কবি চন্ডীদাস ও চন্ডীভিটে
কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত। চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে…..
অহং ব্রহ্মাস্মি; আমিই ব্রহ্ম। আমার নাভিপদ্ম থেকে সৃষ্টি করেছি এই পুরুষ এই নারী। সৃষ্টিতত্ত্বে কোনো বিভেদ রাখিনি। পরস্পরের পরিবর্ত নয় বরং পরিপূরক। আমাদের প্রমিত রন্ধনশালায় জেগে থাকা অর্ধেক নারী সত্ত্বা আর বাকি অর্ধেক চন্দ্রাহত পুরুষ সত্ত্বা যখন মিলনের গান গায়, সাম্য নয়, সমন্বয়ের মন্ত্র বাজে দিকখোলা সঙ্গমের সবুজ মাটিতে। রাত্রিত্বকে জেগে ওঠে পূর্ণ মানুষ সম্ভাবনা। কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ পূর্ণতার সংজ্ঞা জানে না। কোমল কিশোরীর অপ্রস্তুত যোনিমার্গ খোঁজ করে ব্রহ্মতেজের আস্ফালনে। কুমারীর গোপনাঙ্গের রক্তস্রোতে লোহিত নদী নির্মাণে ব্যস্ত সে; যে নদী গড়ে দেবে কুলীনের কাঙ্ক্ষিত স্বর্গের সিঁড়ি। আকাশমার্গে তখন বিস্মিত ব্রহ্ম। উন্মাদ দেহবন্দী পুরুষের যৌনহ্রেষা শুনে বৃষ্টি ডাকে; এসিড রেইন; ধুয়ে মুছে যায় নারী নির্যাতনের ঘৃণ্য ইতিহাস।
সেই সময়, যখন নারীমেধ যজ্ঞের ঋত্বিকগণ নারীকে সমিধ আর কৌলীন্যকে হোমদন্ড করে যজ্ঞবেদি প্রস্তুত করেছে নির্বাণ লাভের আশায়; দাউদাউ জ্বলছে বিকৃত কামনার আগুন; সেই সময়েরই এক মর্মস্পর্শী প্রতিচ্ছবি ‘ব্রাহ্মণ নবাব’। শিল্পী কমল চক্রবর্তী। সাহিত্যিক মাত্রই কল্পনাবিলাসী। তাই বলে তিনি কোনো নীহারিকাবাসী জীব নন। শুভাশুভের দ্বন্দ্বে গড়া এই পৃথিবীরই মানুষ। তাঁর দ্বিতীয় জীবনে শিল্পীসত্তাই প্রধান হলেও প্রথম জীবনে তিনি মানুষ আর মানুষ মাত্রই সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের অন্তস্থলে যে গভীর স্রোত সতত বহমান, যে জটিল আবর্তে সমাজের আঁকেবাঁকে জমে ওঠে অভিশপ্ত পলিমাটির স্তর, সেই জীবন প্রবাহের সংঘাতের সঙ্গে নিবিড় সূত্রে বাঁধা পড়েছেন লেখক। কালের গন্ডি তাঁকে বাঁধতে পারেনি। সময়ের লক্ষ্মণরেখা ডিঙিয়ে সর্বকালের সর্বমানুষের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য গ্রন্থন। তাই লেখক যখন অনুভূতির গভীরতম তলে ডুব দিয়ে প্রাচীন কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ এবং সতীদাহকে ঘিরে চারপাশের মানুষগুলিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন; আরোপ করেন দ্রষ্টার স্বচ্ছ আবরণ; সেই আবরণের ওপারে আমরা দেখতে পাই এক অন্য দিগন্ত। সেখানে নারীনিধন যজ্ঞের পুরোহিত নরোত্তমই শুধু ব্রাহ্মণ নয়। রয়েছেন তিনকড়ি, হৃদয়ে যাঁর মানুষের জন্য আবহমানের বিশ্বাস। যিনি ভাবেন কুলীনজন্ম ইতরজন্ম, নিষ্ঠুর অত্যাচারী। বিবাহের নামে নগ্ন নির্মম নারীনিধন যজ্ঞ কুলীন ব্রাহ্মণের অক্ষয় যৌন ব্যাভিচার মাত্র, তন্ডুলকণার জন্য পৃথিবীর সঙ্গে অশুভ আঁতাত মাত্র। রয়েছেন ডাকাত রমণীকান্ত পুষিলাল; পৃথিবীর সৌন্দর্য নির্মাণ ও উপভোগ করার জন্য যাঁর জন্ম –
