নারী তোমার অনেক দোষ

আজমত রানা
নারী, মুক্তগদ্য
Bengali
নারী তোমার অনেক দোষ

নারী তোমার অনেক দোষ।

কতটা দোষ?

কত বড় দোষ?

দোষ মাপার কোন যন্ত্র আছে কি?

থাক বা না থাক নারী যখন দোষ করে তখন সেটা মাপার দরকার নেই এমনিতেই বলে দেয়া যায় “ওটা অনেক বড় দোষ”।

নারীর দোষ কোথা থেকে শুরু হয়,  শৈশবে? কৈশরে? যৌবনে?

আরে না, এর বহু বহু আগে থেকেই নারীর দোষের শুরু। রক্তমাখা পিচ্ছিল শরীরটা যখন আপনজনদের উষ্ণ আলিঙ্গনের অপেক্ষা করছে তখন আতুর ঘরের সবগুলো চোখ লিঙ্গ নিশ্চিত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যারা বাইরে অপেক্ষা করছে তারাও অস্থির হয়ে ওঠে “ কি হয়েছে ”? উত্তরটা যদি হয় “মেয়ে” দোষের শুরু সেখান থেকেই। মেয়ে হয়ে জন্মালো কেন এটাই তার অপরাধ। মেয়ে হয়েছে শোনার পর অনেক পরিবারেই মুরুব্বীদের মুখটা আন্ধার হয়ে যায়। এমন মানুষকেও দেখেছি যিনি মেয়ে হয়েছে শুনে সপ্তাহ খানেক ঘরেই ঢোকেননি।আবার অনেককেই দেখেছি প্রথমটা মেয়ে হয়েছে জানার পর মন খারাপ করলেও মেনে নিয়ে এর পরেরটা যেন ছেলে হয় সে সতর্কতা জারি করেছেন। আবার একদল আছে যারা একে একে চারটা মেয়ে হওয়ার পরেও পঞ্চমবার বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করছেন এবং বলা বাহুল্য যে তাবিজ কবজ ফকির কবিরাজকে আব্বা ডাকাও শুরু করে দেন।চারটা মেয়েও তার সন্তান আকাঙ্খা মেটাতে পারেনি অর্থাৎ মেয়েগুলো তার সন্তান নয় সন্তান হলো ছেলে। যে নারী মেয়েগুলো জন্ম দিয়েছে সে বিরাট দোষ করে ফেলেছে। এ দোষের কারণে খোটা শুনতে হয় এর ওর কাছে, স্বামীর কাছেও।

নারী তুমি চলবে ফিরবে কীভাবে,খাবে কীভাবে,গোসল করবে কীভাবে,কাপড় পরবে কীভাবে,কথা বলবে কীভাবে,কথা শুনবে কীভাবে, কাজ করবে কীভাবে তার সব কিছুই নিয়ম করা আছে। এ তো নিয়ম নয় আইন। পুরুষের বানানো আইন। এ আইন অলঙ্ঘনীয়। তোমার চারপাশে এ আইনের লক্ষণ রেখা টেনে দেয়া আছে, সেটা তুমি চাইলেই ডিঙ্গাতে পারবেনা।যদি সে আইন ভাঙ্গার চেষ্টা কর ভুলেও তবে সেটা তোমার মারাত্মক এক দোষ বলে বিবেচিত হবে।তোমার বিচার হবে,তুমি শাস্তি পাবেই।

পুরুষের মতো তোমারও দুটো পা আছে অথচ চাইলেই তুমি পুরুষের মত সে পা বাড়াতে পারোনা। যেখানে ইচ্ছে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাবান শুধু পুরুষের পা দুটো। খালি পায়ের কথা বলি কেন;পুরুষের মতো তোমার হাত আছে। সে হাত তুমি কখনই কোন পুরুষের ওপর ওঠাতে পারবেনা। পুরুষের হাত ওপর উঠবে বলেই তৈরি হয়েছে। তোমার মাথায় চুল আছে পুরুষেরও আছে। পুরুষ চাইলে তোমার মতো লম্বা করে রাখতে পারে আবার নেড়ে করেও রাখতে পারে। নারী তুমি চাইলেই পুরুষের মতো করে ছোট করে চুল কাটাতে পারবেনা। তোমারটা বড় করে রাখতেই হবে। সময় অসময়ে ওটা টেনে ধরে তোমার পিঠে দু ঘা বসাতে পারে পুরুষ।

