করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
নারীদিবস দিনটি অর্থাৎ ৮ই মার্চ তারিখটি নারীদের জন্য নির্দিষ্ট করার এই সিদ্ধান্তটিতে তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশেরই হাত নেই। দিনটি এসেছে সুদূর আমেরিকা থেকে। কিন্তু কেন? একটি দিন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
অবিভক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস একটু ঘাঁটলে জানা যাবে আর্যযুগে এই দেশেই ছিলেন গার্গী, অপালা, লোপামুদ্রা নামের নারী যাঁদের জ্ঞান ও পান্ডিত্যের প্রমাণ তাঁরা রেখে গেছেন বেদ ও উপনিষদে। আরেকটু পিছিয়ে গেলে জানা যায় সিন্ধু সভ্যতার সময় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। অবিভক্ত বাংলাদেশেও জানা যায় খনা বলে এক বিদুষী নারীর যিনি তৎকালীন পণ্ডিত বরাহমিহীরকে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন।
তাহলে সেই দেশেই কেন নারীরা এতটা পিছিয়ে পড়ল যে তাদের এগিয়ে আনার জন্য সমাজ সংস্কারকদের এগিয়ে আসতে হলো? কেন সেই দেশে সতিদাহের মতো একটি বর্বর রীতি প্রচলিত হলো? মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের গভীর গবেষণার মাধ্যমে জানিয়েছেন শ্রেণী শোষণই নারীদের পিছিয়ে পরার একমাত্র কারণ। এঙ্গেলস তাঁর ‛পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থে বলেছেন যখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে শোষণ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা চলে এসেছে তখন থেকে শুধুমাত্র শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত শোষিত হয়েছে তাইই নয়, তাদের মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে নারীরাও শোষিত হতে শুরু করলো। আবার পারিবারিক জীবনেও তারা পুরুষের অধীন হয়ে শোষিত হয়েছে। ক্রমশ সম্পত্তির অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে, সমাজে উৎপাদনশীল সব কিছু থেকে সরিয়ে তাদের গৃহদাসীতে পরিণত করা হয়েছে। দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, ধনতান্ত্রিক সমাজ এসব নারীর শ্রমের ওপরেই পারিবারিক প্রথার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে।
প্রাচীন ভারতে বহুবিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল। একজন কুলীন ব্রাহ্মণ তার জীবদ্দশায় যতগুলি সমভব বিবাহ করে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের উদ্ধার করে তার বদলে তারা পণ ও যৌতুক নিয়ে নিজেদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করতেন। সেই তালিকায় স্থান পেত পাঁচ বছরের বালিকাও। এই ব্যক্তির মৃত্যুর পরে সেই তরুণীদের উঠিয়ে দেওয়া হতো সহমরণে। এখানেও কিন্তু অর্থনৈতিক রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায়। মৃত ব্যক্তির সব স্ত্রীরা যাতে বিপুল সম্পত্তির দাবী করতে না পারে সেই বিপত্তি আটকাতে এই ঘৃণ্য প্রথার জন্ম। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথা রদ করেন রাজা রামমোহন রায়। তবে তার জন্য তাকে প্রচুর বাধা অতিক্রম করতে হয়।
সতীদাহ প্রথা রদ হওয়ার পরও সমস্যার সমাধান হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বুঝতে পারেন এই বিধবা নারীদের প্রতিদিন এত কঠোর কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হতো যা একপ্রকার নির্যাতন। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে তিনি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগীতায় পাশ করেন বিধবা বিবাহ আইন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই কাজের জন্য প্রচুর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। আসলে যুগ যুগ ধরে যারাই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারাই পেরিয়েছেন কণ্টকাকীর্ণ পথ।
