নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

মৃদুল শ্রীমানী
প্রবন্ধ
Bengali
নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার: নারীজাগৃতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

নবজাগরণের সঙ্গে নারীর জাগরণ, নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা, এবং নারীমুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে এই নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (২২ মে, ১৭৭২ – ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৩)। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ কল্পে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনে আন্দোলন গড়ে তুলে সাফল্য পেয়েছিলেন। ১৮১২ সাল থেকেই সতীদাহ কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন রামমোহন। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশের থেকে প্রবল বিরুদ্ধতার সঙ্গে লড়ছিলেন। সমগ্র ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে ১৮২৮ সালে ক্ষমতায় এলেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, বা লর্ড উইলিয়াম হেনরি ক‍্যাভেন্ডিশ বেন্টিঙ্ক, (১৪.০৯.১৭৭৪ – ১৭.০৬.১৮৩৯)। ক্ষমতায় আসার পরে পরেই তিনি স্বীয় আলোকপ্রাপ্ত অন্তরের গুণে রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন, এবং এক রবিবারের সকাল বেলায় ঘোষণা করেন, আজ আমি উপাসনা করতে চার্চে যাব না, আমার সবচাইতে বড় উপাসনা হোক হিন্দু বিধবাদের সতীদাহ কুপ্রথার হাত থেকে রক্ষা করা। ওই দিনই, ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর তারিখে রেগুলেশন XVII জারি করে সতীদাহ প্রথাকে শুধু বেআইনি ঘোষণা করলেন না, এই কাজে জড়িত থাকাকে ক্রিমিনাল অপরাধ আখ‍্যা দিলেন। কোম্পানি প্রশাসনের ভিতর থেকে কিন্তু বেন্টিঙ্কের বিরোধিতা করা হয়েছিল। উচ্চপদস্থ প্রশাসক চার্লস মেটকাফ সতীদাহের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তকে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, এতে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ ও প্রতিপত্তিশালী হিন্দুরা কোম্পানির বিপক্ষে চলে যাবেন। কিন্তু ভারতের গভর্নর জেনারেল নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বিরোধিতা সবচাইতে বেশি এসেছিল গোঁড়া হিন্দুদের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব ও হিন্দু ধর্মসভার পক্ষ থেকে। এঁরা বলেছিলেন, সতীদাহ প্রথা বন্ধে বেন্টিঙ্কের সিদ্ধান্ত ইংল‍্যাণ্ডের সম্রাট তৃতীয় জর্জের স্ট‍্যাটুট ৩৭কে ক্ষুণ্ন করে। সতীদাহ বিরোধী নতুন রেগুলেশন রুখতে এই গোঁড়াপন্থীরা প্রিভি কাউন্সিলে মামলা পর্যন্ত করেন। সেখানে সাতজন বিচারকের মধ‍্যে চারজন নূতন রেগুলেশনকে সমর্থন করেন।

যে ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিত, প্রতিপত্তিশালী অংশ গোঁড়ামির সক্রিয় সমর্থক, সেখানে রাজশক্তির সাহায্য চাওয়া দরকার ছিল। রামমোহনের দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করল ১৮২৯ এর এই সতের নম্বর রেগুলেশন।

এছাড়াও রামমোহন বহুবিবাহ, বাল‍্যবিবাহ ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল অংশের তীব্র ও তিক্ত বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর আধুনিক মনস্কতার আরেকটি অত‍্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তিনি মেয়েদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের সপক্ষে বলতেন।

রাজা রামমোহন রায়ের পর নবজাগরণের সপক্ষে লড়াই করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর ( ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ – ২৯ জুলাই, ১৮৯১)।

বিদ‍্যাসাগর মহাশয় লক্ষ্য করেছিলেন যে, কৌলীন‍্যপ্রথার জন‍্য অতি অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হচ্ছে। একই কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত অনেক বালিকার। বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত কুলীনের মৃত্যু হলে, সকল বালিকাই একযোগে বিধবা হত ও শ্বশুরবাড়িতে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হত। যেক্ষেত্রে বিধবারা পিতৃগৃহে থাকত, সেখানেও একাদশী ও নানা অজুহাতে নির্জলা উপবাস সহ নানাভাবে দগ্ধে দগ্ধে জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হত তাদের। শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়ির লোকজনই নয়, পিতৃগৃহেও ধর্মীয় আচারের নাম করে এইভাবে অত‍্যাচারিত ও বঞ্চিত হত বিধবারা। সে সময়ে নারীশিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। স্বনির্ভরতার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, ও স্বনির্ভরতাহীন মেয়েরা সহজেই যৌবনোদ্গমের কালে নানা সমস্যায় জর্জরিত হত এবং অনেক সময়ই শ্বশুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের সমাজবিধিবহির্ভূত কামনার শিকার হত।

