নারীদিবসে তিনটি তর্জমা কবিতা

আজফার হোসেন
কবিতা, নারী
Bengali
নারীদিবসে তিনটি তর্জমা কবিতা

পুরুষতন্ত্রের তোমরা যারা

মূলঃ মার্থা ভিয়ানুয়েভা (পূর্তো রিকো’র কালো কম্যুনিস্ট নারীবাদী কবি)

ভীষণ উপুর-করা দুপুর খাঁ খাঁ, আমার দেহ ঝলসে যায়
আর আমার চামড়ার ওপর তোমাদের স্পর্শরা তাঁবু গাড়ে।
রঙমহলের অবিরত উৎসবে আপাদমস্তক ঝলসে যায়,
ঝলসে ঝলসে ঝলসে যায়; ঝলসে ঝলসে ঝলসে যায়।

হা হা হাহাকারে মরু হাওয়ায় ভেসে যাওয়া ধবনি সব আর্তনাদ করে,
তাদের গতরে গতরে মাটির আদিম গন্ধ, ঢেউ-তোলা কারুকাজে
শ্রমের গন্ধ, শিশুর নাড়িতে তারই অন্তরের ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক,
সেও ঝাঁ ঝাঁ ঝলসানো দুপুরে; এরপরও বলো, তাদের ইতিহাস কই?
তারপরও নৈঃশব্দকে করাত দিয়ে চিরে চিরে তারাই তো দেখায় ইতিহাস।

তেপান্নটি অলিগলি মাড়িয়ে সবাই যখন ভরাট রাতের মুখোমুখি
তোমাদের দিনে দিনে বেড়ে ওঠা সাজানো-গোছানো অন্ধকারে
ভিক্ষা শেখানো শিক্ষায় কেবলি তর্জনি নির্দেশ, কেবলি রক্তচক্ষু
কিংবা শুধুই সূর্য ঢেকে দেয়া রক্তপাত বা বন্দুক-বুলেট-বেয়োনেট।

তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা
তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা
তোমাদের শিক্ষা শেখায় ভিক্ষা

পুঁজি শেখায় ভিক্ষা
উপনিবেশ শেখায় ভিক্ষা
বিশ্বব্যাংক শেখায় ভিক্ষা
পুরুষালি আইন শেখায় ভিক্ষা
অর্জনে
তর্জনে
গর্জনে
বর্ষণে
ভিক্ষা
ভিক্ষা
ভিক্ষা

বিশেষ্য থেকে সর্বনামে কিংবা ক্রিয়াপদের চঞ্চল আবাহনে
তোমাদের তাবৎ আখ্যানের পরতে পরতে ক্ষমতার ক্ষ্যাপা দাপটে
শীতের চাবুকে চাবুকে, মসজিদের প্রবেশ পথে, ভিক্ষাপাত্র হাতে
কঙ্কালসার দেহ নারী থাকে, ঘুরপাক খায়, আবারো ছোটে সে।
থাকে সে তোমাদের তাবৎ জাল-ফেলা জ্যামিতির ভেতরে ভেতরে,
যেমন তোমাদের হে হে করা পুরুষালি জাতীয়তাবাূত
কিংবা ঘেউ ঘেউ করা পেশী-ফোলানো নন্দনতত্ত্বে বারবার
মাটি নারী হয়, নারী হয় নদী, নারী হয় নক্ষত্র, নারী হয় জাতি-
কিন্তু কার থাবায় দাউ দাউ জ্বলে সেই নদী-নক্ষত্র-জাতি-দেশ?
কার আততায়ী ইশারায় তছনছ সেই দেহ, সেই মাটি, সেই ভিটে?

বচনে বসনে বিজ্ঞাপনে বিপণনে সাবানের রকমারি-ঝকমারিতে
কিংবা কোকাকোলা-পেপসির ফুঁসে ওঠা ফেনায় ফেনায়
দেহ বিকোনোর দালালদের তকমায় তকমায়, জোব্বা-পরা মুরুব্বিদের
শাস্ত্রে শাস্ত্রে, ভণ্ডামির পিঠে পিঠে আমরা দেখি শ্রমবিদ্ধ নারী,
গুলিবিদ্ধ নারী, এমনকি তোমাদের উপমা-রূপক-বিদ্ধ নারী,
আর ওই দেবদূতের গান পান করে এখন মশগুল হরেক রকম কর্তা।

কিন্তু দেশের শস্যের দানায় দানায় নারী, ক্ষেতে-মাঠে-মিলে-
কারখানায় নারী, একেবারে বাড়ির ভেতরে ভেতরে নারী,
তোমার সন্তানের পাতে পাতে নারী, উন্নয়নবিশারদের বানোয়াট
পরিসংখ্যানে-পরিসংখ্যানে নারী, শাসনতন্ত্রের মার্জিনে নারী,
প্লেটো-এরিস্টটল-দেকার্ত-ফ্রয়েডের পাদটীকায় নারী,
আবার জেগে ওঠা ভোরের ফেটে পড়া রক্তলাল আলোতে নারী,
কিংবা রাস্তায় ঝরা টকটকে গোলাপের মতো অঢেল রক্তে নারী,
বিস্ফোরকের মতো টগবগ করা আগুন-ধরা ভাষণে ভাষণে নারী
নারী নারী নারী নারী নারী নারী নারী নারী নারী নারী নারী মার্চে নারী
আর উজ্জ্বল সময়ের সংকেতে আমরা নিশ্চিহ্ন করবো তোমাদেরঃ

