নারীর শিক্ষা অর্জন করা জরুরি

রওশন হক
নারী, প্রবন্ধ
Bengali
নারীর শিক্ষা অর্জন করা জরুরি

নারীর কোন বিষয়ে লিখবো? নারী অধিকার, নারীর সম্মান, নারী শিক্ষা, নাকী নারীর আধুনিকায়ন? গ্লোবালাইশনের যুগে নারীর বাঁধা বিপত্তি নিয়ে মাথা গোলমেলে ঠেকছে। সব কিছুকে ছাপিয়ে মাথা শুধু নারী নির্যাতনের দিকে চলে যাচ্ছে। যেখানে ছয় মাসের শিশু থেকে একশো বছরের বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা। ধর্ষণ এক মহামারী রোগের নাম। যার কোন ওষুধ আবিষ্কার হয় নি। ধর্ষণকারীর পরিচয় নিজের বাবা থেকে শুরু করে সবাই। ধর্ষকের যেমন আলাদা পরিচয় হয় না, তেমনি ধর্ষণের জন্য কোন বয়সের বাছ-বিচার থাকে না।

আমাদের দেশে নারীদের যৌন হয়রানি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অনেকেই আওয়াজ তোলেন, যৌন হয়রানির মত ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়েদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মেয়েদের খোলামেলা পোশাকের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে কেউ কেউ আওয়াজ তোলেন। আজকাল মেয়েরা শুধু পশ্চিমাদের মননে অনুসরণই করেন না, তাদের মতো পোশাকও পরেন, তাই চারদিকে শুধু ধর্ষণের মহামারী আকার ধারণ করেছে। মোদ্দাকথা হলো, নারী এখনো একদলা মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ স্বরূপ অধূনা দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘মিটু’ শব্দ দেশ, কাল, সময়ের গণ্ডী পেড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে শব্দের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন পুরো পুরুষসমাজ। এই ‘মিটু’ দিয়ে জীবনের অনেক গোপন সত্য উদ্ঘাটন আমাদের সাহসী করে তোলে।

আমার মনে হয় ‘মিটু’ নিঃসন্দেহে আসলে সেই ১৯৯৭ সালে সমাজকর্মী টারানা বার্ক যখন ১৩ বছরের এক কিশোরীর মুখে তার ওপর যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন, তখনই তাঁর বুকের ভিতর জন্ম নিয়েছিল ‘মিটু’।

পরে যৌন হিংসার বিরুদ্ধে বার্ক তাঁর প্রচার আন্দোলনের নামও রাখেন ‘মিটু’, অর্থাৎ ‘আমিও’ যৌন হেনস্তার শিকার। প্রতিবাদ হচ্ছে প্রতিবাদ হবে। বিচারও হবে। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় কী?

বলা হয় নারী স্বাধীনতা এসবকিছু থেকে মুক্তি দিতে পারে। স্বাধীনতার কথায় আসলে বলতে হয় ইউরোপের শিল্প বিপ্লব সমাজ সংস্থায় পূর্ণ মাত্রার পরিবর্তন এনেছিল। শিল্প বিপ্লব সমাজকে নবতর ভিত্তিতে গড়ে তুলতে শুরু সহায়তা করেছে। শিল্প বিপ্লবোত্তর কালে নারী যখন সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় শ্রম করতে শুরু করেছিল, তখন নারী সমাজের মনে বিরাট বিপ্লব সূচিত হয় এবং তাদের জীবন যাত্রায় আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়। নারী অর্থ উপার্জন করতে শেখে। স্বোপার্জিত অর্থ সম্পদের তারা হল মালিক। সমাজ সমষ্টির সাথে তাদের কার্যক্রমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

নারীরা এখন আর কোন ক্ষেত্রেই নিজদেরকে অস্তিত্বহীন এবং দুর্বল মনে করে না। তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পুরোপুরিভাবে বিকশিত ও অনস্বীকার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে সমাজজীবনের সকল স্তরে নারীদের বিচরণ তাদেরকে অপরাধ জগতের সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করেছে। বর্তমান সময়ে নারী অপরাধ সংঘটনের নেত্রী পাপিয়ার অপরাধ নারীসমাজকে নতুন করে ভাবনায় খোরাক জুগিয়েছে।