অবাঞ্ছিত গর্ভ রুখতে গিয়ে, গোপনে অবৈজ্ঞানিক পথে গর্ভপাত করাতে গিয়ে বহু মেয়ের প্রাণহানি হত, বা সারাজীবন ধরে অসুস্থতার বোঝা টানতে হত। বহু মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় যেত হারিয়ে। বাপের বাড়িতেও পা টুকু রাখার জায়গা মিলত না। অপুষ্টি ও অনাহারে, উপবাসে অকালেই যৌবন যেত ঝরে। তখন বৃন্দাবন ইত‍্যাদি তীর্থস্থানে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন কাটত তাদের। ব্রাহ্মণ পরিবার সহ অনেক পরিবারের ভরযুবতী বিধবা মেয়েরা গিয়ে পড়ত যৌনপল্লীতে।

বিদ‍্যাসাগর মহাশয় যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের চোখ দিয়ে বর্ণহিন্দু সমাজের এই গভীর নৈতিক অবক্ষয় ও সংকট লক্ষ্য করেছিলেন, এবং তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীশিক্ষা, বাল‍্যবিবাহ রোধ ও বহুবিবাহ রোধের পাশাপাশি তরুণী ও যুবতী বিধবা নারীর সামাজিক পুনর্বাসন হিসেবে সম্ভাব‍্য ক্ষেত্রে বিবাহের অধিকার থাকা প্রয়োজন।

বলা দরকার, হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল অংশ বিদ‍্যাসাগরের এহেন সংস্কার প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। শেষে, ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই তারিখে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক‍্যানিং এর উদ‍্যোগে বিধবা বিবাহ আইন ১৮৫৬ সালের পনের নম্বর আইন হিসেবে চালু হয়।

বলা দরকার বিধবা বিবাহ আইনের খসড়া প্রস্তুতি পর্যন্ত কাজ এগিয়ে দিয়েছিলেন পূর্বতন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি (১৮১২ – ১৮৬০)। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হবার আশঙ্কা ও প্রশাসনিক কর্তাদের বিরোধিতা, এই জোড়া কাঁটাকে উপেক্ষা করেই লর্ড ডালহৌসি আইনের খসড়া তৈরির কাজ করে গিয়েছেন। অবশ্যই শীর্ষ কর্তৃপক্ষ হিসেবে ডালহৌসি সাহেবের নজরে এসেছিল তরুণ ব‍্যক্তিত্ববান বিদ‍্যাসাগরের লাগাতার সেক‍্যুলার লড়াই। ডালহৌসি শুধু যে তাঁর আন্দোলনের সারবত্তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাই নয়, বিদ‍্যাসাগরের বক্তব্যের দার্ঢ‍্যে যুক্তির প্রাঞ্জলতায় উদ্দেশ্যের মহত্ত্বে ডালহৌসি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি গভর্নর জেনারেল পদে ছিলেন ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সালের প্রথম দিক অবধি। ওই ১৮৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় আসীন হন লর্ড ক‍্যানিং এবং কয়েকটি মাস পরেই ২৬ জুলাই তারিখে বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হিসেবে ঘোষিত হয়। সতীদাহের আইনের সঙ্গে বিধবা বিবাহ আইনের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, সতীদাহ ঘটানো, সতীদাহের সঙ্গে লিপ্ত থাকা, সতীদাহে মদত দেওয়া যেখানে ছিল ফৌজদারি অপরাধ, এবং জেল হাজতের আশঙ্কাপূর্ণ, সেখানে পরবর্তী আইনটি ছিল বাধা অপসারণ। কোনো মতেই অবশ‍্যপালনীয় নয়। কিন্তু দেশের মেয়েদের অভিভাবকদের দল ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আচারভীরু, ধর্মমোহগ্রস্ত। মেয়েরা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত। আর গোঁড়াপন্থীরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদ‍্যাসাগরের কুৎসা রটনায় লেগে পড়েন। বিদ‍্যাসাগর মহাশয় শুধু প্রচার পত্র ছাপিয়ে, বা সংবাদপত্রে লিখে তাঁর কর্তব‍্য শেষ করেন নি। যা ভাল বলে বুঝতেন, তার জন্য তিনি জীবনের সর্বস্ব পণ করেছিলেন। তবে, বিধবা বিবাহ প্রচলনকে নিজের মুখে স্বীয় জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম বললেও, আসলে তাঁর সবচাইতে বড় সৎকর্ম ছিল বেদান্তকে অসার বলে বুঝতে পারা ও নির্ভীক কণ্ঠে প্রকাশ‍্যে তা বলতে পারা।