“যদিও তাহাদের আকৃতি মানুষের মতই, কিন্তু প্রকৃতি কিছু পৃথক। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত তাঁহারাই বিবেচনা করেন। কেন লাল রঙ, কেন বেগুনী। কেন প্রভাতে পাখি, কেন সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ। কেন আকাশ নীল! পৃথিবীতে অনেক রূপ, ঐশ্বর্য, যাহা কেবল শরীর নয়। রমণ ও ভোজনের বাইরের পৃথিবী। মেঘদূত বা রামায়ণ পৃথিবীতে হাজার বছর পূর্বে রচিত। মাত্র কিছু মানুষের জন্যই মহাভারতের পৃষ্ঠা প্রতিদিন খোলা হয়। গোপনে মেঘদূতে হাত রাখেন, কারণ চারিদিকে শরীর শরীর মত্ততা। খাদ্য গন্ধে মানুষ জাগিয়া, যৌন গন্ধে ঘুমায়। রমণী ডাকাত, নভমন্ডলে দৃষ্টি, মেঘদূত ভাসিয়া যাইতেছে”।
কুলীনজন্ম ইতরজন্ম – প্রাচীন কুলীন ব্রাহ্মণের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। একটু পিছুফেরা। একটু ইতিবৃত্তে ভ্রমণ। সময়টা খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী। বাঙলা তখন প্রায় ব্রাহ্মণশূন্য অনার্য্যভূমি। গৌড়ের রাজা আদিশূর ৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে পুত্রেষ্টিযজ্ঞের জন্য কনৌজ থেকে ৫ ব্রাহ্মণকে এদেশে নিয়ে এলেন। তাঁদের ৫ টা গ্রাম দান করা হল। ১৫০ বছরে সেই ৫ ঘর ব্রাহ্মণ থেকে ১১০০ ঘর ব্রাহ্মণের সৃষ্টি, যা বহুবিবাহপ্রথার সুনিশ্চিৎ ইঙ্গিত। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই ৫ ব্রাহ্মণের মোট ৫৬ টি সন্তান – ভট্টনারায়ণ – ১৬; দক্ষ – ১৬; বেদগর্ভ – ১২; শ্রীহর্ষ – ৪; ছান্দড় – ৮।
অর্থাৎ এক পুরুষে ১১ গুণ বৃদ্ধি, যা বহুবিবাহ ছাড়া সম্ভব নয়। রাজা আদিশূরের ১৫০ বছর পর বল্লালসেন রাজা হলেন, তখন বাঙলায় ১১০০ ঘর কনৌজ ব্রাহ্মণের বংশধর। এই বংশধরদের মধ্যে বল্লালসেন কৌলীন্য প্রথার প্রচলন করলেন। অর্থাৎ বলা হল তোমরা সুব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ। আদিশূর যখন ৫ ব্রাহ্মণকে কান্যকুব্জ থেকে নিয়ে এলেন তখনও বাঙলায় কিছু ব্রাহ্মণ ছিল। সংখ্যা প্রায় সাতশ। যাদের বংশধরদের বলা হত সপ্তশতী। বল্লালসেন কিন্তু এই আদি ব্রাহ্মণদের এড়িয়ে শুধুমাত্র কনৌজের পাঁচ ব্রাহ্মণের বংশদ্ভুদদের মধ্যে কৌলীন্য সংস্থাপন করলেন। কান্যকুব্জীয় ব্রাহ্মণরাই বংশপরম্পরায় কুলীন ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। শ্রীহর্ষের ত্রয়োদশ পুরুষ উৎসাহ, যিনি বল্লালসেনের কাছে কুলীন উপাধি পান – মুখোপাধ্যায় ঐ উৎসাহের বংশধর। তেমনি চট্টোপাধ্যায় দক্ষের অষ্টমপুরুষ বহুরূপের বংশধর ইত্যাদি।