আজকে মাথায় বার বার একটা প্রশ্ন আসছে, পুরুষদের কাছে জানতে ইচ্ছে করছে, কয়জন পুরুষ আছেন যারা জি-পয়েন্ট চেনেন। নিশ্চয়ই মাথায় হাত পড়েছে এটা আবার কি জিনিস! যারা জানেন তারা হয়তো বলবেন এটা আবার লেখার বিষয় নাকী! এক ইউটিউব ভিডিও দেখলাম যেখানে ছেলেদের সেক্স পাওয়ার বাড়ানো এডভার্টাইজিং-এর জন্য ম্যানহাটনের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ছেলেদের প্রশ্ন করছে জি পয়েন্ট কী? একটা পুরুষও পাওয়া গেলনা যে সে এ বিষয়ে জানে বা শুনেছে। কেউ কেউ বলেছেন জানেন, তবে তিনি তার স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ড-এর মাঝে খুঁজে পান নি। না জানা বিষয়টা যদিও হাস্যকর তবে এই যে যিনি জানেন তবে খুঁজে পান নি, তার বিষয়টা আরো জটিল করে দেখানো হয়েছে। কোন পুরুষকে সেক্স কীভাবে করতে হয় শেখাতে হয় না। পুরুষের কথা না জগতের সকল প্রাণীকুল এ বিষয়ে জানেন। তবে মানুষ হিসেবে মেয়েদেরও পুরুষের মত সেক্স করে সুখী হবার অধিকার আছে তা কয়জন পুরুষ আছেন যারা তার সঙ্গীকে সেই সর্ব সুখটা দেন? আছেন যারা তাদের সংখ্যা খুবই কম। পুরুষেরা এই জি পয়েন্ট চেনে না বলেই আধুনিক বিজ্ঞান মেয়েদের জন্য সেক্স করার ইন্সট্রুমেন্ট তৈরি করে। মেয়েদের শরীরে এমনকিছু জায়গা আছে যেখানে স্পর্শ করলে মেয়েরা অনেক বেশি ‘টার্ন অন’ হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ছেলেরা সেইসব অংশের দিকে নজর দেয় না। ফোরপ্লে সীমাবদ্ধ থাকে ব্রেস্ট, নিপলস আর কিসের মধ্যেই। তারপরেই ইন্টারকোর্স। আমি যদি নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে বলি তাহলে কেন তা বিছানা থেকে নয়?

নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মানবাধিকারের সব বিষয়গুলোই নারীঅধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অধিকন্তু নারীদের জন্য আছে আরো কিছু অধিকার যা একান্তভাবে নারীকে তার নিজস্ব মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায়। পরিবারে একজন নারীকে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পারিবারিক অঙ্গনে নারীকে সকল সময়ই অনেক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। বিশেষত, তিনি যদি বধূ হয়ে থাকেন তবে তার মানসিক চাপের মাত্রাটা থাকে অনেক বেশী। পরিবারে পান থেকে চুন খসলেই তাকে নানান গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তবে কন্যা, বোন এমনকী বর্তমান সমাজে মাকেও প্রচুর মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

মানসিক নির্যাতন ছাড়াও বহু নারীকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্বামীর হাতে তো বটেই এমনকী পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের হাতেও নারীকে অত্যাচারিত হতে হয়। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক নারীকে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়তে হয়।

পারিবারিক পরিবেশে নারীকে চরম লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পরিবারের সমস্ত ভাল জিনিস পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা প্রভৃতির অধিকার কেবল পুরুষেরই থাকে। নারী হয়ে থাকে অবহেলিত।

চাকরিক্ষেত্রে গিয়েও নারী বৈষম্যের শিকার হয় চরমভাবে। ভাল পদগুলো থাকে পুরুষদের দখলে। কর্মক্ষেত্রে নারী মূলত কাজের যন্ত্রের পাশাপাশি পুরুষের দৃষ্টির মনোরঞ্জনের পাত্রে পরিণত হয়, অনেকক্ষেত্রে পরিণত হয় ভোগের পণ্যে।

বতর্মানে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, নারীরা অনেকে পেশাজীবীও হচ্ছেন, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। অনেক অভিভাবক এখনো কেবল মেয়ের ‘ভালো বিয়ে’ দিতে তাকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলা দরকার বলে মনে করেন; এই মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। কেবল বিয়ের কথা না ভেবে মেয়েকে সমাজে স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে, স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তোলার জন্য উচ্চশিক্ষিত করে তোলার কথা অভিভাবকদের গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে নারী যদি নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে। পড়াশুনা করে সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। উপার্জন ক্ষমতাই পারে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

রওশন হক। লেখক ও সাংবাদিক। রওশন হকের জন্ম জন্ম হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রামে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম থেকে এমবিএ করেছেন ব্যবসায়ী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক করেছেন নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..