সমপ্রেম ও বিবাহ
চমৎকার সামার এর বিকেল।জুন মাস। লালচে দীর্ঘ সোনালী বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে হাডসনের জলে। নিউইয়র্ক…..
লিখেছেন: মাসকাওয়াথ আহসান
কোথাও বিমান দুর্ঘটনা হলে সে খবর মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বড় জায়গা দখল করে। সমাজ অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে বিষয়টি নিয়ে। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে বড় অংকের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। নিহত পাইলটকে নিয়ে রচিত হয় শোকগাথা।
কিন্তু কোথাও বাস দুর্ঘটনা বা লঞ্চ ডুবে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে মিডিয়ায় খবরটা আসে। কিন্তু তা বড় জায়গা দখল করে না। খুব কম ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়; পেলেও তা ছোট অংকের। আর বাসের নিহত ড্রাইভার বা সারেং-কে নিয়ে শোকগাথা তো দূরের কথা; পারলে তার শব ব্যবচ্ছেদ করে নাগরিক সমাজ।
এই যে একটা শ্রেণী বোধ ও বিভাজন চর্চা ; মানুষের গুরুত্ব তার শ্রেণী অবস্থান দিয়ে নির্ধারণ করার যে ক্লিশে মনোজগত তা সত্যিই আহত করে। এই বিষয়টি ঘুরে ফিরে সব ক্ষেত্রেই ঘটে। হ্যাভসদের আনন্দে হাসতে; তাদের বেদনায় কাঁদতে কাঁদতেই সবার বেলা চলে যায়; হ্যাভ নটসদের ছোট ছোট আনন্দ বা বড় বেদনার ক্যানভাসটি মনোযোগের আড়ালে রয়ে যায়।
সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলনের মাঝে হ্যাভস-দের সমস্যাগুলো অনেক বেশি আলোচিত হয়; কিন্তু হ্যাভ নটসদের সমস্যাগুলো অনালোচিত থাকে।
যে আন্দোলন কেবল অল্প-সংখ্যক মানুষের মুক্তির কথা বলে; আর বেশি-সংখ্যক মানুষের মুক্তির কথা প্রায় উপেক্ষিত থাকে; তা নিয়ে পুনর্ভাবনার সুযোগ রয়েছে নিশ্চিতভাবেই।
আমাদের সমাজ আদিতে মাতৃতান্ত্রিক ছিলো। খুব সম্ভব শ্রম ঘন সমাজে শারীরিক শক্তিতে পুরুষ নারীর চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকার সুযোগে পুরুষতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু সমসাময়িক কালে অটোমেশানের কারণে শারীরিক শক্তির চেয়ে মানসিক সামর্থ্য আবার গুরুত্বের জায়গা ফিরে পাচ্ছে। ফলে যুদ্ধবিমান থেকে পাবলিক বাস চালানোর ক্ষেত্রে নারী পিছিয়ে নেই।
শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা সব ক্ষেত্রেই নারী পুরুষকে অতিক্রম করেছে। হালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশেই নারীর সাফল্য নজর কাড়ার মতো। নারী ফুটবল দল, ক্রিকেট দলের সাফল্য প্রণিধান যোগ্য। ফলে নারীকে আর অনুগ্রহ করে ক্ষমতায়িত করার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। একবিংশ শতক যে নারীর সক্রিয়তার শতক; তার উদ্ভাস স্পষ্ট।
মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা সরিয়ে পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার মসনদ দখল করার পর; পুরুষ পরিচালিত সভ্যতা ধরিত্রীকে নারীর মতোই অবহেলা ও নির্যাতন করেছে। এই যে বিপর্যস্ত ধরিত্রী; তাকে একমাত্র বাঁচাতে পারে নারীরাই। কারণ ধরিত্রীকে নারী যতটা বোঝে; পুরুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় বলে মনে হয়। তাই একবিংশের সভ্যতার মেরামতিতে নারীর ভূমিকা হবে সর্বাগ্রে; এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
পুরুষ ধরিত্রী বাঁচাতে খুব কার্যকর হবে বলে অতীতের অভিজ্ঞতা অন্তত কোন ইঙ্গিত দেয় না। ঠিক তেমনি ধরিত্রীর মতোই যে নারী; তাকে নানারকম নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে নারীকেই সংঘবদ্ধ হতে হবে।
নারী আন্দোলনে সাধারণত সক্রিয় হন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীরা। নিম্নবিত্তের নারী গার্মেন্টস-এ একই শ্রম দিয়ে পুরুষের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পান, পুরুষ গাড়ি চালকের চেয়ে অনেক বেশি শ্রম দিয়ে অনেক কম পারিশ্রমিক পান নারী গৃহকর্মী। এরকম অগণিত বঞ্চনার ঘটনা ঘটে নিম্নবিত্ত নারীর জীবনে। আজ নারী দিবসের আলোচনায় যখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীরা অংশ নেবেন; তখন তাদের গৃহের নারী গৃহকর্মীটি নারী দিবসের ছুটি পাবেন কীনা; সে নিশ্চয়তা দক্ষিণ এশিয় সমাজে কম।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীরা আর তাদের সমস্যার কথা যেভাবে হাইলাইটেড হয়; নিম্নবিত্ত নারীদের সংকটগুলো সেইভাবে হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডে গুরুত্ব পায় বলে মনে হয়না।
আশা রাখা যায় নারী আন্দোলনে সক্রিয়রা দারিদ্র্য রেখার নীচের বিবর্ণ নারী জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানে আরো বেশি সক্রিয় হবেন।
কেবল সামষ্টিক নারী জাগরণই পারে নারী বিকাশের আকাংক্ষাকে পরিপূর্ণতা দিতে।
একবিংশের নতুন প্রজন্মের যারা ক্রমশ নারী-পুরুষ হয়ে উঠছে; তারা পরস্পরকে পারসন হিসেবে দেখে। অতীতে নারী বাড়তি গুরুত্ব ও অবহেলা দুটোই পেয়েছে। কিন্তু নতুন প্রজন্মে গুরুত্বের দিক থেকে সবাই সমান। ফলে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীর পুরুষের ব্যাপারে যে অভিযোগগুলো; সেগুলো একবিংশের তরুণ-তরুণীর কাছে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। যেমন আমরাই যখন শুনি, এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করতে হতো; সেটা বড্ড অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে আমাদের কাছে।
আবার আমার যুগ বাস্তবতা বা পূর্ব-সংস্কার জনিত ধারণা দিয়ে আগামি প্রজন্মের মাঝে নারী ও পুরুষের সংজ্ঞা দাঁড় করাতে চাইলে খুব একটা কাজে আসবে না। আগামির নারী ও পুরুষ নিজেরাই ঠিক করবে তাদের সম্পর্কের রসায়ন। সেটা অনেক সহজ ও সাবলীল হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
Written by: Nilima Deb
Don’t you think
It’s a ground to dig
The poison, you bleed
And the silence copies the ash….
A step strong, mars wrong!!!
Violence against women routed globally.It is nothing but a long term physical and emotional effects include domestic violence, sexual assault, incest, sexual harassment, female infanticide, female circumcision, and female sexual slavery. It’s basically gender based interpersonal discrimination which is directed towards human right violation of worldwide significance. Violence against women and girls is ubiquitous influence towards every society now and then.
The elimination against women is entitled to the equal enjoyment and protection of all human rights and fundamental freedoms in the political, economic, social, cultural, and civil or any other fields. The efforts to combat violence against women have undergone extensive changes; still the responsible government and nongovernmental organizations need to update the proceedings. Various global campaigns raised awareness for the elimination of violence against women. Media has played a pivotal role by spotlighting the problem to the masses.
The mental health professionals need to take the challenge and present a comprehensive proposal for definite action to prevent all forms of violence against women. The sensitization of gender should focus more sincerely on the sensitivities and boundaries of man-woman relationships and strategies to prevent violence in unusual places and times. More effective education can be provided by the parents and
Relationship handling, violence prevention, and communication skills should be installed in youth through training workshops at schools, colleges and at community level. The national and sub-national efforts are to be scaled-up and intensified to achieve the targets towards eliminating the violence against women. The specific target of ending violence is a challenge and sustainable development goals must be adequately founded in order to bring real and significant changes in the lives of women and girls.
লিখেছেন: অর্পিতা রায়চৌধুরী
আমায় একটুখানি ভালোবাসতে দেবে?
নিজের মধ্যে জমে থাকা প্রণয়গুলো আমায় কেবল বড্ড পোড়ায়
শরীরি খেলা সাঙ্গ করে নগ্নদেহ জড়িয়ে ধরে, ঘুমোও তুমি।
তোমায় ভালোবাসবো বলে
আমি তখন ইট-পাথরের দেয়াল ভাঙার যুদ্ধে নামি,
হৃদয় জুড়ে ক্লান্তি আসে; তৃষ্ণা বাড়ে!
অন্ধকারে হাতরে ফিরি,
নিজের তৈরি পাহাড়সম ভালোবাসায় পিষ্ট হয়ে নিজেই মরি
তুমি হয়তো গভীর ঘুমে,
অন্য কারুর হাতটা ধরে স্বপ্নালোকে ভালোবাসার ফেরি করো,
মনের সুখে আরও বেশি দেয়াল গড়ো;
আমি তখন দেয়াল ভাঙার যুদ্ধে নামি।
লিখেছেন: তপনকান্তি মুখার্জি
আমার না হয় পুড়েছে শরীর
তোমার পুড়েছে মুখ,
আমার পাশেতে অগণিত হাত
তোমার শূন্য বুক।
আমার চোখেতে স্বপ্নরা খেলে
নাচে ভরা শ্রাবণেও,
তোমার চোখেতে শুধুই কুয়াশা
আঁধার আলোর ক্ষণেও।
ভালোবাসি আমি ফুল–ফল–নদী
ভালোবাসি, কাছে আসি,
চার দেয়ালেতে তুমি তো বন্দি
দুঃখ রাশি রাশি।
বিশ্বাসে আমি এখনও অটল
জিতবই নিরবধি,
আমার চোখেতে হাসি–আলো–রঙ
তোমার অশ্রুনদী।
আমার হাতেতে রবীন্দ্রনাথ
তোমার হাতেতে দড়ি,
হারাবার যা হারিয়েছ তুমি
আমার সাজানো তরী।
আমার না হয় পুড়েছে কোষ
বেঁচে আছি, হারিনি,
তোমার পুড়েছে মনুষ্যত্ব
পারনি হারাতে পারনি।
(অ্যাসিডে ক্ষতবিক্ষত মনীষাদের স্মরণে)
লিখেছেন: বল্লরী সেন
শরীরে শরীর রেখে গান বাঁধি, চলকে ওঠে বারুদ বাক্য
স্বর ভেঙে বার কোড্ মাপো, জেনে নাও কতখানি খাদ এই রাত্রি পোশাকের,
তার তলে ঘৃণারাজ্য, তারপর শাবকের তেলোয় মাটি চাপা অবদমনের ইতিহাস সর্বজনগ্রাহ্য নয়।
কালোপাথর ভেঙে যে মেয়েটি নেশা করে পুরুষঘ্রাণে,
যে অশিক্ষিত হাতে তার দুপুরের নিকাহ্ সেরে অন্য এক ঘাই হরিণের শিঙে রক্ত দেখে ফেলে,
নিজেকে দাগী করে, নিজেকে টান মেরে ফেলে দেয়,
নিম দাঁতনের আগে রাখেনি সে অলিখিত চুমুর হিসাব, তার কাছে পলাশের উৎসব কখনো নেবে না।
শরীরে শরীর বাঁধা কলেবর
অল্প একটু ভুল করে প্রমাদ গণনায়
কী করে যে হারিয়ে ফেলছে ক্রমাগত সুর তাল লয়
একে একে সিঁড়িগুলো পাল্টে নেওয়া
বারুদবাক্য, মেয়েটার মরে যাবার তন্দুরি মসল্লা।
লিখেছেন: বল্লরী সেন
সপ্তদশ অষ্টাদশের বাংলা কবিতায় প্রথম নারীকণ্ঠের শ্রাব্য পদাবলী লিখলেন জ্ঞানদাস। বিদ্যাপতির রাধা যখন সখীসঙ্ঘকে ত্যাগ করে একা চললেন অভিসারে, সত্যি পৌঁছলেন কিনা জানা গেল না, কিন্তু যাওয়াটাই স্রেফ মিথ হয়ে থাকলো, জ্ঞান কহে লাজঘরে ভেজাই আগুনি। সব দ্বিধা শেষ করে মেয়েটি তার নিজের প্রাণের সঙ্গে আপোষ করলো না। কবিতাটি শুরু হল এইভাবে, রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর~ রাধা নিজের ইন্দ্রিয়কে হনন করে এগোচ্ছেন, পরিবেশ বা প্রতিবেশ সব ম্লান হয়ে গেল। পরের লাইনটি যুগান্তকারী পালাবদলের। প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। এই মুহূর্তে স্বীকৃত হল আয়ানের স্ত্রীর স্বতন্ত্র চাওয়া, তীব্র মানসিক ও শারীরিক। রূপের জন্য যে দেখতে চাওয়া, তাকেও সরিয়ে রাধা সোচ্চারে কামনার কথা বললেন। তাঁর এই মিলনের অভিবাদন কেমন এ্যানাক্রনিজম্ কে সাক্ষী রেখে এবার হৃদয় এল, পরান এল, এল প্রবলতর অস্থিরতার আপ্তকথা। কিন্তু অনুরাগের পর্যায়ে আমরা তবু জ্ঞানদাসকে গ্রহণ করিনি। চৈতন্যের কাছে পাওয়া বিদ্যাপতি চন্ডীদাসের বাইরে রবীন্দ্রসমালোচনায় গোবিন্দদাস যদিবা, কিন্তু এই জ্ঞানদাস কদাপি নয়। এই উপেক্ষার কারণ অজানা। অথচ পদাবলীর সমালোচনাতেও মেয়েরা তেমন তৎপর যে নন, তাঁরা পরবর্তী বাংলা কবিতায় রাধার ধারক হতে চেয়েছেন, নতুন করে রাধার স্বরান্তরে নিজের কথা বলেছেন, গড়ে উঠেছে নতুন কনসেপ্ট, অবিড়ম্বিত আত্মরতির কবিতা। কিন্তু জ্ঞানদাসের দুর্লভ এই কবিতার কোনো বিশ্লেষণ হয়নি।
পরের কথায় যেন দম নিতেই একটু থামলেন রাধা। বললেন, সই,কি আর বলিব। যে পণ কর্যাছি মনে সেই সে করিব। এ রাধা অন্যরকম,দৃঢ় শক্ত। টলানো মুস্কিল। নেকুপুষু কাঁদুনি নেই। সখীর কাছে বলতে গিয়ে ১০ বার ভাবে না, দুম্ করে নিজের শৃঙ্গার কামনা ছুঁড়ে মারে পাঠককে। মনের দেয়ালগুলো ক্রমাগত পড়তে থাকে। আর রাধা আমাদের অন্দরে সোফা মোড়া জাজিমের তলায় ঢুকে আসেন। কেবল পরিষ্কার দেহের কথা নিঃসংকোচে বলামাত্র আমাদের কাল বদলে যায়। মনের অন্য পারের সুহৃদ আমাদের ভাষান্তর করে দেয়। প্রথমে এল দেখবার সাধ, পরে এল দেখেও সাধ না মেটা। রূপ দেখি হিয়ার আরতি নাহি টুটে,বল কি বলিতে পারি যত মনে উঠে …আহা, ভাষাকে দুষলেন। গালি দিলেন। তথাপি গ্লানিবোধ নেই। সচেতন হয়ে পর পুরুষকে কামনার কথা ঘোষণা। দেখলাম,সাধ মিটিল না। আবার যেন তোমাকে পাই। এ কথা বলেছে দামিনী,বিশ শতকে। তখন সে শ্রীবিলাসের বিবাহিতা। এ সুখ যে পৃথক,অপৌরুষেয়। রাধা তাঁর না পাওয়াকে বড়াই করলেন না, আরো বেশি মথিত হলেন। সগৌরব এ হেন দেহের বিভ্রমকে সেলিব্রেট করা নিয়ে কল্লোলের কত না দপ্ দপানি ছিল,নিবারণ চক্কোত্তি তাকে নিবারণ করতে পারেনি। আর এখানে,দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা। গা …ভাবুন কী প্রয়োগ।ভাবুন কি সরল করিশমা। আধুনিক নারীর ফেমিনিস্ট বোভায়া নির্মিত সেক্স এর ধারণা কত যুগ পরের তত্ত্ব,যা নিয়ে আমাদের মুগ্ধ পশ্চিম অপসারণ।
লিখেছেন: তন্বী হালদার
সময় কি জীবনের সংজ্ঞা বদলে দেয়? আমার মনে হয় খুব বেশি দেয় না। শুধু প্রেম বলতে কি কিছু হয়? না আমার তাও কিছু মনে হয় না। আসলে যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্কই প্রেমের সম্পর্ক। সে শুধু দুটি বিষম লিঙ্গের মধ্যেই যে ঘটবে তা নয়। যে কোনো সমলিঙ্গের মধ্যে ও এই প্রেম সম্ভব।
আসলে মানুষে মানুষে ভালো সম্পর্কই হল এই প্রেম। বৈষ্ণব শাস্ত্র মতে আট প্রকার প্রেম বা প্রেমের দশা আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে অন্ততঃ বর্তমান সময়ে সে হিসেব গুলিয়ে গেছে বা দিচ্ছে। যেমন গুলিয়ে দিচ্ছে কৌশিক গাঙ্গুলীর নগর কীর্তন বায়োস্কোপ। সমান্তরাল সম্পর্কের বাইরের সম্পর্ক। যাকে গোদা বাংলায় প্রেম বলা যেতে পারে। বাকা চোখ, বাকা মন, খিল্লি করার আমেজে, পপকর্ন হাতে নিয়ে (সিনেমা হলে আজকাল চীনা বাদাম পাওয়া যায় না) দেখতে বসে কোথাও মেরুদণ্ড টানটান হয়ে যায়।
পুটির লাজুক চাউনি। মধুর কেয়ারিঙ মনোভাব, যার জন্য সারা জীবন একটা মেয়ে মাথা খুঁড়ে মরে। পুটিকে নিয়ে পালানোর সময় খিদে পেয়েছে? প্রশ্ন। পুরুষের এই নরম শাঁসালো নরম মন নামক হরমোনের সিক্রেশনটাই চায় একটা মেয়ে। যত স্বাবলম্বী হোক না সে তবু ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের ফান্ডাটা কোথাও মেলে না। বাসে পাশাপাশি সিটে বসে তাই পুরুষের কাঁধে মাথা রাখে নারী। পুটিও আদ্যোপান্ত একজন মেয়ে মানুষ। সেও তাই করেছে। হাতে প্রেমের দেবতা শ্রীচৈতন্যের মূর্তি নিয়ে ও তাই পরম নিশ্চিন্তে মাথা রাখে মধুর কাঁধে। ঘুমিয়ে পড়ে। এ ঘুম ভালোবাসার খোঁজে, ভালোবাসার ওমে পরম নিশ্চিন্তের ঘুম। পুটি ঈশ্বররূপী শ্রীচৈতন্যের থেকে অনেক বেশি নির্ভর করে তার মানবরূপী মধুদার উপর। আবার অভিসার পর্যায়ে সে ভয় পায় গুরুমা আরতিকে। বলে, জানতে পারলে কেলিয়ে বৃন্দাবন দেখাবে। মধুও তার দ্বিধা গোপন করে নি। এখনেই তার জিৎ। সে স্পষ্ট বলে, ছেলেতে ছেলেতে এসব হয়! পুটির বোঝানোর চেষ্টা, আমাদের সঙ্গ করবার সময় তোমার আমাকে একবার ও মনে হয়েছে, আমি মেয়ে মানুষ ছাড়া অন্য কিছু? আসলে জাত পাত, সম বিষম, বয়েস কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক। সম্পর্কের তকমা। এই তকমাকে নির্ভর করে কখনও কখনও শরীর আধার হয়ে ওঠে। এখানে তোমার মন নাই কুসুম? এই কনসেপ্ট ভুল। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে পুটির শরীরের পরিবর্তনের জন্য মধু এবং পুটি দুজনেরই এত তাগিদ কেন?
