সেদিকে। দরজার পর্দা সরিয়ে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলো সে! জায়নামাজে দাঁড়িয়ে আছে তাকিয়া। তোফা দু’হাত দিয়ে চোখ কচলে ভালো করে তাকালো। না, ভুল দেখছে না সে। এ যে তারই আদরের বোন তাকিয়া । মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। তাকিয়া নামায শেষ করে মুচকি হেসে বললো, ‘কি রে ভাইয়া? তুই এখানে?’
তোফা আরেকটু এগিয়ে তাকিয়ার দুহাত ঝাপটে ধরে বলে, ‘আমি আমার রুমে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা আলো এসে ছুঁয়ে দিলো আমায়। কোত্থেকে সেই আলো আসছে সেটা খুঁজতে খুঁজতে এখানে আসলাম। এবার বুঝতে পারছি এটা কিসের আলো। তাকিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কীসের আলো?’
তোফা জবাব দেয়, ‘নামাজের আলো।’
মা ততক্ষণে কোরআন তেলওয়াত শেষ করে এসে দাঁড়িয়েছেন। তোফা আনন্দে ও আবেগের কণ্ঠে মাকে দেখে বলে, ‘মা! ও মা! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো সেই আলো? দেখোনা, পুরো ঘরে সেই আলো কিভাবে ছড়াচ্ছে!’
মা দু’জনকে দু’হাতে কাছে টেনে বললেন, হ্যাঁ বাবা। মন থেকে আল্লাহকে স্মরণ করে নামাজ পড়লে নামাজের আলো এমনই হয়। নামাজ সুন্দর ও আলোকিত করে অন্তর- মন।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..