নারীজাগৃতির প্রশ্নে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ – ২৯ জুন, ১৮৭৩) একজন উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে স্মরণীয়। নারীর আত্মসচেতনতার ক্ষেত্রেও তাঁর কলমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সাহিত্য ও পুরাণকথা আত্মস্থ করে ওজস্বী ভাষায় তিনি মেঘনাদবধ ও বীরাঙ্গনা কাব‍্য লিখেছিলেন। সংস্কৃত সাহিত‍্যে নারী ছিল পুরুষের সম্পূর্ণ অধীন। নারীজীবনের যে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, প্রতিটি মানুষের জীবনের যে মূল্য আছে, তা প্রাচীন ভারতে স্বীকৃত ছিল না। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর শ্রীরাম পাঁচালিতে সীতাকে দিয়ে বলিয়েছেন, সকল সম্পদ মম দুর্বাদলশ‍্যাম। আরো কয়েকধাপ অধঃপতিত করে হিন্দি ভাষার কবি রামচরিতমানসকার তুলসীদাসজি বলেছেন,

“ঢোল গাঁওয়ার শূদ্র পশু নারী

ইয়ে হ‍্যায় সব তাড়নকে অধিকারী। ”

শ্রীরাম মনে করতেন, দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, কিন্তু সহোদর ভাই পাওয়া অত সহজ নয়।

মহাকাব‍্য শ্রীরামকে বহুবিবাহকারী হিসাবে না দেখালেও তাঁর পিতা দশরথের প্রধান রানি ছিলেন তিনজন। অন‍্যান‍্য শয‍্যাসঙ্গিনীর কোনো হিসাব ছিল না। কুরুক্ষেত্রের মাঠে দাঁড়িয়ে যিনি গীতা বলে যাচ্ছেন, সেই পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের

প্রধানা মহিষী ছিলেন পাঁচজন, যথাক্রমে, রুক্মিণী, সত‍্যভামা, জাম্ববতী, লক্ষ্মণা ও সুশীলা। এরপরেও কৃষ্ণের ষোলহাজার গোপিনী স্ত্রী ছিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণের পরেও একে একে সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদা ও উলুপীর সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে জড়াতে অসুবিধা বোধ করেন নি। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সহ প্রত‍্যেক পাণ্ডব বহুবিবাহের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। দ্রৌপদী তাঁদের পাঁচজনের যৌথ ও সাধারণ স্ত্রী হলেও প্রত‍্যেকে আলাদা আলাদা নারীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন। যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী ছিলেন গোবাসনের কন‍্যা দেবিকা। তাঁর গর্ভে যুধিষ্ঠির বৌধেয় নামে পুত্রের জন্ম দেন। ভীমসেনের স্ত্রী ছিলেন কাশীরাজের কন‍্যা বলন্ধরা ও আরও একটি স্ত্রী ছিলেন হিড়িম্বা। বলন্ধরার গর্ভজাত পুত্র ছিলেন সর্বগ। হিড়িম্বার গর্ভজাত পুত্র ঘটোৎকচ। নকুলের স্ত্রী ছিলেন চেদিরাজকন‍্যা করেণুমতী। তাঁর গর্ভজাত পুত্র ছিলেন নিরমিত্র। সহদেব বিবাহ করেছিলেন মদ্ররাজকন‍্যা বিজয়াকে। আর তাঁর গর্ভে সুহোত্র নামে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এছাড়া যদুবংশীয় ভানুমতীকে তিনি বিবাহ করেন। পঞ্চ পাণ্ডবের ঔরসে দ্রৌপদীর প্রতিবিন্ধ‍্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন নামে পাঁচটি পুত্র সন্তান হয়। লক্ষ্য করুন, পুরাণে মহাকাব‍্যে কন‍্যাসন্তানের উল্লেখ দৃষ্টিকটু রকম কম। সুতরাং সনাতনী রুচির হিন্দুদের মনে নারীর অস্তিত্বটাই ছায়ায় আবৃত। এই পরিবেশে নারীর আত্মসচেতনতা ও মর্যাদাবোধের কোনো স্বীকৃতিই ছিল না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিন্তু পৌরাণিক ও মহাকাব‍্যিক উপাদান নিয়ে লিখলেও নারীর ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন।