তারপর ইতিহাসের অনেকগুলি পৃষ্ঠা উল্টে গেছে সমাজব্যবস্থার অস্থির চলনের মধ্যে দিয়ে এবং স্থির অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ কুলীন থেকে কমল চক্রবর্তী প্রণীত কুলীন ব্রাহ্মণের জন্ম।
‘ব্রাহ্মণ নবাব’ উপন্যাসের এক উজ্জ্বল চরিত্র তিনকড়ি। পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ, লোলচর্ম অগ্রদানী ব্রাহ্মণ। অগ্রদানীও সমাজের এক প্রহসন মাত্র। অগ্রদানী অর্থে মৃত ব্যক্তির আত্মার প্রতিভূ। শ্রাদ্ধের সময় মৃতের আত্মা অধরা, অথচ শ্রাদ্ধের দান প্রেতের উদ্দেশ্যে সর্বাগ্রে দেওয়া শাস্ত্রবিধি! তাই সমাজের গরীব ব্রাহ্মণকে অগ্রদানী নাম দিয়ে মৃতের আত্মা সাজানোর প্রহসন। ঐ প্রেতের জন্য নির্দিষ্ট পিন্ড ও দান সামগ্রী অগ্রদানীর প্রাপ্য। আবার যেহেতু সে প্রেতের ভূমিকায় অভিনয় করল তাই সমাজ তাকে পতিত বলে দেগে দিল। অনৈতিকতার আশ্চর্য সামাজিক যুক্তিবোধ!
এহেন তিনকড়ির জীবনে স্বপ্ন দেখার ন্যূনতম অবকাশ বা অবস্থান কোনোটাই ছিল না। নবাবের হারেম সুন্দরীদের আরোগ্যকামনায় তিনি মা শেতলার পূজো করলেন। এবং এই হারেমবন্দিনীদের মধ্যে আবিষ্কার করলেন সরল স্বাভাবিক ভঙ্গীর এক আফ্রিকান কৃষ্ণমল্লিকা, সিম্বি; যার অনাবিল সারল্যই হয়ে উঠল তিনকড়ির পূজোর উপকরণ। এই কৃষ্ণকলি শেষপর্যন্ত স্বপ্নহীন তিনকড়ির চোখেও স্বপ্ন এঁকে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন পৃথিবীর সুদৃশ্যগুলি অন্তরালবর্তী। সূক্ষ্ম সংবেদনশীল লেখকের চেতনায় মনুষ্য জীবনের অসহায়তা, নৈরাশ্য ও বিষাদের ছায়ামূর্তি; স্নায়ুকোষের নিবিড়ে তৈরি করে ছায়াপথ। যে পথে লেখক আলোর বার্তা বয়ে আনেন বোরখাবৃত হারেমের নবাবী অন্ধকারে। সুন্দরী হারেমকন্যাদের আনন্দহীন জীবনের পাশেই স্থাপন করেন দিগম্বরী আফ্রিকান নন্দিনী সিম্বিকে, যে দাসত্বের মাঝেও বাঁচার আনন্দ কুড়িয়ে নিতে জানে। অকিঞ্চিৎকর জীবন হলেও লেখকের মমতাময় কলম তার রূপকে করেছে অপরূপ, কৃষ্ণময়তাকে বর্ণময়, কোলাহলহীন নীরব অবয়বের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন প্রকৃতির ভুবনমোহিনী রূপ –
“তাঁহার কৃষ্ণকায়, ভুবনমোহিনী রূপ, ভ্রমরকৃষ্ণ আয়ত চক্ষুদ্বয়। আজানুলম্বিত দীর্ঘ বাহু, আকাশময় ছাড়া চুলের উত্তাল ভয়ংকরতা, জঙ্ঘা হইতে পা অবধি কৃষ্ণকিংখাবের জৌলুষ, নীরব অথচ যেন পৃথিবীর যাবতীয় ঘূর্ণনের জন্য দায়ী, পুরু বিস্ফারিত ঝুলিয়া পড়া অধরওষ্ঠ, উদ্ধত জিঘাংসা, দীপ্ত স্তন যুগল যেখানে লালসা নয় কাম নয় বনকুসুমের বিস্তীর্ণ বিবরণভূমি, সূক্ষ্ম কাঁকালের দায়িত্বে ঈষৎ উন্নত নিতম্ব।“
