নারী দিবস

কাজরী মজুমদার
গল্প, নারী
Bengali
নারী দিবস

সবার জন্য সুখবর আছে!

বরুণ-কি সুখবর? তোর জন্য আগ্রার পাগলা গারদে সিট বুক হয়েছে?

মিঠি-ইয়ার্কি মারিস না!খবর শুনে পাগলা হয়ে যাবি

মালা-শিগগির বল

মিঠি-আমার বাবার একটা টেন্ডার পাশ হয়েছে

বরুণ-তো!

মিঠি-তো আর কি! বাবা হেব্বি খুশি,পকেটে প্রচুর মাল ঢুকবে।ব্যাস আমায় আর পায় কে।বাবার কাছে টাকা চেয়ে বসলাম

মালা-বাবা দিলো তোকে?

মিঠি-দেবে না আবার?দশ চেয়েছি

বরুণ-দশ হাজার?ওরে গুরু,তুই তো লম্বা হাত মেরেছিস

মালা-তুই দশ চাইলি আর তোর বাবা দিয়েও দিলো?

মিঠি-আরে চাওয়ার মতো করে চাইতে হয়েছে।বাবাকে বুঝতেই দি নি যে আমি জানি বাবার পকেট গরম।কাচুমাচু মুখ করে চাইলাম

মালা-কিন্তু কি বলে চাইলি?এখন তো তোর জন্মদিনও নেই!

মিঠি-ওটাই তো ট্রিক্স,বললাম বাবা,সামনে ওমেন্স ডে।নারী হিসেবে আমরা কি সেই দিন একটু সেলিব্রেট করতে পারি না? বাবা খুশি মনে দুহাজার টাকা দিচ্ছিল।আমি বললাম আমি এত স্বার্থপর নই যে শুধু নিজে আনন্দ করবো।পুরো ক্লাসের সব মেয়েরা মিলে ওমেন্স ডে পালন করবো।বাবা জিজ্ঞেস করলো,কত লাগবে? বললাম হিসাব মতো  পনেরোর কাছে লাগবে।বাবা বললো পুরো কলেজের মেয়েরা থাকবে নাকি? বললাম না,ছাড়ো এতো টাকা দিতে হবে না,তুমি দশ দিলেই হবে।ব্যাস আর কি!বাবা ভাবলো কমের ওপর চালিয়ে দিচ্ছে আর আমিও খুশি

বরুণ-যাক গে! ভালোই হলো,আমাদের পার্টিটা তাহলে খুব ভালো হবে

মিঠি-ঐ শিউলি! তোর আবার কি হলো?

শিউলি-শুনছি সব

মিঠি-তুই সব সময় সন্ধ্যারানীর মতো মুখ করে বসে থাকিস কেন বল তো?

সন্ধ্যা রানী…..না!ইনি বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত দুঃখী অভিনেত্রী নন।এন্ড্রুজ কলেজের বি.এ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী শিউলিকে, মিঠি সন্ধ্যারানী বলে ডাকতো।আসলে মিঠি,বরুণ,মালা,সৈকত ওরা গ্রূপে যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে থাকতো,শিউলি সবার তুলনায় একটু গরীব বলে,সব সময় নিজেকে খুব গুঁটিয়ে রাখতো।সবার মধ্যে শিউলিকে মিঠি সব থেকে বেশি ভালোবাসতো।সবার মধ্যে মিঠির বাড়ির অবস্থা সব থেকে ভালো ছিল। এখন সবার মধ্যে চলছে ওমেন্স ডের প্ল্যানিং……

মিঠি-বলবি তো তোর কি হয়েছে?

শিউলি-ভাবছি তুই এতগুলো টাকা কত অনায়াসে পেয়ে গেলি,তা আবার ওমেন্স ডে-র জন্য।আমি তো তার এক ভাগ পেলেও কতো কিছু করতাম

মিঠি-কি করতি শুনি?

শিউলি-দূর ছাড়!