স্বীকৃতি। হ্যাঁ সমাজ সংসারের কাছে একটা নিটোল, ভরভরন্ত জীবন যাপনের স্বীকৃতি। যেখানে রাস্তায় বের হলে ছক্কা পাঞ্জা শুনতে হয় না। প্যাড দেওয়া ব্রা পরতে হয় না, মাথায় নকল চুল পরতে হয় না।
আশা রাখি দিন আসবে এই স্বীকৃতির। তখন আর পুটিদের জটিল অস্ত্রোপচার আর হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির দ্বারস্থ হতে হবে না। যা আমার আছে তাতেই আমি পূর্ণ। তাতেই আমি সুন্দর। তাতেই আমি তোমার। যেন ধ্বনিত হয়-
আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব
ফুটিয়ে ফেলে আবার ভরেছে
জীবন নব নব।।
লিখেছেন: শাহাব আহমেদ
হাল ধরে বসে আছি, তর তর করে এগিয়ে চলেছে নৌকা, যেন পিঁপড়ের লেজের পরে লেজ, আরও কত রঙের কত কত নাও!
দুদিকে গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে আছে। আজালিয়া, বোগেনভিলার ঢল ঢলে যৌবন। কালো নতুন এসফাল্টের নদীর বুকে চিক চিক করছে রোদ, সকালের রোদ। মেঘ গুলো আকাশের একেবারে ছাদ ছুয়ে সরু সুন্দর আঙুলে ঝুলে আছে, ওরা আজ কোথাও যাবে না, কোন তাড়া নেই। ওদের বিদেশের ঘড়ি ধরা জীবন নয়, ওদের নেই রাস্তার স্পিডের মত অন্তহীন ছুটে চলা।
আজ ৮ই মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। গতকাল ছিল ৭ই মার্চ আমাদের বাঙালি জাতির জন্মের আজানটি দেয়া হয়েছিল যেদিন। জন্মের আগেই আজানটি দিয়েছিল যে, খুব কম মানুষই এত স্পষ্ট করে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিল তাঁর মতো। তাই ছিল এই আগাম আজান, অনেক শব্দের মাঝে দুটি শব্দ: জয় বাংলা। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম দুটি শব্দ। সম্ভবত তিনি তাঁর ভবিষ্যতও দেখতে পেয়েছিলেন (তাঁর মত মানুষ পিছিয়ে যাবার নয়), আমরা শুধু অন্যরকম ভাবি।
আর তুমি, যে বাংলার মাটি, হিজল, কদম, বিল, হাওর, মাঠ -ঘাটের অণু পরমাণু দিয়ে তৈরী, যে বেহুলাবাংলার হৃদয়ের স্পন্দন, তুমি এই কি চাপিয়েছ আপাদ মস্তক তোমার শরীরে? আমি তোমাকে দেখবো বলে এতদূর থেকে এলাম। না, তারপরে ইচ্ছেটা পুরোপুরি উবে গেল। তোমার দিকে তাকানোর বদলে আমি খড়ের গাঁদার দিকে তাকিয়ে, পুরোনো গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে, মাঠের গরুর পাল ও তাদের স্তুপাকৃতি গোবরের দিকে তাকিয়ে তোমাকে না দেখার অতৃপ্তি মিটিয়ে এলাম। সেই ভালো, আমার আরবী কন্যাদের প্রতি কোন বিরাগ নেই, কোন টানও নেই।
আমি বাংলার নারীকে ভালোবাসি যার পরনে শাড়ী, হাতে চুড়ি আর কপালে টিপ। আর উন্মুক্ত আঁচলে অবদাত হাওয়া। তার চুলে বেহুলার সৌন্দর্য। তুমি তো দেখো নাই, আমি দেখেছি।
আরব মরুভূমির একটাই রূপ, ধু ধু শূন্যতা। চোখ, ভ্রু, নাক, গাল, টোল বা হাসির মিমিক, কোন কিছুই তার নেই। তার কালো চুল নেই, নেই চোখে কালো কালো ঝালরের বুকে খামচি মেরে ধরার সৌষ্ঠব। শুধু এক অবয়বহীন কাফন মোড়া, বৈচিত্রহীন মৃত মরুভূমির হাহাকার। তুমি সেই কালো হাহাকার গায়ে মেখে হাঁটছো?
তুমি ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে কাফন পড়ে হাঁটো, কালো, সাদা, লাল, এমনকী কাকাতুয়া রঙের, আমার কিছু আসে যায় না। ওইদেশের পুরুষরা তোমার মুখ দেখার জন্য একটুও কৌতুহলী নয়। তুমি গায়ে আলকাতরা মেখে হাঁটলেও ওরা মেনে নেবে। ওরা তো সভ্য ভব্য মানুষ। কিন্তু আমি, আমি উন্মুখ হয়ে থাকি তোমার মুখ দেখার জন্য, যে মুখ না দেখলে আমার ভেতরের পাঁচ হাজার বছরের একটা মানুষ ছটফট করে মরে যায়।
তুমি কেন, কেন কাফনমোড়া হয়ে হাঁটছো? তোমার কি বাংলার রোদ, আলো, বাতাস, বৃষ্টি আর গায়ে লাগাতে ইচ্ছে করে না? তোমার চামড়া কি আরবীয় মরুভূমির পোড়া বালি? খোস-পাচড়া সেকেন্ডারি সিফিলিস আর শংকরাক্রান্ত কদর্য ও কুৎসিত? তুমি কি ঢাকতে চাইছো?
কেউ কেউ মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলে যে কবরে নাকি পাপী তাপীদের ফেরেশতারা অবিরত মুগুর পিটায় অনন্তকাল ধরে। আমি যেদিন প্রথম তোমার মুখ দেখেছিলাম, যখন তুমি বাঙালি ছিলে এবং যখন আরবী মরুভূমির লু হাওয়া আমাদের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছায় নাই, সেইদিন থেকেই আমার আকাশে ফ্যাকাশে হয়ে গেল চাঁদ। আমি সেই মুগুরের আঘাত সইছি বুকে ও মগজে, প্রায় অনন্তকাল ধরেই। কিন্তু আমি পাপী নই। আমি ঋণখেলাপী, অসৎ ঠিকাদার, অসৎ ব্যবসায়ী, মাদক বিক্রেতাও নই। আমি কারুর জমি জবরদখল করি নি। আমার ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খাওয়ার চাকরি নেই। আমি ক্ষমতার করিডোরের কেউ নই। আমার শশুর মৃত, শাশুড়ী বৃদ্ধ এবং ক্ষমতার আশেপাশে আমার কোন শালা সম্বন্ধী কিংবা দুলাভাই নেই। আমি যেই দেশে থাকি সেখানকার খবিস সরকার ১০০ % ট্যাক্স অগ্রিম কেটে রেখে তবেই বেতন দেয়।
ডাক্তার হিসেবে ঔষধ কোম্পানি, ল্যাবরেটরি বা রেডিওলজি থেকে এক পয়সাও নিতে দেয় না। বিদেশ কেন নিজের শহরেও বিনেপয়সায় একটা সেমিনারেও যেতে দেয় না। ইহুদি নাসারাদের দেশে আমার আয়ের একটি কাণাকড়িও অন্যায়ভাবে অর্জিত নয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে, যে আমার দিনের তন্ময়তায়, রাতের ঘুমহীনতায় গুণ গুণ করে গ্রাম্য বাংলায় গান গায়।
তুমি আমাকে আর তোমার মুখ দেখাতে চাও না। তোমার কি অসংখ্য জেনার কালসিটে দাগ গলায় ও গালে? অথবা তুমি জন্মের পরে বা রজ: আসার আগেই ভাই বাপ-চাচা-মামা ইত্যাদি আপনজনের স্পর্শে অপবিত্র হয়ে সেই দাগ ঢেকে রাখতে চাইছো? নাকি তোমার বাঙালি মুখ আমাকে আর দেখাতে চাও না আরবী শেখেদের দেখাবে বলে?
ও, ওসব কিছুই নয়? তুমি সুন্দর ও পবিত্র বর্ষা-ধোয়া হিজল ফুলের মত? তবে কেন তুমি কাফন পড়ে হাঁটো? তুমি কি জানো না কোন মানুষেরই অধিকার নেই ঈশ্বরের সুন্দরতম সৃষ্টিকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখার?
ঈশ্বর সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য, আমার জন্যে, যাতে আমি মানুষ, সেই সৌন্দর্যে চোখ রেখে বলতে পারি, ঈশ্বর, যে তুমি এই অপূর্ব সুন্দরের স্রষ্টা, তুমি না জানি কত সুন্দর!
লিখেছেন: তৌহীদা ইয়াকুব
দুপুরের এই সময়টা শিফা রহমান একটু অবসর পেয়ে আরাম করে বসেন। কখনো বিকেলের নাস্তার জন্য কোন প্রিপারেশন করে রাখেন কাজের মেয়েটাকে দিয়ে। কখনো টিভির সামনে বসেন। এই সময়টা একটু নিজের মত করে থাকেন, আসলে থাকতে চান। এইসময় কখনো বাবার বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন। তবে কেমন যেন কথা ফুরিয়ে যায়। আজকাল তেমন আর কথা থাকে না। সবকিছু যেন মুখস্ত অভ্যস্ত। একটু পর শাশুড়ি দুপুরের ঘুম থেকে উঠবেন। আসর নামাজ শেষে তাঁকে চা নাস্তা দিতে হবে। পাশের বাসার খালাম্মাও আসেন মাঝে মাঝে শাশুড়ির সাথে গল্প করেন। তখন শিফা বারান্দায় টবের গাছগুলোর যত্ন নেন। শিফা রহামানের কলেজের বন্ধুরা যোগাযোগ করে মাঝে মাঝে। বন্ধুরা চায় তাদের মত সেও বাইরে বেরুক। কোন বিকেলের বিনীত রোদে রিকশার হুট ফেলে ঘণ্টা চুক্তিতে ঘুরে আসুক কিছুটা পথ ওদের সাথে। কিন্তু তার ওসব হয়ে উঠে না। এভাবেই কেমন করে দিন ফুরিয়ে রাত, আবার সকাল, ঘুরে ফিরে মাস বছর চলে যায়। তার স্বামীর ভাল ব্যবসা। না চাইতেই সব আসছে সংসারে। ছেলে মেয়ে রিনাউন্ড আর এক্সপেন্সিভ স্কুল কলেজে পড়ছে। আর কি চাই এক জীবনে! তাই এসব বাড়তি কিছু নিয়ে সে তেমন ভাবে না।
এই তো সেদিন শান্তা আর রিতা এসেছিল ওর সাথে দেখা করতে। একই শহরে বেড়ে উঠা ওদের, একই স্কুল, কলেজ। তিনজনের যেন এক আত্মা। ওরা দু’জনই যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে খুব সচেতন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষেই শিফার বিয়ে হয়ে যায়। নিজের ক্যারিয়ারের দিকে তেমনভাবে ভাবতে পারার আগেই পর পর দুটো ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে। ওদেরকে নিয়েই কেটে গেছে সময়। সে যাই হোক এখনও শান্তা, রিতা আর শিফার আগের মতই ভাব। কোন কিছুতেই ওদের বন্ধুত্বের কোন কমতি পড়েনি। এসেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শিফাকে দেখছিল ওরা দু’জন। সবসময় খুব সাদামাটাভাবে থাকে শিফা।ওকে কেমন যেন ক্লান্ত আর বয়স্ক লাগে। যেন সময়ের আগেই সময় এসে জানান দিয়ে যাচ্ছে ওর চেহারায়। অথচ একসময় ওর চোখ, চুল নিয়ে কিংবা ওর সৌন্দর্য নিয়ে কাছের বন্ধুরা কিছুটা অহংবোধ করত। আর কলেজের অন্য মেয়েরা, সিনিয়র আপুরা আড়চোখে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে ওর কথাই বলত। হিংসা মিশ্রিত কথা বা অন্য কথা, সব কথাতেই ঘুরে ফিরে ওর প্রশংসাই ছিল সেসময়। আর এখন তার বারান্দার টবে ফোটা ফুল পাতা, ঘরের ডেকোরেশন, রান্নার স্বাদ, খাবার টেবিলের পরিবেশন বাহারি ডিনার সেট, ছেলে মেয়ের ভাল রেজাল্ট এসবই যেন মোক্ষম পাওয়া জীবনের। এর বাইরে তো কিছু নয়! আর কিছু নয়!
এই তোর কী হয়েছে রে? শরীর ঠিক আছে তো? দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস? একটু সাজতে টাজতে পারিস তো না কী! একেবারে কেমন খালাম্মা বনে গেলি দেখছি! সপ্তাহে একটা দিন আমাদের সাথে ফিটনেস ক্লাবে যেতে পারিস। মাসে একবার পার্লারে গিয়ে আর কিছু না হোক ফ্রেসিয়াল করে নিতে পারিস। তোকে নিয়ে আর পারি না! চল আজ আমাদের সাথে। শান্তার জোড়াজুড়ি থামতেই চায় না। অনেক বলে কয়ে শিফা সেদিন ওদের ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন জাহিদের এক বিজনেস পার্টনারের সাথে তার ওয়াইফ ডিনারে আসবার কথা ছিল বলে। তবে ফিরে যাওয়ার সময় পার্লারের ফোন নম্বর রেখে গেছে ওরা। বারবার করে বলে গেছে এই নম্বরে কল করে পার্লারের কোন এক এক্সপার্ট বিউটিশিয়ান এর সাথে অ্যাপয়েনমেন্ট করে নেয়ার সময় অবশ্যই যেন শান্তা আর রিতার কথা বলে। দূর! এর কি সত্যি কোন দরকার আছে? শিফার হাসি পায় ওদের কাণ্ড দেখে। নিজের মনে একা একা বিরবির করে বলে- এখন এসব অর্থহীন। আর জাহিদ? ও তো কখনও কিছু বলে নি। দুজনে তো বেশ আছি আমরা। তাহলে? আর শারীরিক কোন অসুখ বিসুখও নেই। ফিটনেস ক্লাব, সে তো ওই ফিগার মেইন্টেইনের জন্যই। সারাদিন ঘর দোর, সংসার, আত্মীয়-স্বজন সামলানো, কত দায়িত্ব! এতকিছুর পর জীবনের এবেলাতে এসে সবার সাথে মিলে মিশে থাকার পর নিজেকে আলাদা করে ভাবার আর কি আছে?
বেশ বড়সড় ড্রয়িংরুমের মাঝখানে ঝাড়বাতি। লাস্ট ইয়ারে চায়না থেকে জাহিদ খুব শখ করে এনে লাগিয়েছিল। এরপর ঘরের পর্দার রঙের সাথে ঘরের দু’পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্পের শেড মিলিয়ে দারুণ এক আলোছায়া ঘেরা মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে আছে এখানে। এর মাঝে ছেলে রক মিউজিক ছেড়ে দিয়েছিল। শিফা গিয়ে সেটা বন্ধ করেছে। ঘরে একটু পর গেস্ট আসবে বলে। ছেলের কণ্ঠে অনুযোগ ‘মা ইউ আর সো বরিং’। আজকাল ছেলেমেয়েরা কেমন যেন মা বাবার মুখের উপর ‘তুমি খুব বরিং’ বলে দেয়। শিফার অবাক লাগে এসব।
মিস্টার এন্ড মিসেস এনাম এসেছেন। মিসেস এনাম ডার্ক ব্রাউন এর উপর ডার্ক রেড এর কম্বিনেশনে দারুণ একটা গাদোয়াল কাতান পরেছেন। মহিলা বেশ সৌন্দর্য সচেতন। হালকা ন্যাচারাল মেকআপ লেয়ারকাট চুল ছেড়ে রেখেছেন। গলায়, হাতে হালকা গহনা। সব কিছুতেই পরিমিতিবোধ আর আভিজাত্য। মিস্টার এনাম বারকয়েক তার স্ত্রীর প্রশংসা করলেন। জাহিদ তাকে সায় দিয়ে একবার বেশ জোরালোভাবেই বলে উঠল, হ্যাঁ ভাবীকে দেখলেই বুঝা যায় উনি খুব মেইন্টেইন করে চলেন নিজেকে। সাথে মিসেস এনামের সাজ নিয়েও উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করেছে জাহিদ। ওর দৃষ্টি আর মুখের এই ভাবটা ঠিক ধরতে পারে না শিফা, কিছু অপ্রাপ্তির দৈন্য তার ছায়া? নাকী এমনি এমনি? শিফা পরেছিল নীল রঙের টাঙ্গাইল সিল্ক। খুব ঘরোয়া হাত খোপার মতই সে সাবলীল আর তার সংসারের সবকিছুর সাথে এইসময় পর্যন্ত তার নিরন্তর বয়ে চলা যেন ক্ষণিক ছেঁদ চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে গেল। এসব কি একটু ভাববে সে? সবমিলিয়ে এর আগেও কি এমন কথোপকথন হয় নি? মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার কথাও বার বার নানা জায়গায় জাহিদ বলেছে। তখনও ওর এমন কিছু মনে হয় নি। কিছু কি অন্য রকম ছিল আজ?
শিফা যখন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিল, মা তখন বার বার করে বলেছিলেন- দেখ মা, যা কিছুর জন্য নিজের ক্যারিয়ারকে তুমি আজ সেক্রিফাইজ করো না কেন, দিনশেষে সেসব কিছু কেউ ভাববে না … তুমি যে পারোনি সেটাই শেষ কথা হয়ে থাকবে। তাহলে কি তাই সত্যি হলো?