মানুষ মনুর পুত্র এটা ইতিহাস। কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমিক কমল চক্রবর্তীর উপলব্ধি ইতিহাস মানে না। মানুষ মাত্রই প্রকৃতির সন্তান আর প্রকৃতির মতই তার চরিত্র। যেখানে নটরাজের তান্ডব মূর্তির পাশাপাশি বিরাজ করে শান্ত সমাহিত রূপ। যেখানে নরোত্তমের লালায়িত কিশোরী ভজনার পাশেই তার পুত্র পুষিলালের মাতৃবন্দনা। কুলীন ব্রাহ্মণ নরোত্তম তর্কালঙ্কারের পুত্র শ্রীবাস বিদ্যাভূষণ। পিতার নিয়মিত বিবাহ ও যৌনক্রীড়ার মত্ততা দেখে নরনারীর বৈবাহিক জীবনের অন্তসারশূন্যতা যখন প্রকট; যৌন দুর্গন্ধে কলুষিত সংসার ও সমাজব্যবস্থা মূল্যহীন; তখন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত শ্রীবাস বিশ্বাস করলেন, মানুষ জন্মে মানুষের কিছু করণীয় থাকে, কিছু নিষ্ঠা। আর সেই বেঁচে থাকার মূল্য দিতেই ব্রাহ্মণরাক্ষস পিতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হল পুত্র শ্রীবাসকে। বেছে নিতে হল কুলীননিধন যজ্ঞ। হতে হল রমণীকান্ত পুষিলাল। নারীর কান্না, সহমরণের দাউদাউ শিখা, প্রথম রজদর্শনেই বিবাহযোগ্যতা, না হলে সমাজের বিধানে পতিতা পরিত্যক্তা – এই ছিদ্রপ্রধান ক্ষয়া সমাজের যন্ত্রণা বয়ে মেঘদূতে আকন্ঠ নিমজ্জিত শ্রীবাস হয়ে উঠলেন ডাকাত। কুলীন ব্রাহ্মণের মৃত্যুদূত।
লেখকের কলমে প্রকৃতি যেন দ্বিচারিনী হয়েছেন। একই গর্ভে নারীনিধন যজ্ঞের পুরোহিত নরোত্তম আর কুলীননিধন যজ্ঞের পুরোধা রমণীকান্ত ডাকাত। একই মাটিতে যৌন কোলাহলের নির্মম গরলে বোধের নিরঞ্জন আর ব্যর্থযৌবন কুলীন নারীর গোপন অভিসারের যন্ত্রণায় দীর্ণ ডাকাতিয়া অশ্রু। একই জলীয় আবহাওয়ায় “নারী মাত্রই নরকের দ্বার”- এই মর্মে নির্বিকার পাষন্ডের নারী ব্যবহার আর নারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে শাণিত ১০৮ মহানিশা নিয়ে বিশাল বঙ্গভূমির জ্বলন্ত সতীথানে মাথা পেতে কবি ডাকাতের কান্না। পুষিলালের ১০৮ খড়্গ তৎকালীন কুলীন ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত ঊষর বঙ্গ মৃত্তিকার যদি কিছু শোধন করে থাকে, যদি সেই কবি ডাকাতের চোখের জলে সমস্ত সতী নারীর দাহ কিছু কম হয়ে থাকে, তবে সেই চিত্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে লেখক মানুষের জন্য মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। মাটি মানেই নারী। সেই মাটি সেই ধরিত্রীর বুকের ওপর ধরিত্রীপুত্রের অত্যাচারের দলিল ‘ব্রাহ্মণ নবাব’, যার দর্শনে মনে প্রশ্ন ওঠে, – ধরিত্রী, সর্বংসহা নামে তোর এত মোহ!