ভারতীয় নারীরা একটা বিরাট সময় ধরে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। তাদের বোঝানো হয়েছিল মেয়েরা শিক্ষিত হলেই তারা পাপের ভাগী হবে। এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। যদিও ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট মে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মিস মেরি অ্যন কুক ভারতবর্ষে ৩০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেও সেই বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীর পরিমাণ খুবই কম ছিল। আসলে সেইসব স্কুলে বাইবেল শিক্ষা দেওয়া হতো এবং হিন্দু মহিলারা ধর্মান্তরিত হওয়ার ভয়ে স্কুলে পা দিতেন না। এই সমস্যার সমাধান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও ড্রিংক ওয়াটার বেথুন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলো বেথুন গার্লস স্কুল। তবে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার আরেকজন হোতার নাম না বললেই নয়, তিনি ছিলেন আরেকজন নারী বেগম রোকেয়া সাখোয়াত। তিনি আমৃত্যু নারী শিক্ষার সচেতনতা প্রচার করে গেছেন। তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে নারীরা এক অন্ধকার অধ্যায়। তবে তা শুধুমাত্র ভারত ও তার আশেপাশের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নারী নির্যাতন ছিল প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেও। স্বাধীনতার পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য স্থাপন করে বিভিন্ন কলকারখানা। সেখানে কাজ শুরু করেন যারা তারা তাদের সমগ্র পরিবার নিয়েই কাজে নেমে পড়েন। সেখান থেকেই তাদের কষ্টযাপন শুরু। ১৯০৭ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনের বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী ক্লারা জেটকিন আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিকদের সংহতির ডাক দিলেন। এর আগে যদিও ১৮৬৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনে মার্কস ও এঙ্গেলস শ্রমজীবী নারীদের ট্রেড ইউনিয়নের সভ্য করার আহ্বান জানান। সেইসময় পুরুষরা এই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়নি। কিন্তু জেটকিনের ডাকে আমেরিকান নারীরা এগিয়ে আসেন। বাস্তবিক সেই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
স্বাধীনতা পূর্ব যুগে রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে বসে বিতর্ক ও বিরোধিতার সম্মুখীন হন। পুত্রসন্তানহীন জমিদাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন প্রণয়ন করে ইংরেজ সাম্রাজ্য। নারীদের সম্পত্তির অধিকার প্রথম থেকেই খর্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাম উঠে এসেছে বহু নারীদের। দেশ পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলা-ধূলা, শিক্ষা, চিকিৎসা শাস্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চাকরি সমস্ত ক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছেন নারীরা। মধ্যযুগীয় পর্দাপ্রথা, পণ প্রথা, বধূ হত্যা, তিন তালাক পেরিয়ে আজ নারী স্বনির্ভর। তবুও কি উত্তরণ হয়েছে?
উত্তরাখণ্ডের উত্তর কাশীতে ১৩২টি গ্রামে তিনমাস ধরে জন্মেছে শুধু পুত্র সন্তান। যেখানে আদর্শ জন্ম হার হওয়া উচিত ১০০০ পুরুষ শিশুতে ১০০৫ টি কন্যা শিশু, সেখানে হিসেব মতো ২১৭,০৮ টি কন্যা ভ্রূণ বা শিশুকে হত্যা করেছে তার বাড়ির লোক, বাবা-মা। মা’টি এখানে একটি সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্র। তার প্রতিবাদের ভাষা গলা টিপে রোধ করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের একটি চা বাগানে বেশিরভাগ মহিলা কর্মীর জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। মাসিক বা গর্ভাবস্থা চলাকালীন মহিলা