আজ সারাদিন কেটে গেল কিংবা ঠিক গেলো না। অনেকগুলো ভাবনা নানাবিধ যতিচিহ্ন নিয়ে থেমে আছে যেন। শরীর মনে লেগে থাকা ক্লান্তি খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ালো শিফা। একটু অযত্ন আর বেখেয়ালের বোঝাপড়া তার চেহারায় স্পষ্ট দেখা যায়। মনে পড়ে পার্লারের কথা। শিফা ফোন নম্বরটা খুঁজতে থাকে।
লিখেছেন: সাঈদা মিমি
গোপন খেলার কথা কাউকে বলি না।
ঝিম মেরে পড়ে থাকা সত্যের আড়ালে
কিছু সতী থাকে, আমি তাদের
মতো নই। আমার প্রান্তর জুড়ে উদ্দাম
প্রেম, নিজস্ব পুরুষের প্রতি নেশা।
কেউ কেউ স্বাধীনতার গল্প বলে; স্বাধীন
নারীর লীলায়ন, আমি তাদেরও কেউ
হতে না পারায় ভেবে ভেবে ক্ষয়ে গেছি
কখনো সখনো! কামগন্ধি সুখ, পুরুষের
ঘামের আড়ালে অবিরাম তৃপ্তি
খুঁজেছি! যদি জানতে চাও সেইসব,
বলবো না। শুধু বলা যেতে পারে, আমি
নারী নামের কলংক এক,
সত্যের সুরভী আড়াল।
লিখেছেন: সুচরিতা চক্রবর্তী
আগুন তোমায় পোড়াতে পারে না।
বৃষ্টি তোমায় ভেজায় না আপাদমস্তক।
গনগনে রোদে কষ্ট হয় না তোমার।
উত্তুরে বাতাস কাঁপন ধরায় না তোমার পাঁজরে।
তোমার কোনও ভয় নেই, লজ্জা নেই, কষ্ট নেই…
তোমার কোনও রাগ নেই, ঘৃণা নেই, বিরক্তি নেই।
তোমার কোনও মোহ নেই, লোভ নেই, খিদে নেই।
তুমি পেছনে ফেলে এসেছো তোমার সবুজ অতীত।
সুতরাং তা অস্তিত্বহীন।
তোমার সামনে যে অনন্ত আগামী সে তোমার সন্তানের
সোনালী ভবিষ্যৎ।
সুতরাং তাতে তোমার অধিকার নেই।
যে ধূসর বর্তমান তোমায় নিয়ত কর্ষণ করে
তাতে কোনও তরঙ্গ নেই। আকাঙ্খা নেই।
ভালোবাসাও নেই।
এত কিছুই যদি নেই তবে প্রাণ আছে কেন?
প্রাণ আছে কারণ তোমার প্রাণের প্রয়োজন আছে।
তুমি উর্বরা। তুমি কর্মক্ষমা।
তুমি জননী, তুমি জায়া,
কখনও বা তুমি কন্যা।
তুমি বীজ বোনো। জলসেচন করো।
তুমি সোনালী ফসল ঘরে উঠে এলে
আগামী বছরের জন্য
বীজ তুলে রাখো।
তুমি আটা ছেনে গরম রুটি সেঁকে আনো।
সাত মাইল হেঁটে কুয়ো থেকে তুলে ফেরো সুশীতল জল।
তুমি ভোর হতে না হতে ছেলেপুলেকে ঘুম থেকে
তুলে স্কুলে পাঠাও।
রাত জেগে হোম ওয়ার্ক শেষ করো।
প্রোজেক্ট বানাও ইউ টিউব ঘেঁটে।
তারপর টিফিন, লাঞ্চ, ডিনার…
ওফ। তুমি সেরা মা…
কী দারুণ বৌদি তোমার বাগান…
এই পর্দাগুলো হাতিবাগানের?
সত্যি পালবাবু, আপনি সৌভাগ্যবান…
অজস্র স্তুতি তোমার আঁচলে লুটোয় দিনরাত।
তুমি আলতো মেখে নাও। টুসকিতে ঝেড়ে ফেল।
যেমন ঝেড়ে ফেলো অগণিত অপমান।
তুমি জানো তুমি অপরিহার্যা।
তোমায় ছাড়া বেসামাল পুরুষ।
এলোমেলো পুরুষ।
অসহায়। বিপন্ন।
তাদের রাগ,ক্রোধ,তেজ,পৌরুষ,ভীরুতা
তাদের সমস্ত অভিমান,আত্মসম্মান
এবং নিস্পৃহতা, ঔদাসীন্য
তুমি পরম মমত্বে লালন করো।
এভাবেই মেনে নাও সব।
এভাবেই মানো না কিছু।
খুব গভীরে কোথাও ঠিক জানো…
এরা যাকে দেখছে সে তুমি নও।
একদিন সাপিনীর মত
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে তোমার আসল রূপ।
সে অবলীলায় দৃপ্ত ভঙ্গীতে
পার হয়ে যাবে সমস্ত উঠোন।
তারপর খোলা চুলে
দুহাত প্রসারিত করে বলবে…
আমি তোমাদের অর্ধেক আকাশ।
আমি তোমাদের প্রাণবায়ু।
আমি তোমাদের দীর্ঘশ্বাস।
লিখেছেন: রঞ্জন রায়
সকালবেলায় কবিতা পড়ছিলাম, আজকালকার কবিতা আমি বুঝি না। আমার প্রয়াত বন্ধু লেখক রাঘব বন্দ্যো বলতেন—প্রত্যেক মানুষ তার নিজের সময়ে বাঁচে।
খাঁটি কথা। আমিও তাই পড়ছিলাম মণীশ ঘটকের কবিতা। জোরে জোরে, দুলে দুলে—আসলে আমাদের সময়ে ওইভাবেই পড়া মুখস্থ করতে হত কি না।
“দেবী তো নহ, বল তো তোমায় কেমনে পূজা করি?
তোমার মুখে দিব্য বিভা বৃথাই খুঁজে মরি।
আছে তোমার ললিত বাহু, নিটোল দুই স্তন,
তপ্ত তনু…“
ব্যস, খনখনিয়ে বেজে উঠল গিন্নির গলা।
সক্কালবেলা, এসব কী শুরু হয়েছে?
মানে, কবিতা…।
তো তোমাদের চোখে মেয়েদের বর্ণনা শরীর থেকেই শুরু? তাও সোজা বুক থেকে? তারপর নাভি বা তার নীচে।
এসব কী বলছ খুকুর মা?
কেন, সেদিন আর একটা কোবতে পড়ছিলে না? “নাভিমূলে ফিরে যাব…“ বা ওইরকম কিছু?
আমার কথা হোল ঋগবেদে পুরুষসূক্তে আদিত্যবর্ণ পুরুষের বর্ণনা শুরু হয়েছে মস্তক থেকে, তাহলে মেয়েদের শরীরের বর্ণনা কেন বুক থেকে? আমাদের কি মাথা নেই? না তাতে ব্রেন ম্যাটার তোমাদের থেকে কিছু কম?
তা, ভাববার কথা বটে!
তুমি ভাববে? তাহলেই হয়েছে। কালিদাস নিজে সরস্বতীর রূপবর্ণনায় সেই একই পূর্বাগ্রহ দেখিয়েছেনঃ জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে!
দেখছ তো, সবকটা কবি—সে কালিদাস থেকে মণীশ ঘটক—সবাই মেয়েদের বুক নিয়ে মজে আছে। মেয়েরা সব সময়েই অবজেক্ট– বুদ্ধি নেই, মেধা নেই, ব্যক্তিত্ব নেই।
কেন রবীন্দ্রনাথ?’ মুখপানে চেয়ে দেখি’ লেখেন নি? বা ‘ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো, আমার মুখের কাপড়খানি’।
আমার মুখ খুলিও না। উনি আগে লিখেছিলেন—আমার বুকের কাপড়খানি। শেষে শান্তিনিকেতনী বেহ্মদের পরামর্শে ‘বুকের’ জায়গায় ‘মুখের’ হোল। স্বয়ং মুজতবা আলী সাক্ষী। আরও আছে ‘নিরাবরণ বক্ষে তব নিরাভরণ দেহে, চিকণসোনা লিখন উষা আঁকিয়া দিল স্নেহে’। কাজেই জোর গলায় বললেই মিথ্যেটা সত্যি হয়ে যায় না। তোমাদের জাতটাই এমনি। মানসচক্ষে মেয়েদের নিরাবরণ আর নিরাভরণ করে দেখতেই ভালবাস।
উঃ, অনেক হল ; এবার আমার কথাটা একটু শোন।
শুনব, আগে চায়ের জল চড়িয়ে এস। ঘরের কাজেকম্মে একটু হাত লাগাও।
গ্যাসে জল চড়িয়ে এসে শুরু করি।
দেখ, আজ থেকে দেড়শ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা?’ বন্দনা করেছেন উর্বশীর, মানে নারীর সেই স্বতন্ত্র রূপের—নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ সুন্দরী রূপসী। সৃষ্ট হয়েছে ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য ও ‘ল্যাবরেটরি’র নীলার মত চরিত্র।
হুঃ; মন দিয়ে দেখ লাবণ্য হোক কি কেটি মিটার, অথবা সোহিনী কি ওর মেয়ে নীলা—কারও কোন স্বতন্ত্র নারীসত্তা নেই। ওরাও পুরুষের কল্পনায়, মানে তোমরা যেমন করে মেয়েদের দেখতে ভালবাস—সেই ছাঁচে তৈরি।
আর মণীশ ঘটক? গোটা কবিতাটা শুনলে বুঝতে উনি আদিকাল থেকে মেয়েদের দেবী বানিয়ে যে ফাঁকিবাজি, সেটাকেই ঝাড় দিয়েছেন। একটা কবিতা দেখেই কি কবির গোটা দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়?
মানছি, মনু থেকেই ব্যাপারটা চলে আসছে। একবার বলা হচ্ছে যে ঘরে নারীর সম্মান পায়, সেই ঘরে দেবতার নিবাস। উনিই আবার বলছেন নারী স্বতন্ত্র নয়। শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণে থাকতে হয়। তুলসীদাস সেই লাইনেই রামচরিতমানসে খেলে দিয়েছেন-
‘চোর, ঢোর , গাঁওয়ার শূদ্র অউ নারী,
ইয়ে সব হ্যায় তারণ অধিকারী।।‘’
‘চোর, মোষ, গোঁয়ার, শূদ্র ও নারী,
এদের বশে রাখতে চাই লাঠির বাড়ি।।‘
আমি এবার নিজের লাইন পেয়ে গেছি। আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিই।
খেয়াল করেছ যে প্রাচীন সমস্ত ধর্মশাস্ত্রে নারীর ভূমিকা গৌণ। বেদে উষা ও সরস্বতী ছাড়া কোন দেবী নেই। যত প্রধান বৈদিক দেবতা—অগ্নি, মিত্রাবরুণ, ইন্দ্র—সবাই পুরুষ।
ইতিমধ্যে মেয়ে হাজির, তিনকাপ চা নিয়ে।
কেন যে বাপিকে বল চা করতে? জল ফুটে শুকিয়ে গেছল। আমি ফের বানিয়ে আনলাম।
কোন কাজ যদি ঠিকমত করে!
আসলে ওর মাথায় সারাক্ষণ একটা ভাবের ঘুঘু ডাকতে থাকে–এই আর কি! সবাই কি আর একরকম হয় বৌমা, ও ছোটোবেলা থেকেই একটু অন্যরকম।
এইসব আশকারা দিয়েই তো ওকে এ’রকম বানিয়েছেন বৌমা; স্পেয়ার দ্য রড এন্ড স্পয়েল দি চাইল্ড!
আরে ঠাম্মা এসে গেছে! একটু বাবাকে সাপোর্ট দাও তো! আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসছি।
তোমাদের কথা শুনছিলাম, বৌমা। শাস্ত্র নিয়েএকটু একপেশে লাগছে। বৈদিক যুগে যাই হোক, শাক্ত ও বৈষ্ণব মতে নারীকে কি সবচেয়ে সম্মান দেওয়া হয় নি? ‘স্বামীর বুকে পা দিয়ে ওই দাঁড়িয়ে আছে মাকালী’—এমন এমপাওয়ারমেন্ট! আর দুর্গা ? অসুরনিধনের জন্যে সব দেবতারা হার মেনে ওঁর শরণাপন্ন হলেন। এদিকে রাধারাণীর কৃপা না হলে কৃষ্ণলাভ হয় না। সব ভক্তেরা রাধাভাবে ভাবিত হয়ে সাধনা করেন। চৈতন্যচরিতামৃত বা চৈতন্যভাগবত পড়ে দেখ। কৃষ্ণ নিজে রাধার মান ভাঙাতে বলছেন যে আমার মাথায় তোমার পা তুলে দাও, ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’। গোস্বামী কবিরাজ লিখে গেছেন।
মা, একটা কথা বলি। এসব হচ্ছে পুরুষদের চালাকি। মেয়েদের দেবী বলে পূজো করা কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট বায়বীয় ইস্যুতে। কিন্তু দৈনন্দিন বাস্তবে প্রতিনিয়ত ওদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে ওরা সেকন্ড ক্লাস সিটিজেন। বাবা-মার আর্থিক সামর্থ্য কম হলে, মানে ছেলে মেয়ে দু’জনকে হায়ার স্টাডিজ দিতে না পারলে, ছেলেকে করাবে প্রফেশনাল কোর্স, মেয়েকে বলবে ঘর সামলাতে শেখ, আর বি এ/বিএসসি পড়। কারণ, মেয়ে হোল পরের বাড়ির আমানত। বিয়ে দিয়ে বিদেয় করতে হবে; মানে লায়াবিলিটি। আর ছেলেকে পড়ানো মানে ইনভেস্টমেন্ট। ছেলে স্বর্গে বাতি দেবে।
হ্যাঁ ঠাম্মা; আসলে এটা একটা ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি, একটা গেম। আমাদের অফিসেও চলে। একজনকে ডোবাতে হলে আগে বার খাইয়ে গ্যাস দিয়ে মাথায় তোল, তারপর তাকে ক্ষুদিরাম করে দাও।
আমি সায় দিই—পুত্র শব্দের সমাস ভাঙলে দাঁড়ায় ‘যে পুং নামক নরক হইতে ত্রাণ করিবে’!
এতে গিন্নির পুরুষবিদ্বেষে ঘি পড়ল।
আর বিয়ের পর? বৌ সবার শেষে খাবে, স্বামী দেরি করে ফিরলে ( সে কাজে আটকে ছিল, নাকি বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিল—কে দেখছে?) নিজে না খেয়ে খাবার আগলে বসে থাকবে।
মায়ের মুখ ভার হোল।
বৌমা আমি তোমাকে কখনও কিছু বলিচি?
আপনার তো একই ছেলে, মেয়ে নেই। যদি হত , তাহলে কী করতেন বলা মুশকিল। আমি মেডিকেল পড়তে চাইতাম; বায়োলজিতে ভালই করছিলাম। কিন্তু বাবা ভাইকে পড়াল। আমাকে উচ্চ মাধ্যমিকে আর্টস নিতে চাপ দিল। বলল আমার বিয়েতে খরচা আছে, তাই।
তোমাকে খাওয়াদাওয়া নিয়ে কিছু বলিচি? ছেলে আর বৌমার মধ্যে মাছের পিস নিয়ে ?
তা বলেন নি। আপনি অন্যদের মত না। কিন্তু ভাবুন, নতুন বিয়ে হয়ে এসেছি। সাতদিনের মাথায় আমাকে বললেন যে বৌমা তোমাকে সবার আগে ওঠা উচিত। নতুন বৌ দেরি করে ওঠে– এটা ভাল দেখায় না।
হ্যাঁ, বলিচি; তোমার শ্বশুরমশায় বলেছিলেন এটা বলতে। তোমার কী হয়েছে, বলত? আজ তুমি এইসব কথা তুলছ?
আচ্ছা,আপনি বা বাবা কখনও নিজের ছেলেকে সকালে বিছানা ছাড়তে বলেছেন? জানতেন, যে তখন আপনার ছেলেই আমাকে উঠতে দিত না?
আমার মা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
মেয়ে বলল—মা, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। আজকাল এসব হয় না। ছেলেমেয়ে দুজনেই চাকরি করে। আমার বিয়ে হলে এসব ইস্যু নিয়ে আগেই মামলা ক্লিয়ার করে নেব। নো ঝামেলি!
তোর বাবা কেন চুপ করেছিল? কখনও আমার পাশে দাঁড়িয়েছে? বরং বলেছে মা-বাবা অন্য জেনারেশন; ওঁদের চিন্তা এত তাড়াতাড়ি পালটানো সম্ভব নয়। বরং তুমিই একটু মানিয়ে নাও।
সে কী বাপি, তুমি এইসব বলেছিলে?
শুধু তাই? কোন পারিবারিক ঝামেলা দেখলে বলেছে আমি এতে মাথা গলাব না। তুমি একজন প্রাপ্তুবয়স্ক লেখাপড়া জানা মহিলা। যা উচিত মনে হয় করবে। আমি কোন দিকে নেই।
বাপি, এত এড়িয়ে যাওয়া! তুমি অফিসে ইউনিয়ন কর, বেশ অ্যাকটিভ, মায়ের ব্যাপারে এমন কেন? না, উকিলের যুক্তি শুনব না; অনেস্ট আন্সার চাই।
আমি চুপ করে গেলাম। কী যে বলি! মাথাটা একটু ধরেছে।
বাপি, আমরা অপেক্ষা করছি।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। চোয়াল শক্ত, চোখ জ্বলছে। এ কি আমার সেই খুকু? কবে এত বড় হয়ে গেল?
ঢোঁক গিললাম; আস্তে আস্তে চোখ তুলে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম।
কী জানিস, আমার সংকোচ হত—খোলাখুলি বৌয়ের সমর্থনে দাঁড়ালে লোকে যদি আমাকে স্ত্রৈণ ভাবে?
উঃ, কী কঠিন সব বাংলা শব্দ, ইংরেজিতে কী বলে? হেন-পেকড-হাসব্যান্ড? ঠিক বুঝেছি? আচ্ছা, তোমরা তো বাঙাল; ঠাকুমা দাদুরা কী বলত?
আমি চুপ।
আচ্ছা, আমি হেল্প করছি। ঘটিরা বলে বৌয়ের হাতধরা। বাঙালরা?
মাইগ্যা!
তো লাইফ-পার্টনারের অসম্মান হলে তার পক্ষে দাঁড়ালে সে ‘মাইগ্যা’? তোমার গায়ে এই লেবেল সেঁটে যাবে এই ভয়ে তুমি চুপ; আমি হলে এমন হাজব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতাম।
এই চুপ কর! সক্কালবেলায় ওসব অলুক্ষুণে কথা বলিস না।
এই ভয়েই তো তোমরা গেলে মা। এটাই তোমাদের ব্ল্যাকমেইলিং পয়েন্ট।
আচ্ছা বাপি, তোমার কাপড় তো তুমি নিজে ধোও; কিন্তু তোমার শরীর খারাপ হলে কে ধুয়ে দিত?