মিঠি-দুঃখিত!ছাড়তে পারছি না ,বল!ধর এই দশ হাজার টাকা তুই পেলি, তুই কি করবি?

শিউলি-কি করবো তা জানি না।তবে গতবছর এই

ওমেন্স ডে তে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।গত বছর আমি ওমেন্স ডে -র দিন দেশের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম।তোরা তো জানিস আমার দেশের বাড়ি সুন্দরবনের ওদিকে।আমাদের কিছুটা নৌকো করে যেতে আসতে হয়।নৌকায় আমার পাশে এক মহিলা বসে ছিল।আমি তার একটা ছবি তুলে,তাকে ওমেন্স ডে-র উইশ করলাম।খুব বিরক্তি মুখ করে আমায় বললো….

-কি হয়েছে? কি বলছো?

-আজ ওমেন্স ডে মানে নারী দিবস

উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলেন।বললাম….

-ওমেন্স ডে মানে মহিলা দিবস

-তাতে কি হবে শুনি?

-কিছু হবে না।আজ আমাদের মহিলাদের দিন তাই আপনিও মহিলা বলে আপনাকে …..ওই আর কি,আপনার একটা ছবি নিলাম

-এসব ঢং তোমরা করলে মানায়,আমরা কি আর মহিলা?

-এমা!সে কি কথা বলছেন,আপনি যে মহিলা সেটা কি আপনি জানেন না?

-না জানি না!আমরা হলাম মেয়েছেলে,মাগী।এই গুলোই আমাদের পাওয়া নাম।আমাদের আবার কোনো মহিলা দিন হয় নাকি?জন্মের পরে শুধু দেড় বছর আমাদের মেয়ে ভাবা হয় ।তারপর থেকেই ওই ছোট্ট বেলা থেকে নিজের থালা নিজে ধোয়া,আর ক’ বছর পর মার সাথে সাথে ভাতের হাঁড়ি ধরা,ভাই বোনদের খেতে দেওয়া,তারপর শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রাখা।শরীর একটু গতরে বাড়লে বিয়ে দেওয়া।কার সাথে বিয়ে দিচ্ছে,কি আমার ভবিষ্যৎ,ওসব কেউ ভাবে না।বিয়ে হলেই আবার বর বলে লোকটার সামনে ঘট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।সে কাপড় খুলে আমাদের শরীর ছিড়ে খাবে।আমরা কিন্তু মুখ খুলতে পারবো না।দুমাস পরে আমরা পোয়াতি হবো,সেই পেট নিয়েই আমরা সব কাজ করবো।তারপর গরু ছাগলের মতো আমাদেরর নিজের ঘরেই বাচ্চা হবে।আমাদের শরীরের সেই ব্যাথা ঠিক হতে না হতে,আমাদের বরের আবার আমাদের ওপর ভালোবাসা জাগবে।ওই সদ্য বাচ্চা রাতে মায়ের দুধের জন্য কাঁদবে কিন্তু সেই মেয়েছেলেকে তো তখন আবার ছিড়ে খাচ্ছে বর নামে জন্তুটা।চার বছরে কোলে একটা,হাতে একটা নিয়ে চাষ করতে যেতে হবে,ঘর লেপতে ,কাপড় ধুতে পুকুরে যেতে হবে, ভাত ফুটিয়ে খাইয়ে আবার ভাবতে হবে পরের দিন কি খাবো।মেয়েরা যখন পনেরো পেরিয়েছে তখন আবার বরের ভালোবাসা জেগেছে তখন মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় হচ্ছিল,এদিকে আমার কোলে তখন ছেলে।এই সবের মধ্যে তিনবার তো পেটেই বাচ্চা মরেও গেছে।তাই আমাদের কি আবার মহিলা দিন হয়?মহিলা! থুতু ফেলি এরকম জীবনে।বাচ্চা দিলেই মহিলা হয় না।মহিলা হলে তোমরা।আমরা হলাম মেয়েছেলে,মাগী।আমরা বেঁচে থাকি শুধু মরার অপেক্ষায়।যেদিন মরবো সেদিন আমরা আসলে বাঁচবো।আমাদের দিন কখনো বদলায় না,বদলাবেও না।তাই আমাদের মতো মেয়েছেলেদের সাথে এসব ঢং করো না,তোমাদের এসব দেখলে খুব রাগ হয়

সবাই চুপ।কিছু মুহূর্ত পরে শিউলি…..