অর্বাচিনের বাচালতায় কিছুক্ষণের বিরাম দিয়ে কলম এক্ষণে লঘু হতে চাইছে। তারই ইচ্ছাপূরণকল্পেঃ
‘ব্রাহ্মণ নবাব’-এর মত মহান শিল্পকর্ম বৃক্ষপ্রেমরহিত হবে, তাও কি হয়! ‘বৃক্ষু’-র সৃষ্টিকর্তা অলক্ষ্যে হাসলেন। মৃতপ্রায় তারিনীবালার নগ্ন নারীশরীর দর্শনে অশান্তচিত্ত শিষ্যের মন শান্ত করার উপায় বাৎলাচ্ছেন সন্ন্যাসী সূর্যভানু –
“শান্ত হও! যাও নদীতীরে খানিক ভ্রমণ করে এসো। অথবা মন্দিরে নামগান কর। তাও যদি না হয়, বৃক্ষের আরাধনা, বন্দনা, সেবা। বৃক্ষের জন্মে মন দাও। বৃক্ষ তোমার ভার লাঘব করবেন। বৃক্ষ হৃদয়ের সমস্ত বোঝেন।“
দোষ নেবেন না। আমি শুধু উদ্ধৃতি দিয়েছি মাত্র। স্বয়ং বারীন ঘোষাল স্বপ্নও দেখেন এই বৃক্ষপ্রেমিকের। “সাহিত্য কী অর্থে শিল্প”- এই মর্মে এক স্বপ্নসভার সাম-আপ করতে কমল চক্রবর্তীকে অনুরোধ করলেন –
“কমল এসেই বললো – ‘সাহিত্য হল গাছ, আর গাছের বেড়ে ওঠাটাই শিল্প। ঐ তার কাজ এবং অর্থ। গাছ পুঁতলেন কি পুঁতলেন না, বেড়ে ওঠাটায় আপনি অংশ নিলেন কি নিলেন না, ভেবে দেখুন। আজকের সার এইটুকু’ [কবিতার অধিকার’-বারীন ঘোষাল]
লঘুতা ছেড়ে এবার ফেরা যাক উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে। অর্থাৎ যৌনতা। বিষয় এবং উপকরণ যথেষ্ট পরিমাণেই মজুত ছিল উপন্যাসটিকে অকারণ যৌনগন্ধী করে তোলার। কিন্তু লেখকের নাম কমল চক্রবর্তী। যাঁর কাব্যিক গদ্যে প্রেক্ষণের দ্বন্দ্ব থাক বা না থাক নিঃশেষ সমর্পণ প্রতিটি চরিত্রচিত্রনে। যাঁর শব্দচয়নের মোহিনী মায়ায় মুহূর্তগুলোর অবাক জলছবি। তুলির সূক্ষ্মতায় রঙের গভীরতায় রেখার বক্রতায় ছবির মধ্যে ছবি। যে গহনে ডুব দিলে মেঘদূতের উড়ন্ত মেঘে হাত, নারীর মূর্ত বেদনার বিমূর্ত দর্পণে নিঃশব্দ মুখ দেখা।
উপন্যাসের পাতায় পাতায় কুলীন ব্রাহ্মণের প্রেমহীন যৌনতা আর নবাবের হারেমযাপন- যার বোরখাবৃত অলিন্দে বাতাস নেই; ছিদ্রহীন নৈরাশ্যের ডানায় কোনো রঙ নেই; কোনো উড়ান নেই; অর্থহীনতার বোধে আক্রান্ত হয়ে অন্ধকার যৌনতার ভেতর যখন পাখি কই পাখি কই বলে হাতড়ে ফিরছি একটু আলোর জন্য, একটু বৃষ্টির জন্য; তখনই আমরা পৌঁছে যাই তিনকড়ি-সিম্বির