ভারতে নারীজাগৃতির কথাটা ঠিক ঠিক বলতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৭ জুন ১৮৩৮ – ৮ এপ্রিল ১৮৯৪) এর নাম না করাটা অন‍্যায়। তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গানটি শুধু দেশমাতা নয়, মাতৃত্বের সর্বব্যাপী রূপের বন্দনাগাথা। বহু শতাব্দী ধরে নারীর উপর যে লাঞ্ছনা ও অবমাননা বর্ণহিন্দু সমাজ জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে রেখেছিল, তাকে কিভাবে অতিক্রম করা যায়, ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন‍্যাসে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত তরুণী প্রফুল্লকে ভবানী পাঠক যেভাবে শাস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি ব‍্যায়াম, লাঠিখেলা ইত্যাদি শারীরিক নৈপুণ্যের প্রশিক্ষণের ব‍্যবস্থা করেন, তা কিছুতেই রক্ষণশীল ও সনাতনপন্থী মানুষের মনে উদয় হবে না। সচেতন পাঠকের আরো লক্ষ‍্যণীয় যে, ভবানী পাঠক তার ছাত্রীকে সংযম ও কষ্টসহিষ্ণুতার মাধ‍্যমে আদর্শ নেত্রী ও প্রশাসক করে গড়ে তুলছেন। নারীর সম্ভ্রমবোধ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের লক্ষ্যে ভবানী পাঠকের এই পরিকল্পনা অত‍্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।স্বামী বিবেকানন্দের শিষ‍্যা হিসেবে ভারতে এসেছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল ( ২৮ অক্টোবর ১৮৬৭ – ১৩ অক্টোবর ১৯১১)। তেজস্বিনী এই আইরিশ নারী স্বামী বিবেকানন্দের সাথে পরিচিত হবার আগেই নিজের দেশে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। ভারতে এসে তিনি নারীশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ও নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। গুরুর দেশকে ও জাতিকে তিনি সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে নিজের করেছিলেন এবং কিসে ভারতীয় জাতিসত্তার উন্নতি হবে, সেই লক্ষ্যে তিনি আত্মনিবেদন করেছিলেন। ক্রমে ভগিনী নিবেদিতা সেবা ও আত্মত্যাগের মূর্তপ্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করতেন। ভিতরে আইরিশ স্বাধীনতা চেতনা সজীব ছিল বলেই হয়ত তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতের বিপ্লব প্রচেষ্টার সক্রিয় উৎসাহদাতা ছিলেন।

রাজনৈতিক বিষয়ে এই সক্রিয়তার কারণেই তাঁর গুরুর প্রতিষ্ঠিত সন্ন‍্যাসী সংগঠন থেকে তাঁকে সরে যেতে বলা হলেও, ভগিনী নিবেদিতা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের ব‍্যাপারে আপস করেন নি।

নারীত্বের মর্যাদা বিষয়ে গভীর কথাগুলি সাধারণ মানুষকে হৃদয়ঙ্গম করাতে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮)। তাঁর কলমে সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই দেখতে পাওয়া যায়। জমিদারতন্ত্রের গ্লানিকর দিকগুলির বিষয়েও তিনি কলম ধরেছিলেন। নারীপুরুষের সম্পর্কের মধ‍্যে নারীর তেজোদীপ্ত আত্মসম্ভ্রমপূর্ণ অবস্থানের সঙ্গে আন্তরিক ভালবাসাকে তিনি অনবদ‍্যভাবে মিশ্রিত করেছিলেন।

