করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নানা শারীরিক-মানসিক-যৌন-অর্থনৈতিক নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। নারীর প্রতি নানা সহিংসতার পরিসংখ্যানগুলো আমাদের সমাজে নারীর নাজুক অবস্থান তুলে ধরে। এরকম পরিস্থিতিতে নারী দিবসের ভাবনায় নারী পুরুষের সম অধিকার এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করার পথে থাকা বাধাগুলোকে সঠিকভাবে উদঘাটন করা খুব জরুরী। প্রথমেই দেখা দরকার, নারীর প্রতি নানা বৈষম্যমূলক আচরণ কেন হয়।
প্রতিটা শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হল তার বাড়ি, তার পরিবার। এটিই তার আচরণ, মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরী করে দেয়। এই ভিত্তিই তার সারাজীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। এখান থেকে সে যা শিখবে, সারাজীবন সে তাই করবে। পরিবারে সে ভাল কিছু শিখলে সে ভাল হবে, নাহলে খারাপ। উন্নত প্রতিটা দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা বাবামার পাশাপাশি বাচ্চাদের সারাজীবনের কাঙ্খিত আচরণের ভিত গড়ে দেন।
বিদেশে প্রতিটা বাবা-মা জানে কোন বয়সের বাচ্চাদের সাথে কি আচরণ করতে হবে, বাচ্চাদের সামনে কি কথা বলা যাবে বা যাবেনা। তার সামনে কি আচরণ করা যাবে বা যাবেনা, তা আমরা জানিনা। আমাদের সমস্যার শুরু এখান থেকেই।
মেয়ে সন্তানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয় তখন থেকেই, যখন জানা যায় গর্ভস্থ শিশুটি ছেলে না মেয়ে। ছোটবেলা থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা পরিবার, প্রতিবেশী, স্কুল, খেলার সাথী, শিক্ষক, সমাজ – এদের কাছ থেকে দিনে দিনে একটু একটু করে শেখে যে মেয়েরা নীচু শ্রেণীর জীব, পুরুষের আজ্ঞাবহ, চাকর সমতুল্য এবং কোনমতেই সে পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়। শিশুরা ওদের সামনে বা ওদের সাথে করা বড়দের নানা আচরণ থেকে এমন ধারণা পায়। তাই পরবর্তীতে সেও বড়দের মতই আচরণ করে।
উদাহরণ দিই-
– শিশুরা ছোটবেলা থেকে দেখে যে বাবা মাকে মারে বা গালি দেয়। দিতে পারে। এটা তার অধিকার। কিন্তু কোন মা সেটা পারেনা। মা গালি বা মার খেয়েও হাসিমুখে আবার সংসার করে, বাবা অন্যায় করলেও শাস্তি হয়না, তাকে কেউ কিছু বলেনা। বাবার কোন আচরণকেই অন্যায় মনে করা হয়না। তাই বাবার মর্যাদা বেশী, মায়ের কম।
– পরিবারে অর্থ বা সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষ। শিশু জানে, টাকা থাকে বাবার হাতে। যেকোন প্রয়োজনে মাকে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতে হয়। বাবার মর্জি হলে দেয়, না হলে দেয়না। না দিলে মায়ের কিছু করার থাকেনা। চাকুরীজীবি মায়েরাও টাকা ইচ্ছামত খরচ করতে পারেনা। স্বামী করতে দেয় না। তাছাড়া মেয়েরা সংসার, বাচ্চা সামলিয়ে সময় পায়না। ফলে তার সৃজনশীলতা থাকলেও প্রকাশ পায়না। ধীরে ধীরে সে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেনা, সারাজীবন পরনির্ভরশীল থেকে যায়। পুরুষ ইচ্ছে করে মেয়েদের অর্থ-সম্পদ করায়ত্ব করে, যাতে মেয়েরা তাকে ছাড়া একা বাঁচতে না পারে।