প্রেমমদির যৌনময় রাত্রীযাপনে। যেখানে অবয়বের বিনির্মাণের ওপর স্তরে স্তরে নির্মিত হয়েছে কায়াহীন অঝোর বৃষ্টি। নির্মীয়মাণ কালের চুড়ান্ত অভিশপ্ততা ধুয়ে মুছে দুটি সংবেদনশীল হৃদয়ের পাশাপাশি অবস্থান। যেন শরীরী প্রেম নয়, প্রেমের অন্তরা বেয়ে গোর্খাই ঝোরার আবহসঙ্গীত। যেন যৌনতার গান নয়, মিথুনের আসমানী সীমানায় মিড়ভাঙা বন্দিশ –
“যেন মানব মানবী নন! যেন এই বিশ্বের কেহ নন! যেন নিরাকার হাজার বছরের আনন্দ মাত্র। বিমূর্ত, আশা, আশ্রয়, হৃদয়, ভালোবাসা যাহা ছোঁয়া যায়না, অনুভব শুধু, বিশ্বে প্রথম একাত্ম। কৃষ্ণ করাল হাঁ, রক্তাক্ত, অজগর সাদৃশ্য, ক্রমে গিলিল। রঙের উৎসব হইতে কতিপয় ধ্বনি মাত্র। কখনও পুরুষ কখনও নারীকন্ঠ! আর সমস্তই ঝংকার, তরঙ্গ, উদ্বেল, উৎকন্ঠা, উন্মনা। যেন বিশ্বে এই প্রথম লজ্জাবোধ জাগিয়াছে এবং দেখিলেন, প্রকৃতির যাবতীয় সুন্দর হইতেও মনুষ্য শরীর আরও। যেন প্রকৃতির নিজস্ব প্রজনন কল্পে, এতদিনে শুদ্ধ দুই অবলম্বন পাইল।“
আমাদের হৃদয়বৃত্তির ওপর যখন নিয়মাধীন অথচ রহস্যাবৃত প্রকৃতির ছায়াপাত ঘটে, তখনই রহস্যময়ীর ইতিবৃত্তে জটিল বন্ধন গড়িয়ে সৃষ্টি হয় অমর কাব্য বা উপন্যাস। কিংবা বলা যায় যাবতীয় শিল্পকলার প্রেক্ষাপট ওই ছায়াপাত। প্রেমকলাও এর ব্যতিক্রম নয়। দেহ ও মনের যৌগিক সত্তায় গড়া মানুষ; দেহের টান আর মননের আরোহ-অবরোহ বেয়ে সৃষ্টি করেছে প্রেম। যৌনতা প্রকৃতির সৃষ্টি। কিন্তু প্রেমময় মানুষ, তিনকড়ি-সিম্বি, সেই যৌনতার ভিতের ওপর গড়ে তুলেছে প্রেমের উজ্জ্বল আলোকিত ইমারৎ। যার অলিন্দে মুগ্ধ বাতাস; দেওয়াল জুড়ে মাতালগন্ধী জ্যোৎস্না; মেঝের ছড়ানো আঁচলে রোদ্দুরে নেশা; ছাদের নিভৃত প্রান্তরেখায় অচেনা বন্দিশ।
প্রেমের বন্দিশ ছেড়ে এবার বাঙালী রক্তের জলীয় আবহাওয়ায় কিছু ছিদ্রান্বেষণ –
প্রথম অনুযোগ – সত্তরোর্ধ নরোত্তমের যৌন লালসার লোহিতসাগরে দ্বাদশী পাতাকুড়ানির ব্যক্ত আর্তনাদ তো আমরা কান পেতে শুনেইছি। তারপরও “অব্যক্ত সংলাপ”! একটু কি অতিরিক্ত হল? এই সংলাপের বার্তা সমস্ত উপন্যাসটি জুড়ে স্বমহিমায়, সেখান থেকে কি একটু টলে গেল?