-সেদিন নারী হওয়ার এক নগ্ন দিক দেখলাম,সত্যিই নিজের খুব লজ্জা লাগছিলো।আমি তো ভেবেছিলাম,ছবি তুলতে দেখে উনি খুব খুশি হবেন কিন্তু সত্যিই তো,তাদের জীবনে আনন্দের তো কিচ্ছু নেই।কিন্তু দ্যাখ ওরাও তো নারী,আমরাও নারী।কিন্তু ভাগ্যের দোষে ওরা অন্ধকারেই জন্মায় আবার অন্ধকারেই মরে যায়

কথা বলতে বলতেই সৈকত এসে চুপ করে বসে সব শুনেছিল।মিঠি বলে উঠলো….

-ওই মহিলা কোথায় থাকে জানিস?

-হ্যা, ওই তো আমাদের ওদিকেই।আমাদের গ্রামে না

মিঠি- আচ্ছা,ওই মহিলাকে যদি খুঁজে বের করি?বরুণ-তাতে কি হবে?

মিঠি- এবারের নারী দিবসে যদি ওনাকে একটু আনন্দ দিয়ে আসি

বরুণ-তোর মাথাটা পুরো গেছে।ওনাকে আনন্দ দিয়ে কি তুই পুণ্য করবি?

মিঠি-শিউলি তুই বল

শিউলি-না রে ,সে সব করার দরকার নেই।এরকম তো কত কত মহিলা আছে যারা কত কষ্ট করে বাঁচে আমরা তাঁদের কথা জানতেও পারিনা।আমরা নারী দিবসে পার্টি করে দশ হাজার টাকা খরচ করার কথা ভাবি আর কোথাও একজন নারী তার সারাজীবনে দশ হাজার টাকা চোখেও দেখতে পায়  না।বরং চল এবার একটু অন্য রকম নারী দিবস করি

মিঠি-সেটা কি রকম?

শিউলি-এটায় অবশ্য বরুণ আর সৈকতের সাহায্য লাগবে

সৈকত-হুকুম করুন ম্যাডাম

পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ করা হলো। না! অনেক বড় কিছু নয়,অনেক দূরের কিছু না,কোনো অসাধ্য কিছু না।কলেজের বাইরে রাস্তার ঠিক ওপারে একটা রিক্সা স্ট্যান্ড আছে। ওই রিক্সা স্ট্যান্ডের সামনে কতবার মিঠিরা অটোর জন্য অপেক্ষা করছে,বন্ধুরা মিলে হৈচৈ করেছে।তাই কয়েকজন রিক্সা ওয়ালার সাথে মুখ চেনাও আছে তাঁদের।সেখানের দশজনকে একটা করে প্যাকেট দেওয়া হলো,ঠিক নারী দিবসের আগের দিন।প্যাকেটে ছিল একটা ছাপার শাড়ি,লাল টিপের পাতা আর একটা ছোট আয়না।বলা হলো পরের দিন নারী দিবস,ওরা যেন এটা ওদের বৌদের দেয়।চার পাঁচ জন পেয়ে খুব খুশি হলো,তিনজন তো নিতেই চাইছিল না।দুজনের কোনো অভিব্যক্তিই ছিল না।শিউলি মিঠিদের বলেছিল,নারীরা নারীদের জন্য নারী দিবসে করবে এটা তো সাধারণ ব্যাপার।কিন্তু নারী দিবসে নারীরা পুরুষদের মাধ্যমে নারীদের জন্য কিছু করবে,এটাই স্পেশাল।যদিও যখন রিক্সা ওয়ালারা বৌদের ওগুলো দিয়ে মহিলা দিবসের উপহার বলবে সেই সুন্দর মুহূর্তটা  মিঠিরা দেখতে পাবে না।কিন্তু শিউলির বক্তব্য কারোর জন্য করতে ইচ্ছে করলে অনেক দূরে গিয়ে কিছু করতে হয় না,নিজের আশে পাশের মানুষদের জন্যও করা যায়।