তোর মা।
ঠিক; কিন্তু মার শরীর খারাপ হলে?
আমি নিরুত্তর।
মেয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরের মত আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে– মার শরীর খারাপ হলে?
বাস্কেটে পড়ে থাকত।
কেন? অসুস্থ বৌয়ের কাপড় ধুলেও সেই ‘মাইগ্যা’?
এখন তো ওয়াশিং মেশিনে ধোয়া হয়।
সে হয়; ওয়াশিং মেশিন, কুকিং গ্যাস ও প্রেসার কুকার ঘরের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। ছেলেরাও পারে, কিন্তু করে না।
শোন বাপি; কাল ভারতের সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস সীকরী রিটায়ার করেছেন। ফেয়ারওয়েল অ্যাড্রেসে বলেছেন যে ভাল জাস্টিসের মধ্যে কিছু নারীত্ব থাকা উচিত, তাহলে বিচার ভাল হয়। উনি বলছেন যে কমপ্যাসন একটা দামি সেন্টিমেন্ট বা মাইন্ডসেট। উনি বলছেন যে উনি হ্যাপি ওঁর মধ্যে কিছু নারীসুলভ গুণ আছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফুট কাটি—হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথও এমনি কিছু বলেছিলেন ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে… সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।
উনি কিন্তু নারীসুলভ গুণের জন্যে লজ্জা পান নি।
আমি প্রাণপণে গোলপোস্ট সরাতে চাই।
কী জানিস, আসলে আমরা, মানে পুরুষেরা, হাজার হাজার বছর ধরে প্রিভিলেজড; যুক্তি দিয়ে বুঝলেও অভ্যেস যায় না। ইংরেজদের মধ্যে অনেক ভাল লোক ছিল, বুঝত কলোনিয়ালিজম কত বড় ইভিল। কিন্তু-
হ্যাঁ; ঘাড়ধাক্কা না খেলে কেউ…। গিন্নি আমার কথা কেটে দেয়।
আসছে তোমাদের ঘা খাওয়ার দিন। আমাদের দিন গেছে। এরা, এই এদের জেনারেশন তোমাদের শিক্ষে দেবে।
তা ঠিক। উইমেন্স’ লিব আন্দোলন এখনও এদেশে তেমন করে-
না বাপি; সবই পাল্টাচ্ছে। আমরা বুঝি—উইমেন্স লিবের কোর ইস্যু হচ্ছে ছেলেদের সচেতন করা যে ওরা কত বর্বর। অর্থাৎ এই আন্দোলন পুরুষদের বাদ দিয়ে নয়, বরং ওদের সাথে নিয়ে এক ইনক্লুসিভ মুভমেন্ট। হাজার বছর ধরে সুবিধা পেয়ে ওরা ধরে নিয়েছে এটাই স্বাভাবিক ব্যবহার। এখনও ওদের মধ্যে ভদ্র এলিমেন্টরা বড় জোর মেয়েদের দেখে ডিসট্রেসড ড্যামজেল হিসেবে; নিজেদের মনে করে শিভালরাস নাইট। বোঝে না এতে আমাদের অপমান করা হয়। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কান্ট্রিজে বাসে ট্রেনে লেডিস সীট নেই। সিনিয়র সিটিজেন ও শিশুদের জন্যে আছে। অর্থাৎ মেয়েরা দয়া চায় না, প্রটেকশন চায় না। সমান স্পেস চায় , নিজের শরীর ও মনের উপর স্বাধিকার চায়।
ওরে বাবা! কী লেকচার দিলি রে! আন্তর্জাতিক নারী দিবস কবে? কলেজে বলবি নাকি? গলা শুকিয়ে গেছে। একটু কফি খাওয়াবি?
কালকেই ৮ই মার্চ। কিন্তু এখন তুমি গিয়ে কফি বানিয়ে আন। আগের বার ছড়িয়েছিলে।
আর নারীদিবস বছরে একদিন কেন? কেন রোজ হবে না? অর্থাৎ এটা আলাদা করে পালন করার দরকার কী? কই, ঘটা করে পুরুষদিবস তো হয় না।
মেয়ে ঠিক বলছে। আজ থেকেই শুরু কর। পাঁজি দেখে কাল কেন? জব জাগ উঠা, তভী সবেরা।
যখন ঘুম ভেঙেছে, তখনই সকাল।
লিখেছেন: তাসবীহ্ ইসলাম নাবিলা
আমি এক মায়ের কথা বলছি
সদ্য ফোটা কুমারীর কথা বলছি
আমি এক বেশ্যার কথা বলছি
আমি এক প্রেমিকার কথা বলছি
আমি এক নারীর কথা বলছি!
পুরুষ, তোমার ঐ নরক আক্রান্ত চোখে
সদ্য ফোটা কুমারীকে দেখো
অথবা কোনো বেশ্যাকে
নয়তো তোমার প্রেমিকাকে
দেখতে পারো কোনো নারীকে!
খুব কাছে এসে মাথা রাখো বুকে
বুকটা হতে পারে সেই কুমারীর
অথবা সেই বেশ্যার
নয়তো তোমার প্রেমিকার
হতে পারে কোনো নারীর!
এবার নিঃস্তব্ধ হয়ে যাও
এক মিনিট নিরবতা পালন
শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছো তুমি?
আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছো?
কে যেন কাঁদছে
কে যেন ডাকছে
কে যেন ধুঁকছে
কে যেন মরছে।
প্রশ্ন করো, কে? কে তুমি?
কথা বলো? কথা বলো?
আবারো চুপ হয়ে রও
এবার দুই মিনিট নিরবতা পালন!
“আয় খোকা বুকে আয়,
ক্ষুধা পেয়েছে তোর?
কাঁদছিস যে? পিপাসা পেয়েছে?
এতো ক্ষুধা বুকে? এতো ক্ষুধা?
চিনতে পেরেছিস তো খোকা?
এ বুক চিনতে পেরেছিস?
এতোদিন পর মাকে চিনতে পেরেছিস?”
লিখেছেন: স্বাতী রায়
নারীদিবস আসে, চলে যায়। বছর বছর। কিছু সভা-সমিতি, কিছু গোলাপ-চকোলেট-বেলুনের বিক্রিবাটা। আর হোয়াটস অ্যাপে কিছু খাজা রসিকতার আদান-প্রদান। এর বাইরে ঠিক আর কি যে হয় সেটা আমরা আম-জনতা বুঝেই পাই না! আর সত্যি কথা বলতে কি, আমরা শহুরে বা তথাকথিত শিক্ষিত মেয়েরা তবু দিনটার খবর রাখি, সেটাই বা জানেন গোটা বিশ্বের ক’জন!
তবু গতানুগতিকতায় মাঝে মাঝে ছেদ পড়ে। যেমন একটা ঝটকা লাগল, এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল বিষয়টি দেখে। Think equal, build smart, innovate for change. সবাইকেই সমান বলে ভাবা । ঘর-বাড়ী-শহর-বাজার-কাছারি-অফিস-আদালত, রাস্তা ইত্যাদি পরিকাঠামোই শুধু নয়, বিভিন্ন নীতি, সরকারী-বেসরকারী সেবা ইত্যাদি সবকিছুই ছেলে-মেয়ে এবং এই লিঙ্গ-বাইনারীর বাইরে যারা, তাদের সবদলের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবেই তৈরি করা যাতে সবাই সমানভাবে সেই সেবার সুযোগ পান । দিনবদলের জন্য নতুন নতুন আবিষ্কারকে হাতিয়ার করা। এই হল ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের লক্ষ্য। তিনটি বিষয়, দিনবদলের প্রশ্নে প্রত্যেকটি বিষয়-ই অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। আর প্রতিটি বিষয়ই আলাদা আলাদা বিশদ আলোচনার দাবী রাখে। তবু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা রয়েছে সবার সামনে। Think equal। যদি সমান না ভাবতে পারি তাহলে তো একেবারে গোড়ার লিঙ্গ-সাম্য ব্যাপারটাই জোলো হয়ে যায়। আর সমান না ভাবতে পারলে কি ভাবেই বা আমাদের-ই হাতে তৈরি পলিসি সবাইকে সমান চোখে দেখবে? আমাদের তৈরি স্পেস কিভাবে সবার জন্য সমান নিরাপদ হবে? আমাদের চিন্তার মধ্যে যদি অন্তর্নিহিত অসাম্যের ভাবনা থাকে তাহলে পরিষেবাগুলো যে আদৌ সবার কাছে সমান ভাবে পৌঁছান দরকার সেই ভাবনাটাই তো ঠিক করে তৈরি হবে না! সমাধান তো দূর অস্ত।
সমান-সমান
সমান ভাবা? সে তো আমরা কবে থেকেই জানি। আমরা মানে শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরা, উচ্চবিত্তেরা। যাদের বেশীর ভাগেরই বসবাস নগর- শহর- ছোট শহর- গঞ্জের সীমানায়। ওইসব মেয়ে বলে বৌকে ত্যাগ করা বা বাচ্চাকে মেরে ফেলা, মেয়ে সন্তানকে পড়াশোনা না করতে দেওয়া, বাল্য-বিবাহ, বৌ-কে খেতে-পরতে না দিতে পারলেও তার উপর মরদ-গিরি ফলান, সে পিঠে বাঁশ ভেঙ্গেই হোক বা পেটে বছর বছর বাচ্চা ঠেসে দিয়েই হোক – ওসব হয় হাড়হাভাতে ছোটলোকদের ঘরে। আমরা হলাম শিক্ষিত, হাতে অল্প-বেশী দু-পয়সা আছে। আমরা ছেলে-মেয়ে আলাদা করে দেখি না।
এক মিনিট, এক মিনিট থামুন দাদা – ছেলে মেয়ে সমান করে দেখেন তো বুঝলাম, না-ছেলে, না-মেয়ে যারা, আপনার ঘরে তারা নিশ্চিন্তে বিকশিত হতে পারছে তো? তাদেরও কিন্তু একটি ছেলে বা একটি মেয়ের মতই বা হয়তো তাদের থেকে একটু বেশীই আদর, ভালোবাসা লাগে, বাইরের জগত থেকে ধাক্কা খেয়ে বাড়ী এলে আরো একটু বেশী শান্তির ঘর লাগে যাতে ক্ষতের স্থান সেরে উঠতে পারে। পাচ্ছে তো তারা সে সব?
মেয়েকে আমরা মোটেই আলাদা করে দেখি না। পড়াশোনা-নাচ-গান কোন দিকটাতে কার্পণ্য করেছি? স্কুল ছাড়িয়ে কলেজ, কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় – সবটাই তো টেনেছি। তারপরই তো বিয়ে দিয়ে দিলাম – একেবারে হীরের টুকরো ছেলে। জামাই আমার মেয়েকে বড্ড ভালোবাসে – মেয়েও তো চোখে হারায়। কি সুন্দর সংসার করছে দুটিতে, দেখলেও চোখ জুড়ায়!
আচ্ছা মানলাম আপনি ছেলে আর মেয়েকে আলাদা ভাবেন না, তাহলে আমাদের দেশে কেন এখনো একটা ছেলের চাকরী না জুটলে জীবন বৃথা, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওই চাকরী না জোটাটা অতটা গুরুত্ব পায় না কেন? আর মেয়েকে আলাদা করে না দেখলেও ছেলেকে তো আলাদা করে দেখেন। তার জন্য কেমন স্ট্যান্ডার্ডটা আলাদা হয়ে যায় না মাঝে মাঝেই ? হেয়ারকাটিং তাও ছেলেরা শেখে, কিন্তু কজন ছেলে বিঊটিশিয়ানের কোর্স করে? বা নিজের ছেলে ঘরে বসে সংসার সামলাচ্ছে আর ছেলের বৌ চাকরী করছে এটা কল্পনা করতে পারেন? এমনকি কে কি কাজ করবে তাও কি আলাদা করা নেই? বাড়ী করার কাজে কতজন মহিলা রাজমিস্ত্রী বা প্লাম্বার বা ইলেক্ট্রিশিয়ান দেখা যায়? কেন আমরা এখনো বলি, মায়েরা চাকরী করলে ছেলে মেয়ে মানুষ হয় না। বাবারা চাকরী করলে কিন্তু কেউ বলে না সন্তানের পড়াশোনা হয় না। অথবা, পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরের কাজকর্ম শেখাটা মেয়েদের জন্য একটা মুখে-না-বলা-নিয়মের মধ্যে পড়ে – সেটা শুধু মেয়েদের জন্যেই বরাদ্দ থাকে কেন? কোনদিন কোন ছেলের মা’কে বলতে শুনেছেন, আমার ছেলেটার আর পড়াশনা হবে না, সারাদিন শুধু সাজছে, গুজছে আর ঘর গোছাচ্ছে! অথচ মেয়েদের মায়েদের মুখে একথাটা আকছার শোনা যায়।
মলিন মর্ম মুছায়ে
কথাটা সমান ভাবা, সব বাবদেই। শুধু কিছু বাহ্যিক আচরণ নয়, একেবারে নিজের মনের অন্তঃস্থল থেকে সব রকমের অসাম্যের ভাবনা হটিয়ে দেওয়া। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে আমরা যতই মুখে বলি না কেন, ক্লাস এবং কাস্ট নির্বিশেষে ভারতে এখনো ছেলে হল হীরের আংটি আর মেয়ে হল মাটির ঢ্যালা এই ধারণার কালো ছোপ রয়ে গেছে। আর তৃতীয় লিঙ্গ আজো আমাদের ভাবনার পরিসরে আসে না। শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরে যদি বা সরাসরি তফাৎ করাটা, যেমন ছেলের জন্য দুধের গ্লাস, মাছের মাথা, মেয়ের জন্য মুড়ির বাটি, আজকাল আর প্রায় চোখে পড়ে না, তবু আমাদের চেতনা থেকে তফাৎ পুরো মুছে যায় নি আজো। তাই আমরা মেয়েকে বলি, “রোদ্দুরে বাইরে যাস না, একটু রোদ পড়লে যাস বরং” আর ছেলেকে বলি “ঘরের মধ্যে সারা দুপুর ধরে ফুটবল পেটাচ্চিস কেন, যা তো বাড়ির বাইরে যা!” – – মেয়ের গায়ের রং ফুটফুটে থাকাটা জরুরি, কিন্তু ছেলের জন্য কি আর সে কথা খাটে! “মেয়েদের জন্য স্কুলের চাকরী, নিদেন পক্ষে সরকারী চাকরীই ভালো” বলি, কারণ মুখে না বললেও মনে জানি যে মেয়েকে চাকরীর পাশাপাশি সংসারের কাজও করতে হবে। বেশীর ভাগ সময়েই সেটা পরিবারের একটি ছেলের থেকে অনেকটা বেশী। আর লিঙ্গ-বাইনারীর বাইরে যারা তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে বাইনারীর বাধ্যকতার গণ্ডী – মানিয়ে নিতেই হবে।
সমস্যাটা হল যে তফাৎগুলো বাইরে থেকে দেখা যায় বা যেগুলো আমাদের চিনতে শেখান হয়েছে, যেমন দুধের গ্লাস বনাম মুড়ির বাটি, তাদের চিনে নিয়ে জীবন থেকে বাতিল করা সহজ। এই মোটাদাগের জিনিসগুলো নিয়ে অনেক অনেক সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচী আগেও নেওয়া হয়েছে, এখনো চলছে আর ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু তার বাইরের যেগুলো এখনো চেনা হয় নি বা বলা ভাল চোখে আঙ্গুল দিয়ে চেনানো হয় নি, সেগুলো নিজে থেকে চিনে নেওয়া ততটা সহজ নয়। একটা বক্তব্য বা ধারণার পিছনের চিন্তাটা কি, সেটা কি সত্যিই অর্ধচেতন বা অবচেতনের লিংগ-ভাবনার অন্তর্গত অসাম্যের ধারণার উপরে গড়ে উঠেছে নাকি তার পিছনে অন্য কোন মানবিক অনুভূতি রয়েছে, এই টানাপোড়েন চলতেই থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানের কথা। এমন একটা নিষ্কলুষ পারিবারিক বন্ধনের উদযাপনের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক অসাম্যের স্ট্যাম্প লাগানোটা কতটা জরুরি এই কথাগুলো শুনতে শুনতে যে কোন মানুষেরই গুলিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক – তবে কি আমি আমার দাদা কিংবা ভাইকে যথেষ্ট ভালোবাসতে পারি নি? অপরাধবোধ জাগে মনে।
এই টানাপোড়েন থেকে বেরোনর জন্য চাই ক্রমাগত সতর্ক নজরদারি। নিজেদের ব্যবহার, নিজেদের চারপাশের মানুষের ব্যবহার, কথা বার্তায় যদি কখনো কোন স্টিরিওটাইপ ধরা পড়ে, তাকে সচেতনভাবে বর্জন করা। নিজের মধ্যে থাকা যে সব চিন্তাগুলো দুজন মানুষের মধ্যে অকারণ পার্থক্য করতে শেখায়, সেগুলোকে চিনতে শেখা দরকার। যেমন সাত বছরের মেয়েটির জন্মদিনের উপহার কিনতে গিয়ে যদি রুবিকস কিঊবের দিকে হাত বাড়িয়েও আবার সরিয়ে নিতে হয়, তাহলে ভাবা দরকার, কেন? ইচ্ছা থাকলে আর নিজে সচেতন থাকলে অনেকটাই ভুল অভ্যেস, ভুল ধারণাগুলোকে চিনে ফেলা যায়। তার উপরে আরও ভালো হয় যদি নিজের চারপাশে একটা সকলের সমানাধিকার চান এমন আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনের বৃত্ত তৈরি করা যায়, যারা একে অপরের বিচ্যুতি ধরিয়ে দেবে, সতর্ক করে দেবে। আর হ্যাঁ, বিচ্যুতির জায়গা হতে পারে ঘরের মধ্যে বা ঘরের বাইরে – যে কোন জায়গাতেই। কাজেই নিজের উপর নজরদারী চলুক সবসময়, ফাঁক না পড়ে। আর এই কাজটা করার হক আছে শুধু আমাদের মত আমজনতাদেরই। নিজের ভাবনার পরিশুদ্ধিকরণের দায় আর কেউ নিতে পারে না।
একটি বছর দশেকের ছেলে একবার নালিশ জানিয়েছিল , “এই যে আমার স্কুলে সব সময় বলে ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান, তাহলে প্রেয়ার লাইনে কেন বলে ছেলেদের চুল বড় হলেই শাস্তি? সবাই সমান হলে, হয় মেয়েদের চুল ছোট রাখাটা ছেলেদের মত বাধ্যতামূলক হোক না হলে ছেলেদেরও চুলের দৈর্ঘ্য নিয়ে বকাবকি বন্ধ হোক।“ সবাই বাচ্চা ছেলের কথায় ভারী হেসেছিল, তবু …
লিখেছেন: চিরঞ্জীব হালদার
কোন স্ত্রীবাচক নামের সাথে বালা যুক্ত হলে তাকে কি অনাধুনিক বলা যায়? এক শতাব্দী আগে কে আর গাঁয়ে কোন অপাংক্তেয় অসুন্দর মেয়ের ঠিকুজি লিখে রাখে – তাই ননীবালার কোনও ঠিকুজি ছিল না। প্রান্তবাসী ঝিম কালো ৫-ফুটিয়া। বয়স ৯০- এর আশেপাশে। ১৮-র বৈধব্য যাতনা তিক্ত।
একমাত্র উর্পাজনক্ষম ছেলের গরবিনী মা। তার নারীচেতনার কোনও ছবি আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। সম্পন্ন গ্রামের মধ্যদেশে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক ভানকি পরিবার। দুই নাতবৌ আর একমাত্র ছেলের বৌকে নিয়ে ভরাট সাঁজোয়া কলতান। তিরিশ ফুট লম্বা আর আট ফুট চওড়া দাওয়ার পূব দিকে এক শাল কাঠের তক্তোপোশে তার সূর্যাস্ত -সূর্যোদয়। তার খাওয়া শোওয়া থেকে নিত্য কর্ম সব ওই শালরথে। তার অশৈলপনায় এবাড়িতে কেহ টুঁ’ শব্দটিও করতে পারবেনা। তাহলে এবাড়িতে তার ঠাঁইই জোটা দুস্কর! প্রথমে ধোপা নাপিত বন্ধ, তারপর এই ভদ্রাসনও ত্যাগ করতেই হবে। সে তার বৌমা হোক বা নাতবৌ। অদূরে রান্না ঘরে মুড়ি ভাজার গন্ধ উড়লেই তার মুখের সুরধ্বনি উথলে উঠতো।
“…ওঃ গোর বেটার আবাগীরা তোরা একা একা মুড়ি খাচ্ছিস, আজ শচী আসুক। নকুল খাকিরা সব মুড়ি ভেজে পদ্মর বাড়িতে চালান হচ্ছে।”
আমার মা আগেই সাদা কলাইয়ের থালা নিয়ে শাশুড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতো প্রথম টগর টগর উষ্ণফোটা মুড়ি অগ্নিসমর্পনের পর আগে ঝি বুড়িকে না দিয়ে অন্য কাজেই হাত দিত না। দেরি হলেই অথর্ব ননীবুড়ি খেজুর পাতার ঝাড়ুও ছুঁড়ে মারতো।
আমার সহোদরা মেজো পুতির নাম সুন্দরী, তারই নির্বাচন! বলা বাহুল্য এই নামটি এক অসুন্দরীর নাম হতেই পারে না। ছোটবেলায় সে একঘর গোল -গাল নাদুস পোড়া কয়লার তাল মাত্র। এমন নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম রাখবে এ বাড়িতে কার সাধ্যি!