দ্বিতীয় অনুযোগ – উপন্যাসের শেষপাতায় এসে আমরা যখন পুষিলালের ব্রাহ্মণযজ্ঞে আহূত হয়েছি, মর্মে মর্মে মহাকালের অট্টহাস্য, বর্ণময় সূর্যাস্তের প্রেক্ষাপটে কুলীন ব্রাহ্মণের চিতাবহ্নিতে অগ্নিশুদ্ধ হচ্ছি, নারীর কান্না শুনতে শুনতে দীর্ণ হতে হতে শেষবেলায় এসে পুষিলালের জ্বালা আগুনের তাপে অনির্বচনীয় আত্মশুদ্ধির স্পর্শ পাচ্ছি – এর পরও কিছু পর আছে? বিশ্বাস হয়নি। তবু আছে। একটি “মাতৃবন্দনা”, শেষবেলার ধ্যানমগ্নতায় এসে সহ্য হয়নি।
সাহিত্যে নবরসের মধ্যে বিভৎসরস ‘ব্রাহ্মণ নবাব’-এর অন্যতম ঐশ্বর্য। সে কোনো রূপে নাকি অরূপে বেজেছে টের পাইনি। তবু চরাচরের প্রতিটি কণায় কিসের যেন স্পন্দন ধ্বনিত হয়েছে। শিরায় শিরায় বেজেছে দারুণ অগ্নিবীণা। সংসারীরা কীভাবে ধ্বংসের দিকে, জন্মের দিকে চলেছে তারই নির্মাণকল্পে ডাকাতগড়ে মহাকালের মূর্তি; যার সামনে জীবনের সমস্ত বোধ তুচ্ছ হয়ে যায়; পরিচিত জগৎ চারপাশের জীবন সামান্য ও অনাবশ্যক হয়ে পড়ে –
“কালো কষ্ঠিপাথরের বেঁটে ভয়ানক উলঙ্গ মূর্তি। মুশলের ন্যায় লিঙ্গ। পুষ্ট। লিঙ্গমুন্ড স্বর্ণ টোপরে আচ্ছাদিত। নিয়মিত জল, ঘি, দুধে ধৌত হওয়ায় আলো বিচ্ছুরিত। মহাকালের দুহাতে অগ্নিকুন্ড, মুখেও শিখা। পায়ের নিচে পিঠে নরনারী, ত্রিভূবন।
পিছনের দেয়ালে ভয়ানক এক রমণী। উলঙ্গ। যোনিতে মহাকালের দীপ্ত, দৃঢ় লিঙ্গ প্রবেশ করিতেছে। স্তন দুইটি ডাঁটো, একটি হইতে অগ্নিশিখা হু হু, অন্য স্তনটা দুগ্ধ নয় রক্তে টইটুম্বুর। রক্ত গড়াইয়া ফোঁটা ফোঁটা। এই মৈথুনরত দেবীর দুপায়ে দুইটি বিবস্ত্র রমণী চিত্র। বামে যিনি তার যোনির বিশাল ব্যাদন হইতে বৃক্ষ, হাওয়া, অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র, পর্বত ইত্যাদি তোড়ে। ঊরু দুইটি দুই পার্শ্বে বিস্ফারিত! অসীম আঁধার মাংসল ঊরুর চাপে যোনিমুখ বিশাল হাঁ। দক্ষিণের রমণী একই মুদ্রা। শুধু তাহার যৌনাঙ্গ হইতে মানুষ, ইঁদুর, আরশোলা, গরু, মহিষ, গাধা, সিংহ, চিল, টিয়া, শকুন, কুকুর ইত্যাদি ঝড়ের হাঁ হাঁ। যেন যোনিমুখ নয়, মহাভারত যুদ্ধের কৃষ্ণের হাঁ মুখ, তোড়ে যাবতীয় নশ্বর”।
একদিকে যেমন সমাজ সংবেদনা লেখকের সৌন্দর্যবোধের সীমানায় এসে ধরা দিয়েছে অনায়াসে, তেমনি তাঁর আজন্ম সৌন্দর্যের সাধনা শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বময় সামাজিক উপলব্ধিকে রূপময় করেছে। দূরপারে সেই চুপকথার ঈঙ্গিত দিয়ে পৃথিবীর কদর্যের দিকে, মানুষের দুঃখ ও পাপের দিকে লেখক মোহমুক্ত চোখ তুলে তাকিয়েছেন। বর্তমানের কোনো ঔপন্যাসিক কিন্তু কিছুতেই জমিদার তনয়ের বলির সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। যত রক্ত তত উত্তেজনা তত বাজারে। কিন্তু কমল চক্রবর্তী এখানেই অনন্য। তাই দেখি, মহাকাল যজ্ঞের