নারীদিনের প্রাসঙ্গিকতা- সোনার পাথরবাটি

রাজশ্রী বসু
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
নারীদিনের প্রাসঙ্গিকতা- সোনার পাথরবাটি

সময় ছুঁয়ে যায় জীবনের প্রত্যেকটি প্রকাশ মাধ্যমকে। এটাই সময়ের ধর্ম। ঠিক তেমনি শিল্পও ছুঁয়ে থাকে সময়কে। বিষয়টি পারস্পরিক। বিষয়টি শর্তসাপেক্ষ। শিল্প যদি সময়ের অনুবর্তী না হতে পারে তবে তা কাল নিরপেক্ষতা অর্জন করতে পারে না। তাই কালোত্তীর্ণ হোক বা শিল্পত্তীর্ণ জীবনের সবক’টি প্রকাশকই হতে হবে সময় অবলম্বী।

আর পাঁচটি শিল্প মাধ্যমের মত চলচ্চিত্র বরাবরই সময়ের কথা বলে। একেবারে নির্বাক ছবির কাল থেকেই যদি ধরা যায় তাহলেও তা সমাজ রাজনীতির উত্থান পতনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চলাচলকেও সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে। সেক্ষেত্রে চার্লি চাপলিনের ছবি হোক বা একেবারে সমকালীন মিস্টার বিন – প্রত্যেকেই আসলে পাওয়া না পাওয়ার কথা বলেন। ব্যক্তিগত সাফল্য আর ব্যর্থতার পাশাপাশি তুলে ধরেন সমকালীন জীবন সংগ্রামের ছবি।

লিঙ্গ রাজনীতির কথা বলতে বসলে একথা বলাই যায় নারী কখনোই শিল্পীর সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়নি।একেবারে চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে শিল্পীর সব কটি জাঁরেই নারীর কথা উঠে এসেছে। শিল্পীর সচেতনতায় কিংবা অচেতনতায়  নারী কখনো দেবী রূপে পূজিত হয়েছেন কখনো তারা ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’

এখন প্রশ্ন হল ‘লিঙ্গ রাজনীতি’ বিষয়টি কী। ‘লিঙ্গ রাজনীতি’ শব্দগুচ্ছটির ইংরেজি পরিভাষা হল ‘Gender Politics’ । উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত সংজ্ঞা অনুসারে-

“Gender roles are considered by social constructionists to be hierarchical, and are characterized as a male-advantaged gender hierarchy. The term patriarchy, according to researcher Andrew Cherlin, defines “a social order based on the domination of women by men, especially in agricultural societies”.

অর্থাৎ লিঙ্গ রাজনীতি হল কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটা সামাজিক শৃঙ্খল। যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজবিন্যাসেরই একটি শর্ত। যা একইসঙ্গে মেয়েদের ওপর একটি অধিকার রক্ষার দাবী কায়েম রাখে।

বাংলা সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র বরাবরই পরস্পর অভিমুখী এবং পরস্পরের পরিপূরক। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের বহু আগে থেকেই সাহিত্যের সূত্রপাত হয়েছিল। চর্যাপদ থেকে শুরু করে যদি বাংলা পাঠ্যগ্রন্থগুলি পাঠ করা যায় তাহলে লিঙ্গ রাজনীতির চিহ্নগুলিকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। পাঠকের মনে থাকবে ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরী’র কথা। পাঠকের মনে থাকবে ‘এক সে শূণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধহ’ প্রভৃতি পদের কথা।

নারী তার আপন মাংসের জন্য নিজেই দায়ী এই দূরদর্শিতার নমুনা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রতিটি ছত্রের উপপাদ্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজনীতির ফলাফল। কৃষ্ণ স্ময়ং এবং বড়াই দুজনেই প্রবলভাবে লিঙ্গ রাজনীতির ন্যক্কারজনক দিকটিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