এই ননীবালা এমন একজন নারী যিনি অলক্ষ্যে শচীর সংসারের চালিকা শক্তি। তিনি হলেও অথর্ব বা শারীরিক ভাবে অপাংক্তেয় এনার জন্য সংসারের যত বাড় -বাড়ন্ত। সামান্য এক মুটে ভানকি থেকে শচী আজ প্রায় বিঘে কুড়ি জমির মালিক। আর বিজয় বাঁড়ুজ্জেদের বাজারে মহাজনী আড়তদার। ননীবালা ওরফে শচীনের মাতারানী এক অপাপবিদ্ধ কর্মঠ নিপাট সামাজিক নারী।অনেকের আপদে বিপদে শুনেছি পাশে থেকেছেন। প্রাক গোধূলিতে দেখতাম বাড়ির প্রশ্বস্ত আঙিনায় আরও অনেক নাতিপ্রৌঢ়াদের ভীড়। গ্রাম্য রসালো আড্ডা। বৈকালিক বিনোদনের প্রসুতিভূমি। কেহ কেহ পাঁচ পোয়া টাকায় গড়া সোনার নথ নেড়ে নেড়ে আসর মাত করতো।
এমন আসরের ননী মধ্যমণি তো নন কিন্তু তাকে আড়ালে রেখে কোন গুলতানি করা যাবেনা, তাহলে তার খিস্তিতে ওঝাও ভাগবে। … ও আটকুড়ি ঝিরা…, লাওঠারবেটিরা… তিনকুলখাকির ঝি রা… এখানে এলে কি মহাকুষ্ঠ হবে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমন নির্ভার সাহসী ননী। এই ৯০য়ে টান টান জিভ। টাকুর টাকুর শব্দ তুলে কুলের আচার চাটা টান টান জিভ। মিথ্যেহীন দিন যাপন করা ১৮ র বিধবা। সাহসী। একাকিনী। ছেলে সম্বল আর না দমা গতর দিয়ে গড়া এই সংসার।
তা শচী আবার কথায় কথায় দান ধ্যানী। ননীর প্রশ্রয়ে তো বটে। আবার সখের ওঝাগিরি ও আছে। পাঁচ পাড়ার বাতাস লাগা বাচ্চা, ঘুসঘুসে জ্বরো রোগী থেকে জল পোড়া, তেল পোড়ার লোক বা বউ-ঝি’র আনাগোনা সকালে লেগেই থাকতো। ননি তক্তোপোষে বসে বসে হারানের বাপ কেমন আছে বা উপেনের ছেলের পিলেটা কমেছে কিনা জানার জন্য বোধের নাড়ি টনটনে। আবার এই সাত সকালে ছেলের আড়ালে ন নী বুড়িকে একটু রাগাতে বা রগড় করতে উস্কে দিতো।
আমরাও বাদ যেতাম না কখনো। চিমটি কেটে দূরে পালাতাম। ‘কোন গোরবেটার পো আমায় চিমটি কাটে—। এমন কপট চিমটি গ্রহনের মানুষ রা আজ আর সামাজের কোথাও নেই। আশ্চর্য এটাই, যে বাচ্চা চিমটি কেটে বড়োর হাতে মার খাচ্ছে, তাকে বুড়ি পরক্ষণে উদোম শাপ শাপান্তি করে। নাত বৌ বা বড় নাতি যেই হোক।
ইনি দজ্জাল ছিলো কিনা জানা হয়নি। বৌমাকে গুনে গুনে ভাঁড়ার থেকে হিংয়ের বড়ি দিয়েছে কিনা বা কুনকে মেপে মুড়ি দিতো কিনা জানিনা। নারী হয়ে অন্য নারী কে গঞ্জনার জন্য তার জিহ্বা চিরে চিরে লক-লক করতে দেখিনি। বড় রসিক এই ঝিম কালো ননীবালা।
শ্যাম রাধের প্রেমাভিবিলাসের অনেক গান তার কণ্ঠস্থ। খাওয়া দাওয়ার পর এক ভাতঘুমের পর এক রহিস মেজাজ তাকে পেয়ে বসতো। অনামী বৈষ্ণব পদকর্তাদের গ্রামীন অপভ্রংশ উচ্চারণ গীতি। তার অপরীশীলত কাঁপা গলার সুর শোনার জন্য যেন বিকালের রোদ বহুদূর থেকে তার তক্তোপোশে আসে পাশে জমা হতো। সেই সব বিরহ গাথা নব্বুইয়ের ননীদের মুখে অপভ্রংশ হতে হতে পল্লীতে ৬য়ের দশকেও ‘হাতি মেরে সাথি‘ র পাশাপাশি সমান বিরাজমান। তখন টেপ রেকডিং এর কনসেপ্ট চালু হয়নি। ধান ভানতে পদাবলী গীত আমরা বেশ ভালো শুনেছি। তাব্লির মার আবার নির্বাচিত ঢেঁকি গান বেশ জনপ্রিয়। রসিকা ননী ওই খাটে বসে কাঁপা কাঁপা সুরে লেজ নাড়াতো। কিছু না করেও সে এবাড়ির মহা হাইকমান্ড। এমন এক ননীবালা যার মন্ত্রে সব্বাই এক সুরে বাঁধা। নারী হিসাবে তার প্রাপ্ত মান্যতা চার চার জেনারেশনকে ধরে রেখেছিল কোন এক অলীক ভাবক বাঁধনে। তিনি কতটা আধুনিক, কতটা সহনশীল, কতটা জননী, কতটা কালপ্রনয়ী তা বলে দেবার একজনও আর বেঁচে নেই। স্মৃতি নিংড়ে এমনই ননী উঠে আসছে কালের পথ ধরে।
লিখেছেন: মৌ মধুবন্তী
OMG! বয়ঃসন্ধি। এতে বিসর্গ থাকার কি মানে আছে? তেমনি মেয়েদের এই মাসিক পিরিয়ড আর পিউবার্টি এবং সর্বশেষ ধাক্কা মেনোপজ হবার খুব কি দরকার? মেনোপজ। তো এইসব পিউপিউ কিঁউ কিঁউ কেন। মাসিক মাসিক, মেনোপজের মত বিষয়গুলো পুরুষদের হলে কী ক্ষতি হতো? আর এইসব বিষয়গুলো কেন পুরুষদের কাছ থেকে লুকোতে হবে? এটা সর্বজনবিদিত যে মেয়েদের এইসব প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যদি সৃষ্টির সিস্টেম অনুসারে মেয়েদের পিরিয়ড হবে প্রতিমাসে, তা হলে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম, অফিসের কাজ থেকে মেয়েদেরকে প্রতিমাসে সেই সাতদিন ছুটি দেয়া অনিবার্য, প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে।
বিশ্ব নারীদিবসে ‘ব্যালান্স ফর বেটার‘ যদি থিম হয়েছে, তা হলে এই দাবীও উত্থাপন খুব জরুরী। পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধির ঝক্কি আবার মেয়েদের যেমন হয়, ছেলেদেরও তেমনি হয় তবে মেয়েদের আট থেকে বারো বছরের মধ্যে যে কোন সময় হতে পারে, তা হলো মাসিক পিরিয়ড, রক্তপাত হওয়া, না না একে পাত বলা যাবে না। এটা হলো স্রাব। আরে আরে পাত আর স্রাব যাই হোক কষ্ট কিন্তু একই।
আর এই বিষয়ে ছেলেদেরকে কোন শিক্ষাই দেয়া হয় না। প্রতিটি মায়ের উচিত তার ছেলেকে মেয়েদের এই পিরিয়ডের ব্যাপারে অবগত করা, এর কষ্টের ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া এবং কীভাবে একজন ছেলে তার পার্টনার মেয়েকে এই বিশেষ সময়ে যত্ন করবে তার বিশেষ শিক্ষা দেয়া। আমার ভেবে অবাক লাগে, কোন মা কেন তার ছেলে বাচ্চাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলে না, শেখায় না, আর সেটা করছে না বলেই ছেলেদের গোবরে মাথায় এই কষ্টদায়ক অধ্যায় নিয়ে কোন চিন্তা নেই।
হিন্দু ধর্মে অশৌচ উপাধি দিয়ে নারীকে আরেক রকমের কয়েদি জীবনে ঠেলে দেয়। অনেক পুষ্টিকর খাবার খেতে দেয়া হয় না। ধর্মের সাথে খাবারের এই যে বিধিনিষেধ এর কোন মানে আমি খুঁজে পাইনা। পুষ্টি দরকার শরীরে ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে। কিন্তু একটি ছেলের বয়ঃসন্ধি কালে মায়েরা তাকে অনেক যত্ন করে, গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে, মায়েদের দুশিচন্তার অন্ত থাকেনা। এমনি দেখেছি অনেক পরিবারে। আমাদের পরিবারে ছেলেদের যখন এই পর্যায় এসেছিল, আমি তখন বারোহাজার মাইল দূরে। আমি তাই প্রত্যক্ষ করতে পারিনি পার্থক্য ছিল কীনা। তবে এটা জানি যখন আমার প্রথম মাসিক হয়েছে, আমার মা আমাকে কোন ব্যবস্থাই শিখিয়ে দেয়নি। সেই অভিমান আমার আজো আছে। কিন্তু কেন করেনি। মা নাকি লজ্জা পেয়েছে। মায়ের লজ্জার চেয়ে আমার যে হতবিহবল অবস্থা আর সামাল দেবার যন্ত্রণা তা বহুগুণ বেশী ছিল।
প্রতিটি মায়ের উচিত তার মেয়েকে হাতে নাতে প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দেয়া। এই সময়ে খাবার খেতে না পারার জন্য তাকে অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করে কিনা তা জিজ্ঞেস করা, জ্বর আসে বলে তাকে রেস্ট নেবার সুযোগ করে দেয়া। স্কুলে শিক্ষকদের সাথে বিষয়টি খোলাখুলি আলাপ করে জানিয়ে রাখা। তাতে করে একটি মেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নিজের দেহের ওপর তার সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে।
সবশেষে নোরা এফরনের উক্তি দিয়ে উপসংহার টানছি-
‘Whatever you choose, however many roads you travel, I hope that you choose not to be a lady. I hope you will find some way to break the rules and make a little trouble out there. And I also hope that you will choose to make some of that trouble on behalf of women.’
– Nora Ephron
নারীর দিবস আর নয়, বিশ্বমানব দিবস হোক প্রতিটি নারীর জন্য।
লিখেছেন: শিবব্রত মণ্ডল
সার্কাসের মেয়েরা বেশ ভাল হয় বেশ ভাল
আঁটোসাঁটো চেহারা, কস্টিউম, লাল নীল আলো
সার্কাসের মেয়েরা বেশ ভাল হয় বেশ ভাল।
কর্তাবাবু টানা সাত দিন সন্ধ্যা বেলায় হলে
পাড়াতে এই প্রথম সার্কাস, বাদ দিলে কি চলে?
বাবু সেদিন সামনে বসে একটুও না নড়ে
সেই মেয়েটি গেল কোথায় সাইকেল যে চড়ে!
ঐ তো মেয়ে এগিয়ে আসে, বাবু একটু কাশে
রঙীন সাইকেল রঙীন ছাতা ঐ তো মেয়ে হাসে।
কী সুন্দর ছোট্ট ড্রেস স্লিম শরীরে মানায়
এই বাজারে আর কী মেলে এই ক’খানি আনায়?
ফর্সা গায়ে আলোর ঝলক ফর্সা পায়ে মোজা
নীলচে রঙের ময়ূর পালক সিল্কি চুলে গোঁজা।
এই দেখতেই হলে ঢোকা আর কি কিছু চাই?
অমন মেয়ে অমন চলন সার্কাস তো ছাই।
জ্বলছে আলো চলছে মেয়ে সুঠাম দুটি পায়
ইচ্ছে করে নীল পরীটির একটু ছুঁতে গায়।
খানিক পরে কর্তা দেখেন সেই পরীটি নাই
পয়সা দিয়ে হলে ঢোকা ঐ মেয়েটাই চাই।
দড়ি বেয়ে চলতে নাকি পড়ল মেয়ে নীচে
মেয়ে নাকি পোয়াতি ছিল মাস চারেকের কাছে।
খানিক সময় বন্ধ সবি খেলা কি আর হবে!
গ্রীণরুমেতে চাপা কান্না ঐ মেয়েটির তবে।
একটু পরেই আবার শুরু জ্বলল রঙীন আলো
আবার মেয়ে আরো মেয়ে সার্কাস বেশ ভাল।
সেই খেলাটাই আবার হবে সেই মেয়েটাই নাই
নতুন পায়ে নতুন মোজা আর কী তবে চাই!
কর্তা বাবু হল ছেড়েছেন খেলা হল শেষ
গ্রীণরুমেতে চাপা কান্না সেই গলারই রেশ!
তবে বুঝি সেই মেয়েটিই দেখিয়ে গেল খেলা
শরীর জুড়ে তীব্র বেদন জীবন জুড়ে জ্বালা।
আজ ঘুমোতেই প্রথম রাতে স্বপ্নে মেয়ে এল
রঙীন ছাতা আঁটো পোশাক ফর্সা মেয়ে দোলো..
সার্কাসের মেয়েরা বেশ ভাল হয় বেশ ভাল।
লিখেছেন: আলপনা তালুকদার
– হারামী, পারিস্ নাতো বিয়ে করেছিলি কেন?
কষে একটা চড় মারলো আরিফ।
– কি বললি তুই? আমি পারিনা? আমি পারিনা তো আমার কাছে চাস্ কেন? যাকে পাস্ তাকে দিয়ে তোর চুলকানি মিটালেই পারিস!
– স্বামী থাকতে যার তার কাছে যাব কেন? আমি কি বেশ্যা নাকি?
– হ্যাঁ, তুই বেশ্যা। তোর মা-বোন সব বেশ্যা। তোর চৌদ্দগুষ্টি বেশ্যা, খানকি, নটি।
বলে সজোরো একটা ঘুষি মারলো রিনির যোনিতে। আরিফের হাতের মার ভীষণ লাগে। পুলিশের হাত বলে কথা! তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে সশব্দে কেঁদে উঠলো সে। অসহায়ের মত বিছানায় পড়ে থাকলো কিছুক্ষণ। রাগে ফুঁসছে আরিফ। যেন আবার মারবে। ব্যথাটা সামলে নিয়ে ভয়ে ভয়ে রিনি বিছানা থেকে নেমে টয়লেটে গেল। তার পুরো শরীর উলঙ্গ। টয়লেটের আয়নায় তার নিজের অসহায় মুখটা ভেসে উঠলো। রিনি একবার আনমনে তাকালো। তারপর খেয়াল করে দেখলো তার ভারী ভরাট বুক। ফর্সা মসৃণ লিকলিকে শরীর। একদম মোমের মত। কিন্তু কী লাভ?