– আমাদের সমাজের নিয়ম অনুসারে কিছু কাজ ছেলেদের, কিছু কাজ মেয়েদের। মা ও বাড়ীর মেয়েরা অনুৎপাদনশীল কাজ করে। অর্থাৎ তারা যত কাজই করুক, তারা সে কাজের কোন পারিশ্রমিক পায়না। মা টাকা আয় করেনা। তাই শিশুরা মায়ের কাজ বা পরিশ্রমকে ‘ফালতু’ ভাবতে শেখে। মায়ের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন মনে করে। বিদেশে সেটা হয়না। কারণ বিদেশে সব কাজ সবার। রান্না করা, ঘর-বাড়ি পরিস্কার করা, সন্তান প্রতিপালন- ইত্যাদি সব কাজ সবাই মিলে করে। তাই মেয়েদেরকে একা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়না। ফলে মেয়েরাও ব্যবসা বা চাকরী করতে পারে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। আমাদের সমাজের নিয়ম অনুসারে কিছু কাজ ছেলেদের, কিছু কাজ মেয়েদের। তুলনামূলকভাবে মেয়েদের কাজগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ ও বোরিং।
– আমাদের সমাজে মেয়েরা নিজের ইচ্ছামত কিছু করতে পারেনা। বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে, অর্থাৎ কোন না কোন পুরুষ মেয়েদেরকে পরিচালিত করে। তারা কি করবে, কি করবেনা, সেটা তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, নিতে দেওয়া হয়না। তাদের জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষরা। ফলে শিশুরা মেয়েদেরকে পরনির্ভরশীল বা পুরুষের পরগাছা ভাবে, কখনোই স্বাধীন সত্ত্বা ভাবতে পারেনা।
– মেয়েদেরকে ছেলেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় সবসময়। যেমন – একা কোথাও যেতে দেওয়া হয়না, সন্ধ্যার পর বাইরে যেতে বা থাকতে দেয়া হয়না, ভীড়ে একা ছাড়া হয়না, ছেলেদের সাথে মিশতে দেয়া হয়না, সব পরিবেশে যেতে দেওয়া হয়না, সব কাজ করতে দেয়া হয়না ইত্যাদি। অর্থাৎ মেয়েরা আক্রমণযোগ্য প্রাণী। যেকোন সময় যেকোন পুরুষ তাকে আক্রমণ করতে পারে, এই ভয় তার মনে বদ্ধমূল করে দেয়া হয় বলে সে নিজেকে দূর্বল ভাবে, ভয়ে ভয়ে সাবধানে চলে এবং নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
– নাটক, সিনেমা, খবরে প্রতিনিয়ত শিশুরা দেখে যে, মেয়েরা আক্রান্ত হয়, যার কোন প্রতিকার হয়না। আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। অর্থাৎ মেয়েদের প্রতি অন্যায় করে পার পাওয়া যায়। পুরুষ দোষ করলেও সমাজ মেয়েদেরকেই দোষ দেয়। যেমন ডিভোর্স হয়েছে শুনেই বলা হয় নিশ্চয় মেয়ের দোষ, রেপ হয়েছে শুনেই বলা হয়, নিশ্চয় খোলামেলা পোষাক পরেছিল, স্বামী মেরেছে শুনেই বলে, মারতেই পারে, সে তো স্বামী, দোষ না করলে এমনি মারে? ফলে মেয়েরাও মেনে নেয় যে তার প্রতি নির্যাতন হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই ন্যায্য। সেজন্য সে নির্যাতনের প্রতিবাদ করেনা।
– স্বামীর হুকুম ছাড়া স্ত্রী কিছু করতে পারেনা। ধর্মও তাই বলেছে। স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া দানও করতে পারবেনা। ধর্ম স্বামীকেও স্ত্রীর প্রতি সদয় আচরণ করতে বলেছে। তবে স্বামী সেটা না করলে সমাজ তেমন আপত্তি করেনা। তাই পুরুষ তা করার প্রয়োজন অনুভব করেনা। নারীরা যেন সহিংসতার স্বীকার না হন তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্মসমূহে বিভিন্ন বিধান বা ব্যবস্থা জারি আছে। অথচ ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীরা বেশি নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হন। এর মূলে রয়েছে পুরুষের নারীকে বশীভূত রাখার অসুস্থ’ মানসিকতা এবং ধর্মের অপব্যবহার ও অপব্যাখা। এখনও অনেক গ্রাম্য ও অশিক্ষিত পুরুষ মনে করে, স্ত্রীকে অনুগত রাখতে হলে তার প্রতি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। নাহলে তারা মাথায় উঠবে। আর সে কারণেই মাঝে মাঝে তাকে প্রহার করা জরুরি।
– সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাবা নেন। তার মতই সব। মায়ের মত গুরুত্বহীন। তাই শিশুরা ধরেই নেয়, বাবার বুদ্ধি বেশী, মায়ের বুদ্ধি কম। মেয়েমানুষের বুদ্ধি কম, এটা পরিবার-সমাজে সবাই জানে, মানে। তাই মেয়েদের মতের কোন দাম দেয়া হয়না।