কর্মীটি কাজ না করেও মজুরি পাবে, এতে মালিক পক্ষের ক্ষতি। সেই ক্ষতি রুখতে মালিক পক্ষ কিছু অর্থলোভী ডাক্তারদের সাথে হাত মিলিয়ে এই অশিক্ষিত মহিলাদের যেকোনো অছিলায় অপারেশন করিয়ে জরায়ু বাদ দিয়েছেন। এর ফলে যে ব্যাধি বাসা বাঁধছে তাদের শরীরে তা ঘুনাক্ষরেও জানেন না তারা। একটা বিশাল সংখ্যক আদিবাসী মহিলারা আজও মাসিক চলাকালীন স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করতে পেরে গোপন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সচেতনতা কোথায়? যে দেশে মাটিকে মা মনে করা হয় সেই দেশই ধর্ষণে গোটা বিশ্বে দশম। সেই নারকীয় কান্ডে যেমন আঠাশ মাসের শিশু আছে তেমনই আছে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা। আরো দুঃখজনক এইসব অপরাধের বিচারের প্রহসনে নষ্ট হয় দেশের সম্পদ।
শুধু শারীরিক নয় সমাজিকতাতেও নারীকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়ম চাকুরিরতা নারীকে একের পর এক টপকাতে হয় কর্মজীবন, সংসার, সন্তান প্রতিপালনের হার্ডল। সেই তুলনায় পুরুষদের পথ কিছুটা হলেও পরিষ্কার। এছাড়াও গৃহবধূ বা গৃহদাসীদের পরিশ্রমের সমান মূল্য তারা পায়না। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ভালোবাসার কর। তাদের শুধুমাত্র ভালোবাসা বা কর্তব্যের খাতিরে ছেড়ে দিতে হয় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন, ভালোলাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে। সেই পারিশ্রমিক কিন্তু কোনদেশের অর্থনীতিই ক্যালকুলেট করে না বা করতে পারে না। শহরে হৈ হৈ রৈ রৈ করে যেদিন পালিত হবে নারী দিবস বা তার প্রহসন। সেদিন হয়তো কোন অনুন্নত গ্রামে কোনো মহিলা বাড়িতে শৌচাগারের অভাবে মাঠে যাবে আর গণধর্ষণের স্বীকার হবে। তারপর পর্দায় ভেসে উঠবে শুধুই ব্রেকিং নিউজ আর মহিলাটির ঝলসানো দেহ।
যে নারীর ঋতুস্রাব না হলে বিশ্ব চরাচর আর এগোবে না। জন্ম হবে না কোনো মানুষের সেই নারীকেই মাসিক চলাকালীন ব্রাত্য বলে ঘোষণা করা হয়। তারা পুজো বা যেকোনো শুভ কাজে অনাকাঙ্ক্ষিত। মন্দির বা মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ তাদের। এদিকে কামাখ্যা মাতার মাসিক চলাকালীন অম্বুবাচিতে তার যোনির ওপর রাখা কাপড় মাদুলি করে গলায় ঝোলায় রক্ষাকবচ হিসেবে এই ধুরন্ধর অশিক্ষিত সমাজ। কি বিচিত্র এ পৃথিবী!
পুরুষতন্ত্র শুধুমাত্র পুরুষদের গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত সমাজ নয়। এর পিছনে রয়েছে একটি নীরবে মেনে নেওয়ার অপরাধ। পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক শুধু পুরুষরাই নয়, মেয়েরাও। তারাও প্রথম থেকে নিজেদের মেরুদন্ড সোজা করে এগিয়ে যায়নি। বরং পরস্পর্কে টেনে নীচে নামিয়ে দিয়েছে। তারা এগিয়ে যেতে দিয়েছে সমাজের একটি দলকে। নানান নিয়ম বানিয়ে পুরুষকে প্রধান বানিয়েছে। পুরুষের পায়ের তলায় উৎসর্গ করেছে নিজেদের। আর নিজেরা পিছতে পিছতে এতটা পিছিয়ে গেছেন যে তাদের সেই অতলান্ত থেকে টেনে বের করতে এগিয়ে আসতে হয়েছে কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। আসলে মাতৃতন্ত্রই পিতৃতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে।
নারীদিবস সেদিন সফল হবে যেদিন gender equality আসবে সমাজে। যেদিন নারী পুরুষ বিভেদ উঠে গিয়ে সাম্য আসবে। সেদিন হয়তো আলাদা করে নারী বা পুরুষ দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তাই পড়বে না কারুর। যেদিন শিক্ষার আলো পৌঁছবে প্রত্যেক মনে। যেদিন নারীকে শুধু শরীর না ভেবে মানুষ ভাবার উদারতা আসবে সকলের মনে সেদিন নারীদিবস সফল হবে। নারীদিবস সেদিন সফল হবে যেদিন নারীই নারীকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। পৃথিবী হবে সুন্দর, নির্মল।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..