আজ নারী দিবস।দশ হাজার টাকা দিয়ে এবারে মিঠিদের পার্টি করা আর হলো না।যদিও তাতে বরুনদের মনে বেশ আফসোস ছিল,তবে মিঠির কোনো দুঃখ ছিল না,কারণ বাবার থেকে টাকা নেওয়া মিঠির বাঁ হাতের খেল।তবে মিলি ,বরুণ,শিউলি,সৈকত মিঠির বেঁচে যাওয়া সামান্য টাকার সাথে নিজেরা একটু টাকা জুড়ে ঠিক করেছে দুপুরে সবাই একসাথে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবে।তবে তার আগে হবে আড্ডা।সবাই কলেজের সামনেই দেখা করলো।বাইরের সিঁড়িতে বসে সবাই আড্ডা মারছে।হঠাৎ একটা আট ন’বছরের বাচ্চা মেয়ে মিলিদের সামনে এসে মিলির দিকে একটা ফুল বাড়িয়ে দিলো।মিলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো…..

-কি রে,এটা আমার?

-হ্যা

-তুই আমাকে চিনিস?

-না

আরো দুটো ফুল মিঠি আর শিউলির দিকে বাড়িয়ে দিল।শিউলি ফুলটা নিয়ে বললো….

-খুব সুন্দর ফুল,থ্যাংক ইউ।তুই আমাদের ফুল দিচ্ছিস কেন রে?

-বাবা বলেছে আজ মেয়েদের দিন

শিউলি-তোর বাবা!মানে কোথায় তোর বাবা?

মেয়েটা রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে-ওই যে

মিঠিরা তাকিয়ে দেখে হাসি মুখে এক রিক্সা ওয়ালা তার বউয়ের সাথে রাস্তা পাড় হয়ে মিঠিদের দিকেই আসছে।মিঠিরা কিছু বলার আগেই রিক্সা ওয়ালার বউ কাছে এসে মিঠিদের দিকে হাত জোড় করে বললো…..

-এই দেখো দিদিরা,আমি তোমাদের দেওয়া নতুন শাড়ি পরেছি।আমরা তো এই সব মেয়ে দিন,ছেলে দিন জানি না।তোমাদের জন্য বর এই প্রথম এরকম প্যাকেট করে শুধু আমার জন্য জিনিস নিয়ে গেছে।এই আমার মেয়ে।তোমাদের কি দেবো ভাবছিলাম,মেয়েই বললো ফুল দেবে।আশীর্বাদ করো দিদিরা,আমার মেয়েকে পড়াশুনা শিখিয়ে যেন তোমাদের মতো বানাতে পারি

শিউলি-হ্যা হ্যা, ও পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে

রিক্সা ওয়ালার বউ-না দিদি,অনেক বড় হতে হবে না,শুধু যেন তোমাদের মতো হয় আর ও যেন তোমাদের মতো এরকম কিছু করে মেয়েদের নাম,মেয়েদের দিনটা সার্থক করে

মিঠি- করবে করবে…..কি রে করবি তো?

রিক্সা ওয়ালার মেয়ে-করবো, মা জানে না তাই মেয়ে দিন বলছে,আমার স্কুলের দিদিমণি বলেছে আজ হলো নারী দিবস।

কাজরী মজুমদার। লেখক। জন্ম ও ভিটেমাটি ভারতের কলকাতায়। বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থলের সূত্রে দিল্লিতে বসবাস। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও সামাজিক বিষয়ে সরল ভাষায় লেখালিখি করেন। তিনি বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এছাড়া বিভিন্ন ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..