আমরা আছি
আমরা আছি
আমরা আছি
আমরা আছি

এই পরিচিত ইতিহাসেই
আমাদের মুছে ফেলা সব আখ্যানকে
আগ্নেয়গিরি বানাবার এই লড়াইয়ে

আমরা আছি।

 

আরো দুর্দান্ত প্রেমের জন্য

মূলঃ রোকে ডাল্টন (লাতিন আমেরিকার কম্যুনিস্ট কবি)

সকলেই মানেন যে, যৌনতা
প্রেমিক-প্রেমিকার পৃথিবীতে শর্ত বটেঃ
এ-কারণে পেলবতা আর তার বুনো শাখা-প্রশাখা

সকলেই মানেন যে, যৌনতা
পরিবারের অভ্যন্তরে দারুণ প্রয়োজনীয়ঃ
এ-কারণে সন্তান-সন্ততি,
এক সঙ্গে রাত্রি যাপন
আর দিনে আলাদা থাকা
(পুরুষ জীবিকার কারণে থাকে রাস্তায়,
অফিসে কিংবা ফ্যাক্টরিতে;
নারী থাকে পারিবারিক কাজের পশ্চাৎরক্ষী সৈনিক হিসেবে,
রান্নাঘরের রণকৌশল আর রণনীতিতে
যাতে অভিন্ন লড়াইয়ে তারা টিকে থাকে
নিদেনপক্ষে মাসের শেষ পর্যন্ত।)

সকলেই মানেন যে, যৌনতা
একটি অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিঃ
এ-ক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের উল্লেখ করাই যথেষ্ট,
কিংবা ফ্যাশনের কথা
সংবাদপত্রে নারীর জন্য বরাদ্দ আলাদা পাতা
কিংবা পুরুষের জন্য।
কিন্তু ঝামেলা বাধে তখনই
যখন একজন নারী বলে ওঠেন—
যৌনতা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ক্যাটাগরি।

কেননা যখন একজন নারী বলে ওঠেন—
যৌনতা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ক্যাটাগরি,
ঠিক তখনই তিনি কেবল নারী থাকেন না,
তিনি হয়ে ওঠেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন নারী
নারীর পক্ষে নারী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন
তিনি তাঁর যাত্রা শুরু করেন মানুষ-হওয়া থেকে,
যৌনতা থেকে নয়,
আর তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন, কেননা তিনি জানেন,
যে কর্পোরেশন তৈরি করেছে লেবুগন্ধী ডিওডোরেন্ট আর সাবান
যেগুলো ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিতে স্পর্শ করে তাঁর চামড়া,
সেই একই কর্পোরেশন বানিয়েছে বোমা বা নেইপাম;
কেননা তিনি জানেন, যে-কাজ ঘরের
সেই কাজ সামাজিক শ্রেণীরও, কেননা ঘর সমাজের বাইরে নয়।

তিনি জানেন, নারী আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য
আরও বেশি জ্বলজ্বল করে ওঠে গভীর প্রেমভরা রাতে
যখন আমাদের সকল গোপন-রাখা বিষয়
যা আমাদের মুখোশ পরিয়ে অপরিচিত করে রেখেছিল
জানাজানি হয়ে যায়।

 

উদ্বৃত্ত মূল্যের উপর, অথবা মালিক দুইবার ডাকাতি করে প্রতিটি শ্রমিককে

মূলঃ রোকে ডাল্টন (লাতিন আমেরিকার কম্যুনিস্ট কবি)

নারীর গার্হস্থ্যশ্রম
পুরুষের জন্য সময় বের করে
যাতে সে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় কাজটা
সারতে পারে
যার জন্য সে আবার পুরা মজুরিটাও পায় না
(তার বড় অংশের মূল্যকে
পুঁজিপতি ডাকাতি করে নিয়ে যায়)
পায় ততোটুকু
যাতে সে বেঁচেবর্তে থাকে আর কাজ
করে যেতে পারে
সেই মজুরি নিয়েই
পুরুষ বাড়ি ফেরে
আর বউকে বলে:
দ্যাখো, টাইনাটুইনা চালায়া নিতে পারো কিনা
যাতে ঘরের কাজের সকল খরচাপাতি
মিটাইতে পারো।

আজফার হোসেন, পিএইচডি। তাত্ত্বিক, সমালোচক, একাডেমিক, দ্বিভাষিক লেখক, অনুবাদক এবং শিক্ষক। জন্ম বাংলাদেশ। বর্তমান নিবাস মিশিগান, আমেরিকা। পিএইচডি করেছেন ইংরেজি ও বিশ্ব সাহিত্য বিষয়ে। পেশাগত জীবনে চাকরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি মিশিগানের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, লিবারাল...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..