সাহিত্য সমাজ জীবনেরই প্রতিফলক। ত্রয়োদশ শতকের সমাজবোধ যেমন ফুটে উঠেছে ত্রয়োদশ শতকের সাহিত্যগ্রন্থে, ঠিক তেমনই মঙ্গল যুগের সাহিত্যেও আছে তুর্কি আক্রমণোত্তর সমাজছবি। কেবলমাত্র লৌকিক দেবীর উত্থান নয়, রীতিমত শৈববাদীদের পৌরুষপ্রাধান্যের ভিতর দিয়ে নারী দেবতার আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত নির্মিত হয়েছে। সেখানে প্রতিষ্ঠাকামী নারীকে হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ চেহারা দেওয়া হয়েছে। ভারতচন্দ্রও যে নারী দেবতাকে নির্মাণ করলেন, তিনি কেবল বাঙালি সংস্কৃতিতে মা হয়েই রইলেন। নারীর স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি সমকালীন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন শাক্ত পদকর্তারা।

আচার্য মনু তাঁর স্মৃতিশাস্ত্রে লিখেছিলেন, নারী কখনোই স্বতন্ত্র হতে পারেন না।

“পিতা রক্ষতি কৌমারে
ভর্তা রক্ষতি যৌবনে
পুত্রশ্চ স্থবিরে
ভাবেন স্ত্রী: স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।”

নারীর এই বিশেষ ভূমিকা থেকে মুক্তি পান নি স্বয়ং দেবতারাও। আর তারই ধারাবাহিকতা বর্তেছে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলিতে।

নারী যে স্বাতন্ত্র্যহীন সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে। নবপর্যায় বঙ্গদর্শন ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৮-১৩০৯ বঙ্গাব্দে) চোখের বালি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয় ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায়। ১৯০৩ থেকে ২০০৩ এই সুদীর্ঘযাত্রায় নারী এখনো স্বাতন্ত্র্যহীনা। নারী যখনই স্বতন্ত্র হতে চেয়েছে, তার পরিণতি হয়েছে গৌরী লস্কর। বঙ্কিমচন্দ্রের রোহিনী হোন কিংবা রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী- নারী যখনই নিজের চাওয়া পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে, হয় তাকে হত্যা করা হয়েছে; নয় তো পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কাশীতে।

একবার শূর্পনখার কথা মনে করুন। ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়ে তাকে শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে। এই সমাজের ছবি নিয়েই নির্মিত হয়েছে একালের চলচ্চিত্র। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখিত ‘দহন’ উপন্যাসটি। এটিও একটি সামাজিক অসাম্য অনুভবের পাঠ্য।

প্রায় একদশক আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লিঙ্গ রাজনীতি’ বিষয়ক একটি কর্মশালায় প্রাপ্ত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল মেয়েরা পরিবার কাঠামো বদলে ফেলার পক্ষে দ্রুত এবং স্পষ্ট ভূমিকা পালনের পক্ষে বিশেষ পক্ষপাতী। কর্মশালায় উপস্থিত প্রায় চল্লিশ শতাংশ মহিলাই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির দ্রুত বদলের পক্ষে সওয়াল করলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপন বদলাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের নিজেকে নিয়ে ভালো থাকার দৃষ্টিভঙ্গী।

সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র বরাবরই পরস্পরমুখী। এবং দুজনেই জীবনসম্ভূত। আর জীবন সম্পর্কিত মূল্যবোধের ছাপ ধরা পড়ছে আর বিনোদন বিন্যাসে। মনে করা যেতে পারে অন্তহীন ছবিটির কথা। মনে করা যেতে পারে তার একবছরের ব্যবধানে বানানো হয়েছিল অপর্ণা সেন পরিচালিত দ্য জাপানিজ ওয়াইফ ছবিটা। ঠিক আমাদের চেনা কাঠামোয় নির্মিত সুখ খুঁজে নেওয়া ছবি নয়। বরং অচেনার ভিতর দিয়েই জীবনকে চিনে নেওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে পরিচালকদের সৃষ্টি কৌশলে।

