নারীর মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন

সোহেল দ্বিরেফ
নারী
Bengali
নারীর মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন

নারী দিবসের কথাটি আলোচনায় এলেই ঘুরেফিরে ১৮৫৭ সালে ঘটে যাওয়া দিনটির কথা বারবার সামনে চলে আসে। ৮ ই মার্চ নারী দিবসটি এমনি এমনি আসেনি। এটার জন্যে বহু নারী শ্রমিক রাজপথে রক্ত ঢেলেছে! আমরা দেখেছি, বড় বড় যুগান্তকারী আন্দোলনের উর্বর ভূমি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অন্য দেশগুলো থেকে আলাদা। তারা যেমন ১৮৮৬ সালের ১’লা মে শ্রমিকদের অধিকার আদায় করতে একসাথে রাস্তায় নেমেছিল ঠিক তেমনি নারীদের ক্ষেত্রেও ন্যায্য অধিকার, মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল।

নারী অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে আন্দোলনের সূত্রপাত হিসেবে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরাই সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিল। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এলে সরকারি পুলিশ বাহিনী তাদের উপর চড়াও হয়ে বেধড়ক মারধর করতে থাকে। তখন সরকার ভেবেছিল, একটু দমন নিপীড়ন চালালেই বিপ্লবী জনতাকে থামিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তাদের উপর সরকার যতই চড়াও হয়েছে শ্রমিকরা ততই স্ফূলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠেছে। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আশপাশের রাষ্ট্রের নারী শ্রমিক নেতারাও! বিষয়টি আস্তে আস্তে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখন তার চড়াও সুর কিছুটা হলেও নরম হতে থাকে! কিন্তু এর পেছনেও ছিল সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য।

ঘটনার পরিক্রমায় এই আন্দোলনে পুরোপুরী সফলতা অর্জন না হলেও নারীরা আন্দোলনটি চালিয়ে যায় আরও অর্ধশত বছর! তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনটি আরও বেগবান করতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যায় বিক্ষিপ্তভাবে। ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় দিতে নারী শ্রমিকদের প্রতি নির্যাতন দিনে দিনে আরও বাড়তে থাকে। তখন শাসকশ্রেণি বা শিল্পপতিসহ সবাই মনে করত, চাবি যেহেতু আমাদের হাতে তাই ওদের ভাগ্য নির্ধারণ সহ সবকিছুই আমরা ঠিক করব। নারী পুরুষের বিভক্তিটা মূলত তাদের হাতেই তৈরি! পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের সংখ্যাও ছিল প্রায় সমান তবুও সুযোগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে মেয়েদের অবদানকে ছোট করে দেখা হতো। কখনো কাজের অবদানকে হাইলাইটস করতে গেলেও পুরুষদের ব্যাপারটা সামনে আসতো কিন্তু নারীদের অবদানটা সচেতনভাবেই চাপা রাখা হতো।

পরবর্তীতে যান্ত্রিক সভ্যতার আশীর্বাদে কম সময়ে অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন সম্ভব হতো। শ্রমিকেরা আগে যে ১২ ঘন্টা কাজ করতো সেটাও বহাল রাখলো, কেউ কাজ করতে না চাইলে তাকে বাধ্য করা হতো। তাহলে দেখা যায় পণ্য উৎপাদন ঠিকই বাড়ছে কিন্তু সেতুলনায় মালিকপক্ষ মজুরির ন্যূনতম অংশও বাড়াতে চায় না। এজন্য কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা করার দাবিতে আবারো জোর আন্দোলনে শ্রমিকরা রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

নারী শ্রমিকদের উপর শত বাঁধা আসলেও তাঁরা থেমে যায়নি। নিজেদেরকে আরও সুসংগঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ভেতরে ভেতরে। এই বৈষম্য যে শুধু নিউইয়র্কে ছিল এমনটা নয়, এটা সংক্রমণের মতো পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিল কিন্তু কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি! অবশেষে এই প্রথা পরিবর্তনের জন্য নারী শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন, জার্মানির সমাজতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক কর্মী ক্লারা জেটকিন। তিনি জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির একজন অন্যতম স্থপতি। তার আহবানে বৃহদাকারে ১৯০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নারীদের ব্যাপকভাবে সাড়া মেলে! এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ৮ ই মার্চ ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে নারীদের ২য় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়! সেই সম্মেলনে ১৭ টি দেশের প্রায় ১০০ জন নারীনেত্রী অংশগ্রহণ করেন। তাদের জোর দাবি ছিল, ৮ ই মার্চকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। এবং সেটা বিশ্বব্যাপী হতে হবে। তিলে তিলে গড়া তাদের সেই আন্দোলন বৃথা যায়নি! একসময় সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের সকল দেশে এই দিবসটি পালন করতে থাকে।