বাম বুকে আরিফের দাঁতের কামড় লাল হয়ে আছে। ওখানেও ব্যথা। কাঁদতে কাঁদতেই সে নিজেকে পরিষ্কার করে বেরিয়ে এলো। বিছানার পাশে পড়ে থাকা গোলাপী মোলায়েম নাইটিটা শরীরে গলিয়ে দরজা খুলে পাশের ঘরে গিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লো সে।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিনি। তার পুরো জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। এখন তার কী করা উচিত, সে ভেবে পায়না।
তার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। কিন্তু পুরোপুরি শারীরিক সুখ সে পেয়েছে মোটে তিন-চারদিন। প্রতিবার দুই-তিন মিনিটেই আরিফের দম ফুরিয়ে যায়। তীব্র অতৃপ্তির কষ্ট নিয়ে সে সারারাত ছটফট করতে থাকে। ব্যস্ততার অজুহাতে দিনের পর দিন আরিফ তার কাছে আসেনা। সামান্য ঝগড়া হলেই কথা বলেনা পনেরো দিন। রিনি আরিফের কাছে গেলেও সে ব্যস্ত থাকে। রাতে রিনিকে এড়িয়ে যায়। কখনও ক্লান্তি, কখনও ঘুমের বাহানায়। প্রতিবার রিনি সেই অতৃপ্তি নিয়েই ফিরে আসে নিজের ফ্ল্যাটে।
রিনিদের পাশের বাড়ীতে তার বান্ধবী ছিল সুনীতা। তার বড়বোন অনীতার যখন বিয়ে হয়, তখন রিনি বিয়ের প্রায় পুরোটা সময়ই ছিল সুনীতার সাথে। বিয়েবাড়িতে। বরটা দেখতে মোটেই ভালো না। মাথায় টাক, বড় বড় কাঁচাপাকা মোচ, ইয়া ভুঁড়ি! বুকের লোম পর্যন্ত পাকা! বিয়ের পর সুনীতার এক দীদা বলেছিল, “হা ভগবান!! এত কচি মেয়ে, আর তার বর কিনা এই! দেবরদেরকে দিয়ে কোন রকমে জীবনটা চলে যাবে আর কী!”
কথাটার মানে তখন রিনি বোঝেনি। এখন হাড়ে হাড়ে বোঝে। কেন বিবাহিতা মেয়েরা পরকীয়া করে, তাও এখন খুব বোঝে। রিনির লাভ ম্যারেজ হয়নি। বাবার পছন্দে বিয়ে। রিনির কোন প্রেম ছিলনা। তাই শরীরের কোন অভিজ্ঞতাও তার ছিলনা। ফলে বিয়ের পর শরীরের বিষয়টা ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই আরিফ সতেরো দিনের মাথায় চলে গেল বিদেশে। শান্তি মিশনে। এক বছরের জন্য। পরের মাসে রিনি জানতে পারলো, কুহু তার পেটে।
ফুটফুটে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। রিনি কুহুর খুব কাছে সরে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ওর গালে। চুলে হাত বোলালো। ছোট হাতটা নিজের মুঠির মধ্যে নিল। ওর নরম শরীরটা তার কীযে ভাল লাগে! কী মিষ্টি ওর গায়ের গন্ধ! চুলের গন্ধ!! ওর মুখের বাজে গন্ধও রিনির ভালো লাগে। মায়েরা বোধহয় এমনই। বাচ্চার কোনকিছুই তাদের খারাপ লাগতে নেই। মেয়েটা খুবই অলস। রাতে ঘুম পেলে আর দাঁত ব্রাশ করতে চায়না। বেশীরভাগ দিন ব্রাশ না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। চকলেটের অত্যাচারে তার দুইটা দাঁতে পোকাও ধরেছে।
রিনি এই ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে, কুহু কিছু টের পায়নি। আরিফ বিশ্রী ভাষায় প্রায়ই তাকে গালি দেয়। জঘন্য। শোনা যায়না। কিন্তু আরিফ কী অবলীলায় ঐ নোংরা শব্দগুলো বলে চলে। পুলিশেরা সবসময় ঐ ধরণের শব্দ বলে অভ্যস্ত বলে ওগুলো ওদের কাছে মোটেই অশ্লীল মনে হয়না।
আরিফ পুলিশ অফিসার। রিনি দেখেছে, বাইরে এদের ঠাটবাট যতই থাক, প্রচন্ড চাপ সহ্য করে এদের চাকরী করতে হয়। বসের খবর্দারি, অফিসের কাজের কোন সময়-অসময় নেই, সবসময় নিজের প্রমোশনের জন্য নিজের কাজের পারফরমেন্স ঠিক রাখার চেষ্টা, তদবির, বদলির ভয়, রাজনৈতিক চাপ ইত্যাদি অনেককিছু সামলে চলতে হয়। রাতদিন অপরাধীদের সাথে থাকতে থাকতে এদের মানবিক দিকগুলো ফিকে হয়ে যায়। বৌ-বাচ্চার প্রতি এদের ভালবাসা প্রকাশের, পরিবারকে সময় দেবার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যায়। দরকারী জিনিসপত্র কিনে দেয়া, লোক দিয়ে বাজার করিয়ে দেয়া বা মাস শেষে টাকা দেওয়া মানেই তার দায়িত্ব শেষ।
রিনি নিজে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাবা পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। ছোট চাকরী। তবে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই রিনির বিভাগের এক সিনিয়র শিক্ষকের সুদৃষ্টির কারণে তার চাকরীটা হয়েছে। তিনি তখন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। রিনি অবশ্য আশা করেনি যে, চাকরীটা তার হবে। রেজাল্ট যতই ভালো হোক, ধরাধরির লোক না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়না। তাই মাস্টার্সে পড়াকালীন বাবার চাপে সে বিয়েতে রাজী হয়। বাবা তখন অবসরে। আরো দুটো বোন, একটা ভাই পড়াশোনা করছে। তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। রিনির বাবার শরীরটাও খারাপ। তাই তিনি অন্ততঃ বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে একটুখানি স্বস্তি পেতে চান।
রিনি আপত্তি করেনি। আরিফ দেখতে সুদর্শন। বাড়ির অবস্থাও ভাল। কোন চাহিদা নেই। রিনির পরিবারের সবকিছু জেনেই আগ্রহ করে বিয়ে করতে চায়। রিনির চাকরীটা হবার পর ওর বিয়েটা হলে রিনি কিছুতেই এ বিয়ে করতো না। রিনি দেখতে সুন্দরী। হয়তো কোন শিক্ষককেই সে অনায়াসে বিয়ে করতে পারতো। তার ক্লাসমেটদের অনেকেই তাকে পছন্দ করতো। তারা এখন ভালো চাকরী করে। রিনি কাউকে পাত্তা দেয়নি। তার কাছে প্রেম করার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে পাস করা বেশী জরুরী ছিল।
এমনিতে রিনি স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। কোথাও গেলে তিন-চারজন পুলিশ তার গাড়ীর দরজা খুলে দেয়, ডাকামাত্র ছুটে আসে, সারাদিনের জন্য ড্রাইভারসহ গাড়ী নিয়ে যেখানে খুশী যেতে পারে। শাড়ী-গহনার কমতি নেই। ঢাকায় বদলী হওয়ার আগে যখন ওরা একসাথে থাকতো, তখন আরিফ প্রচুর ঘুষের জিনিসপত্র রিনির বাসায় পাঠাতো। লোকেরা এসে এসে দিয়ে যেত। বড় বড় ইলিশ মাছ, গলদা চিংড়ি, খাসির মাংস, বড় বড় মিষ্টি, গাদা গাদা ফল। রিনি অত খেতে পারতোনা। একে ওকে বিলাতো।
এখনও মাঝে মাঝে পাঠায়।
প্রথম প্রথম রিনি আরিফের ঘুষ খাওয়া নিয়ে আপত্তি করতো।
– ঘুষ না খেলে হয়না?
– সমস্যা কী?
– ঘুষ খেলে সমস্যা নেই?
– না নেই। পুলিশের চাকরী করবে, অথচ ঘুষ খাবেনা, এটা হয়না। চোখের সামনে বাকীরা ধাঁ ধাঁ করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, সম্পদ করবে। তোমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া পুলিশের চাকরীটা এমন, যে ঘুষ খাবেনা, পদে পদে তারই বিপদ। আমি বাস্তববাদী মানুষ। ফালতু ইমোশনে চলিনা।
রিনি বুঝে গেছিল, আরিফ বদলাবে না। তাই তার ঘুষ খাওয়া নিয়ে আর কিছু বলেনি। আরিফ তাকে আটাশ শ’ স্কয়ারফিটের একটা সুন্দর ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। কিছু টাকা রিনিও দিয়েছে। ব্যাংকে মোটা টাকাও আছে। সব দামী দামী ফার্নিচার, জিনিসপত্রে তার বাড়ী ঠাসা। আরিফ ঢাকায় যে ভাড়া বাসায় থাকে, সেটাও সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে রিনি। নিজে থেকে কিছুই করতে হয়না। লোক আছে। শুধু হুকুম করলেই তারাই সব করে। অফিসার হিসেবে আরিফের বেশ সুনাম আছে। সবাই তাকে সমীহ করে। সে তার পেশায় দক্ষ।
যে ছেলেটা আরিফের রান্না করে, তার নাম সুমন। তার রান্না ভীষণ ভালো। ঘরবাড়ি, টয়লেটও পরিষ্কার। আরিফ নোংরা পছন্দ করেনা। একদিন ডালে চুল পেয়েছিল বলে গরম ডালের বাটি সুমনের গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিল। ভাগ্য ভাল, ডালটা বেশী গরম ছিলনা। লোকে আসলে নির্যাতনকে ভয় পায়। এজন্যই ছেলেটা কাজে ফাঁকি দেয়না। আর রিনির কাজের মেয়ে ময়না ঠিক তার উল্টো।
রিনি নিজেও অনেক টাকা বেতন পায়। প্রতি মাসে হাত খুলে খরচ করতে পারে। মা-ভাই-বোনের দেখাশোনা করতে পারে। মেজ বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। বর ব্যাংকে জব করে। পছন্দের বিয়ে। ওরা ভালো আছে। ছোট ভাইটা পাস করে চাকরীর চেষ্টা করছে। আর বোনটা মাস্টার্সে পড়ছে। শুধু বছর দূুই আগে রিনির বাবা মারা গেছেন।
সবই ভালো। শুধু আরিফের ব্যবহার ভালো না। তার শারীরিক সমস্যা আছে, সেটা ঠিক। তবে আরিফ চাইলে ডাক্তার দেখাতে পারে। রিনি অনেকবার বলেছে। কিন্তু সে দেখাবে না। তার কথা, তার কোন সমস্যা নেই। কিংবা হয়তো ডাক্তার দেখিয়েছে। কোন লাভ হয়নি বলে আর দেখাতে চায়না। নিজের অক্ষমতা ঢাকতে সে রিনিকে এড়িয়ে চলে।
– দ্যাখ, আমাদের একটা বাচ্চা আছে। তুমি কেন এরকম কর?
– আমি কি করি? আমি তো কিছু করিনা। যা করার তুমিই তো কর।
– আমি কি করি?
– তুমি সময় চাও। একঘন্টা পর পর কথা বলতে চাও। আমার সাথে থাকতে চাও। তুমি জান, আমি সেটা পারব না। আমার চাকরীর কারণেই পারবনা।
– আচ্ছা বেশ। সারাদিনে না পার, রাতে তো কথা বলতে পার। কখনও শুনেছ, স্বামী টানা পনেরোদিন বৌ-বাচ্চার খোঁজ নেয়না? মেয়েটা তোমাকে মিস্ করে। আমি মিস্ করি।
– আর আমি করিনা? শালী, তুই কি কইতে চাস্? আমি দায়িত্বহীন?
রিনি আর কোন কথা বলেনি। উঠে গিয়ে রাতভর কেঁদেছে। পরের দিন সকালে অফিস যাবার সময় আরিফ জানালো, তার জরুরী মিটিং আছে। ডিসি স্যারের সাথে। দুপুরে আসবে না।
সকাল এগারটার দিকে কী মনে করে রিনি আরিফের এক কলিগ এবং বন্ধু রঞ্জুকে ফোন করল। ছেলেটা ভীষণ আন্তরিক। আরিফের সাথে রিনির সম্পর্ক যে ভালো না, সেটা সে জানে। রিনিকে সে খুব সমীহ করে।
– কেমন আছেন রঞ্জু ভাই?
– ভাল আছি ভাবী। কুহু কী করে?
– দোলনায় বসা। আজ কি কোন মিটিং আছে আপনাদের?
– না ভাবী। কেন?
– না, এমনি। আরিফ কই?
– পাশের রুমে। চা খাচ্ছে।
আরিফ কেন তাকে মিথ্যে বলল, রিনি ভেবে পায়না। সেদিন রাত বারোটার পর আরিফ বাসায় ফিরল। রিনি হাঁসের মাংস রান্না করেছিল। আরিফ খুব পছন্দ করে বলে। মাছের মুড়িঘন্ট, বেগুনের চাকভাজি। সবই আরিফের প্রিয়। রাতে আরিফ কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরবেলা কলিং বেলের শব্দ শুনে রিনি দরজা খুলে দিল। একটা অল্পবয়সী মেয়ে। সালোয়ার-কামিজ পরা। রোগা, শ্যামলা। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ।
-কাকে চান?
– আরিফ স্যারকে। জরুরী দরকার।
– বসেন।
আরিফ এসে মেয়েটিকে দেখেই সিংহের মত মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চড়-থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি মারতে লাগলো।
– খানকি মাগী, তোকে এখানে কে আসতে বলেছে? কেন আসছিস্? মানা করেছিলাম না? তবু কেন আসছিস্?
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে কোন রকমে ছুটে পালিয়ে গিয়ে বাঁচলো। রিনি হতভম্ব। মেয়েটি কে, কেন তাকে মারলো, কী হয়েছে, এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর আরিফ দেয়নি।
– এসব আমার অফিসিয়াল ব্যাপার। তোমার নাক গলানোর বিষয় না।
আরিফকে মাঝে মাঝে রিনি বুঝতে পারেনা। গতবছর মার্চে যখন আরিফ এসেছিল, সেই চারটা দিন রিনির কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়েছিল। প্রতি রাতেই আরিফ তাকে খুব আদর করতো। ঐ চারটা রাতের মত এত শারীরিক সুখ সে আর কখনও পায়নি। রিনির ভাবতে অবাক লাগছিল, এই আরিফই কি সেই আরিফ? এত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল?
পরের দিন চলে যাবার সময় আরিফ আচমকা প্রশ্ন করলো, “আমার প্যান্টের পকেটে কোন ট্যাবলেট পেয়েছিলে?”
– না তো! কেন? কোন ট্যাবলেট ছিল কি?
রিনির মনে হল, আরিফ বোধহয় কোন যৌনউত্তেজক ট্যাবলেট খেয়ে থাকবে। সেজন্যই এত পরিবর্তন।
রিনি সকালে শাড়ী পরে কাজের মেয়েটাকে ডাকলো।
– ময়না, সেপ্টিপিনটা লাগিয়ে দাও।
গরীব মানুষদের নানান সমস্যা। বুদ্ধি কম। রুচিও বাজে। ময়নার ধোয়া প্লেটের নীচে ময়লা থাকে। বিছানা ঠিকমত ঝাড়ে না। এত বলার পরেও ফার্নিচারের ধূলা মোছেনা। কোন কাজই ঠিকমত করতে পারেনা। রিনির ধারণা, ময়না ইচ্ছা করে যেনতেনভাবে কাজ করে। আসলে তার কাজ করার মোটেই ইচ্ছে নেই। সে নেহাত টাকার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজ করে। সে এতটাই অপদার্থ যে, এতদিন শেখানোর পরেও সামান্য একটা সেপ্টিপিনও ঠিকমত লাগাতে পারেনা। তবু রিনি ওকে রেখেছে। কারণ যেটুকু করে, রিনির কাছে তাইই ঢেড়। বাকীটা রিনি নিজে করে নেয়। কাজ করতে তার ভালো লাগে। ছুটির দিনগুলোতে রিনি কাপড় কাচা, বাসা পরিষ্কার করা, বেশী করে বাজার করে কেটেকুটে ফ্রিজে রাখা, এই কাজগুলো ময়নাকে সাথে নিয়ে করে।
ময়না সকাল সাতটায় আসে। নাস্তা বানায়। দুপুরে আর রাতের রান্না রিনি নিজে করে। কোন কোনদিন দুপুরের তরকারী রান্না করে রেখে ভার্সিটি যায়। এসে শুধু ভাত করে।
আজ সে রান্না করেনি। তার মেজাজ খারাপ। খুব ভোরে আরিফ বেরিয়ে চলে গেছে। রিনি ওঠেনি। কোন কথাও বলেনি। আগে আরিফ যাবার দিন রিনি ভোরবেলা উঠতো। নাস্তা বানিয়ে হটপটে ভরে দিত। আরিফ হোটেলের খাবার পছন্দ করেনা। রাতেই আরিফের ব্যাগ গুছিয়ে রাখতো।
কাল রাতের পর থেকে রিনি হতাশায় ডুবে আছে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। অফিসে যেতেও ইচ্ছে করছে না। তবু যেতে হবে। জরুরী মিটিং আছে। একটা ক্লাসও নিতে হবে। রিনি দায়িত্বে অবহেলা করেনা।
– মা, কালিপদ খাচ্ছে না।
রিনি বিরক্ত হয়। নিজে খায়নি, তার সাথে সাথ নাই, আর বলে কিনা “কালিপদ খাচ্ছে না!”
– খেতে হবেনা। তাড়াতাড়ি জুতোটা পর। দেরী হয়ে যাচ্ছে।
কুহু কথা শুনলো না। চামচটা কালিপদর মুখে ধরেই থাকলো। কালিপদ তার পুতুলের নাম। কুহু নিজেই রেখেছে। মেয়ে পুতুলের নাম কেন সে ‘কালিপদ’ রাখলো, রিনি ভেবে পায়না। কালিপদ নামে তার পরিচিত কেউ নেই। কুহু এই নামটা শুনলো কার কাছে? বাচ্চারা যে কখন, কোথা থেকে কী শেখে, তা বোঝা মুশকিল! সে আরিফের স্বভাব না পেলে হয়! অনেক পুতুলের মধ্যে কালিপদই কুহুর সবচেয়ে প্রিয়। এটাকে নিয়েই বেশী খেলে। রাতেও কালিপদকে নিয়েই শোয়।
এই সমস্যা মেনে নিয়েও রিনির সংসার করতে আপত্তি ছিলনা। সবাই সবকিছু পায়না। এত সুন্দর একটা মেয়ে আছে। ওর জন্যই অনেককিছু মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হলো, আরিফ রিনিকে ভালবাসে না। ভালো করে কথা পর্যন্ত বলেনা। মেয়েটাকেও মিস করেনা। ফোন করেনা। রিনি ফোন করলে বিরক্ত হয়। ব্যস্ততা দেখায়। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখন মাঝে মাঝেই সে রিনিকে মারে। দিন দিন রিনির কাছে আরিফের উপস্থিতি অসহ্য হয়ে উঠছে! রিনি আগে কখনও মুখ খারাপ করতো না। এখন মাঝে মাঝে সে নিজেও মুখ খারাপ করে ফেলে। এসব সে শিখেছে আরিফের কাছ থেকেই।
আর রিনির যেটা অসহ্য লাগে, সেটা হল, আরিফ চায়, রিনি অন্য কাউকে দিয়ে তার শরীরের চাহিদা মেটাক। কোন স্বামী যে এটা চাইতে পারে, রিনির তা বিশ্বাস হয়না। কিন্তু কথা সত্যি। রিনি সেটা পারবে না। সে ধার্মিক মেয়ে। এমন পাপ সে করবে না।
রিনি আরিফের সাথে থাকতে চায়না। ওকে ছাড়লেই কি খুব লাভ হবে? আরিফকে তালাক দিলে তাকে একা থাকতে হবে। লোকে জানতে চাইলে কী বলবে? কেন তালাক দিয়েছে? কী সমস্যা? তাছাড়া আমাদের সমাজ মেয়েদেরকেই দোষ দেয়। সবাই বলবে, নিশ্চয় মেয়ে খারাপ। নাহলে স্বামী ছাড়ে? এ সমাজে কোন মহিলার একা টিকে থাকা যে কতটা কঠিণ, তা রিনি বেশ জানে। শরীরের চাহিদা মেটাতে হয়তো আবার বিয়ে করতে পারবে। তাতে কুহুর সমস্যা হতে পারে। রিনি কোন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।
রিনি সবসময় কুহুকে ওদের ঝগড়া থেকে দূরে রাখতে চায়। বাবার ঐ বিশ্রী আচরণগুলো সে না দেখুক। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখে ফেলে। তখন মায়ের কোলের মধ্যে লুকায়। ভয়ে, আতঙ্কে কাঁদে।
এতদিন রিনি ভেবেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আরিফ বদলাবে। মেয়ে বড় হচ্ছে। এখন রিনির আর তা মনে হয়না। গতমাসে রিনি ঢাকায় গিয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় আরিফকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। নতুন করে সম্পর্কটাকে কাছে আনার চেষ্টা করেছে।
প্রায়দিনই তার অফিস যেতে দেরী হয় কুহুর জন্য। রোজ সে কুহুকে নিয়েই ভার্সিটি যায়। অফিসের পিওনের কাছে দিয়ে ক্লাসে যায়। কোন কোন দিন ওর বসার রুমে রেখে কম্পিউটারে কার্টুন দিয়ে দেয়। কুহুর কার্টুন খুব পছন্দ। কোন কোনদিন ছাত্রছাত্রীরা এসে কুহুকে নিয়ে যায়।
– আপা, মন খারাপ নাকি?