– সব ধর্মে বহুবিবাহ জায়েজ। কোন কারণ না দেখিয়েও স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়া যায়। না দিয়েও একাধিক বিয়ে করা যায়। তাই বহু স্বামী বউ ছেড়ে গিয়ে আবার বিয়ে করে, করতে পারে। তাতে স্বামীর কোন শাস্তি হয়না। যেকোন বয়সী পুরুষ খুব সহজে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। কিন্তু মেয়েরা পারেনা, বিশেষ করে সন্তান থাকলে তো আরোই পারেনা।
– স্ত্রী নিজেকে স্বামীর অধীনস্ত মনে করে, ভয় পায়। স্বামী অসন্তুষ্ট হতে পারে, এমন কোন কাজ নিজে করেনা। সন্তান বা অন্য কাউকে করতে দেয়না। মা বাচ্চাকে বলে, “এটা কর বা ওটা করোনা, বাবা রাগ করবে।” ফলে শিশু বোঝে, পরিবারে পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ, তার কথাই শেষ কথা।
– বাবা মালিক, মা চাকর। বাবাকে না খাইয়ে মা খায়না, খেতে পারেনা। সব ভাল খাবার বাবা, ছেলে, বাড়ীর গুরুজনদের দিয়ে তারপর মেয়েদের দেয়। সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা নিজে হাসিমুখে যা থাকে তাই খায় বা কখনও কখনও বাসি বা উচ্ছিষ্ট খাবার খায়। অধিকাংশ মায়েরা কখনোই একসাথে খায়না।
– ছুটির দিনে বাবা টিভি দেখে, আরাম করে। মা সেদিন তার আরামের জন্য বিশেষ খেয়াল রাখে। ভাল খাবারের ব্যবস্থা করে, তার কাপড় কেচে দেয়, চুল কলপ করে দেয়। রোজ কাজ থেকে ফিরেও বাবা আরাম করে। অথচ মায়ের কোন ছুটি নেই। তার কোন বিনোদনেরও প্রয়োজন নেই। কারণ সে সারাদিন বাড়ীতে বসে বসে আরাম ছাড়া আর তো কিছুই করেনা! চাকরী বা কাজ করলেও তার রোজকার সংসারের কাজে আর কেউ তাকে সাহায্য করেনা। গ্রামের মহিলারা ঘরের এবং ফসল উৎপাদনের অনেক কাজ করলেও সে কাজের কোন মূল্যায়ন হয়না। তাছাড়া নারী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক পুরুষের তুলনায় অনেক কম।
– হিন্দু মেয়ে বিধবা হলে গহনা-শাঁখা-সিঁদুর খুলে নেয়া হয়, চুল কেটে দিয়ে কুশ্রী করা হয় যাতে কেউ তাকে পছন্দ না করে, বিয়ে করতে না চায়। যৌন চাহিদা অবদমনের জন্য ধর্মের দোহায় দিয়ে বিধবাদেরকে নিরামিষ খাওয়ানো হয়। রঙ্গীন পোষাক, রূপচর্চা সব নিষিদ্ধ। মুসলিমদের মধ্যেও বিধবাদের গহনা পরা, রঙীন পোষাক পরা, বিয়ের উৎসবে যাওয়া ভাল চোখে দেখা হয়না। অর্থাৎ স্বামী ছাড়া সমাজে মেয়েদের অবস্থান দূর্বল ও নীচু হয়। তার সব চাওয়া-পাওয়া, ভাললাগা-মন্দলাগা সবকিছু গুরুত্বহীন হয়ে যায়। বাবা-মাও চায়না মেয়ে স্বামীকে তালাক দিক। তালাকপ্রাপ্তা নারী ও তার সন্তানদের আর্থিক দায় নারীর পরিবার নিতে চায়না। মাথার উপরে বাবা, স্বামী বা ছেলে, মানে কোন পুরুষের ছায়া না থাকলে মেয়েরা আরো বেশী আক্রমণযোগ্য হয়ে যায়। ধর্মেও তালাককে নিরুৎসাহিত করা আছে। ফলে মেয়েরা বাধ্য হয়ে যেকোন মূল্যে পুরুষের সাথে, পুরুষের ছত্রছায়ায় থাকে। এজন্য স্বামী নির্যাতন করলেও মেয়েরা প্রতিরোধ করেনা।
– সমাজ ও ধর্মমতে বৃদ্ধ বয়সে বাবামার দেখাশোনা, খাওয়া-পরা এসব দেখার দ্বায়িত্ব মূলতঃ ছেলেদের। তাই আমাদের সমাজে অধিকাংশ পরিবারে ছেলে সন্তান খুব বেশী কাঙ্খিত। মেয়ে সন্তান নয়। এটিও নারীর প্রতি বৈষম্যের একটি বড় কারণ। এজন্য ছোটবেলা থেকেই সব ভাল জিনিসটা বরাদ্দ থাকে ছেলেদের জন্য। সবসময় ছেলের সুবিধার কথা আগে ভাবা হয়, পরে মেয়েদের। যত্ন ও ভালবাসাও ছেলের জন্যই বেশী। ফলে মেয়েরা নিজেদেরকে ছেলেদের তুলনায় কম কাঙ্খিত ও কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে বাধ্য হয়।