বাংলার রেনেসাঁসের প্রতি ভূমিকা পালনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি একটা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। এই বাড়ির লোকজন, পুরুষ এবং নারী, বাড়ির সন্তান এবং বিবাহসূত্রে যুক্ত হওয়া বধূরা নারীজাগৃতির নানাপ্রশ্নে, পত্রপত্রিকা সম্পাদনায়, সৃজনশীল সাহিত্য রচনায়, গান ও থিয়েটারের চর্চায় তো বটেই, এমনকি জীবনযাপনের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে নতুন হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েদের বাইরে বেরোনোর উপযোগী আধুনিক পোশাক, পুরুষদের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা, পত্রপত্রিকা সম্পাদনা করা, গান বাজনায় তালিম নেওয়া এবং অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া ইত‍্যাদিতে গোটা বাংলায় ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অগ্রণী ছিলেন। এই বাড়ির দৌহিত্রী সরলা দেবী চৌধুরাণী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ মহলে গিয়ে কাজ করেছেন।

ঠাকুরবাড়ির পরবর্তী প্রজন্মের কাছে খুব বেশি প্রিয় না হলেও, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪ – ১ আগস্ট ১৮৪৬) জীবন উপভোগ ও উদ‍্যমের প্রশ্নে বর্ণময় ব‍্যক্তিত্ব ছিলেন। সেকালের বিত্তশালী ব‍্যক্তিদের মতোই তিনি বাগান বাড়িতে আমোদে প্রমোদে বিলাসে ব‍্যসনে রাত কাটানো পছন্দ করতেন। এইজন্য তাঁর স্ত্রী দিগম্বরী দেবী তাঁকে এড়িয়ে চলতেন ও দেহসংশ্রব করতে দিতেন না। কিন্তু দ্বারকানাথ কখনো স্ত্রীর এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেন নি। দ্বারকানাথ সফল শিল্পপতি ছিলেন এবং নিজের মালিকানাধীন জাহাজে চড়ে বিদেশে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে ইংল্যান্ডের মহারানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কে পৌঁছেছিলেন। অন‍্যান‍্য সম্ভ্রান্ত মহিলাদের প্রতিও তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্পষ্টতই নারীজীবনের প্রতি বিদ্বিষ্ট ও প্রতিকূল হলে নারীদের সঙ্গে এভাবে মেলামেশা দ্বারকানাথের পক্ষে সম্ভব হত না। উত্তরপুরুষের চোখে ততটা শ্রদ্ধা না পেলেও জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে নবজাগরণের ভিত্তি ভূমি তৈরি করতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের অবদান ছিল না, একথা বলা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বালিকাবধূকে বিবাহ করলেও, এবং নিজের তিন তিনটি কন‍্যাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর না করলেও শান্তিনিকেতনের জীবনে নানাভাবে নারীর শারীরিক বিকাশের কাজ তিনি করে গিয়েছেন। তাঁর কলমে বহু সংগ্রামী নারী চরিত্র যেমন গড়ে উঠেছে তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে এখনো মেলা ভার। এইসূত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’য় সংকলিত কয়েকটি কবিতা, ‘মহুয়া’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘সবলা’, ‘পুনশ্চ’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘সাধারণ মেয়ে, ‘শ‍্যামলী’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘বাঁশিওয়ালা’ ও ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

একজন সার্থক কবি সত‍্য ও সুন্দরের পূজারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় সৌন্দর্য ও সত‍্যের সার্থক মেলবন্ধন ঘটেছে। নারীর দেহসৌন্দর্যের সঙ্গে মিশেছে ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার ভাষা।