রিনি চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকালো। সোহেল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা রিনির বছর দুয়েকের জুনিয়র। গতমাসে জাপান থেকে এমএস করে ফিরেছে। ব্যাচেলর। রিনিকে খুব পছন্দ করে।
– না, মন খারাপ না। এমনি বসে আছি। তোমার খবর কি? পাত্রী পছন্দ হল?
– না আপা। এখনও হয়নি। ঈদের ছুটিতে বড়আপা আসছে আমেরিকা থেকে। তখন ফাইনাল হবে।
রিনি ভাবছিল তার নিজের কথা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিকতা না থাকলে সে বিবাহিত জীবনের কী মানে? রিনি অনেকবার আরিফকে তালাক দিতে চেয়েছে। কুহুর জন্য পারেনি। মেয়েটা বাবা ছাড়া বড় হবে। সবাই খুবলে খেতে চাইবে। রিনি কতদিন বাঁচবে সে জানেনা। হঠাৎ তার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা একা কীভাবে বাঁচবে? তাছাড়া তালাক দিলে কুহু বড় হয়ে হয়তো রিনিকেই দুষবে। ছোট বোনটার এখনও বিয়ে হয়নি। এখন তালাক দিলে বোনটার ভালো বিয়ে হওয়া সমস্যা হবে।
– আপা, আপনার জার্নালগুলো এসেছে। আমি লাইব্রেরীতে রেখেছি। দেখে নেন। আসেন।
রিনি মুখ তুলে তাকালো। নীল জর্জেট শাড়ীতে সুফিয়াকে সুন্দর লাগছে। সুফিয়া রিনির বিভাগের লাইব্রেরিয়ান। বাবামার একমাত্র মেয়ে। ওর ছোট ছেলেটার বয়স যখন ছয় বছর, তখন কার এক্সিডেন্টে সুফিয়ার ডাক্তার স্বামী মারা যায়। তারপর দুই ছেলেকে নিয়ে সে একা আছে। আর বিয়ে করেনি। সুফিয়ার ভাশুর তাকে এই চাকরীটা পাইয়ে দিয়েছে।
আচমকা রিনির মনে হল, সুফিয়া বা সুফিয়ার চেয়ে দূর্বল মেয়েরা পারলে সে কেন নয়? তালাক হওয়া আর মারা যাওয়া তো একই কথা। আরিফ মারা গেলে সে কী আটকাতে পারবে? তখন কি একা থাকতে হবেনা? মানসম্মানের ভয়? আরিফ যখন নির্মমভাবে রিনিকে মারে, বেশ্যা বলে গালি দেয়, তখন মানসম্মান যায়না? কুহু যখন দেখে, তার বাবা তার মায়ের সাথে জঘন্য আচরণ করছে, তখন সম্মান যায়না?
প্রতিবার ঝগড়ার পর রিনিই আরিফকে ফোন করে। সরি বলে। রিনি ঠিক করল, এবার সে আর তা করবেনা। রিনি টাকা জমাচ্ছিল। সে ফ্ল্যাট কেনার সময় দেয়া আরিফের টাকাটা ফেরত দিতে চায়। প্রয়োজনে সে ব্যাংক লোন নেবে। সে একাই কুহুকে মানুষ করতে পারবে। প্রয়োজনে সে তার মাকে নিয়ে আসবে তার বাসায়। তাছাড়া এই ফ্ল্যাটে আরো নয়টা পরিবার থাকে। সবার সাথেই রিনির ভালো সম্পর্ক। সিকিউরিটিও খুব ভালো। সমস্যা হবেনা। রিনি একটা স্কলারশিপেরও আবেদন করেছে নেদারল্যান্ডসে। সে খুব আশাবাদী।
রিনির বাসার বারান্দায় অনেক ইনডোর প্লান্ট আছে। তারমধ্যে একটা ক্যাকটাস গাছে কিছুতেই ফুল আসেনা। ছুটির দিন বলে আজ সে দেরীতে নাস্তা করে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে কফি খাচ্ছিল আর গাছটার কথা ভাবছিল। যে গাছ ফল-ফুল কিছুই দেয়না, সেটা রেখে কী লাভ? শুধু গোড়াটা রেখে রিনি একদম মুড়ো করে গাছটা ছেঁটে দিল।
মাসখানেক পরে একদিন দুপুরে রিনি রান্না করছিল। মুরগীর মাংস। কুহুর পছন্দ। হঠাৎ কুহুর চিৎকারে সে ঘরে ছুটে গিয়ে দেখলো, কুহুর হাতে বেডসুইচ থেকে শক করেছে। তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করে সে তারটা দূরে ফেলে দিল। আজই বেডসুইচ খুলে ফেলবে। কুহু তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। রিনি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। জোর করে ওর হাতটা ধরে দেখলো, তিনটা আঙ্গুল পুড়ে কালো হয়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। কুহু প্রায়ই বেডসুইচ নিয়ে খেলে। মানা করলে শোনে না। রিনি তাড়াতাড়ি কুহুর হাতে এন্টিসেপ্টিক ক্রিম লাগিয়ে দিল।
কুহু তখন শুয়ে আছে। রিনি ভাবছিল, আরিফকে ফোন করবে কিনা। কুহু আরিফকে কতটা ভালোবাসে, রিনি জানেনা। তবে খুব ভয় যে পায়, সেটা জানে।
– মা, তুমি কি বাবাকে ফোন করবে?
– কেন? তুমি কথা বলতে চাও?
– না।
– না কেন?
বাবা পচা। খুব পচা।
– কেন?
– তুমি বাবাকে আসতে বলবে না। ঢাকায়ও যাবেনা।
– কেন?
– তুমি যখন থাকনা, তখন বাবা আমাকে মারে। আমি তোমাকে বলিনি।
– কবে মেরেছে? কেন মেরেছে?
– অনেকবার। তুমি সেদিন বাজারে গেলে। বাবা ফোনে কথা বলছিল। আমি দৌড়ে বাবার কোলে চড়তে গেছি। আর ফোনটা পড়ে গেল। তখন।
– কীভাবে মেরেছে?
– জোরে জোরে চড় মেরেছে। কান টেনেছে। বকা দিয়েছে। মা, ‘শুয়োর’ কী?
– বাবা মেরেছে, আমাকে বলনি কেন?
– বাবা বলেছে, বললে আবার মারবে।
রাগে, দুঃখে ক্ষোভে রিনির চোখে পানি চলে এলো। নিজেকেই তার আঘাত করতে ইচ্ছে করছিল। এতদিনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে এবার মনস্থির করে ফেললো। সে আরিফকে তালাক দেবে।
সেদিন গভীর রাতে রিনি একা হল। হিন্দু মেয়েরা বিধবা হলে শাঁখা ভেঙ্গে ফেলে, সিঁদুর মুছে ফেলে। রিনি একে একে আরিফের সব স্মৃতি মুছে ফেলল। ঘরের যেখানে যেখানে আরিফের ছবি ছিল, সব সরিয়ে একটা ব্যাগে ভরে আলমারীতে রেখে দিল। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল খুব। তবে দিলনা। কুহু বড় হয়ে যদি কোনদিন দেখতে চায়, সেদিন বের করে দেবে।
তারপর যেখানে যেখানে আরিফ তাকে নক করতে পারে, সেই সবগুলো জায়গায় আরিফকে ব্লক করে দিল। যদিও তার মনে হয়না, আরিফ তাকে ফোন করবে। রিনি খুব স্বস্তি পাচ্ছিল। মন থেকে দীর্ঘদিনের একটা বোঝা নেমে গেল।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে রিনি দেখলো, সেই ক্যাকটাস গাছটাতে অনেকগুলো কুঁড়ি গজিয়েছে। এরপর ফুল ফুটবে! দেখে খুশীতে রিনির মনটা ভরে গেল। আজ অনেকদিন পর সে গুন গুন করে গান গাইছে!
“আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরো আরো আরো আরো দাও প্রাণ…”
লিখেছেন: তীর্থপতি গুপ্ত
একটা টিপ পড়লেই যদি চলে তবে কপালে সূর্য নাও
একটা পা বাড়ালেই যদি চলে দুই পা বাড়াও
হেঁটে গেলেই যদি চলে যায় তবে দৌড়ে যাও
শুধু মেয়েরা মেয়েদের নিয়ে চলো
এক লাইন লিখলে যদি চলে তবে পাতা ভরিয়ে লেখো
একটা ছুঁচে যদি চলে যায় জীবন তবে খাঁড়াটা দেখিয়ে রেখো নীরবে
একটা চাঁদ মুখ দেখালে যে খুশি হয় তাকে সূর্যের খবর দাও আড়ালে
শুধু মেয়েরা মেয়েদের জন্য বাঁচো
ওই যে পাথর ভাঙা হাত
ওই যে আদর করা হাত
ওই যে খাবার খাওয়ানো হাত
ওই যে কান্না মোছা হাত
এক হাত প্রেমের জন্য থাক
একহাত নারীকে দিও তবে
শুধু মেয়েরা মেয়েদের হাতে হাত রাখো
তোমাতে তুমিই পূর্ণ করো
তোমাদের তুমি গাঁথ গাথা
তোমার তুমিই ভরসা হও
তবেই সমাজ নোয়াবে মাথা
এখনও সময় হয়নি শেষ
এখনও কাজ অনেক বাকি
দোষের রোগ ঝেরে ফেলে
নারী, তুমি নিজে জাগবে না কি?
লিখেছেন: রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল
তন্ত্র শাস্ত্র যদি পড়া যায়, তবে দেখা যাবে- বিভিন্ন দেবের মূল চালিকা শক্তি কিন্তু দেবীরা। তাঁদের সঙ্গী হলেন দেবতা এবং দেবীরাই হ্লাদিনি শক্তি। তন্ত্রমতে ভারতে চারটি সিদ্ধপীঠ রয়েছে। সেগুলো হল-
১) জ্বালামুখী (হিমাচল):
হিমাচল প্রদেশে এই মন্দির। হিমালয়ের কোলে কাংড়া জেলার জ্বালামুখী শহরে আছে এই মন্দির। জ্বালাদেবীর এই মন্দির ৫১ পীঠের একটি। এই মন্দিরে ৭টি আগুনের শিখা দেখা যায় যেগুলি কখনও নেভে না।
২) কামাক্ষ্যা (গৌহাটি):
এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাক্ষ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
৩) কন্যাকুমারী:
কন্যাকুমারী নামটি এসেছে হিন্দু দেবী কন্যাকুমারীর (যাঁর স্থানীয় নাম কুমারী আম্মান) নামানুসারে।
৪) বিমলা: পুরী মন্দির।
ইতিহাসে( ধর্ম কিংবা ঘটনা) দেখতে পাই – নারীকে ঘিরেই কিন্তু সমস্ত ঘটনা ঘটেছে। নারী কখনও- মা, জায়া, বন্ধু এবং সব ব্যাপারেই জড়িত। নারী ছাড়া পুরুষ অসম্পূর্ণ। সেই নারীকেই কিন্তু যুগে যুগে বারবার অসম্মান করা হয়েছে। চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, নানা বিধিনিষেধ। সব ধর্মেই কিন্তু নারীকে শিক্ষা দেবার ঘোর বিরোধিতা আছে, সেটাও লক্ষণীয়।
সীতা বনে যাবার সময় কৌশল্যার উপদেশ শুনে বলছেন,
না তন্ত্রী বিদ্যতে বীণা, না চক্রো বিদ্যতে রথঃ।
না পতিঃ সুখ মেধেত সা স্যাদপি শতাত্মজা।।
অর্থাৎ, ‘তার ছাড়া যেমন বীণা হয় না, চাকা ছাড়া যেমন রথ হয় না, শত সন্তান হলেও পতি ছাড়া সুখ নেই’।
বেশ অবাক হলাম, কারণ সেকালে অনেক পুরুষই বহুবিবাহ করতেন! স্বয়ং দশরথেরই তো তিন তিনটে বৌ ছিল। কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা। কোনো কোনো রামায়ণে তো বলা হয়, তাঁর ৩৫০ জন স্ত্রী ছিলেন! সব স্ত্রী কি এই রকমই ভাবতেন? নাকি এটা সীতার মুখে প্রক্ষিপ্ত? কৈকেয়ী কিন্তু প্রথম দিকে রাম, ভরতের মধ্যে কোনো ফারাকই দেখতেন না। তিনি মন্থরাকে (প্ররোচনা দেবার পর) বলছেন,
রামে বা ভরতে বাহং বিশেষং নোপলক্ষয়ে
যথা বৈ ভরতো মান্যস্তথা ভূয়োঽপি রাঘবঃ
রাজ্য যদি হি রামস্য ভরতস্যাপি তৎতদা
অর্থাৎ, রাম এবং ভরতে আমি কোনো ফারাক দেখি না, আমার কাছে রামও যেরকম, ভরতও তাই। রাজ্য যদি রামেরও হয়, তবে সেটা ভরতেরও। মন্থরা এবারে নানা ভয় দেখালো। তার মধ্যে যে দুটো কৈকেয়ীর মনে দাগ কাটলো বলে জানা যাচ্ছে- সে দুটো হলো-
“তুমি কৌশল্যার ওপর ভীষণ অত্যাচার করেছ আর ভরতকে কেন মামাবাড়ীতে রাখা হচ্ছে রামের অভিষেকের সময়?”
তার মানে, এটা কি ভাবা যায় যে সতীনকে অত্যাচার করতো অন্য সতীন সুযোগ পেলেই! আর মন্থরা এর সুযোগই নিয়েছে! কিন্তু কার নির্দেশে?
সবই প্রহেলিকা!