– ছোটবেলা থেকে মেয়েদেরকে বিয়ে করে সংসার করার জন্য তৈরী করা হয়। তারা পড়াশুনা, চাকরী, রূপচর্চা, শরীর ঠিক রাখা- এসবই পুরুষের জন্য করে, যাতে তার ভাল বিয়ে হয়। অর্থাৎ মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল ভাল বিয়ে হওয়া। অন্য কথায় ভাল আশ্রয় পাওয়া। নিজেকে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন চেষ্টাই সে করেনা। কারণ সে জানে, সমাজে একা সে টিকতে পারবেনা। তাকে টিকতে দেয়া হবেনা।
– মেয়েরা ধর্ষিত বা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হলে আমরা গোপন করি। কারণ মেয়েটিকেই সবাই অস্পৃশ্য মনে করবে। তার ভাল বিয়ে হবেনা। তার পরিবারের বদনাম হবে। একটি মেয়ের সম্ভ্রম চলে যাওয়া মানে সমাজে সে অপাংক্তেয়। পচে যাওয়া খাবারের মত, যা কেউ খেতে চায়না। পুরুষ রেপ করলে, পতিতালয়ে গেলে, পরকীয়া করলে, প্রেমিকার সাথে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করলেও তার কিছু হয়না। তাকে কেউ খারাপ বলেনা। দিব্বি সে আবার বিয়ে করতে পারে। সমাজে তার মান এতটুকু কমেনা। কিন্তু মেয়েরা সমাজের চোখে একবার ভ্রষ্টা খেতাব পেলে তার বেঁচে থাকা দায় হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয়না। এটিও নারীকে মানসিকভাবে ছোট ও দূর্বল ভাবতে শেখায়।
– সব খারাপ বা নেতিবাচক ঘটনার জন্য মেয়েদেরকে দায়ী করা হয়। যেমন- সন্তান ফেল করলে, বখে গেলে, দোষ করলে, ভুল করলে, প্রেম করলে, চুরি করলে তার দায় মায়ের। কারণ বাবা আয় করেন, তাই বাকী আর কিছু সে করবেনা। তার কাছে কেউ কিছু আশাও করেনা। সন্তান লালন-পালন, পড়াশোনা, সব দায় একা মায়ের। শিশুরা এসব দেখে দেখে মেয়েদের অশ্রদ্ধা করতে শেখে। ছেলে শিশুরা নিজেদেরকে বাবার মত ক্ষমতাধর ভাবতে শেখে আর মেয়েরা নিজেদেরকে দূর্বল, পরনির্ভরশীল ও হেয় ভাবতে শেখে। এভাবে পরিবারের ছেলে শিশুরা বাবার কাছ থেকে ওসব আচরণ অনুকরণ করে। পরে দাম্পত্য জীবনে তারাও একই আচরণ করে। এভাবে বংশ পরম্পরায় মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন চলতে থাকে। এভাবে ছোটবেলা থেকে নানা বৈষম্যমূলক পরিবেশে বড় হতে হতে একসময় মেয়েরাও মেনে নেয় যে, তারা পুরুষের চেয়ে কম যোগ্য। তাই সমাজে, পরিবারে তাদের ক্ষমতা, অধিকার, মর্যাদা কম। তাই তারা নিজের শখ, সৃজনশীলতা, ইচ্ছেগুলোকে বিসর্জন দিয়ে “পরিবারের শান্তির জন্য” স্বামীর আজ্ঞাবহ রোবট হয়ে যায়।
– আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়েদের আলাদা রাখা হয়, আলাদা খেলা, আলাদা শোয়া, আলাদা খাবার, আলাদা সুবিধা। আলাদা স্কুল, কলেজ। এমন কি একই স্কুলের ক্লাসেও ছেলে-মেয়ে আলাদা আলাদা বেঞ্চে বসে। ছেলেদের দ্বারা আক্রান্ত হবার ভয়ে বা প্রেমে পড়ার ভয়ে ছেলেমেয়েকে অভিভাবকরা একসাথে রাখেনা। আবার একসাথে রাখেনা বলেই মেয়েদের প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ, লোভ, আগ্রহ সবচেয়ে বেশী। উন্নত দেশগুলোতে ছেলেমেয়েরা একসাথে চলাফেরা, পড়া, কাজ করে, একইরকম পোষাক পরে। তাই ওসব দেশের ছেলেরা মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় না, মেয়েদেরকে অপমান বা নির্যাতন করেনা।
– উন্নত দেশগুলোতে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার সমান। একজন ছেলে যা যা করতে পারবে, একটি মেয়েও তাই। কোন মেয়েকেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা হয়না। জোর করে কোন অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিতও করা হয়না। মেয়েরাও মানুষ। পছন্দ না হলে মেয়েরাও ডিভোর্স করতে পারে, আবার বিয়েও করতে পারে, লিভ টুগেদার করতে পারে, কুমারী মেয়ে মা হতে পারে ইত্যাদি। আমদের সমাজে প্রতি পদে পদে ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক কারণের দোহায় দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে সে মেয়ে। তাই পরিবারে ও সমাজে নারীদের অবস্থান, অধিকার, সুযোগ, যোগ্যতা, ক্ষমতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা ইত্যাদি সব কম। এগুলো কমই থাকবে। কারো বেশী হলে সেটা পুরুষরা সহ্য করতে পারেনা।