কড়ি ও কোমল, মানসী, সোনার তরী, চিত্রা এইসব প্রথম যৌবনের কাব‍্যগ্রন্থে নারীর দেহসৌন্দর্যের জয়গান ছিল। ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২৩ অগ্রহায়ণ তারিখে লেখা ‘উর্বশী’ কবিতায় এবং ওই একই বৎসরের ১ মাঘ তারিখে লেখা বিজয়িনী কবিতায় নারীর দেহসৌন্দর্যের বর্ণনা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। এই ১৩০২ বঙ্গাব্দে কবির বয়স চৌত্রিশ বৎসর। এই কবিতা দুটির সূত্রে রসিকজনের মনে পড়বে পাশ্চাত্যের রেনেসাঁস যুগের শিল্পকৃতির কথা। বত্তিচেল্লির ‘বার্থ অফ ভেনাস’ (১৪৮৬), মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ‘স্ট‍্যাচু অফ ডেভিড’ (১৫০৪), গিয়ান লোরেঞ্জো বারনিনির ‘দি রেপ অফ প্রসরপিনা’ (১৬২১-২২) মনে পড়বে। মানসী ও চিত্রার যুগের এই ভাষা অনেকটা বদলে গেল মহুয়ায় পৌঁছে। ততদিনে পেরিয়ে গিয়েছে আরো বত্রিশটা বছর। মহুয়ার সময় চৈত্র ১৩৩৩ থেকে পৌষ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ। এই কাব‍্যগ্রন্থের ‘সাগরিকা’ কবিতায় নারীর দেহসৌন্দর্যের সুকুমার বর্ণনা গিয়ে পৌঁছল অন‍্যমাত্রায়। কবি লিখলেন, ‘ধনুকবাণ নাহি আমার হাতে,…/ এনেছি শুধু বীণা–/ দেখো তো চেয়ে, আমারে তুমি চিনিতে পারো কি না।’ এই কাব‍্যগ্রন্থেই নির্ভয় কবিতায় বললেন, ‘ পঞ্চশরের বেদনা মাধুরী দিয়ে…/ ভাগ‍্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।’ আরো বললেন, ‘ছুটিনি মোহন-মরীচিকা-পিছে-পিছে,/ ভুলাইনি মন সত‍্যেরে করি মিছে।’

এই কথাগুলি লেখার সময় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ৬৭ বৎসর। জীবনের অনেকখানি পেরিয়ে এসেছেন, আরো অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা পার হয়ে চলেছেন। এই মহুয়া কাব্যগ্রন্থের ‘সবলা’ কবিতায় নারীমুক্তির একটা বলিষ্ঠ বক্তব্য রচনা করেছেন তিনি। বিধাতার কাছে স্পষ্ট ভাষায় কৈফিয়ত দাবি করলেন, ‘নারীর আপন ভাগ‍্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?’ বললেন, ‘শুধু শূন্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে / সার্থকের পথ?’ বললেন, ‘কভু তারে দিব না ভুলিতে / মোর দৃপ্ত কঠিনতা।… ফেলে দেব আচ্ছাদন দুর্বল লজ্জার।’ শেষপর্যন্ত বললেন, ‘ হে বিধাতা, আমারে রেখো না বাক‍্যহীনা।’

এই প্রেক্ষিতেই আমরা ‘পলাতকা’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘নিষ্কৃতি’ কবিতার মঞ্জুলিকাকে মনে করব। অল্পবয়সী মেয়ে মঞ্জুলিকার বিয়ে হল মস্ত কুলীন বৃদ্ধ পঞ্চাননের সঙ্গে। মেয়েটির পিতার পুঁথিগত শিক্ষা ও আর্থিক সামর্থ্য যথেষ্ট থাকলে হবে, তিনি ভীষণ গোঁড়া হিন্দু। বিয়ের অল্পদিন পরেই মঞ্জুলিকা বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে এল। মা বিধবা বালিকাকে দেখে কষ্ট পান। বৈধব‍্যের নামে মঞ্জুলিকার উপর নির্জলা উপবাস সহ নানারকম অত‍্যাচার চালাতেন তার বাবা। মায়ের স্পর্ধা ছিল না, ক্ষমতাও ছিল না প্রতিবাদ করার, শুধু বুকভরা কান্না ছিল। মঞ্জুলিকার বিয়ের আগেও মা কান্নাকাটিই করতেন। মঞ্জুলিকাকে ভালবাসত পুলিন। একই পল্লীর চট্টোপাধ্যায়দের বাড়ির উজ্জ্বল মেধাবী সন্তান। মা জানতেন তাঁর মেয়ের সাথে এই ছেলেটি একসাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে। আর ওদের মধ‍্যে ভালবাসাও আছে। মঞ্জুলিকার মা তাঁর স্বামীর কাছে মঞ্জুলিকার সঙ্গে পুলিনের বিয়ে দেবার কথা তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী পুলিনের পৈতৃক পরিবারের কৌলীন‍্যের বিশুদ্ধতায় সন্দিহান ছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর সুচিন্তিত প্রস্তাব এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