প্রত্যেকটি ছবিতেই একটা করে প্রজন্ম বদলের গল্প আছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে পড়ছে। আর সমান্তরালে গড়ে উঠছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শন, সম্পূর্ণ আলাদা মূল্যবোধ। বিপরীতমুখী দুইটি অনুভবের মধ্যে দাঁড়িয়ে লিঙ্গ রাজনীতি কী বিপুলভাবে তার ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে তার প্রমাণ আমাদের কথাসাহিত্য এবং চলচ্চিত্র।

নারী; পৃথিবীর একটি অত্যন্ত অসহায় শব্দ। যুগের পর যুগ পেরিয়ে সে কেবল হয়ে উঠতে পেরেছে সংস্কৃতির কাঁচামাল। নারী এখন চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হতে পারে। হতে পারে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারী একেবারেই স্বাতন্ত্র্যহীন। পুরুষতন্ত্র নামক সিস্টেমের সঙ্গে সহযোগ সম্পর্কে থাকতে থাকতে নারীও তার বেঁচে থাকাটাকে আপসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দহন চলচ্চিত্রের প্রতিবাদী চরিত্র ঝিনুকও তো শেষ অবধি প্রেমিকের শর্তে আপস করে। আপস করতে হয়। আপস করতে হয় নয় নম্বর গলফ ক্লাব পাড়ার ছোটো বউ রনিতাকে। আপস করতে হয়েছিল ঝিনুকের ঠাকুরমাকেও। এভাবেই দ্বিধাহীন আপসের পথে প্রজন্মের চলার পথ মসৃণ হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন হল, সত্যিসত্যিই কী আপসের রাস্তায় হাঁটলেই মেয়েদের চলার পথ মসৃণ হয়? না কী ভালোবাসাহীন, অভিমানভরা দীর্ঘজীবন মেয়েদের কাটাতে হয় সম্পূর্ণ একা! দহন চলচ্চিত্রে রনিতার বাবা মেয়েকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘ছোটোখাটো কিছু স্বাধীনতা বিসর্জন দিলে মানুষ মরে যায় না’। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার আবার ছোটো বড় কী!স্বাধীনতা – স্বাধীনতার স্বপ্ন- একসময় মেয়েদের বেঁচে থাকার পরিপূরক হয়ে ওঠে। মনে করতে হবে ‘পারমিতার একদিন’ ছবিটির কথা।

ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে ধরা পড়েছে মেয়ে জীবনের যন্ত্রণারা। শাশুড়ি মা সনকা সারাজীবন ভালোবাসাহীন একটা জীবন বহন করেছে। পুত্রবধূর জীবনেও সেই বঞ্চনার পুনরাবৃত্তি। তাও শেষঅবধি পারমিতা ভেঙে ফেলতে পারে পুরুষতন্ত্রের চেনা খাঁচাটিকে। এই পারাটুকুই তো জেতা। পারমিতার শাশুড়িমা যা পারেননি সেই না পারাগুলিই ইতিবাচকতার ডানা মেলেছে পারমিতার নতুন করে বেঁচে নেওয়ার ভিতর দিয়ে।

নতুন করে বাঁচা, নিজের ইচ্ছেতে বেঁচে থাকার দুরূহ আকাঙ্ক্ষা নিয়েই লেখা হয়েছিল সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস। এই উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। কিন্তু ঝিনুক আর রনিতা একাকীত্বকেই আশ্রয় করেছিল। দাম্পত্য জীবনের পূর্ণতা আমাদের কেবল নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে শেখায়। এই ভুলে থাকার মধ্যে কতখানি যে আপস আছে তাকে পরিমাপ করা যায় না বেশিরভাগ সময়েই।

রাজশ্রী বসু, পিএইচডি। লেখক ও অধ্যাপক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়। পেশাগত জীবনে তিনি কলকাতার টিডিবি কলেজে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..