– বিদেশে যে কোন ছেলে বা মেয়ে যেকোন কাজ করে নিজের জীবন চালাতে পারে, তাই তারা স্বাধীন। মেয়েরাও সহজে কাজ পেতে পারে, তারাও চাইলে একা থাকতে পারে। নিজের যোগ্যতা থাকলে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই তাদের অত ভাবতে হয়না। আমাদের দেশের নারীদের প্রতি অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণের মূল কারণ হল মেয়েদের আর্থিক স্বাবলম্বীতা না থাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক জরিপমতে, বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ কোনো না-কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। বিবাহিত নারীরা আগের মতোই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। ২০১১ সালে প্রথম জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ চার বছরে নির্যাতনের হার কমেছে ৭ শতাংশ।
তবে বিবাহিত নারীরা আগের মতোই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু অধিকাংশ নারীরাই নির্যাতকের বিরুদ্ধে কাউকে কোনো অভিযোগ করেন না (৭২ দশমিক ৭ শতাংশ)। কেন করেননা, এ প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ৩৯ জনের বেশি নারী বলেছেন, পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে, আরও নির্যাতনের ভয়ে, স্ত্রীকে স্বামীর মারার অধিকার আছে ভেবে অথবা লজ্জায় তাঁরা বিষয়গুলো কাউকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করেননি। কারণ নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে তারা “পরিবারিক বিষয়” বলে মনে করেন।
দেশে নারী সুরক্ষায় কঠোর আইন আছে। আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত রয়েছে। আইনের ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে দশ শতাংশের সাজা হয় না। মামলার তদন্তেও নানা অবহেলা থাকে।
ব্র্যাকের একটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীরা পারিবারিক, সামাজিক ও আইনগত নানা জটিলতার কারণে সহজে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চান না। দেশে পারিবারিক নির্যাতন রোধে সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ না থাকা এবং সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কারণেই পারিবারিক নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, সরকার নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে সহায়তা করার জন্য ১০৯২১ নম্বরের একটি হেল্পলাইন চালু করে ২০১২ সালে। বিবাহিত নারীদের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ এ নম্বরের কথা জানেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারীশিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে এ ধরনের নির্যাতনের সংখ্যা কমতে থাকে এবং দরিদ্র নারীরাই (৬৬%) সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নারী নির্যাতনের অনেক ধরনের মূল্য দিতে হয়। তা সমাজকে আঘাত করে। নির্যাতনের হার দেখে একটি সমাজের অবস্থান বলে দেয়া যায়। নারী নির্যাতনের ফলাফলগুলো হলো; মানুষের দুঃখ, ব্যথা, চাকরিচ্যুত হওয়া, হত্যাসহ নানান কিছু। নির্যাতনের ফলে কিশোরীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা বিশ্বকে মোকাবেলা করতে পারছে না। কর্মক্ষেত্রে অথবা প্রকাশ্য জনসমাগমের স্থানে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। নির্যাতন সব ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। এই ধরনের ক্ষতিগুলো সামাজিক ক্ষতি।