মেয়ের বৈধব‍্যের পরেও পুলিনের সঙ্গে তার বিয়ের কথা মঞ্জুলিকার মা ভেবেছিলেন ও স্বামীর কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। মঞ্জুলিকার বাবা বিধবা বিবাহের সেই সময়োচিত সুবিবেচিত প্রস্তাবকে ক্রূর ব‍্যঙ্গ করেছিলেন। মঞ্জুলিকার কল‍্যাণ কামনায় স্ত্রীর প্রতিটি শুভপ্রস্তাবেই বেঁকে বসতেন তার বাবা, যেমন করে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতিরা অবধারিতভাবে সমাজ সংস্কারের প্রতিটি পদক্ষেপকে কঠিন ভাবে বিরোধিতা করে এসেছেন। বলা দরকার, বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধতা পেয়েছিল ১৮৫৬ সালে, জুলাই মাসে। তার ছয় বৎসর আট মাস পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সাতান্ন, তখন তিনি পলাতকার কবিতা লিখেছেন। মঞ্জুলিকার বিধবা বিবাহের প্রস্তাব শুনে তার বাবার এই ক্রূর ব‍্যঙ্গ মনে করিয়ে দেয়, কিভাবে মহাপ্রাণ বিদ‍্যাসাগর মহাশয়কে কঠিন ব‍্যঙ্গ উপহাস কুৎসা এমনকি গালাগালিও সহ‍্য করে প্রগতির সপক্ষে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। বাস্তব ঘটনা হল এই, আইনসিদ্ধতা পাবার পরেও বিধবা বিবাহের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতে বিদ‍্যাসাগর মহাশয় নিজের রক্তবিন্দু নিংড়ে দিয়েছেন। ভদ্রলোকের ছেলেরাও বিধবা বিবাহের নাম করে তাঁর থেকে টাকা আদায় করে তাঁকে পথে বসাতে দ্বিধা করেন নি।

পরিশ্রমী পাঠককে দীর্ঘ কবিতাটি পড়ে নিতে বলব। শেষমেশ মঞ্জুলিকা তার বাবার দ্বিচারিতা দেখে তাঁর ধর্মবাতিকের আসল চেহারাটা বুঝে নিয়ে ওই পুলিনের সঙ্গেই গৃহত্যাগ করল। এর আগে যতবার সে বাবাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছে, পিতৃতান্ত্রিক ব‍্যবস্থাকে মানতে চেয়েছে, ততবারই তাকে নিষ্ঠুর ভাবে প্রতারিত হতে হয়েছে। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।’ বাবা মঞ্জুলিকাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। মঞ্জুলিকা জানত, বাবা তাই করবেন। কিন্তু তখন ভয় পেতে তার লজ্জা করত। এক স্বাধীন, সচেতন, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম মঞ্জুলিকার ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নিষ্কৃতি’ কবিতায়।

এই নির্দিষ্ট কবিতাটি রচনার কোনো তারিখ সঞ্চয়িতাতে নেই। শুধু সূচীপত্রে বলা আছে, ১৩২৫ সালের আশ্বিন কার্তিকে ‘পলাতকা’র প্রথম আবির্ভাব।

‘পুনশ্চ’ কাব‍্যগ্রন্থে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ সাধারণ মেয়ে কবিতাটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতায় জনৈক মালতী নিজের বয়ানে নিজের গল্প বলতে থাকে। মালতী নিজেকে চেনে একটি সাধারণ মেয়ে হিসেবে। তার বয়স ছিল অল্প। কিন্তু সেই অল্প বয়সের অতি সাধারণ মেয়ের শরীরেও এমন কিছু একটা থাকে, যা পুরুষের চোখে জাদুর কাজ করে।