তবে, এটাও সত্যি- নারীরা, নারীদেরই শত্রু হয়েছে একাধিকবার। তবুও বলা যায় – নারী বিনা জগৎ অন্ধকার। পৃথিবীকেও কল্পনা করা হয়েছে নারী হিসেবে। মা যেমন সর্বংসহা, পৃথিবীও তাই। শষ্য তৈরি হয় এই পৃথিবীর মাঠেই। নারীকে নিয়েই যত কাব্যগাথা। রামায়ণ, মহাভারত থেকে ইলিয়াড, ওডিসি। নারীদের নতুন সমস্যা আসে, পুরোনো সমস্যা সরে গিয়েও সরে না। পাহাড় জমে সবকিছুর। জীবনসংগ্রামে নুইয়ে পড়ে মাথা, সমস্যার কালবৈশাখিতে। তবু হারে না নারী। আমাদের স্মৃতিগুলো তো ফুলই। সময়ের গাছের তলায় পড়ে থাকে। কেউ কুড়োবার নেই। যে যারটা কুড়িয়ে নেয়। পরে, কালস্রোতের কালবৈশাখি সেগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। একদিন গাছটাও মরে যাবে, তবু ফুলের সুগন্ধ ছেয়ে পড়ে থাকবে পথ।
“সুখমাপতিতং সেব্যং দুঃখমাপতিতং তথা,
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ।”
অর্থাৎ, আগত সুখ যেমন গ্রহণীয়, আগত দুঃখও সেইভাবে গ্রহণীয়। সুখ এবং দুঃখ চাকার মতই পরিবর্তিত হয়।
নারীরা এই শ্লোকটিকে আপ্তবাক্য হিসেবে এখনও আঁকড়ে থাকেন। বিজয়তে- সত্যম শিবম্ সুন্দরম্।
টীকা:
* হ্লাদিনি শক্তি : আনন্দযুক্ত অবস্থায় আছেন এমন নারী।
লিখেছেন: সীমন্তিনী ঘোষ
১) মা-জেঠিমা-ঠাকুমাদের প্রতি
এসব নীরবতারা আগেই ছুঁয়ে গেছে,
এসব সীমানা পেরিয়েছে নিশ্চুপ পথ
এসব নির্ভরতা বহুকালের পিছুটান
এসব ঊষ্ণ শ্বাস জেগেছে বহু রাত।
কোনো লুকোনো গভীরে ওম জড়িয়ে
এসব অশরীরী স্বপ্ন ঘুমিয়েছে এক যুগ।
এসব তৃষ্ণাবীজ জন্মেছে অন্ধকারের বুকে
এসব শরম খোওয়া গেছে নাম-না-জানা- সন্ধিকালে
এসব নীরবতাই আগের বুক-চাপা
এসব সীমানাই মিলিয়েছে নিরুদ্দেশে।
২) যারা আমরা নই, ছিলাম না
আমরা কথার ফেরিওয়ালা
আমরা বাকযুদ্ধ করে যাই অক্লান্ত, অনর্গল
আর এদিকে রাত হয়
চিৎকারের মুখ চেপে ছিন্নভিন্ন করে ছ’জন
শরীরের খোলস থেকে মন যদি আলাদা করা যেতো,
যায়না, তবে, কাপড়ে জড়িয়ে ধুলোয় পড়ে থাকে যুবতীঅঙ্গ,
লোহায় ছিঁড়ে খাওয়া বালিকা ছেঁড়া ফ্রকে কেঁদে বাড়ি আসে
আজও।
এদিকে সকাল হয়
হাড় কাঁপানো শীতের ঝকমকে সকালে
শুয়ে থাকে ছেঁড়া রক্তমাখা পা’জামায়
তাজা, দুই বোনে জড়াজড়ি।
জমাট রক্ত গলায়না কোনোকিছু
তাই ভুলে যাই,
প্রান্তিকের যারা কোনোকালেই আমরা হয়ে উঠতে পারতো না
পুলিশের গরম পাথর সব ছারখার করে দিয়ে হাসপাতাল নিয়ে এলে
আমরা কেবল আন্তর্জালে জ্বলে উঠি।
আর্তনাদে রক্ত ফুটে ওঠে
কদিন।
৩) আমরা
এসব বড় বেশী জটিল,
সূক্ষ্মতা থেকে সূক্ষ্মতায় বাস
কথায় কথা বেড়ে যায়,
শুধু হয়না যেটুকু বলা সবচেয়ে ছিলো অপরিহার্য্য।
আমরা এক অদ্ভুত স্পেসে বাঁচি।
আসলে আমি তুমি, কেউ যেনো না ভেবে ফেলি,
আর পাঁচজনেরি মত আমি, ক্ষুদ্রতম।
আমাকে তাই ভাবতেই হয়
আমি খুব ভালো আছি।
আমাকে মানতেই হয়, বলা কথা বলারই
এখনো উপযুক্ত পাত্রপক্ষ চুপি চুপি রূপোথালাবাটিচুনিআংটি একান্নটা নমস্কারী চেয়ে যেতেই পারে
এখনো বংশগরিমা খর্ব হলে, আমার আর কোনো অস্তিত্ব মেনে নাও নেওয়া হতে পারে
এখনো নিক্তিমেপে ওজন হতেই পারে,
এখনো আমি আছি আমার পরিসরেই।
লিখেছেন: মিতালী মুখোপাধ্যায়
ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয় আরও এক ইতিহাস রচনা। ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস অন্য আর পাঁচটা দিবসের মতো নয়। অনেক মর্যাদার সাথে ইউরোপে এই দিনটা পালিত হয়ে আসছে।
জার্মানির বার্লিনে এবছরই প্রথম আন্তর্জাতিক নারীদিবসকে সামনে রেখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ জার্মান ভাষায় দিনটি Weltfrauertag (ভেল্টফ্রাউয়ারটাগ) যাকে ইংরেজিতে বলা হয় International Womens Day। এদিন বার্লিনে অনুষ্ঠিত হবে নারীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
আপনারা হয়তো অনেকেই ক্লারা জোসেফিনে সেটকিনের (অনেকেই ইংরেজিতে বলেন ক্লারা জেটকিন) নাম জানেন। তিনি ছিলেন জার্মানির মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও এক্টিভিস্ট। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক মহিলা কনফারেন্সে, ‘নারীদিবস‘ পালনের প্রথম দাবি তোলেন ক্লারা সেটকিন। এবং প্রথম ‘নারীদিবস‘ পালন করা হয় ১৯১৭ সালে ১৯ মার্চ। ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাংগেরি এবং সুইটজারল্যান্ডে।
ইতোমধ্যে ১৯১৭ সালের ৫ই মে কার্ল মার্ক্স এর শততম জন্মদিনে USPD’তে ‘নারীদিবস‘ পালন করার দাবি উত্থাপিত হয়।
বেতন না কেটে মহিলাদের কাজের সময় কমানো, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, প্রতিদিনের স্কুলের খাবার সরবরাহ এসব দাবি ছিল তখনকার প্রধান দাবি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভ্রুণপাতের বৈধতা আদায়ের দাবি।
এসব দাবিগুলোই ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯১৮- ১৯৩৩) ভাইমারার রিপাবলিক-এর সময় নারীদের প্রধান দাবি। বিধ্বস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটাকে নতুনকরে সাজিয়ে তুলেছিল এ দেশের নারীরাই।
সেইসময় ক্লারা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে এক শক্তিশালী নেত্রী। তারপরেই আস্তে আস্তে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি এবং জার্মান সোসালিস্ট পার্টির মধ্যে মতানৈক্য শুরু হয়।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দাবি দাওয়া এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ বিরোধিতা করে এসেছে জার্মানির সংগ্রামী নারী নেত্রীরা। তাদের একটাই শ্লোগান ছিল- সমাজতন্ত্র ও শান্তি।
ইউরোপে নারীরা তাদের আন্দোলনের মাধ্যমেই ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হোন। ইউরোপে বেতন ও মজুরির সমতা, কর্মস্থলে কাজের সুস্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার অধিকার আদায়ে নারীরাই ছিল মূল ভুমিকায়। নারী অধিকার আদায়ে তারা নিজেদের পথ নিজেরাই মসৃণ করেছে। কারুর করুণায় নয়, শিক্ষা আর কর্মদক্ষতাই নারীরা আজ এই অবস্থায় এসেছে।
নারীর ভবিষ্যৎ কেবলমাত্র লিখিতভাবে একটি কলমের মাধ্যমেই পালটে যায় না। তাকে পাল্টাতে সংগ্রাম করতে হয়। কারুর প্রতি দোষারোপ নয়, কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করার মানসিকতাই করবে নারীকে স্বাবলম্বী।
লিখেছেন: সুমনা চৌধুরী
বেশীরভাগ পুরুষ, নাহ্ বেশীরভাগ নারীও ‘নারী দিবস’ বলতে বুঝেন এবং জানেন নারীর ফুল চকলেট উপহার পাওয়ার দিন। সোস্যাল মিডিয়ায় ‘শুধু নারীর জন্যে একটি দিন কেন?‘ অথবা ‘পুরুষদের জন্যে আলাদা দিন নেই কেন?‘ – এইসব প্রশ্ন তোলার দিন। শপিং মলগুলোতে স্পেশাল উইম্যানস ডে ডিসকাউন্ট দেওয়ার দিন। ফেইসবুক এবং হোয়াট্সঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে ‘নারী সম্মানের বস্তু, নারী মহান, মাতৃত্ব তার অহংকার, মা ও নারী‘ এইসব বাণী প্রচারের দিন বিভিন্ন ছবির সাহায্যে। কী নিপুণভাবে আপস না করার একটি লড়াই এর ইতিহাসকে বিকৃত করে পুরুষতন্ত্র নারীর মগজ ধোলাই করে, সেটা এই দিনটা না এলে এত প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা যায় না!
পুরুষদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম, কিন্তু সেইসব নারী যারা ‘নারী দিবস‘ বলতে বুঝেন আবালশ্রেণীর মেসেজ এবং পোস্ট শেয়ার এবং ফুল প্রজাপতি চকলেটসহ স্পেশাল ডিসকাউন্টে শপিং করার স্বাধীনতা – তাদের এখনো জানার এবং বুঝার বাকী ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসে’র আদি নাম, ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং আজকের যুগের নারীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার অবদান। তাদের বোঝার বাকি এই দিনটি লড়াইকে জিইয়ে রাখার দিন। অতীতের সংগ্রামের হাত ধরে আগামীর আরো কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার দিন। পথে নামার দিন।
তাহলে বরং শুরু থেকে শুরু করা যাক –
ইতিহাস:
এই দিনটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের, সংগ্রামের ইতিহাস। দিনটির আদি নাম ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস‘। এবারে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে এই নামকরণের নেপথ্যের ইতিহাস কী? কেনই বা এই নাম? দীর্ঘদিনের সংগ্রামের সেই ইতিহাসকে সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে খানিকটা এরকম, ১৮৫৭ সালের ৮ ই মার্চ নিউইয়র্কের সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন মূলত তিনটি দাবী নিয়ে –
১) মজুরী বৈষম্য সমাধান
২) কাজের সময় নিদির্ষ্ট করা এবং
৩) কর্মক্ষেত্রের অমানবিক পরিবেশ বন্ধ করা।
কিন্তু রাষ্ট্র এবং তার তাবেদার সরকার সেটা মেনে নেবে কেন? দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের এহেন আস্পর্ধা দেখে অবাক থেকেও বেশী রাগে জ্বলছিল তারা। সুতরাং নারী শ্রমিকদের সেই মিছিলে চললো সরকারী লেঠেল বাহিনীর তাণ্ডব। মারাত্মকভাবে আহত হলেন আন্দোলনকারী নারী শ্রমিকেরা। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর নিজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সবচেয়ে সংগঠিত এবং সংঘবদ্ধ লড়াই বোধহয় এই সূতা কারখানার নারী শ্রমিকদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল।
তারও অনেক পরে ১৯০৮ সালে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন, সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। এরপর ১৯১০ সালে কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে বিশ্বের ১৭ টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি যোগ দেন এবং এই সম্মেলনেই ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব করেন ‘৮ই মার্চ‘ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস‘ হিসেবে পালনের। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ সাল থেকে এই দিনটিকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে পালন করার। ১৯১৪ সাল থেকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ ৮ই মার্চ উদযাপন করা শুরু করে। অবশেষে ১৯৭৫ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে রাষ্ট্রসংঘ এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান করে দিবসটি উদযাপন করার। বর্তমানে সারা বিশ্বেই এই দিবসটি পালিত হচ্ছে, কিন্তু ইতিহাস বিকৃত করে যে নারী দিবসের লাড্ডু আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে সেটা নারীর অধিকার আদায়ের সমস্ত লড়াইকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সুগভীর পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রমজীবী নারীর অবস্থান:
আমাদের দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নারীরা ভয়াবহভাবে শোষণ এবং বৈষম্যের শিকার। ১৯৯৪ সালে ভারত রাষ্ট্রসংঘের সিডোও (CEDAW) অথবা ‘The Convention on the Elimination of all forms of Discrimination Against Women’ – গ্রহণ করে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে। নারীর পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অসমতা দূর করার লক্ষ্যে। কিন্তু একটি অ্যাক্ট বা কনভেনশন গ্রহণ করলেই তো শুধু হয় না, তার বাস্তবায়নও জরুরী। এবং ভারতবর্ষের নিরিখে সিডোও অ্যাক্টগুলি আজোও বাস্তবায়িত হওয়ার থেকে কয়েকশো হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছে।
ভারতের সংবিধানে সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার স্বীকৃত আছে। কর্মক্ষেত্রেও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাস্তবতা?
বাস্তবতা হলো, এদেশে ৮০ শতাংশ নারী দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। এবং সংগঠিত এবং অসংগঠিত কাজ করার প্রবণতাও এই দারিদ্রসীমারেখার নীচে বসবাসকারীদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। ভারতে বিভিন্ন কলকারখানা, নির্মাণকাজ, কৃষিক্ষেত্র, গৃহ পরিচারিকা, বিড়ি বাধা, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি পেশায় প্রায় ৮০ শতাংশ নারী নিয়োজিত আছেন। যদি কৃষিক্ষেত্রের কথা ধরা যায়, সেখানে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৯৭.৮ শতাংশ নারীই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। শিল্পক্ষেত্র থেকে নির্মাণকাজ – সব জায়গাতেই নারী পুরুষের চেয়ে মজুরী কম পায়। এই ক্ষেত্রে করিমগঞ্জের একটা উদাহরণ দেই। গ্রাম করিমগঞ্জে সুপারির খোসা ছাড়ানোর কাজে বহুসংখ্যক নারী নিয়োজিত আছেন। এই কাজে সময় লাগে বেশী এবং একটানা বসে কাজ করতে হয়। ১০০০ সুপারির খোসা ছাড়িয়ে নারী শ্রমিকেরা সারাদিনে রোজগার করেন ৩০ টাকা, সেই জায়াগায় একজন পুরুষ দিনমজুরের দৈনিক রোজগার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
এতো গেল নিম্নবিত্ত নারীর কথা। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের নিয়োগ পুরুষদের থেকে কম। প্রায় তিনভাগ পুরুষের বিপরীতে নিয়োজিত এক ভাগ নারী। সিনেমা জগতের ক্ষেত্রেও দেখা যায় পুরুষের বিপরীতে নারীর পারিশ্রমিক অর্ধেক।
সারা ভারতজুড়ে বিভিন্ন কর্মচারী এবং শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। কিন্তু সেই ইউনিয়নগুলিও পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষ দ্বারা। নারী সেখানে সদস্য মাত্র। হ্যাঁতে হ্যাঁ এবং না তে না মিলানো যার একমাত্র কাজ। ডিসিশন নেওয়া বা লিডারশিপ দেওয়ার অধিকার তার বাস্তবে নাই। রেল মজদুর ইউনিয়ন থেকে ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক ইউনিয়ন – নারী সেখানে ব্রাত্য। সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট দলগুলোতেও এর ব্যতিক্রম এদেশে নেই। নারী শ্রমিক, নারী কৃষক, নারী কর্মচারীর পেশাগত পরিচয় বাদেও আরেকটা পরিচয় তাদের কপালে অদৃশ্য ভাবে সাটা থাকে, তারা নারী। আর নারীরা ডিশিসন নেবে, লিড করবে একটা আন্দোলনকে, সেটা ভারতের অতি বড় কমিউনিস্ট ও বিশ্বাস করেন না, করতে চান না। আর ঠিক সেজন্যেই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কর্মক্ষেত্রে, পেশাক্ষেত্রে নারী তার দাবী দাওয়াগুলো রাষ্ট্র, সরকার, মালিকপক্ষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে না। আর ক্ষেত্রবিশেষে তা তুলে ধরলেও পুরুষপক্ষ তা শোনে না, শুনতে চায় না।
বেশীভাগ স্বল্প শিক্ষিত নারী পারিবারিক এবং সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক চাপ, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির কারণে ঘরে বসে থাকে। অথচ এইসব স্বল্প শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব নারী যদি নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সবধরনের কাজের ক্ষেত্রে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পেত, তবেই হয়তো কর্মক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত। সিডোও নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ নারী নিয়োজিত হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে? অথচ সরকারি বেসরকারি সবক্ষেত্রে যদি নারীর কাজের অংশগ্রহণ, সম বেতন, সম মর্যাদা দেওয়া হতো তাহলে নারী নির্যাতন হ্রাসের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও আরো সমৃদ্ধ হতো।
সুতরাং যে পুরুষতন্ত্রের তালে তাল মিলিয়ে নারীরা ‘নারীদিবস’কে চকলেট আর ফুলের রঙিন মোড়কে রাঙিয়ে তুলছেন, শপিং মলের একস্ট্রা ডিসকাউন্টে পাখা মেলে উড়ছেন, সেই পুরুষতন্ত্র দ্বারা আজোও তারা সর্বক্ষেত্রে শোষণের শিকার। তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত তারা। এই সহজ সরল সত্যটা সময় থাকতে প্রত্যেকজন নারীর বোঝা দরকার এবং আগামী লড়াইয়ের জন্যে সংগঠিত হওয়া দরকার। সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার।
প্রতিবছরের মতো এবার ও আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবস তার প্রতিপাদ্য বিষয় বা থীম নিয়ে হাজির হয়েছিল পৃথিবীর দোরগোড়ায়। কিন্তু রঙিন উষ্ণতায় ভেসে যাওয়া নারী-পুরুষগণ সেটা দেখেননি বা দেখলেও বুঝতে চাননি। তাই আরেকবার আমিই বলে যাই এবছরের নারীদিবসের থিম –
“সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো,
নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো।”“Think Equal, Build Smart
Innovate for Change”
সময় থাকতে এইবোধটুকু মাথায় ঢুকানো খুব জরুরী। কারন আপাতত আরো কয়েক যুগ অব্দি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে এই দিনটি আপনাকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আরোও কয়েকযুগ অব্দি এই দিনটি আমাদের সংঘবদ্ধ, সংগঠিত হতে শেখাবে।
============
মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
নীলিমা দেব (Nilima Deb), কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
অর্পিতা রায়চৌধুরী (জন্ম ১৯৯৫- মৃত্যু ২০১৮)। জার্মানি প্রবাসী নির্বাসিত লেখক, সেক্যুলার ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মী। তিনি ছিলেন অংশুমালী সাহিত্য পত্রিকার অন্যতম উদ্যোক্তা ও ইউরোপ চ্যাপ্টারের সম্পাদক।
তপনকান্তি মুখার্জি, কবি। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
বল্লরী সেন, গবেষক, কবি। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
তন্বী হালদার, কথাসাহিত্যিক ও গল্পকার। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
শাহাব আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, চিকিৎসক। অংশুমালীর লেখক।
তৌহীদা ইয়াকুব, ফ্রান্স নিবাসী কবি, নারী উদ্যোক্তা। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
সাঈদা মিমি, কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
সুচরিতা চক্রবর্তী, কবি। অংশুমালীর লেখক।
রঞ্জন রায়, কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী। অংশুমালীর লেখক।
তাসবীহ্ ইসলাম নাবিলা, কবি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। অংশুমালীর লেখক।
স্বাতী রায়, কথাসাহিত্যিক ও নারী অধিকার সচেতনতার দিশারী। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
চিরঞ্জীব হালদার, কবি। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
মৌ মধুবন্তী, কবি, গীতিকার ও নারী উদ্যোক্তা। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
শিবব্রত মণ্ডল, কবি ও শিক্ষক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
আলপনা তালুকদার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
তীর্থপতি গুপ্ত, কবি ও চিকিৎসক। অংশুমালীর নিয়মিত লেখক।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল, লেখক, অবসর প্রাপ্ত ঔষধ বিপণন আধিকারিক
সীমন্তিনী ঘোষ, কবি, লেখক, গবেষক ও নারী প্রবক্তা।
মিতালী মুখোপাধ্যায়, জার্মানি প্রবাসী কবি, সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষক। অংশুমালীর লেখক।
সুমনা চৌধুরী, লেখক, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী। অংশুমালীর লেখক।
===========
পাবলিশার্স নোট:
‘আমায় একটুখানি ভালোবাসতে দেবে?’ শিরোনামের কবিতাখানি অর্পিতা রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি থেকে বাছাই করা হয়েছে। এটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি ফ্ল্যাটে তাঁকে মৃতাবস্থায় উদ্ধার করা হয় এবং গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে নিজ এলাকায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
চমৎকার সামার এর বিকেল।জুন মাস। লালচে দীর্ঘ সোনালী বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে হাডসনের জলে। নিউইয়র্ক…..
বিধবা রতিমন্জরী বুঝেছিল যে স্বামীবিয়োগজনিত দুর্নীতির পরিণাম পুরোটাই তার ওপর বর্তাবে। তার চাইতেও কঠিন হল,…..
গল্পের আবহ দিয়ে শুরু করা যাক। একটা নামকরা প্রতিষ্ঠানে দুজন কাজ করেন। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ…..
ধরুন লক্ষ লক্ষ বছর আগে গহীন পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা কোনো স্রোতস্বিনীতে পেটানো শরীরের এক…..