নারীর ওপর নির্যাতনের ফলে নির্যাতনের শিকার নারী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। আর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে পুরো সমাজের ওপর। এক জরিপে দেখা গেছে, নারী নির্যাতনের কারণে বছরে দেশের মোট জিডিপির ২.১৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। নির্যাতনের পর স্বাস্থ্য খরচ, কাজ কামাই করাসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বে ন্যূনতম দেড় লাখ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। এই দেড় লাখ কোটি ডলারের মধ্যে ২ শতাংশও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে সমতা অর্জন করা সম্ভব।
সন্তান লালন-পালনের সময় কন্যা সন্তানের প্রতি যেন কোনরকম বৈষম্যমূলক আচরণ না করেন, সে ব্যাপারে বাবামার মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরি করতে হবে। ছেলেদেরকে ছোটবেলা থেকেই বেশী প্রাধান্য না দিয়ে সমান প্রাধান্য দিতে হবে। মেয়েদের কে মানুষ ভাবতে শেখাতে হবে যাতে সে বড় হয়ে মেয়েদেরকে অপমান, নির্যাতন বা ছোট মনে না করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটিতেই আদালতে বিচার শুরু হতে লাগে দুই বছর। এসব কারণে সহিংসতার শিকার ৯৭ শতাংশ নারী বিচার পান না। এই বিচারহীনতার কারণে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। তাই নারী নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের দ্রুত ও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্বে নারী অধিকার আদায়ে অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। যে নারীরা মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পায়, তাদেরকে এ বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাদেরকে সাহস ও আইনি সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে।
নির্যাতন কমাতে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিবর্তন না হলে নির্যাতন বন্ধ হবে না। কারণ পরিবার মনে করে, নারী নির্যাতন বলে কিছু নেই। পারিবারিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোকে নির্যাতনের ক্ষতিকর দিকগুলো বোঝাতে হবে এবং এ বিষয়ে আইনে যে শাস্তির বিধান আছে সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে তা জানিয়ে তাদের এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত রাখতে হবে।
কিছু নারী এবং পুরুষ নারীর প্রতি সংবেদনশীল হলেও অধিকাংশ মানুষরাই নারীর প্রতি সহিংসতার ইস্যুতে সবসময় নারীর ওপরেই দোষারোপ করতে আগ্রহী। এজন্য নারীর প্রতি আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা প্রয়োজন। নারী নির্যাতনকারীর অধিকাংশই যেহেতু পুরুষ তাই নারী নির্যাতনবিরোধী সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকাণ্ডে পুরুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের কাজ আরো বেগবান হবে।
সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে নারী শিক্ষার হার ও কর্মসংস্থান আরও অনেক বেশি বাড়াতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে একসময় নারী স্বাবলম্বী হবে। আর তখনই কেবল নারী দিবস পালন স্বার্থক হবে।
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..