মূলত সরকারিভাবে নারী দিবসের ঘোষণা আসে ১৯১৪ সালের ৮ ই মার্চ এ। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবসের ঘোষণা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৮ ই মার্চ। বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকেনি এক্ষেত্রে, ১৯৭১ সাল থেকে এই ৮ ই মার্চ দিনটি গুরুত্বের সাথেই পালন করে আসছে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের আরও অনেক দেশ এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবেও ঘোষণা করে থাকে।

ভালো লাগার বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে প্রতিটি কাজে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। তাঁরা এখন কোনকিছুতেই আর পিছিয়ে নেই। তারাও পুরুষের পাশাপাশি থেকে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছেন নিজ নিজ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শিল্প কারখানা, কৃষি, উদ্ভাবনী মূলক কাজে, শিক্ষা, অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোনখানে এখন নারীরা পিছিয়ে? কোথাও না! প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা তাদের যোগ্যতার সাক্ষর রেখে চলেছে নিয়মিত! যেকোনো দেশকে আরো এগিয়ে নিতে হলে তাদেরকে সঙ্গী করেই এগোতে হবে। তাদেরকে ব্যতিরেকে কখনোই সর্বোচ্চ্য উন্নয়ন সম্ভব নয়! শ্রমবাজারেও নারীদের জয়জয়কার চলছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, নারীদের একটা বিরাট অংশ পোশাক শিল্প, চা শিল্প, চামড়া শিল্পে কাজ করে নিজেদের সাবলম্বী করার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। নারীরা যে পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয় সেটা তাঁরা তাদের কর্মের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে!

তাদের এই অগ্রযাত্রা যেন কখনো পিছিয়ে না পড়ে সেটা সচেতন মহলকেও নজরে রাখতে হবে। তাছাড়া শ্রমিক-মালিকের মধ্যে যে অদৃশ্য বিরোধ আছে সেটাও পরস্পরের সহযোগিতার মাধ্যমে নিরসনের পথ খুঁজতে হবে। নারীকে বা নারীর কোন কাজকে ছোট করে দেখার আর কোন সুযোগ নেই! পরস্পরের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখলে উভয় পক্ষের সম্মান বাড়ে! মাঝেমধ্যে নারীনেত্রীদের নিয়ে সেমিনার করে তাদের চাওয়া পাওয়া গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে। একটি সুস্থ ও সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করতে সবার অংশগ্রহণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তাদের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। রাতারাতি হয়তো আমুল পরিবর্তন সম্ভব নয় কিন্তু যেটা হতে শুরু হয়েছে তাতে ভালোকিছুর আভাস পাওয়া যায়।

একটা কথা না বললেই নয়, নারী দিবসকে আরও অর্থববহ করতে দেশের প্রতিটি নাগরিককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এই সমাজ যেন নারীকে শুধু পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার সাহস না পায় সেটা নজরে রাখতে হবে। তাছাড়া নারী অধিকার বলতে যেন সেটা শুধু শ্রমশক্তি ও পারিশ্রমীকের সুষম বণ্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনের সকল অধিকার যেন নিশ্চিত হয়। অন্যান্য বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে আমাদের দেশও প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমন কোন দিন নেই যে পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণ, অপহরণ বা নারীকে অবৈধকাজে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য করা সহ নানা খারাপ সংবাদ চোখে পড়ে না! যা খুবই উদ্বেগজনক! এসব ঘটনা মোকাবিলা করতে শুধু মুখে মুখে না বলে সবাইকে নিজ নিজ জায়গায় সজাগ থাকতে হবে। তা-না হলে বছর ঘুরে বছর আসবে, ৮ ই মার্চ ঠিকই পালন হবে কিন্তু এই সমাজ ঐ ধর্ষণ, অপহরণ, বৈষম্যতা থেকে কখনো মুক্তি পাবে না এবং নারী অধিকারও প্রতিষ্ঠা হবে না!

সোহেল দ্বিরেফ। কবি ও শিক্ষার্থী। জন্ম বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জে। লেখাপড়া করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত বই: 'অমীমাংসিত দিনগুলি' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৯)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

সাবিনা স্পিয়েলরিন: বাংলা সাহিত্যে জিঘাংসা ও জিজীবিষার নতুন পাঠ

সাবিনা স্পিয়েলরিন: বাংলা সাহিত্যে জিঘাংসা ও জিজীবিষার নতুন পাঠ

বিধবা রতিমন্জরী বুঝেছিল যে স্বামীবিয়োগজনিত দুর্নীতির পরিণাম পুরোটাই তার ওপর বর্তাবে। তার চাইতেও কঠিন হল,…..