বলিপ্রদত্ত কুলীন জমিদার তনয় শেষপর্যন্ত পুষিলালের হাতে হাত রেখে ব্রাহ্মণযজ্ঞে অংশগ্রহণের শপথ নেয়। সমস্ত উপকরণ মজুত থাকা সত্ত্বেও বর্তমান যুগের থ্রিলারের হাতছানি উপেক্ষা করে উপন্যাসটিতে মানুষের কান্না রূপ পেয়েছে অসীম মমতা নিয়ে। লেখকের মন যেন সমাজের সূক্ষতম বীণাতন্ত্র। “অত্যাচারিত অপমানিত অসহায় আবহমান নারীর” কান্নার ঝংকার উঠেছে সেই তারে। অশুভ অমঙ্গলময় সমাজের দিকে প্রতিবাদের আঙুল তুলেছেন লেখক অথচ তাঁর মরমিয়া কলমের মুন্সিয়ানা নারীর গোপন কান্না ও নিদারুণ শীৎকারের মধ্যেও মঙ্গলময় বিশ্ববিধানের ঈঙ্গিত রেখে গেছে। মন্ত্রমুগ্ধতায় দেখি, মৃত্যুর সময় নরোত্তম আকাশমুখো। সারাজীবন রমণ ও ভোজনের প্রাত্যহিকতায় আকাশ দেখার অবকাশ হয়নি তার। কিন্তু লেখক তো শুধু দ্রষ্টা নন, স্রষ্টাও বটে। সামাজিক দুঃখের অভিঘাত জীবনের পাকদন্ডী ঘুরে যে বিষাদ চেতনার জন্ম দিয়েছে, তারই প্রেক্ষাপটে লেখক মৃত্যু মুহূর্তে নরোত্তমকে আকাশ দেখার একটু অবকাশ দিয়ে গেছেন। জীবনের সবটুকু ‘না’-এর মধ্যে যেটুকু আলোর হদিশ সেখানে হাত রাখেন লেখক। কারণ অন্ধকার সততই নিজেকে বিনিময় করে আলোর সঙ্গে, যার অলিন্দে আমাদের বসবাস।
কবি, গদ্যকার, ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৪৬ সালে। কর্মসূত্রে জামশেদপুর। তিনি কৌরব পত্রিকার গোড়াপত্তনকারী এবং সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে মূলধারার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও পরীক্ষামূলক সাহিত্যসাধনা করেন। তিনি এক ভিন্নপন্থী সমাজসেবী। পুরুলিয়ায় ভালোপাহাড় নামে এক কবিকলোনি গড়ে তুলেছেন নতুন কবিতা আন্দোলনের সমস্ত কবিদের সহায়তায়, যেখানে নিয়মিত কবিতার ওয়ার্কশপ, কবিতাক্যাম্প বসে। কিন্তু এটাই ভালোপাহাডের একমাত্র পরিচয় নয়। ভালোপাহাড় হল দরিদ্র আদিবাসীদের স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে শিশুদের পড়াশোনার পাশে পাশে তাদের পরিবারের মানুষজনও বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস: বৃক্ষু, আমার পাপ, প্রচ্ছদ কাহিনি, ব্রাহ্মণ নবাব ইত্যাদি; কবিতাগ্রন্থ: মিথ্যা কথা, চার নম্বর ফার্নেস চার্জড, স্বপ্ন, মদের দোকানের ছেলেটা, একশো কমল, ভদ্রলোক ইত্যাদি।
কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত। চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে…..
উপায়ন “রাত জেগে বই পড়ার একটা আলাদা ভালোলাগা আছে। চারিদিকে চুপচাপ আর নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে বইয়ের…..
রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..
টমাস মান (Tomas Mann) – এর বুদেনব্রুক (Buddenbrooks) বইটি মূল জার্মান ভাষায় পড়ার পর কিছুটা…..