নারী তুমি কেন লেখাপড়া করবে? পড়তে চাইলেই দোষ হবে। তুমি পড়তে চাইবে বলেই কত কত ফতোয়া তৈরি হয়েছে।তুমি পড়তে চাও বলেই তো পাকিস্তানে মালালার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে। তোমাকে থামাবে বলেই স্কুল যাওয়ার পথে তোমাকে ধর্ষণ করা হয়। তোমাকে বাড়িতে ফেরত পাঠাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠি-বড় ভাই কিংবা শিক্ষক ধর্ষণ করে, যৌন হয়রানি করে। এইতো কদিন আগেই সফি হুজুর তোমার বাবাকে ওয়াদা করালো “মেয়েকে স্কুলে পাঠাবোনা” বলে।

তুমি পড়তে কেন চাইবে? পড়লেই তো জানবে আর জানলেই যত অঘটন ঘটবে। জানলে তুমি কথা বলবে,জানলে তুমি আইনের দরজা পর্যন্ত যাবে সেটা কি পুরুষের জন্য অমর্যাদাকর হবেনা? তারচে সেই ভালো তুমি হয় লেখাপড়া করবেনা অথবা করলেও চার/পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত।তুমি প্রতিদিন ম্যাসিন হয়ে থাকবে স্বামীর সাথে সহবত করার জন্য। তোমার আবেগ থাকবেনা অনুভূতি থাকবেনা। তোমার কোন যন্ত্রনা হবেনা। তুমি চোখ খোলা রেখে মুখটা হাসি হাসি রাখবে যেন তার অত্যচারের এ আলিঙ্গন তুমি উপভোগ করছো।

কোথায় যাবে নারী তুমি?

কাজ করে খাবে?

আরে সেখানেতো তুমি আরো বেশি বৈষম্যের শিকার। একই কাজ করে আমরা পুরুষেরা যেখানে মজুরি পাই চারশ টাকা,তোমরা পাও মাত্র তিনশ টাকা। তোমার দোষেই তুমি একশ টাকা কম পাও। এ তো গেল একটা এর পর রয়েছে মালিক মহাজন কর্মকর্তা অথবা তোমার সাথে যে পুরুষটা কাজ করছে তার পৈশাচিক লোভাতুর চোখ,হাত,দাঁত এবং শিষœ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এক যুদ্ধ। এতকিছুর পরেও বেলা শেষে তোমারই দোষ গুনতে বসে সবাই। তুমি নারী সেটাই দোষ।

নারী তমি কি খুব ক্লান্ত? ঘুমিয়ে পড়ছো?

ওঠো, মালিক মহাজন কর্মকর্তা সহকর্মীর সামনে যাও। একজন পুরুষের সামনে যাও,চিৎকার করে বল “আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি”। আমার কোন অপরাধ থাকলে সেটাই বড় অপরাধ। তোমাকে পুরুষ করে জন্ম দিয়েছি বলেই তুমি তোমার মায়ের দোষ খোঁজ। নারী তুমি না জাগলে নাকের নোলক,হাতের চুড়ি,পায়ের বেড়ি লাগিয়ে শেকলে বাধবে তোমায়। তুমি সন্তান এবং শষ্য উৎপাদন করবে। তোমার ইচ্ছেকে বলি দিয়ে তুমি বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে প্রতিদিন আকন্ঠ সাদা বিষ পান করে নিজেই বিষাক্ত হয়ে উঠবে। তোমার মুক্তি তোমার হাতেই,ভেবে দেখ জাগবে? না কি এখনও ঘুমোবে। তুমি যতক্ষণ ঘুমোবে রাতের দৈর্ঘ্য ততক্ষণ বাড়বে।

আজমত রানা। লেখক ও সাংবাদিক। নিম্নবিত্ত ঘরে জন্ম বলে জন্মের সঠিক দিন তারিখটা তাঁর জানা নেই। লেখাপড়াটাও এগোয়নি ইচ্ছের কমতি আর অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারে উত্তরের প্রান্ত শহর ঠাকুরগাঁওয়ে শ্রমিক বাবার ঘরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বয়স আঠার হতেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