শারীরবিজ্ঞানের ছাত্রেরা জানেন, এই জাদু আসলে হরমোনের চমৎকার। শরীরের নিয়ম মেনেই একটা সময়ে তার উজানস্রোত, আরেক দিনে তার ভাঁটির টান। গুণ নয়, যোগ্যতা নয়, বিশ্বাসের দৃঢ়তা নয়, কবি বার বার করে ‘কাঁচা বয়সের জাদু’ ও ‘অল্প বয়সের মন্ত্র’, এই ধরনের কথার দিকে আমাদের নজর টানেন। জাদু ও মন্ত্রের বিকাশ সমাজ বিবর্তনের একটা স্তরে হয়েছিল। তখনো যুক্তিবিজ্ঞানের বিভায় মানুষ স্নাত হয়নি। তবে, জাদু ও মন্ত্রের প্রতি যার যে বিশ্বাসই থাক, ওই বিশ্বাসের জোরে তা সত‍্য হয়ে উঠতে পারে না। ওই কবিতাতেই কবি আমাদের সচেতন করছেন এই বলে, ‘মন যায় না সত‍্যের খোঁজে/ আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।’

মালতী বেশ জানে, ‘মূল‍্যবানকে পুরো মূল‍্য চুকিয়ে দিই/ এমন ধন নেই আমার হাতে।’ আর বলে, ‘এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে, …../ তারা ফরাসি জর্মান জানে না,/ কাঁদতে জানে।’

মালতী, সাধারণ মেয়েটি, সক্ষমতা ও যোগ‍্যতা দাবি করে সাহিত‍্য সম্রাটের কলমের কাছে। তাঁর কলমের এক আঁচড়ে এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে চেয়েছে, তাও হেঁজিপেঁজি বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, একেবারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর বিষয়টা শুনুন, সে হল গণিত।

আর তার পরেও মালতীর স্বপ্ন থামে না। দুনে চৌদুনে লাফিয়ে চলতে থাকে। কিন্তু জানে, বাস্তবে ওটা হয় না। খোদ বিধাতাও নিয়মবিধি লঙ্ঘন করে কিছু করে দিতে পারেন না। অভিমান করে মালতী সাহিত‍্যিককে বলে, ‘খাটো কোরো না তোমার কল্পনা—/ তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।’

মালতী জেনেছে, সামান্য মেয়ের জীবন আসলে বিধাতার শক্তির অপব‍্যয়। বিধাতা যে সুবিচারক নন, এমনকি বেশ ভালরকম একপেশে তাঁর দৃষ্টি, এমন কথা বারবার চলে আসে প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২ আষাঢ় তারিখে লেখা ‘শ‍্যামলী’ কাব‍্যগ্রন্থের ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতায় বাংলাদেশের আরেকটি মেয়ের ছবি আঁকেন রবীন্দ্রনাথ। এ মেয়ের নাম দেবার আর প্রয়োজন বোধ করেন নি কবি। সে মেয়ের ক্ষোভ, ‘সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেননি/ আমাকে মানুষ করছ গড়তে…./ মিল হয়নি ব‍্যথায় আর বুদ্ধিতে,/ মিল হয়নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়।’ সে মেয়ে জানে তাকে ডানা দেয়নি বিধাতা তার ইচ্ছার জোর নেই। নিষেধের পাহারা কাত করে ফেলার বুকের পাটা নেই। সে মেয়ে বলছে, ‘কঠিন করে জানিনে ভালবাসতে/ কাঁদতে শুধু জানি,/ জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।’ কিন্তু এই ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতায় সে মেয়ে আরো বলেছে, সে স্বপ্নে পেয়েছে কবির গান, বাঁশিওয়ালার বাঁশি তাকে ডাক দেয় অমর্তলোকে। কবির ডাক শুনে একদিন ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল, সে তখন ঘোমটাখসা নারী। এক বিদ্রোহিণীর ছবি আঁকতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ এই ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতায়।

তার সপ্তাহটাক পরেই ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতায় তেমন মেয়ের ছবিই আঁকলেন তিনি। সে মেয়ের দোলনচাঁপার মতো চিকন গৌর মুখ। যাকে কবি আগে বারবার দেখেছেন, সে আজ কালো রেশমি কাপড়ে কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে।

‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার মেয়েটি আর কারো খেলনা নয়, সে তার নিজের জগতের খোঁজ খানিকটা পেয়ে গিয়েছে, তাই বুঝিয়ে দেয় যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে। কি আশ্চর্য অনায়াসে মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী এক মেয়ের ছবি গড়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..